৪
সোফিয়া এল। কিন্তু সে সোফিয়া নয়। এ যেন আলাদা মানুষ। পেশোয়াজ পায়জামা নয়—ঘাঘরা কাঁচুলী ওড়না নয়, নাকে হীরার নাকচাবি নাই—কপালে টিকলী নাই। কানে দুল মাকড়ি নাই, গলায় চিক নাই। হার নাই। হাতে বাজুবন্ধ, কঙ্কণ নাই, সাদামাটা হিন্দুস্তানী ঢঙে লালপাড় শাড়ী পরে এসেছে, গায়ে মুসলমানী কাঁচুলী আছে; চুলে বেণী নাই, চুল এলানো এবং বেশ ভাল করে আঁচড়ানোও নয়। চোখে সুরমা আছে, মুখে পান জর্দাও আছে। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে সোফিয়ার তা এক নজরেই বোঝা যায়।
ঘরে ঢুকেই সে শয্যার আধশোয়া অবস্থায় বীরেশ্বর রায়কে দেখে কয়েক মুহূর্ত যেন স্তম্ভিতের মত দাঁড়িয়েছিল। সে বিশ্বাস করতে পারেনি নিজের চোখকে। তসলিম জানাতেও ভুলে গিয়েছিল।
ভবানী দেবী তাকে আহ্বান করে বলেছিলেন—এস।
সোফিয়া বলেছিল—রুস্তমের মত বাবুজীর এমন হাল হয়ে গেছে!
ঘরখানা ছিল নিস্তব্ধ। সোফিয়া মৃদুস্বরে বললেও—বীরেশ্বর শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি একটু হেসে বলেছিলেন—দুনিয়া ভর একটিই হাল সোফি। সব কুছ বদল যাতা হ্যায়। সোফি বিবি ভি বদল গয়ি হ্যায়।
এতক্ষণে সে তসলিম জানিয়ে বলেছিল—হাঁ হুজুর-ই বাত ঠিক হ্যায়।
বীরেশ্বর বলেছিলেন–এঁকে চিনতে পারছ?
—হাঁ হুজুর। হুজুরাইনকে আমি দেখবামাত্র পহছান লিয়া! ওঁর পরওয়ানা পেয়েই আমি এসেছি। পরওয়ানা না পেলেও দেখলেই আমি চিনতে পারতাম। উ তসবীর? ওই তো।
সে ভবানী দেবীকে বার বার তসলিম জানিয়েছিল।
ভবানী দেবী একখানা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—বসো।
—আপ খড়ি হ্যায়। আগে আপনার তশরিফ রাখতে হুকুম হোক।
—আমাকে বসতে হবে?
—জরুর। না-হলে আমি বসতে পারি? আমি তওয়ায়েফ-নবাব বাদশা আমীর লোকের পরসতার থাকত—আমি তাও নই। আপনি হুজুরাইন। আগে আপনি বসুন।।
রত্নেশ্বর রায় তখন পাশের পুজোর ঘরে স্তম্ভিত বিস্ময়ে পত্র দুখানা পড়ে যাচ্ছেন। ভবানী দেবী লিখেছেন—মৃতবৎসা রোগাক্রান্তা বিমলা নিজের মৃত্যুরোগাতুর ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে নিস্তব্ধ ঘুমন্ত পুরীর মধ্যে নিজের ঘরের দরজা খুলে, বেরিয়ে এসে ভবানী দেবীর ঘরে ঢুকেছেন। ঘরে তখন বীরেশ্বর রায় বোনের সাড়া পেয়ে কোণে আলমারির আড়ালে লুকিয়েছেন। ভবানী দেবী ঘুমের ভান করে পড়ে আছেন। বিমলা নিজের ছেলেকে শুইয়ে রেখে রত্নেশ্বরকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেলেন।
রত্নেশ্বর কমলাকান্ত হয়ে গেলেন।
ধীরে ধীরে কমলাকান্ত বড় হয়ে দেখতে হল বিমলাকান্তের মতো। মাথা তাঁর ঝিম্ ঝম্ করছে।
হ্যাঁ, মুখের চিবুকের গড়ন, কপালের গড়ন, লম্বা ঢঙ-এ বিমলাকান্তের মতই বটে। শুধু নাকের ডগা এবং চোখের দৃষ্টি তাঁর বীরেশ্বর রায়ের মত। সারা দেহের কাঠামো তাঁর রায় বংশের মোটামোটা হাড় এবং শক্ত গাঁথুনিতে গাঁথা। রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন, সুলতা—“আমার মনে হইতে লাগিল—যেন সমস্ত ভূমণ্ডল থর-থর করিয়া কম্পিত হইতেছে। আকাশমণ্ডল হইতে নক্ষত্ৰসমূহ কক্ষচ্যুত হইয়া দিগ-দিগন্তরে ছুটা-ছুটি করিয়া কোথায় হারাইয়া যাইতেছে। আমি দিবা না রাত্রি বুঝিতে পারিতেছি না। ইহা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য সম্যক উপলব্ধি হইতেছে না। কখনো ক্রোধ হইতেছে এতকাল যাঁহাকে মাতা বলিয়া জানিতাম সেই বিমলা দেবীর উপর। আমার মাতৃবক্ষ হইতে তিনি আমাকে কাড়িয়া লইয়াছেন। কখনো ক্রোধ হইতেছে আমার প্রকৃত পিতামাতার উপর। আমাকে তাঁহারা কাড়িয়া লইতে দিলেন। চক্ষে দেখিয়াও নীরব রহিলেন!
“এতদিনে বুঝিতে পারিতেছি, আমাকে-আমার পিতা বলিয়া যাঁহাকে জানিতাম তিনি—কেন বিমলা দেবীর একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ করিতে দিতেন না। আমাকে বলিতেন ইহা তাঁহার ইচ্ছাক্রমেই হইতেছে। তাঁহার মৃত্যুর সময় তিনি বলিয়াছিলেন-আমার শ্রাদ্ধ তুমি করিবে। কমলাকান্তকে করিতে দিবে না। তাহাতে তাহার অমঙ্গল হইবে। আমার উপনয়নের সময় নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ করিতে বসিয়া পিতামহ মাতামহ প্রভৃতির নাম তিনি মনে মনে বলিয়াছিলেন।
“কারণ এতদিনে বুঝিলাম। এতদিনে সব বুঝিলাম।”
সে তিনি পূর্ণ তিন পৃষ্ঠা লিখেছেন।
সুরেশ্বর বললে—হবারই কথা। এ তো সাধারণ ঘটনা নয়। এ তো একটা এত বড় গাছ—তাকে শেকড়সুদ্ধ তুলে নদীর এক তীর থেকে আর এক তীরে এনে নতুন করে লাগানোর মত ব্যাপার। গাছ হলে বাঁচত না। মানুষ বলেই সম্ভবপর হয়েছে।
সুলতা বললে—রাগ করো না, একটা কথা বলব। আমি সোস্যালিস্ট বলে বলছি না। বলছি একেবারে সাধারণ মানুষ হিসেবে। ব্যাপারটা যদি একটু ইতর-বিশেষ হত-ধর― যদি তাঁর আসল বাপ-মা রায়বাড়ীর আশ্রিত দরিদ্র দম্পতি হতেন এবং তারপর এতটা বয়সে—এই সত্য জানিয়ে তাঁর বাপ-মা তাঁকে নিজের ছেলে বলে দাবী করতেন—তা হ’লে এটা তাঁর সহ্য হত কিনা সন্দেহ।
সুরেশ্বর বললে—রাগ সত্যি করব না সুলতা। খুব খাঁটি কথা বলেছ। সংসারে বিমলাকান্তের মত মানুষ দু-চারজনের বেশী হয় না—যাঁরা সব স্বার্থ অনায়াসে ত্যাগ করে দুঃখকে মাথায় তুলে নিতে পারেন। রত্নেশ্বর রায় তা ছিলেন না। বিমলাকান্তের শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর রক্ত তাঁর মধ্যে ছিল না। সামলে নিতে তাঁর বেশিক্ষণ লাগে নি। তিনি এরই মধ্যে এঘরে সোফিয়া বাঈয়ের সঙ্গে বীরেশ্বর রায়ের যে কথা হচ্ছিল তা শুনে মনে রেখেছিলেন। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। এ সত্য আমি অস্বীকার করব না। তবে চরিত্রেও তিনি খুব শক্ত মানুষ ছিলেন—অত্যন্ত শক্ত। আমার মনে হয়েছে, তন্ত্রসাধনা যদি সত্য হয় তা হলে শ্যামাকান্ত যা পারেন নি, তা তিনি পারতেন। প্রখর বুদ্ধিজীবী। তন্ত্র সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা বলব পরে। বলব কেন, ডায়রী থেকে পড়ে শোনাব।
সোফি বাঈ পাগলাবাবার কোন খবর দিতে পারেন নি।—তিনি অকস্মাৎ একদিন বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি।
সোফি বলেছিল—বাবুজী হুজুর, আপনি যেদিন বাবাসাহেবকে জখম করে দিয়ে চলে এলেন, উসকে বাদ-পুরা ছ মাহিনা—উনি মুর্দার মত পড়ে থাকতেন। না খানা, না পিনা, একদম মুংগা—বোবার মত। কভি কভি—আঁ-আঁ—এমনি করে পুকারতেন।
কারুকে দেখে শান্ত হতেন না। সোফি এলে তবে শান্ত হতেন। ওদিকে বাজারময় খবরটা রটেছিল—হিন্দু সিদ্ধযোগীকে মুসলমান করে নিচ্ছে মুসলমান বাঈ। একদিকে মোল্লারা লেগেছিল উঠে পড়ে। তার সঙ্গে সোফি বাঈয়ের মায়েরও উৎসাহের সীমা ছিল না। অন্যদিকে হিন্দুরা ক্ষেপে উঠেছিল।
—বাবুজী, এই সময়ে মিউটিনির হাঙ্গামা না হলে হয়তো একটা ‘খারাপ’ কিছু ঘটে যেত। আমরা, বাবুজী, বহুবাজার থেকে চলে গিয়েছিলাম; বড়া মসজেদের কাছাকাছি। পাগলাবাবার তবিয়ৎ এমন বেহাল হয়ে গেল যে, আমরা ভাবলাম—মরে যাবে। আমার মা চাইলে—উনকে বাহার রাস্তার পর ছেড়ে দিতে। কিন্তু আমি দিই নি। এক রোজ রাতে বাবুজী, সকলে ভাবলাম আজ রাতে ফকীর জরুর মরে যাবে। মাকে উ রোজ কিছুতেই রুখতে পারলাম না-ঘরসে বাহার বারেন্দেমে নিকাল দিলে। আমিও, বাবুজী, ওই বারান্দায় এসে তার শিয়রে বসে রইলাম। থোড়া পানি যদি মরবার সময় খেতে চেয়ে না পায় তবে তার চেয়ে গুনা আর হয় না। জাড়ার রাত বাবুজী। তার গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে, নিজে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাধুর ঠোঁট নড়ছিল হরদম, যেন কিছু বলছিল। কিন্তু আওয়াজ ছিল না। আমার কাছে কস্তুরী ছিল—আর কিছু দাওয়াই ছিল—মকরধ্বজ আমি থোড়া থোড়া মুখে দিয়েছিলাম।
এমনি সমস্ত রাত বাবুজী। শেষ রাতে আমার থোড়া নিদ এসেছিল। ওদিকে বড়া মসজিদে আজান উঠল। আর তার পরই সাধুজী যেন পুকারে উঠল—মা!—ধরা গলায় খুব ঠান্ডা আওয়াজে বললে—মা!
আমি চমকে উঠে ঝুঁকে পড়ে ডাকলাম —বাবাসাহেব!
বাবাসাহেব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল বাবুজী। সে কী কান্না কি বলব! সে যেন দরিয়াতে তুফান উঠে গেল!
.
সেই দিন থেকে সাধুজীর ওই হাল কাটল—আবার একটু একটু করে ভাল হয়ে উঠল। আমি হকিম ডেকে দেখালাম। হকিম তাজ্জব বনে গেল। বললে-এ বেঁচে উঠল কি ক’রে? তাজ্জব কি বাত!
বেঁচে সাধুজী উঠল বাবুজী, লেকিন দুসরা আদমী হয়ে গেল। বহুৎ চুপ-চাপ। যেন পাগল আর নয়।
আমাকে বললেন—বেটী, আমার যা কুছ সঙ্গীতকে মূলধন আছে—তোকে দিয়ে দি, নিয়ে লে। তবে এক বাত আমাকে দে। এই বাত দে কি কসবীগিরি আর করবি না। এই গানা গেয়ে খাবি। আর রোজ সুবাতে উঠে ভজন করবি।
বাবুজী, গলার আওয়াজ উনকে খারাব হয়ে গিয়েছিল। ভাঙা তানপুরার মত। তবু আমাকে ভাঙা গলায় গান উনি শেখালেন।
ওদিকে বাবুজী, আমার মা মোল্লাদের নিয়ে মতলব করলে কি উনকে কলমা পড়াবে। আমাদের বদনামি হচ্ছিল—কি আমরা সাধুজীর সঙ্গে থেকে হিন্দু বনে গিয়েছি।
বাবাসাহেব সমঝালেন। এক রোজ আমাকে বললেন—আমি চল যায়েগা বেটী। ধরম সব কুছ এক হ্যায়। লেকিন যো সাধন আমার উ তো আবি তক পুরা হুয়া নেহি। অব হামকো যানে হোগা। তু হামাকে নিকাল দে হিয়াসে। হম চলা যাই।
একটু চুপ করে সোফিয়া বলেছিল- লেকিন বাবুজী, উনকে বচানে নেহি সেকা হম। বাঁচাতে পারি নি বাবুজী—আমার আম্মাজান আর মোল্লারা মিলে তাঁকে জোর করে কলমা পড়িয়েছিল।
আমি তার পায়ে ধরে কেঁদেছিলাম—কিন্তু তিনি বলেছিলাম—কেঁদো না সোফি। আমার জাত নেই। ধুবড়ীর কাছে আমি মুসলমান বাড়ীতে ছিলাম—তারা খুব ভক্তি করত। তাদের ঘরেই খেয়েছি। থেকেছি। জাত আমার নেই। জাত কারুর যায় না। তবে এ আমার নসীব। জলদি জলদি তু আমার যা দেবার তু নিয়ে নে। আমি চলে যাব।
দু মাহিনা পরে বাবাসাহেব চলে গেলেন। কোথায় গেলেন বলে যান নি।
.
পাশের ঘরে বসে সব শুনছিলেন রত্নেশ্বর রায়। তাঁর ঘৃণার আর অন্ত ছিল না। শ্যামাকান্ত ভট্টাচার্য সম্পর্কে যেখানে কথা উল্লেখ করেছেন—সেখানেই তাঁর ঘৃণা ক্রোধ যেন উপচে পড়েছে।
তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, সুলতা—“আমার ইচ্ছা হয় আমার দেহ চিরিয়া শ্যামাকান্তের যে রক্ত আমার মধ্যে আছে-তাহা নির্গত করিয়া দিই। কিন্তু তাহা মানুষের পক্ষে তো সম্ভবপর নয়। কিন্তু এ পাপ-রক্তের প্রভাব হইতে আমারই পরিত্রাণ কোথায়? কি করিয়া জগতে আত্মরক্ষা করিব তাহার কুল-কিনারা দেখিতেছি না।”
সোফিয়া আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার জন্য উঠেছিল। যাবার আগে কয়েকটা কথা হয়েছিল—সেই কথা কটি শুনে রত্নেশ্বর বেশী বিচলিত হয়েছিলেন। ভবানী দেবী বলেছিলেন—ডেকে পাঠালে আবার আসবে তো?
তসলিম জানিয়ে সোফি বলেছিল—আমি হুজুরের বাঁদী। যখন ডাকবেন আসব।
—তাঁর খবর পেলে জানাবে?
—খবর? জরুর জানাব। তবে—গোস্তাকিমাফ হলে বলি—
—বল।
—খবর আপনার কাছে আসবে।
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ভবানী দেবী।
—আপনার জন্যে বাবাসাহেব কাঁদতেন।
—আমার জন্যে?
—হ্যাঁ। বোধ হয় তিনি আপনাকেই খুঁজছেন।
এতক্ষণে বীরেশ্বর বললেন-তোমাকে তিনি কী বলেছিলেন, বল।
—বলেছিলেন—হু জু রা ই ন—তাঁর বেটী! পহলে দিন—উনার তসবীর দেখে—ওহি লিয়ে তিনি এমন চীৎকার করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন..হুজুরাইনের মায়ের তসবীর। কিন্তু হুজুরাইনের ছটা আঙুল-তাঁর ছটা আঙুল ছিল না। আর বলতেন—ওঁর সঙ্গে দেখা না হলে তাঁর গুণাহর শেষ হবে না। বলতেন—হুজুর তিনি ঝুটা বাত কখনো বলতেন না। বলতেন—সোফি তুমি আমাকে বল বাবাসাহেব, আমি তোমাকে বলি বেটী! তবু কভি কভি দিলের মধ্যে তুফান উঠে যায়। আমার অন্দরে এক শয়তান আছে—সে বলে—কেন? দুনিয়াতে ও হল ঔরৎ আর তুমি হলে মর্দানা। কেঁ ও বাপ বেটী কেঁ ও। তার টুটি টিপে ধরি। বলি—মর যা—তু মর যা! কিন্তু সে মরে না। ডরকে মারে লুকিয়ে যায়। আবার সুবিস্তা পেলেই বেরিয়ে আসে। ইস—সে রেহাই আমার সেই বেটী দিতে পারে। রায়বাবু বলেছে- সে মরে নি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে—বলতে পারো ও কোথায় আছে? সে বেঁচে আছে। আমাকে তাকে খুঁজতে হবে। তার দেখা পেলেই, আমার অন্দরের শয়তান মরবে। আমাকে বেটীর মত পিয়ার করতেন! আমার আম্মা এর জন্য নারাজ ছিলেন। আমাকে একলা পেলে বলতেন এসব কথা। এসব বাত তোকে বেটী বলে বলছি সোফি। আর কাকে বলব? তুই যদি পারিস তো রায়বাবুকে বলিস। দোসরা কাউকে বলিসনে। বলিস—আমি তার কাছে মাপ চাচ্ছি। তবে আমার বেটী—সে সাক্সাত দেবী।
কথাগুলি শুনে চমকে উঠেছিলেন—রত্নেশ্বর। সন্দেহ তাঁর গোড়া থেকেই হচ্ছিল যে, যে তান্ত্রিক পাগলাবাবার কথা হচ্ছে, এর সঙ্গে শ্যামাকান্তের সংস্রব আছে। সোফিয়া যখন প্রথম আসে তখন তিনি সন্দেহ করেছিলেন বীরেশ্বর রায়ের লালসাকে। তারপর চিঠি দুখানা পড়ে তাঁর এই পরিচিত চেনা পৃথিবী চুরমার হয়ে গেল, তিনি ভাবছিলেন এই বিচিত্র কথা আর শুনছিলেন সোফিয়া বাঈয়ের কথা। প্রায় নিঃসন্দেহই হয়েছিলেন যে, সোফিয়া বিবি যে পাগলাবাবার কথা বলছে, সেই হয়তো শ্যামাকান্ত। এবং বীরেশ্বর রায় ও ভবানী দেবী এই প্রয়োজনেই সোফিয়াকে ডেকেছেন। শেষ কথা কটিতে তিনি নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন। এই হতভাগ্য ধর্মত্যাগী নারীলোলুপ তান্ত্রিকই শ্যামাকান্ত। তাঁর মাতামহ
কয়েক মুহূর্তে ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। অনেক ভেবেছিলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে ভবানী দেবীকে ডেকে বলেছিলেন—ভালো-মা! ভালো-মা!
ভবানী তখন দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে সোফিয়াকে বিদায় দিচ্ছেন। তিনি ফিরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—রত্ন?
—ওঁকে একটু দাঁড়াতে বল মা।
—দাঁড়াতে বলব?
—হ্যাঁ। বলেই নিজে এগিয়ে গিয়ে সোফিয়াকে সেলাম করে বলেছিলেন- মাতাজী, মেহেরবানী করে যদি একটু অপেক্ষা করেন। একটু!
সোফিয়া তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল সেই বিয়ের আসরের বীরেশ্বর রায় হুজুরকে।
—আমার কয়েকটা কথা আছে আপনার সঙ্গে।
সোফিয়া এবার বলেছিল—সাহেবজাদা, তুমি মাতাজী বলে আমাকে সালাম জানালে। বেটা, তোমার উপর আল্লাহতলার মেহেরবানী বর্যাক। বল বেটা কী বলছ?
—একটু বসতে হবে।
ফিরে এসে বসেছিল সোফিয়া। রত্নেশ্বর বলেছিলেন—আমার বাবুজীর এই বেমার। তা ছাড়া আমার বাবুজীকে তো আপনি জানেন-আমীর মানুষ। গানা-বাজনা ওঁর দিলের পিয়ারা চীজ। আপনি ওঁকে দিনের পর দিন গান শুনিয়েছেন। খুশী রেখেছেন। এখন উনি একলা পড়ে থাকেন। মেজাজ দিল ঠিক থাকে না। তা আপনার কাছে আমার আর্জি আপনি যদি—যেমন ওঁকে গান শোনাতেন দিল খুশ রাখতেন—তেমনি ভাবে প্রতিদিন আসেন-থোড়া কুছ গান শোনান—তা হলে বড় ভাল হয়। আমি মাতাজীর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব। আর আপনি আমার মাতাজীর সমান—আপনি আজ বেকার হয়ে কে কবে মজলিশে গানা বাজানার জন্যে ডাকবে তার জন্যে তাকিয়ে থাকবেন—এতে আমাদের ইজ্জতও যায়। যা তনখা আপনার মিলত—তাই মিলবে। পাল্কী যাবে। নিয়ে আসবে আপনাকে। আমি আপনার জন্যে মোকাম ঠিক করে দেব। সেই মোকামে থাকবেন। দারোয়ান ভি থাকবে—কাউকে দিক করতে দেবে না!
তাঁর কথা শুনে সোফিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল তাঁর মুখের দিকে। ভবানী দেবী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বলতেও কিছু পারেন নি সোফিয়ার সামনে। নিজের কানকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সোফিয়ার কথা কাশী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। সে সময় মধ্যে মধ্যে রত্নেশ্বর যে সব কথা বলত, তা মনে করে আজকের এই কথার অর্থবোধ তাঁর হয় নি। আজই সোফিয়া এই ঘরে আসবার ঠিক আগেই সে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছে—“ভালো-মা, এইসব অনাচার, এ আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি একে পাপ মনে করছ না?” সেই রত্নেশ্বর এ-কি বলছে?
বীরেশ্বর রায় শুনেই যাচ্ছিলেন, একটি কথাও বলেন নি।
রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন—“পিতৃদেব নীরবে সমস্ত শ্রবণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমান। তিনি আমার মনের কথা যথার্থ অনুমান করিলেন এবং কহিলেন—তুমি উত্তম কহিয়াছ। সোফির নিকট আমি ঋণী রহিয়াছি। সম্ভবত তাহার গান আমাকে পাগল হওয়া হইতে রক্ষা করিয়াছে। আজ প্রয়োজন ফুরাইয়াছে বলিয়া তাহাকে বিদায় করিলে অন্যায় হইবে। এবং জীবনে গীত-বাদ্যের আনন্দের প্রয়োজন আছে। আজ সোফিকে দশজনের মজলিশে গান করিয়া বাঁচিতে হইলে তাহাও এ বাটীর পক্ষে অপমানজনক। সোফি, তুমি বাবুজীর কথা রাখিলে আমি খুবই খুশি হইব। কোন অনুশোচনা থাকিবে না। তোমারও জীবনে সাধু-সংস্পর্শে পরিবর্তন হইয়াছে। নিত্য বা মধ্যে মধ্যে আসিয়া ভজন শুনাইবে—উচ্চাঙ্গের গীত শুনাইবে। ইহা আমারও বাসনা।” ভবানী দেবীকে বোধ করি কোন ইঙ্গিতও করে থাকবেন। তিনিও বলেছিলেন—আমিও খুব খুশী হব সোফিয়া।
সোফিয়া একটু অভিভূত হয়েছিল। সত্যই শুধু গানবাজনার উপর নির্ভর করার জন্য তার আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। চোখে জল এসেছিল তার, সে কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছে বলেছিল—হুজুরাইন যখন বলেছেন তখন তাই হবে। হুজুরাইন বলেছেন—বাবাসাহেব ছোটা হুজুর বলেছেন—আমি কি তা অমান্য করতে পারি? যেমন বলবেন, তেমনই হবে।
ভবানী দেবী অন্যরকম বুঝেছিলেন। তিনি সোজা অর্থেই ধরেছিলেন —বীরেশ্বর রায় যা বলেছেন তাই। আজ সোফিয়াকে অর্থের জন্য কষ্ট পেতে হচ্ছে, সুতরাং রায়বাড়ী থেকে মাসোহারার ব্যবস্থা করলে রত্নেশ্বর। বাপের জমিদারী আমীরী ইজ্জত বজায় রাখলে। কিন্তু তাঁর ভুল ভাঙল। সোফিয়া চলে যেতেই বীরেশ্বর রায় রত্নেশ্বর রায়কে বলেছিলেন—তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে আমি খুব খুশি হলাম রত্নেশ্বর। ভালই করেছ। কথাটা আমার মনেও হচ্ছিল। কিন্তু তোমার মাকে না জানিয়ে, না বুঝিয়ে কথাটা বলিনি।
রত্নেশ্বর স্থিরদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—কথাটা প্রকাশ পেলে রায় বংশের কলঙ্কের আর বাকী থাকবে না।
এবার চমকে উঠেছিলেন ভবানী দেবী। বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের মন। তিনি বলেছিলেন —আবার চাপা দিবি রত্নেশ্বর? একবার চাপা দিয়ে—
বাধা দিয়ে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—হ্যাঁ মা, চাপা দিতে হবে। এমন কি এরপর রায়-বংশেরও আর কেউ যেন জানতে না পারে-তার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি তো আজ বারো বছর চাপা দিয়ে এসেছ মা। তুমি তো ওঁকে জানাতে পারো নি। সাধারণ ঘর হ’লে হতো মা। রায়বাড়ী তো তা নয়! কথাটা প্রকাশ পেলে ওই গোপাল সিংয়ের মত লোক দেশময় মুখে মুখে বে-ইজ্জত করে বেড়াবে। মহাভারতের যুগ এটা নয়। তাই বা বলছি কেন? কর্ণের কথাটা ভেবে দেখো।—সারাটা জীবন সূতপুত্র পরিচয়েই থেকে গেলেন—কোনোদিন মাকে মা বলতে পেলেন না। মা কুন্তি—তিনি ও ছেলেকে ছেলে বলতে পারেন নি। কর্ণের মৃত্যুর পর ছেলেদের বলেছিলেন—কর্ণের তর্পণ করো, উনি তোমাদের বড় ভাই। আজ তাও চলবে না। চাপা দিতেই হবে। উনি মুসলমান হয়েছিলেন—এপ্রকাশ পেলে রায়বাড়ীর ছেলেমেয়ের বড় ঘরে বিয়ে হবে না।
এছাড়া এর নজীর রায় বংশে তখন সোমেশ্বর রায় স্থাপিত করে গেছেন। যে লোকটা জলমগ্ন পাগলাবাবার সন্ধান করতে গিয়ে ফেরে নি—সে বাঘের পেটে যায় নি—তাকে সরিয়ে ফেলেছিলেন সোমেশ্বর। কারণ, লোকটা কেঁদেছিল।
***
যাক, পাগলাবাবার কথা বলি।
এর ছ মাস পরে একখানা চিঠি এসেছিল নবদ্বীপ থেকে। শ্যামাকান্ত রায়ের শেষ পত্র। নবদ্বীপের ‘পোড়া মা’ তলায় শ্যামাকান্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন। সোফিয়ার বাড়ী থেকে চলে গিয়ে ওই ‘পোড়া মা’ তলায় পথের ধারে একটা গাছতলায় বাসা বেঁধে জীবনের শেষ ক’দিনে তিনি কী সাধনা করেছিলেন, তা তিনি বলতে পারেন। সাধনার ক্রিয়াকর্ম কেউ কিছু দেখে নি। তবে ওই আধপাগলের মত মানুষটি বসে থাকতেন। কেউ দিলে খেতেন, না দিলে খেতেন না। মাত্র ভোরে একবার তাঁকে গঙ্গার ঘাটে দেখতে পেতো। ঘাট থেকে স্নান করে ফিরতেন। গঙ্গার ঘাটে যাওয়া কেউ বড় একটা দেখে নি।
যে লোক চিঠি নিয়ে এসেছিল—সে সাধারণ সামান্য লোক। চিঠি দিয়ে বলেছিল—আজ্ঞে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। না গেলে হয়তো দেখা হবে না।
সুরেশ্বর বললে-চিঠিখানার কথা বলেছি তোমাকে সুলতা। সাধারণ সুস্থ মানুষের লেখা বলেই মনে হয়।
তিনি তখনো সুস্থও হয়েছিলেন। চিঠিখানা পড়ে মনে হয় তিনি যেন ভবানী দেবীর ফেরার কথাও জানতেন।
তখন বিমলাকান্ত কলকাতায় এসেছেন। কাশীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছেন। সম্পত্তি তিনি গ্রহণ করেন নি; তবে টাকা তিনি কয়েক হাজার নিয়েছেন। টাকাটা বিমলা দেবীর নামে বিষয়ে খাটছিল। কলকাতায় স্বতন্ত্র বাসা করেছেন। তিনি গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে নিয়ে যান নি।
গিয়েছিলেন ওঁরা পাঁচজন। বীরেশ্বর রায়, ভবানী দেবী, বিমলাকান্ত, মহেশচন্দ্র আর সোফিয়া রত্নেশ্বর রায় যান নি। যাবার তাঁর উপায় ছিল না। তিনি তখন মামলার আসামী। রাধানগরে দে-সরকারের বাড়ীতে ডাকাত পড়েছিল। ডাকাতেরা টাকা-কড়ি বিশেষ নিতে পারে নি, তবে দে-সরকারকে নির্মমভাবে মারধর করে ডান হাতখানা ভেঙে দিয়েছে, আর বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কুঠিয়াল জন রবিনসন তখন নেই। সে খুন হয়েছে—তার নিজের লোকের হাতে।—একজন ফিরিঙ্গী এসে তার কাছে চাকরি নিয়েছিল। দুর্ধর্ষ দুর্দান্ত লোক, রবিনসন সাহেবের নামডাক শুনে এসেছিল। ইংরেজ ফিরিঙ্গী নয়। পর্তুগীজ ফিরিঙ্গী।
তখন শ্যামনগরের প্রজাদের জোট জমাট বেঁধেছে। তারা ধর্মঘট পেতে দে সরকারদের খাজনা বন্ধ করেছে। রবিনসন সাহেবের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করছে। একেবারে সোজা আইন-আদালতের পথ। তার জন্য তদ্বির-তদারক মামলা পরিচালনা করছে কীর্তিহাটের এস্টেটের কর্মচারীরা। বিমলাকান্তের বাড়ীতে বিমলাকান্তের নামের আড়ালে তাদের সেরেস্তা বসেছে। পাইক-লাঠিয়াল আছে। বিচক্ষণ মামলাবাজ গোমস্তা আছে। ওদিকে হুগলীতে একটা বাড়ী কিনে সেখানে আর এক দফা সেরেস্তা। সেখানে একজন নীলকুঠীর পুরানো কর্মচারীকে মাসিক পঁচিশ টাকা মাইনেতে বহাল করা হয়েছে। হুগলীর সব থেকে বড় উকীলকে নিযুক্ত করা আছে। সাব-ডিভিশন আরামবাগে আর এক দফা সেরেস্তা।
এসব হয়েছে দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্যের পাতা ছক অনুযায়ী। তবে খেলে যাচ্ছেন রত্নেশ্বর রায়।
পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আচার্য বলেন- মার খেয়ে যাও ভাই। কিস্তি দিক, তুমি ঢেকে দিয়ে চল। সময় হলে উঠকিস্তি, পরকিস্তি একসঙ্গে হবে।
দে সরকারদের বাকী খাজনার মামলা চলছে; মামলার সমন আসছে কিন্তু জারী হচ্ছে না। প্রজাকে পায় না। বাড়ীতে লটকে জারী করবে তার সাক্ষী মেলে না। তারপর সমন জারী হলে নানান বিচিত্র আপত্তি পড়ছে। সিধে সরল বাকী খাজনার মামলা—চলছে তো চলছেই। অবশেষে ডিক্রী হচ্ছে। ওদিকে মুন্সেফকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সদরে আপীল হচ্ছে। সমস্ত যুগলপুর লাটে শ-পাঁচেক জমা।
সুরেশ্বর বললে—জমা বুঝতে পারছ সুলতা?
হেসে সুলতা বললে—টেনেন্সি বলছ তো! তা জানি।
—হ্যাঁ টেনেন্সি জান, তা জানি, কিন্তু ওর এদেশী নাম জমা। তাই বলছি। এই ধরো না সন-তারিখের মত। আজ কোন্ তারিখ কোন্ সাল জিজ্ঞাসা করলে আমিও বলব, তুমিও বলবে—আজ পঁচিশে নভেম্বর নাইন্টিন ফিফটি-থ্রি, বাংলা সনটি যদি বা সাত বছর যোগ করে, ছ’শো বছর বাদ দিয়ে তেরশো ষাট সালের হদিস করতে পারি, তবু তারিখটা কোনমতেই বলতে পারব না। জমা বলতে ক্রেডিট কথাটাই মনে পড়বে।
—মেনে নিলাম। এখন বল রত্নেশ্বর রায়ের কথাটা বল। রত্নেশ্বর রায় জমিদারীতে বসেই ফৌজদারী মামলার আসামী কেন হলেন, সেইটেই আমার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। তুমি বলেছিলে রত্নেশ্বর রায় রায়বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তিনি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদাকে খুন করিয়েছিলেন। আবার বলছ—জমিদারী গদিতে ছ’মাস বসতে না বসতে ফৌজদারী মামলার আসামী হলেন, সুতরাং শ্রেষ্ঠ পুরুষের সংজ্ঞাটির জন্য কৌতূহলের আমার শেষ নেই।
সুরেশ্বর বললে-হ্যাঁ সুলতা, আমার বিচারে তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ রায়বংশে। বীরেশ্বর রায় পথনির্দেশ করছেন, আচার্য দেওয়ান তাঁর পাশে পাশে চলেছেন, শেখাচ্ছেন লড়তে হবে, লড়াই ছাড়া রাজত্ব চলে না। এবং লড়তে হলে লড়বে শক্তের সঙ্গে, সবলের সঙ্গে। তাতে যেমন চাই শক্তি এবং সাহস, তেমনি চাই বুদ্ধি এবং কৌশল। একটা কথা এই সঙ্গে বলে নিই-বীরেশ্বর রায় যে পালোয়ান রেখেছিলেন, তার সঙ্গে তাঁর হুকুমে রত্নেশ্বর রায়কে কুস্তি করতে হয়, প্যাঁচ শিখতে হয়। ঘোড়ায় চড়তে হয়।
ওই প্রথম দিনই যে হজরৎপুরের পিদ্রুজ একজন পর্তুগীজ ফিরিঙ্গীকে নিয়ে এসেছিল, সেই লোকটা পিদ্রুজের কাজিন। কস্টেলো পিদ্রুজ, গোয়ার লোক। মধ্যে মধ্যে কলকাতায় আসত। থাকত। এই লোকই রবিনসনের কাছে গিয়ে কাজ নিয়েছিল। কিছুদিন সাহেবের হুকুম তালিম করে সাহেবের সঙ্গে শিকার খেলে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল তার। হঠাৎ তার কাছে এল হজরতপুরের পিদ্রুজ, একটি মেয়েকে নিয়ে। ফিরিঙ্গী মেয়ে—কটা চোখ, কটা চুল, কটা রঙ এবং খানিকটা বর্বরা। হজরতপুরের পিদ্রুজের সৎবোন; গোয়ার ফিরিঙ্গী পিদ্রুজের বাগদত্তা বধু। নাম তার মাথা।
এ সবটাই সুকৌশলে সাজানো বাঘশিকারের ‘বেট’-এর মত। বাঘ ঠিক এল, শিকারীর লক্ষ্য অব্যর্থ, বাঘ ম’ল।
রবিনসন একদিন ফিরিঙ্গী পিদ্রুজের অনুপস্থিতিতে মার্থার ঘরে ঢুকল। মার্থা চিৎকার করলে। তার সঙ্গে লড়াই করলে। অথচ সে-ই তাকে ইশারায় ডেকেছিল। পিদ্রুজ ছুটে এল। লাফ দিয়ে পড়ল রবিনসনের ঘাড়ে, এবং তাকে শেষ করে দিয়ে চলে গেল মার্থাকে নিয়ে; গঙ্গায় নৌকা ভাসিয়ে।
পুলিশের হুলিয়া হ’ল—মার্থাকে তারা পেল, কিন্তু ফিরিঙ্গী পিদ্রুজকে পাওয়া গেল না।
পর্তুগালে যাওয়ার জাহাজের টিকিট কেনার দাম খরচ পড়ে আছে রায়বাড়ীর খাতায়। একটা মোটা টাকাও খরচ পাওয়া যায় দাতব্য খাতে। কাকে কি বৃত্তান্ত তা লেখা নেই
এটা ঘটল তিন মাসের মাথায়। মার্থা জবানবন্দী দিলে। সাহেব পিদ্রুজের অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে তার উপর পাশবিক অত্যাচার করতে চেষ্টা করেছিল, সে চীৎকার করে উঠেছিল। কস্টেলো পিদ্রুজ কোথায় ছিল—সে ছুটে এসে সাহেবকে আক্রমণ করে। সাহেবও তাকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু পিদ্রুজ গোড়াতেই পড়েছিল তার ঘাড়ে। সে তাকে ছুরি মেরে তাকে অর্থাৎ মার্থাকে নিয়ে পালায়। শ্যামনগর থেকে কলকাতা। কলকাতায় মার্থাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই সে যে কোথায় চলে গেছে মার্থা তা জানে না।
মার্থার পক্ষে বড় কাউন্সিল নিযুক্ত করেছিল হজরতপুরের পিদ্রুজ। ব্যাপারটা সাদা চামড়া আর কটা চামড়ায় বলে খুব বেশিদুর এগোয় নি। মাথার কাউন্সিলও ছিল একজন খাস বিলিতী সাহেব। রবিনসনের ইতিহাসটাও নারী-সম্পর্কিত ব্যাপারে খুব পরিচ্ছন্ন ছিল না। এর আগে একটা ব্রাত্য নারীহত্যার অভিযোগ হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। মামলাতে তার কিছু হয় নি। কিন্তু প্রথম কুঠী তার ফেল পড়েছিল এইজন্যে। সুতরাং কোনক্রমেই রায়বাড়ীর জমা-খরচের খাতা পর্যন্ত হাত বাড়িয়ে হাতড়াতে পুলিশের মনে হয় নি।
তাছাড়া রায়বাড়ীর হাতে আর একটা জোরালো প্রমাণ ছিল রবিনসনের বিরুদ্ধে ধার বাবদ বিশ হাজার টাকার একটা ডিক্রী। যেটা উত্তরাধিকারী অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্রহীন রবিনসনের মৃত্যুতে প্রায় দিকভ্রান্ত হয়েছিল জারীর পথে। রবিনসনের উত্তরাধিকারী স্থির হওয়া না পর্যন্ত ডিক্রী জারী স্থগিত রাখতে হয়েছিল। মৃতের উপর জারী হবে ডিক্রী, নয় তার উত্তরাধিকারীর উপর। সুতরাং রবিনসনের মৃত্যুতে রায়বাড়ীর সমূহ ক্ষতি। তবে তা দেখাতে হয় নি। বলেছি তো এ-পথেই হাঁটে নি পুলিশ।
তারপরই মাসখানেক পর দে সরকারদের বাড়ীতে ডাকাত পড়ে, মারধর করে তার ঘর জ্বালিয়ে দিলে। দে-সরকারের ডান হাতখানা মুচড়ে ভেঙে দিলে। জ্বলন্ত মশালের বাড়ি মেরে সারা মুখখানা ছিঁচকে পোড়া করে দিয়ে গেল।
দে-সরকার এজাহারে পুলিশের কাছে বললেন—তিনি দেখেছেন কমলাকান্ত ভট্চাযকে, একটু দূরে বাড়ীর ফটকের সামনে তাকে ঘোড়ার উপর দেখেছেন।
সুরেশ্বর বললে—সব দেশের জমিদারীতেই বোধ হয় আছে। তবে বাংলাদেশের জমিদারীর ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা অনেকগুলিই আছে। দু-একটা ঘটনা গল্প হয়ে আজও চলিত আছে মুখে-মুখে। জমিদারী চালনায় এগুলি সে-আমলের সিংহকীর্তি। অন্তত, তাই লোকে বলত, সমাজে মানত।
মুসলমান আমলে কাজী ছিল, বিচারও ছিল, কিন্তু ইংরেজের ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোড ছিল না। প্রজার কাছে খাজনা আদায়ের জন্য হপতম পঞ্চম আইন করেছিল কোম্পানী কিন্তু ক্রমে ক্রমে জমিদারদের মুখে পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের আট-ঘোড়ার গাড়ীতে ক্রিমিন্যাল আইনের কাঁটা-লাগানো লাগাম পড়ীয়ে দস্তুরমত পোষা আরবী ঘোড়ায় পরিণত করেছিল। হপ্তম পঞ্চম তুলে দিয়ে সিভিল স্যুটের মুন্সেফী আদালত দেখিয়ে দিয়েছিল। এবং ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোড চালু করে জমিদার- প্রজাকে এক গোয়ালে পুরেছিল। তবু তারা এই কাঁটা-লাগাম ছিঁড়ে দুর্দান্তপনা করেছে ইচ্ছামত।
একটা ঘটনার কথা বলি—হেস্টিংস সাহেবের প্রিয়পাত্র কান্ত প্রথমে হলেন বাবু, তারপর রাজা। বহু লক্ষ টাকা আয়। কান্তবাবুর চতুর্থ পুরুষ কৃষ্ণনাথ। নাবালক অবস্থায় মালিক হয়েছিলেন বিষয়ের। স্টেট গিয়েছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডসে। কৃষ্ণনাথকে খাসা ইংরিজী শিখিয়ে কোর্ট অব ওয়ার্ডস তাঁকে রাজার মেজাজ তৈরী করে দিয়েছিলেন। প্রচুর মদ্য, হৈ-হল্লা, ইয়ার-বন্ধু, কুকুর-বন্দুক-পিস্তল এসব দিয়ে রাজত্বের খেলাঘর সাজিয়ে দিতে কসুর করেন নি। তার সঙ্গে রাজোচিত পোশাক এবং ডেকরেশন। তরুণ কৃষ্ণনাথ দিলদরিয়া লোক, তেমনি মেজাজ। একবার বাড়িতে যাত্রাগান হচ্ছে। উনি অবশ্য দেখছিলেন না। উনি বাইরের প্রমোদভবনে ছিলেন। সেখান থেকে রিটায়ারিং টাইমে অন্দরে যাচ্ছেন। সঙ্গে চোপদার চলেছে, মশালচী চলেছে। যাবার পথ ওই আসরের পাশ দিয়ে। আসরে তখন নারদমুনি হরিগুণগান করছেন। রাজার রঙদার চোখে সাদা চুল-দাড়ি পরা মুনিকে খুব ভাল লাগল। চোপদারকে জিজ্ঞাসা করলেন—কৌন হ্যায় উয়ো?
চোপদার বললে—নারদমুনি হুজুর!
—নারদমুনি? আচ্ছা। উ তো আচ্ছা আদমী হ্যায়। বলে ঘুরলেন। কুর্শি আনিয়ে সব লোকের সামনে বসলেন এবং হুকুম করলেন—আউর এক নারদমুনি লাও!
অধিকারী সন্ত্রস্ত, ছুটে সাজঘরে গিয়ে আর একজনকে পাকা চুল-দাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসরে নামালেন।
হুকুম-আউর লাও। আউর লাও।
শেষ পর্যন্ত দশ-বারোজন লোক—মেয়েদের চুলে সফেদা মাখিয়ে সাদা করে পরিয়ে আসরে এনে নামিয়ে দিলে। রাজা খুব খুশি হয়ে একশো টাকা ইনাম দিয়ে চলে গেলেন।
এই কৃষ্ণনাথের হাতের হাজার পাঁচেক টাকা দামের আংটি চুরি গেল, সন্দেহ হল চাকরের উপর। সুতরাং তাকে শাস্তি দিলেন। কিন্তু ভুলে গেলেন ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোড অনুযায়ী ও-অধিকার তাঁর নেই। এমন প্রহার করলেন যে, চাকরটা মরে গেল।
বহরমপুরের এস ডি ও খুশি ছিলেন না মহারাজ কৃষ্ণনাথের উপর। লোকটিও ছিলেন গণ্যমান্য বংশের। কিন্তু সে খাতির কৃষ্ণনাথ করতেন না। তিনি ওয়ারেন্ট বের করলেন; কৃষ্ণনাথ তার আগে কলকাতা পালালেন। কিন্তু কোম্পানীর রাজত্বে কলকাতা তার কেল্লা নয়। মুসলমান আমলে রাজাদের মাটির কেল্লাগুলোর পাঁচিল আর ফটক সব ভেঙে দিয়েছে কোম্পানী। কলকাতাতে কোম্পানীর খাস ডেরা। কোথায় যাবেন? কৃষ্ণনাথ যে-খেলনাটা পেয়েছিলেন কোম্পানীর কাছে—পিস্তল—গ্রেপ্তারের ভয়ে সেই পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
তবু বাংলা দেশের জমিদারেরা হটেন নি। সুচতুর ভাবে আইনের সুঁচের সূতোর ছিদ্র দিয়ে উটে চড়ে পার হয়ে যেতেন।
রবিনসনের পর দে সরকার। গোপাল সিংয়ের পর্ব শুরু হয়ে গেছে তখন। মামলা-মোকদ্দমা চলছে তখন। বাঘ-নেকড়ে মারার পথ আর ইঁদুর ধরা কি মারার পথ এক নয়। দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্যের একখানা পত্র আছে। তিনি রবিনসনের মৃত্যুর পর কীর্তিহাট থেকে লিখেছিলেন কলকাতায়। লিখেছিলেন বীরেশ্বর রায়কে। আচার্য বীরেশ্বর রায় এবং রত্নেশ্বরকে কলকাতায় রেখে চলে এসেছিলেন কীর্তিহাট। হজরতপুরের পিদ্রুস মারফৎ ওই কস্টেলো পিদ্রুসকে তিনিই নৌকো করে হজরতপুর পর্যন্ত এনে নামিয়ে দিয়েছিলেন। কস্টেলো ওখান থেকেই ফিরে গিয়ে উঠেছিল শ্যামনগরে। চাকরি নিয়েছিল রবিনসনের। কস্টেলো পিদ্রুস উধাও হয়ে গেল তার কাজ সেরে, খবর পেয়ে দেওয়ান জানালেন—“যে পাপ-বৃক্ষটির কাণ্ড কায়স্থ এবং তস্য শাখা ফিরিঙ্গী, তাহার শাখাটি ছেদিত হইয়াছে। অতঃপর কাণ্ডটির ব্যবস্থা হইতেছে। এই বৃক্ষে ছত্রী মুষিকটি আশ্রয় লইয়াছে, এক্ষণে তাহাকে গর্তে আশ্রয় লইতে হইবে। চিন্তা করিবেন না, সকল ব্যবস্থাই হইতেছে। তবে এক্ষণে বাবু রত্নেশ্বর ভায়াজীবনকে লইয়া এখানে আসা প্রয়োজন। ইস্কুল-পত্তনের যে আয়োজন হইতেছে, ওই আয়োজনে খোদ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে এখানে আনয়ন করিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হউক। তাহাতে বিশেষ সুফল ফলিবে বলিয়া মনে করি। আমি উক্ত রাত্রেই কাণ্ড ছেদন করাইব।”
***