প্ৰথম খণ্ড - আদি পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পর্ব
তৃতীয় খণ্ড
1 of 2

কীর্তিহাটের কড়চা – ১.৫

কীর্তিহাটের বাড়ী ছিল রায়দের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এবং তার এগার আনা অংশ ছিল দেবেশ্বর রায়ের ছেলেদের অর্থাৎ সুরেশ্বরের বাপ-জেঠার। ছোট ভাই রামেশ্বর সবই বিক্রী করেছিলেন ভাইদের কাছে। দেবেশ্বর তাঁকে সম্পত্তি পত্তনী বিলি করতে সহজ অনুমতি দিয়েছিলেন, শিবেশ্বরের অনুমতি ছিল শর্তসাপেক্ষ। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন সম্পত্তি পত্তনী বিলি করতে হলে ভাইদের করতে হবে। বাড়ী বিক্রী করতে পারবেন না। কিন্তু দেবেশ্বর রামেশ্বরের জন্য শিবেশ্বরের বিরোধিতা করেই একলাই বাড়ীর অংশ কিনেছিলেন। তাতে শিবেশ্বর আপত্তি করেননি। তিনি জানতেন—রামেশ্বর বা দেবেশ্বর বা তাঁদের ছেলেরা কেউ এখানে বাস করতে আসবেন না। তাই ভাইদের যারই হোক সবটাই তিনি ইচ্ছেমত ভোগদখল করতে পারবেন। বাড়ীটার নিজের নিজের অংশ এঁরা মেরামত করতেন- তালা বন্ধও করে যেতেন—শিবেশ্বর সে তালা খুলে, প্রয়োজন হ’লে ভেঙে ব্যবহার করতেন, না করে তাঁর উপায়ও ছিল না। কারণ পুত্র তাঁর ছয়টি, কন্যা ছয়টি—তাদের সন্তানসন্ততি ছেলেদের তরফে সতেরো জন। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ীতে থাকে—যখন আসে তখন কোলাহল সম্পর্কে নিজেই শিবেশ্বর বলেন-ওঃ, বিরাট রাজার উত্তর গোগৃহসম উথলিছে সমুদ্রের মত। এবং গালাগাল করতেন ছেলেদের এত সন্তান-সন্ততির জন্য। কথাবার্তায় তাঁর আবেগ রণরণ করত। ওটা যেন তাঁর স্বভাবধর্ম ছিল। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাঁর থিয়েটারি অভ্যাস। প্রথম যৌবন থেকে তাঁর থিয়েটারে ছিল প্রবল আসক্তি। থিয়েটারে পার্ট ভাল করতেন। নায়ক সাজতেন। তাতেও আবেগের পার্ট হলে তিনি প্রায় মদমত্ত হস্তীর মত হয়ে উঠতেন। সেই পারঙ্গমতা এবং স্বভাবগত আবেগবশে তিনি বলতে গেলে গোটা জীবনটাকেই নাটকের নায়কের ভূমিকা করে নিয়েছিলেন। ওই যে বলতেন—ওঃ বিরাট রাজার উত্তর গোগৃহসম উথলিছে সমুদ্রের মত।—ঠিক নাটকের ঢঙে বলতেন। নাটকীয় ভঙ্গি এবং ঢঙেই তিনি সুরেশ্বর এবং হেমলতাকে অভ্যর্থনা করলেন, যখন তাঁরা যোগেশ্বরের শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে কীর্তিহাটে পৌঁছুলেন। নায়েব টেলিগ্রাম করেই নিশ্চিন্ত ছিলেন না—নিজে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে কীর্তিহাটে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে কীর্তিহাট খুব বেশী দূর নয়; ট্রেনে পাঁচ ঘণ্টা লাগত তখন। শিবেশ্বরকে যোগেশ্বরের মৃত্যু-সংবাদ এবং সুরেশ্বর ও হেমলতা শ্রাদ্ধের জন্য এখানে আসছেন—সংবাদটা দিয়েই নায়েব আর উত্তরের অপেক্ষা করেনি—বেরিয়ে এসে দেবোত্তরের নায়েবের সঙ্গে গুটি কয়েক কথা বলে বেরিয়ে পড়েছিল গ্রামে। রায়বংশের দশরাত্রির জ্ঞাতি সাতপুরুষ ঊর্ধ্বে—কুড়ারাম ভট্টাচার্যের সহোদরদের বংশধর ভট্টাচার্যদের বাড়ী গিয়ে তাদের সঙ্গেও কথা বলে এসেছিল। ফিরে এসে আবার গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল শিবেশ্বর রায়ের সামনে। শিবেশ্বর বসে ছিলেন—একখানা মোটা দলিলের উপর হাত রেখে নিরাসক্ত মুক্ত পুরুষের মত। নায়েব গলার সাড়া দিয়ে ভিতরে এসে তক্তাপোশের একপ্রান্তে বসে বলেছিলেন—তা হ’লে—

—কিছু বলছ? যেন চমক ভেঙে প্রশ্ন করেছিলেন শিবেশ্বর।

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আজকেই তো মা আসছেন, সুরেশ্বরবাবুকে নিয়ে

বাধা দিয়ে শিবেশ্বর বলেছিলেন, টেলিগ্রাম করে দাও আসতে নিষেধ করে।

—নিষেধ করে দেব?

—হ্যাঁ।

—এমন আদেশ কেন করছেন?

—আদেশ আমার নয়, আদেশ এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা সোমেশ্বর রায়ের। এই তাঁর উইল- তারপর এটা হল স্বর্গীয় পিতা রত্নেশ্বর রায়ের। যারা স্বধর্মচ্যুত বা ধর্মত্যাগী তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রায়বাড়ীর নাই। তুমি তো জানো!

সুরেশ্বরের নায়েব বলেছিল—তা আমাদের স্বর্গীয় বাবু তো ধর্মত্যাগ করেননি!

—আর ধর্মত্যাগ কাকে বলে?

—কাকে বলে তা জানি না। তবে তিনি কোনদিন ধর্মত্যাগ করেননি।

—আমার মতে ও বিচারে করেছিলেন। আমি এ অশৌচ নেব না।

—তা নেবেন না।

—নিশ্চয়, ধর্মই সনাতন, তাকে ত্যাগ আমি করতে পারি না।

আলোচনাটা কতদূর অগ্রসর হত কেউ বলতে পারে না, তবে এইখানেই হাত নড়ে গিয়ে বাক্যের মাঝখানেই একটা দাঁড়ি পড়ে যাওয়ার মতো রায়বংশের ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষের জ্ঞাতি ভট্টাচার্য বংশের দুজন মাতব্বর ভট্টাচার্য এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, একটা দাঁড়ি নয় দুটো দাঁড়ির মত। শিবেশ্বরেরই সমবয়সী।

—মধ্যম কত্তা রয়েছেন!

—কে? ও আপনারা! তা বেশ বেশ, এসেছেন ভালই হয়েছে। শুনেছেন তো যোগেশ্বর জার্মানীতে মারা গেছে। হাসপাতালে। জানেন তো সব, স্ত্রী-পুত্র ফেলে একটা ক্রীশ্চান মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ইয়োরোপ।

বার দুয়েক আক্ষেপের ভাব ও ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন—স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম ভয়াবহ। পরিণাম দেখুন!

সঙ্গে সঙ্গে মুখচোখের ভাব পালটে গেল, দীপ্ত হয়ে উঠল, বললেন—আমার পুত্র হলেও আমি এমন পুত্রের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতাম না, অশৌচ গ্রহণ করতাম না! তাই বলছিলাম হরচন্দ্রকে। হরচন্দ্র, কি বলে তুমি এলে বলতে যে সেই ধর্মত্যাগী যোগেশ্বরের কামান-শ্রাদ্ধ- এখানে হবে? এখনও চন্দ্র, সূর্য উদিত হচ্ছে, হরচন্দ্র। এখনও ধর্মের অন্তত একপাদও অবশিষ্ট।

তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে গোটা ঘরটা পায়চারি করে চিন্তিতভাবে ঘাড় হেঁট করে পিছন দিকে কোমরের কাছে হাত দুটি মুঠিতে আবদ্ধ ক’রে মধ্যে মধ্যে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন—হয় না, হয় না। এ হতে পারে না… অসম্ভব!

হঠাৎ নাটকের নাটকীয় গতিকে রূঢ় ভাবে ভেঙে দিয়ে শিবেশ্বরের জ্ঞাতি কাকা মহেন্দ্ৰ ভট্টাচার্য বলেছিলেন—আমরা কিন্তু অশৌচ গ্রহণ করব শিবেশ্বর।

শিবেশ্বর থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন—এবং নির্বাক হয়ে সবিস্ময় দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাক্যস্ফুর্তি হয় নি।

মহেন্দ্রর সঙ্গী জগবন্ধু মহেন্দ্রের ভাইপো, সুতরাং শিবেশ্বরের জ্ঞাতিভাই। তিনি বলেছিলেন—এমন কথা আপনি বলবেন আমরা ভাবিনি।

—ভেবে দেখুন!

—দেখবার কিছু নাই বাপু শিবেশ্বর। ও সব আলোচনা না করাই ভাল। দেখ, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে। থাক। আমরা সংবাদটা শুনে এসেছিলাম তোমার কাছে-আসতে হয়—তত্ত্ব-তল্লাস সামাজিক নিয়ম। আর-আর-নিয়মানুযায়ী অশৌচকালের মধ্যে যেমন আমাদের রাজ-রাজেশ্বরের অনুপ্রসাদ বিধি আছে, তার ব্যবস্থামত এখনও সংবাদ পেলাম না কেন সেইটে জানতে। দেবোত্তর নায়েবকে বলে এলাম। সে বললে—এখনও তো কত্তার হুকুম পাইনি, তবে আয়োজন আমি করছি—কিছুক্ষণ পরই কেউ গিয়ে ঘর ঘর বলে আসবে।

সোমেশ্বর রায় তাঁর দেবোত্তরের উইলে এই একটি ব্যবস্থা করে গেছেন। সেটা হল—তাঁর রায়বংশে এবং তাঁর পিতৃব্য দুজনের বংশের কারও মৃত্যু ঘটলে অশৌচের দশদিন তাঁরা রাজ রাজেশ্বরের প্রসাদ পাবেন। অবশ্য যাঁরা ইচ্ছা করবেন। বলা বাহুল্য, এ ইচ্ছা এক যাদের বাড়ী বা পরিবারে মৃত্যু ঘটে তারা ছাড়া সকলেরই হয়। বাকী সকলেই এ প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন। কারণ অ-তৈল অ-সম্বরাব্যঞ্জন বা হবিষ্যান্নের পরিবর্তে দেবতার প্রসাদ বলে ঘৃত-তৈলসিক্ত ব্যঞ্জন কে না খেতে চায়? সুতরাং এটা প্রচলিত আছে। শিবেশ্বর দেবোত্তরের ট্রাস্টি হিসেবে বেছে বেছে সাত পুরুষের বাইরে যারা তাদের বাদ দিয়েছেন। কিন্তু সাতপুরুষ পর্যন্ত এখনও ব্যবস্থা আছে। সেই নিয়মের কথা উল্লেখ করলেন মহেন্দ্র ভট্টাচার্য।

শিবেশ্বর তাঁকে কোন উত্তর দিলেন না। তিনি এক বিচিত্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যোগেশ্বরের নায়েব বা ম্যানেজার হরচন্দ্রের দিকে।

হঠাৎ নিচে লোকজনের সাড়া উঠতেই হরচন্দ্র উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে বললে-ও।

শিবেশ্বর তখনও তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হরচন্দ্র বললে—ঘরদোর পরিষ্কারের জন্য লোক পাঠাতে বলেছিলাম ঘোষালকে। এসে গিয়েছে দেখছি।

ঘোষাল এখানে দেবোত্তরের নায়েব।

শিবেশ্বর বললেন—হুঁ। তারপর বললেন —ঘরদোর পরিষ্কার করাবে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঁরা তো এখানে সন্ধ্যেতেই পৌঁছুচ্ছেন।

আবার শিবেশ্বর বললেন—হুঁ। সঙ্গে সঙ্গে একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল তাঁর। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবার লোক তিনি নন, তাই পড়ল কথাটাই প্রযোজ্য।

হরচন্দ্র বললে—ওঁরা তো কলকাতার বাসিন্দে, ধরণ-ধারণ একটু পরিষ্কার- মরিষ্কার! ময়লা টয়লা দেখতে পারেন না। তা ছাড়া রোগটোগকে ভয় করেন। গঙ্গাজলে ফিনাইল দিয়ে ধোবার হুকুম আছে।

কথাগুলি সাধারণ অর্থের অন্তরালে অনেক অর্থ ব্যক্ত করেছিল ইঙ্গিতে। সে ইঙ্গিত হল, যোগেশ্বরের তরফের যে ঘরগুলি শিবেশ্বরের পুত্রেরা দখল ক’রে বাস করছেন সেগুলি খালি করে দিতে হবে। তারই একখানা ঘরেই কথা হচ্ছিল—শিবেশ্বর এই ঘরেই বৈঠকখানা করেন। তাঁর খাস বৈঠকখানা। এবং পাশের ঘর দুখানায় তাঁর কনিষ্ঠা গৃহিণী থাকেন।

যোগেশ্বর থেকে তাঁর বড় ভাই যজ্ঞেশ্বর কলিয়ারীর ব্যবসায়ে বেশী অর্থের মালিক হয়েছিলেন একসময়, তিনি কলকাতায়, কাশীতে, পুরীতে, দার্জিলিং-এ, শিমুলতলায় বাড়ী করেছিলেন, এখানকার বাড়ীও মেরামত তিনি করিয়ে রাখেন। কিন্তু যোগেশ্বর সায়েবী রুচির লোক ছিলেন, তিনি যেখানে গেছেন হোটেলে থেকেছেন, বাড়ী কোথাও করেননি। কিন্তু কলকাতার বাড়ী এবং কীর্তিহাটের বাড়ী মেরামত করিয়েছিলেন নিজের রুচি অনুযায়ী যথেষ্ট খরচ করে। হেমলতাকে বিয়ে করবার ঠিক আগেই প্রথমবার। তখন তাঁর ইচ্ছে ছিল কীর্তিহাটে হানিমুন করবেন এবং তার পরেও মধ্যে মধ্যে আসবেন এখানে বিশ্রাম করবার জন্যে। কিন্তু তা কাজে পরিণত হয়নি। তবে কীর্তিহাটের বাড়ীর নূতন ঢঙ এবং রুচিকে তিনি বজায় রেখে এসেছিলেন নিয়মিত মেরামতে। এই যে-ঘর তিনখানা শিবেশ্বর এখন দখল ক’রে আছেন এ তিনখানা, যোগেশ্বর যতদিন দেশে ছিলেন অর্থাৎ চন্দ্রিকাকে নিয়ে ইয়োরোপ চলে যাবার পূর্ব পর্যন্ত, বন্ধই থাকত, শিবেশ্বরও জবর দখল করতে সাহস পাননি। তিনি ইয়োরোপ চলে যাবার পর থেকে তিনি দখলে এনেছেন। নায়েব হরচন্দ্র নীচের লোকজনের সাড়ার দিকে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে তাঁকে ইঙ্গিতে জানালে, ঘরগুলোকে হিন্দু মতে গঙ্গাজলের সঙ্গে সায়েবী বা বিজ্ঞানসম্মত মতে ফিনাইল মিশিয়ে শুদ্ধ এবং ডিসইনফেক্ট করে নিতে হবে।

মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলেন শিবেশ্বর। তাঁর মুখখানা একবার রূঢ় কঠোর হচ্ছিল, তারপরেই আবার অসহায়ভাবে করুণ হয়ে উঠেছিল। সব থেকে লজ্জা পাচ্ছিলেন জ্ঞাতিখুড়ো মহেন্দ্ৰ ভট্টাচার্য এবং ভাই জগবন্ধু ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে।

হরচন্দ্র জানালার কাছে গিয়ে বললে—দাঁড়া দাঁড়া যাচ্ছি। তারপর শিবেশ্বরের দিকে তাকালে। তার অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট।

শিবেশ্বর মহেন্দ্র ভট্টাচার্যদের দিকে এবার ফিরে তাকিয়ে বললেন—নায়েব ঘোষাল যখন আয়োজন করব, লোক পাঠাব বলেছে তখন লোক যাবে মহেন্দ্রকাকা। আর এ তো জাতিগোষ্ঠীর কারুর মৃত্যুতে অশৌচ নয়, এ যোগেশ্বর-রায় বংশের তিন শরিকের এক শরিক। তার মৃত্যুতে অশৌচ-এ বলতে হবে কেন?

মহেন্দ্র বললেন-হ্যাঁ। সেই তো কথা। কিন্তু পুকুরে দেখলাম জাল পড়ছে। মাছ ধরছে তোমাদের বাড়ীর জন্যে। তোমার নাতিরা কজন বসে আছে। বলে—

—কি বলে? কেড়ে নিলেন কথাটা শিবেশ্বর। তারপর বিস্ফোরকের মত ফেটে পড়লেন- হ্যাঁ, বড় ছেলে আমার ধুয়ো তুলেছে বটে। দাদা তো একটা ক্রীশ্চান মেয়ে নিয়ে ইউরোপ গিয়ে ক্রীশ্চান হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে অশৌচ কেন নেব আমরা? এ দলিলপত্র সে-ই তো বের করে দেখতে চাইলে। আমি দেখছিলাম। কিন্তু মাছ ধরাচ্ছে খাবে বলে এ তো জানিনে। অপগণ্ড আর কাকে বলে? মদ্য পান ক’রে সিঁদুরের ফোঁটা কপালে এঁকে তান্ত্রিক! তুমি যাও মহেন্দ্ৰকাকা, ম্যানেজার ঘোষালকে একবার পাঠিয়ে দিয়ে যাও।

মহেন্দ্র ভট্টাচার্য এবং জগবন্ধু ভট্টাচার্য চলে গেলেন।

শিবেশ্বর বললেন—হরচন্দ্র!

—আজ্ঞে বলুন বাবু।

—আমি হেরে গেলাম।

—আজ্ঞে না বাবু! আপনি হারতে পারেন, না, আপনাকে কেউ হারাতে পারে? আপনি জিতলেন। আপনার ভাইপো—।

কথাতে কানই দিলেন না শিবেশ্বর, বললেন -দেখ, কথায় আছে পরভাতি হই সেও ভাল তবু পরঘরি না হই। ওঃ! ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। অর্থাৎ নিজের অংশের বাড়ী মেরামত না করিয়ে ভাইপোদের বাড়ী দখল করে থেকে।

হরচন্দ্র অকারণে ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে-আমি যাই বাবু। ওই বিবি-মহলটা বরং সাফ করিয়ে নিই। ওখানেই ওঁরা উঠবেন। বেশ নিরিবিলি থাকবেন। পাঁচজনের গোলমাল থাকবে না। সেই ভাল হবে।

রায়দের বাড়ী প্রকাণ্ড। ইমারত অনেক। প্রথম পুরুষ সোমেশ্বরকে সামনে রেখে তাঁর বাপ কুড়ারাম ভট্টাচার্য প্রথম একখানা চকমিলান দালান তৈরী করিয়েছিলেন। তারপর তার সামনে তৈরী করিয়েছিলেন কালীবাড়ী, নাট-মন্দির, কাছারী। তারপর সোমেশ্বর তৈরী করিয়েছিলেন পিছন দিকে। আর এক মহল, সেটা করেছিলেন তাঁর কন্যা-জামাতার জন্যে। তাঁর পুত্র বীরেশ্বর। তিনি করিয়েছিলেন মূল বাড়ী থেকে পৃথক করে একটু সরে এসে একেবারে কংসাবতীর ধারে, কিনারায় পোস্তা বেঁধে ছোট একটি সুন্দর বাড়ী। কিছুটা দোতলা কিছুটা একতলা। এই বাড়ীতে তিনি বিবাহের পর বাস করতেন স্ত্রীকে নিয়ে। তিনি ছিলেন সাহেবী মেজাজের লোক। তারপর স্ত্রীকে ত্যাগ করে তাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে বাস করতেন এক কলকাতার বাঈকে নিয়ে। লোকে বলত বিবি। সেই নামে বাড়ীটারও নাম হয়ে গিয়েছিল বিবি-মহল। তারপর তার পরবর্তী পুরুষ রত্নেশ্বর—বীরেশ্বর রায়ের ভাগ্নে এবং পোষ্যপুত্র—তিনি করিয়েছিলেন অন্দরের দু’মহলের সঙ্গে যোগ করে আর এক মহল। তাঁর তিন ছেলে, তিন ছেলের জন্য হিসেব করে তিন মহল সম্পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর আমলে বিবি-মহল হয়েছিল সাহেব মহল-তারপর নাম হয়েছিল গেস্ট হাউস। পরবর্তীকালে দেবেশ্বর কিনেছিলেন এ বাড়ী দুই ভাইয়ের কাছ থেকে।

মহলটার দুর্নাম ছিল। মহলটায় নাকি দুর্ভাগ্যের বোঝা অদৃশ্যভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সুতরাং ইংরাজী উনিশশো সাল পড়িপড়ি সময়টায় শিবেশ্বরের মত লোক সানন্দেই বিক্রী করেছিলেন এবং রামেশ্বর ব্যারিস্টারি পড়তে যাবার সময় ওটার অংশ দাদাকে বেচেছিলেন অর্থের জন্য। দেবেশ্বরের বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বর কলিয়ারী নিয়েছিলেন এবং দেবতা ধর্ম-এর প্রতি আসক্তি এবং বিশ্বাস যতই যুগধর্মে দুর্বল হোক ব্যবসার লাভ লোকসানের খাতিরে গ্রহ মানতেন —প্রবাল, গোমেদ, নীলাতে যথেষ্ট বিশ্বাস করতেন। তা ছাড়াও কোন সম্পত্তি বা কোন জিনিসের পয়- অপয় মানতেন। ইংরিজিনবীশ যোগেশ্বর সেটা মানতেন না। তাই মূল বাড়ীর অংশ কম নিয়ে তিনি এই বিবি-মহল নিতে আপত্তি করেননি। এই বিবি-মহলেই দেবেশ্বরের মৃত্যুর কারণ ঘটেছিল। কারণটা কি তা কেউ সঠিক জানে না, তবে দেবেশ্বর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তারপর জ্ঞান হয়ে তিনি নিজেই প্রায় উন্মত্ত বিভ্রান্তের মত ওখান থেকে বেরিয়ে এসে পড়েছিলেন ঠাকুরবাড়ীতে। সেইখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। আরও কিছু অপ্রিয় ঘটনার স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িত।

যোগেশ্বর যখন হেমলতাকে নিয়ে এখানে প্রথম আসেন তখন ইচ্ছা ছিল এই বাড়ীতে উঠবেন। কিন্তু স্টেশনে নেমে কেমন পরিবর্তন ঘটেছিল যোগেশ্বরের। তিনি ভিতর-বাড়ীতে এই ঘর কখানাতেই বাস করেছিলেন কয়েক দিন।

তিন মহল রায়বাড়ীতে উপরে-নীচে প্রত্যেক মহলে বারোখানা হিসেবে ছত্রিশখানা ঘর। দেবেশ্বর ছোট ভাই রামেশ্বরের অংশ কিনেছিলেন বলে তাঁর অংশে ছিল চব্বিশখানা ঘর দুটো মহলে মিলিয়ে। প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগের তৈরী বাড়ী—তার নীচের তলাগুলি স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে। সে মেরামত সত্ত্বেও হয়েছে। এবং আগের আমলে এগুলিতে ছিল লক্ষ্মীর ঘর, ভাঁড়ার। তাছাড়া তরকারীর ঘর, পান সাজার ঘর, কাপড়-চোপড়ের ঘর, সুতিকাগৃহ, খাবার ঘর, চাকরঝিদের বাসের ঘর। শুধু লক্ষ্মীর ঘরের সামনে বড় দরদালানটি ছিল দিনের ভাগে অন্দরবাসিনীদের ব্যবহারের স্থান। সুতরাং এখন শিবেশ্বরকে যোগেশ্বরের অন্দর মহলের শ্রেষ্ঠ ঘর তিনখানি ছেড়ে দিয়ে ওই বিবি-মহল ছাড়া থাকবার যোগ্য স্থান আর ছিল না। অন্ততঃ এমন আরামদায়ক আর কোন ঘর যোগেশ্বরের অংশে ছিল না।

হরচন্দ্র সেই বিবি-মহলেই সুরেশ্বর এবং হেমলতার বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেইখানেই উঠেছিল সুরেশ্বর হেমলতার সঙ্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *