কি পেলাম – ৭

০৭.

হারুন দুবাই পৌঁছে রোকেয়াকে চিঠি দিল।

রোকেয়া চিঠি পেয়ে পড়তে লাগল

ওগো আমার প্রাণহরিণী,

কোন সুদূরে আছ তুমি? প্রথমেই তোমাকে জানাই আন্তরিক দোয়া ও ভালবাসা। আর তোমার নরম ঠোঁটে আমার গরম চুমো পাঠালাম। ঠাণ্ডা হতে দিও, কিন্তু তাড়াতাড়ি নিও। পরে স্নেহের পুতলী রোকসানাকে স্নেহ চুম্বন দিও। রোকা, সেদিন তোমাকে একা ফেলে রেখে আসতে আমার খুব খষ্ট হয়েছে। কেবলই মনে হচ্ছে, বিয়ের পর থেকে তোমাকে এতটুকু সুখ শান্তি দিতে পারি নি। শুধু দুঃখ দিয়েই চলেছি। শোন রোকা, আম্মা কিছু বললেই তুমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দাও, এটা ঠিক নয়। লক্ষীটি খাওয়া। নিয়ে রাগ করো না। কারণ একদিকে যেমন তোমার শরীর নষ্ট হবে, অপরদিকে কেউ তোমাকে খেতে বলবে না। আমার কথা ভেবে শরীরের যত্ন নিও। আল্লাহপাকের কাছে কামনা করি, তুমি সুখে থাক, শান্তিতে থাক। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করো। রোকসানাকে চোখে চোখে রাখবে। পরিশেষে আল্লাহপাকের দরবারে তোমার কুশল কামনা করে এবং তোমার চিঠির আশায় থেকে শেষ করছি।

তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী
হারুন।

চিঠি পড়ে রোকেয়ার মন বেদনায় ভরে গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চিন্তা করল, হারুন তুমি শুধু আমার রাগটা দেখলে; কিন্তু কেন রাগ করি সেটা জেনেও তার বিহিত করে গেলে না। তোমার মা যে উঠতে বসতে ঝগড়া করে, গালাগালি করে, মিথ্যে বদনাম দেয়, সে সব নিজের চোখে দেখে শুনেও আমাকে এখানে রেখে গেলে। আমি যে কি হালে এখানে থাকি তাও তুমি জান। তবু তার কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা করে গেলে না। এই সব চিন্তা করে রোকেয়া এখানকার ভালো-মন্দ খবর জানিয়ে সাদামাটা একটা চিঠি লিখে স্বামীর পত্রের উত্তর দিল।

এবারে হারুন চলে যাওয়ার পনের বিশ দিন পর একদিন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই এবার বাপের বাড়ি চলে যা। তোর জন্য আমার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তোর পাপের জন্য আমার ছেলেদের অসুখ লেগেই আছে, নচেৎ তাদেরকে বাঁচাতে পারব না। তুই আমার সংসার নষ্ট করেছিস। যা যা চলে যা, আর থাকিস না। এরকমভাবে প্রায় প্রতিদিন বলতে লাগলেন। আর একদিন বললেন, তোকে এত করে চলে যেতে বলি, যাস না কেন? তোর বাপ ভাই বোধহয় তোকে খাওয়াতে পারবে না। তাই বুঝি যেতে চাস না।

রোকেয়া প্রতিদিন শাশুড়ীর মুখে একই কথা শুনে স্বামীর উপদেশের কথা ভেবে এতদিন সহ্য করে আসছিল। কিন্তু আজ তাকে বাপ মা তুলে কথা বলতে শুনে আর সহ্য করতে পারল না। বলল, আম্মা, কেউ কাউকেই খাওয়াতে পারে না। খাওয়াবার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই সকল প্রাণীর রেযেকদাতা।

হানুফা বিবি রেগে গিয়ে তার একটা হাত ধরে গেটের বাইরে বের করে দিয়ে গেট বন্ধ করে বললেন, যা চলে যা, আর আসবি না।

রোকেয়া গেটের বাইরে বসে বসে কাঁদতে লাগল।

শেষে প্রায় ঘন্টা দুই পর রোকসানা যখন মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করতে লাগল তখন বদরুদ্দিন বৌমাকে ঘরে নিয়ে এলেন

দুতিন দিন পর রোকেয়া চাচি শাশুড়ীদের ও চাচাতো জায়েদের ডেকে বলল, আমার শাশুড়ী সব সময় আমাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে বলেন, তবু আমি যাইনি। দুদিন আগে যে আমাকে উনি ঘর তেকে বের করে দিয়েছিলেন, আপনারাও জানেন? এখন আপনারাই বলুন আমি কি করব?

তাদের মধ্যে কেউ বললেন, আমরা কিছু বলতে পারব না। আবার কেউ বললেন, তোমার শাশুড়ী বললেও যাওয়া ঠিক হবে না। শুধু এক চাচাতো জা বলল, তুমি তোমার স্বামীর কাছে চিঠি দিয়ে জেনে নাও।

এর কয়েকদিন পর রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে একাই বাপের বাড়ি এল। তারপর মা বাবাকে বলল, আমি আর শ্বশুরবাড়ি যাব না। কারণ আজ দুবছর ধরে আমার শাশুড়ী আমাকে চলে আসতে বলছে। এমন কি একদিন ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।

সেদিন রোকেয়ার নানি রহিমন বিবিও মেয়ের বাড়ি এসেছেন। তিনি নাতনির কথা শুনে বললেন, তোর এখানে থাকা চলবে না। কয়েকদিন বেড়িয়ে চলে যা। আর কখনো হুট করে চলে আসবি না। তোর শাশুড়ী যতই তোকে বের করে দিক, তবু আসবি না। তুই দুয়ারে বসে থাকবি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, শাশুড়ী বের করে দিয়েছে।

রোকেয়ার বাবা শাহেদ আলী বললেন, এবার যখন তোর শাশুড়ী চলে আসতে। বলবে তখন তাকে বলবি, আমার বাবাকে ডেকে এনে তারপর যেতে বলবেন।

সপ্তাহখানেক পর লোকের মুখে শাহেদ আলী খবর পেলেন, রোকেয়ার শাশুড়ীর কঠিন অসুখ। সে কথা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে রোকেয়াকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

রোকেয়া চিন্তা করে রেখেছিল, হারুন বিদেশ থেকে ফিরে এসে নিয়ে না গেলে সেখানে যাবে না। কিন্তু মা বাবা যখন পাঠাতে চাইলেন তখন নিরুপায় হয়ে চলে এল। এসে দেখল, শাশুড়ীর ভীষণ অসুখ। চলাফেরা করতে পারেন না। রোকেয়া সংসারের সব কাজ করার সাথে সাথে শাশুড়ীর সেবা যত্ন করতে লাগল। অসুখ আরো বেড়ে যেতে হনুফা বিবিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু হাঁটা চলা করতে পারছেন না। তাকে ওষুধ খাওয়ান, গোসল করান ও ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, সব কিছু রোকেয়াকে করতে হচ্ছে।

মায়ের অসুখের কথা চিঠিতে জানতে পেরে হারুনের মেজভাই শামসু বিদেশ থেকে বাড়ি এল। যখন শামসু বাড়িতে ঢুকল তখন রোকেয়া শাশুড়ীকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরতে এলে হানুফা বিবি বৌয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, তোকে ধরতে হবে না, আমি যেতে পারি। তারপর তিনি বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শামসুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রোকেয়া শামসুকে আসতে দেখেনি। শাশুড়ীর দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে দেখল, শামসু আসছে। তখন সে বুঝতে পারল, কেন শাশুড়ী তাকে ধরতে দিল না। শামসুকে জানাতে চান, বৌ আমার সেবা যত্ন করে নি। এখন তাকে দেখে অভিনয় করছি। ততক্ষণে শামসু মাকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আম্মা, এখন তুমি কেমন আছ? তোমার অসুখের কথা জেনে চলে এলাম।

হানুফা বিবি ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, এখন একটু ভালো আছি। তুই ঘরে যা, আমি বাথরুম থেকে আসছি। তারপর আস্তে আস্তে বাথরুমে গেলেন।

শামসু এবার রোকেয়াকে বলল, ভাবি কেমন আছ?

রোকেয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি।

শামসু জিজ্ঞেস করল, রোকসানা কোথায়?

রোকেয়া বলল, রুমে ঘুমোচ্ছে। তা তোমার ভাইয়া কেমন আছে?

শামসু হেসে উঠে বলল, ভাইয়া ভালো আছে। তোমার জন্য সন্দেশ পাঠিয়েছে। তারপর ব্যাগ খুলে মুখ আঁটা একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিল।

রোকেয়া চিঠিটা নিয়ে রুমে এসে পড়তে লাগল।

প্রিয়তমা রোকা,

পত্রে আমার আন্তরিক সবকিছু নিও। রোকসানাকে আমার আন্তরিক দোয়া ও স্নেহাশীষ দিও। আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি। তবে তোমার কথা ভেবে ভেবে বড় অশান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আল্লাহ কবে যে তোমাদের কাছে নিয়ে যাবেন, সে কথা তিনিই জানেন। তুমি ও রোকসানা কেমন আছ জানাবে। অনেক দিন তোমার পত্র না পেয়ে চিন্তিত আছি। পত্র দিয়ে চিন্তা দূর করো। আল্লাহপাকের দরবারে আমার জন্য দোয়া করো। আমি তাঁর দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করছি। আজ এই পর্যন্ত থাক। বেশি কিছু লিখতে মন চাইছে না। কারণ শামসু বাড়ি যাচ্ছে, আমারও যাওয়ার জন্য মন খুব ছটফট করছে। কিন্তু ছুটি পেলাম না বলে যেতে পারলাম না। তোমার নরম গালে ও ঠোঁটে কয়েকটা চুমো পাঠালাম, গ্রহণ করে এই হতভাগাকে ধন্য করো। আর পত্রে আমার জন্য তুমিও কিছু পাঠিও। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি
তোমার হারুন।

এমন সময় রোকসানা ঘুম থেকে উঠে আম্মা আম্মা বলে কেঁদে উঠতে রোকেয়া চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে রোকসানাকে কোলে তুলে নিল।

.

এবারে শামসু এসে বিয়ে করার কথা জানাল।

হানুফা বিবি মেয়ের সন্ধান নিয়ে একদিন শামসুকে বললেন, তোর ভাবিকে নিয়ে মেয়ে দেখে আয়।

শামসু বলল, ভাবির যাওয়ার দরকার নেই। আমি প্রথমে একা দেখে আসি। তারপর ভাবিসহ সবাই দেখে আসবে।

হানুফা বিবি তার কথা শুনলেন না। বৌকে ডেকে বললেন, তুই শামসুর সঙ্গে গিয়ে মেয়ে দেখে আয়।

রোকেয়া রান্নাঘর থেকে তাদের কথা শুনেছে। তাই বলল, যে বিয়ে করবে সে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না, আমি যাব কি করে?

শামসু ততক্ষণে মেয়ে দেখতে চলে গেছে। তাই তখন হনুফা বিবি আর কিছু বললেন না। একদিন হনুফা বিবি বাড়ির সকলের সামনে বললেন, রোকসানার মায়ের মতো মেয়ে এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তাকে কত করে বললাম মেয়ে দেখতে যেতে, সে দেমাগ করে গেল না। আমরা জানি, ভাবিরাই মেয়ে দেখে দেবরদের বিয়ে দেয়। আমাদের বৌটার পেটে খুব হিংসা।

রোকেয়া চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, আম্মা, আপনি যুক্তি ছাড়া কথা। বলেন। আপনি মেয়ে দেখতে যেতে বললেন, আর মেজভাই বলল, সে আগে একা মেয়ে দেখে পছন্দ হলে পরে আমরা যাব। তাহলে কেমন করে যাই আপনারাই বলুন।

হানুফা বিবি রেগে উঠে বললেন, আমাকে কি তুই এতই বোকা পেয়েছিস? আমি কি কিছু বুঝি না। তোর যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে শামসুর সঙ্গে জোর করে যেতে পারতিস।

 রোকেয়া শাশুড়ীকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু বলল না।

শামসু মেয়ে দেখে এসে পছন্দ হয়েছে বলার পর একদিন সবাই মিলে গিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে এল। কিন্তু রোকেয়াকে কেউ যেতে বলেনি বলে সে গেল না। কয়েকদিন পর রোকেয়া একদিন শামসুর ঘর পরিষ্কার করছিল। হনুফা বিবি সেখানে এসে ঝংকার দিয়ে বললেন, তোকে কে এসব করতে বলেছে? জা আসবে সেই হিংসাতে তাকে দেখতে গেলি না। এখন আবার তার ঘর পরিষ্কার করছিস। তারপর রোকেয়ার একটা হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিলেন।

রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেখান থেকে চলে এল।

বিয়ের দিন শামসু বৌ নিয়ে এলে বৌয়ের এবং তার সঙ্গে যারা এসেছে তাদের আদর আপ্যায়ন দেখে রোকেয়ার নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন তার ও তার সঙ্গে যারা এসেছিল তাদেরকে কি রকম আদর আপ্যায়ন করেছিল, আর এদের কি রকম আদর আপ্যায়ন করা হচ্ছে। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় রোকেয়ার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।

শামসুর বৌ সায়লা খুব ভালো মেয়ে। দেখতে শুনতে যেমন, আচার ব্যবহারও তেমনি। দুএকদিনের মধ্যে রোকেয়ার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করল। দুজায়ে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজকর্ম করতে লাগল।

একদিন শায়লা রোকেয়াকে বলল, তুমি আগে মরলে, তোমার পাশে আমার কবর দিতে বলব।

রোকেয়া মনে মনে খুব খুশি হয়ে ভাবল, আল্লাহ বুঝি এবার তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। জা যখন মনের মত হয়েছে তখন শাশুড়ী আর বেশি কিছু বলতে পারবে না। বলল, মরণ বাচনের কথা আল্লাহ জানেন।

মেজ জাকে নিয়ে রোকেয়া বেশ আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাতে লাগল। শাশুড়ী আর সংসারের দিকে ফিরেও তাকাননি। যা কিছু দুজায়ে মিলেমিশে করে। মাঝে মাঝে এক জা অন্য জাকে নিয়ে তাদের বাপের বাড়ি থেকে দুচার দিন করে বেড়িয়ে আসে।

কিন্তু যার তকদির খারাপ, তার কেউ ভালো করতে পারে না। কিছুদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পর হানুফা বিবি দুবৌয়ের মধ্যে এত মিলমিশ সহ্য করতে পারলেন না। মেজ বৌ শায়লার কাছে বড় বৌ রোকেয়ার অনেক বদনাম করতে শুরু করলেন।

শাশুড়ী যখন একদিন শায়লার কাছে রোকেয়ার নানারকম বদনাম করলেন, তখন সে চুপ করে শুনলো। তারপর সময় মতো রোকেয়ার কাছে এসে বলল, বুবু, আম্মা আজ আমার কাছে তোমার অনেক বদনাম করলেন। আমি সেসব বিশ্বাস করিনি। আমি জানি, সব মিথ্যে কথা। আসলে উনি আমাদের দুজনের মিল সুনজরে দেখতে পারছেন না এবং সহ্যও করতে পারছেন না। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আম্মা যা কিছু বলুক না কেন, আমরা দুজনে তার কথায় কান দেব না।

রোকেয়া বলল, আমি তোমার মতই একটা বোন চেয়েছিলাম! আল্লাহ মিলিয়েও দিয়েছেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাই।

এদিকে সবার অলক্ষ্যে রোকেয়ার ভাগ্য হাসছে। দুজায়ের এত ভাব থাকা সত্বেও এ সুখ শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হল না।

একদিন হানুফা বিবি শায়লাকে গোপনে বললেন, মেজ বৌ, রোকসানার মায়ের সাথে বেশি মেলামেশা করো না। তুমি এখন নতুন। তাকে চিনতে পারনি। সে খুব জঘন্য ধরনের মেয়ে। তোমার ভাসুরকে কতবার মেরেছে। তোমার ভাসুর খুব ভালো। বৌ ছেড়ে দিলে বংশের বদনাম হবে, তাই ওকে নিয়ে ঘর করছে। ওর সঙ্গে মিশলে তুমিও খারাপ হয়ে যাবে।

শায়লা শাশুড়ীর কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, আম্মা, এ আপনি কি বলছেন? মেয়ে মানুষ যতই খারাপ হোক, সে কোনোদিন স্বামীর গায়ে হাত তুলতে পারে না।

হানুফা বিবি বললেন, আমিও তো তাই জানতাম। কিন্তু রোকসানার মা খুব ছোট ঘরের মেয়ে। তার স্বভাব-চরিত্র আর কত ভালো হবে? তা না হলে স্বামীর গায়ে হাত তুলে! তাই তো তোমাকে সাবধান করে দিলাম।

শায়লা শাশুড়ীর কথা বিশ্বাস করতে পারল না। একসময় রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করল, বুবু, তুমি নাকি রোকসানার আব্বাকে মারধর কর?

রোকেয়া বলল, সেকথা পরে বলছি; আগে বল কার কাছে শুনেছ?

 আম্মার কাছে।

রোকেয়া রসিকতা করার জন্য হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ,শায়লা করি। রোকসানার বাবা একটু অশিক্ষিত ছিল। তাই মারধর করে কিছু শিক্ষা দিয়েছি।

শায়লাও হেসে উঠে বলল, ধ্যাৎ, তুমি ইয়ার্কি করছ। আম্মা যখন বললেন, তখন যেমন বিশ্বাস করিনি, এখন তোমার কথাও তেমনি বিশ্বাস করিনি।

রোকেয়া হাসি থামিয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, কিছু বুঝতে পারছ?

শায়লা বলল, কি বুঝব বুবু?

রোকেয়া বলল, সেদিন তুমি বললে না, আমাদের দুজনের মিলমিশ আম্মা সহ্য করতে পারছেন না?

শায়লা বলল, হ্যাঁ, তা তো বলেছিলাম। কারণ তখন আমি তাই বুঝেছিলাম।

রোকেয়া বলল, তাহলে এখনো বোঝা উচিত ছিল, সেই মিলমিশ ছাড়াবার জন্য গুটির চাল চালাচ্ছেন।

শায়লা বলল, বুবু, তুমি ঠিক কথা বলেছ। এখন আমি বুঝতে পারলাম।

এর কিছুদিন পর হারুনের সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের খা হল। ধোয়ানীর দিন খুব বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথমে মিলাদ মাহফিল হবে। তারপর মেহমানদের খাওয়ান হবে।

রোকেয়া তখন বাপের বাড়িতে ছিল। শামসু একদিন দাওয়াত করতে এলে রোকেয়া তার সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করার পর আপ্যায়ন করাল।

আপ্যায়নের পর শামসু বলল, ভাবি, তালই সাহেব কি বাড়িতে নেই?

রোকেয়া বলল, সকালে মামা এসেছিল, আব্বা তার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। কোথায়, গেছে বলে যায়নি।

শামসু বলল, তাহলে মাওই সাহেবকে একটু ডেকে দাও।

রোকেয়া মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তোমাকে আমার মেজ দেবর ডাকছে। মেহেরুন্নেসা মেয়ের সঙ্গে শামসুর কাছে এসে তাদের বাড়ির ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেন।

শামসু সে সবের উত্তর দেওয়ার পর ছোট ভাইয়ের খানার অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

রোকেয়ার ছোট বোন জুলেখা সেখানে ছিল। শামসু চলে যাওয়ার পর রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, তোমার দেবর কই তোমাকে কিছু বলল না যে? তুমি কি যাবে?

রোকেয়া বলল, ভেবে দেখি কি করা যায়। তারপর চিন্তা করতে লাগল, আব্বা তো যাবেই না, কাউকে যেতেও দেবে না। আরো চিন্তা করল, আমার শাশুড়ী না হয় আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি; কিন্তু শায়লা শামসুর হাতে যাওয়ার কথা বলে দিল না কেন? আর শামসু নিজেও তো সেকথা বলতে পারত? ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, সে যাবে।

অনুষ্ঠানের দিন মা-বাবাকে বলে সে একটা স্কুটার করে শ্বশুর বাড়ি এল।

 বাড়িতে পৌঁছাতেই হানুফা বিবি বললেন, তোকে তো আসতে বলিনি, তবু তুই এলি কেন? তোর মা-বাপকে দাওয়াত দিতে শামসুকে পাঠিয়েছিলাম। কিছু দেওয়ার ভয়ে বুঝি তারা না এসে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছে?

বাড়ি ভরা মেহমানদের সামনে শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া অপমানে ও লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মাথা হেট করে নিজের রুমে চলে গেল। রুমের ভেতর থেকে শুনতে পেল, শ্বাশুড়ী মেহমানদের বলছেন, আমার এ বৌটা খুব অপয়া। তাই এমন শুভ অনুষ্ঠান করার আগে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বেয়াই-বেয়ানকে দাওয়াত না দিলে লোকে মন্দ বলবে বলে তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। তারা গরিব, খালি হাতে কি করে বড় লোকের অনুষ্ঠানে আসবে, তাই মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে।

শাশুড়ীর মুখে মেহমানদেরকে এসব কথা বলতে শুনে রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহকে জানাল, ইয়া আল্লাহ, এসব শোনার আগে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলে না কেন? তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে রোকেয়া সংসারের কাজে লেগে গেল।

অনুষ্ঠানের সময় যখন ছবি তোলা হচ্ছিল তখন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই এখান থেকে চলে যা, এদের সঙ্গে তোর ছবি তোলা যাবে না। এদের সঙ্গে ছবি তুললে সব নষ্ট হয়ে যাবে।

সমস্ত লোকজন ও মেহমানদের সামনে শাশুড়ীর কথা শুনে লজ্জায় ও মনের কষ্টে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। সে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না। এরকম ছুটে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। সারাদিন আর ঘর থেকে বের হল না। ভাবল, শায়লাও কি তাদের দলে ভিড়ে গেল? তা না হলে সে আমার হয়ে কিছু বলল না কেন?

অনুষ্ঠানের পরের দিন থেকে হানুফা বিবি রোকেয়াকে বাপের বাড়ি চল যাওয়ার জন্য বার বার তাগিদ দিতে লাগলেন।

একদিন রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার বোনের বাড়ি এল। তার সামনে হানুফা বিবি রোকেয়ার হাত ধরে বের করে দেওয়ার সময় বললেন, যা এক্ষুণি তুই তোর ভাইয়ের সঙ্গে চলে যা। এখানে থাকলে তুই মেজ বৌকেও খারাপ করে ফেলবি। আজ তিন বছর ধরে তোকে চলে যেতে বলছি এবং কতবার ঘর থেকে বের করেও দিয়েছি, তবুও তুই যাসনি কেন?

 বখতিয়ার এবছর বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছে। সে এর আগে মাত্র একবার এখানে এসে ঘণ্টাখানেক থেকে চলে গিয়েছিল। আজ দ্বিতীয় বার এসেছে। রোকেয়ার শাশুড়ী সম্পর্কে অনেক ভালো-মন্দ কথা সে শুনেছিল। এখন তার সামনেই বোনকে এরকম করতে ও বলতে দেখে যেমন অবাক হল তেমনি খুব রেগেও গেল। বলল, মাওই আম্মা, আপনি মানুষ না অন্য কিছু? তারপর রোকেয়াকে বলল, যা তোর মেয়েকে নিয়ে আয়। এক্ষুনি তোদেরকে নিয়ে যাব। তুই তোর শাশুড়ীর এত অত্যাচার সহ্য করে আছিস কি করে? শিগগির যা করতে বললাম কর।

হানুফা বিবি বখতিয়ারের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়লেন। এতদিন কোথায় ছিলে গো নবাবের বাচ্চা, বোনের হয়ে দরদ দেখাতে এসেছ। যাও নিয়ে যাও তোমার বোনকে। আর যেন এখানে না আসে। আমরা আমাদের ছেলের আবার বিয়ে দেব। মনে করেছ, তোমার বোন চলে গেলে আমরা ছেলের আর বিয়ে দিতে পারব না?

বখতিয়ার কিছু বলতে যাচ্ছিল, রোকেয়া শাশুড়ীর হাত থেকে নিজের হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে বখতিয়ারের দুপা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মেজ ভাই, তোমার পায়ে ধরে বলছি, তুমি এখান থেকে যাও; আমি যাব না। এটা আমার স্বামীর ঘর। উনি আমার শাশুড়ী। ওঁকে কিছু বলার অধিকার তোমার নেই। আমাকে এরা তাড়িয়ে দিলেও আমি স্বামীর ঘর ছেড়ে যাব না। তুমি চলে যাও মেজ ভাই, চলে যাও। তারপর সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

বখতিয়ার বোনের ওপর রেগে গিয়ে বলল, তবে তুই এখানে পড়ে পড়ে মর, আমি চললাম। একথা বলে সে হন হন করে চলে গেল।

বাড়িতে এসে বখতিয়ার বাবা-মাকে রোকেয়ার শ্বশুর বাড়ির সব ঘটনা খুলে বলে বলল, তোমরা এমন ছোটলোকের বাড়িতে রেকের বিয়ে দিয়েছ, যেখানে সে জীবনে কোনোদিন সুখ-শান্তির মুখ দেখতে পাবে না। বাবারে বাবা, ওর শাশুড়ী যে এত জঘন্য মেয়ে যা দেখা তো দূরের কথা, কারো মুখে কোনোদিন শুনিনি।

ছেলের কথা শুনে মেহেরুন্নেসা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বিয়েটা তখন ভেঙে গিয়ে ভালোই হয়েছিল, কিন্তু….।

ভারাক্রান্ত মুখে শাহেদ আলী স্ত্রীর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি তকদিরে যা রেখেছেন তা হবেই। সেখানে কারো কিছু করার নেই।

এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর শায়লার কোল আলো করে একটা ছেলে হল।

একদিন ঘরে তরিতরকারী কম ছিল। তাই রোকেয়া শাশুড়ীকে সেগুলো দেখিয়ে বলল, আজ ঘরে যা আছে তা দিয়ে চালিয়ে দিই আম্মা? কাল না হয় বাজারে পাঠাবেন।

হানুফা বিবি বললেন, বাবারে বাবা, এটা কোনোদিন আমরা পারব না। তোর বাপেরা গরিব। তোদের অভ্যাস আছে, তোরা করতে পারিস।

রোকেয়া মনে কষ্ট পেয়ে চুপ করে রইল।

যেদিন রোকেয়ার মেজ দেবরের ছেলের আকীকার অনুষ্ঠান হবে, সেদিন হঠাৎ করে হারুনের নানি সখিনা বিবি বললেন, আমি বাড়ি চলে যাব। উনি আগের থেকে এখানে আছেন।

হানুফা বিবি বললেন, কেন আম্মা, তুমি চলে যেতে চাচ্ছ? আজ শামসুর ছেলের আকীকার অনুষ্ঠান?

সখিনা বিবি রসিকতা করার জন্য বললেন, এখানে আর ভালো লাগছে না। তোদের বৌগুলো আমার সাথে কথা বলে না।

হানুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, কোন বৌ তোমার সঙ্গে কথা বলে না?

 সখিনা বিবির মুখ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে এল, রোকসানার আম্মা।

হানুফা বিবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, আমি আগেই জানতাম। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন এলেই রোকসানার মা রিশ করে মুখ ভার করে থাকে। তারপর রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বল, তুই এমন করিস কেন? আমার আত্মীয়-স্বজনরা কি তোর বাপের খানা খায়? বল মাগী চুপ করে থাকিস না। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।

সেখানে হানুফা বিবির এক চাচাতো জা ছিলেন। তিনি হানুফা বিবিকে বললেন, এসব তুমি কি বলছ হারুনের মা? তোমার আত্মীয়-স্বজন এলে রোকসানার মাকে তো কোনোদিন মুখ ভার করতে আমরা দেখিনি। এসব কথা তোমার মুখে সাজে না।

হানুফা বিবি বললেন, তোমরা আমার ঘরের খবর জানবে কি করে? যার যার ঘরের খবর সে-ই জানবে। তোমরা চুপ করে থাক। তারপর রোকেয়াকে বললেন, যা এবার তুই এখান থেকে চলে যা। আর তোকে আমি খাওয়াতে পারব না। তোর স্বামী আর টাকা পাঠায় না। তোদের মা-বেটির জন্য চুরি করতে যাব নাকি? যা, যা, চলে যা। এত বলি তবু যাস না কেন? তোর জন্য আমার মেজ বৌটাও খারাপ হয়ে গেল। তুই-ই তাকে খারাপ করেছিস? তোর জন্য আমার সোনার সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তুই যাবি কি না বল? এই বলে রোকেয়ার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন।

রোকেয়া এতদিন স্বামীর কথা স্মরণ করে শাশুড়ীর শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনাসহ্য করে আসছিল। আজ আর পারল না। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আম্মা, আপনি আমাকে সব সময় যাতা বলে গালাগালি করেন। এমনকি আমার বাবা-মাকেও করেন। আমি অন্যায় না করলেও মিথ্যে অপবাদ দিয়ে গালাগালি করেন। কোনোদিন আমি প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আজ আর আমি চুপ করে থাকব না। আপনাকে বলতেই হবে, কেন আপনি শুধু শুধু আমার ওপর এত অত্যাচার করেন? আমার কি এমন অপরাধ?

হানুফা বিবি এমনি রেগে ছিলেন। তার উপর বৌয়ের সাহস দেখে আরো রেগে গিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন, তুই কে যে, তোর কথার উত্তর দিতে হবে? তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোকে আমার ভালো লাগে না। আর কোনোদিন লাগবে না। তোর পায়খানা দেখতে ইচ্ছা হয়, তবু তোর মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না। এখন তুই আর কোনো কথা না বলে চলে যা। তোর ও তোর মেয়ের পেছনে কি কম টাকা খরচ হয়? আমাদের এতগুলোর চেয়ে তোদের মা-বেটির পেছনে বেশি খরচ হয়।

শাশুড়ী বৌয়ের মধ্যে যখন এসব কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে সখিনা বিবি, শায়লা, বদরুদ্দিন ও বাড়ির অন্যান্য সবাই এবং আশপাশের বাড়ির হারুনের কয়েকজন চাচি ও তাদের বৌয়েরা ছিলেন।

এত লোকের সামনে রোকেয়া অপমানিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল। বলল, আম্মা, আপনি আজ তিন বছর ধরে চলে যেতে বলছেন; কিন্তু কেন আমি যাব? আমি কি প্রেম করে আপনার ছেলেকে ভুলিয়ে বিয়ে করেছি? না পালিয়ে এসে তার সাথে বিয়ে বসেছি? যার জন্য এত জ্বালাচ্ছেন। মনে রাখবেন, আপনি যেমন পরের ঘরে এসেছেন, আমিও তেমনি পরের ঘরে এসেছি। এ ঘর যেমন আপনার বাবার নয়, তেমনি আমার বাবারও নয়। এটা যেমন আপনার স্বামীর ঘর, তেমনি আমারও স্বামীর ঘর। এখানে আপনার যেমন অধিকার আছে, তেমনি আমারও আছে। আমার অসুখের সময় আমার আম্মা একদিন আমাকে দেখতে এসেছিল। তার আগে-পরে কোনোদিন আসেনি। সেদিন এদিকে এক ডাক্তারের কাছে এসে আমার অসুখের কথা শুনে দেখতে এসেছিল। ঐদিন ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যাওয়ার পর আপনি বললেন, তোর মায়ের অসুখ বলল, নচেৎ ঝুটি ধরে কাজে লাগিয়ে দিতাম। সেদিন কেন আমার আম্মাকে এত বড় কথা বলেছিলেন? সে কি আপনার খায়, না পরে। আপনি পেয়েছেন কি? যেতে বললেই আমি চলে যাব? যাব না, দেখি আপনি কি করতে পারেন?

হানুফা বিবি কোনোদিন রোকেয়াকে রা করতে দেখেননি। আজ এত কথা বলতে শুনে বেশ একটু দমে গেলেন। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, যাবি কি করে? বাপ-ভাই খাওয়াতে পারলে তো যাবি? তারপর কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললেন, এখন বল, আমার বুড়ো মা এলে রিশ করে মুখ ভার করে থাকিস কেন? এটা তো আর মিথ্যে না? সকলের সামনেই আম্মা বলল!

তখন রমযান মাস। রোকেয়া নানি শাশুড়ির দুহাত ধরে বলল, নানি আপনি রোযা মুখে বলুন, আমি আপনার প্রতি রিশ করে মুখ ভার করে থাকি কি না?

একথা শুনে সখিনা বিবি কেঁদে ফেললেন। বললেন, নাতবৌ হিসেবে আমি তোমাকে নিয়ে একটু ঠাট্টা করেছি। আর সেই কথা নিয়ে তোমার শাশুড়ী এমন করবে ভাবতেই পারিনি। তাকে বোঝালেও বোঝে না। বাবা আর আমি কোনোদিন এখানে। আসব না! একথা বলে তিনি চলে যেতে চাইলেন।

রোকেয়া চিন্তা করল, এখন যদি নানি চলে যান, তাহলে শাশুড়ী তার উপর আরো জুলুম করবে। তাই সে নানির হাতে-পায়ে ধরে যেতে দিল না।

পরের দিন রোকেয়া হারুনকে চিঠি দিল। চিঠিতে বাড়ির বিস্তারিত সবকিছু লেখার পর আরো লিখল, তোমার বাড়ি আর এক মুহূর্তে থাকতে আমার ইচ্ছা হয় না। তবে তুমি যদি বল, তোমার মেজ ভাইয়ের বৌয়ের দাসীগিরী করে খেতে, তাহলে তাই হয়ে খাব। নচেৎ তুমি এসে এর একটা ফায়সালা করে যাও।

হারুন তার পত্রের উত্তরে জানাল, রোকা, তুমি পত্র পাওয়ার সাথে সাথে বাপের বাড়ি চলে যেও। আমি টাকা পাঠালে খাবে নচেৎ না খেয়ে থাকবে। আর একটা কথা মনে রেখ, কেউ যদি বলে, তোমাদের খাওয়াতে পারছি না, তাই বাপের বাড়ি চলে এসেছ, তাহলে সেদিন আমার মরণের খবর পাবে।

হারুনের পত্র পেয়ে রোকেয়া বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে চলে এল।

মাস দেড়েক পর রোকেয়ার মেজ জা শায়লা একদিন তাকে নিয়ে যেতে এল। রোকেয়ার মা-বাবা ও বাড়ির অন্যান্য সকলে তাকে যেতে বারণ করল।

কিন্তু শায়লা নাছোড় বান্দা। বলল, বুবুকে না নিয়ে আমি একা ফিরে যাব না।

শায়লার জেদাজেদিতে রোকেয়ার মন একটু নরম হল। মা-বাবাকে বলল, আমার জা যখন আশা করে নিয়ে যেতে এসেছে তখন তাকে যদি ফিরিয়ে দিই, আর সেকথা যদি তোমার জামাই শুনে, তাহলে সে খুব মনে কষ্ট পাবে। অথবা আমাকে ও তোমাদেরকে অন্যরকম ভাববে। তার চেয়ে আমি ওর সঙ্গে যাই।

দুদিন আগে থেকে রোকেয়ার খুব জ্বর। তার কথা শুনে মেহেরুন্নেসা মেয়েকে বললেন, তুই যে যাবি বলছিস, তোর গায়ে তো এখনো বেশ জ্বর রয়েছে। এই কদিন আগে ডায়রিয়ায় ভুগলি। তারপর জ্বর হয়েছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে যাবি কি করে? শরীর ভালো হোক, তারপর না হয় যাবি।

রোকেয়া বলল, তোমরা বাধা দিও না আম্মা। আল্লাহ চাহে তো জ্বর দুদিনে ভালো। হয়ে যাবে।

মেয়ের যাওয়ার আগ্রহ দেখে তারা আর বাধা দিলেন না।

রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে শায়লার সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি চলে এল। বাড়িতে এসে শাশুড়ীকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আম্মা কেমন আছেন?

হানুফা বিবি রোকেয়ার কথার উত্তর না দিয়ে শায়লাকে বললেন, তুমি আনতে যাওনি বলে এতদিন আসেনি। বলেছিলাম না, সব আমার পায়ের তলে। কোনোদিন বাপের বাড়ির ভাত হজম হবে না। তুমি নিয়ে এলে কেন?

শায়লা বলল, আমি তো আনি নাই। রোকসানার মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে সাথে চলে এল।

হানুফা বিবি বললেন, তোমরা সবাই সবাইয়ের কাছে ভালো থাকবে, আর মাঝখান থেকে আমি দোষী হব, তা হতে দিচ্ছি না। তাকে সাথে করে আনা তোমার উচিত হয়নি।

রোকেয়া খুব জ্বর ছিল বলে শাশুড়ীকে কদমবুনি করে রুমে এসে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। সে শায়লার কথা শুনতে পায়নি। কারণ শায়লা নিচু স্বরে কথা বলছিল। কিন্তু শাশুড়ী জোর গলায় কথা বলছিল বলে তার কথা শুনতে পেয়েছে। একসময় শায়লাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আম্মাকে কি এমন কথা বললে, যা শুনে তিনি ঐসব বললেন?

শায়লা শাশুড়ীকে যা বলেছিল, তা হুবহু বলল।

রোকেয়া খুব অবাক হয়ে বলল, এমন মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারলে? তুমি আমাকে দেখতে গিয়ে একরকম বেঁধে নিয়ে এসেছ, আর আম্মাকে বললে, আমি নিজে। এসেছি?

শায়লা বলল, সত্য কথা বললে, আম্মা আমাকে গালি দিত এবং বাড়ির সবাই আমার বদনাম করত। তাই মিথ্যে করে বলেছি।

রোকেয়া বলল, তুমি যতটুকু লেখাপড়া করেছ, তার তুলনায় তোমার জ্ঞান একটুও হয়নি। তুমি যদি সত্য কথা বলতে, তাহলে আম্মা গালাগালি করলেও এ বাড়ির ও অন্যান্য বাড়ির সবাই তোমার সুনাম করত। সবাই তখন বলত, শাশুড়ী আনতে বারণ করা সত্ত্বেও জা-জাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তুমি তা না করে মিথ্যে বলে আমাকে সকলের কাছে অপমান করলে।

হানুফা বিবি এতক্ষণ আড়ি পেতে দুবৌয়ের কথা শুনছিলেন। এবার রুমে ঢুকে রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মেজ বৌ তোকে আনতে যায়নি, দেখতে গিয়েছিল।

রোকেয়া বলল, আমাকে আনতে যায়নি ঠিক কথা; কিন্তু ধরে আনতে গিয়ে বেঁধে এনেছে।

একথা শুনে হানুফা বিবি শায়লাকে গালাগালি দিতে লাগলেন।

এমন সময় শামসু ঘরে এসে শায়লাকে মা গালাগালি করছে শুনে মাকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আম্মা? তুমি শায়লাকে গালগালি করছ কেন?

হানুফা বিবি চিল্লে চিল্লে শায়লা কি করেছে বলল।

শামসু শুনে সেও শায়লাকে রাগারাগি করে গালাগালি দিতে লাগল।

হানুফা বিবি শায়লাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কি আমি রোকসানার মাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম, না তুমি তার অসুখের কথা শুনে তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য আমার হুকুম নিয়েছিলে? আমি তো বলেছিলাম, তাকে দেখেই চলে আসবে। আনতে গেলে কেন?

শায়লা কাচুমাচু হয়ে বলল, আম্মা, আমাকে মাফ করে দিন। এ ধরনের ভুল আমি আর কখনো করব না। আমাকে গালাগালি করবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না। তারপর রোকেয়াকে বলল, বুবু আমি না হয় কথাটা বলেই ফেলেছি, তাই বলে তুমি আম্মাকে বলে দিলে কেন?

রোকেয়া বলল, সবাই আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে দিয়ে অনেক অপমান করেছে। আমি আর অপমান সহ্য করত পারছি না। এখন থেকে আর চুপ করেও থাকব না। কাউকে ভয়ও করব না। তাতে আমার কপালে আল্লাহ যা রেখেছেন, তাই হবে।

সেদিন তারপর আর কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *