গৌড়ানন্দ কবি ভনে

কীভাবে আমরা লাভ করতে পারি

কীভাবে আমরা লাভ করতে পারি

আমার প্রতিবেশী নিমাইদাকে সেদিন বাজার থেকে এক কিলো ওজনের একটা ইলিশ মাছ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এমনিতেই তিনি কখনও বাজারে টাজারে বিশেষ যান না। কিম্বা বেহিসাবী লোক বলেও তাঁর বদনাম শুনিনি।

তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ব্যাপার, আজ যে এত বড় একটা ইলিশ। বাড়িতে গেস্ট এসেছে না কি?’

‘না না,’ নিমাইদা বললেন। ‘দোকানে যাব বলে বেরিয়েছি। হঠাৎ ভাবলাম, যাই, বাজারটা একবার ঘুরেই যাই। ঢুকেই দেখি ইলিশ। ফারসট ক্লাস সব ইলিশ। আর কী সস্তা। তাই আর লোভ সামলাতে পারলাম না, বুঝলেন। তাই একটা কিনেই ফেললাম। একেবারে পাক্কা এক কিলো।’

‘কত করে কিনলেন?’

‘দু টাকা আশী কিলো।

‘বলেন কি! তাহলে যাই, আমিও একটা নিয়ে আসি। দুম করে এমন দাম নেমে গেল? কালকেও দেখলাম দশ টাকা হাঁকছে। খুব আমদানী হয়েছে বুঝি?’

‘আমদানী? কই তেমন একটা বেশি তো কিছু দেখলাম না। অবিশ্যি আমি তো বাজারে বড় একটা যাই টাই নে।

‘ভিড় দেখলেন খুব?’

‘না, তেমন কিছু ভিড় এখনও দেখলাম না। তবে পরে হয়তো হতে পারে।’

‘তো যা বলেছেন। এখনও হয়তো সবাই ব্যাপারটা জানে না।’

‘তাই হবে। সবাই হয়তো ভাবছে দর হয়তো চড়াই আছে।’

‘তা বই কি। এই দেখুন না, আমি তো রোজই বাজারে যাই। দামের কথা ভেবে কাটা পোনা, ভেটকি, কি ইলিশের দিকে উঁকিও মারিনে। জানি তো, দশ টাকা বারো টাকা দিয়ে মাছের কিলো কেনা আমার সাধ্যে কুলোবে না।’

‘দশ টাকা কিলো হলে আমিই কি কিনতাম না কি ভেবেছেন। দোকান করে খাই। অত ফুটানি আমার নেই। নেহাৎ দু টাকা আশীতে পেয়ে গেলাম এক কিলো তাই কিনে ফেললাম একটা। আজ আরও কিছু কিনব।’

‘কি কাটা পোনা? ‘

‘না না, মাছ আর না। তিনটে তো প্রাণী বাড়িতে। এক কিলোই যথেষ্ট। অন্য সব জিনিস কিনব। কিছুই তো কিনতে পারিনে দামের ভয়ে। কটা টাকা আর রোজগার করি বলুন? অথচ দরকার তো আর ছাড়ে না। আমার দরকার, আমার পরিবারের দরকার, আমার মেয়ের দরকার। তাই ভাবছি এবেলা আর দোকানে যাব না। বাড়ি গিয়ে যার যে জিনিস দরকার আগে একটা লিসটি করে ফেলি। তারপর সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পড়ি।’

‘কী ব্যাপার বলুন তো? লটারি জিতেছেন না কি?’

‘আরে না না, ওসব কিছু নয়। আজ কেনাকাটা করলে কিছু সুবিধেই পেয়ে যাব তো, তাই।’

‘যেমন এই ইলিশটা পেয়ে গেলেন, তেমনি।

ঠিক ধরেছেন। তা আপনিও তো মশাই আমারই মতো ছা পোষা লোক, আপনার সংসারেও তো অনেক কিছুরই দরকার?’

‘দরকার নয় আবার।’

‘তাহলে আপনিও চলুন না। ঝাঁ করে গিয়ে আগে দু টাকা আশী পয়সা কিলোর মাছটা কিনে আনুন। তারপর কত্তা গিন্নীতে মিলে যা যা দরকার চটপট তার একটা ফর্দ করে ফেলুন। তারপর চলুন দুজনে গিয়ে সোরগোল পড়ার আগেই যা যা কেনবার কিনে ফেলি গে।’

‘সোরগোল। কীসের সোরগোল?’

‘আগে ঝাঁ করে মাছটা কিনে আনুন দেখি। পরে বলছি।’

মাছের বাজারে ঢুকতেই রাখালবাবুর সঙ্গে দেখা। ওঁকেও ক্বচিৎ কখনো বাজারে দেখি। ওঁর হাতেও দেখি এক কিলো ইলিশ। আমাকে দেখেই একেবারে হিড়হিড় করে মাছওয়ালার কাছে টেনে নিয়ে গেলেন।

তারপর বললেন, ‘এই যে ভাই, আমার এই বন্ধুটিকেও একটা দাও।

মাছওয়ালা বলল, ‘এক কিলো তো?’

আমার হয়ে উনিই বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ এক কিলো তো নিশ্চয়ই।’

আমাকে বললেন, ‘তবে ডিম ছাড়া আর পেলেন না। আমিও পাইনি। নিমাইবাবুর মুখে শোনামাত্র চলে এসেছি। তাও দেখুন ডিম ছাড়া মাছ হাতছাড়া হয়ে গেল। যে-গুলো আছে, এগুলো সব ছোট ছোট। তা আজকের দিনে ছোট মাছ কে আর ছোঁয়। কি বলেন?’

‘আরে দামের ভয়ে ছোট মাছ তো রোজই খাচ্ছি। বড় মাছ কষে কিনেছি মনেই তো পড়ে না। তা ডিম ভরা ইলিশ তো খেতে খারাপ নয়। ডিমটা বাড়তি পাওয়া যাচ্ছে। ভাজা খান, অম্বল খান। যা আপনার খুশি।’

‘হ্যাঁ সেটা একটা মস্ত লাভ বই কি?’

মাছওয়ালা দাম চাইতেই একখানা পাঁচ টাকার নোট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে ফেরৎ পয়সার আশায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

মাছওয়ালা পাঁচ টাকার নোটটা নিয়ে বলল, ‘এক কিলো দিয়েছি বাবু, আরও পাঁচ টাকা দিন।’

আমি অবাক হয়ে যেই বলেছি, ‘সে কী। তবে যে শুনলাম দু টাকা—’

রাখালবাবু সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ টাকার একখানা নোট মাছওয়ালার হাতে গুঁজে দিয়ে আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলেন।

বললেন, ‘সর্বনাশ করেছিলেন আরেকটু হলে।

বললাম, ‘সর্বনাশটা কোথায় করলাম মশাই। মাছের দাম দশ টাকাই বা দিতে গেলেন কেন? নিমাইবাবু দু টাকা আশি পয়সা কিলোর মাছ নিয়ে গেলেন, তা জানেন?’

‘জানব না কেন?’ শান্তভাবে রাখালবাবু বললেন, ‘আমিও তো সেই দরেই কিনলাম।’

‘বাঃ! বেশ তো! নিজেরা দু টাকা আশী পয়সা করে মাছ কিনে আমাকে দশ টাকায় ঠেকিয়ে দিলেন। কেন, আমার কী ব্ল্যাকের টাকা।

কীভাবে আমরা লাভ করতে পারি বাকি ৮৫

‘না না ব্ল্যাকের টাকা হবে কেন? চবনের টাকা। তা আপনিও তো প্রকৃতপক্ষে সেই দু টাকা আশীতেই মাছটা কিনলেন। আপনি কি আজ কাগজ পড়েন নি? চবনের স্টেটমেন্ট পড়েন নি?’

‘না তো। কেন?’

‘চবন লোকসভায় বলেছেন,’ রাখালবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘টাকার দাম ২৮ পয়সা হয়ে গিয়েছে। মাছওয়ালা তা জানে না। জানলে দশ টাকার মাছ ২৮ টাকা হাঁকতো বুঝলেন। ও টের পায়নি বলেই আমরা দশ টাকার মাছ আজ দু টাকা আশিতেই পেয়ে গেলাম। একেবারে পঁচিশ টাকা কুড়ি পয়সা প্রফিট।’

এতক্ষণে বুকের বোঝা আলগা হল। পকেট থেকে ওঁকে একখানা পাঁচ টাকা দিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরলাম। এক্ষুনি ফর্দ তৈরি করে নিমাইদার সঙ্গে বাগড়ি মার্কেটে যেতে হবে। এ সুযোগ ছাড়া মুখার্মী হবে।

৩১ জুলাই ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *