২
পরদিন কমলাকান্ত সাহেবের সঙ্গে কথামত দেখা করতে গিয়ে তাই বলে এল এবং ঝগড়া করেই চলে এল।
জন রবিনসন তাঁকে বলল—ওয়েল ইয়ং ম্যান, আমি তোমার অর্ধেক জমি নীলচাষ থেকে রেহাই দেব। নট অল। দে সরকার জমিদার বললে—তোমাদের ল্যান্ডই হল বেস্ট ল্যান্ড। ওল্ড রায়বাবু ইয়োর ম্যাটারন্যাল গ্র্যান্ডফাদার, ভেরি শুড ম্যান, সে সান-ইন-ল’র জন্যে বেছে বেছে বেস্ট ল্যান্ড কিনেছিল। হাফ ছেড়ে দেব আমি।
মনে মনে তেতে উঠেছিলেন কমলাকান্ত। কিন্তু নিজের কথা বাদ দিয়ে বলেছিলেন—বাট হোয়াট অ্যাবাউট আদার পি? অন্য সব লোকেদের কি হবে? আমি আমার জন্যে কিছু বলব না, অন্যদেরও অর্ধেক জমি ছেড়ে দাও। সকলের ভালো জমিতে তুমি জবরদস্তি নীল লাগাতে বাধ্য করছ। তা করলে তো হবে না।
চমকে উঠেছিল জন রবিনসন।
দেশে তখন নীলকরের অত্যাচার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। হরিশ মুখার্জি বলে একজন নেটিভ খুব কড়া কড়া কথা লিখছে। এখানে লেফ্টন্যান্ট-গভর্নর গভর্নর-জেনারেলের কাছে দরখাস্ত করছে। ছেলেটা সেই সুরে কথা বলছে। শহর থেকে এসেছে ইংরিজী-জানা ইয়ং ম্যান। জন রবিনসন চমকে উঠল। তার উপর ছেলেটা বীরেশ্বর রায়ের ভাগ্নে। কীর্তিহাটের অর্ধেক অংশের মালিক। এর আওয়াজ তো ব্ল্যাঙ্ক কার্টিজের আওয়াজ নয়।
জন রবিনসন চমকে উঠে বলেছিল—হোয়াট?
—অন্য লোকেদের কি হবে?
জন রবিনসন বলেছিল—আই সী, ভয় দেখাচ্ছ আমাকে?
—নো। বলছি—এ মহা অন্যায় করছ তুমি। অত্যাচার করছ। এটা না করে অর্ধেক জমি ওদেরও ছেড়ে দাও। ওদের ফেলে আমি তোমার এই অনুগ্রহের অর্ধেক ছেড়ে দেওয়া-এ আমি নেব না।
জন রবিনসন হাসি থামিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল-হুঁ! I see. You are a chela of Harish Mukherjee.
কমলাকান্তের প্রকৃতিও উগ্র ছিল, তিনি ভয় পাননি, বলেছিলেন—No, I am not anybody’s chela.
–Then what are you? Who taught you all these things?
—আমি কীর্তিহাটের রায়বাড়ির অর্ধেকের মালিক। যে সোমেশ্বর রায়ের টাকাতেই তোমার বাপ ব্যবসা করেছিল, মাসে মাসে সুদ গুনতে তোমরা, তিনি আমার মাতামহ। I know all these things.
রবিনসন রেগে উঠে দাঁড়িয়েছিল।—You say so?
—Yes, I say so. কীর্তিহাটের এলাকায় তোমার কুঠী আছে। এস্টেটের টাকা সব শোধ হয়েছে কিনা জানি না। হরিশ মুখার্জির চেলা নই আমি।
জন রবিনসন চিৎকার করে বলেছিল- বোয়, হামারা চাবুক লে আও।
মুহূর্তে কমলাকান্তও উঠে দাঁড়িয়ে লাফ দিয়ে নেমেছিলেন জমিতে এবং দ্রুতপদে চলে এসেছিলেন। রবিনসন হা-হা শব্দে হাসতে লেগেছিল।
গ্রামে ফিরে সে-গ্রামের সকলকে ডেকেছিলেন এবং রবিনসনের সঙ্গে লড়াইয়ের বীজ পত্তন করেছিলেন সেইদিনই।
সুরেশ্বর বললে—এখানে একটা কথা বলি সুলতা। সেটা হল- বামুন, বদ্যি আর কায়স্থ এই তিনটে জাত সেকালে জমিদারী সেরেস্তায় বড় খারাপ জাত ছিল। তার সঙ্গে মুসলমান। সহজে এরা বশ মানত না। রাজা-জমিদার এদের হজম করতে পারে নি। তার সঙ্গে ছত্রী। তবে বাংলাদেশে তারা খুব কম। জমিদারীর বাজারে যে সব মৌজায় এই তিন জাতের বেশী বাস, সে-সব গ্রামের দর কিছু সস্তা। শ্যামনগর সেই ধরনের গ্রাম। ঠাকুর-মিঞাদের জমিদারী যেদিন দে-সরকাররা কেনে, সেদিন এঁরা ঢাক বাজিয়ে পুজো দিয়েছিলেন সর্বরক্ষেতলায়। দে-সরকার যেদিন সুদের দাবী করেছিল, সেদিন গ্রামসুদ্ধ চড়াও হয়েছিল দে-সরকারের নতুন জমিদারী-কাছারীর আটচালায়।
কমলাকান্তকে পেয়ে এরা কোমরে বল পেয়েছিল। বিশেষ করে কমলাকান্ত যে দম্ভ করে বলে এসেছে—আমি কীর্তিহাটের এস্টেটের আট আনার মালিক, তাতে ভরসা পেয়ে তাদের মনের আগুনের উপরে পড়া ছাই উড়ে গিয়ে নতুন করে গনগনিয়ে উঠেছিল। সুতরাং বিবাদটা পাকতে দেরী হয় নি।
পথ একটা স্থির হয়েছিল, তাতে জমিদারের সঙ্গে লড়াই শুরু হল আগে। দে-সরকার রবিনসনকে ডেকে এনে বসিয়েছে; সে-ই এখন টাকা দিচ্ছে, সুতরাং মূলে আঘাত দেওয়া হল আগে। ওদিকে রবিনসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কমলাকান্ত তাঁর নতুন শেখা ইংরিজীবিদ্যায় ফলাও করে দরখাস্ত করলেন হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট থেকে কমিশনার, লাটসাহেব পর্যন্ত। ওদিকে দে-সরকারদের সঙ্গে ধর্মঘট করে খাজনা দেওয়া বন্ধ করা হল।
দে-সরকারের বাড়ী রাধানগর-সেখানে অধিকাংশই কায়স্থ, কায়স্থেরাও চুলবুল করতে লাগল, কিন্তু দে-সরকার সুকৌশলে ব্যাপারটাকে কায়স্থদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ এবং অপর জাতের জোট বেঁধে, জাত নিয়ে ঝগড়ায় পরিণত করেছিলেন। ফলে কায়স্থেরা যোগ দিতে ইচ্ছে থাকতেও সরে রইল।
সুরেশ্বর বললে—জাত নিয়ে ঝগড়া যে কি, তা তো তোমাকে বোঝাতে হবে না। এ দেশটাই হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ে ভাগ হয়ে গেল।
সুলতা বললে—ইয়োরোপে জু-কৃশ্চানের ঝগড়া, সার্ব-স্লাভের ঝগড়া অনেক উদাহরণ আছে, তুমি বল—কথাটা অবিশ্বাস করছি না। ব্রাহ্মদের সঙ্গে হিন্দুদের ঝগড়া নেই-নেই করেও থেকে গেছে। বাবা বলেছিলেন-সুরেশ্বর পিছিয়েছে বোধ হয়, তোকে বিয়ে করলে দেবোত্তরের সেবায়েৎ-স্বত্ব থেকে বঞ্চিত হবে বলে।
সুরেশ্বর বললে—চতুর দে সরকার এই জাতিতত্ত্বের চাল চালতে ভোলেন নি। রবিনসনের কুঠীতে অনেক কায়স্থের চাকরি করে দিয়েছিলেন। চতুর লোক ট্যারা দে সরকার। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও তুলেছিলেন—পথে-ঘাটে দেখা হলে বামুনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মুখে-বুকে ধুলো বুলোতে হবে এটা কি রকম? সেইটে আমি করিনে, সেই ওদের রাগ।
তবুও একটা দল বিরূপ ছিল, কিন্তু ধর্মঘটে যোগ দেয় নি।
শ্যামনগরে ব্রাহ্মণেরা সদগোপ এবং অন্যদের বারণ করেছিলেন—কোন কায়স্থকে দেখে মাথা হেঁট করবিনে। খবরদার!
ঠাকুরদাস পাল তাদের নেতা, কমলাকান্তের চেয়ে বয়সে বড় হয়েও অনুগত লক্ষ্মণ সে হরিধ্বনি দিয়ে বলেছিল—হরি হরি ভাই!
সোৎসাহে হরিধ্বনিও উঠেছিল। ঠিক এই সময়ে এসেছিল বীরপুরের গোপাল সিং। গোপাল জানত বিমলাকান্তকে এবং কমলাকান্তকে তাড়িয়েছেন বীরেশ্বর রায়। চতুর বিষয়ী গোপাল সিং কমলাকান্তের আগমনবার্তা শুনেই এখানে এসেছিল, বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে লড়াইয়ে কমলাকান্তের মতো দুর্ভেদ্য ঢালের পশ্চাতে আশ্রয় নেবার জন্যে।
বিষয় হল মজার বস্তু, কমলাকান্তকে উত্তেজিত করে কোনরকমে খাড়া করতে পারলে বীরেশ্বরের ডান হাতখানাই ভেঙে দিতে পারবে।
কার্যকারণে ঘটনাও এই মুখে চলছিল। বীরেশ্বর রায়ের পাঠানো বজরা এল, লোক এল চিঠি নিয়ে, কমলাকান্ত চিঠির উত্তরে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে চিঠি লিখে বজরা ফিরিয়ে দিলেন। গোপাল উৎসাহিত হয়ে উঠল। তার কাজ ফতে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অতি উৎসাহে হঠাৎ একটা কথায় ঘটনার স্রোত ফিরে গেল। অতি চাতুর্যের সঙ্গে সে একই নিঃশ্বাসে কখনো জন রবিনসন এবং দে-সরকারদের সঙ্গে ঝগড়ায় কমলাকান্তকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে বসেছিল।—
সুরেশ্বর বললে রত্নেশ্বর রায় তাঁর ডায়রীতে লিখেছেন—
“গোপাল সিং লোকটি দুর্দান্ত সাহসী লোক। তাহার অসাধ্য কর্ম নাই। সে আমাকে ধর্মঘটে এবং রবিনসন সাহেবের সঙ্গে বিরোধে সাহায্য করিবার প্রতিশ্রুতি দিল এবং বলিল—আপনি বলেন বাবা সাহেব-স্রিফ বলেন, মামলা হ’লে টাকা খরচ করবেন—আমি উদের দেখে লিই। গোপাল সিংয়ের দল আছে বাবা, উ দল নিয়ে সে সব পারে। বিশু-বাবু ডাকাইতি করত, নীলকুঠী সে অনেক লুটেছে, সো বাবা হামিও পারে। স্রিফ বলেন-মামলাতে খরচ যোগাইবেন, বাস্, দিব শালা লুচ্চা আংরেজবাচ্চাকে–।
“দম্ভের উপর দত্ত স্থাপন করিয়া সে ডান হাতখানা তলোয়ারের মত চালাইয়া দিল। অতঃপর বলিল—টাকা বাবাসাহেবের ছালা ছালা গো! ওই মামা —আপনের মামা কংস মামা আছে গো! হাঁ, উস্কে হঠিয়ে দিন, আপনার সম্পত্তির ভাগ আউর টাকা লিয়ে লিন। আপনি তো রাজা গো। দেখবেন তখুন ই সাহেবটো আপনার পাশ টাকা লিয়ে যাবে আউর বলবে—ঘুট মর্নিং বাবুসাব, সেলাম বাজাইবে। হাঁ! ইখানে উ সাহেবের জবরদস্তি হামি রুখবে। ই বাত হামি দিলাম। আপনি মামলা করেন, আপনার সম্পত্তির ভাগের লিয়ে, ঢেঁরা পিটাইয়ে দিন তামাম তৌজিতে কি বীরেশ্বর রায়কে খাজনা দিবে তো হামি ও উশুল দিবে না। তাহার কথাগুলি চিন্তা করিয়া দেখিতেছি। সে সত্য কথাই বলিয়াছে। আমার এই অত্যাচারী নৃশংস মাতুলের হাত হইতে অন্তত আমার প্রাপ্য অংশ উদ্ধার করিতে হইবে। ইহা আমার কর্তব্য। ইহা ধর্ম। না করিলে আমি মনুষ্যপদবাচ্য হইতে পারি না। এবং রবিনসন ও দে সরকারদের অত্যাচার হইতে শ্যামনগরের অধিবাসীদের যদি বাঁচাইতে না পারি, তবেই বা আমি মনুষ্যপদবাচ্য কিসে?”
সুরেশ্বর বললে-এর পরই ঘটনার স্রোত বিচিত্রভাবে ঘুরে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় কমলাকান্তের বাড়ীতে গ্রামের লোকেদের জমায়েত হবার কথা। আগের দিন ষষ্ঠীপুজো ছিল। সেই পূর্বকাল থেকে ষষ্ঠীপুজো সর্বাগ্রে হয় ব্রাহ্মণদের। জমিদার ব্রাহ্মণ হলে এবং গ্রামের লোক হলে তাঁর পুজো ব্রাহ্মণদের মধ্যে আগে হয়। কিন্তু জমিদার ব্রাহ্মণ না হ’লে তাঁদের বাড়ীর মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়, ব্রাহ্মণ-গৃহিণীদের পূজা হ’লে তবে হয় তাঁদের পূজা। দে-সরকার জমিদারী কেনার পর প্রথম বৎসর এ নিয়ে একটা কাণ্ড হয়েছিল; ব্রাহ্মণ-গৃহিণী ও কন্যারা তাঁদের নাকঝাপটা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এটা দে সরকারকে মেনে নিতে হয়েছিল, উপায় ছিল না। এবার সকালবেলাতেই দে-সরকারের গোমস্তা শেখজী রবিনসন সাহেবের পাইক নিয়ে এসে ষষ্ঠীতলা ঘেরাও করে বসেছিল। এবং বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘিরে রেখে দে-সরকার এবং তাঁর আত্মীয়বন্ধু বাড়ীর মেয়েদের পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাউকে পুজো করতে দেয় নি।
কমলাকান্ত পর্যন্ত সেখানে গিয়েছিলেন প্রতিবাদ করতে। সঙ্গে ছিল ঠাকুরদাস এবং ছত্রী গোপাল সিং, আর ছিলেন একজন মাতব্বর ব্রাহ্মণ।
গোমস্তার সঙ্গে বাদানুবাদ কিছু হয় নি। কুঠীর লাঠিয়ালরা, সাহেবের চাকরেরাই মহড়া নিয়েছিল। তারাই বলেছিল—জমিদারের বাড়ীর পূজা হবে, তবে অন্যের পূজা হবে, তার আগে নয়। সাহেবের হুকুম আছে।
বিনা লাঠির জোরে তাদের হঠবার হুকুম ছিল না। হঠলেও বিপদ ছিল রবিনসন কুঠীয়ালের চাবুকের। কমলাকান্ত ভাবছিলেন, কিন্তু প্রবীণ ব্রাহ্মণেরা সব দিক বিবেচনা করে সরেই এসেছিলেন। সেইদিনই গোপাল সিং যে-বন্ধনে বেঁধেছিল কমলাকান্তকে, অতি উৎসাহে বেমক্কা টান দিয়ে কমলাকান্তকে চমকে দিলে; কমলাকান্তও ক্রুদ্ধ হয়ে টান মেরে বাঁধনটাকে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।
কমলাকান্ত বসে প্রতিকারের কথা ভাবছিলেন। গোটা গ্রামটাই আহত হয়েছে এ-অপমানে। যারাই আসছিল, বসছিল, তাদের সকলেরই ছিল এক কথা। জমিদার মাথার উপর পা দিচ্ছে, ধর্ম-সমাজ পর্যন্ত মানছে না।
তারই ভিতর থেকে কখন যে দে-সরকারদের কুৎসা আরম্ভ হয়েছিল কেউ বুঝতে পারে নি।
গোপাল তার মধ্যে ফোড়ন দিয়ে যাচ্ছিল, তার ফোড়নের উপকরণের সবটুকুই জমিদারের অত্যাচারের নামে বীরেশ্বর রায়ের কুৎসা।
দে-সরকারদের নিন্দা, তাদের অধর্ম-আচরণ, কৃপণতা, ছোট নজর থেকে দে-সরকারের ট্যারা-চোখে এসে উপস্থিত হল। তারপর তার পুত্রের গণ্ডমুর্খত্বের কথা। তার থেকে এল দে-সরকার-গৃহিণীর নাকের নথে; এরই মধ্যে কে বললে—সরকারের কন্যেটার ঢঙ দেখেছ! স্বামী ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তার জন্যে কোন দুঃখ আছে, খেদ আছে!
একজন বললে—ওরা তো বলে, মেয়ের ছেলে হ’ল না বলে জামাই বিয়ে করেছে, তাই দে-সরকার কন্যেকে বাড়ী এনে রেখেছে; বলেছে-মেয়ে আমার সতীন নিয়ে ঘর করবে না। কিন্তু আসল ব্যাপার তাড়িয়ে দিয়েছে। সে নাকি সাতখানা কাণ্ড।
কমলাকান্ত বলেছিলেন- থাক না ওসব কথা। ও নিয়ে আমাদের দরকার কি?
গোপাল বলে উঠেছিল—দরকার আছে বাবাসাহেব। আদালতে সরকারকে হাজির করতে পারলে ওই তো পরম্ বাণ। হামাদের উকীল জেরা করবে কি-তুমার বেটী ঘরে আছে কেন সরকারবাবু? আঁ? সরকার জরুর বলবে কি—বেটী হামার সতীন লিয়ে ঘর করবে না, তাই হিয়াঁ থাকে। উকীল দিবে এক ধমকঝুট্ বাহ্! ফলানা আদমীর সাথ আপনের বেটীর লটঘট হোয় নাই? সব গোলমাল হইয়ে যাবে সরকারবাবুর। হাঁ। উ সব বিলকুল খবর জোগাড় করো বাবা।
সকলে হেসে উঠেছিল। কমলাকান্ত তিক্ত হয়েও কথাটা ভেবে দেখেছিলেন।
গোপাল নিজের কথার জের টেনে বলে চলেছিল—হামি বাবা একদফে বীরেশ্বর রায়কে হাজির করাইয়ে ই জেরা তো জরুর করাই কি, রায়বাবু আদমী লোক বলে কি আপনে রাণীসাহেবা ভাগ গিয়েছে, কিসকে সাথ গিয়েছে আউর কাঁহা গিয়েছে? অ্যাঁ?
মুহূর্তে বিস্ফোরণ হয়ে গিয়েছিল। কমলাকান্ত চমকে উঠেছিলেন অসহ্য মর্ম-যন্ত্রণায়; কথা কটা যেন তাঁর বুকের ভিতরে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। মনে হ’ল গোপাল চিমটে দিয়ে জ্বলন্ত আংরা ধরে তাঁর বুকের ভিতরে টিপে ধরেছে।
—এ্যা-ও! বলে একটা বুকফাটানো হুঙ্কার আপনি তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এবং লাফ দিয়ে উঠে তিনি গোপালের গালে মেরেছিলেন প্রচণ্ড একটা চড়।
গোপাল চমকে উঠেছিল, সঙ্গে সঙ্গে গোটা মজলিশ। প্রথমটা কেউ বুঝতেও পারে নি এর মধ্যে হল কি? গোপাল হতভম্ব হয়ে কমলাকান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কমলাকান্ত বলেছিলেন—মুখ ভেঙে দেব তোমার। জিভটা ছিঁড়ে নেব!
এরপর যা হবার তাই ঘটল। কথা দু-চারটে আরো হয়েছিল, কিন্তু সে থাক। গোপাল নিজের পাগড়িটা যেটা কমলাকান্তের চড় মারার ঝটকায় পড়ে গিয়েছিল, কুড়িয়ে নিয়ে নীরবে হনহন করে চলে গিয়েছিল।
সেইদিনই আর একটা ঘটনা ঘটে গেল। সেটা সন্ধের সময়। কমলাকান্তের বাড়ীর দাওয়ায় গ্রামের মজলিশ বসেছিল। আলোচনা ওই আলোচনা। কমলাকান্ত হিন্দু পেট্রিয়টের হরিশ মুখার্জিকে পত্র লিখেছেন—রবিনসনের অত্যাচারের কথা জানিয়েছেন, তাই পড়ে শোনাচ্ছিলেন, এমন সময় জন তিন-চার চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে ছুটে এসে বললে-দে-সরকারের পাল্কি যাচ্ছে। তার ছেলে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ী। ষষ্ঠীতে যায় নি, আজ যাচ্ছে।
সমস্ত আসরটা মুহূর্তে একাগ্র ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। পাল্কী হাঁকিয়ে সদম্ভে চলে যাবে?
কমলাকান্ত বলেছিলেন—ক’জন চাপরাসী আছে রে?
—পাঁচজন-ছ’জন হবে।
—আর বেহারা আটজন নিয়ে তেরো-চৌদ্দজন।
চট করে ঠাকুরদাস উঠে এসে বলেছিল—তা থাক। তুমি হুকুম দাও, আমি ওর ছেলেকে পায়ে হাঁটিয়ে এখানে এনে দি!
—মারামারি করবি না?
—না-না-না। তিনসত্যি করছি। তুমি শুধু হুকুম দাও। দেখ না কি করি আমি!
–কোন অভদ্রতা করবি নে, শুধু পাল্কী থেকে নামিয়ে আনবি! দাঙ্গা করবি নে, সে হবে কি করে?
—দেখ না! গাঙের ঘাটের পাশের জঙ্গল থেকে বড়মেয়ার দুটি হাঁক ছাড়ব শুধু। বলেই সে ক’জন শাগরেদকে ইশারা দিয়ে ছুটে চলে গেল। পিছনে পিছনে জন-পনেরো শাকরেদ। ছুটে বেরিয়ে গেল। গোটা মজলিশটা মুহূর্তে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। এমনকি কমলাকান্তের সম্পর্কে দাদামশাই-বয়সে ষাট পার হয়েছেন—তিনি পর্যন্ত খি-খি শব্দে হেসে বলেছিলেন—তাহলে জলদি যা, জলদি! দেখ তো কেউ পাল্কী কত দূরে?
কমলাকান্ত ঠিক বুঝতে পারেন নি ব্যাপারটা। জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি বলুন তো?
—দেখ না নাতি, দেখ না! ঠাকুরদাস অনেক রকম পারে হে। দেখ না!
ইতিমধ্যেই দুরে পাল্কীর বেহারাদের ডাক শোনা যাচ্ছিল। ক্রমে আলোর ছটা বাড়ল, মশাল হাতে মশালচীর পিছনে দে-সরকারের ছেলের পাল্কী। সামনে পিছনে তিনজন-চারজন লাঠিধারী বরকন্দাজ। মাথায় লাল শালুর পাগড়ি। মজলিশটা স্তব্ধ হয়ে গেল। কমলাকান্তের মনে লেগেছিল। তাঁর ডায়রীতে তিনি লিখেছেন—“আমি কীর্তিহাটের রায় এস্টেটের মালিক, আমার তুলনায় এই ব্যক্তিটা একটা ক্ষুদ্র ব্যক্তি। সে এইভাবে লোক-লস্করসহ পাল্কী চাপিয়া চলিয়া গেল, আমি আমার অদৃষ্টকে ধিক্কার দিলাম। এবং মনে হইল, ইহার জন্য দায়ী বীরেশ্বর রায়, আমার মাতুল। এমন হিংসা, এমন জটিল চরিত্র-বিশিষ্ট মনুষ্য আমি দেখি নাই। আমাকে আমার অধিকার উদ্ধার করিতেই হইবে। এবং এই শ্যামনগর-রাধানগর- যুগলপুর লাট খরিদ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম।”
তখন আসরে চলেছে দে সরকারদের ভবিষ্যৎ ভবিতব্যের কথা। প্রবীণতম ভট্টাচার্য বলছেন—অতি দানে বলি বদ্ধঃ, অতি মানে চ কৌরবাঃ। অতি দর্পে হতা লঙ্কা, সর্বমত্যন্তগর্হিতম্। এই কায়স্থ কুলকজ্জলের তাই হয়েছে। একসঙ্গে অতিমান এবং অতিদর্প। এ সহ্য হবে না!
আঘাত তাঁদেরও লেগেছিল।
—সম্মুখে দেবস্থান, ব্রাহ্মণদের মজলিশ চলছে, একেবারে একটা সম্ভাষণ না করে চলে গেল! পাল্কী থেকে না নামিস, মুখ বাড়িয়ে দেবতাকে প্রণামটা তো করলে পারতিস!
হঠাৎ একটা প্রবল কোন্ জান্তব গর্জনে সব কথা বন্ধ হয়ে গেল, দু-চারজন চমকে ও উঠেছিল। পরক্ষণেই হেসেছিল সকলে। কমলাকান্তও চমকে উঠেছিলেন।
—কি? বাঘ?
সঙ্গে সঙ্গে আর একটা হুঙ্কার। ওদিকে কতকগুলো লোকের চিৎকার শোনা গেল।—বাঘ-বাঘ-বাঘ! সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রান্তেই বাঘ-তাড়ানো টিন বেজে উঠল।
বাঘ? এখানে বাঘ আছে। চিতাবাঘ। মধ্যে মধ্যে দু-একটা গেলেদা বাঘও এসে পড়ে, একথা রত্নেশ্বর শুনেছেন।
বুড়ো ভটচাজ হেসে উঠে বলেছিলেন- সাবাস, সাবাস, সাবাস! কমলাকান্তের এবার মনে হল ঠাকুরদাস উঠে যাবার সময় বলে গেছে ‘বড়মেয়া’র দুটি ডাক! তবে কি! তিনি বললেন-ঠাকুরদাস?
—হ্যাঁ। ফুটো হাঁড়ি-মালসায় মুখ ভরে অবিকল ডাকতে পারে। তবে আজকের ডাক মোক্ষম!
ঠিক সেই মুহূর্তে পাল্কীবেহারা চাপরাসী মশালচী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে মজলিশের মানুষগুলি দেখে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।
বৃদ্ধ ভটচাজ জিজ্ঞাসা করলেন-কি হল?
একজন সভয়ে বললে—বাঘ! ডোরা বাঘ, একবারে ঘাটের মুখে জঙ্গল থেকে হাঁকড়ে উঠল মশায়, জঙ্গল একেবারে ঝড়ে নড়ার মত নড়ে উঠল।
—বস বস বাবাসকল বস। একটু করে জল খাও। লাঠিগুলি রাখ। বাবু কোথায়?
একজন চাপরাসী বললে—বাবু ওই পালকির মধ্যে। কি হবে?
—হবে, বস। হচ্ছে।
ঠিক এই সময়েই দুরে ঠাকুরদাসের গলা পাওয়া গেল। সে হেঁকে বলছিল—দাদাঠাকুর! দাদাঠাকুর!
বলতে বলতেই দে-সরকারের ছেলেকে একরকম জড়িয়ে ধরে নিয়ে এসে হাজির হল। বললে—ওঃ, অ্যাই বড় বাঘ, একটু হলেই ঝাঁপ দিত। বাপ, হাঁকাড় কি? আমরা ওখানে ছিলাম। তা বেয়ারা-বরকন্দাজরা পাল্কী ফেলে চলে এল, বাবুমশায় দেখি পালকির মধ্যে প্রায় বেহুঁশ। বড়া খারাপি হয়ে গিয়েছে। কোনরকমে ওনাকে এই নিয়ে আসছি। ছোঁড়াগুলান হৈ-হৈ করে বাঘের পেছনে টিন বাজাচ্ছে। এই লেন। বসেন বাবুমশায়, বসেন। এক ঘটি জল দেন।
দে-সরকারের ছেলের পোশাক-পরিচ্ছদ ধুলোয় নষ্ট হয়েছে। ঠাকুরদাস তাকে পাল্কী থেকে বের করবার সময় সুকৌশলে মাটিতে একটা আছাড়ও খাইয়েছিল।
প্রবীণতম ভট্টাচার্য বলেছিলেন—বস বাবা, না, তার আগে ঘরে দেবতা রয়েছেন প্রণাম কর; ব্রাহ্মণেরা রয়েছেন, পায়ের ধুলো নাও। এ হল বাবা দেবতা ব্রাহ্মণকে অবহেলা উপেক্ষার ফল। কলিকাল হলেও এক পাদ ধর্ম তো এখনো আছে! এমন করে দেবতা ব্রাহ্মণকে ‘তুম কোন্ হ্যায়’ বলে চলে গেলে এমনি করেই হুঙ্কার দেয়। বাঘে দেয়, ভালুকে দেয়! কখনো কখনো বিনা মেঘে বাজও হাঁকড়ে ওঠে বাবা!
সুলতা হেসেছিল এবার। বলেছিল-সেকালের রসজ্ঞান তো বিচিত্র!
—সেকালটাই বিচিত্র ছিল সুলতা। সুরেশ্বর হাসলে। তবে একালেই কি আমরা কম যাই! কলকাতার একটা ইলেকশনে দেখেছিলাম প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের বাড়ীর সামনে একদল সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম করে বলছিল—অমুকচন্দ্র অমুক। আর দল সঙ্গে সঙ্গে একটা হাঁড়ি হাতে নিয়ে দুম করে ভেঙে দিচ্ছিল। অর্থাৎ নাম করলে হাঁড়ি ফাটে।
সুলতা হেসে বললে—জানি।
সুরেশ্বর বললে—ও কথা থাক। এখন শুনে যাও যা ঘটল। এই রসিকতার মাশুল কি দিতে হল, তাই বলি।
—দে-সরকারের ছেলে একটু স্থূলকায় কিন্তু জমিদার কায়স্থের ছেলে, তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি দেবতাকে এবং ব্রাহ্মণদের প্রণাম করে বলেছিলেন-আমি যাই এবার। এ উপকার মনে থাকবে আমার।
বেয়ারারা পাল্কীখানা আনতে গিয়ে সেটাকে পায় নি। সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে পথের উপর পড়েছিল। ঠাকুরদাস বলেছিল, তাহলে বাঘটা বোধ হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেঙে দিয়েছে।
এর পর বিনা বাক্যব্যয়ে পায়ে হেঁটে দে-সরকারের ছেলে বাড়ী ফিরে গিয়েছিলেন। কমলাকান্ত সারাক্ষণ চুপ করেই বসে ছিলেন। বিদায়ের সময় শুধু বলেছিলেন—আপনার বাবাকে বলবেন, আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার পিতা শ্রীবিমলাকান্ত তাঁর মহলে একটা জোত রাখেন বটে, কিন্তু আমি এখনো প্রজা নই আপনাদের। আমি কীর্তিহাটের আট আনা অংশের মালিক। আমিও জমিদার। বলবেন।
দে-সরকারের ছেলে চলে গিয়েছিল।
তার দশ দিন পর, রাত্রি তৃতীয় প্রহরে শ্যামনগরে আগুন লাগল। শ্যামনগরে তখন জোট বেশ জমাট বেঁধেছে। সকলে সাবধানে চলাফেরা করে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে পাহারা দেয়। দেখে জমিদারের বা রবিনসনের লোক আসছে কিনা। দু দিন পর অবশ্য দে-সরকারের ছেলে অনেক বরকন্দাজ সঙ্গে করে পাল্কী হাঁকিয়ে শ্বশুরবাড়ী গেছেন। সেদিন রাস্তার ধারে কেউ ছিল না। কিন্তু কোথায় কোন্ অন্তরাল থেকে ক্যানেস্তারা বাদ্য হয়েছিল। এই পর্যন্ত।
হঠাৎ দশ দিন পর তৃতীয় প্রহর রাত্রে যখন সব মানুষ একটা শেষরাত্রের ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন গ্রামে আগুন লাগল, সে আগুন একটা পরিকল্পনা করে লাগানো আগুন। যাকে আগুনের বেড়াজাল বলে তাই।
প্রায় সব কটি ঘরে একসঙ্গে আগুন লাগল। যেন কেউ কারও সাহায্যে যেতে না পারে এবং কমলাকান্তের কোঠাঘরের চার কোণে আগুন লাগল। এবং ঘরের দরজায় শিকল তুলে তালা দিয়েছিল একটা। কমলাকান্তের কাছে ঠাকুরদাস শুয়ে থাকত। ঠাকুরদাস কোঠাঘরের জানালা ভেঙে বের হবার পথ করেছিল। তখন মাথার উপরে চাল পুড়ে খসে পড়েছে ভিতরে। কমলাকান্ত উপুড় হয়ে পড়ে গেছেন। পিঠ তাঁর ঝলসে গেছে। ঠাকুরদাসই তাঁকে কোনরকমে টেনে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল নিচে। ওদিকে তখন ঠাকুরদাস পালের বাড়িতে তার স্ত্রী-পুত্র সকলে পোড়া চালের তলায় চাপা পড়েছে। তার বাড়িতেও ঠিক তালা শিকল লাগিয়ে চার কোণে আগুন লাগানো হয়েছিল।
আগুন লাগিয়েছিল গোপাল সিং। হুকুম ছিল রবিনসনের।
গোপাল সিং কমলাকান্তের কাছে চড় খেয়ে তা হজম করে নি। সে গোপাল সিং, তা সে করে না। সে শ্যামনগর থেকে চলে আসতে আসতে ফিরে গিয়েছিল কমলাকান্তের শত্রু রবিনসন এবং দে সরকারের কাছে। রবিনসন নিতান্ত ইতর ইংরেজ হলেও ইংরেজ, সে যা করবার নিজে সোজাসুজি করতে চেয়েছিল। কিন্তু চতুর দে-সরকার গোপাল সিংকে দেখিয়ে বলেছিল—গোপালকে ভার দাও সাহেব। তার থেকে জবরদস্ত লোক তোমার নেই। আর গোপালও তো তোমার কুঠীর কাজে ভর্তি হচ্ছে। দাও, ওকেই ভারটা দাও।
গোপালের দম্ভ স্ফীত হয়ে উঠেছিল এবং ধূমায়িত আক্রোশটাও বাতাস পেয়ে উঠেছিল জ্বলে। সে নিজে হাতে শোধ নেবে। সে বলেছিল—চুপ করে থাকেন সাহেব, ক’টা দিন চুপ করে থাকেন। আমি আমার সাকরেদদের নিয়ে আসি। দোহাই আপনের, কুচ্ছু করবেন না। আমি লাল ঘোড়ার চৌঘুড়ি হাঁকিয়ে দিব। আপনা কুটিকে বারেন্দেমে কুর্সী পর বইঠিয়ে আরামসে দেখবেন লাল ঘোড়াকে ঘৌড়দৌড়।
গোপাল হেঁকে বলেও গেছে। হামার নাম গোপাল সিং!
***
সওয়ার খবর নিয়ে ফিরে এল।
বীরেশ্বর সংবাদটা শুনে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন- বেঁচে আছে? তুম আপনা আঁখ সে দেখা?
—নেহি হুজুর। মুলাকাত আমার সঙ্গে হয় নি। চিঠিও ফিরিয়ে দিয়েছেন।
বীরেশ্বর রায় অকস্মাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ পর চেতনা হয়েছিল। কিন্তু চোখ লাল দৃষ্টি বিহ্বল। তার সঙ্গে বিকারের মত প্রলাপ।
মেদিনীপুর থেকে ইংরেজ ডাক্তারসাহেব এসেছিল। ডাক্তারসাহেব বলেছিল-ব্রেন কন্জেশন হয়েছে। যারা মদ খায়, তাদের হয়। আবার কোন মানসিক আঘাত থেকেও হয়। মনে হচ্ছে অবস্থা খারাপ। গিরীন্দ্র আচার্য মহল থেকে ফিরে এসেছেন খবর পেয়ে। তিনি এসেই সাহেব ডাক্তার আনিয়েছেন।
সাহেব ডাক্তারের কথা শুনে পরামর্শ করে রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন, গিরীন্দ্র আচার্য লোক পাঠালেন কমলাকান্তের কাছে। মাতুলের অবস্থা তাঁকে জানানো আবশ্যক। সেও অসুস্থ। তবু যেমন করে হোক তাঁর আসা আবশ্যক। বজরা তাঁরা পাঠান নি সাহস করে।
পাঁচ দিনের দিন একখানা ছিপ এসে লেগেছিল কাঁসাই-এর ঘাটে। নৌকা থেকে নেমে এসেছিলেন মহেশচন্দ্র এবং ভবানী।
লোকে প্রথমটা চিনতে পারে নি।
পারবে কেন? সাধারণ লোকে রায়বাড়ীর বধূ ভবানী দেবীকে দেখে নি। সেটা পর্দার যুগ। সুলতা, প্রৌঢ়া রানী কাত্যায়নীকে একটা চৌদ্দ বছরের ডোমেদের ছেলে অবাক-বিস্ময়ে গাছের উপর থেকে দেখছিল বলে তার কি শাস্তি হয়েছিল বলেছি। সেই যুগ। তার উপর বধূ ভবানী দেবীকে তারা জানত রাজরাণী এবং তাঁকে না দেখলেও তাঁর রাজরাণীর উপযুক্ত বসন-ভূষণের সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল। এ মেয়ে সাধারণ গৃহস্থ ঘরের। ভূষণের মধ্যে হাতে দু গাছি শঙ্খ ছাড়া কোন ভূষণ ছিল না; আর পরনে একখানি লালপেড়ে শাড়ী। তবে রুখু চুলের রাশি এবং চোখের দৃষ্টিতে তারা বিস্মিত হয়েছিল। চিনতে পারে নি।
ভবানী দেবী এসে ঢুকেছিলেন কালীবাড়ীতে।
লোকজন তখন ব্যস্ত। বাবুর অসুখ। একটা চাপা আশঙ্কা সকলের বুকে এবং চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। লোকজন অনেক, তবু গুঞ্জনের কলরবও ছিল না।
ভবানী দেবী নাটমন্দিরে প্রথমে প্রণাম সেরে, নাটমন্দির থেকে মায়ের মন্দিরে বারান্দায় উঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গড়িয়ে পড়েছিলেন। একেবারে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে পড়েছিলেন কিছুক্ষণ। রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন ছিলেন তখন রাজরাজেশ্বরের মন্দিরে। মায়ের মন্দির খোলাই ছিল। দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখার নিয়ম ছিল। পরিচারক ঘুরছিল এদিক-ওদিক, সে ভোগের জোগাড়-যন্ত্র করছিল। সে হাতে একটা বড় গাড়ু নিয়ে গঙ্গাজল ছড়া দিয়ে চলেছিল ভোগশালা থেকে মন্দির পর্যন্ত। এই পথে মায়ের ভোগ আসবে। নাটমন্দির থেকে লোকজনেরা সরে যাচ্ছিল, ভোগে দৃষ্টি পড়বে তাদের। সে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল ওই বারান্দায় লুটিয়ে পড়া মেয়েটিকে দেখে।
—কে গো? ও গো, কে গো তুমি বাছা? ওঠো ওঠো। মায়ের ভোগ হবে, ভোগ আসবে ওঠো।
উত্তর দেন নি ভবানী দেবী, নিস্পন্দ হয়ে পড়েই ছিলেন। পরিচারক আবার ডেকেছিল, ও গো মেয়ে! আরে, এ যে নড়ে না! কি বিপদ?
নাটমন্দিরে একটা থামের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহেশচন্দ্র। তিনি বোধ করি নিদারুণ সংশয়ের মধ্যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, কি হবে, কি ঘটবে এর পর! এবার তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে পরিচারককে বলেছিলেন—ওঁকে ডেকো না বাবা, ওঁর হলে উনি আপনি উঠবেন।
মহেশচন্দ্র সে আমলের শহরবাসী ইংরিজী-জানা মানুষ। লম্বা-চওড়া মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল। তাঁর কথায় পরিচারক একটু দমে গিয়ে বলেছিল- মায়ের যে ভোগের সময় হল।
—তা হোক। মা তো! একটু না হয় দেরীই হবে সন্তানের জন্য!
কথাটা শুনে পরিচারক হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। সে কি করবে বুঝতে না পেরে গাড়ুটা হাতে ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। ঠিক সেই সময় রাজরাজেশ্বরের মন্দির থেকে ন্যায়রত্নমশাই মায়ের মন্দিরে এসে পড়েছিলেন। রাজরাজেশ্বরের চত্বরের দরজা পার হয়েই তিনি মহেশচন্দ্রের কথাগুলি শুনতে পেয়েছিলেন। পরিচারকের কথাও—শেষ কথা—শুনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন সে একটু বিব্রত।
—মায়ের যে ভোগের সময় হল।
উত্তরে শুনলেন—তা হোক। মা তো! একটু না হয় দেরীই হবে সন্তানের জন্য।
ভালো লাগল। কিন্তু হল কি? তিনি পরিচারককে ডেকে বললেন, কি হল হরিচরণ?
—আজ্ঞে, একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মায়ের দরজার সামনে। ডাকলে সাড়া নেই। উঠতে বলছি, তা উনি বলছেন—
ন্যায়রত্ন ততক্ষণে এসে পড়েছেন সামনে। দেখলেন সাষ্টাঙ্গে প্রণতা ভবানী উপুড় হয়ে পড়ে আছে, পিঠের উপর রাশীকৃত রুক্ষ চুল ছড়িয়ে পড়েছে; নিথর নিস্তব্ধ। একটি প্রগাঢ় আত্মনিবেদন যেন ধ্যানে সমাহিত হয়ে গেছে। তিনি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।
—কোন মানসিকের জন্য এসেছেন বুঝি? তিনি এবার ফিরে তাকালেন মহেশচন্দ্রের দিকে। তিনি চমকে উঠলেন, যেন চেনা মুখ। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। তাঁর বিস্ময় অপরিসীম হয়ে উঠেছিল। দু-পা এগিয়ে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন—মহাশয়ের নাম?
—নাম? মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বলে আঙুল দেখিয়ে ভবানীকে দেখিয়ে বললেন—খবরটা পেয়ে আর থাকতে পারলে না, ছুটে এসেছে।
ফিরে ভবানীর দিকে তাকালেন ন্যায়রত্ন।
মহেশচন্দ্র বললেন—বারো বছর ব্রহ্মচারিণীর ব্রত নিয়েছে, এই আর এক পক্ষ বাকী। তবু এল। পারলে না থাকতে।
ন্যায়রত্ন বোধ হয় শোরগোল তুলতেন। মহেশচন্দ্র বারণ করে বললেন—না। শোরগোল তুলবেন না। সে খুব খারাপ হবে!
ন্যায়রত্ন এবার এগিয়ে গিয়ে ভবানী দেবীর মাথায় হাত দিয়ে ডাকলেন—মা।
ভবানী দেবীর সাড়া ছিল না। তিনি ওখানে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তিনি পরিচারকের হাতের গাড়ুটা নিয়ে গঙ্গাজল ঢেলে মাথায় ছপছপ করে ঝাপটা দিয়েছিলেন। আর ডেকেছিলেন—মা-মা-মা!
শোরগোল উঠেই গেল আপনা থেকে। গিরীন্দ্র আচার্য ছিলেন বাড়ীর মধ্যে, বীরেশ্বর রায়ের শোবার ঘরের বারান্দায়। মেদিনীপুরের একজন দেশী ডাক্তার রয়েছেন ঘরের মধ্যে বীরেশ্বরের খাস চাকর জলধর বসে আছে মাথার শিয়রে। মাথা কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। জলপটি চলছে অহরহ। একজন চাকর বাতাস দিচ্ছে। রায়বাড়ির কবিরাজমশাই বসে আছেন আচার্যের পাশে। নাড়ি দেখছেন তিনি। সারা অন্দরে এক পায়রার ডাক ছাড়া কোন ডাক শোনা যায় না। নিষেধ আছে জোরে কথা বলতে। কথাবার্তা ফিসফিস করে; অথবা অতি মৃদুস্বরে চলছে, তাও দুটো-চারটে। পুকুরের ধারে জলের উপর ঝুঁকে-পড়া কুলগাছ থেকে পাকা কুল মধ্যে মধ্যে ঝরে পড়ার সঙ্গেই তার তুলনা হয়। মধ্যে মধ্যে একটি দুটি টুপ-টুপ শব্দ।
এরই মধ্যে গিরীন্দ্র আচার্য কালীবাড়ীর শোরগোলের সাড়া পেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন-কি হল?
ঠিক এই সময়েই উঠল শাঁখের শব্দ। তিনি দ্রুতপদে নেমে এলেন। ভেবেছিলেন কমলাকান্ত এসেছেন।
তিনি নিচে নাটমন্দিরে এসে দেখলেন, সমস্ত সেরেস্তাখানা, চাকর-বাকর, লোক-লস্কর সব ভিড় করে চারিপাশে দাঁড়িয়ে গেছে। সব স্তব্ধ, শুধু একটা ঠেলাঠেলি চলছে। মধ্যে মধ্যে দারোয়ানেরা হেঁকে সাড়া তুলছে। খবরদার! খবরদার! খবরদার!
ভিড় ঠেলে তিনি জিজ্ঞাসা করতে করতেই এলেন—কি? কি? ব্যাপার কি? একটি কথা -রানীমা!
—রাণীমা? রাণীমা কে?
—আজ্ঞে রাণীমা! সতীরাণী বউ!
—সতীরাণী বউ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
বুকের ভিতরটা ধক ধক করতে শুরু করেছিল আচার্যের। আশঙ্কা না আনন্দ তিনি বুঝতে পারেন নি। বারো বছরেরও বেশী তের বছর পূর্ণ হবে এই বর্ষায়। এতকাল পর? তবে এটা তিনি জানতেন, বীরেশ্বর রায় আজও তাঁর সন্ধান করেন। এত বড় এস্টেটের দেওয়ান, এস্টেটের খুঁটিনাটি, জমিদারীর জোত-জমাই শুধু তাঁর নখদর্পণে নয়, খোদ মালিকের প্রতিটি কর্মের সংবাদ তিনি রাখেন। পা ফেললে আওয়াজ শুনে তিনি বলতে পারেন, মালিক কোন্ মেজাজে কি বলতে আসছেন।
সেদিন ছেদী ফিরে আসবামাত্র বীরেশ্বর রায় চঞ্চল হয়ে উঠে বিষয়কর্ম সমস্ত ঠেলে ফেলে তাঁদের একটা কথায় বিদায় দিয়ে, ছেদীকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে পাহারা রেখে ঘরে ঢুকেছিলেন। একটি প্রহর দরজা খোলেন নি। তারপর যখন বের হলেন, তখন যেন অন্য মানুষ। সেইদিনই তিনি কমলাকান্তকে পরম সমাদরে যেন আর্ত হয়ে আসতে বলে চিঠি লিখেছিলেন। এর মধ্যে একটা রহস্যের আভাস তিনি পেয়েছিলেন।
একটা কৈফিয়ৎ অবশ্য মিলেছিল ন্যায়রত্নের কাছে। তিনি সোমেশ্বর রায়ের পাপের কথা, শ্যামাকান্তের কাছে তাঁর অপরাধের কথা চিঠি লিখে বীরেশ্বরকে জানিয়েছেন, একথা ন্যায়রত্ন তাঁকে বলেছিলেন; এবং বলেছিলেন, বীরেশ্বরের মন সম্ভবত এই কারণেই পাল্টেছে। কমলাকান্ত শ্যামাকান্তের পৌত্র। প্রায়শ্চিত্ত করবার সুমতি সেই কারণেই।
তবু এই বিষয়ী মানুষটির মন এতে সন্তুষ্ট হয় নি। তিনি ছেদীকে ডেকে কথাবার্তার মধ্যে প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করেছেন। ছেদী বুদ্ধি তাঁর থেকে বেশী ধরে না। তবু বিশেষ কিছু জানতে পারেন নি। তবে আভাস একটা পেয়েছেন।
কাশীতে বিমলাকান্ত আবার বিবাহ করেছেন তা জেনেছেন। আর পেয়েছেন এক সতীমায়ের খবর। ছেদী বলেছে—তিনি সাকসাৎ দেবী। তপস্যা করেন। এই সতীমাঈজীই বিবাহ দিয়েছেন বিমলাকান্তের। কমলাকান্তকেও তিনি খুব কৃপা করেন। বাবুজী, বেটার মাফিক। এমন কি সতীমাঈ তীরথ করতে এসেছেন, যাবেন গঙ্গাসাগর পর্যন্ত, এসেছেন বিমলাকান্তের সঙ্গে। কিন্তু সতীমাঈ যে কে তা তিনি প্রশ্ন করেন নি। কাশীধাম তপস্যার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। এই কলিতে ঈশ্বরসন্ধানী তপস্বী-তপস্বিনীদের আশ্রয়-ভূমি। সুতরাং কাশীতে সতীমাঈর আবির্ভাব তাঁর বিষয়ী মনের উপরেও এতটুকু সন্দেহের ছায়া ফেলে নি। এমন কি রায়বাড়ীর ভেসে-যাওয়া সতীরাণী বউয়ের সঙ্গে কাশীর সতীমাঈজীর নামের মিল সত্ত্বেও এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকতে পারে, তাও তাঁর মনে হয় নি। এই মুহূর্তেও তা তাঁর মনে হচ্ছিল না। তিনি নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়েই এসে মন্দিরের সামনে দাঁড়ালেন। ভিড় থেকে বেরিয়েই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, একটি মেয়ে মন্দিরের দরজার সামনে নতজানু হয়ে বসে আছেন, দরজায় দাঁড়িয়ে রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন তাঁর হাতে মায়ের নির্মাল্য দিচ্ছেন। পরিচারক তখনো হাতে শাঁখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে ধরে তার পাশে বসে আছেন একজন পক্ককেশ বৃদ্ধ। তাঁর মুখের এক দিকটা দেখা যাচ্ছিল। দেখে মনে হল—দেখা মুখ, এবং মুহূর্তেই বুঝলেন ভবানী দেবীর পালক-পিতা, মহেশচন্দ্র। গিরীন্দ্র আচার্য এসে মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়ালেন।
ন্যায়রত্ন নির্মাল্য মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেন—চিরায়ুষ্মতী ভব।
প্রণাম করলেন ভবানী দেবী। ন্যায়রত্ন গিরীন্দ্র আচার্যকে দেখতে পেলেন এবার, এবং বেশ দীপ্তমুখে বললেন—আর ভয় নেই আচার্যমশায়। বারো বৎসর তপস্যা করে রায়বাড়ীর গৃহলক্ষ্মী ফিরেছেন। মা প্রসন্ন। বীরেশ্বর অচিরে সুস্থ হবেন।
ভবানী দেবী প্রণাম করে উঠে ফিরে তাকালেন; গিরীন্দ্র আচার্যের নাম শুনেই তাকালেন। এবং উঠবার চেষ্টা করলেন।
আচার্য তাঁর মুখের দিকে স্তম্ভিত বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়েছিলেন; শীর্ণ পাণ্ডুর মুখ, রুক্ষ চুলের রাশি সে মুখখানিকে ঘিরে আশ্চর্য রূপ এবং মহিমা দিয়েছে। ঠোঁট দুটি শুষ্ক। কিন্তু চোখ দুটি আশ্চর্য উজ্জ্বল। ভবানী দেবী একটু ট্যারা। চোখের দৃষ্টিতে স্বপ্নাচ্ছন্নতা রয়েছে যেন। অথবা কোন্ ভাবনায় সে দৃষ্টি সমাহিতের মতো মগ্ন। মধ্যে মধ্যে সচেতনতা দেখা দিচ্ছে, মেঘাচ্ছন্ন দিনে কাটা মেঘের ফাঁক দিয়ে বিচ্ছুরিত সূর্যালোকের মতো। আচার্যকে দেখে সেই মুহূর্তে তেমনি এক ঝলক সচেতনতার আলো ফুটে উঠেছে। তিনি এতক্ষণে অনবগুণ্ঠিত মাথার উপর কাপড়ের আঁচল টেনে দিলেন।
সামাজিক এবং বিষয়ী মানুষ আচার্যের মনে মুহূর্ত পূর্বেও শত প্রশ্ন একটা ভয়ার্ত জনতার মতো একসঙ্গে যেন কোলাহল শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু ভবানী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে শান্ত শুধু হল না, লজ্জিত হয়ে তারা লুকিয়ে পড়ল মনের কোণে কোণে। আচার্যের ঠোঁট দুটি কাঁপতে লাগল; একটা আবেগ তাঁর বুকের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, তিনি বললেন—আসুন মা!
শুধু বৃদ্ধা মাসিমা, রাজকুমারী রানী কাত্যায়নীর এক জ্ঞাতি ভগ্নী যিনি এখন রায়বাড়ীর অন্দরে পোষ্যমহলে কর্তৃত্ব করেন এবং দেবমন্দিরে মেয়েদের কৃত্যগুলি সম্পন্ন করেন এবং করান, তিনি এগিয়ে এসে বললেন—এত দিন পর কী দেখতে এলে মা? একদিন-আধদিন নয়, সাড়ে বারো বছর পার হয়ে গেল, লোকে জানে, আমরা জানি, তুমি জলে ডুবে মরেছ, সেই তুমি ফিরে এলে আজ কি মনে করে বল দিকি? সম্পত্তি? বলি ও আচার্য!
আচার্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন কথা শুনে, নিজের নাম শুনে সচেতন হয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন—চুপ করুন আপনি! জিভ আপনার খসে যাবে। কাকে কি বলছেন? জানেন! সারা কাশীধাম ওঁকে বলে সতীমাঈ! পথে চলে যান, লোকে পথের ধুলো কুড়িয়ে নেয়! ছেদী—ছেদী কই? ছেদী!
ছেদী অনেকক্ষণ এসে একটু দুরে দাঁড়িয়েছিল লাঠিতে ভর দিয়ে, সে বললে—হুজুর! হামি আপনা আঁখ সে দেখিয়েছি হুজুর, দেওতা, মাঈজী হামার দেওতা আছেন। হুজুর, হামার বাবুজী মাঈজীর পতা করতে কাশী পাঠাইয়েছিলেন। উনকে চিট্টি হামি হামারা হুজুরকে উ রোজ হাতে দিলম, বিলকুল সব বললাম। বাবুজীর আঁখ সে আঁশু নিকাল গেলি!
ভবানী দেবী মৃদুস্বরে বললেন—ছেদী! চুপ কর তুমি। খুড়োমশায় আপনি বলুন, আমাকে পথ দিতে। আমি ভিতরে যাব।
তারপর তিনি মাসিমাকে বললেন-অপরাধ আমার হয়েছে মাসি। কিন্তু উনি আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন। তিনি আমাকে আসতে লিখেছেন। তাঁর হুকুমেই আমি এসেছি।
আচার্যের দিকে একখানা চিঠি তুলে ধরে বললেন—এই পড়ে শোনান, ওঁরা যদি শুনতে চান। উনি কমলাকান্তকে লিখেছিলেন। তার মধ্যেই আছে! শেষখানার শেষছত্রটা পড়ুন।
আচার্য পড়লেন—“তুমি তোমার ভালো-মাকে বল, আমি তাঁহার জন্য ব্যাকুল হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছি।”
পড়া শেষ হওয়ামাত্র ভবানী দেবী চলে গেলেন রাজরাজেশ্বর মন্দিরে, সেখানে প্রণাম করে এসে অন্দরের মুখে দাঁড়ালেন, বললেন—আমাকে পথ দিন। বললেন মাসিমাকে, কিন্তু সকলে দু পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিলেন।
পরিচারক আবার শাঁখ বাজালে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের মধ্যে কেউ একজন হুলুধ্বনি দিয়ে উঠেছিল, একজন শুরু করতেই সব মেয়েরাই দিয়েছিল। উলু-উলু শব্দে নাটমন্দির হেসে উঠল যেন।
একজন কেউ বলেছিল—করছ কি? সবাই কি থম্ব হয়ে গেল নাকি। জলধারা দিয়ে নিয়ে
যাও, জলধারা দাও।
আচার্য বলেছিলেন-ওহে পরিচারক, করছ কি? এস আমার সঙ্গে এস। তিনি ভবানীকে থামতে বলেন নি, তাতে পিছু-ডাকা হবে; একটু ত্বরিতপদে তাঁকে পাশ কাটিয়ে আগে এসে বলেছিলেন—আমি আগে যাই মা। মহেশবাবু, আপনি আসুন।
সিঁড়ি পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়িয়ে আচার্য বলেছিলেন—তাঁর দেওয়ানী ভঙ্গিতে—আর নয়। এখান থেকে সব ফিরতে হবে। কেউ না। বরকন্দাজ কোথায়? মহাবীর! সিঁড়ির মুখে খাড়া থাক। কেউ না উপরে যায়। একটি শব্দ না হয়। হাঁ?
—হাঁ হুজুর!
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, এ সমস্ত বিবরণ আছে রত্নেশ্বর রায়ের প্রথম ডায়রীখানায়, যেখানায় এক পিঠে আছে দৈনন্দিন দিনলিপি, ওই পোষ্যপুত্র হিসেবে বাপ-মায়ের কোলে ফিরে আসার দিন থেকে, আর এক পিঠে আছে তাঁর বিগত জীবনের বিবরণ। তাঁরই মধ্যে এই দিনটির সমস্ত ঘটনা তিনি বিশদভাবে লিখেছেন। শুনে লিখেছেন অবশ্য। কারণ তিনি তখনো শ্যামনগরে পিঠের পোড়া ঘা নিয়ে শুয়ে। এবং তখনো তিনি তাঁর আত্মপরিচয় জানেন না।
তাঁর পুড়ে জখম হওয়ার কথা কীর্তিহাটের বরকন্দাজ ফিরে এসে বলেছিল বীরেশ্বর রায়কে, ওদিকে স্ত্রী-পুত্রহারা আহত ঠাকুরদাস কমলাকান্তের ভালো-মাকে খবর দিতে ভুলে যায় নি। শ্যামনগর তখন পুড়ে গেছে। প্রজারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, কিন্তু তারই মধ্যে তাদের ধর্মঘটের ঘট মাটির ঘট থেকে পাথরের ঘট হয়ে উঠেছে, শুধু তাই নয়, রাধানগরের কায়স্থদের মধ্যে এই ঘটনায় দে-সরকারদের জ্ঞাতিদের নেতৃত্বে দু ভাগ হয়ে গেছে। যারা এতকাল জ্ঞাতি, স্বজাতি এবং স্বগ্রামবাসী বলে মুখে চুপ করেছিল, তারাও সদলে শ্যামনগরে এসে ব্রাহ্মণ মাতব্বরদের কাছে বলে গেছে যে, তাঁদের সঙ্গেই তারা রইল, আজ থেকে দে সরকার জ্ঞাতি, স্বজাতি হয়েও আমাদের শত্রু! ঘরে শিকল দিয়ে আগুন লাগিয়ে ব্রহ্মহত্যা! হে ভগবান! ওই ম্লেচ্ছ কুঠীয়ালের সংসর্গে এসে পিশাচ হয়ে গেছে লোকটা!
শুধু রাধানগর নয়, এই খবরটা এমন একটা চেহারা নিয়ে চারিদিকে ছড়িয়েছিল যে, আট-দশখানা গ্রামের মানুষ এসে বলে গিয়েছিল, আমরাও আছি। এসব গ্রামের দু-তিনখানায় জন রবিনসনের নীল অভিযান চলেছিল। বাকী গ্রাম এসেছিল প্রাণের দরদে, দুঃখে।
শ্যামনগর পুড়ে গেল, কিন্তু আশ্চর্য একটা বাহুবলের সৃষ্টি হয়েছিল। ঠাকুরদাস পাল, বৃদ্ধ ঠাকুরদাদা ভটচাজমশায়কে ডেকে বলেছিল, একটি কাজ করতে হবে বাবাঠাকুর, কমলাকান্তদাদার ভালো-মায়ের কাছে আমি যে তিন সত্যি করেছি, ওর অসুক-বিসুক, বিপদ কিছু হলেই আমি তাঁকে খবর দোব। তা তেনাকে যে একটা খবর দিতে হয়। উনি কাশীর সতীমা, কাশীতে লোকে বলে দেবতা। আমার মহা অপরাধ হবে!
—কোথায় খবর দেব? উনি কোথায় আছেন?
—সে আমাকে বলে গিয়েছেন বাবাঠাকুর। আমাদের জানা থানেই আছেন। আমাদের ঠাকুর মিঞাদের হজরতপুর-গুলমহম্মদ শরীফের ঈশেন কোণে পাগলী কালীমায়ের থান আছে, তিনি সেখানে আছেন। কাশী থেকে স্বপনাদেশ পেয়ে এসেছেন, স্বপন হয়েছে নাকি ওইখেনেই তেনার কি বেরতো আছে, শেষ হবে। বলে গেছেন, বাবাঠাকুর, মিঞাসাহেবের কাছে গেলেই তিনি লোক দিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দেবেন। রাজরোষের উপর দেবরোষ হলে সব্বনাশ হবে বাবাঠাকুর। আমার নরক হবে।
বৃদ্ধ ভটচাজ বলেছিলেন—আজ লোক পাঠাচ্ছি, ভাবিসনে তুই। ওরে আমরাও যে ভাবছি। এ করলাম কি? বিমলাকান্তের একমাত্র পুত্র রে; রূপে কার্তিক, গুণে বৃহস্পতি। তার এ দশা তো আমাদের জন্যে। নইলে সে কীর্তিহাটের জমিদার, বিমলাকান্তের সঙ্গে সাহেবের আলাপ, সে তো তার জমি ছেড়েই দিতে চেয়েছিল। আমাদের জন্যেই মিটমাট করে নি। ঝগড়া করেছে সাহেবের সঙ্গে। আমরাও যে মাথায় মাথায় ভাবছি—বিমলাকান্তকে এ সংবাদ দেব কি করে?
তারপর হঠাৎ বলেছিলেন-ওরে, তুই যা বলছিস তাতে ওই সতীমাটি দেবতাই বটেন রে। নইলে এই যোগাযোগ হয়? যোগাযোগটা তিনিই করে দিলেন। শুনেছি, বুড়ো ঠাকুর মিঞা আজও বেঁচে আছেন। বয়ঃক্রম পঁচাশি হয়তো, বেঁচে আছেন এই আজকের জন্যে। তিনি ফিরিঙ্গী কোম্পানীকে খাজনা দিতে হবে বলে যুগলপুরের মত লাট ইস্তফা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। যাবার দিন আমরা বামুনরা সর্বরক্ষেতলায় পুজো দিয়েছিলাম ঢাক বাজিয়ে। ঠাকুর মিঞা কানে আঙুল দিয়ে নৌকায় চেপে চলে গিয়েছেন। তাঁর কাছেও একখানা পত্র দেব রে, বলব হজরতের বংশ আপনারা ঠাকুরসাহেব, আপনারা এককালে সিদ্ধযোগী ছিলেন। তা আপনাদের কাছে অপরাধের ফল ফলেছে। আমরা আপনাদের নজরানা, সেলাম আপনাকে জানালাম। আমাদের ক্ষমা করবেন।
সুলতা, এইখানটা পড়ে আমার ভারী ভাল লেগেছিল। হয়তো এটা সেকালের কুসংস্কার অজ্ঞতা, যা বলবে সবই। তবু ভাল লেগেছিল।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে একটু হাসলে সুরেশ্বর। সুলতার মুখেও একটি করুণ হাসি ফুটে উঠল। সুরেশ্বর বললে—যাক। সেইদিনই লোক চলে গিয়েছিল ছোট একখানা ছিপ নিয়ে। ভাটির মুখে যাওয়া। বোধহয় এক দিনেই পৌঁছেছিল। ভালো মা ফিরেছিলেন, তিনদিনের দিন। একখানা লম্বা ষোল দাঁড়ের ছিপে এসে পৌঁছেছিলেন; দাঁড়িদের সবাই ছিল গোয়ান। ছিপখানা ঠাকুর মিঞার নিজের ছিপ।
সুলতা প্রশ্ন করলে—ঠাকুরসাহেব কিছু লেখেন নি?
—না! তবে নাকি ভালো-মাকে বলে দিয়েছিলেন, মা, তুমি ভটচাজদের বলিয়ো, কবরের মুখে পা বাড়াইয়াছি। দিল্লীর বাদশাহের শাজাদাদের ফিরিঙ্গীরা শুনেছি নাকি শড়কের উপর ফটকে ফাঁসি লটকাইয়া রেখে দিছে; কবর দিতে দেয় নাই তিনদিন। এই রসুলপুরের মোহনা দিয়া বাদশাহকে জাহাজে করে রেঙ্গুন পাঠাইয়া আটক রাখছে। শুনে কেঁদেছি। আল্লায়তালা আর রসুলে আল্লা পয়গম্বরের কাছে কইছি—খতম কর জিন্দেগী, পার কর; কবরে ফরমান পাঠাও। তা আজ ভটচাজের চিঠিখানা পেয়ে মনে হচ্ছে—এই চিঠি দরখাস্ত পাবার তরেই আল্লা আমারে জীবিত রাখছিলেন। বলিয়ো, দিল সাফা করে হিয়ে খোসলে আমি সব মাফ করে গেলাম।
আর একশো টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন নতুন ঘর করবার জন্যে।
ভবানী দেবী যখন দুদিন পর এসে পৌঁছেছিলেন, তখন কমলাকান্তের ফাঁড়া কেটেছে, ফোস্কাগুলো কিছু বসেছে, কিছু ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে; পোড়া ঘায়ের চিকিৎসা করছে বিষ্ণুপুরের ভাণ্ডারীরা। তখন এদেশে নানা চিকিৎসা ছিল, অ্যালোপাথি তখনো কলকাতা এবং বড় বড় শহর ছাড়া বড়-একটা হয় নি। বৈদ্য ছিলেন বড় বড়। বিচক্ষণ বৈদ্য। তা ছাড়া ছিল নানান স্বপ্নাদ্য ওষুধ। যার পরমায়ু আজও ফুরোয় নি। পেনিসিলিন উঠেছে। ১৯৫৩ সালে অনেকটা সুলভও হয়েছে, তবু চাঁদসীর, মা মনসার স্বপ্নাদ্য চিকিৎসা বেঁচে আছে। পাঁজির পাতা ওল্টালে আরো অনেক এমন চিকিৎসার বিজ্ঞাপন পাবে। বিষ্ণুপুরের ভাণ্ডারীরা জাতে নাপিত, তাদের কুলধর্ম ক্ষৌরি তারা করত না। ঘা ফোড়ার চিকিৎসা করত। তাদের ওষুধ নাকি অব্যর্থ ওষুধ ছিল। সেই চিকিৎসা চলছে। কমলাকান্ত তিন দিনেই ফাঁড়া কাটিয়েছেন, ঠাকুরদাসের পোড়া তাঁর থেকে বেশী। সে তখনো খুব কাতর!
.