১৬
সুরেশ্বর বললে-সুলতা, আমি ৬ই মাঘ, দুদিন পর কলকাতায় এলাম। খুড়ীমার কথাটা আমার মনে ভাল লেগেছিল। অন্নপূর্ণা দেবীকে বছর দুয়েক বিজয়ার পর একবার ক’রে দেখেছি। বাবা-মার সঙ্গে যেতাম। বিজয়ার পর প্রণাম করতে যেতেন। বাবা যখন খুব সাহেব, যখন বিয়ে করেন নি, তখন বাবা যেতেন না তাঁর ভয়ে। বিয়ের পর তিনি নিজে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, মাকে গয়না দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। আমি যেবার প্রথম যাই তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। আমাকে দেখে ব’লে উঠেছিলেন-ওরে এ যে অবিকল আমার দেবু রে। কী সমাদর—আমাকে একশো টাকার নোট দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—দেখ, সাঁচ্চা জরি বসানো ভেলভেটের পোশাক কিনে দিস। আর মাথায় একটা পালক দেওয়া পাগড়ি। জানিস, কালীপূজার সময় এই বয়েসে দেবু আমার এই পোশাক পরত।
পরের বছর ঠিক তেমনি পোশাক পরে গিছলাম বিজয়ার সময়। তিনি একদৃষ্টে অনেকক্ষণ আমাকে দেখে কেঁদেছিলেন। অবিকল দেবেশ্বর। অবিকল! তারপর আমাকে বলেছিলেন-দেখিস বাবা সেই রূপ পেয়েছিস, কিন্তু দেবুর মত হসনে। খবরদার।
তারপর যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। বাবা ইংরিজী কাগজে খুব কড়া প্রবন্ধ লিখলেন, সেটা ষোল সতেরো সাল, পলিটিকাল মার্ডার আর টেররিজম নিয়ে প্রবন্ধ। প্রবন্ধ একটা নয়, সে একটা সিরিজ–বোধহয় তিনটেতে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তার মধ্যে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন মার্ডারারের মন এবং প্রকৃতি। তিনি বলেছিলেন—আসলে এরা মার্ডারার প্রকৃতি নিয়েই জন্মায়; যদি এরা শিক্ষা না পেত, তা হ’লেও তাদের এই দুর্নিবার প্রকৃতি এই পথেই এদের চালাত। সাধারণ মার্ডারের সংখ্যা তো কম নয়। এ শুধু এদেশেই নয়, সব দেশে। শিক্ষা এদের খুঁজিয়েছে একটা ‘কজ’। কিন্তু কজ-যা তোমার কাছে নোবল—তা অন্যের কাছে নোবল তো নয়ই, সেটা সেই চিরন্তন ক্রাইম। এই ধরনের প্রবন্ধ। তার সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন ল’ইয়ার অ্যাডভোকেটদের। বলেছেন-যারা এই সব ক্রিমিন্যালদের ব্রিফ নিয়ে কেস ডিফেন্ড করে তাদের নেচার অ্যানালিসিস করলেও ঠিক এই ‘ক্রিমিন্যাল ইনস্টিংকুট্’ পাওয়া যাবে। এবং তাদের মধ্যে আবার আরো এক গভীর জলের মৎস্য আছে যারা একই সঙ্গে এই ইনস্টিংকট এবং তাদের কেরিয়ারের পথ ক্লীয়ার এবং ব্রডার করে নেয়-যাতে ক’রে তারা পায়ে হাঁটার বদলে জুড়ি গাড়ী হাঁকিয়ে চলতে পারে। সেই হিসেবে কনসিডার দেম গ্রেটার অফেন্ডারস্ টু দি সোসাইটি এ্যান্ড স্টেট। যদিও ম্যাজিকে মুগ্ধ জনসাধারণের স্তিমিত লজিক অনুযায়ী তারা সেলফলেস গ্রেট মেন এ্যান্ড ওয়ার ফ্রন্টের সাপ্লাই অ্যান্ড সাপোর্ট লাইনের বিগ হিরোজ বলে পরিগণিত হয়।”
তুমি তো জান সুলতা বাবা আমার গান্ধীজীকে কি ব্যঙ্গোক্তি এবং বক্রোক্তি করেছিলেন! তাঁর এ প্রবন্ধ আমি পড়ি নি, কারণ বয়স তখন আমার ছ’ সাত বছর। আমি শুনেছি। অবিশ্বাসও করি না। বাবা হয়তো ঠিক এই ধরনের মানুষ ছিলেন না, তবে ইংরিজী কাগজে গিয়ে নাম করবার জন্যে এই ধরনের স্টান্ট লিখেছিলেন। এ বোধহয় ছিল তাঁর রক্তে।
সুলতা বললে—তার কিছুটা তোমার মধ্যেও আছে।
—নিশ্চয় আছে। স্বীকার করব না কেন? নিশ্চয় করি। নইলে বাবার বিরুদ্ধে আমিও তো এগার পেরিয়ে বারো বছর বয়েসে নন-কোঅপারেশনে পিকেটিং করতে গিয়েছিলাম। যার ধাক্কায় বাবা চাকরি ছাড়লেন। বাবা মিস চন্দ্রিকাকে নিয়ে পালালেন। আমি গোঁড়া হিন্দু হলাম। তারপর বাবা মারা গেলেন, শ্রাদ্ধ করতে এসে কীর্তিহাটের রায়বংশের পরিণতি দেখে তিরিশ সালে জেলে গেলাম। জেল থেকে বন্ড দিয়ে একমাস আগে বেরিয়ে এসে ইংরিজী কাগজে বিদায় সত্যাগ্রহ লিখলাম। তারপর আর্টিস্ট হলাম। দাড়ি গোঁফ রাখলাম। মা মারা গেলেন। তোমার সঙ্গে আলাপ হল। হঠাৎ কীর্তিহাটে সেটেলমেন্টের টানে এসে আর এরকম হয়ে গেছি। বলতে গেলে জমিদারী মেজাজ নিয়ে রায়বাড়ীকে কলঙ্কমুক্ত করবার মত দম্ভ নিয়ে এই সব ছবি এঁকেছি! বাবার স্টান্ট আমার রক্তে আছে বই কি।
সুলতা রাগ করলে না। হাসলে। বললে—বড় রেগে গেছ তুমি হঠাৎ। কথা শেষ হতে হতে হাসিটা জোর হয়ে উঠল। হঠাৎ থেমে বললে—পাত্রাধার তৈল এবং তৈলাধার পাত্র একসঙ্গে দুইই সত্য—বললে—রাগ করো না।
লজ্জিত হল সুরেশ্বর। বললে —ঠিক বলেছ। মনটা ফুঁসছে। পাত্রে তৈল থাকে পাত্রের আকার নেয়, তৈলও গুণ হারায় না পাত্রও আকার হারায় না। কীর্তিহাটে এসে ইন্টেলেকচুয়াল আমি এবং জমিদারী আসনে বসে জমিদার বংশধর আমি মিশে গিয়েছি। হয়তো প্রদীপ হয়ে আলো ছড়াতে চেয়েছি কিন্তু কড়াইয়ের তেলে বেগুনের ফালির মত ফুটতে শুরু করেছি। সুলতা হেসে উঠল আবার। বললে-চমৎকার বলেছ। কিন্তু আমি বলছি—বে-গুণ তুমি নও। গুণ তোমার আছে। হঠাৎ রেগে গেছ। কারণটা ঠিক বলতে পারব না।
একটু চুপ করে থেকে সুরেশ্বর আবার বললে—কারণ আমার বাবার ঐ প্রবন্ধের স্মৃতি। ওই ‘বিদায় সত্যাগ্রহ’ চিঠিটার একটা সম্পর্ক আছে। হেরিডিটি ছাড়া কি বলব? তা ছাড়া যা বলতে যাচ্ছি—অন্নপূর্ণা দেবীর বাড়ীতে অর্চনার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়ার কথা—তার সঙ্গে যোগটা আরো নিবিড়। ওর সঙ্গে আমার বাবার ওই প্রবন্ধটা বের হবার পরই অন্নপূর্ণা দেবী বাবাকে একখানা চিঠি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন-”তুমি ইংরাজী কাগজে যেসব কথা লিখিয়াছ তাহা শুনিয়া আমি নগেন্দ্রকে পড়িয়া শুনাইতে বলিলাম। সে সমস্তই আমাকে বাংলা করিয়া শুনাইল। ইহাতে তুমি আমাদিগকেও গালি দিয়াছ। আমার ছেলে ভবেন্দ্র উকীল ছিলেন। আমার স্বামী উকীল ছিলেন। আমার স্বামী আলিপুর বোমার মকদ্দমায় আসামীপক্ষে ছিলেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত ছিলেন। আমার ছেলে ভবেন্দ্র এমন অনেক মকদ্দমায় বিনা ফীতে কাজ করিয়া গিয়াছে। সেও আজ নাই। তাহার পুত্র নগেন্দ্রও এখন ওকালতি করিয়া থাকে। আমি তাহাকে এ বিষয়ে উৎসাহ দিই। ইহার জন্য আশীর্বাদ করি। সুতরাং তুমি আমার বংশকে এমনকি আমাকেও অপমান করিয়াছ। বহু পূর্বেই পিতৃবংশের সহিত সম্পর্ক ত্যাগই করিয়াছি। সে দাদার আমল হইতে। শুধু দেবেশ্বর আমার সমবয়সী —খেলার সঙ্গী ছিল, তাহাকে বাল্যকালে ভাইফোঁটা দিবার জন্য কাঁদিতাম সেই কারণে সে অনেক কুকার্য করিলেও তাহাকে ত্যাগ করি নাই। অদ্য হইতে তোমাকেও ত্যাগ করিলাম জানিবে। অতঃপর তুমি বৎসরে একদিন আইস, তাহাও আর আসিবে না।”
বাবা হেসে চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এবং আর যাননি কোনোদিন। আমিও যাইনি। এবং একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ-পত্ৰ গিয়েছিল। অন্নপূর্ণা দেবী লোক দিয়ে ঘাটে কামিয়ে উঠবার পর পরবার জন্য নতুন কাপড় পাঠিয়েছিলেন। আর দশ টাকা লৌকিকতা। কিন্তু পত্র দেন নি।
মায়ের মৃত্যুর পর ও-বাড়ীতে যাইনি নিমন্ত্রণ করতে। মনটা যেন ভুরু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলেছিল—নাঃ। কি লাভ হবে কতগুলো কটু কথা শুনে!
এবার অর্চনার জন্যে সংকোচ করলাম না। ঠিক করলাম যাব। অন্তত অর্চনার ফটোখানা দেখিয়ে আসব।
খুঁড়িমা বললেন—উকিল নগেনবাবুর ছেলেটি ভাল। ডাক্তারি পাশ করেছে, বিয়ে করেনি। কারণ, অন্নপূর্ণা দেবীর প্রপৌত্রের জন্য পাত্রী তাঁর পছন্দমত হওয়া চাই।
অর্চনা অবিকল ভবানী দেবীর মত দেখতে, তার উপর সে গৌরী। দেখেছ তো অর্চনাকে। আজও তার কী রূপ! কিন্তু সে সময়ের রূপের আর কিছুই নেই। সে অর্চনার আর কিছুই নেই বিধবা অর্চনার মধ্যে।
ঠিক এই মূহূর্তেই পুরানো কথার ধারায় বাধা দিয়ে আজকের বিধবা অর্চনা এসে ঢুকল। কাঁধে একখানা বড় তোয়ালে। তার বেশী অংশটাই সামনের দিকে ঝুলছে, সে তাতে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল। এবং বললে—রায়বংশের ইতিহাসে বড় বড় রায়দের ছেড়ে সর্বনাশী অর্চনার নাম কেন? –না, তাই বলছ।
সুলতা বললে—না ভাই, হচ্ছিল তোমার সে কালের রূপের কথা।
—রূপের কথা! একটু হাসলে অর্চনা। তারপর বললে—হ্যাঁ, তা ছিল। কিন্তু তাই আমার কাল। রূপের জন্যই বিয়ে হল। বল তো সুরোদা, বিয়েটা না হলে রায়বংশের মহাভারত কি অশুদ্ধ হত? আমি আমার পথ তো ঠিক করে নিয়েছিলাম। আমি হয় মরতাম নয়তো এত মেয়ে জেলে গেল-যেতাম। সুলতাদির মত দেশের কাজ করে বেড়াতাম।
সুরেশ্বর বললে—তোর বিয়ের কথাই বলছি রে। রায়বংশের মহাভারত তুই যে শুদ্ধ করতে এসেছিস। তোর বিয়ে না হলে সেটা হয় কি করে? অতুলেশ্বর কাকা আজ কংগ্রেসী মাতব্বর। স্বাধীন দেশের মধ্যে কাটা বাংলাদেশে মেদিনীপুর সব থেকে বড় জেলা। সেখানকার কংগ্রেসীরাই আজ প্রধান। বল না অতুলেশ্বর রায়বংশের মহাভারতে পাণ্ডব কৌরবদের কে? কেউ না! সে যদু বংশের মহানায়ক পার্থসারথীর ডানহাত বা বাঁহাত সাত্যকি-টাত্যকির মত কেউ হয়ে বসে আছে। রায়বংশের মহাভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তার চুকে গেছে। তুই তেমনি ধারা, রায় বংশের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে সুলতার মত প্রমীলা-ট্রমীলা কেউ হতিস।
—খুব হয়েছে। কিন্তু এখনকার মত ওঠো। খাবার তৈরী, শীতের দিন গরম গরম খেয়ে নাও এখন। পুরনো কাল ছেড়ে নতুন কালে—যে-কালে মহাভারতের হস্তিনাপুর ইন্দ্রপ্রস্থ মাটি-ঢাকা পড়েছে, সেই কালে এস। নয়া দিল্লীর কনট সার্কাসের হোটেল-রেস্টুরেন্টের মত খাবার করেছি। তবে মাংস মুর্গীর নয়। ওটা মাপ করতে হবে।
—ব্রজদা কি করছে? তার ভজন-টজন শেষ হয়েছে?
—অনেকক্ষণ। বসে বসে মাংস রান্না বালাচ্ছিল। ওইটেই ছাড়তে পারলে না ব্রজদা। কি বলছিল জানো?
—কি?
—হঠাৎ চুপ করে গেল একসময়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—বল, এবার কি করব? ঝোল অনেক রয়েছে, অথচ মাংসটা নরম হয়ে গেছে খুব। গলে যাবে হয়তো। উত্তর দিলে না। আবার ডাকলাম ব্রজদা। ব্রজদা হেসে উঠল। বললাম, হাসছ যে? ব্রজদা বললে-ওরে অর্চি, সন্ধেবেলা থেকে ঠাকুরকে বলছিলাম—ঠাকুর, এবার পথে বের করে দাও। বড় ইচ্ছে সন্ন্যাসী হয়ে শুধু তোমায় নিয়ে থাকি। কিন্তু মজা দেখ—এই এতক্ষণ ধরে ঘ্রাণেন অর্ধভোজন করছি, আর ভাবছি, আঃ, এমনি আহারটি যদি নিত্যি জোটে! হঠাৎ সন্ধের কথাটা মনে পড়ল। ভাবছিলাম, ঠাকুর সব পারে। চোখ-কান-মাথা-হাত-পা সব জব্দ করতে পারে। সবাইকে দমন করতে পারে। কালীয় নাগকেও পারে, কংসের হাতীকেও পারে। পারে না শুধু মানুষের উদরের সঙ্গে। আরে, অন্যে পরে কা কথা, নিজেই ঠাকুর ছেলেবেলায় চুরি করে খেয়েছে, মদ্দ জোয়ান হয়ে ভাত পায়নি, রুটি পায়নি, বিদুরের খুদ খেয়ে নামই হয়ে গেছে দামোদর।
বলতে বলতে কেঁদে ফেললে অর্চনা। তোয়ালের খুঁটে চোখ মুছলে।
সুলতা বললে—ওটাই মহাভারতের আদি কথা অর্চনাদি। কৌরব-পাণ্ডব রায়বাড়ী—সব বাড়ীর সব কথার মুলেই ওই কথা। তবে উদর বলব না, বলব অন্ন।
—না। সুলতাদি, কথাটা তোমার নেহাতই পলিটিক্যাল থিয়োরী। ওছাড়া আরো অনেক কিছু আছে।
সুরেশ্বর বললে—চল, খেয়েদেয়ে এটার মীমাংসা করব। ওঠো সুলতা।
.
খাওয়া-দাওয়া সেরে এ ঘরে এসে সুরেশ্বর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—দেখ, আমার জবানবন্দী নেবার বিচারক, তুমি কি অ্যাডজোর্নমেন্ট দিয়ে বাড়ী যাবে না? রাত্রিও অনেকটা হয়েছে।
সুলতা চুপ করে রইল। ভাবছিল।
—তা হলে আজ না হয় থাক! গাড়ী বলে দিই।
—না। অন্তত অর্চনার ভাগ্যের কথা শুনে যাব। উনি—ওকথা বললেন কেন?
—কোন্ কথা, নিজেকে স্বামীঘাতিনীর কথা?
—হ্যাঁ।
কথাটা অৰ্চনা বলেছে খাবার সময়। দুপাশে মুখোমুখি হয়ে বসেছিল চারজনে।
টেবিলে নয়, অর্চনা খাবার ব্যবস্থা করেছিল মেঝের উপর আসন পেতে। বলেছিল—টেবিলে বসলে আমার বসা হবে না—তাই মেঝের উপর আসন পেতে সনাতন নিয়মে করলাম। অসুবিধে হবে?
কথাটা সুলতাকেই বলেছিল। এর অর্থ সুলতার বুঝতে দেরী হয় নি। ব্যাপারটা ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার। এবং সেটা তাকে নিয়েই। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলেছিল- না- না—অসুবিধে কিসের? ঠিক আছে। এ বেশ সুন্দর ব্যবস্থা। কিন্তু শেষকালটায় না বলে পারে নি আর ছোঁয়াছুঁয়িটা আপনি মানেন—
—না সুলতাদি, তা মানিনে। এই দেখুন—ওপাশে দুখানা আসন—ও দুখানা বড়দা আর সুরোদার জন্যে। আর এদিকে পাশাপাশি আমরা দুজন। আমি মাছ মাংস পেঁয়াজ এগুলো খাইনে, রাত্রে ভাতটাও খাইনে। কিন্তু নিরামিষ তরকারি আলু ছেঁচকি-আলুভাজা—পটলভাজা এসব খাই, লুচি রুটির সঙ্গেও খাই মুড়ির সঙ্গেও খাই। হয়তো জানেন না নির্জলা একাদশীও একালে উঠে গেছে। তা নয়, আমার আপত্তি ওই টেবিল। আর ওই চাদর। বুঝলেন না, ওটা ভাই বরদাস্ত করতে আমি পারিনে। বিধবা বিয়েও আমি সহ্য করতে পারি, সমর্থন করি। অসবর্ণ বিয়ে—এমন কি International কি Inter Communal বিয়েতেও আপত্তি নেই। কি একটা মেয়ে ডাইভোর্স করছে তাও সয়—কিন্তু দুবার তিনবার ডাইভোর্স করে বিয়ে এটা সহ্য করতে পারিনে। ওটাকে আমি ঘেন্না করি। আর ঘেন্না করি cheating—কে! ভালবাসার ছলনার চেয়ে পাপ আর হয় না! জানেন আমার লাইফের ট্র্যাজেডিই ওইখানে। আমার স্বামী আমাকে—।
হঠাৎ চুপ করে গেল অর্চনা। কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে, বসুন- আপনাদের পরিবেশন ক’রে দিয়ে আমি বসে পড়ব আপনার পাশে।
প্রায় অন্ধ ব্রজেশ্বর কালো চশমাটা খুলে রেখে খেতে বসল। তার পাশে সুরেশ্বর। ব্রজেশ্বর দিনের থেকে রাত্রে দেখতে পায় অপেক্ষাকৃত ভাল। সকালে সূর্যোদয় থেকেই চোখ তার রাঙা হতে শুরু করে। রোদ যত বাড়ে তত যন্ত্রণা বাড়ে। কালো চশমায় আরাম বোধ করে এবং একটু-আধটু দেখতেও পায়। রাত্রে যন্ত্রণা কমে—জল পড়া বন্ধ হয়। তখন আলোতে দেখতে পায়।
চশমাটা খুলে রেখে ব্রজেশ্বর বলেছিল—ওরে ভাই, এসব এড়াবি কি করে? সংসারে এ জন্মের ঋণ ও জন্মে শোধ করতে হয়। তুই সেই সতীবউরাণী—
অৰ্চনা বলেছিল—থামো তো! ওই বলে ব’লে তোমরা আমাকে পাগল করে দেবে। যতসব বাজে কথা! তোমাদের যত ঝঞ্ঝাটে আমাকে জড়াবার ফন্দী! আমি সতীবউরাণী তাহলে তুমি-টা কে শুনি? আর ওই সুরোদা, ওই বা কে?
ব্রজেশ্বর বলেছিল—রাজাভাই আমার; প্রজাদের কাছে রায়দের ঋণ তো অনেক। শোধ দিতে এসেছে। সে জন্মে মদ খায়নি —বিলাস করে নি-তা ক’রে নিতে এসেছে। অঞ্জনা ঠাকরুণের ঋণ শুধতে এসেছে।
সুরেশ্বর বলেছিল-ব্রজদা, তুমি ভাই একখানা বই লেখ—
ব্রজেশ্বর হা-হা করে হেসে বললে—দ্বিতীয়ভাগের বানানগুলো আজীবনে দোরস্ত করতে পারিনি—বাংলা পণ্ডিতের কিল খেয়ে রায়বংশে জন্মেও মেটাতে পারিনি। তার উপর ঠাকুর চোখে মেরেছেন। তুমি জান রাজাভাই—সুপুরুষ ব্রজেশ্বরের চোখের চাউনিতে কি ভেলকি খেলতো। এখুনি করুণ সজল; রাজা মহারাজাদের সামনে সেই দৃষ্টিতে তাকালে পবন পানি হো যাতা থা। সুন্দরী যুবতীদের দিকে একটু ঢলঢলে উদাস দৃষ্টিতে তাকাতাম, তারা মরমে মরে যেতো। এখন সেই চোখ গেছে, দুচোখে পানি ঝরে। দেখতে পাইনে। তবে আমি বলে যেতে পারি তুমি লিখে নিতে পার। মডার্ন রিয়ালিস্টিক না হোক, লোকে অবাক বনে যাবে।
অর্চনা বলেছিল–আমাকে বলো, আমি লিখব। সংস্কৃতে এম-এ পাশ করেছি—বানান সব আমি শুদ্ধ ক’রে লিখতে পারব।
—তা হলে ধর—তুই সতীবউরাণী রাজা ভাইয়ের তিন জন্ম রায়বংশে—প্রথমে কুড়ারাম রায়, তারপর রত্নেশ্বর রায়, তারপর রাজাভাই সুরেশ্বর রায়।
সুরেশ্বর বলে উঠল—নিজের কথাটা বল—
—দাঁড়াও ভেবে দেখি আমি কে?
অর্চনা বললে—তুমি কে আমি বলব?
—বল?
—তুমি সেই শ্যামাকান্ত—এ জন্মে কাঁদতে এসেছ। মুক্তি তোমার এই জন্মে।
—উঁ-হু, উঁ-হু, উঁ-হু! শ্যামাকান্ত আমি? বাপস্। আমি হলাম;—আমি হলাম কে?
সুরেশ্বর হেসে বললে—তা হ’লে আমি যতটা দিব্যদৃষ্টি পেয়েছি তাতে দেখছি তুমিই হলে কুড়ারাম রায়।
অর্চনা বললে—ঠিক ঠিক, ঠিক! বংশটা প্রতিষ্ঠা করেছিলে–কোন প্রেজুডিস্ ছিল না- সেই মুসলমান মেয়েটার চুল বঁটিতে কেটে গোবর খাইয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে ঘর করেছিলেন, তোমার সঙ্গে মিলবে ব্রজদা–সে-ই হলে তুমি।
খেতে বসে আলোচনার ধারাটা হাস্য-পরিহাসে এসে পৌঁছেছিল। ব্রজেশ্বর বললে–আচ্ছা সুলতা দেবীকে আম্পায়ার কর। উনি বলুন। আমরা গেঁয়ো লোক—বকে মরছি গেঁয়ো চোরের মত, উনি শহুরে—ঠিক সেই শহুরে চোরের মতো নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছেন—ওঁকে একটু বাধা দেওয়া হবে। উনিই বলুন- সেই স্থুলবপু গজরাজের মত দুঃসাহসী, ধীর-গতি যিনি নাকি রায়-রাঁইয়ার রাজহস্তীস্বরূপে যথেচ্ছ ভ্রমণ করে বিশাল কীর্তিহাট নামক অরণ্য এলাকা দখল করে বংশপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন—সেই মহাশয় ব্যক্তি বা ঐরাবত কি এমনি দুর্বল দেহ, শেরালের মতো ধূর্ত ভীরু যে অহং ব্রজেশ্বর রায়—সে হতে পারি?
সুলতা হেসে বললে—শেষকালটায় মিল আছে। তিনিও শেষ বয়সে কালী কালী করেছিলেন, আপনিও কৃষ্ণ কৃষ্ণ করছেন।
—হা হতোস্মি—এই হল আপনার বিচার? শহুরে চোরের মত এক কথায় ফুললো আর মলো? সংসারে শেষ জীবনে কালী কালী বা কেষ্ট কেষ্ট কি শুধু কুড়ারাম রায় করেছিলেন না আমি করছি! সব পাখীতেই মাছ খায় রাজাভাই, ধরা পড়েছে মাছরাঙার মত এই তোমার ব্ৰজদা।
—কি বললেন—কি বললেন কথাটা? কি, সব পাখীতেই—
—ও—সব পাখীতেই মাছ খায় ধরা পড়েছে মাছরাঙা। অর্চনা বললে-ওসব আমাদের পাড়াগাঁয়ের প্রবাদ।
ব্রজেশ্বর একখানা ফ্রাই তুলে নিয়ে বললে-হয়েছে অর্চনা। আমি হলাম অঞ্জনার বাউন্ডুলে স্বামী! সুদর্শন! আর বিমলেশ্বর কাকা কে জান। ও হ’ল সেই বেটা গোপাল সিং! বেটা শেষকালে জব্দ হয়ে বীরেশ্বর রায়ের অনুচর হয়েছিল, তীর্থ করে এসেছিল—সে এসেছে এবংশে তার বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ভোগ করতে। দেখ, সে-জন্মে মেরেছিল নিজের বেটাকে। এ-জন্মে শিবুর হাত কুপিয়ে সে জন্মের জেল খাটাটা খাটতে গেল।
অর্চনা বললে—তুমি বড়দা ভুল বললে—তুমি এসেছ খোদ বেদব্যাস, পথ ভুল করে এই রায়বাড়ীর ভাঙাহাটে। সে-জন্মে যা ভোগ করনি, যে-সব পাপ করনি এ-জন্মে করার পর তোমার ভগবান তোমার চোখে রোগ দিয়ে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছে!
—হ্যাঁ—হ্যাঁ। তাও হতে পারে। না হলে, তুই সতীবউরাণী এ কথা আমার মত কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে? হ্যাঁ, দিব্যচক্ষেই দেখছি রে আমি। অর্চি, দিব্যচক্ষেই দেখছি। সতীবউরাণীকে সে-জন্মে বীরেশ্বর রায় প্রাণ দিয়েও পান নি। বারো বছর পর সতীবউরাণী ফিরে এসেও ধরা দেন নি। তোকে সেই সতীবউরাণী জেনেই অন্নপূর্ণা ঠাকরুণ নিজের একমাত্র নাতির নাতবউ করেছিলেন। তুই এবার প্রাণ ঢেলে তাকে চাইলি-কিন্তু সে শোধ নিলে গত জন্মের, বছর না ঘুরতে রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা ক’রে শোধ নিয়ে চলে গেল।
সুরেশ্বর বলে উঠল—থাম ব্রজদা। কি সব বলছ?
ব্রজেশ্বর হেসে বললে—ওই দেখ। রাজাভাই, কাল জমিদারী উচ্ছেদ বিল পাশ হয়েছে। কাল থেকেই তোমাকে আমার রাজাভাই বলা উচিত নয়, তোমারও আমাকে প্রজাদাদা হিসেবে ধমক মারা উচিত নয়। কিন্তু হলে কি হবে? ও কি ওঠে রে রাজাভাই—না ও ওঠবার। তা বেশ—চুপ করতে বলছ—তা চুপ। চাঁদবিবি নাটক হয়েছিল—তাতে মিয়ানমুঞ্জু আর হাবসী এখলাস্ খাঁ তরোয়াল খুলে লড়ে আর কি, এমন সময় চাঁদ সুলতানা ঢুকল বললে—মিয়ানমুঞ্জু চুপ। অমনি মিয়ানমুঞ্জু চুপ—ওদিকে এখলাস খাঁ রুখে উঠেছে, কাটে আর কি, চাঁদ সুলতানা তাকেও বললে—চুপ! তো সেও চুপ হয়ে গেল। তা তুমি রাজাভাই যখন বলছ তখন মিয়ানমুঞ্জু চুপই হয়ে গেল।
কথাটা বলায় কোথাও যে অন্যায় হয়ে গেছে তাতে তার সন্দেহ ছিল না, সে-কথা বুঝতে পেরেই সে এই ধরনের খানিকটা আবোলতাবোল বকে ব্যাপারটা লঘু করে নিতে চেষ্টা করলে। কিন্তু তার আগেই যা হবার হয়ে গেছে। ব্যাপারটা অর্চনাকে নিয়ে। অর্চনা সুলতার পাশে বসে খাচ্ছিল, হঠাৎ সে বাঁ হাতে কপালটা ধরে ঝুঁকে পড়ল, ঝুঁকে পড়ার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যাতে সকলেই বুঝতে পারলে যে সে নিজের মুখখানিকে ওই ভঙ্গির মধ্যে আড়াল দিতে চাচ্ছে। এবং ডান হাতে সে শুধু খাবার নাড়াচাড়াই করছে, কিন্তু গ্রাস মুখে তুলছে না!
সুলতা বিশেষ কিছু বুঝতে না পারলেও অনুমান করতে কষ্ট হল না যে এই কথাটায় নিজের দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে অর্চনা মূহ্যমান হয়ে পড়েছে। স্বামীকে মনে পড়েছে।
সেও মাথা হেঁট করে খেতে চেষ্টাই করেছিল। সুরেশ্বরও তাই। শুধু অতি স্বল্পদৃষ্টি ব্রজেশ্বর কথাগুলো শেষ করে অকারণে নিজের কথার ব্যর্থ কৌতুকে খানিকটা হেসে হাতে ধরা ফ্রাইখানা খেতে খেতে বললে—কি চমৎকার ফ্রাই করেছিস অর্চনা! জানিস চিরকুমার সভার সেই ধরে আনা বর দুটোর “কটলেট কই মশাই কট্লেট?” মনে পড়ছে। আমি একবার মৃত্যুঞ্জয়ের পার্ট করেছিলাম! ঠাকুরদা বলেছিলেন- সাবাস্ রে ব্রজ সাবাস্! তুই আমার নাতি না হলে তোকে মেডেল দিতাম।
বলে আর একদফা হাসলে এবং গবগব করে খেতে লাগলে।
তাতেও কেউ কোন কথা বললে না; প্রায় অন্ধ ব্রজেশ্বর এবার বললে—গানটা মনে আছে? বলেই হাত নেড়ে ভঙ্গি ক’রে গেয়ে উঠল—যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া—এস দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!
সুরেশ্বর এবার বললে—ব্রজদা কি করছ তুমি?
তার কণ্ঠস্বরে ছিল বিষণ্ণ তিরস্কার, প্রায়ান্ধ ব্রজেশ্বর এবার তার স্পর্শে চমকে উঠে বললে—কেন রাজাভাই? কি-? অর্চি—অর্চি—ওরে অর্চি।
এবার বুঝতে পেরেছে সে। সে আর্তভাবে ডেকে উঠল—অর্চি! অর্চি! ওরে অর্চি! সাড়া দিচ্ছিস না কেন ভাই?
এবার প্রাণপণে নিজেকে সম্বরণ করে অর্চনা কোনমতে বললে-কি বড়দা?
—তুই কাঁদছিস?
—না না!
ব্রজ বলে উঠল—ছিছি—ছি! ছি ছি-ছি! এ আমি কি করলাম। আমি দেখতে পাইনে। ছি-ছি-ছি! এর থেকে
একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অর্চনা বললে—তুমি ছি ছি কর না বড়দা। তোমার কোন অন্যায় হয় নি। কিছু অন্যায় বলনি! আজকের তোমাকে তো আমি চিনি। জানি। তুমি কোনকালে কোন পাপ করেছ তুমি জান। কিন্তু অন্ধ হয়ে চোখ চাওনি—শুধু ভগবানকে ডাকো তোমার মুখ থেকে সত্যি ছাড়া মিথ্যে বের হবে কেন? ঠিক বলেছ তুমি। তোমাদের সতীবউরাণীর অপরাধ কি ছিল তা আমি জানি না। আমি তিনি কি-না তাও বলতে পারব না। তবে তাঁর এক বছরের মধ্যে অকালমৃত্যুর কারণ আমি। বলতে গেলে আমিই স্বামীঘাতিনী। এবং আমাকে দুঃখ দেবার জন্যই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন!
এরপর আর খাওয়া যায় না। কেউ খেতে পারে না। প্রথমেই উঠে পড়ল ব্রজেশ্বর!
—ব্রজদা—বড়দা।
—ওরে অর্চি পেট ভরে গেছে রে। ওরে আর পারব না।
সে যেন আর্তনাদ করে উঠল।
***
আধখাওয়া করে উঠে সুলতা এবং সুরেশ্বর সেই কীর্তিহাটের কড়চার ছবির ঘরে এসে বলল। বিষণ্ণতাটুকু যেন কেটেও কাটছে না। সুরেশ্বর যথাসাধ্য স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললে—দেখ, আমার জবানবন্দীর তুমি বিচারক তুমি কি অ্যাডজোর্নমেন্ট দিয়ে বাড়ী যাবে না? রাত্রিও অনেকটা হয়েছে। দেখ।
সহজ করে কথাগুলি গুছিয়ে বললেও সুরেশ্বরের কণ্ঠের বিষণ্ণতাটুকু চাপা পড়ল না বা মোছা গেল না—রেশটা রয়ে গেল।
সুলতাও চুপ করেই ছিল; ভাবছিল।
সুরেশ্বর বললে—দেখ, গাড়ী আনতে বলে দিই।
সুলতা এতক্ষণে বললে—না। অন্তত অর্চনার ভাগ্যের কথাটা শুনে যাব। উনি ও কথাটা বললেন কেন?
—কোন্ কথাটা? স্বামীঘাতিনীর কথা?
—হ্যাঁ।
একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সুরেশ্বর। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকবার টান দিয়ে বললে—তা হ’লে গোড়া থেকে—মানে যেখানে ছেড়েছি সেখান থেকেই শুরু করি শোন। তা হ’লে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। অন্তত কোন প্রশ্নের ফ্যাকড়া বের হবে না।
সুরেশ্বর বললে—বলছিলাম সেই রাত্রির কথা। ১৯৩৭ সালে বিমলকাকাকে অ্যারেস্টের পরের দিন, বড়খুড়ীমা ধনেশ্বর কাকার স্ত্রী মোহনডাঙার মেয়ে সকালে অর্চনাকে সঙ্গে করে এসে আমাকে অন্নপূর্ণা মায়ের কাছে যেতে বললেন। তাঁর বড় নাতির একমাত্র ছেলে ডাক্তারি পাশ করে কী সব রিসার্চ করছে। উজ্জ্বল ছেলে। অর্চনার উপযুক্ত পাত্র হবে। খুড়ীমা তাঁর মেয়ের জন্য চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু সে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন—তবে অর্চনার চেহারাই এ ক্ষেত্রে বড় আশা। সে সতীবউরাণী ভবানীর মত দেখতে। সতীবউরানী কালো ছিলেন। অৰ্চনা গৌরাঙ্গী, সুতরাং কঠোর অন্নপূর্ণা ঠাকরুণ গলতে পারেন।
আমিও তখন বাইরে থেকে বেকার। না পারি কলকাতায় ফিরতে; তোমার চিন্তাও আনতে পারি না। কাঁসাই নদীর ঘাটের একটা রক্তমাখা স্থান থেকে কে যেন নিষেধ করে। এদিকে বিপদের উপর বিপদ। অতুলেশ্বর কাকা-আমার একাধারে মা এবং দিদির মত স্নেহময়ী সঙ্গিনী মেজদি-জেলে। তার উপর অর্চনা।
অন্যদিকে শীত চলে যাচ্ছে, মাঘ মাস, চাষের ক্ষেতের ধান কাটা হয়ে যাচ্ছে। সেটেলমেন্টের আবার এক নতুন পর্ব আসছে। কিছু বুঝারত তখনো বাকী। তারপর ডিসপিউট দেওয়া কেসগুলির বিচারের জন্য কোর্ট বসবে।
কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়েছে। বিষয়ের জন্য কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছি কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্যের কীর্তিহাটের পাঁচালী; ঠাকুরের সিন্দুকের মধ্য থেকে সোমেশ্বর রায়ের প্রেমপত্র। এবং ওই যোগিনী আর শ্যামাকান্ত সম্পর্কে পত্র, বীরেশ্বর রায়, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীর থাক। বিষয়ের জট ছাড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি রায়বংশের বৃহৎ বটবৃক্ষ।
সে বটবৃক্ষের মূল কাণ্ড মরে গেছে অথচ গাছটা বেঁচে আছে ডাল থেকে নেমে আসা শিকড়গুলোকে কাণ্ড ক’রে নিয়ে।
কখনো দক্ষিণেশ্বর গেছ? তুমি ব্রাহ্ম বলেই জিজ্ঞাসা করছি। অবশ্য বটানিক্যাল গার্ডেনে বিখ্যাত বটগাছটা দেখেছ, কিন্তু সে গাছটা অতি যত্নে তৈরী। রায়বাড়ীর বংশবৃক্ষটা ওই দক্ষিণেশ্বরের গাছটার মত। তারই মধ্যে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম দুনিয়া ভুলে গিয়ে। দেখছি এই বংশ-বৃক্ষটির শিকড় মাটির তলায় তলায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার মুখ বিস্তার করে। সব রস শুষে চুষে খেয়ে নিয়েছে। কত নতুন গাছকে মেরেছে—
সুলতা বাধা দিয়ে বললে-কথা তুমি বাড়িয়ে ফেলছো সুরেশ্বর। ও সব জানা কথা। প্রজাপীড়নের কথা—কত প্রজা-বংশ ধ্বংস করার কথা—কত ঘরবাড়ী সংসার ক্ষেত খামার বন্ধ্যা করে দেওয়ার কথা—জমিদার বংশ, ধনী বংশরূপী বটবৃক্ষেরা যা করেছে কোন ইতিহাসই তার নিখুঁত হিসেব দিতে পারবে না। আজকাল স্ট্যাটিস্টিকসবিদেরা মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পার লোকসংখ্যা যাঁরা বের করেছেন ওটা তাঁদের হাতে ছেড়ে দাও। তুমি অর্চনার কথায় এস–তোমার কথায় এস।
সুরেশ্বর বললে—আমি আমার মনটার কথা বোঝাতে চাচ্ছিলাম। আমি তখন আপনার অজ্ঞাতসারে আমার বংশের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। বংশ-পরিচয় সন্ধানী দীর্ঘকালের প্রবাসী একটি খেয়ালী তরুণ এসে যেমন পোড়ো ভিটের খোঁজ পেয়ে ভূতগ্রস্তের মত ঘুরে বেড়ায়—রাত্রে শাবল হাতে খুঁড়ে বেড়ায় গুপ্ত ধনের সন্ধানে—তেমনি অবস্থা আমার। কোথাও দুচারটে পুরনো মোহর মেলে কোথাও মেলে না। পাথর-যাকে মনে করি দুর্লভ মূল্যবান জহরৎ, কিন্তু ধুয়ে মুছে দেখি মোহরগুলো তামার পয়সা, জহরৎগুলো কাচ। আবার অকস্মাৎ মোহরও মেলে, মণিমুক্তাও মেলে। সারা দিনটা বসে বসে ভাবি আর ভাবি—তেমনি আর কি। এর মধ্যে ওই ডাল থেকে নামা ঝুরির মত লম্বা হয়ে নেমে কখন মাটি ছুঁয়েছি, তারও খেয়াল নেই।
তা থাক ও কথা। ইতিহাসই বলি। গল্প বলব না। কারণ মিথ্যে এর মধ্যে নেই।
অর্চনা আমার পরম প্রিয়পাত্রী, তার সম্পর্কে রায়বংশের প্রচলিত প্রবাদেরও অন্তত বারো আনা বিশ্বাস করেছি। তখন আর আমি ইন্টেলকচুয়াল নই বলতে পার। শুধু খোলসটাই আছে ভিতরটা পাল্টে গেছে। কীর্তিহাট ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে হয় না!
তবু নড়লাম। অর্চনার তাগিদে নড়লাম। রঘুকে বললাম—জিনিসপত্র গুছিয়ে নে, কলকাতায় যাব—কাল হবে না—পরশু। ফিরব দিন চারেক কি এক সপ্তাহের মধ্যে। তার বেশী দেরী হবে না।
খবরটা শুনে মোহনডাঙ্গার খুড়ীমা বলে পাঠালেন-পরশু তেরস্পর্শ, পরশু যেতে বারণ করো সুরেশ্বরকে। শুভ কাজে যাচ্ছে।
খবরটা নিজে এসে দিয়ে গেলেন মনোহরপুরের খুড়ীমা মানে অর্চনার মা।
এখানে একটা ফালতু কথা বলি সুলতা। সেটা ওই রায়বাড়ীর এবং বাংলাদেশের বউদের নামের কথা। আগের কালে বড় বড় এবং মধ্যবিত্ত বাড়িতে বউদের নামকরণের কথা বলেছি। কাত্যায়নী দেবী ছিলেন রাজকুমারী রাণীবউ, তাঁর পুত্রবধূ ভবানী দেবী ছিলেন সতীবউরাণী। তাঁর পুত্রবধূ স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন সরস্বতী বউ। রায়বাহাদুরের তিন ছেলের ছয় বউ। দেবেশ্বরের এক বিবাহ, তাঁর স্ত্রী ছিলেন মানিক বউ; মেজঠাকুরদার তিন বিয়ে—প্রথমার অর্থাৎ ধনেশ্বর জগদীশ্বর সুখেশ্বরের মায়ের নাম ছিল ‘পদ্মবউ’, দ্বিতীয়ার নাম ছিল ‘গোলাপ বউ’—তারপর তৃতীয়া আমার মেজদিদি যিনি আমার মায়ের থেকে কমবয়সী, গ্রামের গরীব পুরুত ঠাকুরের মেয়ে—তাঁরও একটা ফুলের নাম জুটেছিল কিন্তু সে নাম ধরে ডাকবার কেউ ছিল না বলেই সেটা কায়েম হয় নি-লোকে তাঁকে বলত মেজমা। ওঁদের ছোট ভাইয়ের দুই বিয়ে—প্রথম স্বজাতে স্বঘরে হয়েছিল। তাঁর নাম হয়েছিল ‘রত্নবউ’। দ্বিতীয়া যিনি তিনি তখনো কীর্তিহাটে আসেন নি। এলাহবাদের মেয়ে—ব্রাহ্ম ব্যারিস্টারের শিক্ষিতা মেয়ে—তাঁর নাম আমার খাতায় লেখা আছে মনে নেই। কিন্তু রত্ন, মণি, পদ্ম এসব তাতে ছিল না।
এরপর আমার বাবা জ্যেঠা কাকাদের আমল। আমার নিজের জ্যেঠাইমা যজ্ঞেশ্বর রায়ের স্ত্রী বড় কয়লা ব্যবসাদারের মেয়ে, তাঁর নামকরণ হয়েছিল হয়েছিল ‘সৌরভ বউ’। বাবা বিয়ে করেছিলেন সাতাশ বছর বয়সে আমার মায়ের নাম আগে হলে হয়তো ‘গৌরব বউ’ বা এমনি একটা কিছু হ’ত। ধনেশ্বর কাকার বিয়ের কথা বলেছি, মোহনডাঙ্গার দৌহিত্র শরিক বাড়ীর মেয়ে যখন এসেছিলেন তখন তিনিও একটা নাম পেয়েছিলেন ‘সৌভাগ্য বউ’। জগদীশ্বর কাকার বউ মনোহরপুরের জমিদারবাড়ীর মেয়ে, পড়ন্ত জমিদারবাড়ী, —রূপও তাঁর ছিল, তার জন্যই তিনি নাম পেয়েছিলেন—’জ্যোৎস্না বউ’। সুখেশ্বর কাকার বউয়ের আমল থেকে এসব নাম রাখা উঠে গেল। তখন ওদের মা ‘পদ্মবউ’ মারা গেছেন। দ্বিতীয় পক্ষের মেজঠাকুমা ‘গোলাপ বউয়ের কোলে তখন দুই ছেলে এক মেয়ে এসেছে। তিনি বলেছিলেন—নাম আর কত খুঁজবে? দেশেও ওসব নাম রাখা উঠে গেছে, বউদের নাম এখন বাপের বাড়ীর গ্রামের নাম দিয়ে চলেছে। বড়-বউমা মোহনডাঙ্গার মেয়ে ও হবে মোহনডাঙ্গার বউ, মেজবউমা মনোহরপুরের মেয়ে ও হবে মনোহরপুরের বউ, সুখেশ্বরের বিয়ে হল ‘ওতোরপাড়ায়’, ও হবে ওতোরপাড়ার বউ।
তাই মোহনডাঙ্গার মেয়ে সৌভাগ্য বউ নাম পেয়েও হারিয়েছেন—তিনি ঘরে বাইরে মোহনডাঙ্গার বউ;—আমরা সামনে বলি বড় খুড়ীমা—আড়ালে বলি মোহনডাঙ্গার খুড়ীমা।
অর্চনার মা তাই মনোহরপুরের খুড়ীমা—এসে বললেন বাবা, বড়দি বললেন, পরশু তেরস্পর্শ। তেরস্পর্শে যাত্রা নেই। তুমি হয়তো এসব মানো না তাই বললেন—মেজ তুই যা বলে আয়, এ কাজে তেরস্পর্শ মাথায় করে না যায়।
আমি সুলতা, এসব মানতাম না তুমি জান—আজও ঠিক যে মানি তা নয়। তবে সেদিন মেনেছিলাম। না মানলে কি হত তা জানি না। তবে মেনে খুব শুভফল হয়নি। তবে যদি অনিবার্যভাবে এইটেই আমার অর্চনার ভাগ্যফল হয় তো প্রতিবাদের কিছু নেই।
সেদিন ৬ই মাঘ–ভোরবেলা রওনা হলাম। কলকাতার বাড়ীতে খবর দিয়ে রেখেছি। কীর্তিহাট থেকে পাঁশকুড়ো স্টেশন কাছে। কাছে মানে পঁচিশ তিরিশ মাইল। পাল্কীর বন্দোবস্ত করেছিলাম। পথে তমলুকে এসে ট্যাক্সি নিলাম। বাস সার্ভিসও আছে এখান থেকে। স্ট্যান্ডে পাল্কী ছেড়ে নেমে ট্যাক্সি ধরব, নামলাম, নেমেই দেখি—গোয়ানপাড়ার হিলডাবুড়ী দাঁড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে কুইনি, আর ওদেরই একজন মধ্যবয়সী লোক। কখনো দেখেছি বলে মনে হল না।
কুইনি কাপড় পরেছে, —সাজগোজের বাহুল্য নেই। কিন্তু সেই ভোরবেলা—সবে তখন আলো ফুটছে—সেই আলোতে বড় মনোরমা মনে হল তাকে। আমাকে দেখেই সে চোখ নামিয়ে নিয়ে হাত জোড় করে বললে-নমস্কার স্যার।
সুলতা—এর আগে তোমার মনে আছে—একদিন সন্ধেবেলায় অর্চনার সঙ্গে এসে আমার হাতে তাদের বাড়ীর দলিল আর কয়েকখানা চিঠি আমাকে দেখতে দিয়ে নীরবে চলে গিয়েছিল। কাঁসাই সে যখন পার হয় তখন তার পিছন দিক থেকে তাকে তিলুয়েটের ছবির মত মনে হয়েছিল। সেদিন তার রূপ যেন ঠিক উল্টো। উজ্জ্বল সকালের রাঙা আলোয় বললাম তো মনোরমার মত মনে হল। এবং ―।
সুলতা সহাস্যমুখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে হাসির রেখা বড় বিচিত্র।
সুরেশ্বর তার মুখের দিকে তাকায় নি। সে তাকিয়ে ছিল তার ছবির সারির দিকে। সে বললে-ওই দেখ, সে ছবিখানা।
সুলতা আগ্রহভরে উঠে গেল, ছবিখানা একটু দূরে ছিল, ক্রমপর্যায়ে ওটা এসে পড়েছে রায়বংশের কড়চার ছবির সারির শেষের দিকে। ছবিটার পানে সে তাকালে।
সুরেশ্বর ওঠেনি—সে বসে বসেই বললে—দৃষ্টিটা দেখ আমার। এ-দৃষ্টি যৌবনের দৃষ্টি। আমি লুকোইনি।—কিন্তু সেদিন স্বপ্নেও ভাবি নি যে—।
সুলতা ফিরে এসে বললে—এইটেই জীবনের শুভদৃষ্টি। বলে হাসলে সে।
সুরেশ্বর বললে—রাইট। খুব ভাল শব্দ তুমি প্রয়োগ করেছ।—কিন্তু থাক। সে পরের কথা পরে। জীবনে যৌবন-দৃষ্টি তো বহুবার বহু রূপসীর রূপে আকৃষ্ট হয়। মনও উতলা হয়। তার উপর ১৯৩৭ সালে তখনো আমি জমিদার, বুড়ো বৃটিশ সিংহের তখনো নখ দাঁত থাবা অটুট আছে। মার খেয়ে সহ্য করে—সে প্রতিশোধে শত্রুকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে। চার্চিল প্রাইমমিনিস্টার তা তো ইতিহাসে মোটা মোটা অক্ষরে খুদে রেখে গেছেন। ভারতবর্ষের গণ আন্দোলন, টেররিস্ট আন্দোলনে বিচলিত সে হয়েছে নিশ্চয়, কিন্তু তখনো হাল ছাড়েনি। তার আশেপাশে যেসব প্রসাদ-ভিক্ষু নেকড়ে হায়েনার দল বসে আছে তারা ইচ্ছা করলে একটা হরিণী বধ করলে বিশেষ আশঙ্কার কারণ ছিল না। সুতরাং ওই দৃষ্টিতে হয়তো আরো কিছু দরকার ছিল। সেটা আমি ফোটাতে পারিনি। বলতে পারব না কেন? নিজের উপর মমতায় যদি বল, তবে আমি প্রতিবাদ করব না। কিন্তু মন আমার তাতে সায় দেবে না।
সুলতা বললে—তাই মেনে নিলাম। বল। সংসারে দিনেও মানুষের ছায়া পড়ে মাটির উপর, পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে সঙ্গে চলে। রাত্রে কায়াটাই দেহকে ঢেকে নেয়। তুমি বলে যাও না কি হল। তাতেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে।
—ঠিক বলেছ। হিলডা আমাকে সেলাম করে বললে, সালাম হুজুর। আপনি ভি কলকাতা যাচ্ছেন? আমি ভি যাচ্ছি—কুইনিকে নিয়ে।
—কেন? হঠাৎ কলকাতা যাচ্ছ কেন?
—পুছেন হুজুর ইয়ে ছোকরাকে পুছেন।—ই আমাদের আপনা আদমী। কলকাতায় কাম করে, ইখানে কভি কভি আসে—ওহি কলকাতায় মোকামের ভাড়া আদায় করে।
কুইনি তার আগেই মৃদুস্বরে বললে, কলকাতায় সেই বাড়ীর ভাড়াটেরা গোলমাল করছে স্যার। ওদের কাছে মাসে মাসে লোক পাঠিয়ে ভাড়া আদায় করত দিদি, এবার তারা বলেছে—ভাড়া দেব কি? আদালত থেকে কি নোটিশ এসেছে যে বাড়ী আমার নয়। ভাড়া আমি পাব না।
—সে-কি?
—হ্যাঁ স্যার!
—কাগজপত্র কিছু পাওনি?
—না। মুখেই ওরা বলেছে। আর আমার নামেও একটা কি নোটিশ হয়েছে, সেটাও ভাড়াটেদের কাছে আছে। দেয়নি।
এতক্ষণে সেই লোকটা কথা বললে—হাঁ হুজুর। দিলো না আমাকে।—
জিজ্ঞাসা করলাম—কি নাম তোমার?
আমার নাম হুজুর জন চৌধুরী। আমি বাঙালি ক্রীশ্চান। তবে কুইনিদের সঙ্গে একটা রিলেশন আছে। আমি জানি না। তবে ওদের ভালবাসি!
হিলডা রূঢ়স্বরে বলে উঠল—ই কাম সেই হারামী-হ্যারিসের কাম আছে হুজুর! ওহি হারামজাদা এইসব লটপট লাগা দিহিস! ওহি সোওয়াইন। কুত্তিকে বাচ্চা।
—চুপ কর দিদি। আগে সেখানে চল, দেখ কি ব্যাপার। তারপর বলো।
হিলডা বললে, পানি আর তেল। এ দুনে কভি মিলে নারে কুইনি। তুই তো পুরা গোয়ান নেহিনা। তু বাঙালী!
সুরেশ্বর বললে, আমি বললাম, সুলতা—তুমিও তো বাঙালী হিলডা। এদেশে এতদিন বাস করছ—গোয়া কখনো দেখনি, পর্তুগালের নামও হয়তো জান না। এখানে বাস করছ ভাত খাচ্ছ, পানি খাচ্ছ, বাংলা বুলি বলছ, বাঙালী নও কেন?
হিলডা তবু বললে—নেহি হুজুর, হামি লোক হারমাদদের বেটাবেটী। মুলুক হামাদের গোয়া। উসকো আগে পোর্তুগালসে হামি লোক আসিয়াছিলাম। হামি জানি বাবু।
আমি আর কথা বাড়াইনি। ট্যাক্সিটা এসে গেল। আমি রঘুকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।
***