০৮.
রোকেয়া মাসখানেক থেকে বাপের বাড়ি চলে গেল। সেখানে সপ্তাহ খানেক থেকে আবার শ্বশুর বাড়ি ফিরে এল। তারপর রান্না করার সময় শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করল, আম্মা চাল কত নেব?
হানুফা বিবি বললেন, তুই যখন ছিলি না, তখন এক সের দিয়ে আমাদের সবাইয়ের হয়েও বেঁচে গেছে। এখন তুই ও তোর মেয়ে যখন এসেছিস, তখন দেড় সের নে।
রোকেয়া বলল, আমি আমার মেয়ে কি এক বেলায় আধ সের চাল খাই?
হানুফা বিবি বললেন, না, তোরা মা-মেয়ে বাতাস খেয়ে থাকিস। তোদের জন্য আমার সবদিকে ক্ষতি হচ্ছে। তেল, সাবান ও খাওয়া-দাওয়ায় আমাদের সাত আটজনের যা লাগে, তার চেয়ে তোদের দুজনের বেশি লাগে.। বল, এগুলো আমি পাব কোথায়? সারাদিন তো একটাও কাজ করিস না, আর কাজ করতেও জানিস না। তুই কি আমাদের মেরে ফেলতে চাস? না বাপু, আর পারছি না। এবার ক্ষমা করে বিদায় হও। তোর ছেলে হয়নি বলে শামসুর ছেলেকে হিংসা করিস। তাকে দেখতে পারিস না। সেজন্য কোনোদিন কোলেও নিসনি।
শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া কাঁদতে কাঁদতে শায়লাকে বলল, আমি নাকি তোমার ছেলেকে হিংসা করি, কোনোদিন কোলেও নেইনি?
শায়লা শাশুড়ীর মন রাখার জন্য বলল,আম্মা না দেখলে কি আর মিথ্যে করে বলছে?
একথা শুনে রোকেয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, আম্মার কথা বাদ দাও, তুমি দেখেছ কিনা বল?
শায়লা বলল, আমি দেখলে কি হবে, আম্মা তো দেখেনি?
রোকেয়া তখন শাশুড়ীকে বলল, আম্মা, আল্লাহর নামে কসম করে বলুন তো, আমি মেজ ভাইয়ের ছেলেকে হিংসা করি বা কখনো তাকে কোলে নেইনি।
হানুফা বিবি বললেন, তোর কথায় কসম করতে যাব কেন? আমি দেখেছি বলেই
তো বললাম। তোর জন্য মেজ বৌকে শিক্ষা দিতে পারছি না। তুই সবকিছুর ক্ষতির কারণ। তুই নিজে খারাপ, তাই এই বৌকেও খারাপ করছিস। তারপর শায়লাকে। বললেন, তোমাকে এত করে বলি যে, ওর সাথে একটুও মিশবে না। তোমাকে যে খারাপ করছে, সেকথা এখন না বুঝতে পারলেও পরে বুঝতে পারবে। আর রোকসানার মাকেও কতদিন ধরে বলে আসছি চলে যেতে। যাবে কেন? খেতে-পরতে পেলে কেউ কি যেতে চায়?
রোকেয়া কিছু না বলে চিন্তা করল, শায়লা শাশুড়ীর সঙ্গে তাল দিয়ে চলছে।
কয়েকদিন পর এক বিকেলে রোকেয়ার ছোট ভাই বাহাদুর এলে রোকেয়া বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইল।
শায়লা জানতে পেরে বলল, বুবু তুমি যেও না। আম্মা তো প্রায়ই তোমাকে ঐসব বলে থাকেন।
রোকেয়া বুঝতে পারল, সে চলে গেলে সংসারের সব কাজ শায়লাকে করতে হবে। তাই বাধা দিচ্ছে।
তখন তার বিগত দিনের কথা মনের পাতায় ভেসে উঠল। সে থাকলে হানুফা বিবি মেজ বৌকে কোনো কাজ করতে দেন না। তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, সব কাজ রোকসানার মা করবে। তুমি করতে যাবে কেন? তিনি মেজ বৌকে সঙ্গে নিয়ে বসে বসে গল্প করেন। আর রোকেয়া চাকরাণীর মত খাটে। শায়লা মাঝে মাঝে এটা-সেটা করতে গেলে হনুফা বিবি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান। একদিনের ঘটনা, রোকেয়ার তখন খুব জ্বর। কিছু খেতে পারে না। পরের দিন সকালে বিছানা থেকে উঠে রান্না ঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসল। সেখানে হানুফা বিবি শায়লাকে নিয়ে চা-নাস্তা খাচ্ছিলেন। রোকেয়াকে বসে থাকতে দেখেও কেউ খেতে ডাকল না। হনুফা বিবি খাচ্ছেন আর কি কথা নিয়ে হাসাহাসি করছেন। রোকেয়া আর বসে থাকতে পারল না। রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল।
রোকেয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে শায়লা বলল, বুবু, তুমি কি আমার কথা রাখবে না?
শায়লার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে রোকেয়া বলল, না, আমি এখন আর কারো কথা শুনব না। তারপর সে বাহাদুরের সাথে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগল।
তাই দেখে হানুফা বিবি বললেন, এভাবে যেতে পারবি না। তোর বাবাকে দু পাঁচজন লোক নিয়ে আসতে বল। তাদের সামনে তোকে চিরকালের মত বিদেয় করব। এখন তো আমি তোকে যেতে বলিনি।
রোকেয়া বলল, পাঁচজনকে লাগবে না; আর আপনি এখন যেতে না বললেও কত হাজার বার বলেছেন। যাইনি বলে কয়েকবার হাত ধরে বের করে দিয়েছেন। আজ আবার লোকজনদের জানাবার কি দরকার?
হানুফা বিবি তাড়াতাড়ি ছোট জাকে ডেকে এনে বললেন, দেখ, রোকসানার মা এখন বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে; কিন্তু তোমরা আবার পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। আর সেও যেন আমাকে দোষ দিতে না পারে, তাই তোমাকে ডেকে আনলাম। হানুফা বিবির ছোট জা রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চলে যাচ্ছ কেন? রোকেয়া বলল, ছোট মা বিশ্বাস করুন, এখানে আমার আর একদণ্ড মন টিকছে। খুব অস্থির লাগছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এরকম হচ্ছে কেন? তোমাকে কি কেউ তাবিজ করেছে?
রোকেয়া বলল, তা আমি বলব কি করে?
হানুফা বিবি বলে উঠলেন, এসব আমার বদনাম করার জন্য বলছে।
চাচি শাশুড়ী হনুফা বিবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যেতে চাচ্ছে যাক। তোমার। বদনাম করে আর কি করবে? ওর তো আর বিয়ে হবে না।
হানুফা বিবি বললেন, না না, এখন যেতে পারবে না। গেলে পাঁচজনের সামনে একেবারে যাবে।
চাচি শাশুড়ী বললেন, বৌ জোর করে গেলে, তুমি কি ধরে রাখতে পারবে?
হানুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, একান্ত যদি যাও, তবে আমার কোনো বদনাম করতে বা দোষ দিতে পারবে না।
চাচি শাশুড়ী বললেন, তুমি বললেই কি আর না বললেই কি? তোমার বদনাম যেমন। হবে, তেমনি সবাই দোষও দিবে। একথা বলে তিনি চলে গেলেন।
রোকেয়া তৈরি হয়েছিল। শাশুড়ীকে সালাম করার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আপনাদের বদনাম বা দোষ কোনোদিন দেব না। সবই আমার তকৃদির। তারপর বসে পায়ে হাত দিতে গেল।
হানুফা বিবি তাকে ঠেলে ফেলে দিলেন।
রোকেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে রোকসানাকে বলল, যাও দাদিকে সালাম কর।
রোকসানা সালাম করতে গেলে হনুফা বিবি তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
রোকসানা বলল, দাদি তো বাথরুমে চলে গেল। সালাম করব কি করে?
রোকেয়া বলল, দাঁড়াও উনি একটু পরে বেরিয়ে আসবেন।
প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে যেতেও যখন হানুফা বিবি বাথরুম থেকে বার হলেন না তখন রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে বাহাদুরের সাথে বাপের বাড়ি চলে গেল।
বাপের বাড়িতে এসে রোকেয়া বাবা-মাকে জানাল, সে আর কখনো শ্বশুর বাড়ি যাবে না।
শাহেদ আলী বললেন, তোকে তো আমি অনেক আগেই সেকথা বলেছিলাম।
মেহেরুন্নেসা বললেন, জামাই এসে যদি নিয়ে যেতে চায়?
শাহেদ আলী বললেন, জামাই যদি রোকেয়াকে নিয়ে অন্য জায়গায় আলাদা সংসার করতে পারে, তাহলে পাঠাব, নচেৎ পাঠাব না। আগে জামাই আসুক, তারপর যা করার করা যাবে।
রোকসানাকে পেয়ে এ বাড়ির সবাই খুশি। কারণ এ বাড়িতে আর কোনো ঘোট ছেলেমেয়ে নেই। জাভেদের শুধু দুটো ছেলেমেয়ে। মনোয়ারা ও মানিক। তারা বড় হয়ে গেছে।
রোকেয়া বাপের বাড়িতে চলে আসার পর স্বামীকে সবকিছু জানিয়ে পত্র দিল।
হারুন পত্র পেয়ে টেলিফোন করে রোকেয়াকে বলল, তুমি যা করেছ, তা ভালোই করেছ। আমি তোমাকে মাঝে মাঝে টেলিফোন করব, পত্র দেব, টাকা-পয়সাও পাঠাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
রোকেয়া বলল, তুমি দেশে আসছ না কেন? যত তাড়াতাড়ি পার কয়েকদিনের জন্য হলেও আস। কতদিন তোমাকে দেখিনি। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
হারুন বলল, তোমাদের জন্য আমারও মন খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোম্পানী কিছুতেই ছুটি দিচ্ছে না। তবু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এবার ছাড়ছি, পত্রে সবকিছু লিখে জানাব। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
এরপর থেকে হারুন মাঝে মাঝে রোকেয়াকে টেলিফোন করে, পত্র দেয় এবং টাকা-পয়সাও পাঠায়। এভাবে দিন, মাস ও বছর গড়িয়ে চলল।
একদিন জুলেখা রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, এবার রোকসানাকে স্কুলে ভর্তি করে দাও।
রোকেয়া বলল, এখন রোকসানা ছোট, আর একটু বড় হোক তখন ভর্তি করব।
জুলেখা শুনল না, সে নিজে রোকসানাকে ভর্তি করে দিল।
.
রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসার কিছুদিন পর থেকে হারুনের ছোট ভাইয়েরা এসে মাঝে মাঝে রোকসানাকে নিয়ে যায়। কয়েকদিন রেখে আবার দিয়েও যায়। এভাবে পাঁচ-ছমাস পরে একবার রোকসানাকে নিয়ে গিয়ে প্রায় পনের বিশ দিন রেখেছিল। রোকেয়া মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। শেষে তার চাচাতো ভাই দুলালকে রোকসানাকে নিয়ে আসার জন্য মুন্সীরহাটে পাঠাল। কিন্তু তারা রোকসানাকে দুলালের সাথে দিল না। বরং তাকে যাতা বলে ফিরিয়ে দিল। কিছুদিন পর রোকেয়া বাহাদুরকে পাঠাল। তাকেও তারা যাতা বলে ফিরিয়ে দিল। এমন কি তাকে রোকসানাকে দেখতেও দিল না। তার উপর বলে দিল, রোকসানা তাদের মেয়ে তাদের কাছে থাকবে। এভাবে একমাস পার হয়ে যেতে মেয়ের জন্য রোকেয়া আরো অস্থির হয়ে পড়ল।
একদিন রোকেয়ার চার নাম্বার দেবর মজিদ রোকসানাকে এক ডাক্তারখানায় বসিয়ে রেখে বাজার করতে গিয়েছিল।
সেই পথ দিয়ে রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ রোকসানাকে ডাক্তারখানায় একা বসে থাকতে দেখে তার কাছে গেল।
রোকসানা মামাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল, মেজ মামা, আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে চল। আমি দাদিদের বাড়িতে আর থাকর না।
বখতিয়ার তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কার সঙ্গে এখানে এসেছ?
রোকসানা বলল, মজিদ চাচুর সঙ্গে। সে বাজারে গেছে।
তখন বখতিয়ার তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এল।
ঘরে এসে রোকসানা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মু, আমি আর দাদিদের বাড়িতে যাব না।
রোকেয়া এতদিন পরে মেয়েকে পেয়ে বুকে চেপে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, না মা আমিও আর তোমাকে সেখানে পাঠাব না।
এদিকে মজিদ বাজার থেকে ফিরে এসে ডাক্তারখানায় রোকসানাকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করল। শেষে না পেয়ে ভাবল, তাহলে ওর মামারা কেউ ওকে একা পেয়ে কি এখান থেকে নিয়ে গেছে? একথা ভেবে রোকসানার মামাদের বাড়িতে গেল। ভাবির কোলে রোকসানাকে দেখে মজিদ বলল, এভাবে চুরি করে আনার কি দরকার ছিল? ঘর থেকে আনতে গেলে আমরা কি মেয়েকে দিতাম না?
রোকেয়া দেবরকে খুশি করার জন্য মাকে বলল, মেজ ভাইয়ের কি কাণ্ড দেখ আম্মা, সে আমার দেবরকে না বলে ডাক্তারখানা থেকে রোকসানাকে নিয়ে চলে এসেছে। আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তো আনতে পারত? তারপর মজিদকে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিল।
কয়েকদিন পরে মজিদ রোকসানাকে নিয়ে যেতে এলে রোকেয়া বলল, তোমরা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আর দিয়ে যাও না। কেউ আনতে গেলে তার সাথেও পাঠাও না। আমি রোকসানাকে আর ওখানে পাঠাব না।
এরপর একদিন হারুনের দুভাই হানিফ ও মজিদ রোকসানাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুলে গেল। কিন্তু সেদিন রোকসানা স্কুলে যায়নি। তাই তারা ফিরে গেল।
সেদিন রোকেয়ার এক চাচাতো বোন এসে বলল, জান আপা, আজ স্কুল থেকে রোকসানাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওর দুই চাচা এসেছিল, রোকসানাকে না পেয়ে ফিরে গেছে।
তারপর থেকে রোকেয়া রোকসানাকে আর স্কুলে পাঠাল না। নিজে তাকে ঘরে পড়াতে লাগল। শুধু পরীক্ষার সময় শাহেদ আলী নিজে নাতনিকে সাথে করে স্কুলে নিয়ে যান নিয়ে আসেন। এভাবে দিন অতিবাহিত হতে লাগল।
.
রোকসানার বয়স এখন সাত বছর। সে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। একদিন দুবাই থেকে হারুনের চিঠি এল। রোকেয়া চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।
প্রিয়তমা আমার,
আমি তোমার বিরহে দিন-রাত অস্থির হয়ে আছি। এই সুদূর বিদেশে কেবলই তোমার শেফালি শুভ্র মুখখানা মনে পড়ে। কয়েকদিন ধরে তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় তোমার চিঠির আশায় প্রহর গুনছিলাম। আজ তোমার প্রেরিত টক-ঝাল-মিষ্টি মেশান চিঠি পেয়ে আমার তৃষ্ণা মিটল। তবে দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? যাক, তুমি ভালো আছ জেনে আমার মরা গাছে যেন ফুল ফুটল। শরীরে ও প্রাণে স্পন্দন জাগল। আর তুমি কি না, আমি তোমাকে ভুলে গেছি বলে অভিযোগ করেছ। সত্যি কি তোমাকে ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব? গ্রহ ছাড়া কি উপগ্রহ থাকতে পারে? তুমি যে আমার মরুদ্যানের সজল মৌসুমী বায়ু। তোমার লক্ষ লক্ষ টন পানি চুষে এ মরুদ্যান সবুজ শ্যামল ফুলে-ফলে ভরপুর হবে। সেই আমি কি করে তোমায় ভুলে থাকব? ছায়া বরং কায়ার মায়ায় বিস্মৃত হয়ে পিছু হটতে পারে, পূর্বদিকে সূর্য না উঠে পশ্চিম দিকে উঠতে পারে, কিন্তু আমি কোনোদিন তোমাকে ভুলতে পারব না। আসলে কি জান রোকা, তোমার কাছে যাওয়ার জন্য আমার মন উন্মাদ হলে কি হবে, যখন সংসারের অশান্তির কথা মনে পড়ে, তখন আর দেশে যেতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না। তবে এবার ঠিক যাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না। মামণি রোকসানার জন্যও আমার মন খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। ওকে আমার আন্তরিক দোয়া ও স্নেহচুম্বন দিও। পরিশেষে আল্লাহপাকের দরবারে তোমাকে ও রোকসানাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরামে রাখার জন্য। দোয়া করছি। সবশেষে তোমার তুলতুলে দুগালে কয়েকটা চুমো দিলাম।
ইতি
হারুন
রোকেয়া হারনের চিঠি পড়ে তার উত্তর লিখল,
ওগো প্রাণ সজনী,
তোমাকে জানাই আমার শতকোটি সালাম ও প্রেম-ভালবাসা। কেমন আছ? নিশ্চয় ভালো? আল্লাহপাকের কাছে আমিও তাই কামনা করি। আজ তোমার উচ্ছ্বাস ও আনন্দ মেশানো চিঠি আমার হস্তগত হল। চিঠিটা পড়ে আমার উষ্ণমনে এক পশলা বৃষ্টি বয়ে এনেছে। নিঃসঙ্গতার বেদনা ও জ্বলন্ত বিরহের মাঝে সেই বৃষ্টি শান্তির ধারা বর্ষিত হয়েছে। ওগো প্রাণপ্রিয় স্বামী, তোমার স্মৃতি ও ভালবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রেরণা জোগাচ্ছে। তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাস জানি, আমি কিন্তু মন-প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালবাসি। তুমি যাদুমাখা চিঠি দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রেখে অভিনয় করে চলেছ। এটা কি স্বামীর কর্তব্য? না এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালবাসার স্বরূপ? আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ আট বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা একত্রে বাস করেছি ছয়-সাত মাস। আর বাকি সময়গুলো বিরহের মধ্যে কেটেছে। কিসের ভয়ে আসছ না? তুমি না পুরুষ? তুমি এসে আমাদের সমস্যাটা সমাধান করে যাও। সবাই যেন সুখে থাকে সে ব্যবস্থা কর। তোমার আম্মা তো আমাকে অপছন্দ করেই। এখন তুমি যদি আমাকে নিয়ে সংসার করতে না চাও, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি চাই তোমাদের সকলের সুখ-শান্তি। সংসারে অশান্তির কারণে তুমি স্ত্রী ও মেয়েকে ফেলে রেখে বিদেশে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে-এটা কখনো হতে পারে না। তুমি ফিরে আস। কপালে যা আছে, তা না হয়ে যাবে না। অদৃষ্টের লিখন কে করিবে খণ্ডন? এদিকে আমার শরীর একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। যাকে বলে জীবন্ত কংকাল। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, রোকসানার কথাও কি তোমার মনে পড়ছে না? সে তোমাকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে কান্নাকাটি করে। তার কথা মনে করে হলেও তোমার একবার দেশে আসা উচিত। বিশেষ আর কি লিখব। আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন তোমায় সুখে রাখেন।
ইয়ি
তোমার অভাগিনী রোকা।
রোকেয়ার শরীর দিনের পর দিন জীর্ণ হয়ে পড়ছে। একে স্বামীর ও সংসারের চিন্তা। তার উপর রোকসানা হওয়ার দুবছর পর থেকে তার পেটে এক ধরনের ব্যথা শুরু হয়েছে। আজ প্রায় ছবছর হতে চলল, প্রতিমাসে একবার করে কয়েক দিন ব্যথাটা হয়। প্রথম তিন দিন তো পেটের ব্যথায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। এমনভাবে পেটে কামড় দেয়, যা সে বলতে পারে না। পায়খানা করতে খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তিন দিন পর পেট ফুলে যায়। পাঁচ-ছদিন পর ভালো হয়ে যায়। এতদিন কত হোমিওপ্যাথিক, এ্যালোপ্যাথিক, কবিরাজী ও হেকিমি চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এখন সেই ব্যথা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
রোকেয়ার বড় বোন রূপার স্বামী বশির কুমিল্লা টাউনে একটা বড় দোকান দিয়েছে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে অসুবিধে হয় বলে সেখানে বাসা ভাড়া করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
একদিন রূপা বাপের বাড়ি বেড়াতে এল। এসে রোকেয়া অবস্থা দেখে বলল, কিরে তোর শরীর যে একদম ভেঙে গেছে। ভালো করে চিকিৎসা করাচ্ছিস না কেন? সে বোনের অসুখের কথা জানে।
রোকেয়া বলল, চিকিৎসা তো কম করাছি না; কোনো উপকারই হচ্ছে না।
রূপা বলল, তোকে এবারে আমি কুমিল্লা নিয়ে যাব। তোর দুলাভাইকে বলে বড় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাব।
রোকেয়া বলল, আমার মনে হয়, এ রোগ আর ভালো হবে না। শুধু শুধু টাকা খরচ করে কোনো লাভ নেই।
রূপা বলল, তোর কথা ঠিক নয়। আল্লাহর হুকুম যতদিন না হয়, ততদিন কারো রোগ ভালো হয় না। ওষুধ খেলেও কাজ হয় না। কারণ ওষুধের উপরও আল্লাহর হুকুম থাকে।
রূপা কয়েকদিন থেকে যাওয়ার সময় জোর করে রোকেয়াকে কুমিল্লা নিয়ে এল। তারপর একজন বড় ডাক্তারের কাছে রোকেয়াকে দেখাল।
ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে তিন মাসের ওষুধ দিয়ে বললেন, এগুলো শেষ করার পর দেখা করবেন। আর দুচারদিনের মধ্যে মাথার, পেটের ও বুকের এক্স-রে এবং রক্ত, প্রস্রাব ও পায়খানা পরীক্ষা করাতে বললেন।
রোকেয়া আপার বাসায় সাত-আট দিন থেকে ডাক্তারের কথামত সবকিছু করিয়ে ডাক্তারকে দেখাল।
ডাক্তার সব রিপোর্ট দেখে বললেন, ঠিক আছে, আপনাকে যে ওষুধগুলো খেতে দিয়েছি, ঐগুলো খেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
রোকেয়া আরো দুদিন থেকে বদরপুর ফিরে এল। তিন মাস ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হল না। তারপর সেই ডাক্তারের কাছে আর যাওয়া হল না। কারণ রূপা চিঠি দিয়ে জানাল, তিনি বিদেশ চলে গেছেন।
.
হারুনের সেজ ভাই হোসেন দুবছর হল বিদেশ গিয়েছিল। এর মধ্যে সে দেশে ফিরল। একদিন হোসেন ভাবি ও ভাইজীকে দেখার জন্য বদরপুর এল।
বাহাদুর সদরে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে বলল, বিয়াই, কেমন আছেন?
হোসেন বলল, ভালো আছি। তোমরা সব ভালো আছ?
বাহাদুর বলল, হ্যাঁ, ভালো আছি। তারপর তাকে সদরে বসতে বলে বলল, আপনি বসুন, আমি মেজ আপাকে ডেকে দিচ্ছি। একথা বলে সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, হোসেন বিয়াই এসেছে। তাকে আমি সদরে বসতে বলেছি।
রোকেয়া রোকসানাকে সঙ্গে নিয়ে সদরে হোসেনের কাছে এল।
হোসেন সালাম দিয়ে বলল, ভাবি কেমন আছ?
রোকেয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি কেমন আছি, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। তোমরা সব কেমন আছ বল।
হোসেন বলল, আমরা ভালো আছি। কিন্তু তোমার শরীর এত ভেঙে গেল কেন?
রোকেয়া ম্লান হেসে বলল, সেকথা তোমার জেনে কোনো লাভ নেই। যার লাভ ছিল সে যখন কোনো খোঁজ-খবর রাখছে না তখন আর বলে কি হবে? যাক,তোমার বড় ভাইয়ার কি খবর? সে দেশে আসছে না কেন?
হোসেন বলল, তা আমি কি করে বলব? বড় ভাইয়ার কথা থাক। আমি তোমাকে ও রোকসানাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি যাবে কিনা বল?
রোকেয়া বলল, আমি যাব না। তুমিও একদিন আমাকে বাপের বাড়ি চলে আসতে বলেছিলে। এখন আবার যেতে বলছ কেন?
হোসেন বলল, আমি তোমার কাছে সে কৈফিয়ত দিতে আসিনি। তুমি যাবে কিনা বল?
রোকেয়া বলল, আমিও তোমাকে সেসব কথা বলতে চাই না। তুমি বলতে বাধ্য করলে, তাই বললাম।
হোসেন বলল, তাহলে তুমি যাবে না?
রোকেয়া বলল, না যাব না।
হোসেন বলল, তাহলে রোকসানাকে নিয়ে যাই।
রোকেয়া বলল, না রোকসানাও যাবে না।
হোসেন বলল, কথা দিচ্ছি, রোকসানাকে কয়েকদিন পরে আমি নিজেই দিয়ে যাব।
রোকেয়া বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।
হোসেন আর কিছু না বলে চলে গেল।
মাসখানেক পর হোসেন আবার একদিন এসে রোকসানাকে দেখে গেল। তার তিন-চার মাস পর বিদেশ যাওয়ার আগের দিন আর একবার রোকসানাকে দেখার জন্য এল। কিন্তু সেদিন রোকসানা বাড়িতে ছিল না। তার নানির সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। তাই হোসেন তাকে দেখতে পেল না।
হোসেন বিদেশে গিয়ে বড় ভাই হারুনকে বলল, আমি রোকসানাকে দেখতে বদরপুর গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবি তাকে দেখা করতে দেয়নি। লুকিয়ে রেখে বলল, সে বেড়াতে গেছে।
কিছুদিন পর হারুন রোকেয়াকে চিঠি দিয়ে বলল, রোকা তুমি কি চিরকাল পাগলামি করবে? হোসেন রোকসানাকে দেখতে গেলে, না দেখিয়ে লুকিয়ে রাখলে কেন?
স্বামীর চিঠি পড়ে রোকেয়ার খুব দুঃখ হল। ভাবল, চিঠিতে কিছু লিখলে ভাববে, আমি সাফাই গাওয়ার জন্য মিথ্যে করে লিখেছি। সে বিদেশ থেকে আসলে রোকসানার মুখ দিয়েই সত্য-মিথ্যা যাচাই করাব। রোকসানা এখন সবকিছু বুঝতে শিখেছে। সে-ই তার বাবাকে বলবে। এসব ভেবে রোকেয়া স্বামীর চিঠির উত্তর দিল না।
হারুন রোকেয়ার কাছ থেকে উত্তর না য়ে আরো দু-তিনখানা চিঠি দিল।
রোকেয়া তবুও উত্তর দিল না। কারণ সে প্রত্যেক চিঠিতে লিখে, আমি আগামী মাসে আসব। অথবা ঈদের পর আসব,না হয় কোরবানীর ঈদের পর আসব। এই আসব আসব করে আজ পাঁচ-ছবছর পার করে দিয়েছে। তবুও আসল না। রোকেয়ার মনে। হল, আসবার কথা লিখে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আসলে সংসারের অশান্তির ভয়ে সে আসবে না।
হানুফা বিবিকে তার সব ছেলেই ভয় করে। ভয় করে না শুধু সেজ ছেলে হোসেন। কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের সময় রোকেয়াকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। বিয়ের পরে হোসেন মাকে বলল, আম্মা, সংসারের ব্যাপারে আমাকে ও আমার বৌকে এবং আমার শ্বশুর বাড়ির কাউকে ভালো-মন্দ কোনোকিছু বলবে না। যেদিন : বলবে, সেদিন তুলকালাম কাণ্ড করে ছাড়ব। সেই ভয়ে হনুফা বিবি তেমন বেশি কিছু না বললেও মাঝে-মধ্যে বৌকে বকাঝকা করতে ছাড়েননি। ঐ যে লোকে বলে, ইজ্জত যায় না ধুলে, আর স্বভাব যায় না মরলে।
.
রোকসানা একদিন মাকে বলল, আম্মু, আমার আব্ব কোথায়? আমি তাকে কোনোদিন দেখিনি।
রোকেয়া বলল, মামণি, তোমার আব্ব বিদেশ গেছে। তুমি তখন ছোট ছিলে। তিনি তোমার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় ও কত খেলনা নিয়ে আসবেন।
রোকসানা বলল, আমার অনেক জামা-কাপড় আছে আর লাগবে না। তুমি আব্বকে আসতে বল। সব ছেলেমেয়েরা তাদের আল্লুকে আব্ব বলে ডাকে। আমারও ডাকতে ইচ্ছে হয়।
রোকেয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, ঠিক আছে, আমি চিঠিতে তোমার কথা লিখে তাকে তাড়াতাড়ি চলে আসবে বলব।
রোকেয়ার চাচাতো ভাইয়ের তুষার নামে একটা সাত-আট মাসের ছেলে আছে। রোকসানা তাকে নিয়ে সারাদিন থাকে। একদিন সে তার মাকে বলল, আম্মু, তুষারের মত একটা ভাইয়া আমাকে এনে দেবে। আমি তাকে নিয়ে খেলা করব।
রোকেয়া বলল, তোমার ঐরকম ভাইয়া কিনতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। অত টাকা আমার কাছে নেই।
রোকসানা বলল, তুমি আল্লুকে চিঠি দিয়ে অনেক টাকা পাঠাতে বল। আব্ব টাকা পাঠালে ঐরকম ভাইয়া কিনে নিয়ে আসবে।
রোকেয়া বলল, তাই হবে।
রোকসানা আবার বলল, আচ্ছা আম্মু, তোমার বাচ্চা হয়নি কেন? তুষারের মত একটা বাচ্চা হলে তাকে আমি কত আদর করতাম। সে আমাকে আপা বলে ডাকত, তাই না আম্মু?
মেয়ের কথা শুনে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। তাকে বুকে চেপে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আল্লাহ দেননি, তাই হয়নি। আল্লাহ যখন দেবেন, তখন তুমি আদর করো কেমন!
রোকসানা মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।
.