কি ভয়ানক! (অর্থাৎ সিদ-চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে অদ্ভুত ভয়াবহ রহস্য প্রকাশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ
পুলিশ-কৰ্ম্মচারীগণকে কিরূপে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হয়, অজ্ঞাত বিষয়ের অনুসন্ধানে প্রথম হইতে কিরূপে লিপ্ত হইতে হয়, অজ্ঞাতনামা অপরাধীকে কিরূপে ধৃত করিতে হয়, এবং কিরূপেই বা তাহার নিকট হইতে অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার করিতে হয়, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, আমার সদৃশ সামান্য কর্মচারীর কৰ্ম্ম নহে। এই লোক-জগতে দিন দিন যত প্রকার অপরাধের অবতারণা হইয়া থাকে, তাহার মধ্যে একটি অপরাধের সহিত অপরটির যে কোনরূপ সাদৃশ্য আছে, তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। সহজ দৃষ্টিতে যে সকল অপরাধ একই প্রকারের বলিয়া অনুমান হয়, স্থান-বিশেষে, সময় বিশেষে এবং অবস্থা-বিশেষে তাহাও নানারূপ আকার ধারণ করিয়া থাকে। এমন কি একই প্রকারের অপরাধ হইলেও সময় সময় তাহাদের পরস্পর এরূপ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয় যে, কাহার সাধ্য বলিতে পারে, উহা একই প্রকারের অপরাধ। এই সকল অপরাধের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে, একই প্রকারের উপায় অবলম্বন করা কোনরূপেই হইতে পারে না, অবলম্বন করিলেও সেই কাৰ্য্য কোনরূপে সম্পন্ন হয় না। সুতরাং অপরাধের অবস্থা অনুসারে অনুসন্ধানের পন্থা অবলম্বন করিতে হয়। এই জগতে একাল পৰ্য্যন্ত যত অপরাধ ঘটিয়াছে, এবং বিজ্ঞ ও দক্ষ কর্ম্মচারীগণ কর্তৃক যত অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছে, তাঁহাদিগের মধ্যে এরূপ লোক এপর্য্যন্ত জন্মগ্রহণ করে নাই, যে, কোন প্রকার অপরাধের অবস্থা দৃষ্টি করিয়াই বা অপরের প্রমুখাৎ সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়াই, তদ্দণ্ডেই বলিতে পারেন যে, এই অপরাধ অমুকের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, অপহৃত দ্রব্য অমুক স্থানে লুক্কায়িত আছে, বা অমুকের নিকট গমন করিলে সমস্ত দ্রব্য অনায়াসেই প্রাপ্ত হওয়া যাইবে। দক্ষ, বিজ্ঞ ও বহুদর্শী কর্মচারীগণের মধ্যে যদিও এইমাত্র দেখিতে পাওয়া যায় যে, অপরাধের অবস্থা দৃষ্টি করিয়া সময় সময় তাঁহারা যেরূপ অনুমান করিয়া থাকেন, অনেক সময়ে প্রায় সেইরূপই হয়, তথাচ অনেক সময় তাহার বিপরীত ব্যাপারও দেখিতে পাওয়া যায়। এক কথায়, অবস্থা দেখিয়া প্রকৃত কথা বলিতে পারেন, বা অনুমান করিয়া সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারেন, এরূপ কর্মচারী আজ পর্য্যন্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই। অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে যে বিষয় একবারের নিমিত্তও ভাবা যায় না, বা অনুসন্ধান করিতে করিতে যে সকল সামান্য বিষয়ের দিকে একবারেরও নিমিত্ত নয়ন আকৃষ্ট হয় না, সময় সময় সেই সকল সামান্য বিষয় অবলম্বন করিয়া অনেক মোকদ্দমার গূঢ় রহস্য সকল বাহির হইয়া পড়ে। তাহারই একটি দৃষ্টান্ত আজ আমি পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি।
প্রায় আট বৎসর অতীত হইল, কোন একটি মোকদ্দমার অনুসন্ধান উপলক্ষে আমাকে কয়েক দিবসের নিমিত্ত সহর পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিতে হয়। আট দশ দিবস পরে যখন আমি সহরে প্রত্যাগমন করিলাম, সেই সময় জানিতে পারিলাম যে, সহরতলীর মধ্যবর্তী সেটবাগানের এক স্থানে সিঁদ চুরি হইয়াছে, এবং সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাদিগের বিভাগস্থ দুইজন কর্ম্মচারী গমন করিয়াছেন।
আমাকেও সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিতে হইবে, সেই দিবস সন্ধ্যার সময় ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীর নিকট হইতে এইরূপ আদেশ আসিল। আদেশের বশরৰ্ত্তী হইয়া, সেই অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমি থানা হইতে বহির্গত হইতেছি, এমন সময় যে দুইজন কৰ্ম্মচারী পূর্ব্ব হইতে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন, তাঁহারা থানায় আসিয়া উপনীত হইলেন। ইঁহাদিগকে দেখিয়া মনে করিলাম যে, ইঁহাদিগের নিকট মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে অবগত হইয়া, পরিশেষে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হওয়া আবশ্যক মনে করিব, সেইরূপই করিব। এই ভাবিয়া আমি আমার বসিবার স্থানে আসিয়া উপবেশন করিলাম, কর্মচারীদ্বয়ও আমার নিকট আসিয়া বসিলেন।
আমি কৰ্ম্মচারীদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিয়াছিলেন, সেই মোকদ্দমার যাহাতে উদ্ধার হয়, তাহার কোনরূপ বিশেষ সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছেন কি?”
কর্ম্মচারী। না, এ পর্যন্ত কিছু প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই।
আমি। ইহা কি মোকদ্দমা, চুরি, না সিঁদচুরি?
কর্ম্মচারী। ইহাকে সিঁদ চুরিই বলিতে হইবে।
আমি। ইহাকে সিঁদ চুরিই বলিতে হইবে এ কথার অর্থ কি?
কর্ম্মচারী। সিঁদ চুরি বলিলে সর্ব্বসাধারণে যেরূপ বুঝিয়া থাকেন, ইহা সেরূপ সিঁদ চুরি নহে। কিন্তু আইনানুযায়ী ইহাকে সিঁদ চুরি ভিন্ন অপর কিছু বলা যাইতে পারে না।
আমি। ঘরের ভিতের উপর বা দেওয়ালের কোন স্থানে ছিদ্র করিয়া যেরূপ ভাবে এদেশে সিঁদ দিয়া থাকে, ইহা কি সেই প্রকারের সিঁদ নহে?
কৰ্ম্মচারী। না।
আমি। তবে কিরূপ সিঁদ দিয়াছে?
কর্ম্মচারী। ঘরের চাঁদড়ের একস্থানের ঝাঁপ কাটিয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে।
আমি। ঘরের চাঁদড়ের ঝাঁপ কাটিয়াছে যখন বলিতেছেন, তখন সেই ঘর কোনরূপেই পাকা ঘর হইতে পারে না?
কর্ম্মচারী। না, পাকা ঘর নহে। বেড়া দেওয়া খাপ্রেলের ঘর।
আমি। ঘরের চাঁদড়ের ঝাঁপ কাটিয়া চোর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে বলিতেছেন; কিন্তু চোর চাঁদড়ের উপর উঠিল কি প্রকারে?
কর্ম্মচারী। সেই স্থানে উঠিবার বেশ সহজ উপায় আছে, সেই স্থানে একখানি বাঁশের উপর বসিয়া উপর বসিয়া অনায়াসেই ঝাঁপ কাটা যাইতে পারে।
আমি। এ ঘটনা কবে ঘটিয়াছে?
কর্ম্মচারী। গত রজনীতে।
আমি। কত রাত্রিতে এই ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া অনুমান হয়?
কর্ম্মচারী। রাত্রি বারটার পর, এবং অদ্য প্রাতঃ ছয়টার পূর্ব্বে এই ঘটনা ঘটিয়াছে।
আমি। এই সময়ের মধ্যে যে এই ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা কিরূপে অনুমান হইতেছে?
কর্ম্মচারী। রাত্রি দশটার পর ফরিয়াদী আপন ঘরের দরজা, ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া শয়ন করে, এবং প্রায় দুই ঘণ্টাকাল বিছানায় শয়ন করিয়া থাকিবার পর, তাহার নিদ্রা আইসে। অদ্য প্রাতঃকালে আন্দাজ ছয়টার সময় নিদ্রা ভঙ্গের পর যখন ফরিয়াদী গাত্রোত্থান করে, সেই সময় দেখিতে পায় যে, তাহার ঘরের দরজা খোলা রহিয়াছে, এবং ঘরের ভিতর যে সকল বাক্স ছিল, তাহার মধ্য হইতে দুই তিনটি কাটের হাতবাক্স নাই।
আমি। ঘরের ভিতর কয়টি বাক্স ছিল?
কর্ম্মচারী। পাঁচটি, তাহার মধ্যে দুইটি বড় কিন্তু বহু পুরাতন। উহার একটি প্রায় পিতল কাঁসার তৈজস-পত্রে পরিপূর্ণ, অপরটির ভিতর কতকগুলি পুরাতন বস্ত্র আছে মাত্র। যে তিনটি বাক্স স্থানান্তরিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে অলঙ্কারপত্র এবং নগদ টাকা ছিল। সেই সকল দ্রব্যই অপহৃত হইয়াছে।
আমি। যে বাক্স তিনটির ভিতর অলঙ্কার পত্র ছিল, এবং যে বাক্স কয়েকটি স্থানান্তরিত হইয়াছিল বলিতেছেন, সেই বাক্সগুলিও কি অপহৃত হইয়াছে, না উহা ফেলিয়া গিয়াছে?
কর্ম্মচারী। বাক্স কয়েকটি ঘর হইতে বাহির করিয়া বাড়ীর প্রাঙ্গণে আনিয়াছিল, এবং সেই স্থানে উহা ভাঙ্গিয়া উহার মধ্যস্থিত অলঙ্কার প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। ভাঙ্গা বাক্স তিনটি সেই স্থানে ফেলিয়া গিয়াছে মাত্র।
আমি। যে সকল অলঙ্কার পত্র ও নগদ টাকা অপহৃত হইয়াছে, তাহার আনুমানিক মূল্য কি পরিমাণ হইতে পারিবে?
কর্ম্মচারী। বোধ হয়, দুই সহস্র মুদ্রার কম হইবে না।
আমি। যাঁহার ঘরে চুরি হইয়াছে, তিনি কে এবং কি কার্য্য করিয়া থাকেন?
কর্ম্মচারী। যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহা একটি বৃদ্ধ স্ত্রীলোকের। সে কোন কাৰ্য্যই করে না, আপনার পূৰ্ব্বসঞ্চিত অর্থ হইতে দিন-যাপন করিয়া থাকে।
আমি। যে বাড়ীতে চুরি হইয়াছে, সেই বাড়ীও কি সেই বৃদ্ধ স্ত্রীলোকের?
কর্ম্মচারী। বাড়ীও উহারি।
আমি। সেই বৃদ্ধাই কি তবে আপন ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া ঘরের ভিতর শয়ন করিয়াছিল, এবং প্রাতঃকালে সেই কি ঘরের দরজা খোলা, এবং দ্রব্যাদি অপহৃত হইয়াছে জানিতে পারে?
কৰ্ম্মচারী। হাঁ মহাশয়! সেই বৃদ্ধাই ঘরের ভিতর শয়ন করে, প্রাতঃকালে সেই ঘরের দরজা খোলা অবস্থায় দেখিতে পায়, এবং তাহারই সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে।
আমি। সেই বৃদ্ধার আর কেহ নাই?
কর্ম্মচারী। অপর কেহ নাই, একটি পালিত পুত্ৰ আছে মাত্র।
আমি। আপনি তাহাকে দেখিয়াছেন কি? সেই পালিত পুত্রের বয়ঃক্রম কত হইবে?
কর্ম্মচারী। অনুমান সতের আঠার বৎসর হইবার সম্ভাবনা।
আমি। বাড়ীতে সে কোথায় শয়ন করিয়া থাকে?
কর্ম্মচারী। সেই ঘরেতেই সে শয়ন করে।
আমি। ইতিপূর্ব্বে আপনি বলিয়াছেন, বৃদ্ধা একাকিনী সেই ঘরে শয়ন করিয়াছিল?
কৰ্ম্মচারী। হ্যাঁ, প্রকৃতই বৃদ্ধা একাকিনী সেই ঘরে শয়ন করিয়াছিল। তাহার পালিত পুত্র সেই ঘরে শয়ন করে বটে, কিন্তু সেরাত্রিতে সে সেই ঘরে শয়ন করে নাই।
আমি। কোন্ স্থানে থাকিয়া সে রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছে?
কর্ম্মচারী। তাহার জনৈক বন্ধুর বাড়ীতে সে সেই রাত্রি শয়ন করিয়াছিল।
আমি। আপন বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া সেই রাত্রিতে সে অপরের বাড়ীতে গিয়া শয়ন করে কেন?
কর্ম্মচারী। সে যে কেবল গত রাত্রিতেই আপনার বন্ধুর বাড়ীতে গিয়া শয়ন করিয়াছিল তাহা নহে, মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সেই স্থানে রাত্রি অতিবাহিত করিয়া থাকে।
আমি। উহার নাম কি?
কর্ম্মচারী। ভবেন্দ্রনাথ।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ কি, উহারা জাতিতে কি?
কর্ম্মচারী। জাতিতে ব্রাহ্মণ। উহার নাম ভবেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী।
আমি। বৃদ্ধাও তবে ব্রাহ্মণবংশ-সম্ভূতা?
কর্ম্মচারী। তিনিও ব্রাহ্মণের কন্যা।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ অদ্য প্রাতঃকালে বন্ধুর বাড়ী হইতে কোন্ সময় প্রত্যাগমন করে?
কৰ্ম্মচারী। প্রত্যূষেই আসিয়াছিল। যে সময় বৃদ্ধা শয্যা হইতে উঠিয়া, ঘরের অবস্থা দেখিয়া চীৎকার করিতে থাকে, ভবেন্দ্রনাথ তাহার একটু পরেই আসিয়া উপস্থিত হয়।
আমি। এই মোকদ্দমার সংবাদ থানায় কোন্ ব্যক্তি প্রদান করে? বৃদ্ধা নিজে গিয়া কি থানায় এই সংবাদ প্রদান করিয়া আইসে?
কৰ্ম্মচারী। না, বৃদ্ধা নিজে থানায় গমন করে নাই; ভবেন্দ্রনাথ গিয়াই থানায় সংবাদ প্রদান করে।
আমি। ভবেন্দ্রনাথের আর কে আছে?
কৰ্ম্মচারী। বৃদ্ধা ব্যতীত তাহার আত্মীয় স্বজন আর কেহই নাই, নিতান্ত শৈশবকাল হইতেই বৃদ্ধা তাহাকে প্রতিপালন করিতেছে।
আমি। উহার বিবাহ হইয়াছে?
কৰ্ম্মচারী। অদ্যাবধি বিবাহ হয় নাই; কিন্তু যাহাতে শীঘ্র বিবাহ হয়, বৃদ্ধা তাহার বিশেষরূপ চেষ্টা করিতেছিল।
আমি। তাহার চরিত্র কি প্রকার?
কর্ম্মচারী। তাহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন কথা তাহার বিরুদ্ধে আমরা এ পর্যন্ত কিছুই অবগত হইতে পারি নাই।
আমি। ঘরের চাঁদড়ের যে স্থানের ঝাঁপ কাটা হইয়াছে, তাহার মধ্য দিয়া একজন লোক অনায়াসে প্রবেশ করিতে পারে কি?
কর্ম্মচারী। অনায়াসে না হউক, একটু কষ্টে প্রবেশ করিতে পারে।
আমি। ঘরের বাহিরে একটি বাঁশ আছে, সেই বাঁশের উপর বসিয়া ঝাঁপ কাটা যাইতে পারে, এ কথা আপনি বলিয়াছেন। কিন্তু সেই স্থান দিয়া ঘরের ভিতরে কিরূপে প্রবেশ করিতে পারে?
কর্ম্মচারী। বাহিরে যেরূপ একটি বাঁশ আছে বলিয়াছি, তাহার সন্নিকটে ঘরের ভিতরে সেইরূপ আর একটি বাঁশ আছে। সিঁদের ভিতর দিয়া সেই বাঁশের উপর অনায়াসেই পা দেওয়া যাইতে পারে।
আমি। আচ্ছা, সেইরূপ উপায়েই যদি চোর ঘরের মধ্যস্থিত বাঁশের উপর গমন করিতে পারিল, তাহা হইলে সেই বাঁশের উপর হইতে নিম্নে কিরূপে অবতরণ করিবে? আপনি যে বাঁশের কথা বলিতেছেন, সেই বাঁশ নিশ্চয় মৃত্তিকা হইতে অনেক দূর উপরে?
কর্ম্মচারী। বাঁশ মৃত্তিকা হইতে অনেক দূরে হইলেও, এক বাঁশ হইতে অপর বাঁশের উপর পা দিয়া ঘরের কি প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যাওয়া যায়, এবং ইচ্ছা করিলে ঘরের বেড়া বা খুঁটি বাহিয়া যে স্থানে ইচ্ছা, সেই স্থানে নামা যাইতে পারে।
আমি। যে স্থান দিয়া চোর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, তাহা আপনারা সহজেই অনুমান করিয়া লইয়াছেন; কিন্তু ঘরের ভিতর কোন স্থান দিয়া সে মৃত্তিকাতে অবতরণ করিয়াছে, তাহার কিছু অনুমান করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। না মহাশয়! তাহা আমরা এ পর্যন্ত অনুমান করিয়া উঠিতে পারি নাই। ঘরের ভিতর এরূপ কোন কিছু আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই, যাহাতে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারি যে, চোর কোন স্থান দিয়া ঘরের ভিতর অবতরণ করিয়াছে।
আমি। এই ব্যাপার জানিবার নিমিত্ত ঘরের ভিতর বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছেন কি?
কৰ্ম্মচারী। দেখিয়াছি বৈকি। কিন্তু কিছুই জানিতে পারি নাই।
আমি। যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহার সম্পূর্ণ তালিকা প্রাপ্ত হইয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। বৃদ্ধা যে সম্পূর্ণ তালিকা প্রদান করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহা বোধ হয় না। কারণ, যে সকল অলঙ্কার অপহৃত হইয়াছে, তাহা সমস্ত বৃদ্ধার নিজের নহে, কতক নিজের, কতক বন্ধকী।
আমি। কোন কোন ব্যক্তির কি কি দ্রব্য বন্ধক ছিল, তাহা বৃদ্ধা বলিতে পারিয়াছে কি?
কর্ম্মচারী। তাহাও যে সম্পূর্ণরূপ বলিতে পারিতেছে না। কারণ, যে খাতায় সেই সমস্ত বন্ধকী দ্রব্যের হিসাব ছিল, সেই খাতাখানিও সেই তিনটি বাক্সের একটির মধ্যে ছিল। দ্রব্যাদির সহিত সেই খাতাখানিও অপহৃত হইয়াছে।
আমি। এটি কিরূপ হইল? চোর অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি মূল্যবান্ দ্রব্যই অপহরণ করিবে, খাতা চুরি করিবে কেন? খাতা তাহার কি উপকারে লাগিবে?
কর্ম্মচারী। আমরাও এ বিষয়ে কিছু অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। চোরে যে কেন খাতা চুরি করিল, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া আমরা কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছি না।
আমি। বৃদ্ধা লেখা পড়া জানে কি?
কর্ম্মচারী। না।
আমি। তাহা হইলে তাহার সেই খাতা কে লিখিত?
কর্ম্মচারী। ভবেন্দ্রনাথ, যেরূপ বলিতেছে, তাহাতে অনুমান হয়, খাতার অধিকাংশ লেখাই ভবেন্দ্রনাথের।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কাহারও লেখা সেই খাতায় আছে?
কৰ্ম্মচারী। আছে; পাড়ার অপরাপর দুই এক ব্যক্তির লেখা উহাতে আছে।
আমি। বৃদ্ধার যে কিছু টাকাকড়ি আছে, তাহা দেখিতেছি যে, পাড়ার অনেকেই অবগত আছে?
কর্ম্মচারী। পাড়ার সকলেই জানে যে, বৃদ্ধার অনেক পয়সা আছে।
আমি। পাড়ার কোন লোকের দ্বারা এই কাৰ্য্য হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় কি?
কর্ম্মচারী। এ পর্যন্ত তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারা যায় নাই।
আমি। চোর কর্তৃক কোন অস্ত্রাদি বৃদ্ধার বাড়ীতে পরিত্যক্ত হয় নাই কি?
কর্ম্মচারী। না, কোন দ্রব্যই পরিত্যাগ করিয়া যায় নাই।
আমি। কিরূপ অস্ত্র দিয়া সিঁদ কাটা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয়?
কর্ম্মচারী। সিঁদের অবস্থা দেখিয়া তাহার কিছুই অনুমান করিবার উপায় নাই।
আমি। বাক্স কয়েকটি কিরূপ ভাবে ভাঙ্গিয়াছে?
কর্ম্মচারী। বাক্সের ভিতর যে স্থানে কল আছে, বাহিরে তাহারই নিকট বাক্সের ডালা ও বাক্সের সন্ধিস্থলে অস্ত্র প্রবেশ করাইয়া চাড় দিয়া ভাঙ্গিয়াছে বলিয়া অনুমান হয়।
আমি। তিনটি বাক্স কি একরূপেই ভাঙ্গা হইয়াছে, এবং বাক্সের একস্থানেই কি অস্ত্র প্রবেশ করান হইয়াছে?
কর্ম্মচারী। হাঁ মহাশয়! সেই তিনটি বাক্সেই একই প্রকারের অস্ত্র ব্যবহার করা হইয়াছে, এবং একইরূপে ভাঙ্গা হইয়াছে। দেখিলে অনুমান হয়, যেন একই ব্যক্তি কর্তৃক ও একই অস্ত্র দ্বারা কয়েকটি বাক্সই ভাঙ্গা হইয়াছে।
আমি। যেরূপ অস্ত্রদ্বারা সেই সকল বাক্স ভাঙ্গা হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইতেছে, সেই প্রকারের কোন অস্ত্রাদি ফরিয়াদীর বাড়ীতে আছে কি?
কৰ্ম্মচারী। না, সেরূপ অস্ত্র দেখিতে পাই নাই।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমি। এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে কাহারও উপর আপনাদিগের কোনরূপ সন্দেহ হইয়াছিল কি, বা কাহারও সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ সন্দেহ না হইলেও, ভবেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমরা একটু অনুসন্ধান করি। কারণ, প্রথমতঃ সে ফরিয়াদীর গর্ভজাত পুত্ৰ নহে; পালিত পুত্রমাত্র। দ্বিতীয়তঃ, যে রাত্রিতে চুরি হয়, সেই রাত্রিতে সে বাড়ীতে ছিল না। তৃতীয়তঃ, সে আমাদিগের সহিত সর্ব্বদাই উপস্থিত থাকিয়া, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান সম্বন্ধে বিশেষরূপ যত্ন প্রদর্শন করিতেছে।
আমি। অনুসন্ধানে তাহার বিপক্ষে কোন কথা অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। ভবেন্দ্রনাথের বিপক্ষে কোন কথা পাওয়া দূরে থাকুক, বরং উহার দ্বারাই অনেক কথা পাওয়া যাইতেছে। প্রথমতঃ ভবেন্দ্রনাথ বৃদ্ধার গর্ভজাত পুত্র না হইলেও, বৃদ্ধার যাহা কিছু আছে, তাহার সমস্তই ভবেন্দ্রনাথের। এ কথা ভবেন্দ্রনাথ উত্তমরূপে অবগত আছে। কারণ, এ কথা সকলের নিকটেই বৃদ্ধা সর্ব্বদাই বলিয়া থাকে। দ্বিতীয়তঃ, নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া ভবেন্দ্রনাথের বিবাহ দিবার নিমিত্ত বৃদ্ধা প্রাণপণ যত্ন করিতেছে, এ কথাও কাহারও অবিদিত নাই। তৃতীয়তঃ, ভবেন্দ্রনাথ রাত্রিকালে সেই গৃহে অনুপস্থিত ছিল সত্য; কিন্তু যে বাড়ীতে এবং যাহার সহিত সে রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছে, এ সম্বন্ধে তাহাকে আমরা কোন প্রকারেই সন্দেহ করিতে পারি না। কারণ, তাহার বন্ধু জনৈক বর্দ্ধিষ্ণু লোকের পুত্র। তাঁহার নিজের যাহা কিছু আছে, নিজের খরচপত্রের পক্ষে তাহাই যথেষ্ট; পরের অর্থের দিকে দৃষ্টি করিবার প্রয়োজন তাহার একবারেই নাই বলিলেও হয়। তাঁহারই সহিত তাহারই বৈঠকখানায় ভবেন্দ্রনাথ শয়ন করিয়াছিল, এবং অদ্য প্রাতঃকালে তাঁহারই সম্মুখে সে সেই স্থান হইতে চলিয়া আইসে। বিশেষতঃ কেবলমাত্র আজই যে সে তাহার বন্ধুর বাড়ীতে রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছে, তাহা নহে, মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সে সেই স্থানে রাত্রিযাপন করিয়া থাকে।
আমি। ভবেন্দ্রনাথের বন্ধু ধনবানের পুত্র, তাহারই সহিত ভবেন্দ্রনাথ রাত্রিযাপন করিয়াছে সত্য; কিন্তু যে সকল সম্পত্তি-শালীর পুত্র রাত্রিকালে অন্দরের ভিতর শয়ন না করিয়া, বন্ধু-বান্ধবের সহিত বৈঠকখানায় রাত্রি অতিবাহিত করে, তাহাদিগের চরিত্র প্রায়ই ভাল থাকে না; ইহা আমার বিশ্বাস। এ সম্বন্ধে আপনার কি বিশ্বাস হয়?
কর্ম্মচারী। আপনি যাহা বলিতেছেন, আমারও সেই বিশ্বাস। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে তাহার বিপরীত বলিয়া বোধ হইতেছে। বাড়ীর অপরাপর লোক ও পরিচারকবর্গ প্রভৃতি সকলকেই গোপনে আমরা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছি, প্রতিবেশীবর্গের নিকট হইতে সন্ধান লইতে ত্রুটি করি নাই; কিন্তু তাঁহার বিপক্ষে কোন কথাই এ পর্যন্ত অবগত হইতে পারি নাই। দোষই বলুন, আর গুণই বলুন, তাঁহার একটু গান-বাজনার সখ আছে। এই নিমিত্তই তিনি অন্দরের ভিতর শয়ন না করিয়া, বৈঠকখানা ঘরেই শয়ন করিয়া থাকেন। বিশেষতঃ তিনি অবিবাহিত।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আপনারা যতদূর অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং চরিত্র সম্বন্ধে যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহাতে এ কার্য্য যে, তাহার দ্বারা হয় নাই, ইহা আপনাদিগের বেশ অনুমান হইয়াছে?
কর্ম্মচারী। ভবেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমাদিগের মনে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা ব্যতীত আর কোন বিষয়ের কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?
কৰ্ম্মচারী। খাতা সম্বন্ধে আমরা একটু বিশেষ অনুসন্ধান করিয়াছি।
আমি। কিরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং কেনই বা করিয়াছেন?
কর্ম্মচারী। একাল পর্য্যন্ত আমরা যত চুরির অনুসন্ধান করিয়াছি, এবং যে সকল চুরি চোরের দ্বারা হইয়াছে, তাহার মধ্যে প্রায়ই দেখিতে পাই নাই যে, চোরে অলঙ্কার-পত্রের সহিত হিসাবের খাতাও চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। সময় সময় বাক্সের সহিত কাগজপত্র লইয়া যায় সত্য; কিন্তু পরিশেষে উহা কোন স্থানে না কোন স্থানে প্রায়ই ফেলিয়া’ দেয়। তাহাদিগের পক্ষে যে সকল দ্রব্য মূল্যবান, কেবল তাহাই গ্রহণ করিয়া থাকে। এই ব্যাপারে খাতা ‘পর্য্যন্ত অপহৃত হওয়ায় আমাদিগের মনে একটি বিশেষ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। সুতরাং সে সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধানও করিয়া লই।
আমি। কিরূপ সন্দেহ উপস্থিত হয়?
কৰ্ম্মচারী। সেই খাতা পাড়ার যে সকল লোকজনের দ্বারা মধ্যে মধ্যে লিখিত হইয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা যদি এই কার্য্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার দ্বারা সেই খাতা অপহৃত হইবার সম্ভাবনা।
আমি। কি কারণে সে সেই খাতা অপহরণ করিবে?
কর্ম্মচারী। আমার সামান্য বুদ্ধিতে যতদূর অনুমান হইতে পারে, তাহাতে আমার বোধ হয়, যদি কোনরূপে উক্ত খাতা খানি নষ্ট করিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে পুলিশ বন্ধকী দ্রব্যের তালিকা সহজে প্রাপ্ত হইবে না। সুতরাং বন্ধকী দ্রব্য সকল অনায়াসেই বিক্রয় করা যাইতে পারিবে। যে চোরের এই প্রকার কোন অভিসন্ধি আছে, তাহার দ্বারা বন্ধকী দ্রব্যের খাতা চুরি হইবারই সম্ভাবনা।
আমি। আপনার অনুমান একবারে যুক্তি-বহির্ভূত নহে। কিন্তু খাতা সম্বন্ধে আরও এক কথা অনুমান করা যাইতে পারে। যাক, সে কথা পরে দেখা যাইবে। যে সকল লোকের দ্বারা সেই খাতা লেখা হইয়াছিল, তাহাদিগের প্রত্যেকের মধ্যে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন কি?
কৰ্ম্মচারী। যে সকল ব্যক্তি কর্তৃক সময় সময় খাতা লিখিত হইয়াছে, তাহাদিগের সকলের নাম এ পর্যন্ত জানিতে পারা যায় নাই। যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, ততদূর অনুসন্ধানও হইয়াছে; কিন্তু এ পর্যন্ত তাহাদের উপর সন্দেহের কোন কারণ প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। খাতা সম্বন্ধে আর কি অনুমান করাইতে পারে বলিতেছিলেন?
আমি। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহা বহু দূরের কথা। অত ভাবিয়া চিন্তিয়া চুরি প্রায়ই হয় না; তথাপি বোধ হয়, উহাও একবার আমাদিগের দেখার প্রয়োজন। যে সকল লোকের দ্রব্য বৃদ্ধার নিকট বন্ধক আছে, সেই সকল লোকের মধ্যে কাহারও দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হওয়া একবারে অসম্ভব নহে। সেইরূপ লোকের দ্বারা খাতা অপহৃত হইলেও হইতে পারে।
কৰ্ম্মচারী। উহাদিগের দ্বারা খাতা অপহৃত হইবার কারণ কি?
আমি। কারণ আছে। প্রথমতঃ, যে কারণের নিমিত্ত আপনারা সেই খাতার লেখকগণকে সন্দেহ করিয়াছেন, ইহার পক্ষেই উহা এক প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ এই যে, বন্ধকী দ্রব্যের খাতা যদি প্রাপ্ত হওয়া না যায়, তাহা হইলে যে ব্যক্তি অলঙ্কার আদি বন্ধক রাখিয়া ঋণ গ্রহণ করিয়াছে, সেই ব্যক্তি অনায়াসেই বলিতে পারিবে, “আমার বন্ধকী দ্রব্যের ওজন দশ ভরি নহে, বিশ ভরি। কম মূল্যের অলঙ্কার নহে, বিশুদ্ধ স্বর্ণের অলঙ্কার” প্রভৃতি, অর্থাৎ এইরূপ ভান করিয়া একগুণের পরিবর্তে চতুর্গুণ মূল্য বৃদ্ধার নিকট হইতে অনায়াসেই আদায় করিতে পারিবে। সুতরাং যে সকল ব্যক্তি কর্তৃক অলঙ্কার বন্ধক দেওয়া হইয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে কেহ যদি এই চুরি করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে সেই খাতা যে একবারে অপহরণ করিতে পারে না, তাহা নহে। কারণ সবিশেষ না হউক, সেই খাতা অপহরণে তাহাদিগের একটু না একটু স্বার্থ আছে।
কৰ্ম্মচারী। আপনি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত অসঙ্গত নহে। কিন্তু সে-সম্বন্ধে আমরা পূর্ব্বে কিছুমাত্র চিন্তা করি নাই। যাহা হউক এ বিষয়েও বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া দেখা আমাদিগের একান্ত কর্তব্য।
আমি। এই চুরি সম্বন্ধে প্রতিবেশীবর্গের কোনরূপ মতামত গ্রহণ করিয়াছেন কি?
কৰ্ম্মচারী। হ্যাঁ, অনেকেই জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে।
আমি। তাঁহারা কি বলেন?
কর্ম্মচারী। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই এ সম্বন্ধে কোনরূপ মতামত প্রকাশ করিতে পারেন না। কেহ বলেন, ভবেন্দ্রনাথের কার্য্য। কেহ বলেন, পাড়ার কোন ব্যক্তির দ্বারা এই কাৰ্য্য সমাধা হইয়াছে। কেহ বা বলেন, চুরিই যাহাদিগের ব্যবসা, তাহাদিগের দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে।
আমি। যদি চোরের দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে বৃদ্ধার ঘরের অবস্থা সে কিরূপে জানিতে পারিল? সে বিষয়ে কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন কি?
কর্ম্মচারী। সে বিষয়েও বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়াছি। কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। পাড়ার ভিতর যে সকল লোক বাস করে, তাহাদিগের মধ্যে কোন স্ত্রী বা পুরুষ দুই পাঁচ দিবসের মধ্যে ফরিয়াদীর বাড়ীতে আসিয়াছিল কি না, অথবা অপরিচিত কোন লোক কোনরূপ ছল অবলম্বন করিয়া বৃদ্ধার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল কি না, তাহা অবগত হইবার নিমিত্ত বৃদ্ধাকে, ভবেন্দ্রনাথকে ও পাড়ার লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে; কিন্তু কোন ব্যক্তিই তাহার কিছু বলিয়া উঠিতে পারে নাই।
আমি। ঘরের অবস্থা উত্তমরূপ অবগত হইতে না পারিয়া, বাহিরের কোন চোর এইরূপ চুরি করিতে পারে কি না?
কর্ম্মচারী। একবারে যে পারে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু ব্যাপার দেখিয়া বিলক্ষণই অনুমান হয় যে, যে ব্যক্তি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, সে ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে অবগত না হইলে এরূপ ভাবে সহজে প্রবেশ করিতে সাহসী হয় না। বিশেষতঃ যে কয়েকটি বাক্সের মধ্যে অপহরণোপযোগী দ্রব্যাদি ছিল, কেবলমাত্র সেই কয়েকটি বাক্সই বাহির করিয়া আনিয়াছে। অপর সিন্দুক কি বাক্সের উপর একবারে হস্তার্পণ করে নাই।
আমি। বৃদ্ধার ঘরের ভিতর অলঙ্কারপত্র প্রভৃতি বহুমূল্য দ্রব্যাদি কোন স্থানে রক্ষিত থাকে, তাহা প্রতিবেশীগণের মধ্যে কেহ অবগত আছেন কি?
কর্ম্মচারী। প্রতিবেশীবর্গের মধ্যে অপর কোন ব্যক্তি বৃদ্ধার ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে অবগত থাকুন, কিন্তু পাড়ার গৃহস্থ স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে অনেকেরই বৃদ্ধার বাড়ীতে যাতায়াত আছে। সুতরাং তাহাদিগের মধ্যে অনেকেরই বৃদ্ধার ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে জানিবার সম্ভাবনা।
আমি। যে সকল স্ত্রীলোক বৃদ্ধার বাড়ীতে সর্বদা আসিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কোন অসৎ চরিত্র স্ত্রীলোক আছে, কি না, জানিয়াছেন?
কর্ম্মচারী। জানিবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু জানিতে পারি নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমি। ফরিয়াদীর বাড়ীর ভিতর, কি নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে, অথবা সেই পাড়ার ভিতর, চুরি হইবার আগে কোন অপরিচিত লোককে কেহ দেখে নাই?
কর্ম্মচারী। অপরিচিত লোক সম্বন্ধে একটি কথা উঠিয়াছে এবং অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারীর মনে সেই সম্বন্ধে কতকটা সন্দেহের কারণও হইয়াছে বটে।
আমি। অপরিচিত লোক সম্বন্ধে কিরূপ সংবাদ পাওয়া গিয়াছে?
কর্ম্মচারী। কোন অপরিচিত লোক চুরির পূর্ব্বে সেই পাড়ার ভিতর দেখা গিয়াছে কি না, এই কথা জানিবার নিমিত্ত আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম, সেই সময় থানার একটি কনষ্টেবল হঠাৎ বলিয়া উঠে, চুরির পূর্ব্ব দিবস বৈকালে বড় রাস্তার উপর তাহার পাহারা ছিল। যে স্থানে সে পাহারা দিতেছিল, সেই স্থান হইতে ফরিয়াদীর বাড়ী অনেক দূর। পাহারা দেওয়ার সময় সেই কনষ্টেবল দেখিতে পায় যে, আবদুল নামক একজন পুরাতন চোর ভিক্ষুকের বেশে সেই পাড়ার দিক হইতে আগমন করিতেছে। উহাকে দেখিয়া কনষ্টেবল তাহাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে আবদুল কহে যে, এবার জেল হইতে খালাস হইয়া আসিবার পর, সে চৌর্য্যবৃত্তি পরিত্যাগ করিয়াছে, এবং ভিক্ষা করিয়াই এখন সে দিন যাপন করিয়া থাকে। কনষ্টেবলের এই কথা শুনিয়া আবদুলের উপর আমাদিগের বিশেষরূপ সন্দেহ হয়। আমরা তৎক্ষণাৎ পাড়ার ভিতর গমন করিয়া, চুরির পূর্ব্ব দিবস কোন মুসলমান সেই পাড়ার ভিতর ভিক্ষা উপলক্ষে গমন করিয়াছিল কি না, এই কথা পাড়ার অনেককেই জিজ্ঞাসা করি। তাহাতে জানিতে পারি যে, সেই দিবস বৈকালে একজন মুসলমান ফকীর প্রকৃতই ভিক্ষা উপলক্ষে পাড়ার ভিতর গমন করিয়াছিল, ও ভিক্ষা পাইবার প্রত্যাশায় প্রায় প্রত্যেকের বাড়ীতেই উপস্থিত হইয়াছিল, এমন কি বৃদ্ধার বাড়ী পর্য্যন্তও সে গমন করিয়াছিল কিন্তু যে সময় তথায় উপস্থিত হয়, সেই সময় বৃদ্ধা বাড়ীতে না থাকায় সে বৃদ্ধার বাড়ীতে ভিক্ষা প্রাপ্ত হয় নাই।
আমি। বিশেষ সন্দেহের কারণ বটে। আবদুলকে পাওয়া গিয়াছে কি?
কর্ম্মচারী। না, তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
আমি। এ কোন্ আবদুল?
কর্ম্মচারী। এ একজন পুরাতন চোর। চুরি করিয়া চারি পাঁচ বার জেলে গিয়াছে। সৰ্ব্ব শেষে দুই বৎসর মেয়াদ খাটিয়া প্রায় ছয় মাস হইল ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু সে যে কোথায় থাকে, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। মধ্যে মধ্যে তাহাকে রাস্তাঘাটে দেখিতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাহার থাকিবার স্থানের কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে সকলকেই প্রায় একই প্রকারে উত্তর প্রদান করিয়া থাকে। সকলকেই কহে, “আমার থাকিবার স্থান নাই। ভিক্ষা করিয়া দিনপাত করি, এবং মাঠ বলুন, ঘাট বলুন, রাস্তার কিনারায় কোন বোয়াকের উপর বলুন, যেস্থানে হউক, একস্থানে শয়ন করিয়া রাত্রি অতিবাহিত করি।”
আমি। ইহার উপর বিশেষরূপ সন্দেহ হইবারই কথা। যেরূপে হউক অনুসন্ধান করিয়া আবদুলকে বাহির করা এখন সকলেরই প্রধান কাৰ্য্য। আবদুলকে পাইলে বোধ হয়, এই মোকদ্দমার উপায় হইলেও হইতে পারে।
কর্ম্মচারী। যে যে স্থানে তাহার কিছুমাত্র সন্ধান পাওয়া যাইবে বিবেচনা করিয়াছি, আমি নিজে সেই সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়াছি। তদ্ব্যতীত অপরাপর আরও কয়েকজন কর্ম্মচারী তাহার অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন। কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহার কিছুমাত্র সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই।
আমি। পূর্ব্বে যে সকল মোকদ্দমায় আবদুল ধরা পড়িয়াছিল, সেই সকল মোকদ্দমার অনুসন্ধানে যে সকল কর্ম্মচারী নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহারা সেই সময় আসামী আবদুল সম্বন্ধে নিশ্চয়ই বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া থাকিবেন। আমার বিবেচনায় সেই সকল কৰ্ম্মচারীকে আবদুলের অনুসন্ধানের নিমিত্ত নিযুক্ত করা আবশ্যক।
কর্ম্মচারী। আপনার এ প্রস্তাব মন্দ নহে। আমরা অনুসন্ধান করিয়া এক সপ্তাহে যে সকল বিষয় অবগত হইতে না পারিব, সেই সকল কর্ম্মচারী এক দিবসের মধ্যে সেই সকল বিষয় জানিতে পারিবেন। কারণ, তাঁহারা পূর্ব্বে যখন উহার সম্বন্ধে একবার অনুসন্ধান করিয়াছেন, তখন উহার স্বভাব-চরিত্র এবং বন্ধুবান্ধবের বিষয় নিশ্চয়ই অবগত আছেন।
আমি। আপনার মুখে মোকদ্দমার সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইলাম। এখন সেই স্থানে গমন করিয়া ঘটনাস্থলটি একবার দর্শন করিলে হয় না?
কর্ম্মচারী। ঘটনার স্থানে গিয়া একবার দর্শন করা নিতান্ত আবশ্যক।
আমি। আমি সেই স্থানেই গমন করিতেছিলাম। ঘটনাস্থল স্বচক্ষে উত্তমরূপে দর্শন না করিয়া অনুসন্ধানে নিযুক্ত হওয়া কর্তব্য নহে। কারণ, আমি অনেক মোকদ্দমা দেখিয়াছি, যাহার প্রথম সূত্র ঘটনাস্থলেই প্রথমে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, এবং সেই সামান্য সূত্র অবলম্বনে বৃহৎ বৃহৎ মোকদ্দমার উদ্ধার হইয়া গিয়াছে।
কর্ম্মচারী। কোন সময় আপনি ঘটনাস্থলে গমন করিতে সমর্থ হইবেন?
আমি। আমাদিগের মত কর্ম্মচারীর আর সময় অসময় কি? এখনই ঘটনাস্থলে গমন করিয়া সেই স্থানটি একবার উত্তমরূপে দেখিয়া আসি। পরিশেষে যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করা বিবেচনা করিব, সেইরূপ ভাবেই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
কর্ম্মচারী। যদি আপনি এখনই ঘটনাস্থলে গমন করিতে চাহেন, তাহা হইলে চলুন, আমিও আপনার সহিত গমন করি। কারণ, আমি সেই স্থান ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছি, ও যে যে স্থানে যে যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা আমি অবগত আছি। আমি আপনার সঙ্গে থাকিলে, সেই সকল স্থান অনায়াসেই আপনাকে দেখাইয়া দিতে পারিব; তাহাতে আপনার পরিশ্রমেরও অনেক লাঘব হইবে।
আমি। আপনারা সমস্ত দিবস পরিশ্রম করিয়া আসিয়াছেন, এরূপ অবস্থায় আমার সহিত যাইবার নিমিত্ত আপনাকে অনুরোধ করিতে পারি না। কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে থাকিলে, আমার যে, অনেকটা সুবিধা হয়, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চুরির অবস্থা সকল যে কর্ম্মচারীর প্রমুখাৎ অবগত হইতেছিলাম, সেই কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া আমি ঘটনাস্থলে গমন করিলাম। যে সময় আমরা সেই স্থানে উপনীত হইলাম, সেই সময় রাত্রি হইয়া আসিয়াছিল। সুতরাং গৃহের অবস্থা নিতান্ত সূক্ষ্মভাবে দেখিতে না পাইলেও, মোটামুটি এক প্রকার দেখিয়া আসিলাম। কিন্তু মনে মনে ইচ্ছা থাকিল যে, দিবাভাগে গমন করিয়া সেই গৃহের অবস্থা আর একবার দেখিয়া আসিব।
কর্ম্মচারীর মুখে যে সকল বিষয় অবগত হইয়াছিলাম, ঘটনাস্থলে গমন করিয়া তাহা অপেক্ষা আর অধিক কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না, বা দেখিতেও পাইলাম না।
যে পুরাতন চোর আবদুলের উপর কর্ম্মচারীমাত্রেরই সন্দেহ হইয়াছিল, আমারও কতকটা সন্দেহ তাহারই উপর পড়িল। সুতরাং প্রায় সমস্ত রাত্রি সেই আবদুলের অনুসন্ধানে কাটিয়া গেল। সহর এবং সহরতলীর নানাস্থানে অনুসন্ধান করিতে করিতে তাহার থাকিবার ঠিকানা পাইলাম সত্য; কিন্তু আবদুলকে পাইলাম না। তবে এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, সারা দিবস ভিক্ষা করিয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বেই সে তাহার বাসায় প্রত্যাগমন করিয়াছিল; কিন্তু সন্ধ্যার পরেই গোফুর নামক আর একজন পুরাতন চোরের সহিত তাহার বাসা হইতে কোথায় চলিয়া গিয়াছে; এ পর্যন্ত প্রত্যাগমন করে নাই। করে আরও অবগত হইলাম যে, এইরূপে তাহারা উভয়ে প্রায়ই রাত্রিকালে কোথায় গমন করিয়া থাকে, এবং সময় সময় দুই এক দিবস পরেও প্রত্যাগমন করে।
আবদুলের বাসার সন্নিকটেই গোফুরের থাকিবার স্থান। সেই স্থানে গমন করিয়া আবদুল কি গোফুর কাহাকেও প্রাপ্ত হইলাম না। পুনরায় আবদুলের বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। ভাবিলাম,—রাত্রি শেষ হইতে যে সামান্য বিলম্ব আছে, সেই সময়টুকু আবদুলের বাসার সন্নিকটে বসিয়াই অতিবাহিত করিব।
আবদুলের বাসার সন্নিকটে একটি প্রকাণ্ড অশ্বত্থ বৃক্ষ ছিল, সেই বৃক্ষমূলে উপবেশন করিয়া রাত্রি অবশিষ্ট অংশটুকু যাপন করিবার মানসে সেই স্থানে গমন করিলাম, এবং সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। ইচ্ছা,—প্রভাত হইলেও কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে অবস্থিতি করিয়া দেখিব যে, আবদুল, কি তাহার সঙ্গী প্রত্যাগমন করে, কি না। সেই সময়ের মধ্যে যদি তাহারা প্রত্যাগমন করে, ভালই; নতুবা অপর আর একজন কর্ম্মচারীকে সেই স্থানে উহাদিগের প্রতীক্ষায় রাখিয়া আমরা সেই স্থান পরিত্যাগ করিব।
মনে যতদূর ভাবিতেছিলাম, কাৰ্য্যে কিন্তু ততদূর করিতে হইল না। আমাদিগের সেই স্থানে উপবেশন করিবার অৰ্দ্ধঘণ্টা মধ্যেই দেখিতে পাইলাম যে, আবদুল তাহার সঙ্গী গোকুরের সহিত প্রত্যাগমন করিতেছে। উহাদিগকে দেখিবামাত্রই আমরা তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া উভয়কেই ধৃত করিলাম।
আমরা ইতিপূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম যে, দুইজন পুরাতন চোর রাত্রিকালে একত্র যখন বাহির হইয়া গিয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তাহাদিগের অভিসন্ধি চুরি করা। এরূপ অবস্থায় প্রত্যাগমন করিবার সময় যদি তাহাদিগকে ধরিতে পারা যায়, তাহা হইলে তাহাদিগের নিকট হইতে নিশ্চয়ই কোন না কোন চোরা মাল পাওয়া যাইবে। সুতরাং উহাদিগকে দেখিবামাত্রই আমরা তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া তাহাদিগকে ধৃত করিলাম সত্য; কিন্তু যেরূপ ভাবিয়াছিলাম, তাহার কিছুই হইল না। উহাদিগের নিকট কোনরূপ দ্রব্যই প্রাপ্ত হইলাম না; তথাপি আমরা উহাদিগকে পরিত্যাগ করিলাম না। যে মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমরা লিপ্ত ছিলাম, যদি সেই মোকদ্দমার কোন অপহৃত দ্রব্য যদি উহাদিগের ঘরে পাওয়া যায়, এই ভাবিয়া এক এক করিয়া উহাদিগের উভয়ের গৃহ অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম না।
সেই সময় আমি আবদুলকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ রাত্রিকালে তোমরা উভয়ে কোথায় গমন করিয়াছিলে?” বলা বাহুল্য যে, আবদুল আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিবার পূর্ব্বেই গোফুরকে এরূপ ভাবে দূরে রাখিলাম যে, আমার ও আবদুলের মধ্যে যে সকল কথা হয়, গোফুর তাহার কিছুমাত্র শুনিতে না পায়।
আবদুল। কোথায় আর গমন করিব? একটু ঘুরিতে ফিরিতে গিয়াছিলাম মাত্র।
আমি। কোথায় ঘুরিতে ফিরিতে গিয়াছিলে?
আবদুল। রাস্তায় রাস্তায়।
আমি। কখন গিয়াছিলে?
আবদুল। এখনই গিয়াছিলাম।
আমি। মিথ্যা কথা।
আবুদুল। কিরূপ মিথ্যা কথা হইল?
আমি। আমি পূৰ্ব্বেই জানিতে পারিয়াছি যে, তুমি এবং গোফুর সন্ধ্যার পরেই বাহির হইয়া গিয়াছ।
আবদুল। এ কথা আপনাকে কে বলিল?
আমি। যে বলুক না কেন, ইহা প্রকৃত কি না?
আবদুল। আমরা কত রাত্রিতে বাহির হইয়া গিয়াছিলাম, তাহা ঠিক মনে নাই।
আমি। কোন্ সময় বাহির হইয়া গিয়াছ, তাহা তোমার মনে নাই। কিন্তু কোথায় গমন করিয়াছিলে, তাহাও কি ভুলিয়া গিয়াছ?
আবদুল। এমন কোন স্থানে গমন করি নাই। বেড়াইতে বেড়াইতে গঙ্গার ধার পর্য্যন্ত গমন করিয়াছিলাম।
আমি। আচ্ছা, রাত্রির কথা যাউক। দিনমানে তুমি কোথায় ছিলে?
আবদুল। ভিক্ষা করিতে গমন করিয়াছিলাম।
আমি। কল্য দিবাভাগে তুমি কোন্ দিকে ভিক্ষার্থে গমন করিয়াছিলে?
আবদুল। কালীঘাট অঞ্চলে।
আমি। পূর্ব্ব পরশ্ব দিবস কোন্ দিকে গিয়াছিলে?
আবদুল। টালিগঞ্জ অভিমুখে।
আমি। দেখ আবদুল! আমি তোমাকে যে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহারই মিথ্যা উত্তর প্রদান করিতেছ। তুমি যেরূপ ভাবের চোর, তোমাকে সেইরূপ ভাবে জিজ্ঞাসা না করিলে, তুমি প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে না বলিয়া বোধ হইতেছে।
আবদুল। কেন মহাশয়! আমি কি মিথ্যা জবাব দিলাম?
আমি। পরশ্ব দিবাভাগে কোন স্থানে কোন্ কনেষ্টবলের সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?
আবদুল। রাস্তার অনেক স্থানে অনেক কনেষ্টবলকে দেখিয়াছি!
আমি। কোন কনষ্টেবলের সহিত তোমার কোন কথা হইয়াছিল বা কোন কনষ্টেবল তোমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল?
আবদুল। তাহা আমার ঠিক মনে হয় না। বোধ হয়, কোন কনষ্টেবলের সহিত আমার কোন কথা হয় নাই। আমি চুরি করা ছাড়িয়া দিয়াছি। ভিক্ষা করিয়া এখন দিনপাত করিয়া থাকি। এখন কোন কনষ্টেবল আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবে কেন?
আবদুলের কথা শুনিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, উহার নিকট কোনরূপ প্রকৃত কথা পাইবার উপায় নাই। অধিকন্তু, তাহার কথার ভাবে বর্তমান চুরি সম্বন্ধে তাহার উপর আরও বিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল।
গোফুরকেও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সেও যেরূপ ভাবে উত্তর প্রদান করিল, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, গোফুরও সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা কথা কহিল।
উহাদিগের সম্বন্ধে ভালরূপ অনুসন্ধান হওয়া বিশেষ আবশ্যক বিবেচনায় উভয়কেই থানায় প্রেরণ করিলাম। এদিকে রাত্রিও প্রভাত হইয়া গেল। দিবাভাগে ঘটনাস্থলটি আর একবার দেখিবার নিমিত্ত আমি পুনরায় বৃদ্ধার বাড়ীতে গমন করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ঘটনাস্থলে গমন করিয়া বৃদ্ধার যে ঘরে ঝাঁপ কাটিয়া চোর চুরি করিবার অভিপ্রায়ে প্রবেশ করিয়াছিল, সেই ঘরের বহির্ভাগে চতুৰ্দ্দিকে প্রথমতঃ উত্তমরূপে দেখিলাম। কিন্তু এরূপ কোন দ্রব্য দেখিতে পাইলাম না, যাহা উপলক্ষ করিলে অনুসন্ধানের কিছু সাহায্য হইতে পারে। ঘরের চতুর্দিক উত্তমরূপে দেখা শেষ হইলে, বৃদ্ধার সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঘরের মধ্যস্থিত মৃত্তিকার উপর দণ্ডায়মান হইয়া যতদূর দেখিবার সম্ভাবনা, প্রথমতঃ তাহাই দেখিলাম। পরিশেষে ঘরের মধ্যে যে সকল বাঁশের আড়া ছিল, এক এক করিয়া ক্রমে তাহার উপর উঠিয়া দেখিতে লাগিলাম।
এইরূপে দেখিবার সময় একটি সামান্য দ্রব্যের উপর হঠাৎ আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেই দ্রব্যটি আমি উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু কাহাকেও কিছু বলিলাম না। আস্তে আস্তে আড়া হইতে নামিয়া পড়িলাম। সেই সময় আমি যে কি দ্রব্য দেখিয়াছিলাম, তাহা এখন পাঠকগণের জানিবার কোনরূপ আবশ্যক নাই। আবশ্যক হয়, পরে জানিতে পারিবেন। আবশ্যক না হইলে, জানিবার কোন প্রয়োজনই নাই।
সেই ঘরের মধ্যস্থিত অপরাপর যে সকল স্থান দেখিবার প্রয়োজন মনে করিয়াছিলাম, তাহাও উত্তমরূপে দেখিয়া লইলাম, এবং পরিশেষে বৃদ্ধার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া নিকটবর্ত্তী জনৈক ভদ্রলোকের বাড়ীতে গিয়া উপবেশন করিলাম। যে সময় আমি বৃদ্ধার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় তাহার পালিত পুত্র ভবেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী বাড়ীতে উপস্থিত ছিল। যে পর্য্যন্ত আমি সেই বাড়ীতে ছিলাম, ভবেন্দ্রনাথও সেই পর্য্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল। আমি যখন নিকটবর্ত্তী ভদ্রলোকের বাড়ীতে গিয়া উপবেশন করিলাম, ভবেন্দ্রনাথও সেই সময় আমার সহিত গমন করিয়া আমারই নিকট বসিল।
আমরা সেই স্থানে গিয়া উপবেশন করিলে পর, পাড়ার দুই একজন ভদ্রলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে দুইজন আমার পরিচিতও ছিলেন। আমাকে দেখিবামাত্র তাঁহারা কহিলেন, “কি মহাশয়! বৃদ্ধার ঘর হইতে যে চুরি হইয়াছে, এ পর্য্যন্ত তাহার কোনরূপ অনুসন্ধান হইল কি?”
আমি। অনুসন্ধান ত হইতেছে।
ভদ্র-লোক। অনুসন্ধান চলিতেছে, তাহা ত দেখিতেছি। কিন্তু কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গিয়াছে কি?
আমি। একটু পাওয়া গিয়াছে বৈকি।
ভদ্র লোক। কিরূপ সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, জানিতে পারি কি? মালের কোন সন্ধান হইয়াছে নাকি?
আমি। মালের কোন সন্ধান এখনও হয় নাই; কিন্তু হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। কেবল আসামীর সন্ধান হইয়াছে মাত্র।
ভদ্র-লোক। আসামীর সন্ধান হইয়াছে, কিন্তু বোধ হয়, এখনও ধরা পড়ে নাই?
আমি। কেবল সন্ধান নহে, আসামী ধরাও পড়িয়াছে।
আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী। আপনার বিবেচনায় তবে কি আবদুলই এই মোকদ্দমার প্রকৃত আসামী?
আমি। আবদুল ও গোফুর আমাদিগের নিকট অনেক মিথ্যা কথা বলিয়াছে সত্য; কিন্তু তাহাদিগের দ্বারা এ চুরি হয় নাই। আমি তাহাদিগকে থানায় পাঠাইয়া দিয়াছি। এখনই একটি লোক দ্বারা থানায় সংবাদ প্রেরণ করুন, এবং বলিয়া দিউন, এখনই যেন তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়।
কর্ম্মচারী। আপনি বলিতেছেন যে, এই মোকদ্দমার আসামী ধৃত হইয়াছে। কিন্তু আমি আপনার সহিত বরাবরই আছি, আবদুল ও গোফুর ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তি ত এই মোকদ্দমায় ধৃত হয় নাই। উহাদিগের দ্বারা যদি এই চুরি না হইয়া থাকে, তাহা হইলে যে ব্যক্তি চুরি করিয়াছে, সে কিরূপে ধৃত হইল?
ভদ্র-লোক। মহাশয়! যে ব্যক্তি ধৃত হইয়াছে, সে এখন কোথায়?
আমি। সে এই স্থানেই আছে, আপনার নিকটেই সে বসিয়া আছে।
ভদ্র-লোক। আমার নিকটে কোন চোরকে ত দেখিতে পাইতেছি না।
আমি। কেন আপনি ইহাকে চিনেন না কি?
ভদ্র-লোক। ইহাকে খুব চিনি, ইহার নাম ভবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বৃদ্ধার ঘরে চুরি হইয়াছে সত্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লোকসান হইয়াছে ভবেন্দ্রনাথের। এরূপ অবস্থায় ইনি আসামী হইবেন কি প্রকারে?
ভবেন্দ্র। কি মহাশয়! আমি চোর?
আমি। এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন? তুমি আপন মনে বুঝিতে পারিতেছ না কি?
ভবেন্দ্র। আমার জিনিস চুরি হইল, আর আপনি কিনা বলিতেছেন আমি চোর! আপনাদিগের বিচারকে বলিহারি যাই!
আমি। এ চুরি তুমি কর নাই?
ভবেন্দ্র। না। নিশ্চয় না।
আমি। নিশ্চয়ই করিয়াছ।
ভবেন্দ্র। আমি চুরি করিয়াছি, এ কথা আপনাকে কে কহিল?
আমি। যেই বলুক না কেন। তুমি যে এই চুরি করিয়াছ, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
ভবেন্দ্র। মহাশয়! আপনি ওরূপ কথা বলিবেন না, ভদ্র লোককে এরূপ ভাবে চোর অপবাদ কখনই প্রদান করিবেন না।
আমি। দেখ ভবেন্দ্র! কোন্ ব্যক্তি চোর বা কোন্ ব্যক্তি সাধু, তাহা তোমা অপেক্ষা আমি উত্তমরূপে অবগত আছি। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমি বালক চোরের পরামর্শ চাহি না।
ভবেন্দ্র। তবে আপনার প্রকৃতই বিশ্বাস যে, আমি চোর?
আমি। নিশ্চয়ই। তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তোমার পাড়ার অনেকগুলি ভদ্র লোক এই স্থানে উপস্থিত, তাঁহাদিগের সাক্ষাতে আমি তোমাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি। দেখি, তুমি প্রকৃত উত্তর প্রদান কর কি না। আর যদি প্রকৃত উত্তরও প্রদান না কর, তাহা হইলে সেই সকল প্রশ্নের উত্তর আমি এই সকল ভদ্রলোকের নিকট হইতেই প্রাপ্ত হইব। কারণ, আমি তোমাকে এরূপ কথা জিজ্ঞাসা করিব, যাহা সকলেই অবগত আছেন।
ভবেন্দ্র। যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা আপনি অনায়াসে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। আমি যতদূর সম্ভব, তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিব।
আমি। তোমার প্রকৃত নাম কি?
ভবেন্দ্র। আমার নাম ভবেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী
আমি। চক্রবর্ত্তী? কিরূপ চক্রবর্তী? কোন্ জাতি?
ভবেন্দ্র। কেন মহাশয়, আমি ব্রাহ্মণ। আমার পূর্ব্বপুরুষগণ সকেলেই চক্রবর্ত্তী বলিয়া পরিচিত। এ কথা এই পাড়ার সকলেই অবগত আছে।
আমি। আপনি ব্রাহ্মণ?
ভবেন্দ্র। হাঁ মহাশয়! আমি ব্রাহ্মণ।
আমি। তুমি কখনই ব্রাহ্মণ নও।
ভবেন্দ্র। আপনি এরূপ অন্যায় কথা বলিতেছেন কেন? আমি বলিতেছি, আমি ব্রাহ্মণ। আর আপনি বলেন কি না আমি ব্রাহ্মণ নহি!
আমি। আমি ত প্ৰকৃত কথাই বলিতেছি যে, তুমি ব্রাহ্মণ নহ। আর যদি প্রকৃতই তুমি ব্রাহ্মণ হও, তাহা হইলে, বৃদ্ধার সমস্ত দ্রব্য তুমিই অপহরণ করিয়াছ।
ভবেন্দ্র। কি জানি মহাশয়! আপনি কি বলিতেছেন! আপনার কথার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। আমার কথা তুমি বেশ বুঝিতে পারিতেছ। কিন্তু এত লোকের মধ্যে তাহা বলিতে তোমার লজ্জা বোধ হইতেছে।
ভবেন্দ্র। না মহাশয়! আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আমি। যদি তুমি বুঝিয়া উঠিতে না পার, আমি তোমাকে বুঝাইয়া দিতেছি। তুমি যদি ব্রাহ্মণ হও, তাহা হইলে তোমার পৈতা নিশ্চয়ই তোমার নিকট থাকিবে ত?
ভবেন্দ্র। অবশ্য, ব্রাহ্মণের পৈতা সর্ব্বদাই তাহার নিকট থাকে।
আমি। তুমি ব্রাহ্মণ। এখন সকলকে দেখাও দেখি, তুমি তোমার পৈতা কোথায় রাখিয়াছ।
আমার এই কথা শুনিবামাত্র ভবেন্দ্রনাথ তাহার অঙ্গের সর্ব্বস্থানে ও পরিহিত বস্ত্রের নানাস্থানে তাহার পরিহিত উপবীতের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। কিন্তু কোন স্থানে সে তাহার নিজের উপবীত দেখিতে না পাইয়া যে কতদূর চিন্তিত হইল, তাহা বলা যায় না। সমবেত ভদ্র লোকগণের মধ্যে অনেকেই বলিতে লাগিলেন, “তাই ত, তোমার পৈতা তুমি কোথায় ফেলিলে? ব্রাহ্মণ সন্তান যে তাহার পৈতা ফেলিয়া দেয়, তাহা আমার আজ এই প্রথম দেখিলাম।” তাঁহাদিগের কথা শুনিয়া ভবেন্দ্রনাথ কোন উত্তরই করিতে পারিল না, কেবলমাত্র এদিক ওদিক চতুর্দিকে আপনার উপবীতের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। এইরূপ কিয়ৎক্ষণ পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করিয়া যখন কিছুতেই নিজের উপবীতের সন্ধান পাইল না, তখন কহিল, “আমি আমার পৈতা খুঁজিয়া পাইতেছি না। কোনরূপে কোন স্থানে পড়িয়া গিয়া থাকিবে।”
আমি। এখন বুঝিতে পারিতেছ, আমার কথা প্রকৃত কি না? হয় তুমি চোর, না হয় তুমি ব্রাহ্মণ নও।
ভবেন্দ্র। আমি চোর নহি, আমি ব্রাহ্মণ। দৈবগতিকে কিরূপে আমার পৈতা হারাইয়া গিয়াছে মাত্র।
আমি। দৈবগতিকেই সব হইয়া থাকে। এখন তুমি আমার সহিত আগমন কর, আমি তোমাকে দেখাইয়া দিব যে, দৈবগতিকে তুমি চোরও হইয়া পড়িয়াছ। এখন যদি ভাল চাহ, তাহা হইলে অপহৃত দ্রব্যগুলি কোথায় রাখিয়াছ, তাহা এখনই বলিয়া দেও। নতুবা তোমার অবস্থা যে কি হইবে, তাহা এখন তুমি নির্ণয় করিয়া উঠিতে পারিবে না; কিন্তু পরিশেষে তাহা বেশ বুঝিতে পারিবে।
এ পর্যন্ত আমার কথায় ভবেন্দ্রনাথ যে প্রকার উত্তর প্রদান করিয়া আসিতেছিল, এখন কিন্তু আর সেরূপভাবে উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। তাহার মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না, নিতান্ত ভীত-অন্তঃকরণে সে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ! তোমার মুখ দিয়া ইহারই মধ্যে আর কথা বাহির হইতেছে না, এখনও অনেক সময় আছে। তোমার মনের ভাব এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি। আইস আমরা এই স্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করি।
এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম। আমার সমভিব্যাহারী কর্মচারীও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ উঠিলেন। আমরা ভবেন্দ্রনাথকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিলাম। আমরা যে কোথায় গমন করিতেছি, উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ তাহার কিছুই অবগত হইতে না পারিয়া, তাঁহারাও আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিলেন। আমাদিগের কথাবার্তা শুনিয়া ও আমাদিগের ভাবগতি দেখিয়া তাহারা যে কি পর্য্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলেন, তাহা বলা যায় না। কেহ মনে করিতেছিলেন, পুলিশ অন্যায় করিয়া ভবেন্দ্রনাথের উপর অসদ্ব্যবহার করিতেছেন। কেহ ভাবিতেছিলেন, ভবেন্দ্রনাথকে চোর বলিয়া ও তাহাকে বিশেষরূপ পীড়ন করিয়া তাহার নিকট হইতে কিছু অর্থের সংস্থান করাই পুলিশের একমাত্র উদ্দেশ্য। কারণ, বৃদ্ধা যখন জানিতে পারিবে যে, তাহার পালিত পুত্রই চৌর্য্যাপরাধে ধৃত হইয়াছে, তখন তাহার যাহা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাহাই পুলিশকে প্রদান করিয়া ভবেন্দ্রনাথকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিবে। কেহ ভাবিলেন, এত লোক বৰ্ত্তমান থাকিতেও পুলিশ যখন ভবেন্দ্রনাথকে চৌর্য্যাপরাধে ধৃত করিয়াছে, তখন নিশ্চয়ই ইহার ভিতর কোনরূপ না কোনরূপ গূঢ় রহস্য আছে। নতুবা ভবেন্দ্রনাথে পৈতাই বা কি হইল?
যাহা হউক, আমরা সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া পুনরায় ফরিয়াদীর বাটীতেই গমন করিলাম। এবার কিন্তু অপর কাহাকেও সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না দিয়া, ভিতর হইতে বাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম। বৃদ্ধাও সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। বাড়ীর ভিতর কেবল রহিলাম আমি, আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী, ও ভবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
সেই সময় বাটীর সম্মুখস্থ রাস্তার উপর এত লোক একত্র হইল যে, সেই পথ দিয়া অপর লোকের চলাচল প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল। আমরা ভিতরে যে কি করিতেছি, তাহা দেখিবার নিমিত্ত সকলে প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া কয়েকটি স্থান ও কয়েকটি দ্রব্য ভবেন্দ্রনাথকে দেখাইলাম। যাহা যাহা ভবেন্দ্রনাথকে দেখাইলাম, ভবেন্দ্রনাথ তাহা তাহা দেখিল মাত্র; কিন্তু কোন কথাই কহিল না। পূর্ব্বে যেরূপ ভাবে ভবেন্দ্রনাথ আমার কথার উত্তর করিয়াছিল, এখন সেরূপ জোরের সহিত তাহার মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না। বুঝিলাম, ভবেন্দ্রনাথ ক্রমেই নরম হইয়া আসিতেছেন।
আমি। ভবেন্দ্রনাথ! আর কেন, এখনও কি তুমি বলিতে চাও যে, আমাদিগের কোন কথা জানিতে বাকী আছে? ভবেন্দ্রনাথ। আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
আমি। বুঝিতে বেশ পারিতেছ। এখন আমাদিগকে আর কষ্ট দিও না। তোমাকে আমি একটি কথা বলি, তুমি বিশেষ মনোযোগ পূর্ব্বক উহা শ্রবণ কর, এবং বেশ বিবেচনা করিয়া তাহার উত্তর প্রদান কর। তুমি যে বৃদ্ধার সমস্ত দ্রব্য অপহরণ করিয়াছ, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সন্দেহই বা কেন, এ সম্বন্ধে তোমার বিপক্ষে যেরূপ আনুষঙ্গিক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তোমাকে বলিয়া দেওয়ার প্রয়োজন নাই। কারণ, তাহা তুমি তোমার স্বচক্ষে উত্তমরূপে দর্শন করিয়াছ। এখন আমার শেষ বক্তব্য এই যে, যদি অতঃপরও তুমি প্রকৃত কথা না কহ, তাহা হইলে অনন্যোপায় হইয়া তোমাকে আমি থানায় লইয়া যাইব। সেই স্থানে গমন করিলে তুমি কোন প্রকারই সত্য গোপন করিতে পারিবে না, অধিকন্তু তোমাকে নিশ্চয়ই জেলে গমন করিতে হইবে। কিন্তু যদি তুমি আমার পরামর্শ শুন, তাহা হইলে তোমাকে থানায় লইয়া যাইবার পূর্ব্বেই তুমি সকল কথা স্বীকার কর। কারণ, তুমি বুঝিতে না পারিয়া, হঠাৎ যে কার্য্য করিয়া বসিয়াছ, এখন আর তাহার কোন উপায় নাই। কিন্তু তুমি অপহরণ করিয়াছ কাহার দ্রব্য? যিনি তোমাকে একাল পর্যন্ত লালনপালন করিয়া এত বড়টি করিয়াছেন, এবং তোমাকেই প্রদান করিবার নিমিত্ত যিনি এই সকল অর্থ সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন। সেই অর্থ চুরি করিয়া তুমি একরূপ নিজের অর্থই নিজে অপহরণ করিয়াছ। এরূপ অবস্থায় বৃদ্ধা সমস্ত অর্থ প্রাপ্ত হইলে সে যে তোমাকে জেলে দিতে প্রস্তুত হুইবে, তাহা আমার বোধ হয় না। আরও এক কথা,—এই চুরি যদি তুমি একাকীই করিয়া থাক, তাহা হইলে তোমাকে অধিক কথা বলিবার আমার আর প্রয়োজন নাই। কিন্তু অপর কোন লোকের সাহায্যে যদি এই কাৰ্য্য হইয়া থাকে, তাহা তোমার প্রকাশ করা কর্তব্য। কারণ, সেই ব্যক্তি অপহৃত দ্রব্যের যে অংশ প্রাপ্ত হইবে, প্রকৃতপক্ষে দেখিতে গেলে, সেই অর্থ তোমারই লোকসান হইবে। তুমি আমাদিগকে আর অধিক কষ্ট প্রদান করিও না। কারণ, তুমি মনে বেশ জানিও যে, আমাদিগকে তুমি যত কষ্ট প্রদান করিবে, আমরাও তোমাকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক কষ্ট প্রদান করিব। অথবা যেরূপে পারি, তোমার নিকট হইতে অপহৃত দ্রব্য বাহির করিব, অথচ তোমাকে জেলেও প্রেরণ করিব। আমার যাহা কিছু বক্তব্য ছিল, তাহা বলিলাম, এখন তুমি যাহা ভাল বিবেচনা কর, তাহা করিতে পার।
আমার কথা শুনিয়া ভবেন্দ্রনাথ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। পরিশেষে কহিল, “বৃদ্ধার দ্রব্য আমি অপহরণ করিয়াছি, ইহা যদি প্রমাণিত হয়, তাহা হইলে আমার কারাদণ্ড হইতে পারে, কি না?”
আমি। তোমাকে কারাগারে প্রেরণ করা আর না করা, আমাদিগের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তুমি আমাদিগকে যদি কষ্ট প্রদান কর, তাহা হইলে যাহাতে তুমি কারাগারে গমন কর, তাহার চেষ্টা বিধিমতে আমরা করিব। আর যদি সহজেই অপহৃত সমস্ত দ্রব্য বাহির করিয়া দেও, তাহা হইলে বৃদ্ধা যাহাতে তোমার উপর নালিশ না করে, তাহার বন্দোবস্ত করিব।
ভবেন্দ্র। যদি বিচারে আমায় কারাবাস দণ্ড গ্রহণ করিতেই হয়, তাহা হইলে কত দিবসের জন্য সেই কারাবাস হইবার সম্ভাবনা?
আমি। তুমি এত ভীত হইতেছ কেন, যাহাতে তোমার মেয়াদ না হয়, আমার সাধ্যমত তাহার চেষ্টা করিতে আমি কিছুমাত্র ত্রুটী করিব না। আর যদি তোমাকে কোনরূপে রক্ষাও না করিতে পারি, তাহা হইলে যাহাতে তোমার কেবল নামমাত্র দণ্ড হয়, তাহা করিব। এখন বল দেখি, অপহৃত দ্রব্যগুলি কোথায় রাখিয়াছ, এবং তোমার সহিত আর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল?
ভবেন্দ্র। আমার সহিত আর কেহই ছিল না।
আমি। এ ভাল কথা, তাহা হইলে সমস্ত দ্রব্যই কি তোমার নিকট আছে?
ভবেন্দ্র। এ চুরি আমি করি নাই।
আমি। তবে কে করিল?
ভবেন্দ্র। তাহা আমি জানি না।
আমি। পুনরায় মিথ্যা কথা আরম্ভ করিলে? দেখিতেছি, তোমার অদৃষ্টে বিস্তর কষ্ট আছে।
ভবেন্দ্র। আমাকে একবার ছাড়িয়া দিন।
আমি। কেন, কোথায় যাইতে চাহ?
ভবেন্দ্র। বৃদ্ধার সহিত একবার দেখা করিতে ইচ্ছা করি।
আমি। যে পৰ্য্যন্ত তুমি প্রকৃত কথা বলিয়া অপহৃত দ্রব্যাদি সকল বাহির করিয়া না দিবে, সেই পর্য্যন্ত বৃদ্ধার সহিত তোমাকে কোনরূপেই সাক্ষাৎ করিতে দিব না। অপহৃত দ্রব্যগুলি বাহির করিয়া দিলে, কেবলমাত্র বৃদ্ধার সহিত যে তোমার সাক্ষাৎ করাইয়া দিব, তাহা নহে; যাহাতে সে তোমার বিপক্ষে নালিশ না করে, তাহারও চেষ্টা করিব।
ভবেন্দ্র। বৃদ্ধার সহিত কি তবে আমার সাক্ষাৎ হইবে না?
আমি। অবশ্য হইবে; কিন্তু এখন নহে, পরে। বাজে কথা ছাড়িয়া দেও, এখন বল, সেই সকল দ্রব্য কোথায় রাখিয়াছ?
ভবেন্দ্র। বুঝিতে পারিতেছি, এবার আমার কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। আচ্ছা, আমার সহিত আসুন।
আমি। কোথায় যাইব?
ভবেন্দ্র। আমি যে স্থানে আপনাকে লইয়া যাইতেছি, সেই স্থানে চলুন।
আমি। ওরূপ ভাবে আমি তোমার সহিত যাইব না। কোথায় যাইতে হইবে, বা কোথায় অপহৃত দ্রব্যগুলি রাখিয়াছ, তাহা আমাকে বল, তাহা হইলে আমি তোমার সহিত গমন করিব।
ভবেন্দ্র। সেই রাত্রিতে আমি যে বাড়ীতে শয়ন করিয়াছিলাম, আমার সেই বন্ধুর বাড়ীতে গমন করুন।
আমি। সেই স্থানে কি তুমি অপহৃত দ্রব্য রাখিয়াছ?
ভবেন্দ্র। সেই স্থানেই আছে।
আমি। কাহার নিকট আছে? সেই সকল দ্রব্য কি তুমি তোমার বন্ধুর নিকট রাখিয়াছ?
ভবেন্দ্র। না, আমি কাহারও নিকট রাখি নাই।
আমি। তবে কোথায় রাখিয়াছ?
ভবেন্দ্র। সেই বাড়ীর ভিতর এক স্থানে রাখিয়াছি।
আমি। আচ্ছা চল, আমি তোমার সহিত গমন করিতেছি। কিন্তু যদি মিথ্যা আমাদিগকে কষ্ট দেও, তাহা হইলে দেখিও, তোমার অদৃষ্টে কি ঘটে।
এই বলিয়া ভবেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমরা উভয়েই বৃদ্ধার বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। ভবেন্দ্রনাথ আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া তাহার বন্ধুর বাটী অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। সেই সঙ্গে রাস্তার সমস্ত লোকই আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। তখন আমরা যে কোথায় গমন করিতেছি, বা কিসের নিমিত্তই বা গমন করিতেছি, তাহা তাহারা জানিতে না পারিলেও আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাহারা গমন করিতে লাগিল।
যাহা হউক, ক্ৰমে গিয়া আমরা ভবেন্দ্রনাথের বন্ধুর বাড়ীতে উপনীত হইলাম। বন্ধুর বৈঠকখানার যে গৃহে ভবেন্দ্রনাথ মধ্যে মধ্যে তাহার বন্ধুর সহিত শয়ন করিত, সেই গৃহের ভিতর কতকগুলি বাদ্য-যন্ত্র থাকিত, তাহা পাঠকগণ সকলেই অবগত আছেন। সেই বাদ্য-যন্ত্রের মধ্যে একটি পুরাতন ও ভগ্ন তানপুরা এক স্থানে রক্ষিত ছিল; উহার নিকট কেহই গমন করিত না, বা উহা কাহারও প্রয়োজনে লাগিত না। সৰ্ব্বসমক্ষে ভবেন্দ্রনাথ সেই তানপুরার নিকট গমন করিয়া তাহার মধ্য হইতে একটি পুঁটুলী বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। সৰ্ব্বসমক্ষে সেই পুটুলীটি খুলিয়া ফেলিলাম; দেখিলাম,—বৃদ্ধার ঘর হইতে সে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছিল, তাহার সমস্তই উহাতে আছে, কিছুমাত্র স্থানান্তরিত হয় নাই।
এই ব্যাপার দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন। বিশেষতঃ ভবেন্দ্রনাথ কর্তৃক এই কাৰ্য্য কখনই হইতে পারে না, এইরূপ বিশ্বাস যাহাদিগের ছিল, তাহাদিগের মুখ হইতে আর কোন কথাই বাহির হইল না।
আমি কি নিমিত্ত প্রথমতঃ ভবেন্দ্রনাথকে সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা জানিবার নিমিত্ত অনেকেই বিশেষরূপ উৎসুক হইয়া পড়িলেন। অনেকেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! পূর্ব্বেই কিরূপে ইহাকে চোর বলিয়া একবারে স্থির-নিশ্চয় করিয়াছিলেন।” কিন্তু তখন সেস্থলে কোন কথা ভাঙ্গিলাম না।
সমস্ত অপহৃত দ্রব্যের সহিত ভবেন্দ্রনাথকে আমি আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট লইয়া গেলাম। তাঁহাকে আনুপূর্ব্বিক সমস্ত কথা কহিলাম। পরিশেষে তিনিও আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে প্রথমে ভবেন্দ্রনাথের উপর তোমার সন্দেহ পতিত হয়?”
কিরূপে ভবেন্দ্রনাথকে আমি চোর ঠিক করিয়াছিলাম, অতঃ পর তাহা আমাকে প্রকাশ করিতে হইল। তখন তাঁহাকে কহিলাম, “প্রাতঃকালে যখন আমি বৃদ্ধার গৃহের অবস্থা উত্তমরূপে দর্শন করি, সেই সময় দেখিতে পাই, যেস্থান দিয়া আসামী গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া আড়ার উপর আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং আড়ার উপর হইতে যেস্থান দিয়া মৃত্তিকার উপর নামিতে চেষ্টা করে, তাহার সন্নিকটে একখানি বাঁশের অগ্রভাগে একটি পৈতা সংলগ্ন রহিয়াছে। সেই সময় আমার মনে হয় যে, যে চুরি করিয়াছে সে ব্রাহ্মণ। দ্রুতগতি নামিবার সময় হঠাৎ তাহার পৈতা সেই বাঁশে বাধিয়া যায়, এবং নামিবার সঙ্গে সঙ্গে উহা সেই বাঁশের অগ্রভাগেই রহিয়া যায়। চোরের মন সেই সময় অপর কার্য্যে ব্যস্ত ছিল; সুতরাং সে ইহার কিছুই অনুভব করিতে পারে নাই। ইহার পরই আমি দেখিতে পাই, ভবেন্দ্রনাথের গাত্রে তাহার পৈতা নাই। সুতরাং তাহারই উপর আমার সন্দেহ হয়, এবং পরিশেষে সেই সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হইয়াছে।
সামান্য সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আমি এই মোকদ্দমার উপায় করিতে সমর্থ হইয়াছি দেখিয়া, কৰ্ম্মচারী আমার উপর সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন।
চৌর্য্যাপরাধে ভবেন্দ্রনাথ ধৃত হইয়াছে, এই কথা শুনিবামাত্র বৃদ্ধা রোদন করিতে আরম্ভ করিল, এবং যাহাতে ভবেন্দ্রনাথের কোনরূপ দণ্ড না হয়, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু বিচারক একবারে তাহার কথা শুনিলেন না; তবে অতি সামান্য দণ্ড দিয়া সেই মোকদ্দমার বিচার শেষ করিলেন। বিচারে ভবেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র ছয় মাসের জন্য কারাগারে প্রেরিত হইল।
[পৌষ, ১৩০৩]