চতুর্থ খণ্ড
2 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ১৮

১৮

এই অন্নপূর্ণা দেবী সুলতা। ১৯৩৭ সালেও তিনি বেঁচে, বয়স তখন তাঁর পঁচাত্তর। এখনো এ-বাড়ীর সর্বময়ী তিনি। তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন পরমহংসদেবের কাছে। গোটা বাড়ীটাই বেলুড়মঠের শিষ্য। ভবেনবাবু নিজে স্বামীজী বিবেকানন্দের সঙ্গলাভ করেছেন।

অন্নপূর্ণা দেবীর উপর কথা নেই।

আজও এস্টেট তাঁর নামে। গোটা সংসারের খরচ, খাওয়াপরা, ছেলেদের লেখাপড়া, কাপড়চোপড়, চিকিৎসা এসব তাঁর হাতে। ছেলে ভবেন্দ্র মারা গেছেন পঞ্চাশ বছর বয়সে। নাতিরাও সেই নিয়মে চলে। নাতিদের উপার্জন থেকে একটা করে টাকা তাঁকে দিতে হয়। সেটা জমা হয় এস্টেটে। এখনো নিত্য তরকারি কোটার বঁটি নিয়ে বসেন। পাশে বসেন তিন নাতবউয়ের একজন এবং বিধবা বউ। তিনি বলে দেন—এই রান্না হবে, এই কোটো। আলু এত বড় করে কুটো না। দু ভাগ নয় চার ভাগ কর।

সুলতা বললে—দুর্দান্ত মহিলা।

সুরেশ্বর বললে—হ্যাঁ তা বটে। তিনি খবর পেয়েই আমাকে ডেকে পাঠালেন। নগেনকাকা নিজে উপরে উঠে গিয়ে ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করে বললেন—চল, ওপরে চল। ঠাকুমা ডাকছেন।

আমি তাঁর পিছনে পিছনে পেলাম।

তিনি সেই ফটোটা হাতে দাঁড়িয়ে, দেওয়ালে টাঙানো ভবানী দেবীর অয়েল পেন্টিংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলেন। একেবারে যেন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন।

নগেন কাকা গলার সাড়া দিয়ে ডাকলেন—ঠাকুমা।—

শুনতে পেলেন না তিনি। আবার ডাকলেন নগেন কাকা—ঠাকুমা।—

মুখ ফেরালেন তিনি। দেখলুম পুরু চশমার অন্তরাল থেকে দুটি জলের ধারা নেমে এসেছে। তিনি কাঁদছেন।

সুরেশ্বর বললে-অর্চনার ফটোর সঙ্গে নিজের মায়ের অয়েল-পেন্টিংয়ের এমন সাদৃশ্য দেখে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ঘুরে আমাকে দেখে বললেন-এস। তারপর আবার একবার ছবির সঙ্গে ফটোটা মিলিয়ে দেখে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর একটু হাসলেন। সে-হাসির অর্থ ঠিক বুঝলাম না। শুধু হাসি নয়, ঘাড় নাড়লেন, যেন বললেন—হায় হায়! নাতির দিকে একবার চাইলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন—এই ফটোর সঙ্গে মেয়েকে একবার মিলিয়ে দেখব, বুঝলে বাবা। যদি ঠিক এমনি হয়, তবে এ-মেয়ে আমি নিলাম।—কার মেয়ে বলছ?

এমনটা আমি ভাবতে পারিনি। অর্থাৎ এত সহজে এক কথায়! তারপর বললেন —নগেন? আমি তো বললাম—তুই—

—ঠাক্‌মা, আজ একথা কেন বলছ?

—বলছি। তুই হাজার হলেও ছেলের বাপ। বলে আবার একটু হাসলেন। বললেন—দেখ, ভবেনকে বাপের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে দিইনি। আমিও রাখিনি। কিন্তু ভবেনের বিয়ের সময় তোর মাতামহকে বলেছিলাম—তাঁর কাছে যাও। তুই ছেলের বাপ, মনে মনে হবে যে, ঠাকুমা-বুড়ী মরেও মরে না—বাহাত্তুরে ধরেছে। একবার আমার মতটাও চাইলে না। তারপর—। কার মেয়ে বললে?

আমি বললাম—জগদীশ্বরকাকার মেয়ে।

—জগদীশ্বর? শিবেশ্বরের মেজ ছেলে? যেটা গাঁজা খায়, মদ খায়, একটা বাঘ মেরেছিল, সেইটের?

তাঁর মুখ দেখে কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম-আজ্ঞে শুনেছি, খান। আপনার কাছে মিথ্যে কি করে বলব?

—তাহলে তো টাকা-পয়সা খরচের ক্ষমতাও তার নেই।

—বড়মা, আমি একটা কথা বলব?

—কি বললি? বড়মা? হুঁ। যোগেশ্বর সাহেবের ছেলে হয়ে শিখলি কি করে রে? অ্যাঁ!—কে শিখিয়েছিল—মা? তা তোর মায়ের শ্রাদ্ধের সময় একবার খবর দিলিনে তুই হারামজাদা?

চুপ করে রইলাম। কিন্তু ভারী মিষ্টি লাগছিল। বললেন—বল, কি বলবি?

বললাম—অর্চনার বিয়ের ভার আমি নিয়েছি বড়মা। যা চাইবেন আমি দেবো।

—এ-মেয়ের বিয়ের ভার তুই নিয়েছিস?

—হ্যাঁ বড়মা, টাকার জন্যে মেয়েটিকে একজন দোজবরে পুলিশ দারোগার হাতে দেবার ঠিক করেছিলেন ওর বাবা। আমাকে মেজঠাকুমা জেলে যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন—তুই ওর বিয়ের ভারটা নিস। ভাল ঘর-বর দেখে বিয়ে দিস।

—মেজ-বউমা মানে শিবেশ্বরের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী, যে জেলে গেছে?

নগেনকাকা বললেন—হ্যাঁ ঠাকুমা, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের কীর্তিহাটের জমিদারী কেল্লার ফাটল দিয়ে দেশের হাওয়া ঢুকেছে। মেদিনীপুর তো। অতুলেশ্বর—শিবেশ্বরকাকার দ্বিতীয় পক্ষের ছোট ছেলে, একটা স্বদেশী কেসে ধরা পড়েছে। তার সঙ্গে খুড়ীমা গেছেন। ছেলেটিকে তিনি মানুষ করেছিলেন, সে রিভলবার রাখতে দিয়েছিল মাকে।

—ওরে আর দুখানা আসন দে তো! দাঁড়িয়ে থেকে কোমর ধরেছে। আমি আসনে বসছি—ওরা তো ওপরে বসবে না!—

আসনে বসে আমার কাছে সব শুনে বললেন আশ্চর্য। বংশের প্রায়শ্চিত্ত করলে শিবেশ্বরের এক ছেলে! যার বড় ছেলে মাতাল, মেজটা গাঁজাল-মাতাল, সেজটা ছিল জোচ্চোর। তার ছোট ছেলে। একটা খবর দিলিনে রে নগেনকে?

—না ঠাকুমা। ও খুব বড় ব্যারিস্টার দিয়েছিল।

—তা দিক। তুই যেতিস। আমি খুশী হতাম।

আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন–বোস্‌, আমি আসছি।

নগেনকাকা বললেন—কাল সকালেই একবার এস। রথীনের সঙ্গে দেখা করে যাবে। তাকে একবার দেখাও হবে, আলাপ করেও যাবে। তার ঘরে তোমার আঁকা একখানা ছবি আছে। তোমার মায়ের শ্রাদ্ধের পর ছবির একবিজিশন করেছিলে, সে দেখতে গিয়েছিল—ইনকগনিটো অবশ্য, আলাপ করেনি। একখানা ছবি সে কিনে এনেছিল।

আমি লজ্জিতও হলাম, আবার খুশীও হলাম।

ইতিমধ্যে বাড়ীর ভিতর দিক থেকে অন্নপূর্ণা দেবীর রূঢ় কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল-বউমা, তোমারও কি আক্কেল-বুদ্ধি সব গেছে। সব হারিয়েছ? যোগেশ্বরের ছেলে এসেছে। তুমি একবার বের হলে না। এখনো জলখাবার পাঠাও নি। ছি-ছি-ছি!

—এই তো যাচ্ছি মা! আমি একা যে বাড়ীতে।

—কেন, নাত-বউরা গেল কোথায়? আমার নগেন্দ্রাণী কোথায়? বাড়ীর বড়বউ-

—তারা আজ থিয়েটার দেখতে গেছে মা।

—থিয়েটার দেখতে? তারপরই বললেন—ও, হ্যাঁ। আমাকে বলেছিল বটে! হ্যাঁ, বলেছিল। সুরেন নিয়ে গেছে তো!

—হ্যাঁ।

—ওই আমার আর সব মনে থাকে না। তা তোমার হল?

—এই যে।

তারপরই পায়ের শব্দ পেলাম। এবং ঘরে এসে ঢুকলেন অন্নপূর্ণা দেবী আর তাঁর বিধবা পুত্রবধূ, সম্পর্কে আমার ঠাকুমা–ভবেন্দ্রনাথের স্ত্রী। থান কাপড় পরা, মাথার চুল ছোট করে কাটা, ছোটখাটো মানুষটি। এককালে সুন্দরী ছিলেন। পিছনে ঝি, তার হাতে জলের গ্লাস। আমার সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন—ভাল আছ ভাই?

আমি সসম্ভ্রমে উঠে তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি বললেন—চিনতে পারছ আমাকে? বললাম—হ্যাঁ। আপনি আমাকে একটা ভারী সুন্দর পুতুল দিয়েছিলেন। মার্বেলের ভেনাস। সেটা ঠাকমা আমার এখনো আছে।

—আছে? কি বলেছিলাম বল তো?

—বলেছিলেন—এই তোমার মেম বউ! বড়মা বকেছিলেন।

কথাটায় বাধা দিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। বললেন —থাক।

সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম বাবার কথা।

ওঁরা কি ভেবেছিলেন তা বলতে পারব না। পরে বুঝেছিলাম—তা পরেই বলব। একটুখানি স্তব্ধতার পর অন্নপূর্ণা দেবী বললেন—রথীনের জন্যে এই মেয়ে আমি নিলাম বউমা।

—এতে আর আমি কি বলব?

—নগেনও তাই বলেছে।

—বলবে বইকি। তাছাড়া এ তো দেখছি উনিই একেবারে।

—হ্যাঁ। তবে বাপ গরীব হয়ে গেছে। তা এ-ছোঁড়াটা তো বড়লোকের বেটা বড়লোক, বলছে টাকাকড়ি ও-ই দেবে। আগের কাল হলে কান মুলে দিতুম। শোন—বিয়ের খরচ তুই করবি, বরযাত্রী খাওয়ানো আর পাত্রাভরণ। ওটা তুই দিবি। মেয়ে আমি সাজিয়ে নেব।

আমি ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলাম। মুখ তুলতেই তিনি আমার চিবুকে হাত দিয়ে হঠাৎ জ্বলে গেলেন। বললেন—হ্যাঁরে, তখন থেকে বলব বলব করে বলতে ভুলছি—কথার পিঠে কথা এসে পড়ছে। বলি একি রে? এই জঙ্গুলে দাড়ি রেখেছিস কেন রে? বাপ রেখেছিল ফ্রেঞ্চছাঁট, তুই রেখেছিস লম্বা-দাড়ি। একমুখ জঙ্গল। কেন?

তাঁর পুত্রবধূ আমার ঠাকুমা—নগেনবাবুর মা হেসে বললেন—নাতি খুব খেয়ালী মা। ওর যখন যেটা খেয়াল হয়।

—আমি তো জানি গো সব। ওরা খবর রাখে না- আমি খবর রাখি। মহাবীর দারোয়ান এই তো বছর কয়েক মারা গেছে। মহাবীর তো মধ্যে মধ্যে আসত। দিদি বলত আমাকে। তারপরও খবর নিই। জানবাজারে লোক পাঠাই। কীর্তিহাটের দয়াল আমার থেকে ছোট। শিবেশ্বরেরও ছোট। কীর্তিহাটে যখন যেতুম কালীপুজোর সময় তখন তাঁকে পাঁচ-ছ’ বছরের দেখেছি। কলকাতার এ বাড়ীতে প্রথম প্রথম দয়াল আসত। প্রথম এসেছিল তাঁর মেয়ের বিয়ের সময়; সেকালে তো বিয়ের পণ হয়েছিল বারশো টাকা। তা কীর্তিহাটের বাড়ী থেকে ওকে পাঁচশো টাকা দিয়েছিল। দেবেশ্বর আড়াইশো, শিবেশ্বর আড়াইশো, রামেশ্বর তো তখন বিলেতে। দয়ালের নিজের ছিল শ-চারেক টাকা; বাকীটার জন্যে আমার কাছে এসেছিল, তখন তো ভবেনের খুব নাম! আমি দয়ালকে আড়াইশো দিয়ে বলেছিলাম—পণ ছাড়াও তো খরচ আছে দয়াল। তা দেখ, দয়াল সে-আমলের লোক তো, মিথ্যে বলতে বাধত, বলেছিল—দিদি মিথ্যে বলব না, সে আমার আছে; মাছ-কাঠ এ পাব তোমাদের বাড়ী থেকেই। আমার অভাব একশো টাকার। আর মেয়ের ইচ্ছে একখানা বালুচরের রেশমী শাড়ীর। তার দাম আর কত। ওই বিশ টাকাতেই খুব ভাল হবে। আমার কাছ থেকে একশো পঁচিশের বেশী নেয়নি।

নগেনবাবুর মা বললেন—আমি তাঁকে দেখেছি মা। কী ভাল গান গাইতেন! আর কী আমুদে লোক ছিলেন—সেই গানটা আমার আজও মনে আছে মা! সেই যে যেবার হাতে জুতো নিয়ে ছাতা মাথায় বোশেখ মাসের দুপুরবেলা এসেছিলেন, দারোয়ান ঢুকতে দিচ্ছিল না—।

হেসে উঠলেন অন্নপূর্ণা দেবী, বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাগ্যে আমি বারান্দায় বেরিয়েছিলুম। হ্যাঁ, আমি বললাম—ওকি, দয়াল জুতো হাতে কেন? বললে—পায়ে ফোস্কা পড়েছে। গান গেয়ে বলেছিল।

—আমার সে-গান আজও মনে আছে। আপনি বললেন—ওকি রে, জুতো হাতে কেন? তো সঙ্গে সঙ্গে গান বেঁধে কেত্তনের সুরে গেয়ে বললেন—

“ভাস্করেরই করো, অতীব প্রখরো,
ফোসোকা পড়িল পায়।
দারোয়ানে দ্বার, রুখিয়া হুঙ্কার
ভয়েতে পরাণ যায়!”

—হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ। তোমার তো খুব মনে আছে বউমা। আমরা খুব হেসেছিলাম। নতুন জুতো কিনে দিতে চেয়েছিলাম, তা চটি ছাড়া নেয়নি। বলেছিল—দিদি, কীর্তিহাটের মাটিতে হাঁটি খালি পায়ে, ফাটা চরণ, এতে কি জুতো চলে-দেবে তো চটি দাও।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা! দয়াল-বৃদ্ধকে দেখেছি, তাঁর কাছে গল্প শুনেছি, তিনি আমার জ্বরের সময় হাত দেখতে এসে সোমেশ্বর রায়ের বজরার আসরের গল্প বলতেন। তাঁর শোনা গল্প। চিরকাল রায়বাড়ীর কাছে কৃতজ্ঞ। যদুরাম রায়ের স্বাক্ষর করা ছাড়পত্র তাঁর কাছে দেখেছি। এই বিমলেশ্বর কাকার গ্রেপ্তারের দিনও এসে কেঁদে গেছেন, কিন্তু এমন পরিচয় পাইনি। সম্ভবত বয়সের সঙ্গে হারিয়ে গেছে।

তাই সবিস্ময়ে শুনছিলাম, তাঁর আর এক কালের আর এক রূপের কথা!

সেদিন অন্নপূর্ণা দেবী বললেন—“দয়াল এখনো চিঠি দিলে উত্তর দেয়, তার কাছে খবর পাই। শিবেশ্বরের আমলে একবার ওর তৃতীয় পক্ষের বিয়ের খবর পেয়ে আমি শিবেশ্বরকে খুব কড়া করে চিঠি লিখেছিলাম। গালাগাল দিয়েছিলাম। লিখেছিলাম—“দয়ালের পত্রে সংবাদ পাইলাম যে, তুমি আবার এই বয়সে দুই পক্ষের ছয়-ছয়টি পুত্র এবং পাঁচটি কন্যা থাকিতেও আবার বিবাহ করিয়াছ একটা পুরুতের মেয়েকে। পৌত্র হইয়াছে, পৌত্রী হইয়াছে, কয়েকগণ্ডা দৌহিত্র-দৌহিত্রীও হইয়াছে। তৎসত্ত্বেও এই মতিচ্ছন্ন তোমার কেন হইল তাহা জানি না। রায়বংশকে ভিক্ষুক করিয়া ছাড়িলে তুমি।”

শিবেশ্বর উত্তর দেয়নি। দয়াল দিয়েছিল পত্র। লিখেছিল, ‘দিদি, আপনি আমার নাম করিয়া মেজ-রায়কে পত্র দিয়াছেন, তাহাতে আমার আর লাঞ্ছনার বাকী নাই। অতঃপর আপনাকে আমি নিয়মিত সংবাদ দিয়া খবরাদি দিব। আমাকে আপনি পত্র দিবেন না বা মেজ-রায়কে পত্র দিবেন না। তাহা হইলে আমাকে গ্রাম ত্যাগ করিতে হইবে।” দয়াল আমাকে পত্র দেয়। তোর খবরও আমি জানি! তুই সেটেলমেন্টে গোচর বাস্তু নাখরাজ দিয়েছিস, তুই গোয়ানদের গোয়ানপাড়া নিষ্কর দিয়েছিস, তাও লিখেছে। লিখেছে—’দিদি, যোগেশ্বরের পুত্র এই সময় আসিয়া রায়বংশের সরোবরের পঙ্কোদ্ধার করিয়াছে। চারিদিকে রায়বংশের নাম উজ্জ্বল হইয়াছে নহিলে শিবেশ্বরের সেই দৈত্যের মত পাগল পুত্রের কীর্তির পর রায়বংশ- সরোবর নরককুণ্ড আখ্যা পাইয়াছিল।’

গম্ভীর হয়ে গেলেন অন্নপূর্ণা দেবী। বোধহয় সেই ঘটনা মনে পড়ল তাঁর। তারপর বললেন—সবই কর্মফল আর অদৃষ্ট, তাছাড়া আর কি? আমার মাতামহের ওই যন্ত্রণা ওই তপস্যা সব ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছিল তাঁর জীবনে। আমি ভাবি কি জানিস? আমি ভাবি—ওই আমার মাতামহের ওই পাপ… ওই শিবেশ্বরের ছেলেটা হয়ে এসেছিল।

এরপর সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমিও চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নগেনবাবু মনে করিয়ে দিলেন সময়ের কথা। বললেন আমাকে। বললেন—রাত্রি তো অনেক হয়ে গেল, শীতকাল সাড়ে ৮টা বাজল। তা সুরেশ্বর তুমি আজ এখানেই খেয়েদেয়ে যাও। ঠাকুমা—

যেন দুঃস্বপ্নের ভঙ্গ হল তাঁর। তিনি বললেন-তাই তো যাবে। এর আর নেমন্তন্ন করতে হবে নাকি? ঘরের ছেলে!

নগেনবাবু আবহাওয়াটা গরম করতেই বোধহয় বললেন—তা আজ ওকে ঘরের ছেলে বললে হবে না ঠাকমা।

—কেন? কুটুম্ব?

—তাই বা কেন? ও আজ তোমার নাতির বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে, দেশজুড়ে কনে দেখে পছন্দ হচ্ছে না যখন, তখন এমন কনে ও এনেছে যে, তুমি যে-মেয়েটি চাচ্ছিলে, ঠিক তাকেই এনেছে। ওকে নেমন্তন্ন কর। খাতির কর।

হঠাৎ দুহাতে আমার গালদুটি চেপে ধরে বললেন অন্নপূর্ণা দেবী-শুধু তাই নয় নণ্ড, এর চেহারা আর আমার দেবুর চেহারা এক, একরকম। ঠিক যেমন এই মেয়েটি–কি নাম-

—অৰ্চনা। তা বেশ নাম। ভালো নাম। অর্চনা মানে পূজা। বললেন নগেনবাবুর মা!

—হ্যাঁ। অর্চনা আর আমার মায়ের চেহারা যেমন একরকম, ঠিক সেইরকম। ছেলেবেলায় তাই মনে হত। ওকে আমি ভেলভেটের জরিওয়ালা পোশাক-পাগড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দেখেছি আর কেঁদেছি।

চোখের জল মুছে বললেন—শোন রে, পিসির কথা শোন। তুই আমাকে বড়মা বলবিনে। বলবি অন্নপিসি। তা না পারিস তো বলবি বড়পিসি। দেবু কীর্তিহাটে প্রথম মানুষ হয়েছিল, আমাকে পিসিমা বলত না, বলত অন্নপিসি। শোন, আজ খাবি তো এখানে নিশ্চয়। কাল সকালে উঠে দাড়ি কামিয়ে ফেলবি। নও, আমি তো পুজোয় থাকব ভাই। তুই দাঁড়িয়ে ওর দাড়ি কামিয়ে দেওয়াবি, কেমন? তারপর আমি উঠে ওকে দেখব। তারপর বাড়ি যাবে।

নগেনবাবুর মা বললেন—ও ভারটা আমাকে দিন মা। কিন্তু ওর চুলগুলো? ওই যে লম্বা বাবরি মতন? ওতে কিন্তু ওকে খুব ভাল দেখাচ্ছে।

এরই মধ্যে বাড়ীর যাঁরা থিয়েটারে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরলেন। তাঁদের সঙ্গে অর্থাৎ নগেনবাবুর ভাই সুরেনবাবু এবং বীরেনবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। পরিচয়ে জানলাম -সুরেনবাবুর স্ত্রী আমার মায়ের পিসতুতো বোন।

পরিবারটিকে বড় ভাল লাগল।

সবশেষে এলেন পাত্র রথীনবাবু। মেডিকেল কলেজের নাম-করা ছাত্র। এই সুন্দর সুপুরুষদের বংশের মধ্যে এই ছেলেটিই যেন সবথেকে উজ্জ্বল এবং পৃথক। চেহারায় পার্থক্য আছে। কথায়-বার্তায় আছে, আচারে-আচরণেও আছে।—

আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন—আপনি এ-বাড়ীতে!

অন্নপূর্ণা দেবী তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আনিয়েছিলেন। নইলে ডাক্তার রাত্রে চেম্বার এবং . নার্সিংহোম থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢোকেন। নিচের তলায় তাঁর ঘর। সেখানে বিশেষ রকম বন্দোবস্ত। দরজার সামনে সিঁড়িতে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো থাকে। তাই মাড়িয়ে ঢোকেন। পোশাক সব খুলে স্নান করে কাপড়-চোপড় পরে তবে উপরে আসেন।

বেশ একটু অসুখ ও অসুখের সংক্রামকতা সম্পর্কে বাতিক আছে। স্নান করে এলেও ডেটল-জাতীয় ডিস্‌ইনফেকটেন্টের গন্ধ ওঠে।

আমার উত্তর অন্নপূর্ণা ঠাকুমাই দিলেন। বললেন—তোর জন্যেই এসেছে রে। বসে আছে।

—আমার জন্যে?

এবার আমি বললাম—হ্যাঁ, আপনার জন্যেই।

অন্নপুর্ণা ঠাকুমা বললেন—দেখ তো এই ফটোখানা!

—ফটো? কার?

—দেখে বল তো কার?

হেসে সে বললে—একটি মেয়ের।

—হ্যাঁরে, হ্যাঁ, বাঘিনীর নয়, গণ্ডারনীর নয়, এ তো সবাই জানে।

—তাই তো বলছি।

আমার ভাল লাগল। অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে এমনভাবে কাউকে কথা বলতে শুনিনি।

অন্নপূর্ণা দেবী বললেন—তুই মস্ত ত্যাঁদড়।

—বাঁদরও বলতে পার। তোমার কথার উপর কথা কয় কে বল?

—তুই হারামজাদা সে তুই বলিস। দেখ তো আমার মায়ের অয়েলপেন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে! রথীন এবার ভবানীদেবীর অয়েলপেন্টিংয়ের দিকে তাকিয়ে সত্যই বিস্মিত হল। বেশ ভাল করে দেখে যেন মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে বললে—তাই তো! আশ্চর্য মিল তো! অবিকল মিলে যাচ্ছে। বলতুম এটা ওই অয়েলপেন্টিংয়ের ফটো কিন্তু সাজগোজে মিল নেই, এত গয়না নেই। কার ফটো এ, মামণি?

—তাই তো বলতে বলছি। বল?

রথীন হেসে বললে—মঙ্গলবারের কথায় বলতে—সেটা আমার মনে আছে। মঙ্গলচণ্ডীর আসন টলল, মুকুট নড়ল; মা বললেন—দেখ তো জয়া, দেখ তো বিজয়া খড়ি পেতে, আসন কেন টলে, মুকুট কেন দোলে? অমনি জয়া-বিজয়া গুণেগেঁথে বলতো—মা তোমার ভক্ত বিপদে পড়েছে। আমি তো ঠাকুর নই, দেবতা নই, কি করে বলি বল? তুমিই নয় খড়ি পেতে গুণেগেঁথে বলে দাও—এ-ফটো কার?

—ওই জন্যেই তোকে ভালোবাসীরে ছোঁড়া। তোর এসব মুখস্থ। চমৎকার করে বলিস। শোন, এ ফটো হচ্ছে সুরেশ্বরের খুড়তুতো বোনের। শিবেশ্বরের মেজ ছেলে জগদীশ্বর রায়ের বড় মেয়ে। বাপটা গাঁজা খায়, মদ খায়, লোককে মারপিট করে বেড়ায়। তার মেয়ে। একটা দোজবরে দারোগা ধরে মেয়েটাকে জলে ফেলে দিতে যাচ্ছে। সুরেশ্বর এসেছে আমার কাছে। তোর জন্যে।

—আমার জন্যে? মানে আমাকে বিয়ে করতে হবে?

—হ্যাঁ। আমাদের সবারই মত হয়েছে। ইচ্ছে তাই।

—আমাদের বলে লাভ কি? বল তোমার মত হয়েছে। তোমার মায়ের মত দেখতে, অমনি তোমার মন গলে গেছে। কেমন?

—তবু তোকে হ্যাঁ বলতে হবে তো।

একটু চুপ করে থেকে রথীন বললে—ভেবে দেখতে সময় দাও মামণি। আমাকে ভেবে দেখতে হবে।

সে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। রথীন এক মুহূর্তে আর এক রথীন হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর আলাদা, মুখ-চোখ আলাদা, সব আলাদা।

এবং সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠে নগেনবাবু বলে উঠলেন—রথীন!

পিতৃত্বের শাসন, ক্ষোভ, অধিকার একসঙ্গে যেন মিলিত গর্জনে ধ্বনিত হয়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বরে। কিন্তু রথীন বিচলিত হল না। সে বলল –বলুন!

নগেনবাবু বললেন-এমন কথা তুমি ঠাকুমাকে বলতে সাহস কর আমাদের সামনে?

রথীন বললে—কথাটা কি অন্যায় বলেছি? আমি বিবাহ করব। আমি ভেবে দেখব না?

-–ঠাকুমা কথা দিয়েছেন জেনেও তুমি বলছ ভেবে দেখতে হবে?

নগেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—দাঁড়াও। এ বাড়ীতে বাবার থেকে শুরু করে তোমার ছোটকাকা পর্যন্ত সকলের বিবাহ কখন হবে, কোথায় হবে, সে-সবই স্থির করেছেন উনি, আজ—

অত্যন্ত ধীরকণ্ঠে রথীন বললে-আজ সে-কাল পাল্টে গেছে বাবা—এই কথাটা আপনি বুঝে দেখবেন না?

অন্য সকলে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন—নগেনবাবুর মা, রথীনের মা, সুরেনবাবু, ধীরেনবাবু তাঁদের স্ত্রীরা দুজন। অন্নপূর্ণা দেবী পাথরের মত বসেছিলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম রথীনকে।

দেখলাম, অন্নপূর্ণা দেবীর অজ্ঞাতসারে তাঁর বংশধারা গঙ্গা থেকে পদ্মা ভাগীরথীর মত দুভাগে কখন ভাগ হয়ে গেছে, তা তিনি জানতে পারেননি। অথচ দুভাগ হয়ে গেছে নিঃসংশয়ে। অন্নপূর্ণা দেবী বললেন-সুরেশ্বর, বাড়ি যা বাবা। এখানে বিয়ে হবে না। তুই খরচ করবি বলছিস, মেয়ে সুন্দরী—পাত্রের অভাব হবে না। তুই বাড়ী যা। তারপর রথীনকে বললেন—আমার ভুল হয়েছে রথীন, তুই স্বাধীন হবার আগে তোর বিয়ে না দেওয়া। আজ তুই স্বাধীন।

রথীন আর দাঁড়াল না। সে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল।

আমি বললাম খেয়ে যাব বড়মা। আমার খাবার কথা আছে যে!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *