ষষ্ঠ শাখার প্রাণী
কীট-পতঙ্গ
তোমরা পঞ্চম শাখার নানা রকম প্রাণীর কথা শুনিলে। ধাপে ধাপে প্রাণীরা কেমন উন্নতির দিকে চলিয়াছে, বোধ হয় তাহা বুঝিতে পারিয়াছ।
প্রথম শাখার প্রাণীদের শরীরে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাই; ইচ্ছামত শরীর নাড়িবার জন্য স্নায়ু নাই; এমন কি উদরটা পর্য্যন্ত নাই। ইহাদের সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাণী জোঁকের তুলনা করিয়া দেখ। জোঁকের দেহে উদর আছে, মুখ-চোখ আছে, শিকারের গা চিরিয়া রক্ত বাহির করিবার জন্য চোয়ালে অস্ত্র লাগানো আছে, তা’ছাড়া ডিম প্রসব করিয়া সন্তান উৎপন্ন করা এবং ইচ্ছামত শরীর নাড়াচাড়া করার ব্যবস্থাও ইহাদের দেহে রহিয়াছে। প্রথম শাখার প্রাণী আমিবার সঙ্গে জোঁকদের যেন আকাশ-পাতাল তফাৎ।
আমরা যষ্ঠ শাখার যে-সকল প্রাণীর কথা এখন বলিব, তাহা শুনিলে তোমরা বুঝিবে, ইহারা আরো উন্নত। জীবনের কাজে এবং দেহের উন্নতিতে ইহারা অনেক বড় প্রাণীদেরও হারাইয়া দেয়।
চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া, গোবরে পোকা, ফড়িং, শুঁয়ো পোকা, প্রজাপতি, মাকড়সা, বিছে, কেন্নো, মশা, মাছি, ছারপোকা প্রভৃতি সকলেই যষ্ঠ শাখার প্রাণী। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়াদের সঙ্গে মশা, মাছি ও প্রজাপতিরা কি রকমে এক শাখার প্রাণী হইল? কিন্তু সত্যই ইহারা এক শাখার প্রাণী। ইহাদের দেহের মোটামুটি গড়নের কথা মনে করিলে তোমরা ইহা বুঝিতে পারিবে।
সাপ, ব্যাঙ্, মাছ, গোরু, ভেড়া প্রভৃতি জন্তুদের শরীর কি রকমে প্রস্তুত, তাহা তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। ইহাদের দেহের ভিতরে নানা জায়গায় সরু বা মোটা হাড় আছে এবং সেই হাড়ের উপরে আবার মাংস লাগানো আছে। দেহে হাড় থাকে বলিয়া বড় প্রাণীরা এত দৃঢ় হয় এবং লাফালাফি করিতে পারে। শরীরে হাড় না থাকিলে ইহারা কেঁচো বা জোঁকের মত নির্জীবভাবে নড়াচড়া করিত। ফড়িং, প্রজাপতি প্রভৃতি ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রাণীর শরীরে মাংসের মত নরম জিনিস আছে বটে, কিন্তু ভিতরে হাড় নাই। তাহাদের সমস্ত দেহটাই হাড়ের মত কঠিন আবরণে ঢাকা। মানুষ, গোরু প্রভৃতি বড় প্রাণীদের শরীরের ভিতরে যে হাড় থাকে, তাহা শরীরকে দৃঢ় করে, কিন্তু আড়ষ্ট করে না। যেখানে যেমনটি হইলে সুবিধা হয়, হাড়গুলি খণ্ডখণ্ড-ভাবে সেই রকমে জোড়া থাকে। যষ্ঠ শাখার কীট-পতঙ্গদের দেহ হাড়ে ঢাকা থাকিলেও তাহাতে শরীর আড়ষ্ট হয় না। একটা প্রজাপতি, গোবরে পোকা বা মাছি ধরিয়া পরীক্ষা করিয়ো, দেখিবে, তাহাদের গা হাড়ের মত শক্ত। সমস্ত শরীর চামড়া দিয়া ঢাকা নাই,—হাড়ের মত একটা জিনিস দিয়া আচ্ছন্ন। কিন্তু এই হাড়ের আবরণে পাছে শরীরটা আড়ষ্ট হইয়া যায়, এইজন্য হাড়ের আবরণ আংটির মত অনেকগুলি অংশে ভাগ করা থাকে এবং সেগুলি পাতলা চামড়া দিয়া পরস্পরের সহিত জোড়া থাকে। কাজেই এই অবস্থায় ইহারা শরীরটাকে ইচ্ছামত হেলাইতে দোলাইতে পারে। বোল্তা, কেন্নো বা বিছের শরীরের কঠিন আবরণে ঐ আংটির মত ভাগ স্পষ্ট দেখিতে পাইবে। দেহের আবরণ এই রকম ভাঙা ভাঙা থাকে বলিয়াই বোল্তা, কেন্নো ও বিছেরা ইচ্ছামত শরীরগুলিকে বাঁকাইতে পারে। কেবল বোল্তা, কেন্নো, মাছি বা প্রজাপতির দেহই যে ঐ রকম, তাহা নয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রত্যেক প্রাণীই ঐরকম দেহ লইয়া জন্মে। পরস্পরের শরীরে এই মিল আছে বলিয়া জল স্থল আকাশের নানা রকম প্রাণীকে বৈজ্ঞানিকেরা একই শাখায় ফেলিয়াছেন। চিংড়ি মাছ এবং কাঁকড়া জলের প্রাণী। ইহাদের দেহ কেন্নো, বিছে ও মৌমাছিদের মত কঠিন আবরণে ঢাকা আছে, এইজন্য ইহারা যষ্ঠ শাখায় পড়িয়াছে।
আমরা যাহা খাই, তাহার সার ভাগ দিয়া শরীরের আয়তন বাড়ে। পাঁচ ছয় বৎসর আগের চেয়ে তোমাদের শরীর কত বড় হইয়াছে, একবার ভাবিয়া দেখ। সে-সময়ের জামাগুলো হয় ত এখন তোমার গায়েই লাগিবে না। এই পাঁচ ছয় বৎসর ধরিয়া যাহা আহার করিয়াছ, তাহাই তোমাদের গায়ে নূতন মাংস যোগ করিয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভিতরকার হাড়গুলিকে মোটা করিয়াছে। ষষ্ঠ শাখার সকল প্রাণীই আহার করিয়া এই রকমেই বড় হয়। কিন্তু তাহাদের দেহে যে কৌটার মত কঠিন আবরণ থাকে, তাহা বাড়ে না। তোমার বাক্সে কতগুলি বই আঁটে জানি না। মনে কর, তাহাতে আটখানা বই রাখা যায়। এখন যদি সেই বাক্সে বারো খানা বই রাখিয়া তুমি ডালা বন্ধ করিতে চেষ্টা কর, তবে বাক্স ফাটিয়া যায়। যষ্ঠ শাখার কতক প্রাণী যখন আহার করিয়া দেহ বড় করে, তখন তাহাদেরও ঐ বাক্সের মত দুর্গতি হয়। ছোট কঠিন আবরণের মধ্যে উহাদের বড় দেহ থাকিতে পারে না। কাজেই আবরণটি ফাটিয়া শরীর হইতে খসিয়া পড়ে এবং তাহার জায়গায় নূতন বড় আবরণ জন্মিতে থাকে। এই ব্যাপারটা ঠিক সাপের খোলস-ছাড়ার মত। দেহ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাপের গায়ের আবরণ অর্থাৎ খোলস বড় হয় না। কাছেই ছোট খোলসের মধ্যে দেহ বড় হইতে থাকিলে, তাহা শরীর হইতে ছিঁড়িয়া খসিয়া পড়ে। আরসুলা, মাকড়সা, ছারপোকা প্রভৃতির গায়ের কঠিন আবরণের দশাও তাহাই হয়। ইহারা যেমন বড় হইতে থাকে, গায়ের আবরণ তেমনি খসিয়া পড়ে। ষষ্ঠ শাখার অনেক প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেকবার এই রকমে খোলস্ ছাড়ে। চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়া এই জাতীয় প্রাণী,—ইহারাও শরীরের উপরকার খোলা বার বার খসাইয়া বড় হয়।
প্রাণীদের প্রত্যেক শাখাতেই বিচিত্র আকৃতি-প্রকৃতির অনেক ভিন্ন প্রাণী আছে। কিন্তু যষ্ঠ শাখায় রকম রকম প্রাণীর সংখ্যা যত বেশি অন্য শাখার প্রাণীতে সে-রকম নয়। সমস্ত পৃথিবীতে ছোট-বড়তে মিলিয়া মোটামুটি পাঁচ লক্ষ কুড়ি হাজার রকমের প্রাণী আছে, তাহার মধ্যে এক ষষ্ঠ শাখাতেই চারি লক্ষ রকমের কীট-পতঙ্গ দেখা যায়। ইহাদের প্রত্যেকেরই আকৃতি-প্রকৃতি পৃথক্। কেহ উড়িয়া বেড়ায়, কেহ পা দিয়া মাটির উপরে হাঁটিয়া চলে; কাহারো উড়িবার ডানা আছে, কাহারো ডানা নাই, কেহ ছয়খানা পায়ে চলাফেরা করে, কেহ হয় ত শত শত পায়ে চলাফেরা করে। সুতরাং আমরা চারি লক্ষ রকমের কীট পতঙ্গের কথা তোমাদিগকে বলিতে পারিব না,—বলিতে গেলে হয় ত কুড়ি পঁচিশখানা বড় বড় কেতাব লিখিতে হইবে। তোমরা সর্ব্বদা যে-সকল পোকা-মাকড় দেখিতে পাও, আমরা এখানে কেবল তাহাদেরি জীবনের কথা দেহের কথা একটু বলিব। এগুলি ছাড়া তোমরা যদি কোনো নূতন পোকা-মাকড় দেখিতে পাও, তবে তোমরা নিজেই তাহাদের চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ লইতে পারিবে।
আমাদের ভারতবর্ষ গরম দেশ; য়ুরোপ-আমেরিকার অনেক জায়গা ভয়ানক ঠাণ্ডা। এজন্য আমাদের গরম দেশে যে-সকল পোকা-মাকড় জন্মে, বিদেশের ঠাণ্ডায় তাহা জন্মে না। অনেক পণ্ডিত লোকে মিলিয়া য়ুরোপ ও আমেরিকার সমস্ত পোকা-মাকড়ের বিবরণ বড় বড় বইতে লিখিয়া রাখিয়াছেন। কিন্তু আমাদের দেশের পোকা-মাকড়ের বিবরণ কোনো বইয়ে আজও ভালো পাওয়া যায় না। তোমরা সকলে মিলিয়া যদি আমাদের দেশের পোকা-মাকড়ের বিবরণ সংগ্রহ করিতে লাগিয়া যাও, তবে সকলের চেষ্টায় একখানি ভালো বই প্রস্তুত হইতে পারিবে।
তোমরা আগেই শুনিয়াছ, ষষ্ঠ শাখায় যে-সকল ভিন্ন ভিন্ন পোকা-মাকড় আছে, তাহাদের সংখ্যা প্রায় চারি লক্ষ। কাজেই এলোমেলো করিয়া এতগুলো প্রাণীর বিবরণ দিতে গেলে কাজ চলে না। তাই যষ্ঠ শাখার প্রাণীদিকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ছোট ভাগে ভাগ করিয়াছেন এবং তার পড়ে এক একটি ভাগের প্রাণীদের পরিচয় দিয়াছেন।
ভাগ অনেক রকমে করা যায়। খাবারের দোকানে দোকানদার রসগোল্লা জিলাপি নিম্কি শিঙাড়া ভাগ ভাগ করিয়া সাজাইয়া রাখে। ফলের দোকানেও ফলওয়ালা নারিকেল আম আপেল নাসপাতি সকলি ভাগ ভাগ করিয়া রাখে। কেবল ফলের চেহারা দেখিয়া কোন্টি নাসপাতি এবং কোন্টি আম তাহা ফল-ওয়ালা বুঝিয়া লয়। তোমাদের স্কুলের এতগুলি ছেলেকে মাষ্টার মহাশয়েরা ভাগ ভাগ করিয়া লেখা-পড়া শেখান। যাহারা বেশি লেখা-পড়া শিথিয়াছে, তাহারা ফার্ষ্ট ক্লাশে যায়; যাহারা ইহার চেয়ে কম শিখিয়াছে, তাহারা সেকেণ্ড ক্লাশে যায়। এই রকমে স্কুলের সকল ছেলেই এক একটা ক্লাশে গিয়া লেখা-পড়া শিখে। ড্রিলের সময়ে তোমাদের স্কুলের আবার আর এক রকমে ছেলে ভাগ করা হয়। যাহারা সব চেয়ে মাথায় উঁচু, তাহারা প্রথম সারিতে দাঁড়ায়,—তখন কোন্ ছেলে কোন্ ক্লাশে পড়ে, সেই হিসাবে দাঁড় করানো হয় না। তাহা হইলে তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, অনেক জিনিস থাকিলে সেগুলিকে নানা রকমে ভাগ করা যাইতে পারে। তুমি ওজন দেখিয়া ভাগ করিতে পার, আর একজন অন্য গুণ বা স্বভাব দেখিয়া ভাগ করিতে পারে। পণ্ডিতেরা চারি লক্ষ পোকা-মাকড়কে স্বভাব ও আকৃতি দেখিয়া ভাগ করিয়াছেন। আমরা সেই ভাগ অনুসারে তোমাদিগকে পোকা-মাকড়দের কথা বলিব।
ষষ্ঠ শাখার প্রাণীদের বিভাগ
এই শাখার প্রাণীদিগকে আমরা যে-রকম ভাগ করিব তাহা আগেই তোমাদিগকে বলিয়া রাখিতেছি।
প্রথম ভাগ।—এই ভাগে চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া প্রভৃতি কঠিনবর্ম্মী প্রাণীরা পড়িবে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই জলের প্রাণী কিন্তু পোকা-মাকড়দেরই জ্ঞাতি এবং সকলেরই শরীর গাঁটে গাঁটে ভাগ করা; কিন্তু গায়ের আবরণ খুব শক্ত। যোদ্ধারা লড়াই করিবার সময়ে যেমন বর্ম্ম পরে, ইহারা সেই রকম শক্ত আবরণে গা ঢাকিয়া রাখে, তাই হঠাৎ শত্রুরা ইহাদের অনিষ্ট করিতে পারে না। এই জন্যই ইহাদিগকে কঠিনবর্ম্মী বলিতেছি।
দ্বিতীয় ভাগ।—বোল্তা মাছি প্রজাপতি গোবরে-পোকা ফড়িং ইত্যাদি অনেক ছোট প্রাণী এই ভাগে পড়িবে। এই ভাগে যত প্রাণী আছে, ষষ্ঠ শাখার কোনো ভাগেই তত প্রাণী নাই। ইহাদের মধ্যে কতকগুলি আবার উড়িতে পারে। ইহাদের অনেকেরই শরীরে মাথা বুক ও লেজ এই তিনটি অংশ স্পষ্ট করিয়া দেখা যায়। বুকের তলায় অনেকগুলি পা থাকে; কিন্তু ইহারও সংখ্যা স্থির থাকে। গুণিলে প্রায় সকলেরি ছয়খানা করিয়া পা দেখিতে পাইবে। এই ভাগের প্রাণীদিগকে পতঙ্গ বলা যাইতে পারে।
তৃতীয় ভাগ।—এই ভাগের পোকা-মাকড়কে আমরা লূতা বলিব। “লূতা” মাকড়সার ভাল নাম। নানা রকম মাকড়সাই এই ভাগে আছে। প্রজাপতি বা ফড়িংদের মত ইহাদের শরীরে তিনটা ভাগ দেখা যায় না। যে-সব আংটির মত গাঁট দিয়া পোক-মাকড়ের দেহ প্রস্তুত, সেগুলি ইহাদের শরীরে একবারে গায়ে গায়ে জোড়া থাকে। পেটের তলার আংটিগুলিকে প্রায় চেনাই যায় না। দ্বিতীয় ভাগের প্রাণীদের মত ইহাদের পা ছয়খানা নয়; ইহাদের পায়ের সংখ্যা চারি জোড়া অর্থাৎ আটখানা।
চতুর্থ ভাগ।—এই ভাগের প্রাণীরা ভারি বিশ্রী। কেন্নো এবং বিছে এই দলের প্রধান পোকা। ইহাদেরও দেহ কঠিন আংটি দিয়া গড়া; কিন্তু পায়ের সংখ্যা অনেক বেশি। এই জন্য চতুর্থ ভাগের পোকা-মাকড়কে শতপদী বলা যাইতে পারে।