১৯
বাড়ী ফিরে এলাম এক বিচিত্র মন নিয়ে। অর্চনার বিয়ের ভাবনা আমার মন থেকে তখন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আমার মনে শুধু ঘুরছে রথীন ডাক্তারের কথা। আশ্চর্য একটা ছেলে।
তার সে আশ্চর্য রূপ এতকাল ওই অন্নপূর্ণা দেবীর পরমাদরের মধ্যেই লালিত হয়ে স্বচ্ছন্দবৃদ্ধিতে বেড়ে উঠেছে। তিনিই তাকে যেন ঢেকে রেখেছিলেন। আজ আমাকে উপলক্ষ করেই অকস্মাৎ একমুহূর্তে সে অন্নপূর্ণা দেবীর পরমাদরের সমস্ত আবরণ ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে এসে আপনার চেহারা নিয়ে দাঁড়াল।
জানবাজারে ফিরলাম আমি ওঁদের গাড়ীতে। আমার গাড়ী আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। রাত্রে থাকব কথা হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল কথাটা পাকা করে নিয়ে ফিরব। বাধা উঠবে মনেই করিনি। বাধার মধ্যে বাধা বা অপেক্ষার মধ্যে অপেক্ষা থাকবে-অর্চনাকে হয়তো একবার এনে দেখানোর। কিন্তু সে কোন বাধাই নয়। অর্চনাকে পছন্দ ফটো দেখেই যখন হয়েছে, তখন চোখে দেখলে সে-পছন্দ পরম আগ্রহে পরিণত হবে তাতে আমার কোন সন্দেহই ছিল না। কিন্তু রথীনকে দেখে তার কথা শুনে তার উপর কোন ক্ষোভ আমার হল না। এ-বাড়ীর ছেলে না হলে ভাবতাম হয়তো কারুর প্রেমে পড়েছে। হয়তো অসবর্ণ। কিংবা হয়তো অতি মডার্ন মেয়ে। বরং উল্টো মনে হল। সেটা হল হঠাৎ—ফিরে আসছি ও-বাড়ী থেকে; গাড়ীটা সারকুলার রোড হয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে ময়দান ভেঙে এসে উঠবে এসপ্ল্যানেডের সুরেন্দ্রনাথ রোড আর চৌরঙ্গীর জংশনে, পথে দেখলাম খণ্ড খণ্ড জটলা এখানে-ওখানে। তার মধ্যে দশ-বারোটি ছেলেকে দেখলাম আহত অবস্থায় গাছতলার আড়াল দিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল একটা মিটিং ছিল মনুমেন্টের তলায়। নতুন রিফর্ম আইন প্রবর্তিত হয়েছে, সেই আইনকে বর্জন করবার জন্যই এ-মিটিং করছিল কংগ্রেসের লেটিস্টরা।
কংগ্রেসের সে সময়ের অবস্থার কথা আমার থেকে তুমি ভাল জান সুলতা। হয়তো বা সে মিটিংয়ে তুমিও ছিলে এমন হতে পারে।
কংগ্রেসের মধ্যে দক্ষিণপন্থীদের বিরোধিতা করবার জন্য তরুণ দল, কংগ্রেসের মধ্যেই ছোট ছোট দল হয়েছে। পণ্ডিত নেহেরু লেটিস্ট, লেটিস্টরা তাঁর মুখ চেয়ে থাকে, তবু তিনি দল গড়েননি। তাঁর প্রিয়তমা পত্নী তখন মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর ফিরে এসে তিনিই তখন কংগ্রেসের সভাপতি। বোধহয় এই কারণেই তিনি দল গড়ার দিকে মনোযোগী হননি।
সুভাষচন্দ্র নেহেরুর সমান জনপ্রিয়। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের বীজ পুঁতেছেন। কিন্তু তা তখন বীজ হয়েই আছে। গাছ হয়ে দেখা দেয়নি। তখন—মানে সে সময়টায় দেশে তিনি ছিলেন না। মাসখানেক পর ফিরলেন। সেদিনও আমি কলকাতায় ছিলাম।
এম এন রায় দল গড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন। সব থেকে বেশী দানা বেঁধেছে কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি।
কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছে স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে। ছাত্র ফেডারেশন গড়ে উঠেছে।
কম্যুনিস্ট পার্টি তখন জন্মেছে কিন্তু অন্য একটা নামের আড়ালে বাল্যলীলা শুরু করেছে। সবল নয়, সুস্থ নয়।
সুলতা হেসে বললে—হ্যাঁ, তখন ওরা ন্যাশনাল ফ্রন্টের নামে কাজ চালাতো। তাদের ইন্টারন্যাশনাল এবং অ্যান্টিন্যাশনাল চেহারাখানা ওই নামের নামাবলী গায়ে দিয়ে বন্দেমাতরম্ বলে আওয়াজ দিত। যে মিটিংটার কথা বলছ, তার কথাও মনে পড়ছে। ঠিক বলেছ, আমিও সে মিটিংয়ে ছিলাম। পুলিশ লাঠি চালিয়েছিল।
হেসে সুরেশ্বর বললে-তাহলে আমি ভুল করিনি অনুমানে।
সুলতা বললে—না, তা করনি। গোটা ভারতবর্ষেই তখন সাড়া পড়েছে।
—হ্যাঁ। সেই কারণেই সেদিন আহত অবস্থায় ওদের দেখে আমার মনে হয়েছিল হয়তো বা রথীন কোন দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। বিয়েই হয়তো করবে না। এবং তার দক্ষিণপন্থী বাপ-খুড়োদের এমন কি অন্নপূর্ণা দেবীকেও সেটা জানতে দেয়নি।
একটু চুপ করে থেকে সুরেশ্বর বললে—অকস্মাৎ যেন আমি বদলে গেলাম সুলতা। রায়বাড়ীর এলাকার বাইরে এই ময়দানে যেন সারা ভারতবর্ষের আবেগ আমার বুকে আছড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠল যে—আমিও ঝাঁপ দেব। প্রায়শ্চিত্ত করব জীবনের। শুধু আমার নয় আমার বাবার, আমার পূর্বপুরুষদের, ইংরেজ-আনুগত্যের প্রায়শ্চিত্ত করব। কেন নিজেকে আবদ্ধ করে রাখব এই পচে যাওয়া জমিদারবংশের জটপাকানো বন্ধনের মধ্যে!
চৌরঙ্গীর মোড়টায় এসে দেখলাম, সেখানটা ফাঁকা। পুলিশ ছাড়া কেউ নেই। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সার্জেন্টরা সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার গাড়ীটা থামিয়েও একবার দেখে নিলে আমার চেহারাটা। তারপর গাড়ীটা ছেড়ে দিলে।
গাড়ীটা এসে জানবাজারের এই বাড়ীতে এসে থামল। আমি গাড়ী থেকে নেমে উপরে ঘরের দরজার কড়া নাড়লাম। ভিতর থেকে একজন চাকর দরজা খুলে দিলে। আমি ঘরে ঢুকতে যাব এমন সময় লম্বা বারান্দাটার ওধার লম্বা বারান্দাটার ওধার থেকে কে আর্ত চিৎকার করে উঠল—বাবুজী—হুজুর হামার রায়হুজুর!
কে? কণ্ঠস্বরটা পরিচিত। এবং পরমুহূর্তেই মনে হল এ তো হিলডার গলা। মনে পড়ে গেল, কাল আমি যে-ট্রেনে এসেছি সে সেই ট্রেনেই কলকাতা এসেছে। কিন্তু সে এখানে কেন?
থমকে দাঁড়ালাম।
পরমুহূর্তেই এগিয়ে এসে দাঁড়াল কুইনি। খুব আশ্চর্য হইনি। কারণ হিলডার গলার স্বর আগে পেয়েছি। জিজ্ঞাসা করলাম-কি ব্যাপার কুইনী?
—বড় বিপদে পড়ে এখানে এসেছি স্যার। রঘু ছিল, সে-ই এ-বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দিয়েছে। নইলে হয়তো—একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে—জানি না কি হত? ও-বাড়ীতে দাদিয়া ভাড়াটেদের সঙ্গে ঝগড়া করে যা-তা গালাগাল করেছিল—হ্যারিস ওখানে তালা ভেঙে ঢুকেছে। তারা তাকে ঠেলে ঘর থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। পড়ে গিয়ে দাদিয়ার হাঁটুটা অত্যন্ত জখম হয়েছে। যার সঙ্গে এসেছিলাম, জন চৌধুরী, মারপিট শুরু হতেই পালিয়েছে। তাই এখানে এল দাদিয়া। বললে—আর কোথা যাব? একটু চুপ করে থেকে আবার বললে—আর—। বলতে গিয়ে থেমে গেল কুইনি।
—কি আর?
—ভাড়াটেরা বললে-রায়বাবুরা নোটিশ দিয়েছে—এ-বাড়ী আমাদের। যেন অন্য কাউকে ভাড়া না দেওয়া হয়। শুনলাম, তিন মাসের ভাড়া তারা প্রত্যেককে ছেড়ে দেবে।
—আমরা নোটিশ দিয়েছি? বিস্ময়ের আর সীমা রইল না আমার।
—না স্যার। আপনাদের বড়-তরফের বাবুরা দিয়েছেন নোটিশ।
—আমাদের বড়-তরফ? মানে জ্যাঠামশাই? -যজ্ঞেশ্বর রায়?
—হ্যাঁ। তাঁর নাম আছে। আর হ্যারিসের যে ঘরটা আমরা বন্ধ করে রেখেছিলাম সেই ঘরটা হ্যারিসকে দিয়ে খুলিয়ে তাকে থাকতে দিয়েছেন বড় রায়বাবুর ছেলেরা। হ্যারিস এখন বলছে—এ-বাড়ী বড় রায়বাবুদের। এখানে তারা চিরকাল ভাড়া দিয়ে থাকে। আমার মা-বাবা ও ভাড়া দিত। আমার মায়ের বাবাও ভাড়া দিতো, সে তার সাক্ষী। হ্যারিসই কলকাতায় এসে বড় রায়বাবুর কাছে গিয়েছিল। তাঁর অসুখ। তাঁর ছেলে যিনি সেটেলমেন্টের সময় কীর্তিহাট গিয়েছিলেন, তিনিই হ্যারিসকে দিয়ে এসব করিয়েছেন।
কুইনির বণ্ঠস্বর কাঁপছিল। আমি বললাম —বেশ করেছ কুইনি। ভালই করেছ। আমি খুশী হয়েছি। আপনার ভাবতে পেরেছ—এসেছ এখানে—কিন্তু কিছু খেয়েছ?
টপ টপ করে কুইনির চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল। ঘাড় নেড়ে জানালে—হ্যাঁ। দোকান থেকে কিনে এনে খেয়েছি। কিন্তু দাদিয়া বড় জখম হয়েছে। অনেক রক্ত পড়েছে।
আমি বললাম—আজ বড় ক্লান্ত আমি কুইনি। মনও ভাল নেই। কাল শুনব, তুমি হিলডাকে বল গিয়ে। কাল শুনব; বুঝে দেখব। তবে বাড়ী তোমার এ আমি জানি। দরকার হলে এ-কথা আমি বলব। আদালতেও বলব।
বলে উপরে উঠে চলে গেলাম আমি।
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, সে রাত্রে আদৌ ঘুম হয় নি। আমার মনের মধ্যে পাশাপাশি তিনটে চিন্তার স্রোত বইছিল। ঘুমোতে আমি পারিনি।
একটা স্রোত-অন্নপূর্ণা দেবী বড়মার বাড়ীর ঘটনা এবং ওই রথীন ছেলেটিকে নিয়ে বিচিত্র অনুমান ও কল্পনা। অন্যটি কাল যে-হাওয়াতে ময়দানে নিঃশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম তার চিন্তা। ঘর সংসার বংশ—সমস্ত কিছুর বাইরে যে জগতে ও জীবনের স্রোত বইছে, তার গর্জন। সে রাত্রে এই শেষেরটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আমাকে কোনো মতে স্থির হতে দিচ্ছিল না। একটা প্রবল আকর্ষণে যেন টানছিল আমাকে।
আজও পর্যন্ত আমার জানাশোনা জমিদারবংশের মধ্যে দু-চার ঘর ছাড়া কেউ এই ভারতের জীবনধারাকে সমর্থন করেন নি। আমি নিজে গিয়ে বন্ড দিয়ে ফিরে এসেছি। বাবা গান্ধীজীকে অনেক মন্দ কথা বলে গেছেন।
১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল। প্রথম বম্বেতে তারপর ১৮৮৬ সালে কলকাতায়। সে সময়ে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় জীবিত। বড় ছেলে দেবেশ্বর রায় তখন তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণ। কীর্তিহাটের লোক বলত বড়কুমার। রত্নেশ্বর রায়ের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন- ল্যান্ডলর্ড অ্যাসোসিয়েশন থেকেই জন্মেছে। রাজামহারাজা উপাধিধারী বড় বড় জমিদাররা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে বেশি ছিলেন না। কিন্তু সে কালের যাঁরা এক সঙ্গে জমিদার ধনী এবং শিক্ষা ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে উজ্জ্বল রত্ন—তাঁরা এই অ্যাসোসিয়েশনেই ছিলেন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্তির, কৃষ্ণদাস পাল, রাজা দিগম্বর মিত্তির, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, উত্তরপাড়ার দোর্দাণ্ডপ্রতাপ জয়কৃষ্ণ মুখুজ্জে এরা এঁর সঙ্গে ছিলেন।
প্রথম কংগ্রেস হবার কথা ছিল পুণায়। ছত্রপতি মহারাজাধিরাজ শিবাজীর লীলাক্ষেত্র। জানি না এটা তাঁরা সচেতন জাগ্রত বুদ্ধি নিয়ে করেছিলেন কিনা। মিস্টার হিউম—আমরা জানতাম মহামতি হিউম, ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের অনুমতি নিয়েই এর পত্তন করেছিলেন। দেশে তখন একটা জাগরণ এসেছে। বীরেশ্বর রায়ের কাল চলে গেছে। রত্নেশ্বর রায় রায়বাহাদুরের কাল তখনো যায় নি কিন্তু পোশাক বদলাচ্ছে। পুণাতে কি একটা এপিডেমিক হয়েছিল বলেই স্থান পরিবর্তন করে প্রথম অধিবেশন হয়েছিল বম্বেতে। বাংলার উমেশ বাঁড়ুজ্জে—ডব্যু সি ব্যানার্জি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় অধিবেশন হল কলকাতায় তাতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন জ্যেষ্ঠের মত সমাদর রে সাহায্য করেছিলেন।
রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্তির—শুধু ধনী নন, জমিদারীতে জমিদার নন, নিজে তিনি বিরাট পণ্ডিত, তিনিই ছিলেন কলকাতার সে কংগ্রেস অধিবেশনে রিসেপশন কমিটির চেয়ারম্যান। বম্বের দাদাভাই নওরোজী মূল সভাপতি।
সভাপতি হিসেবে দাদাভাই নওরোজীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন উত্তরপাড়ার জমিদার, যাঁর প্রতাপের ভয়ে প্রজারা কাঁপত তিনি। তখন তাঁর ঊনআশী বছর বয়স।
সভাপতি দাদাভাই নওরোজী থেকে বিভিন্ন প্রভিন্সের ডেলিগেটরা মুক্ত কণ্ঠে কলকাতার সংবর্ধনার প্রশংসা করে গিয়েছিলেন।
রায়বাহাদুরের আমলের জমাখরচের খাতায় তিন অঙ্কের একটা চাঁদা খরচ আছে। কিন্তু নিজে তিনি আসতে পারেন নি, তীর্থে যাবার আয়োজন করেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন দেবেশ্বর রায়; তিনি ছিলেন ভলেন্টিয়ার দলের একজন কর্তা। এবং বহুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন থেকে কংগ্রেস পৃথক হয়ে গেল। তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হল, স্থায়ী অস্তিত্ব; তার লক্ষ্য হল স্বতন্ত্র; দৃষ্টি জমিদার ধনীদের ছাড়িয়ে আরো বিস্তৃত হল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন পৃথক হয়ে গেল।
রত্নেশ্বর রায়ের কাগজপত্রের মধ্যে একখানা চিঠির নকল আছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন লিখেছিল ন্যাশানাল কংগ্রেসের সেক্রেটারিকে। দীর্ঘ পত্র। তার কটা লাইন আমি নোট করে রেখেছি সুলতা। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কংগ্রেস সেসনে ডেলিগেট পাঠাবার জন্য অনুরোধের উত্তরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ‘রাজকুমার সর্বাধিকারী’ লিখেছিলেন—
“No Political Association of the country, can feel the least hesitation in sending delegates to a conference but they will naturally shrink from associating themselves with a rival Association, whose mode of action-whose methods and measures-may often be diametrically opposite to those of their own.”
এরপর থেকে জমিদার শ্রেণীই একরকম কংগ্রেস থেকে দূরে সরেছে। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছে। যেটুকু ছিল, তা ছিল একগোছা না-পাকানো সূতোর বাঁধনের মত। তার অর্ধেকগুলো ছিঁড়ে গেল ১৯০৫ সালে, বাকীটা ছিঁড়লো ১৯২১ সালে। সম্পদ যাদের থাকে সুলতা তারা রাষ্ট্রবিপ্লব চায় না; আর সম্পদ যাদের আছে, তাদের বাঁচবার সাধ বড় বেশী। ওই কথাগুলোই তার সাক্ষী।
এর মধ্যেও হয়তো দুচারজন জমিদারের দুঃসাহসী ও আবেগপ্রবণ ছেলে—কংগ্রেস কেন বোমা-পিস্তলের দলেও ঢুকেছে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারে নি। কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে জমিদার বাপকে ধরে পুলিশ আপিসে এসে নরেন গোঁসাইয়ের মত অ্যাপ্রুভার হয়েছে।
কিন্তু সেদিন যেন অনুভব করেছিলাম, না—এ আর এক যুগ! অন্তত রায়বংশের পক্ষে। আর এক যুগ বলেই অতুলেশ্বর এই কাজ পেরেছে, অর্চনা তার সহকারিণী হতে চেষ্টা করেছে। মেজদি যে মেজদি, তিনিও পেরেছেন।
আমি কেন পারব না?
উত্তেজনায় মধ্যে মধ্যে উঠে বসেছি সেদিন রাত্রে। সে কতবার তা মনে নেই, তবে অনেক ক’বার তা মনে আছে।
এরই মধ্যে আর এক চিন্তাও এসেছে।
মাঝে মাঝে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। যন্ত্রণাকাতর নারীকণ্ঠের চিৎকার। চেঁচাচ্ছিল গোয়ান বুড়ী হিলডা।
সত্য বলব তোমার কাছে সুলতা—মধ্যে মধ্যে এমন বিরক্তি বোধ করছিলাম যে ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে ধমক দিই। থামতে বলি। একবার অন্তত মনে হয়েছিল যে দারোয়ানকে বলি—এমন চিৎকার করলে বের করে দে ওকে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছিল কুইনিকে। কুইনির সঙ্গে সেই চিঠিগুলো। রত্নেশ্বর রায়ের দানপত্র। রায় অ্যান্ড কোম্পানীর চিঠি ভায়লা পিদ্রুসকে। তার ছেলেকে পড়াবার খরচ দেবার কথা। ভায়লাকে মাসোহারা দেবার কথা। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য আবছা প্রশ্ন। কিন্তু সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছিল কুইনিকে কুইনির মধ্যে একটা কি ছিল। যা আমাকে তীব্র আকর্ষণে আকৃষ্ট করত।
হয়তো মানুষের দেহের মধ্যে যে অনিবার্য আকর্ষণ থাকে নারীদেহের প্রতি, যার জন্য পরস্পরের দেখা হওয়া মাত্র নারী চঞ্চল হয়ে উঠে মুখ ফেরায়, ঘোমটা টানে, গায়ের কাপড়টা টেনে দেয়; পুরুষ বিস্ফারিত নির্লজ্জ দৃষ্টিতে দেখে, প্রতি মুহূর্তে এগুতে চায় জন্তুর মত, কেবল মানুষ বলেই পারে না, সমাজ আছে বলে পারে না, গভর্নমেন্ট আছে বলে পারে না—এটা তাই।
ভেবে দেখ সুলতা কোন্ জগৎ থেকে কোন্ জগতে গিয়ে পড়ছিলাম আমি। কোথায় দেশ-মানুষ, আত্মদান—আবার কোথায় পুরুষ আর নারী—দৃষ্টিতে মোহ, অন্তরে প্রবল আকর্ষণ তার সঙ্গে বংশের একটা অন্যায় সংযোগের রহস্যময় কিছু। তাকে কি বলব বুঝতে পারছি না। বার বার নিজেকে তিরস্কার করেছিলাম সেদিন। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীর মধ্যে কিছু কিছু বিচিত্র আত্মবিশ্লেষণ আছে। ডায়রী তিনি বিলুপ্ত করে দেবেন এই ইচ্ছে তাঁর ছিল। ডায়রীর দপ্তরের উপর লেখা ছিল—এগুলিকে আমার চিতায় পুড়িয়ে দিয়ো। যদিই তা কোন কারণে না হয়, অর্থাৎ যদি শেষসময়ে আমি একথা বলে যেতে না পারি এবং এই লুকানো দপ্তর কারুর চোখে না পড়ে, থেকেই যায়, তবে এ ডায়রী কেউ পড়ো না। যে পড়বে সে ব্রহ্মহত্যার পিতৃহত্যার পাতকগ্রস্ত হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ হবে। তার কারণ শ্যামাকান্তের কাহিনী, সোমেশ্বর রায়ের কাহিনী, বিমলা দেবীর সন্তান চুরির কাহিনী তিনি পৃথিবী থেকে মুছে দিতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু পৃথিবীতে তা হয় না। রায়বাড়ীর ক্ষেত্রে আমিই তাঁর সকল নিষেধ অমান্য করলাম।
আমি পড়েছিলাম সুলতা তোমার জন্যে। ঠাকুরদাস পালের খুনের মধ্যে তিনি কিভাবে কতখানি জড়িয়েছিলেন তাই জানবার জন্য। এবং বিচার করবার জন্যও বটে। সেই সুত্ৰে পেলাম রায়বংশের গোপন করা ইতিহাসের কথা। কি সে গুপ্তকথা? তাঁর নির্দেশ মানি নি। চতুৰ্দশ পুরুষ নরকস্থ হবে এ কথা বিশ্বাসই করতাম না। আর পিতৃহত্যা ব্রহ্মহত্যার পাপ—এ আমাকে অর্শাবে বলে ভয়ও করি নি, পড়তে পড়তে এই মানুষটিকে ভয় হয়েছে তাঁর কঠোরতার কথা পড়ে, সত্যবাদিতা দেখে, মনের কথা একবিন্দু গোপন করেন নি ডায়রীতে। এবং বিচিত্র রঙে রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সুলতা, কিছুক্ষণ আগে অঞ্জনার সঙ্গে তাঁর যে কথাবার্তা হয়েছিল একখানি ঘরের মধ্যে—যখন সরস্বতী বউ দ্বিতীয়া কন্যা প্রসবের পর অসুস্থ এবং শোকার্ত, কারণ মেয়েটি মারা গেছে, সেই নিরিবিলিতেও যে সাংঘাতিক কথাগুলি অঞ্জনা বলেছিল এবং তার উত্তরে তাঁর যে স্বরূপটি প্রকাশ করেছিলেন, তা তোমাকে শুনিয়েছি। তোমাকে বলতেই হবে যে, তিনি গোপন কিছু করেন নি, এমন কি নিজের মনের অন্ধকার কোণে নিরস্তর অন্ধকারের মতো যে গোপন কামনাটি লুব্ধ পশুর মতো দাঁড়িয়েছিল, তাকেও তিনি গোপন করেন নি।
এই রত্নেশ্বর রায়ের আর একদিনের বা দু তিন দিনের ডায়রীর মধ্যে বোধ হয় সারা জীবনটা আকাশের আলোর নিচে পৃথিবীর মতো মেলে ধরা আছে। তার মধ্যে দেখেছি এক একটা জায়গা আছে বড় ভয়ঙ্কর। মানুষের সত্য জীবনে যা আছে—গোটা পৃথিবীতে কোথাও বোধহয় তা নেই।
টেবিলের উপর থাক-বন্দী ডায়রীগুলি থেকে উপরের সেই খাতাখানা টেনে নিলে—যেখানকার মধ্যে থেকে কিছুক্ষণ আগে অঞ্জনা এবং রত্নেশ্বরের কথা-কাটাকাটির বিবরণ পড়ে শুনিয়েছিল।
এক চিহ্নিত স্থান খুলে বের করে সুরেশ্বর বললে—ওই ঘটনার তিন মাস পর। অঞ্জনা একদিন সকালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এ ডায়রী সেই দিনের ডায়রী।
লিখেছেন—“প্রভাতে গাত্রোত্থান করিয়া উঠিয়াই শুনিলাম অঞ্জনা গৃহত্যাগিনী হইয়াছে। এত সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলাম—প্রতি দরজায় তালাচাবির ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, দারোয়ান ছিল, কিন্তু তথাপি সে পলাইয়াছে।
সংবাদটা শুনিয়া মনে হইল মুহূর্তে একটা প্রকাণ্ড ঝঞ্ঝা আমার মাথার মধ্য দিয়া বহিয়া যাইতেছে। মনে হইতেছে, আমার অন্তর শাম্মলীবৃক্ষ বা বটবৃক্ষের মত এই ঝঞ্ঝার মূল লইয়া অর্থোৎপাটিত হইয়া ভূতলশায়ী হইতেছে। আমি অবশিষ্ট মূলগুলি দিয়া এবং প্রধান মূলটি দিয়া এখনো কোনরকমে টলায়মান অবস্থায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছি।
চক্ষে দেখিলাম জীবনের যত অশুভ এবং মন্দবুদ্ধি ও মতি, কুটিল সন্দেহ ও আশঙ্কা, জটিল জটপাকানো কামনা এবং ভাবনা—সব আজ এই ঝড়ের আঘাতে মৃত্তিকার অভ্যন্তর হইতে পঙ্কশায়ী মূলের মত উপরে উঠিয়া শত মুখ বিস্তার করিয়াছে। যত ক্রোধ তত আক্রোশ, নিগুঢ়তম মন্দ মতলব মনের মধ্যে খেলিয়া যাইতে লাগিল। খুন করিতে ইচ্ছা হইল। আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা হইল।
ক্রমে তাহা হইতে এত ক্রোধ হইল যে মুখ হাত ধুইতে ধুইতে চৌকিতে বসিয়া প্রস্তরের মতো নিশ্চল হইয়া গেলাম! অঞ্জনা পলাইয়াছে? কাহার সহিত পলাইয়াছে? মনে মনে সব বুঝিতেছি—এই সেই শয়তান, রবিনসন-হত্যাকারী আলফানসো পিদ্রুস; সে রবিনসনকে হত্যা করিয়া এখান হইতে গোয়া এবং গোয়া হইতে পর্তুগাল গিয়াছিল, কিন্তু কিছুদিন হইল আবার আসিয়া হাজির হইয়াছে।
আজ পিতৃদেব থাকিলে এবং দেওয়ানজী থাকিলে হয়তো অসমসাহসিক কিছু করা যাইত। আমি ভুল করিয়া তাহাকে একটা চাকরি দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে চেষ্টা করিলাম। দেশে আজ কয় বৎসর নীল লইয়া আন্দোলন চলিতেছে। দেশের সাধারণ লোকজন উৎসন্নে যাইতে বসিয়াছে। মহারানী ইংলন্ডেশ্বরী স্বহস্তে ভারত শাসনের ভার লইলেন কিন্তু অদ্যাপি ইংরাজ ব্যবসাদারদের প্রতাপ গেল না। গোটা দেশের শাসন-প্রণালী ও পদ্ধতি তাহারাই স্থির করিতেছে। হিন্দু পেট্রিয়টের হরিশ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মত ব্যক্তির যুক্তি প্রতিবাদ ইহারা গ্রাহ্য করে না; ফাদার লঙের মত ব্যক্তিকেও জেলে প্রেরণ করে। সুতরাং অনেক প্রকার চিন্তা-বিবেচনা করিয়া, ম্যানেজারের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই আলফানসোকে হাতে রাখিবার জন্যই মাসিক একশত টাকা বেতনে বন্দুক ইত্যাদির তদ্বির করিতে এবং প্রয়োজন হইলে সাহেব-সুবাদের শিকারের ব্যবস্থা করিতে তাহাকে রাখা হইয়াছিল। আলফানসোকে এখানেই রাখিয়াছিলাম। কারণ ও অঞ্চলের দুচারজন চিনিতে ও পারে। লোকটা নাম পাল্টাইয়াছিল। পূর্বে দাড়ি-গোঁফ দুইই ছিল, এখন দাড়ি কামাইয়া ফেলিয়াছে।
সোফিয়া বাঈকে শ্রদ্ধা করি এবং ইহাও বিশ্বাস করি যে, তাহাকে বেতন দিয়া পিতার মনোরঞ্জনের জন্য বাকী জীবনটার ভার তাহার লইয়াছিলাম বলিয়াই রায়বংশের সকল গোপন কথা কখনো আর প্রকাশ পাইবে না। পিতা গত হইয়াছেন, মাতা স্বর্গে গিয়াছেন —সোফি বাঈকে পাঠাইয়াছি গোয়ালিয়রে। তানসেনের সমাধিস্থল পরিষ্কার করিয়া ধুপ দীপ জ্বালিয়া বাকী জীবনটা কাটাইয়া দিবে।
আলফানসোকেও ঠিক সেই কারণেই রাখিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম ক্রমশ পোষ মানাইয়া আমাদের গোয়ানপাড়ায় একটা বিবাহ দিয়া বাস করাইব। বাড়ী করিয়া দিব। ঘরসংসার ছেলেপুলে হইলেই লোকটা সার্কাসের পোষা চিতায় পরিণত হইয়া যাইবে। না হয় তখন কীর্তিহাটের জঙ্গল অঞ্চলে সুন্দরবনের দিকে লোকটাকে পাঠাইয়া দিব, আপনা-আপনি হারাইয়া যাইবে। কিন্তু লোকটা আমার পিঠের উপর ছুরিকাঘাত করিয়া দিয়া চলিয়া গেল।
সংবাদটা শুনিয়া যেন আমি ক্রোধে ক্ষোভে যন্ত্রণায় উন্মাদ হইয়া গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছা হইল—দামিনী ঝি খবরটা আনিয়াছে, তাহার বুকে একটা লাথি মারিয়া ফেলিয়া দিয়া বলি—মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা! অঞ্জনা যায় নাই, যাইতে পারে না! না-না—পারে না। আমাকে ছাড়িয়া সে। কিন্তু তাহা পারিলাম না।
ক্রমশ উত্তেজনা হ্রাসপ্রাপ্ত হইল, উত্তপ্ত রক্ত শীতল হইল, মনে হইল জমিয়া প্রস্তরীভূত হইয়া গিয়াছে।
মৃদুস্বরে বলিলাম—পলাইয়াছে? কোথায়? গঙ্গায়—
দামিনী বলিল—সে একখানা চিঠি রাখিয়া গিয়াছে। চিঠিখানা বউরাণীর নিকট রহিয়াছে। তিনি বলিলেন—আপনাকে ডাকিতে।
ঘরে আসিয়া দেখিলাম, দেবুকে লইয়া বসিয়া আছেন মদীয় শাশুড়ি ঠাকুরানী এবং বিছানায় শুইয়া আছে স্বর্ণলতা।
শাশুড়িকে দেখিবামাত্র অগ্নিবৎ প্রজ্বলিত হইলাম। ইনিই—ইনিই সর্বনাশের একটি হেতু। ইনি, মাস চারেক পূর্বে স্বর্ণলতাকে যখন কীর্তিহাট হইতে কলকাতা আনা হইয়াছিল, তখন কীর্তিহাটে গিয়া দেবেশ্বরকে অঞ্জনার কোল হইতে কাড়িয়া লইয়াছিলেন।
এস ডি ও সাহেবের পত্নী মেমসাহেব, সভ্যা রমণী, তিনি শুনাইয়াছিলেন, অঞ্জনা দেবেশ্বরকে অসভ্য কথা শিখাইতেছিল। শুধু তাঁহাকে দোষ দিয়াই বা লাভ কি? তাহার কথায় আমিও তো সায় দিয়াছিলাম। অঞ্জনাই দেবেশ্বরকে মানুষ করিত। তাহারই অনুগত ছিল সে। তাহার কোল ছাড়া তাহার ঘুম আসিত না। তাহার জন্যই সে অনেক রাত্রি পর্যন্ত বারান্দায় দেবেশ্বরকে কাঁধে ফেলিয়া পায়চারি করিয়া ঘুমপাড়ানী গান গাহিয়া ফিরিত। মনে পড়িল এই ছড়াটাই সে বেশী গাহিত—“সে যদি তোমার মা হত, ধুলো ঝেড়ে তোমায় কোলে নিতো।”
মাস পাঁচেক আগে শাশুড়ি ঠাকুরণ স্বর্ণলতার অন্তর্বর্তী অবস্থায় শরীর খারাপ শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছিলেন। অঞ্জনা দেবেশ্বরকে কি একটা অশ্লীল কথা বলিয়াছিল—অশ্লীল এই অর্থে যে, হনুমান দম্পতির সঙ্গম দেখিয়া দেবেশ্বর অঞ্জনাকে প্রশ্ন করিয়াছিল-পিসি, দেখ—দেখ কি হইতেছে। অঞ্জনা হাসিয়া ফেলিয়াছিল। এবং ব্যাপারটা তাকে অশ্লীল ভাবে বুঝাইয়া বলিয়াছিল—এমন সবাই করে বাবা। স-বা-ই করে। তাহার পরও অনেক কথা। কথাটা শাশুড়ি ঠাকরুণ শুনিয়া স্বর্ণলতাকে বলিয়াছিলেন, স্বর্ণলতা আমাকে বলিয়াছিলেন। এবং শাশুড়িই জেদ ধরিয়াছিলেন—কলিকাতায় যাইতেছে সেখানে সাহেববাড়ীর সুদক্ষ আয়া নিযুক্ত করা হউক দেবেশ্বরের জন্য।
কলিকাতায় আসিয়া তাহাই হইয়াছে, সাহেববাড়ির আয়া আসিয়াছে। দেবেশ্বরেরও তাহাকে বেশ পছন্দ হইয়াছে। তাহার সাজগোছ বিধিব্যবস্থা সত্যই ভাল। অঞ্জনা তাহাতে কাঁদিয়াছিল। তাহার পর এই সর্বনাশের, রায়বাড়ীতে এই কলঙ্ক-লেপনের সূত্রপাত। কখন কি করিয়া সে ওই দুর্দান্ত আলফানসোকে দেখিয়াছিল, কি করিয়া যোগাযোগ করিয়াছিল তাহা কেহই জানিতে পারে নাই। পাঁচ মাস প্রায় কলিকাতা আসা হইয়াছে—অঞ্জনাকে সঙ্গে লইয়াই আসিয়াছি। অঞ্জনার স্বামী একটা ব্রাত্য রমণী লইয়া ব্যভিচারপ্রমত্ত হইয়াছে, সুতরাং তাহাকে জোর করিয়াই লইয়া আসিয়াছিলাম।
মাস দুয়েক পরে, অর্থাৎ আজ হইতে তিন মাস পূর্বে প্রথম আমার নজরে আসিল অঞ্জনা আলফানসোর সহিত দূর হইতে হাস্য বিনিময় করে। চোখে পড়িল আমারই। কয়েকদিন হইতে দেখিতেছিলাম—আলফানসো হঠাৎ যেন অতিরিক্ত হাঁকডাক শুরু করিয়াছে এবং দারোয়ানদের কুস্তির আখড়াতেও কুস্তি লড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। পোশাক-পরিচ্ছদেরও বাহার বাড়িয়াছে এবং সে এই বাড়ীতে বেশিক্ষণ কাটাইতেছে। তাহার ডিউটি নামমাত্র—একবার সকালে আসিয়া প্রথমে ঘোড়াগুলোকে দেখে এবং সেগুলোকে টহল দেওয়ায়। তারপর বন্দুক ও কার্তুজগুলা গুনিয়া দেখিয়া কলকাতা দপ্তরের ম্যানেজারকে ‘সব ঠিক হ্যায়’ বলিয়া সেলাম বাজাইয়া চলিয়া যায়। আবার অপরাহ্ণে আসে। তখন কাজ যৎসামান্যই। আর কাজ পড়ে, কোন গাড়ী কারখানায় গেলে। সেখানে মেরামতের কাজ দেখিয়া আসে। বাড়ীতে মেরামত-যোগ্য হইলে সে নিজেই খুলিয়া তাহা করিয়া ফেলে। তবে আমি তাহা ঠিক পছন্দ করি না। কারণ যত অস্পৃশ্য চর্বির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে কোথায় যে কোন স্পর্শদোষ কিভাবে ঘটে তাহা কে বলিতে পারে?
এবার তাহার এই উল্লাসময় পরিবর্তন দেখিয়া আমার মনে হইয়াছিল, আলফানসো বোধহয় আবার কোর্টশিপ করিতেছে। রবিনসনের কুঠীতে গোয়ানপাড়ায় পিদ্রুসের যে একটা সৎবোনকে লইয়া গিয়াছিল—সে মেয়েটা, আলফানসো পর্তুগালে চলিয়া গেলে অন্য একজনকে বিবাহ করিয়াছে। আলফানসো পর্তুগালে বিবাহ করিয়াছিল, কিন্তু কি কারণে তাহাকে ডাইভোর্স করিয়া চলিয়া আসিয়াছে। সেই কারণেই এরূপ ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু তাহার দৃষ্টি যে রায়বাড়ীর অন্দর ভেদ করিয়া অঞ্জনার প্রতি নিবদ্ধ হইয়াছে তাহা বুঝিতে পারি নাই। কেমন করিয়া বুঝিব? একজন হিন্দু নারী, ব্রাহ্মণকন্যা তাহার এমন মতি হইতে পারে কি করিয়া বুঝিব? অবশ্য সমাজে গুপ্ত ব্যাধির মত ব্যাধি আছে। ব্যাধি বড়বাড়ি ছোটবাড়ী বাছে না। বড়বাড়ীর বড় শিক্ষাকেও ব্যর্থ করিয়া নানা অনাচার ঘটায়। কাশীধামে থাকিতে ইহার অজস্র দৃষ্টান্ত দেখিয়া আসিয়াছি। ঘৃণা করিয়াছি। কিন্তু কখনো ভাবি নাই যে এমন কিছু আমার বাড়ীতে ঘটিতে পারে। অন্য জমিদারের বাড়িতে ঘটে। জমিদার, ব্যবসাদার, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল এ পাপ যেখানে সুচীছিদ্র পথ পায় সেইখানেই প্রবেশ করে।
অন্যে পরে কা কথা, দেবতাদের গৃহেও ঘটে।
ইন্দ্র গুরুপত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করিয়াছিলেন, অহল্যা পাষাণী হইয়াছিলেন। চন্দ্র বৃহস্পতি-পত্নী তারাকে হরণ করিয়া লইয়া পালাইয়াছিলেন। এবং বৃহস্পতি তারাকে চন্দ্রের ঔরসজাত পুত্র বুধসহ আবার গ্রহণ করিয়াছিলেন।
তবুও আমার বাড়ীর-আমি রত্নেশ্বর-আমার বাড়ীতে এমন ঘটিবে কল্পনাও করিতে পারি নাই। হঠাৎ চোখে পড়িয়া গেল ব্যাপারটা। প্রথম পিতৃদেবের আমলের চাকর মহিন্দর এবং দারোয়ানদের ঘর হইতে ছেদী সিং ব্যাপারটা লক্ষ্য করিয়াছিল এবং আমাকে তাহা জ্ঞাত করিলে, আমি ব্যাপারটা আড়াল হইতে স্বচক্ষে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম ছাদের আলসের উপর ভর দিয়া সে এবং আলফানসো অন্তরালের একটা গলিতে দাঁড়াইয়া পরস্পরে হাসিতেছে, ইঙ্গিত বিনিময় হইতেছে। ছেদীর নির্দেশমত আমি মেথর নির্গত হইবার গলিপথ ধরিয়া আসিয়া আলফানসোর পিছনে দাঁড়াইয়াছিলাম। আলফানসো আমাকে প্রথমটা দেখে নাই কিন্তু আলসে হইতে অঞ্জনা আমাকে দেখিয়াছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় অদৃশ্য হইয়াছিল। আলফানসোকে প্রশ্ন করিতে গিয়াও পারিলাম না।
অঞ্জনার আকস্মিক অন্তর্ধানে হতচকিত আলফানসো ফিরিয়া আমাকে দেখিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পালাইয়া গেল। আমি ধর্ ধর্ বলিয়া চিৎকার করিতে পারিলাম না। কারণ, মুহূর্তে কারণটা এমনই বৃহদাকার ও কুৎসিত হইয়া উঠিবে যে যাহা শুধু অঞ্জনাকে লইয়াই হইবে না, কলিকাতার অভিজাত মহলের কাছে রায়বাড়ীর মাথাই হেঁট হইবে। ওই মেথর চলাচলের পথ ধরিয়াই যেমন চোরের মত গিয়াছিলাম তেমনি চোরের মত ফিরিয়া আসিয়াছিলাম। সারাদিন ভাবিয়া স্থির করিতে পারি নাই কি করিব? আলফানসোর উপর নিষ্ঠুর ক্রোধ সত্ত্বেও চুপ করিয়া ছিলাম, লোকটা এখনই যদি নীলকর সমাজে গিয়া সব ব্যাপারটা প্রকাশ করিয়া দেয়, তবে সর্বনাশ হইবে।
ইংরেজ জাত অতি ভয়ানক জাত। এমনিতে সে ভদ্র ন্যায়পরায়ণ। কিন্তু ইংরেজদের এক বিন্দু রক্তের জন্য সে কি না পারে?
ওঃ! সিপাহী বিদ্রোহ দমন করিয়া শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের পুত্রদের, হুমায়ুন বাদশাহের কবর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া আনিয়া, খুনী দরওয়াজায় ফাঁসি দিয়া দেহগুলিরও সৎকার করিতে দেয় নাই। ইহারা সব পারে। কাশীতে বালকদিগকে গুলী করিয়া হত্যা করিতে দেখিয়াছি। পা-কাটা ছেদী আজও আমার চোখের সম্মুখে রহিয়াছে।
ডাকিয়া তিরস্কার করিলাম অঞ্জনাকে। আশ্চর্য! অঞ্জনা সেদিন যে উত্তর দিয়াছিল তাহাতে শুধু স্তম্ভিতই হই নাই, তাহার ঠিক উত্তরও খুঁজিয়া পাই নাই।
শুধু কয়েকদিন ধরিয়াই ভাবিয়াছিলাম—অপরাধ কি আমার?
অপরাধ ধর্ম অনুসারে আমার নিশ্চয় নয়, তবুও নিজেকে অপরাধী না ভাবিয়া পারি নাই। হ্যাঁ, অঞ্জনাকে আশ্রয় দিয়া আমার নিজের কাছে আমি রাখিয়াছি। নিজের জন্য রাখিয়াছি। স্বর্ণলতার জন্য ঠিক নহে। তাহাকে প্রশ্রয়ও আমি দিয়াছি। ইহা স্বীকার করি। কিন্তু পাপ অভিপ্ৰায় আমার ছিল না। তাহার কল্যাণের জন্য রাখিয়াছিলাম এবং আমার তাহাতে আনন্দ বলিয়াও রাখিয়াছিলাম। আমার এই আনন্দ তাহার মনে আশা উদ্রিক্ত করিয়া থাকিবে। হাঁ, ইহা স্বাভাবিক।
অঞ্জনাকে এইজন্যই শাস্তি দিতে পারি নাই।
আলফানসো সেই দিন হইতে আর আসে নাই। আমি সন্ধানের জন্য গোয়ানপাড়ার পিদ্রুজকে লাগাইয়া জানিলাম, সে ভীত হইয়াছে। এবং বলিতেছে—সুযোগ পাইলেই সে কলিকাতা হইতে গোয়া পলাইয়া যাইবে। যাইবার পূর্বে তাহার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিলে সে নীলকরদের পত্র লিখিয়া রবিনসন বৃত্তান্ত জানাইয়া দিবে। ইহাই অনুমান করিয়াছিলাম।
অবশ্য কলিকাতায় বা বৃটিশ এলাকায় থাকিতে সে ইহা পারিবে না। তাহা হইলে মামলায় তাহাকেই দণ্ডভোগ করিতে হইবে। আমারও হাঙ্গামা কম হইবে না। কিন্তু আমার অর্থ, আমার সম্মান, গভর্নমেন্ট ঘরে আমাদের রেকর্ড–এ সমস্তই আমার সহায়। আমার অনুকুলে। আমি তাহাতে অবশ্যই উত্তীর্ণ হইব।
তথাপি গোয়ানপাড়ার পিদ্রুজকে বলিলাম- তাহাকে বলিও, এরূপ করিবার চেষ্টা করিলে একজন ইংরেজকে দিয়াই আমি তাহাকে শেষ করাইব। এবং আমিই তাহাকে ধরাইয়া দিব। তদপেক্ষা তাহাকে বল—আমি আবার তাহাকে কিছু টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। সে চিরদিনের মতো বৃটিশ ভারত ছাড়িয়া চলিয়া যাউক। প্রস্তাবে সে রাজী হইয়াছিল এবং অ্যাটর্নী বাড়ীতে নগদ টাকা লইয়া অ্যাটর্নীদের তৈরী একখানি কনফেশন পত্রে সই করিয়া দিয়াছে এই পরশু তারিখে।
আর আজ—আজ দেখিতেছি অঞ্জনা নিরুদ্দেশ।
কাহার সহিত নিরুদ্দেশ ইহা কি আমার নিকটেও প্রশ্ন? না, ইহা আমার নিকট দিবালোকের মত স্পষ্ট। বক্ষের অভ্যন্তরে যেন আগ্নেয়গিরির মত প্রধুমিত।
শাশুড়িকে দেখিয়াই আমার সর্বাঙ্গ যেন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। ইনি—ইনি—ইনিই অঞ্জনার অন্তর্ধানের প্রথম কারণ। ইনিই। এই কলিকাতার আধা ব্রাহ্ম এস-ডি-ও সাহেবের মেমসাহেব, ইনিই প্রথম কারণ। দেবেশ্বরকে অঞ্জনার নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছেন ইনি। সাহেববাড়ীর আয়া আনাইয়া রাখিয়াছেন ইনিই। ইঁহারা স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ে যত বয়স হইতেছে, ততই বেশী করিয়া সাহেব-মেম হইয়া উঠিতেছেন। আমার শ্বশুরই পরামর্শ দিয়াছিলেন আলফানসোকে মাহিনা দিয়া রাখিবার জন্য। হাজার হউক একজন গোয়ানীজ ফিরিঙ্গী, সাদা চামড়া চাকর থাকিবে। শিকার করিবার সময় সাহেবদের মনোরঞ্জন করিবে, তাহা ছাড়া লোকটার মুখ যখন বন্ধ করার প্রয়োজন, তখন তাহাকে নিশ্চয় রাখিবে।
আজ তাহার ফল ফলিল। যাহা হইবার হইয়া গেল। যে পত্রখানি অঞ্জনার শয্যার উপর পাওয়া গিয়াছে, সেই পত্রখানি লইয়া এস-ডি-ও সাহেব-দুহিতা, কীর্তিহাটের বিদ্যাবতী বধূঠাকুরাণী বলিলেন—দেখ, অঞ্জনার কীর্তি দেখ।
এস-ডি-ও মেম বলিলেন—আমি জানিতাম, আমি জানিতাম। সেদিন দেবেশ্বরকে যাহা বলিতেছিল, তাহা হইতেই আমি এমনি একটা কিছু অনুমান করিয়াছিলাম। দারুণ ক্রোধে পত্রখানা হাতে লইয়া সেখান হইতে চলিয়া আসিলাম। এবং স্থির করিলাম শ্বশুরকে লিখিব যে, এই ধরনের ঘন ঘন কন্যার বাড়ী আসাটা তাঁহার মেমসাহেবের পক্ষে মর্যাদাহানিকর হইতেছে।
আমি পত্রখানা পড়িলাম-’আমি আল ফাসোর সঙ্গেই যাইতেছি। তোমাদের অনেক খাইয়াছি পরিয়াছি, অনেক দিয়াছ; গহনা কাপড়; আর কিছু লেখাপড়া শিখিয়াছি, কায়দা কানুন শিখিয়াছি। এবার ক্রীশ্চান হইব। ইংরাজী শিখিব। খাঁটি মেমসাহেব হইব। স্বেচ্ছায় যাইতেছি। এবং লাটসাহেবের কাছে জানাইতেছি যে, আমি ক্রীশ্চান হইতে চাই কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজনেরা বাধা দিতে পারেন বলিয়া হুজুর লর্ডবাহাদুরের শরণাপন্ন হইতেছি।”
সুরেশ্বর বললে—এরপর ডায়রী লিখবার সময় রত্নেশ্বর রায় যেন উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। তখন লিখেছেন—“ইচ্ছা হইতেছে আজই লক্ষ টাকা লাগিলেও খরচ করিয়া আলফানসোকে হত্যা করাইব। ওই গোয়ানপাড়ার পিদ্রুজকে দিয়াই হত্যা করাইব। লোকটাকে কোনমতে মুখ বাঁধিয়া তুলিয়া আনিয়া প্রথমে আঙ্গুল কাটিব, তারপর চোখ দুইটা গালিয়া দিব, তাহার পর জিভটা কাটিয়া দিব। এবং কানেও বধির করিয়া দিব। হত্যা করিব না।”
আবার লিখেছেন—”অঞ্জনাকে পাইলে তাহাকে অন্য শাস্তি দিব না। তাহাকে টাকা-পয়সা সাজ-পোশাক দিয়া সাজাইয়া গরানহাটা সোনাগাছি অঞ্চলের বারবনিতা সাজাইয়া বলিব—এই পথ ছাড়া তোমার পরিতৃপ্তি হইবে না। ইহাই তোমার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম। আমার অভিষেকের দিন একরূপ সঙ্কল্প করিয়া তোমার ভার লইয়াছিলাম। সুতরাং ইহা হউক পাপের পথ, এই পথেই তোমাকে দাঁড় করাইয়া দিয়া কর্তব্য পালন করিতেছি। তাহার কামার্ততার শাস্তিস্বরূপ তাহাকে বহুভোগ্যা করিয়া ছাড়িয়া দিব। বলিব প্রেতিনী তুমি—এই পিণ্ডেই তোমার তৃপ্তি। তাহাই গ্রহণ কর।”
তারপর আবার লিখেছেন—“ইচ্ছা হইতেছে আলফানসোকে টাকা দিয়া ওই আলফানসোভুক্তা স্বৈরিণীকে আনিয়া কীর্তিহাটে সিদ্ধপীঠতলায় বলিদান দিই। এবং মাংস টুকরা টুকরা করিয়া ছড়াইয়া দিই। পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, কুকুর-শৃগাল, শকুনি-গৃধিনীরা খাইয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দিক।”
ডায়রীতেই আছে—পরপর তিনদিনের ডায়রীতে যা রয়েছে, সে যেন কোন হঠাৎ উন্মাদ হয়ে যাওয়া মানুষের ডায়রী। মধ্যে মধ্যে অজস্র কাটাকুটার চিহ্ন। তার মধ্যে পেলাম একজন সহিসের পিঠে দশ কোড়া লাগাবার হুকুম দিয়েছিলেন। তিনজন দারোয়ানের জবাব হয়েছিল। কারণ, রায়বাড়ীর দুটো গেটে দু’জন পাহারা ছিল আর একজন হাতার মধ্যে টহল দিয়ে ফিরছিল। এর মধ্যে থেকেও যখন অঞ্জনা পালিয়েছে, তখন প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব তাদের। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারেনি। বলবে কি, জানতেও কিছু পারেনি, কারণ সদর কোন পথে অঞ্জনা অদৃশ্য হয়নি, সে অদৃশ্য হয়েছিল মেথর যাওয়ার গলি-পথটার দরজা খুলে, সেই গলি পথে পথে। এবং এসে আলফাসোর সঙ্গে মিলিত হয়েছিল একেবারে রিপন স্ট্রীটের ধারে। এ-পথ তাকে বাতলে দিয়েছিল গোয়ানপাড়ার পিদ্রুজের এক চ্যালা গোয়ান। রায়বাহাদুর খুন করেছিলেন একেই।
কিন্তু তারপর এর জন্য যে কঠোর প্রায়শ্চিত্ত তিনি করেছিলেন সে এক পরামাশ্চর্য সুলতা। পরমাশ্চর্য।
তিনি ডায়রীতে লিখেছেন—মানুষের মন যখন নিষ্ঠুর আঘাতে আহত হয়, তখন সে স্বর্গমর্ত- রসাতল পরিভ্রমণ করিয়া ফেরে উন্মত্ত কক্ষভ্রষ্ট উল্কার মত। কোথাও সে আশ্রয় পায় না। কোথাও আশ্রয় পাইলেও, সে তাহা লয় না।
একমাত্র আশ্রয় এবং একমাত্র আনন্দ আত্মনির্যাতনে। এইখানেই পরিত্রাণ আছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া বহুজনকে বা বিশ্ববাসীকে যাহারা দগ্ধ করে, হত্যা করে, তাহারা দানব বা দেবতা। আমি মনুষ্য। আমি স্থির করিলাম—আমার সর্বাপেক্ষা বিলাসের সামগ্রী তাম্রকূট সেবন আমি ত্যাগ করিব।
সুলতা বললে—কিন্তু দেবতা বা দৈত্যের চেয়েও এ-মানুষ ডেঞ্জারাস।
হেসে সুরেশ্বর বললে—ওখানে আমার কোন বাদ-প্রতিবাদ নেই। কিন্তু যে-কথা থেকে এত কথা বললাম সুলতা, সেইটে বলে নিই। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের সেই রাত্রে আমার মনও এমনি করে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বা স্বর্গ-মর্ত-রসাতল ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রসাতলে টানছিল হিলডার চিৎকার।
সে কি অমানুষিক গোঙানি।—
ওই গোঙানি শুনে বিরক্তই হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, হেঁকে দারোয়ানকে বলে দি যে, হিলডাকে বল চুপ করতে, না হলে বেরিয়ে যাক এখান থেকে। এমন করে চেঁচানো চলবে না।
আশ্চর্য সঙ্গে সঙ্গে মনশ্চক্ষে মনে হচ্ছিল একটি তরুণীর মুখ। আজই ভবানীপুর থেকে ফিরে এসে ওকে দেখেছি। ড্রয়িংরুমে আড়াইশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলছিল—তারই পরিপূর্ণ আলোকের মধ্যে দেখেছিলাম কুইনিকে। সেই দিন সকালে, সকালবেলাতেই পাঁশকুড়ায় তাকে দেখেছিলাম, আবার দেখলাম এই রাত্রে ইলেকট্রিক আলোর সামনে।
আশ্চর্য মমতা হয়েছিল তার উপর। গভীর মমতা।
Poor Girl!
ঈশ্বর জানেন, তিনি সাক্ষী, সুলতা, চিত্ত আমার চকিত হয়নি তা নয়, হয়েছিল; কিন্তু সে অত্যন্ত নর্মাল ব্যাপার। কলকাতার রাস্তায় অসংখ্য নারী-পুরুষ চলে পাশাপাশি; ট্রামে-বাসে, পথে-ঘাটে; এর মধ্যে যেমন অহরহ একটা মুহূর্তের ভাল লাগার চকিত তরঙ্গ বর্ষা-রাত্রির জোনাকির মত জ্বলে আর নেভে, নেভে আর জ্বলে, ঠিক তারই মত। তার বেশী কিছু নয়। না, ভুলই বললাম। কুইনি তো জোনাকির মতো হারিয়ে যাবার কেউ নয়। সে থাকে গোয়ানপাড়ায়। তার মায়ের বাপকে রত্নেশ্বর রায় বাড়ী দান করেছেন। নিশ্চয় কোন দেনা ছিল।
সেসব কথা ভেবেই দারোয়ানকে হেঁকে বলতে পারিনি—হিলডাকে বলে দাও, চীৎকার করতে হলে যেন বাইরে গিয়ে করে। বের করে দাও।
কুইনির শান্ত শ্রীময়ী মুখখানিও মনে পড়েছিল। সেটা যেন পুরনো বন্ধনের সঙ্গে একটা নতুন বন্ধনের মত গর্জাচ্ছিল—
দেবেশ্বর রায়ের চিঠি মনে পড়েছিল।
রত্নেশ্বর রায়ের এলিয়ট রোডের বাড়ী দানপত্রের কথা মনে পড়েছিল। বলেছি তোমাকে, সেদিন রাত্রে ভাবনা-চিন্তা আমার যেন স্বর্গ-মর্ত-রসাতল ঘুরে বেড়াচ্ছিল ধূমকেতুর মত অথবা নতুনকালের প্লেনের মত। কখনো ভাবছিলাম—দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কখনো ভাবছিলাম- সমস্ত সম্পত্তি দানপত্র করে দিয়ে রায়বংশের সকল ঋণ শোধ করার কথা। অর্থাৎ চিন্তার প্লেনটা এখুনি ল্যান্ড করে আবার রানওয়ে ধরে ও-মাথায় গিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল। আবার ঘুরে এসে নামছিল। কিন্তু রসাতলের দিকে যখন ওই হিলডাকে উপলক্ষ্যে করে কুইনিকে লক্ষ্য করে নেমে যাচ্ছিলাম, তখন যেন ইন্জিনটি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বিকল হয়ে গেছে, একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে জ্বলে উঠবে দাউ দাউ করে।
হ্যাঁ সুলতা, তুমি যা ভাবছ তাই।
কুইনিকে দেখে সেদিন আমি সত্য সত্যই যেন মুগ্ধ এবং মোহগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে আলাপ যখন হয় তখন তার মধ্যে তোমার শ্রী, তোমার রূপও ছিল। কিন্তু এর চেয়েও বড় ছিল তোমার মনের আকর্ষণ।
কিন্তু কুইনির আকর্ষণের মধ্যে তার শ্রী-রূপ ছাড়াও একটা কিছুর আকর্ষণ আমাকে আগুনের শিখা যেমন পতঙ্গকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি করেই আকর্ষণ করছিল।
সুরেশ্বর যেন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎ উঠে গিয়ে সে ফ্রি ইস্কুল স্ট্রীটের দিকে কাচের জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। তার মনে পড়ে গেছে সেদিনের কথা।
আজ ১৯৫৩ সাল। সেদিন ছিল ১৯৩৭ সাল। সেদিনের চঞ্চলতা যেন আজও তার স্মৃতিকে এবং স্মৃতির সঙ্গে মনকে খানিকটা অস্থির করে তুলেছে। বাইরে নভেম্বরের রাত্রে কলকাতার রাস্তা দোকান আইন সত্ত্বেও জমজমাট রয়েছে। পথে জনতা চলছে। এ জনতা সারাদিন যারা খাটেখোটে, পেটের ধান্দায় ফেরে তারা ঠিক নয়। অবশ্য পেটের দায় সব সময়ই আছে। গভীর রাত্রে যে-হতভাগিনী দেহ বিক্রির আশায় রাস্তার কোন কোণে দাঁড়িয়ে থাকে, সে পেটের দায়েই থাকে। কিন্তু তার থেকেও বেশীসংখ্যক থাকে অন্য একদল মানুষ। যারা রাত্রিকালে জীবনের উন্মত্ত নেশায় পাগলের মত বের হয়। নারীদেহের পর নারীদেহ ভোগ করে যাদের তৃপ্তি হয় না। কেন হয় না তা তারা তো জানেই না। অন্যেও জানে কিনা বলতে পারে না সুরেশ্বর। তবে ব্যাধি বললে মিটে যায় এক কথায়।
আজ তার মনে পড়ল কুইনিকে। সেদিনের কুইনিকে। যার জন্য সেদিন ১৯৩৭ সালের শীতের রাত্রে সে পায়চারি করেছিল এবং পেডি ডগলস বার্জ মার্ডার কেস, অতুলেশ্বরের কেস, ১৮৮৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসে দেবেশ্বর রায়ের অংশগ্রহণ থেকে হিলডার চীৎকারে সে যে কুইনির চিন্তায় এসে পড়েছিল, সেই কুইনিকে আজ আবার মনে পড়ল। কুইনির সেই আকর্ষণ আজ তার মনে পড়ছে।
সুলতা প্রশ্ন করলে—কি হল? বসো! না, ক্লান্তিবোধ করছ? কিংবা?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুলতা উঠে গিয়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে বলেছিল- সুরেশ্বর—
—সুলতা।
—তাহলে কি—তুমি সেইদিন—সেই—সেই—।
বাধা দিয়ে সুরেশ্বর বললে -না-না-না। ছিঃ। এতখানি ছোট তুমি আমাকে মনে কর না সুলতা!
সেদিন আমি সমস্ত রাত্রি ঘুমাইনি। কিন্তু সে শুধু কুইনির তাড়না নয়। আরো ছিল। বলেছি তোমাকে। ১৯৩৭ সাল। ১৯৩০ সাল থেকে পেডি ডগলস বার্জ মার্ডার যেখানে হয়েছে, সেই মেদিনীপুরে থাকতাম আমি। অতুলকাকা ধরা পড়েছে। মেজদিদি অর্চনাকে বাঁচাতে ধরা দিয়েছেন, জেল খাটছেন। বিমলেশ্বর কাকা ওই কাণ্ড করেছেন। আগের দিন রাত্রে অন্নপুর্ণা-মাকে দেখেছি, ফিরবার সময় ময়দানে তখনো জায়গায় জায়গায় লোক জমায়েত দেখেছি। সেদিন কেউ তাই পারে? না তা নয়। তবে হাঁ, তার আশ্চর্য আকর্ষণ আমি সেদিন অনুভব করেছিলাম। আশ্চর্য! অর্চনা, মেজদি, অতুলেশ্বর, বিমলেশ্বর এরা চারজনে চারদিকে ঘিরে আমাকে বোধহয় বাঁচিয়েছিল সেদিন।
নিচে হিলডা চিৎকার করেছে, আমি ঠিক এইখানে এই কাচঘেরা বারান্দায় পায়চারি করেছি, কখনো দাঁড়িয়ে থেকেছি। ইচ্ছে হয়েছে নিচে যেতে কিন্তু পারিনি। তার কারণ ওই চারজন। এবং আরো একজন—সে হল রঘু চাকর। সে তো আমি না ঘুমুলে ঘুমোয় না। পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল এরা।
যেন বলেছিল—না-না-না। নিচে নেমো না। নামতে গেলে বাকি থাকবে না। নতুন কাল এসেছে। পাল্টেছি, পাল্টাচ্ছি, রায়বাড়ীর আমরাও পাল্টাচ্ছি। এসময় আর নিচে নেমো না।
কথাগুলো শুনতে বোধহয় তোমার সেন্টিমেন্টাল বা ইমোশনাল মনে হচ্ছে, তা হতে পারে। এবং সত্যও তাই। কিন্তু এই সেন্টিমেন্ট আর ইমোশন এই দুটোই সংসারে অঘটন ঘটায়, চিরকাল ঘটিয়ে আসছে, আজও ঘটাচ্ছে, সেদিনও ঘটিয়েছিল।
কুইনি একলা জেগে বসে আছে, তা যে-কেউ অনুমান করতে পারে, হিলডার ওই চীৎকার এবং যন্ত্রণা দেখে সে নিশ্চয় ঘুমোয়নি।
ভোরবেলার দিকে হিলডার চীৎকার একটু কমে এসেছিল—আমারও একটু তন্দ্রা এসেছিল। রঘু আমাকে ডাকলে।
—লালবাবু!
তন্দ্রা ভেঙে গেল। বললাম-কি? এখন চা খাব না, যা।—
রঘু বললে—না লালবাবু, ওই গোয়ানপাড়ার ওই লেড়কীটি—ওই কুইনি আপনার সাথ দেখা করনেকে মাংছে। হলদী বুড়ীর বহুৎ বেমার।
চমকে উঠলাম। কুইনি?
—হাঁ লালবাবু, ছোকরি কাঁদছে।
—কাঁদছে? কোথায়?
—সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। বললে-রাত্রে আরো দু-দুবার সে বাবুজীর কাছে আসবার জন্য এসেছিল কিন্তু ডাকতে সাহস করেনি।
আমি চমকে উঠলাম। কুইনি রাত্রে আরো দুবার আসতে গিয়ে ফিরে গেছে? বুকটাও কেমন করে উঠল।
রায়বংশের ছেলে আমি এবং ১৯৫৩ সালে জমিদারী উচ্ছেদের রাত্রে বলছি তোমাকে; কথাটা তুমি দুই অর্থে ধরে নিতে পার। বুকটা চলকে ওঠার হেতু কিছু ছিল না। কারণ, কুইনি কাঁদছিল, তবু রক্ত। রায়বংশের রক্ত সুলতা। অথবা বলতে পারো মানুষের রক্তের কীর্তিনাশা ধারা। জান্তব জীবন থেকে উদ্ধার করতে বহু তপস্যা করে মর্তে গঙ্গা এনেছিলেন ভগীরথ। সাগরের কাছাকাছি এসে গঙ্গা ভুল করে পথ হারাল। মানুষই তাকে ভুল পথে নিয়ে গেল। অথবা বলতে পার, ওইটেই তো স্বাভাবিক ক্রমনিম্নতা। জলের স্বভাববশে ওই পথেই তো যাবার কথা। তাই গিয়েছে। তবে বিষ্ণুপদের মহিমা আছে, সেখান থেকে ঝরা জল; তেমনি মানুষের সাধনারও মহিমা আছে, সেই সাধনার বলে কীর্তিনাশাকে বাঁয়ে সরিয়ে পতিতোদ্ধারিণী সাগরসঙ্গমে গেছেন, মানুষের মনুষ্যত্ব—গত দশ-বারো বছরের যুদ্ধ, কালোবাজার, তারপর স্বাধীনতার পর আমাদের বিজয়াদশমীর দিনের মদ খেয়ে উন্মত্ত উলঙ্গ নৃত্যের মধ্যেও মনুষ্যত্ব কিছুটা থাকে, মরে না, একবারে মরে না। সেদিনও আমার মনুষ্যত্ব ছিল। রায়বংশের রক্ত হলেও তার মধ্যে বেঁচে ছিল।
ঘরের দরজা খুলে দেখলাম কুইনি দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটি রাঙা, বুঝলাম অনেক কেঁদেছে। জিজ্ঞাসা করলাম—কি হয়েছে কুইনি?
—বুড়ী দিদিমা—আর বলতে পারলে না।
—কি হল? সারারাত্রি তো চিৎকার করছিল। এই তো কিছুক্ষণ আগেও শুনেছি।
—হ্যাঁ স্যার। কিন্তু হঠাৎ মুখ খুলতে পারছে না—গোঙাচ্ছে। কি রকম হয়ে গেছে।।
—চল দেখি। ভয় কি, একটু বেলা হলেই ডাক্তার ডেকে পাঠাচ্ছি। আসবে, দেখবে ওষুধ দিলেই ভাল হয়ে যাবে। হাঁটুটা বোধ হয় পেকে উঠে থাকবে।
—হ্যাঁ খুব ফুলেছে।
ঠিক এই সময় একখানা ঘোড়ার গাড়ী ঢুকল বাড়ীর ফটকের মধ্যে। এই মুহূর্তেই এলেন অন্নপুর্ণা-মা। অবশ্য আমি সঠিক অনুমান করতে পারিনি যে, এ একেবারে খোদ অন্নপূর্ণা-মা এবং রথীন। তবে ভেবেছিলাম, কম্পাস গাড়ী যখন, এ ভবানীপুরের মুখুজ্যেবাড়ির গাড়ী। হাইকোর্টে ১৯৩৭-৩৮ সালেও এক ঘোড়া দিয়ে টানা পাল্কীগাড়ীর অনেক ভিড় ছিল। ওদের বাড়ীতে তখন ঢুকি বিকেলবেলা, তখন গাড়ীটা দাঁড়িয়ে ছিল। কালো ঘোড়াটার কপালে সাদা দাগটা ভাল লেগেছিল বলে চেনা হয়ে গিয়েছিল।
গাড়ীটা দাঁড়াল, আমি চমকে উঠলাম। একি, ভিতরে খোদ অন্নপূর্ণা দেবী, বড়-মা? আর ও কে? রথীন?
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে গাড়ীটার পাদানের সামনের অংশটা খুলে দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম—বড়-মা!
চিবুকে হাত দিয়ে হাত মুখ ঠেকিয়ে বড়-মা বললেন-প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কাশী যাব ভোরে উঠে। ও-বাড়ীতে আর থাকব না। মা যে-বাড়ীতে দেহ রেখেছেন, সেই বাড়ীতে দেহ রাখব। ওরে মাঝরাতে দেবু এসে যেন আমাকে ডাকলে। সেই বাঁকা বাঁকা হেসে বললে-হেরে গেলে তো। আমার মত পিসি হারতে হয়। জেতা যায় না গো। আমি উঠে বসে ঝি-চাকরদের ডেকে জিনিস গুছাতে বল্লাম—আমি হার মানব না। চলে যাব কাশী। কিন্তু ভোরবেলা রথীন গোলমাল লাগালে। পায়ে জড়িয়ে ধরে বললে—হ্যাঁ, আমি বিয়ে করব, করব, করব। তুমি বাড়ী ছেড়ে যেয়ো না।
গোলমাল হয়ে গেল সব। তা বললাম—আগে চল তাহলে গঙ্গাস্নান করে আসি রাণী রাসমণির ঘাটে, আর বলে আসি সুরেশ্বরকে
বলতে বলতে নামলেন তিনি। আমার ঘাড়ের উপর হাতের ভর দিয়ে। আশী বছরের কাছে বয়স কিন্তু বড়-মা বেশ শক্ত ছিলেন। চোখে তাঁর চশমা লাগত না। তাঁর পিছনে পিছনে রথীন। রথীনকে পেয়ে বেঁচে গেলাম। অর্চনার সমস্যার সমাধান তো হলই, হিলডাকেও দেখাতে পারব। সে ডাক্তার।
বড়-মা নেমেই বললেন—তোর মায়ের ঘরে চল। যে-ঘরে তোর মা শেষকালটা থাকত। আমি শুনেছি, আমি তোদের সব খবর নিই রে, বিশেষ করে দেবুর গুষ্ঠীর। তোর মা বড় পবিত্রভাবে থাকত। সেই ঘরে চল। বলতে বলতেই তিনি বললেন-এ মেয়েটি কে রে?
অর্থাৎ কুইনি। সকালের সদ্য ওঠা রোদটা কুইনির মুখের উপর পরিপূর্ণভাবে পড়েছিল। তার রুক্ষ চুলের মধ্যে ঈষৎ পিঙ্গলাভা, রঙের মধ্যে চাপা পর্তুগালের রঙের আভাস, কালো চোখ এবং সে চোখ-দুটি তার বিচিত্র ডাগর, আয়ত, পটলচেরা, হরিণচোখ এ-সবের কোনটা নয় কিন্তু চোখদুটি আশ্চর্য কালো এবং আশ্চর্য গড়ন, বিশেষ করে চোখের পাতার চুলগুলি। এবং সমস্ত জড়িয়ে একটি বিষণ্ণ মহিমা ফুটে উঠেছিল। নির্বাক হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল। আমি দেখতে যাচ্ছিলাম হিলডাকে, তাতে বাধা পড়ল, তাতে তার চোখেমুখে একটি বিরক্তির রেখা ফুটল না। তার দিকে চোখ পড়া স্বাভাবিকই ছিল। রথীনও তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি বড়-মার কথার উত্তরে বললাম—ওদের বাড়ী এখন একরকম কীর্তিহাট বড়-মা। এখানে এসে বিপদে পড়ে গেছে, দিদিমাকে নিয়ে কাল রাত্রে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল—
কথায় বাধা দিয়ে বড়-মা বললেন—কাদের মেয়ে গো তুমি—হ্যাঁ মেয়ে?
বিনম্রভাবে নমস্কার করে কুইনি বললে-নমস্কার মা। আমি গোয়ানপাড়ায় ছিলাম। আমি ওদের।—
—গোয়ান? ও মা! গোয়ানরা এখন এইরকম হয়েছে নাকি রে? অ্যাঁ? এ যে কলেজে পড়া মেয়ে-টেয়ের মত! অ্যাঁ, আগে সেই লম্বা গাউনের মত ঢিলে পা পর্যন্ত জামা পরে ঘুরত–।
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। বললেন—উঁ? কাউকে যেন কিছু প্রশ্ন করলেন। সম্ভবত নিজেকেই।
কুইনি বললে—আমি ওখানকার মেয়ে নই মা। আমি কলকাতার মেয়ে। তবে গোয়ানপাড়ার ওরা আমাদের আত্মীয়। খুব আপনজন।
—তাই বল। কলকাতার মেয়ে তুমি।-ওরে রথীন, চশমাটা দে তো। দেখ তো ওই ভিজে কাপড়ের ঝোলাটার মধ্যে থাকবে। দে তো!
চশমাটা চোখে দিয়ে খুব ভাল করে কুইনিকে দেখতে লাগলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম সুলতা। আমার পাপবোধই বল আর যাই বল মনে হচ্ছিল, অন্নপূর্ণা দেবী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজছেন–হয়তো বা আমারই স্পর্শের ছাপ বা চিহ্ন কিছু খুঁজছেন।
সেইজন্য আমিই কৈফিয়ৎ দিলাম নিজে থেকে—মেয়েটির মায়ের দরুন একটা বাড়ী ছিল কলকাতায়, সে-বাড়ী নাকি আমাদেরই দান করা ওদের পূর্বপুরুষকে। সেই বাড়ীতে থাকত ওরা। ওর বাবা ছিলেন আমাদের দেশী ক্রীশ্চান—মুখার্জি; ওর মা ছিলেন গোয়ান মেয়ে। হঠাৎ দুজনেই মারা গেলেন একসঙ্গে বছর দেড়েক আগে, মেয়েটিকে গোয়ানপাড়ার হিলডা পিদ্রুজ বলে একটি বৃদ্ধা মহিলা আছেন—
—হলদী? হলদী?—সে তো আমার থেকে ছোট। তা অবিশ্যি এখন বুড়ী হবে বই কি! হলদী বলতাম আমরা। ছোট্ট মেয়েটা। সে বেঁচে আছে? আর কালীপুজোর সময় যখন যেতাম, তখন আসত আমাদের কাছে। তারপর হঠাৎ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—হ্যাঁ, দাদা একখানা বাড়ী দিয়েছিলেন ভায়লেট বলে একটা মেয়েকে। সে অনেক কাণ্ড। অনেক।—
আমি চুপ করে শুনছিলাম, উনি থামতেই বললাম—ওদের সেই বাড়ী, জ্যাঠামশায়ের তরফ থেকে ওঁর ছেলেরা ওদের বেদখল করে দিয়েছে। ভাড়াটেদের কাছে ভাড়া তারা আদায় করছে। খবর পেয়ে হিলড়া এসেছিল কুইনিকে নিয়ে। তা কাল ঝগড়া করে হাঁকিয়ে দিয়েছে, হিলডা ও গালাগাল করেছিল, তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। গোটা হাঁটুটা জখম হয়ে গেছে। ছাল-চাপড়া তো উঠেছেই, আর কি হয়েছে জানি না। কাল ও-বাড়ী থেকে এসে দেখি ওরা কোথাও আশ্রয় না পেয়ে এখানে এসেছে। ওই নীচের পূর্বদিককার একখানা ঘরে আছে। বেচারি সারারাত্রি যা চিৎকার করেছে যন্ত্রণায় যে, সে আর বলবার নয়। তাই সকালেই মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল খবরটা বলতে। তা রথীনবাবু এসেছেন ভালই হয়েছে। একবার দেখুন তো ভাই কি হয়েছে।
—টিটেনাস-ফিটেনাস নয় তো? ক’ঘণ্টা হল? মানে চোটটা লেগেছে কখন?
কুইনি এবার বললে—কাল বেলা তিনটের সময়। দিদিয়া বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে চীৎকার করছিল-রায়বাবু ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন উঠোনের উপর।
বড়-মা ফোঁস করে উঠলেন—রায়বাবু?—কে?—কোন্ রায়বাবু?
কুইনি উত্তর দিলে না, আমি বললাম—প্রণবেশ্বরদা। জ্যাঠামশায়ের ছেলে।
—যজ্ঞেশ্বরের ছোট ছেলেটা—রাস্তার উপর যেটার গাড়ী আটকে কান মলে কাচ্ছি কয়লাওলারা গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়ে দেনার জন্যে গাড়ী কেড়ে নিয়েছে, সেইটে?
আমি চুপ করে রইলাম।
বড়-মা বললেন—তুই যা রথীন, হলদীকে দেখে আয় কি হয়েছে। না, দাঁড়া, আমিও যাব। একবার দেখব হলদীকে।
***