কি পেলাম – ৯

০৯.

এদিকে রোকেয়া অসুখে ভুগে ভুগে কংকাল হয়ে গেল। নিজের ও মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে করে আরো কাহিল হয়ে পড়ল। এক-এক সময় ভাবে, এভাবে বেঁচে থাকার। চেয়ে মরণ অনেক ভালো। কয়েকবার আত্মহত্যা করার কথা চিন্তাও করেছে। কিন্তু। আত্মহত্যা মহাপাপ ভেবে তা করতে পারেনি। বাপের বাড়ি এসেছে চার-পাঁচ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। কতদিন আর বাপ-ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাব। হারুন তাকে চিঠিপত্র দিয়ে সান্ত্বনা দিলেও ইদানিং টাকা-পয়সা পাঠায়নি। সে প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, হে আল্লাহ, তোমার ভেদ তুমি জান। আমার কি হবে, তাও তুমি জান। আমাকে এভাবে দগ্ধে দগ্ধে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ, তা আমি জানি না। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। হয় আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা দাও, নচেৎ আমাকে এ দুনিয়া থেকে তুলে নাও। এর মধ্যে রোকেয়া নিজের অসুখের কথা বিস্তারিত লিখে পর পর কয়েকখানা চিঠি দিল। কিন্তু হারুনের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে রোকেয়া আরো একখানা চিঠি লিখল

ওগো প্রাণের স্বামী,

আমার হাজার হাজার সালাম তোমার পবিত্র কদমে স্থান দিও। আর হতভাগিনী রোকসানার সালাম নিবে। আশাকরি ভালো আছ। আমরাও কোনো প্রকারে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি।

প্রিয়তম, বেশ কিছুদিন থেকে তোমাকে চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাচ্ছি না। এর কারণ জানালে বাধিত হব। বিয়ের আগে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমাকে পছন্দ কর। বিয়ের পর জানতে পারলাম, তুমি শুধু পছন্দ করনি, তোমার আম্মার অমতে একরকম জোর করে আমাকে বিয়ে করেছ। কারণ তুমি আমাকে অত্যন্ত ভালবাস। বিয়ের পর আমিও তা বুঝতে পেরে তোমাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবেসে ফেলি। সেজন্যে তোমার আম্মার হাজারো অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করে সেই ভালবাসা আজও বাঁচিয়ে রেখেছি। তুমিও আমাকে তোমার আম্মার সবকিছু সহ্য করে সবর করতে বলেছিলে। আমি তোমার সুখের জন্য আজ আট বছরের বেশি হতে চলল, নিশ্চল পাথরের মত চুপ করে সহ্য করে রয়েছি। কিন্তু তুমি স্বামীর কর্তব্য পালন করতে পারনি। বলতে পার প্রিয়, এত বছর তোমার মুখের দিকে চেয়ে সবর করে কি পেলাম? অবশেষে সবর করতে না পেরে আজ কয়েকটা কথা বলব। অন্যায় হবে কিনা জানি না, হলে ক্ষমা করে দিও।

তোমার আম্মা রাজি ছিলেন না, তবু আমাকে বিয়ে করলে কেন? তুমি তো তোমার আম্মা কেমন তা নিশ্চয় জানতে? তারপরও জোর করে এ কাজ করা উচিত হয়েছে? যদি আম্মার কথা তখন মেনে নিতে, তাহলে তোমাকে ও আমাকে এত দুঃখ ও অশান্তি ভোগ করতে হত না। তোমার জিদের জন্য তুমি বেঁচে থাকলেও আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। আর তোমার-আমার একমাত্র সন্তান রোকসানা বাপ থেকেও এতিমের মত মানুষ হচ্ছে। সে বার বার তার আব্বার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি বলি বিদেশে আছে, তোমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য আমাকে চিঠি লিখতে বলে। আমি ওকে বলি, তোমার আব্বকে তোমার কথা বলে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি। কতদিন আর ওকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়ে ভুলিয়ে রাখব? আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি, তুমি তোমার মায়ের পছন্দমত আরেকটা বিয়ে করে সুখের সংসার পাত। এখনো আবার সেই কথা বলছি, তুমি উঁচু ঘরের ধনী কন্যাকে বিয়ে করে সংসারের সবাইকে নিয়ে সুখে ও শান্তিতে থাক। আমি যেমন আছি তেমন থাকব। তোমাদের সংসারে গিয়ে অশান্তির সৃষ্টি করব না। এ জগতে তোমাকে মুক্তি দিলাম। তোমার প্রতি আমার আর কোনোদিন কোনো কিছু দাবি থাকবে বা। তুমি এখন স্বাধীন। এবার একটা কেন, পারলে চারটে বিয়ে করতে পার। কিন্তু এ জগতে তোমাকে মুক্তি দিলেও পরজগতের জন্য নয়, আল্লাহর কাছে এর ন্যায় বিচার চাইব। তোমাকে আমি মাফ করলেও আমার অন্তর কোনোদিন করবে না। কারণ তুমি ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমার সর্বনাশ করেছ। আরো অনেক কিছু লিখার ছিল। কিন্তু মন চাচ্ছে না। কারণ লিখে কি হবে? তোমার যদি পুরুষত্ব বলে কিছু থাকত, তাহলে স্ত্রীকে ছেড়ে বছরের পর বছর বিদেশে থাকতে পারতে না। আর সবকিছু লিখতে গেলে কয়েক রীম কাগজ লাগবে। যাক, মনের দুঃখে ভালো-মন্দ অনেক কিছু লিখে ফেললাম : নিজ গুণে ক্ষমা করো। আল্লাহপাকের দরবারে তোমার সহি সালামতের দোয়া চেয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
অভাগিনী রোকসানার মা।

রোকেয়া হারুনকে কোনোদিন এভাবে চিঠি দেয়নি। কিন্তু এবারে দিয়েও উত্তর পেল না।

একদিন রোকসানা মাকে কাঁদতে দেখে বলল, তুমি আব্দুর জন্য কাঁদছ কেন? আব্দু এখন আসবে না।

রোকেয়া চোখ মুছে বলল, কেন মামণি, তুমি একথা বললে?

রোকসানা বলল, তুমি খালি আব্বর জন্য কাঁদ, তাই বললাম। দেখ আম্মু, আমার বিয়ে দিতে আব্ব ঠিক আসবে।

রোকেয়া বলল, তুমি তো এখন অনেক ছোট।

রোকসানা বলল, আমার কি এখন বিয়ে হচ্ছে? যখন বড় হব, তখন আব্ব আসবে বুঝলে?

রোকেয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, তা তো নিশ্চয়ই।

.

প্রতি বছর বদরপুর ক্লাবে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়। এবছরও হবে। একদিন বখতিয়ার রোকেয়ার হাতে একটা কবিতা দিয়ে বলল, তোর মেয়েকে এটা মুখস্থ করা। ১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে ওকে দিয়ে আবৃত্তি করাব।

 রোকসানা সেখানে ছিল, মামাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছ মেজ মামা?

বখতিয়ার বলল, হ্যাঁরে সত্যি।

রোকেয়া রোকসানাকে বলল, মামাকে ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে এস। আমি তোমাকে কবিতাটা আবৃত্তি করতে শিখিয়ে দিই।

.

অনুষ্ঠানের দিনে রোকেয়া রোকসানাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে বখতিয়ারের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল।

কয়েকটা ছেলেমেয়ে আবৃত্তি করার পর রোকসানার পালা। সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আসোলামু আলাইকুম, আমার নাম রোকসানা আক্তার। আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করব। কবিতার নাম, খেলার প্রিয় সাইদু বাদশা। লিখেছেন, আলাউদ্দিন চৌধুরী (আলো)।

খেলার প্রিয় সাইদু বাদশা মন বসে না পাঠে,
 খেলতে খেলা ফুটবল থাকে সদা মাঠে।
মস্ত বড় খেলুয়াড় হতে চাই জীবনে,
 অন্য খেলা খেলে না কখন ভুলে।
শিখতে খেলা যাবে সে বহুদুর জার্মানে,
 শিক্ষা শেষে আসবে দেশে চড়ে এক রকেট জানে।
আসার সময় আনবে সাথে হাজার খানেক বল,
দেশটাকে মাঠ বানিয়ে খেলবে খেলা ফুটবল।

কবিতা আবৃত্তি করে রোকসানা একটা খাতাও একটা কলম পুরস্কার পেল।

এর মধ্যে রোকেয়ার বড় বোন রূপা বাপের বাড়ি বেড়াতে এল। রোকেয়াকে দেখে বলল, কিরে তুই যে দেখছি কবরের ধারে পৌঁছে গেছিস?

রোকেয়া বলল, আল্লাহপাকের যা মর্জি তা কে রোধ করবে?

রূপা কয়েকদিন থেকে ফিরে যাওয়ার সময় রোকেয়াকে সাথে করে কুমিল্লা নিয়ে এল। তারপর আবার একটা বড় ডাক্তারকে দেখাল।

ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে এক মাসের ওষুধ দিয়ে বললেন, এগুলো খেয়ে। আবার আসবেন।

রোকেয়া এক মাস ওষুধ খেয়ে কোনো উপকার পেল না। তবু আবার সেই ডাক্তারের কাছে এসে সে কথা জানাল।

ডাক্তার আগেকার চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন দেখে আবার রোকেয়াকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে বললেন, আপনার একটা অপারেশন না করালে এ রোগ ভালো হবে না। অপারেশনের জন্য স্বামীর অনুমতি লাগবে। ডাক্তার আগেই জেনেছেন, রোকেয়ার স্বামী দীর্ঘ কয়েক বছর বিদেশে আছেন। তাই বললেন, আপনার স্বামী যদি দেশে থাকতেন, তাহলে এ রোগ হত না। যাই হোক, অপারেশনটা একটু সিরিয়াস ধরনের। অপারেশনটা না করালে অন্ধ হয়ে যাবেন অথবা ব্রেনের মধ্যে দারুণ এ্যাফেক্ট করবে। যার ফলে আপনি পাগল হয়ে যেতে পারেন। আপনি অতি সত্বর স্বামীকে দেশে আসতে বলেন। উনি যদি একান্ত না আসতে পারেন, তবে অনুমতি চেয়ে পাঠান। মনে রাখবেন, যা কিছু করবেন, তাড়াতাড়ি করবেন। এমনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। যত শিঘ্রী সম্ভব অপারেশন করান দরকার। ততদিন আগের ওষুধগুলো খেতে থাকুন।

রোকেয়া বদরপুর ফিরে এসে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীকে চিঠি লিখল

 প্রিয়তম,

পত্রের প্রথমে তোমাকে জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শতকোটি সালাম ও ভালবাসা। ভালবাসা তুমি নিতে না চাইলেও শেষবারের মত সব উজাড় কর পাঠালাম। গতবার চিঠি লিখার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতদিন বেঁচে থাকব, আর কোনোদিন। তোমাকে চিঠি দিয়ে বিরক্ত করব না। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে দিতে হল। আশাকরি আল্লাহর ফজলে বেশ ভালোই আছ। নচেৎ এ হতভাগীর কথা তোমার মনে পড়ে না কেন? আমি পরম করুণাময়ের অশেষ করুণায় শুধু প্রাণে বেঁচে আছি। অসুখে ভুগে ভুগে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ডাক্তার বলেছেন, অতি সত্বর অপারেশ করাতে। নচেৎ আমি বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হয়ে যাব। অপারেশনের জন্য ডাক্তার তোমার অনুমতি চেয়েছেন, তাই এ চিঠি দেওয়া। তোমার বণ্ডসই অথবা অনুমতি না হলে উনি অপারেশন করবেন না। তাই তোমার কাছে আমার একান্ত মিনতি, তুমি যত শিঘ্রী পার চলে এস। আমি হয়তো আর বাঁচব না। তাই তোমাকে শেষবারের মত একবার দেখতে চাই। তোমার কাছে আমার আর কোনো দাবি নেই। একান্ত যদি আসতে না পার, তবে চিঠি দিয়ে হলেও অপারেশনের অনুমতি দিও। এবার তোমাকে দুএকটা কথা বলব, শুনে তুমি হয়তো দুঃখ পাবে। তবুও না বলে থাকতে পারছি না। সেজন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তুমি বোধহয় জান, হযরত ওমর (রাঃ) যখন ইসলাম প্রচারের জন্য দেশের পর দেশ অভিযান চালিয়েছেন, তখন তিনি মা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্ত্রীরা স্বামীকে ছেড়ে কতদিন থাকতে পারে? মা আয়েশা (রাঃ) উত্তরে বলেছিলেন, চার মাস। তখন হযরত ওমর (রাঃ) কাসেদ মারফত বিভিন্ন দেশে অভিযানরত সেনাপতিদের খবর পাঠিয়ে দিলেন, যে সমস্ত সৈন্য চার মাসের অধিককাল বিদেশে রয়েছে, তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দিতে। আর তিনি তাদের স্থলে অন্য সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। শুনেছি হাদিসে আছে, স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে চার বছর যোগাযোগ না রাখে, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপনা-আপনি তালাক হয়ে যায়। স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিয়ে করতে পারে। তুমি আজ পাঁচ-ছবছর বিদেশে রয়েছ। ইসলামী আইন মোতাবেক আমাদের বিয়ে কি টিকে আছে? নেই। এ হাদিস জেনে তুমি হয়তো ভাববে, আমি অন্যত্র বিয়ে করতে চাই। অথবা তুমি আমাকে অন্যত্র বিয়ে করার পরামর্শ দেবে। কিন্তু তুমি জেনে রেখ, কোনোটাই আমি চাই না। যদিও তুমি আমাকে আর নিতে না। চাও, তবুও আমি আজীবন তোমাকে স্মরণ রেখে কাটিয়ে দেব। তবু ঐরকম চিন্তা কোনোদিন মনে স্থান দেব না। তুমি আস আর না আস ভাবব, এটাই আমার তকৃদির। বেশি কিছু লিখে তোমাকে আর বিরক্ত করব না। হয়তো অন্যায় কিছু লিখে ফেললাম, পারলে ক্ষমা করো। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
হতভাগী রোকেয়া।

পুনশ্চ রোকসানা তোমাকে সালাম জানিয়েছে। আর আসার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছে। সে তার আব্বকে জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেনি। দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে।

হারুনকে চিঠি দেওয়ার এক মাস পরও যখন দেশে ফিরল না এবং চিঠিও দিল না তখন বাধ্য হয়ে রোকেয়া নিজে বৎসই দিয়ে অপাশেনের প্রস্তুতি নিল। কারণ পেটের যন্ত্রণায় সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল।

অপারেশনের পর রোকেয়া প্রায় দেড় মাস কুমিল্লায় বড় বোন রূপার বাসায় ছিল। এখন সে আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। কিন্তু দৈহিক সুস্থ হলে কি হবে? স্বামীর চিন্তায় এবং নিজের ও রোকসানার ভবিষ্যতের চিন্তায় মনে একটুও সুখ-শান্তি নেই।

প্রায় এক বছর পর একদিন হোসেন রোকেয়ার বাপের বাড়িতে এল। হোসেনকে দেখে রোকেয়া বলল, কবে বিদেশ থেকে এলে?

হোসেন বলল, দুদিন হল এসেছি।

রোকেয়া বলল, তোমরা আসছ যাচ্ছ, তোমাদের ভাইয়া আসছে না কেন?

হোসেন বলল, ভাইয়ার খবর ভাইয়া জানে। আমি বলব কেমন করে?

 রোকেয়া দেবরের উপর রেগে গেলেও কিছু না বলে চুপ করে রইল।

হোসেন বলল, আমি রোকসানাকে নিতে এসেছি।

রোকেয়া শুনে ভাবতে লাগল, ওরা কি রোকসানাকে একেবারেই নিয়ে যেতে চায়?

ভাবি কিছু বলছে না দেখে হোসেন আবার বলল,তুমি চিন্তা করো না, দুচার দিন পর আমি রোকসানাকে দিয়ে যাব।

রোকেয়া বলল, আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করি না। নিয়ে গিয়ে যদি আর না পাঠাও, তখন আমি কি করব? সবকিছু হারিয়ে রোকসানাকে নিয়ে বেঁচে আছি। ওকে কেড়ে নিলে বাঁচব কেমন করে? একথা বলে সে ফুঁপিয়ে উঠল।

হোসেন বলল, আমি কথা দিচ্ছি ভাবি, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।

রোকেয়া একথা শুনে আর আপত্তি করলো না। রোকসানাকে কাপড় পরিয়ে তার সাথে পাঠিয়ে দিল।

কয়েকদিন পর হোসেন রোকসানাকে দিয়ে গেল। এভাবে তিন-চারবার নিয়ে গেল, আবার দিয়েও গেল।

শেষবারে রোকসানা ফিরে এসে মাকে বলল, দাদি তোমার জামা-কাপড় নিয়ে আসার জন্য কাউকে পাঠাতে বলেছে।

মেয়ের মুখে একথা শুনে রোকেয়া ছোট ভাই বাহাদুরকে সেখানে পাঠাল।

বাহাদুর মেজ আপার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তার রুমে ঢুকে জামা-কাপড়গুলো এক জায়গায় করে বাধল।

এমন সময় হানুফা বিবি রুমে ঢুকে তার হাত ধরে বাইরে এনে বললেন, এসব নিয়ে যেতে হলে তোর বাপকে সাথে করে রোকসানার মাকে আসতে বলবি; তারপর চিরকালের মত তোর আপনাকে বিদেয় করে দেব।

বাহাদুর পনের-ষোল বছর বয়সের ছেলে। প্রথমে সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর বলল, আপনি এখন আবার একথা বলছেন কেন? আপনিই তো রোকসানার হাতে এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন।

হানুফা বিবি রাগের সাথে বললেন, হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু কিভাবে নিয়ে যেতে হবে, তা তো বলিনি। এখন বললাম।

বাহাদুর বলল, সেজ বিয়াইও তো একদিন এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য মেজ আপনাকে বলে এল। সেও তো এরকম কিছু বলেনি। আর আব্বাকেই বা আসতে বলছেন কেন? আপনি নিজেই তো মেজ আপাকে বিদেয় করে দিয়েছেন!

হানুফা বিবি বললেন, তুই কুরআন ছুঁয়ে বলতে পারবি, তোর বোনকে আমি বের করে দিয়েছি? সে নিজে চালাকি করে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে চলে গেছে। আমি কি তার মতলব বুঝি না? আমার ছেলের টাকা পয়সা নিয়ে তোদেরকে খাওয়াবার জন্য গেছে। আমার ছেলের টাকায় তোর আইবুড়ো বোনের বিয়ে দেবে, তাও কি বুঝিনি মনে করেছিস?

বাহাদুর বলল, আমরা কি গরিব নাকি যে দুলাভাইয়ের টাকায় আপা আমাদের খাওয়াবে? দুলাভাই তো অনেকদিন আগে থেকে টাকা-পয়সা পাঠায়নি।

সেখানে হোসেন ছিল। সে বাহাদুরের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে বলল, বেশি প্যাট প্যাট করবি না, চলে যা, আর কখনো এখানে আসবি না। যা, তোর বাবাকে থানায় গিয়ে মামলা করতে বল। তারপর দেখা যাবে, কে হারে কে জিতে। তোর বাপের কি আর অত টাকা আছে? আমরা টাকার জোরে জিতে যাব।

এমন সময় হারুনের দুজন বড় চাচাতো বোন এসে দেখে-শুনে বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করল, তোর বোন বুঝি বিদেশ চলে যাবে?

তখন বাহাদুর তাদের ব্যবহারে কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে একথা শুনে রেগে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, যাবে।

তাদের একজন আবার জিজ্ঞেস করল, তোর বোন শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসবে না?

বাহাদুর বলল, না আসবে না।

অন্যজন জিজ্ঞেস করল, তোদের বাড়ি থেকে সোজা চলে যাবে?

 বাহাদুর বলল, হ্যাঁ।

বাহাদুরের কথা শুনে হানুফা বিবি বললেন, এবার বুঝেছি, কেন তোকে জামা কাপড় নিতে পাঠিয়েছে। যা চলে যা, কোনোকিছু নিয়ে যেতে পারবি না। তোর বাপকে বলিস, সে যেন তার মেয়েসহ পাঁচজন লোক নিয়ে এসে একেবারে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বাহাদুর ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে রোকেয়াকে সব কথা জানাল।

শুনে রাগে ও দুঃখে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। তখন তার স্বামীর উপর ভীষণ রাগ হল। চোখ মুছে ছোট ভাইকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ওরা জামা-কাপড় নিয়ে আসতে বলেছিল বলে তোকে পাঠিয়েছিলাম, নচেৎ পাঠাতাম না। আর কখনো তোকে পাঠাব না ভাই। তুইও কোনোদিন আর ওদের বাড়ি যাবি না। আর কাদিস না চুপ কর। তোকে পাঠিয়ে আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে।

বাহাদুর চোখ মুছে বলল, সেকথা আর তোমাকে বলে দিতে হবে না। তারপর সে সেখান থেকে চলে গেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *