০৪.
রহিমন বিবি চলে যাওয়ার পর ঐ দিনই হনুফা বিবি রোকেয়াকে সংসারের কাজে লাগিয়ে দিলেন।
রোকেয়া বাপের বাড়িতে সংসারের কাজ করে বড় হয়নি। তার মা মেহেরুন্নেসা মাঝে মাঝে বকাঝকা করে শুধা রান্না করা শিখিয়েছেন। রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি এসেই। শাশুড়ীর যা পরিচয় পেয়েছে তাতে ভয়ে তার বুক কাঁপে। তার উপর নূতন বৌ। কোনো কাজ করতে গেলে ভুল না হলেও ভুল হয়ে যায়।
তাই দেখে হানুফা বিবি প্রথম দিন থেকেই রোকেয়ার উপর রাগারাগি শুরু করলেন। যা তা বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।
শাশুড়ীর ব্যবহারে রোকেয়া মনে ভীষণ আঘাত পেল। তবু কিছু না বলে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে সংসারের কাজকর্ম করতে লাগল। আর মনে মনে আল্লাহ পাকের কাছে জানাল, আল্লাহ পাক, তুমি যখন আমার তকদিরে এইসব রেখেছ তখন আমাকে সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা দাও।
একদিন রোকেয়া ঘরদোর পরিষ্কার করে আবর্জনাগুলো ঘরের পিছনে ফেলে দিয়ে এলে হানুফা বিবি ঝংকার দিয়ে বললেন, তোর মা কাজ না শিখিয়ে বিদেশী জামাই পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। জেনে রাখ, সংসারের কাজকর্ম যেমন তেমন করে করা চলবে না। তারপর উঠোনের কয়েক দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বললেন, ঐ সব জায়গায় আবর্জনা রয়েছে চোখে দেখিস না? এতবড় ধিঙ্গী মেয়ে ঝাড় দিতেও জানিস না, না এখন থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে আরম্ভ করছিস?
রোকেয়া উঠোনের চারপাশে তাকিয়ে কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে বলল, কই আম্মা, আমি তো কোনো আবর্জনা দেখছি না।
হানুফা বিবি গর্জন করে উঠলেন, কি তোর এতবড় স্পর্ধা? কাল বৌ হয়ে এসে আমার মুখে মুখে তর্ক? হারুন ঘরে আসুক, এর বিহিত করে ছাড়ব।
রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পরিষ্কার উঠোন আবার ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করল।
সেদিন রাতে হারুন ঘরে এলে হনুফা বিবি ছেলেকে খুব রাগের সাথে বললেন, তোর বৌ উঠোন ঝাট দিতে জানে না। তাই আমি তাকে বুঝিয়ে বলতে গেলে আমার মুখে মুখে তর্ক করেছে। তুই এর বিহিত কর। মেয়ে দেখতে গিয়ে ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়ে ভালো হবে না।
রোকেয়া তখন নিজের ঘরে ছিল। হারুন তার কাছে গিয়ে বলল, রোকা, আম্মা কি বলল শুনেছ?
রোকেয়া আর কি বলবে, শাশুড়ীর মিথ্যে অভিযোগ শুনে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। ভাবল, সত্য কথা বললে, ও ছেলের মধ্যে ঝগড়া হবে। তাই সে চুপ করে রইল।
হারুন বলল, আমার কথার উত্তর দেবে না?
রোকেয়া চোখ মুছে বলল, আমি কোন দিকে যাব? কাজ করলেও দোষ আর না করলেও দোষ।
হারুন বলল, সে কথা আমি জানি। আম্মার মুখে মুখে তর্ক করেছ নাকি?
রোকেয়া উঠোন ঝাঁট দেওয়ার সময় যা বলেছিল তা বলল।
তুমি তো জান রোকা, আম্মা ঐ রকম। তবু কেন কথা বলতে গেলে? তোমাকে বলেছি না, আম্মা সত্য মিথ্যা যাই বলুক না কেন, তুমি কোনো উত্তর করবে না?
আমার ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দাও। আর কখনো এ রকম হবে না। হারুন তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, মাফ চাইলে কেন? আমার কথায় রাগ করেছ নিশ্চয়?
রোকেয়া আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, রাগ করব কেন? ভুল করেছি, সে জন্য মাফ চাইলাম।
কয়েক দিন পর হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, আমি বাপের বাড়ি যাব, তুই সংসারের সব কাজ সামলাতে পারবি তো?
রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে শাশুড়ীকে তার সঙ্গে তুই সম্বোধন করে কথা বলেন বলে এবং গালাগালি করেন বলে তার মনে খুব ব্যথা লাগে। তারপর নিজের মনকে বুঝিয়েছে, তার আম্মাও তো তাকে তুই করে বলে। এই কথা ভেবে মনকে বোধ দিয়েছে। আজ শাশুড়ীর কথা বলার ধরন দেখে ব্যথাটা আবার টনটন করে উঠল। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, হ্যাঁ আম্মা, আমি সবকিছু সামলাতে পারব। সেদিন বিকেলে হানুফা বিবি বাপের বাড়ি চলে গেলেন।
রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার একদিন সকালের দিকে রোকেয়াদের বাড়িতে এসে তাকে বলল, নানির খুব অসুখ। তুই দেখতে যাবি না?
রোকেয়া বলল, ওতো ঘরে নেই। তুমি এবেলা থাক। সে ঘরে এলে বিকেলে তিনজনে এক সঙ্গে যাব।
বখতিয়ার বলল, ঠিক আছে তাই হবে।
হারুন দুপুরে ফিরে বখতিয়ারকে দেখে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করল।
বখতিয়ার বলল, আমরা সবাই আল্লাহ পাকের রহমতে ভালো আছি। তবে নানির খুব অসুখ। তাই তোমাদেরকে খবরটা দিতে এলাম।
হারুন বলল, তাই নাকি? তাহলে তো নানিকে দেখতে যাওয়া আমাদের উচিত।
তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোমাকে নিয়ে নানিকে দেখতে যাব।
রোকেয়া বলল, আম্মা বাড়িতে নেই। আমি যাব কি করে? তার চেয়ে খেয়ে দেয়ে তুমি মেজ ভাইয়ার সঙ্গে গিয়ে দেখে এস।
হারুন বলল, আম্মা নেই বলে তুমি নানির কঠিন অসুখের কথা শুনেও দেখতে যাবে না, এ কেমন কথা? আমরা তো আর সেখানে থাকতে যাচ্ছি না? নানিকে দেখে চলে আসব। খেয়ে দেয়ে তুমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
বিকেল চারটের সময় হারুন, বখতিয়ার ও রোকেয়া নানির বাড়ি এসে পৌঁছাল। নানিকে দেখে নাস্তা খেয়ে হারুন রোকেয়াকে নিয়ে ফিরে এল।
পরের দিন রোকেয়া হারুনকে বলল, কতদিন হয়ে গেল আম্মা গেছেন। তুমি গিয়ে নিয়ে এস।
হারুন সেইদিন বিকেলে গিয়ে আম্মাকে নিয়ে এল।
হানুফা বিবি আসার পর রোকেয়ার ছোট দেবর মজিদ মাকে বলল, ভাবি ভাইয়াকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল।
এই কথা শুনে হানুফা বিবির মুখে থেকে তুফান শুরু হল। সাগরের গর্জনের মতো গলার আওয়াজ করে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি বাড়িতে না থাকলে তোর খুব সুবিধে হয়। স্বামীকে নিয়ে হেথা সেথা বেড়াবার সুযোগ পাস। এটা সেটা বাপের বাড়ি চালান করতে পারিস। তাই তো বলি, দশ বার দিন হয়ে গেল হারুন আমাকে নিয়ে আসেনি কেন? কেমন আছি একবার দেখতেও আসল না?
শাশুড়ীর কথায় রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে গেল। হারুন তখন ঘরে ছিল না। ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে সবকিছু শুনে মায়ের কাছে এসে বলল, আম্মা, তুমি তোমাদের বৌকে কি বলেছ। আমার নানি শাশুড়ীর কঠিন অসুখের খবর পেয়ে আমিই তোমার বৌকে নিয়ে গতকাল দেখতে গিয়েছিলাম। তার বাপের বাড়ি যাইনি।
হানুফা বিবি আরো রেগে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সব বুঝি। তোকে আর বৌয়ের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। তুই তোর কাজে যা।
হারুন আর কিছু না বলে রুমে এসে রোকেয়াকে কাঁদতে দেখে বলল, আম্মার কথায় কেঁদো না। জান তো আম্মা ঐ রকম। আমি তুমি ঠিক থাকলে কেউ কিছু বললেও আমাদের কিছু যায় আসে না।
এর তিন চারদিন আগে থেকে হারুনের বাবা বদরুদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাঁটতে পারেন না। কথাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। উল্টো পাল্টা বলেন। হারুন ডাক্তার নিয়ে এসে দেখিয়েছে। এই ডাক্তার তার এ্যাকসিডেন্টের পর থেকে দেখছেন।
ডাক্তার দেখে বলেছেন, এরকম তো প্রায়ই হয়। কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।
হারুন ঘরে চলে যাওয়ার পর হানুফা বিবি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে ভাত খেয়েছ?
বদরুদ্দিন বললেন, না বৌমা আমাকে খেতে দেয়নি।
হানুফা বিবি আর যান কোথায়? স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বাড়ির লোকজনদের ডেকে বললেন, এত লোক থাকতে হারুনের বাপকে কেউ এক মুঠো ভাত দিতে পারল না। আজ কদিন ধরে সে উপোস রয়েছে। আমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই তোমরা এই অসুস্থ লোকটাকে না খাইয়ে রেখেছ?
রোকেয়ার দুজন দেবর শামসু ও হোসেন সেখানে ছিল। তারা বলল, আম্মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আব্বা যে উল্টো পাল্টা কথা বলে সেটাতো আজ নূতন নয়। পাঁচ ছ বছর ধরে এ রকম করছে। জেনেশুনে কেন তুমি এরকম বলছ?
হারুনও বাইরে এসে বলল, আমাদের সকলের সাথে তোমাদের বৌ যদি আব্বাকে না খাওয়াত, তাহলে না হয় আব্বার কথা বিশ্বাস করা যেত। আম্মা, তুমি যা আরম্ভ করেছ, তা লোকে শুনলে কি বলবে?
হানুফা বিবির তবু রাগ পড়ল না। বললেন, লোকে যাই বলুক না কেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কি কাউকে ভয় করি নাকি? সেদিন তোর বৌ বলল, সে সবদিক সামলাতে পারবে। তাই বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন বলেছিল। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে তোরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে ফুর্তি করে কাটিয়েছিস। কে খেল না খেল সেদিকে খেয়াল করবি কেন?
হারুন বলল, আমরা কি তোমাকে সেধে পাঠিয়েছিলাম, না তুমি নিজে যাবে বলে তোমার বৌকে সবকিছু সামলাতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলে? যদি সে বলত পারব না, তখন তো তার দোষ দিতে। আর পারবে বলতে তার দোষ হয়ে গেল? তুমি যে কেন এমন কাণ্ড শুরু করেছ, তা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ছেলের কথা শুনে হানুফা বিবি বললেন, বিয়ে করেছিস তো, এখন বৌয়ের হয়ে কথা না বললে তার মন পাবি কেন? তারপর গজর গজর করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
হারুনের বাবা বদরুদ্দিন খুব ভাল লোক ছিলেন। তিনি স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র জানতে পেরে তাকে খুব কড়া শাসনে রাখতেন। এ্যাকসিডেন্টের পর যখন উনি প্রায় দুবছর প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন এবং ব্রেনের ডিফেক্ট হয়ে গেল তখন থেকে হানুফা বিবি বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
বদরুদ্দিন রোকেয়াকে খুব ভালবাসেন। সারাদিন রোকেয়াকে বৌমা বৌমা করে ডাকেন। রোকেয়া এসে যদি জিজ্ঞেস করে, কেন ডেকেছেন আব্বা? তখন বলেন, এমনি ডেকেছি। আসলে এ্যাকসিডেন্টের পর থেকে শারীরিক কিছু সুস্থ হলেও মাথার গোলমাল রয়ে গেছে। কখন কাকে কি বলেন কিছুই মনে রাখতে পারেন না।
রোকেয়া বৌ হয়ে আসার পর একদিন হনুফা বিবিই তাকে স্বামীর এই অবস্থার কথা বলে বলেছিলেন, তোর শ্বশুরের কথায় তুই কিছু মনে করিস না। সেই জন্যে বদরুদ্দিন বৌকে ভালবাসলেও যখন মাঝে মাঝে গালাগালি করেন তখন রোকেয়া কিছুমনে করে না। উনি রেগে গেলে শুধু রোকেয়াকে নয়, বাড়ির সবাইকে গালাগালি করেন।
একদিন রান্নার ব্যাপার নিয়ে হানুফা বিবি রোকেয়ার বাপ মা তুলে যাচ্ছে তাই করে গালাগালি করলেন।
এর আগেও রোকেয়া শাশুড়ীর অনেক গালাগালি সহ্য করেছে। কিন্তু আজ তার মা-বাপ তুলে গালাগালি করাতে তার মনে খুব কষ্ট হল। সহ্য করতে না পেরে বলল, আপনি যখন তখন শুধু শুধু আমাকে গালাগালি করেন; তবু আমি কিছু বলি না! কিন্তু • আমার মা-বাপকে গালাগালি করছেন কেন? এখানে তারা কি দোষ করল?
হানুফা বিবি রেগে আগুন হয়ে বললেন, কি বললি তুই! এত দেমাগ তোর? আমার মুখের উপর আবার কথা বলা? তোকে আমি পছন্দ করে আনি নাই যে, আদর সোহাগ করব। আর তোর মা-বাপ কোন দেশের নবাব-বেগম যে, কিছু বললে, তাদের অপমান হবে? আমার যা ইচ্ছা তাই বলব, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আজ হারুন ঘরে আসুক জিজ্ঞেস করব, সে তোকে আমার সাথে ঝগড়া করতে শিখিয়ে দিয়েছে কিনা?
শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া আকাশ থেকে পড়ল। ভাবল, আমি আবার ঝগড়া করলাম কখন? যদি বলি আম্মা, আপনি এ আবার কি কথা বলছেন, তাহলে হয়তো আরো যা তা বলে গালাগালি করবেন? তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এলাম তখন কত আশা, কত আনন্দ ছিল। মনে করেছিলাম, শ্বশুর বাড়ি খুব সুখের হয়। কত স্বপ্ন, কত কল্পনার জাল বুনেছিলাম। কিন্তু তখন জানতাম না যে, সাংসারিক জীবনে কত দুঃখকষ্ট আছে। হায়রে ভাগ্যের পরিহাস, সারাজীবন এখানে কাটাব কি করে? এই সব চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
হারুন ঘরে এলে হনুফা বিবি ছেলেকে অনেক কিছু মিথ্যে বানিয়ে বৌয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করে বললেন, তুই কি বৌ করে এনেছিস আমার সঙ্গে ঝগড়া করাবার জন্য? তুই যদি এর বিহিত না করিস, তাহলে এখানে এক ঘোঁট পানিও খাব না।
হারুন মায়ের স্বভাব জানলেও তার শেষের কথা শুনে রোকেয়ার উপর খুব রেগে গেল। রুমে এসে তাকে কিছু বলতে গিয়ে তার বিমর্ষ মুখ দেখে থেমে গেল। বুঝতে পারল মা এমন কিছু আজ বলেছে, যে জন্যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাটের কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল, রোকা উঠ।
রোকেয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বলল, কখন এলে?
হারুন বলল, এই তো এলাম। তারপর আবার বলল, আজ আম্মার সঙ্গে আবার কি হল, যে জন্য সে এখানে কিছু খাবে না বলেছে?
রোকেয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যা কিছু হয়েছিল বলল।
হারুন জানে রোকেয়া কোনোদিন অন্যায়ভাবে আম্মার সাথে কথা বলবে না। তবু মায়ের কথা শুনে আজ রোকেয়ার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। কিন্তু রুমে এসে তার। অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে সেই রাগ আর রইল না। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে। দিতে বলল, চল আমার সঙ্গে আম্মার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নেবে। তা না হলে আম্মা যখন একবার বলেছে এখানে কিছু খাবে না তখন সত্যিই না খেয়ে থাকবে। নচেৎ। বাপের বাড়ি চলে যাবে। সেখানে আবার তোমার ও আমার নামে দুর্নাম রটাবে। তখন কেলেংকারীর শেষ থাকবে না।
রোকেয়া স্বামীর আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, তুমি খুব খাঁটি কথা বলেছ। চল যাই।
হারুন রুম থেকে বেরোবার আগে রোকেয়া শাশুড়ীর কাছে এসে তার দুপা জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমার অন্যায় হয়ে গেছে; আমাকে মাফ করে দিন। তারপর সে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
হনুফা বিবি বৌকে কাঁদতে দেখে মনে করলেন, হারুন নিশ্চয়ই তাকে মারধর করেছে। তাই মনে মনে খুশী হয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করে চুপ করে রইলেন।
একটু পরে হারুন সেখানে এসে মায়ের একটা হাত ধরে বলল, তোমার বৌকে যা করার করেছি। এবার চল ভাত খেতে দেবে, বড় ক্ষিধে পেয়েছে।
হানুফা বিবি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোরা যা আমি আসছি।
ঐদিন রাতে ঘুমোবার আগে হারুন রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কবে বিয়ে হয়েছিল তোমার মনে আছে?
রোকেয়া বলল, ঐ দিনটার কথা কি কেউ ভুলে? ঐ দিনটা চিরকাল আমার অন্তরে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। হঠাৎ ঐ দিনের কথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
হারুন বলল, না এমনি জিজ্ঞেস করে দেখলাম, তোমার মনে আছে কিনা। আমিও। ঐ দিনের কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তারিখটা তোমার মনে আছে?
রোকেয়া বলল, ১০-৪-৮৩ইং তারিখ।
হারুন তাকে আদর করতে করতে বলল, আজ ১০-৭-৮৩ তারিখ। আমি এই মাসের ২৩ তারিখে বিদেশ চলে যাব। তোমাকে ছেড়ে যেতে মোটেই ইচ্ছা করছে না। সত্যি রোকা, তোমার জন্য আমার খুব দুঃখ হয়, কেন যে তোমাকে বিয়ে করে এত কষ্ট দিচ্ছি? যদি জানতাম, বিয়ের পর এত দুঃখ কষ্ট পেতে হয়, তাহলে বিয়েই করতাম না। তার উপর তোমাকে রেখে চলে যাব, আবার কবে তোমাকে পাব, সে কথা মনে করে ভীষণ খারাপ লাগছে। তারপর কান্নায় তার গলা বুঝে এল।
রোকেয়া আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, তুমি আমাকে ধৈৰ্য্য ধরার কথা বলে নিজেই ধৈৰ্য্যহারা হচ্ছ কেন? বরং তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে অতদিন থাকব, সে কথা তোমার ভাবা উচিত। আম্মার এতকিছু অত্যাচার তোমাকে দেখলেই ভুলে যাই। তুমি চলে গেলে কাকে দেখে ভুলব বলতে পার? বিরহ জ্বালা কি তুমি একাই পাবে, আমি পাব না?
হারুন ভিজে গলায় বলল, রোকা, তুমি এমন করে বলো না। সেই কথা ভেবেই তো আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কি করি বল, আমাদের বিষয় সম্পত্তি তেমন নেই যে, ঘরে থাকলে সংসার চলবে। তাই তো মন না চাইলেও আপনজনদের ফেলে সুদূর বিদেশে যেতে হচ্ছে। যদি সংসার চলার মত কিছু সংস্থান থাকত, তাহলে কি কেউ সখ করে আপনজনদের ফেলে বিদেশে যেতে চায়? আমার ইচ্ছা হয়, সব সময় তোমার পাশে থাকি। তারপর চোখ মুছে বলল, আল্লাহ আবার কবে তোমার কাছে নিয়ে আসবেন, তা তিনিই জানেন।
স্বামীর কথা শুনতে শুনতে রোকেয়ার চোখ থেকেও পানি পড়ছিল। সেই অবস্থাতে তার বুকে মাথা রেখে বলল, তুমি চলে যাবে শুনে আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে আমিই বা কি করে থাকব, সে কথা ভেবে পাচ্ছি না। সংসারে যত অশান্ত পাই না কেন, তোমার চাঁদ মুখ দেখলেই সে সব কর্পূরের মত উড়ে যায়। মন শান্তিতে ভরে যায়। তুমি চলে গেলে আমি কি করে এখানে দিন গুজরান করব, তুমি বলে দাও প্রিয়তম।
হারুন তাকে আদর দিতে দিতে বলল, ধৈৰ্য্য ধর রোকা ধৈর্য্য ধর। তোমাকে রেখে যেতে আমারও যে খুব কষ্ট হবে তা তুমিও জান। তুমি এত ভেঙ্গে পড়লে আমি যাব কি করে? রোকেয়ার মালিকের ডেটমত মাসিক না হয়ে বেশ কয়েকদিন আগে পার হয়ে গেছে, সে কথা হারুন জানে। তাই অনুমান করে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল, এই রোকা, আল্লাহ চাহে যদি সত্যি সত্যি তোমার পেটে বাচ্চা এসে থাকে। তাহলে আমি বলছি, আমাদের ছেলে হবে। এই কথা শুনে রোকেয়া ভীষণ লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে চুপ করে রইল।
কি হল কিছু বলছ না যে?
এসব কথা বললে আমার লজ্জা পায় না বুঝি?
লজ্জা আছে বলে পাচ্ছে। তাই বলে যা সত্য তা বলব না? বল না, ছেলে হবে, না মেয়ে হবে?
সে কথা আল্লাহপাক জানেন, আমি বলব কি করে? তবে আমার ইচ্ছা প্রথমে মেয়ে হোক। এখন ও কথা থাক, সত্যি কি আর পেটে বাচ্চা এসেছে? মাঝে মাঝে আমার মাসিকের ডিস্টার্ব হয়।
তিন চার দিন পরের ঘটনা। সেদিন রোকেয়ার শরীর বেশ খারাপ লাগছিল বলে সংসারের কাজকর্ম না করে শুয়েছিল।
তাই দেখে হানুফা বিবি তার রুমের দরজার কাছে এসে বড় গলায় বললেন, নবাবজাদীর মতো শুয়ে আছিস যে? বাপের বাড়ি থেকে পাঁচ দশটা বাদী এনেছিস বুঝি? তারা সংসারের কাজ করবে? ভালো চাসতো উঠে কাজকর্ম কর নচেৎ কি করি বুঝবি।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে উঠে বসতে গেল; কিন্তু মাথা ঘুরে যেতে আবার শুয়ে পড়ল।
হানুফা বিবি তা লক্ষ্য করে বললেন, একটা ব্যামো মেয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছে। বাপ-মাকে খবর দে, তারা এসে নিয়ে যাক। চিকিৎসা করাক। আমার অত টাকা পয়সা নেই যে, তোর চিকিৎসা করাব।
এমন সময় হারুন ঘরে এসে মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারল, রোকেয়ার কিছু অসুখ বিসুখ হয়েছে। মাকে বলল, আম্মা তুমি এসব কি বলছ? মানুষের কি অসুখ বিসুখ করে না? এর আগে তো তোমার বৌয়ের কোনোদিন কিছু হয়নি। তারপর মা কিছু বলার আগে আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল।
হানুফা বিবি আরো রেগে গিয়ে বৌয়ের গুষ্ঠি তুলে গাল দিতে দিতে সংসারের কাজ করতে লাগলেন।
রোকেয়া সেসব সহ্য করতে না পেরে কাজ করার জন্য আরো দুতিন বার বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিবারেই মাথা ঘুরে চোখতলা ধুয়া হয়ে গেল। শেষে বিফল হয়ে শুয়ে শাশুড়ীর গালাগালি শুনতে শুনতে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
ঘন্টাখানেক পরে হারুন ডাক্তার নিয়ে ফিরে এল।
ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপসান করার সময় হারুনকে বললেন, খুব সম্ভব আপনার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। ওঁকে এখন থেকে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলবেন। তারপর তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর হারুন লজ্জায় মাকে ডাক্তারের কথা বলতে পারল না। টাকা নিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেল।
ডাক্তার যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ হানুফা বিবি চুপ করেছিলেন। ডাক্তার ও ছেলে বেরিয়ে যেতে আবার গজরাতে লাগলেন, কি পাপ না ঘরে এনেছি। এই মেয়ের দ্বারা আমার সংসারের অনেক ক্ষতি হবে। বেশি কিছু বলাও বিপদ। স্বামী ঘরে এলেই আমার বিরুদ্ধে লাগবে। ডাইনী আমার ছেলেকে যাদু করেছে। যাক হারুন এলে বলব, এই বৌ নিয়ে তুই কোনেদিন সুখী হবি না। একে ছেড়ে দে। আমি ভাল মেয়ে দেখে আবার তোর বিয়ে দেব।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে মনে ভীষণ আঘাত পেল। অনেক কিছু বলতে তার ইচ্ছা করল; কিন্তু বলে কোনো লাভ হবে না। বরং উল্টো কিছু হতে পারে ভেবে চুপ করে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজাতে লাগল।
হারুন ওষুধ নিয়ে এসে রোকেয়াকে খাওয়াতে গেলে রোকেয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলল, কি হবে ওষুধ খেয়ে? আমি ভালো হতে চাই না। আমাকে তুমি বিষ এনে দাও। খেয়ে তোমাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যাই। সবাই জানবে অসুখ হয়ে মারা গেছি। আর তা না হলে আমাকে তালাক দিয়ে চির জনমের মত বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। তারপর সে দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হারুন তার কথা শুনে বুঝতে পারল, সে ওষুধ আনতে চলে যাওয়ার পর আম্মা নিশ্চয় যা তা করে অনেক গালাগালি করেছে। বলল, ছিঃ রোকা, এরকম কথা তুমি বলতে পারলে? আম্মা তোমাকে যা কিছু বলুক না কেন, আমি কি তোমাকে কোনোদিন কিছু বলেছি? না আমার কাছ থেকে কোনো রকম অবহেলা পেয়েছ? তোমাকে আমি কত ভালবাসি, তাকি তুমি জান না? তোমার কিছু হলে আমিও বাঁচব না। তারপর কান্নায়। তার গলা বুজে এল।
রোকেয়া স্বামীর কথা শুনে বুঝতে পারল তালাকের কথা বলা তার ঠিক হয়নি। কান্না থামিয়ে বলল, অনেক দুঃখে আমার মুখ থেকে হঠাৎ কথাটা বেরিয়ে গেছে। তবু বলে আমি ভীষণ অন্যায় করেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্রিয়তম। আমারও তো রক্ত মাংসের শরীর। আর কতটুকুই বা আমার জ্ঞান? তারপর হারুন ওষুধ আনতে চলে যাওয়ার পর শাশুড়ীর যেসব কথা বলেছিলেন তা বলে বলল, ওঁর কথা শুনে এই অসুস্থ। শরীরে আমার মাথা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে ফেলেছি। কথা শেষ করে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হারুন তাকে প্রবোধ দিতে দিতে চোখ মুখ মুছিয়ে ওষুধ খাওয়াল। তারপর বলল, তোমার কাছে বলতেও আমার লজ্জা করছে; আম্মা যে তোমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার করবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বিয়ের সময় যখন আম্মা তোমাকে অপছন্দের কথা বলল, তখন ভেবেছিলাম, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর স্ত্রীর দুগালে কয়েকটা চুমো খেয়ে বলল, ক্ষমা তুমি পেয়েছ। তবে যে কথা বলে ফেলে তুমি ক্ষমা চাইলে সেকথা যদি আবার কোনোদিন বল, তাহলে সেদিন আমার মরা মুখ দেখবে।
রোকেয়া স্বামীর মাথা দুহাত দিয়ে ধরে গালে গাল ঠেকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমি না হয় রাগের মাথায় ঐ কথা বলে ফেলেছি। তাই বলে তুমিও ঐ রকম কথা বললে কি করে? তুমি কি জান না, তুমি আমার সমস্ত তনুমনে মিশে রয়েছ? তোমার কিছু হলে আমিও মরে যাব বলে রাখলাম।
হারুন বলল, আমিও মানুষ। আমারও ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ওয়াদা করছি আর কখনো ওরকম কথা বলব না। তুমিও ওয়াদা কর বলবে না।
রোকেয়া বলল, বেশ, আমিও ওয়াদা করলাম। আল্লাহপাক যেন আমাদেরকে ওয়াদা পালন করার তওফিক এনায়েৎ করেন।
হারুন আমিন বলে বলল, এবার একটা সুখবর শোনাব, কি খাওয়াবে বল।
ডাক্তার যখন হারুনকে রোকেয়ার সন্তান সম্ভাবনার কথা বলেন তখন রোকেয়া শুনেনি। তাই সুখবরটা কি হতে পারে ভেবে পেল না। বলল, তুমি যা খেতে চাইবে তাই করে খাওয়াব।
হারুন বলল, আমি কিন্তু খাবার খাওয়াবার কথা বলিনি।
ওমা, খাবারই তো তোক খেতে চায়। অন্য কিছু আবার খাওয়ার জিনিস আছে নাকি?
আছে আছে, তুমি না জানলে কি হবে।
তা হলে কি খাবে তুমিই বল।
হারুন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল।
রোকেয়া লজ্জায় লাল হয়ে স্বামীর পিঠে কয়েকটা কিল দিয়ে বলল, দুষ্ট। যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এই কথা বলে তাকে হাত দিয়ে ঠেলে দিল।
হারুন হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে, সুখবরটা আমিও শোনাব না। এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভান করল।
রোকেয়া খপ করে তার একটা হাত ধরে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু লোকের সাথে দুষ্টুমী করলে দোষ হয় না। ঠিক আছে, তাই খাওয়াব। তারপর লজ্জায় স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলল, এবার সুখবরটা শোনাও।
হারুন বলল, তুমি মা হতে চলেছ। এই, তুমি মা হলে আমিও বাবা হব তাই না?
রোকেয়া আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, জানি না যাও। তুমি জানলে কি করে?
হারুন বলল, ডাক্তার বলেছেন। দেখো রোকা, আমাদের ছেলে হবে।
না, মেয়ে হবে।
আচ্ছা দেখা যাবে কার কথা ঠিক।
শুনেছি যাদের নাকি প্রথমে মেয়ে হয়। তাদের জন্য বেহেস্তের দরজা খোলা থাকে।
কথাটা আমিও শুনেছি। তবে হাদিস কালামে আছে কিনা জানি না। যাক, এবার আর একটা সুখবর শুন, আমার যাওয়ার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। তাই আগামীকাল তোমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসব।
রোকেয়া খুশি হয়ে বলল, তাই হবে।
পরের দিন সকালে হারুন মাকে বলল, আজ তোমার বৌকে নিয়ে বদরপুর যাব। কয়েকদিন পরে তো আমার ফ্লাইট। তাই সকলের সঙ্গে দেখা করে আসব।
হানুফা বিবি বললেন, বৌয়ের অসুখ যাবে কি করে? বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে অসুখ ভালো হয়ে গেছে বুঝি?
হারুন মায়ের স্বভাব জানে, কিছু বরতে গেলেই তাকেও যাতা করে বলতে শুরু করবে। তাই মায়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে রোকেয়াকে নিয়ে একটা স্কুটারে করে রওয়ানা দিল।
শ্বশুর বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর হারুন রোকেয়াকে বলল, চল চাঁদপুর টাউন থেকে বেড়িয়ে আসি।
রোকেয়ার ছোট বোন জুলেখা সেখানে ছিল। বলল, দুলাভাই শুধু মেজ আপাকে নিয়ে যাবেন, আমাকে সাথে নেবেন না?
হারুন বলল, কেন নেব না। যাও তোমরা তৈরী হয়ে এস।
বদরপুর থেকে তারা রিক্সায় করে বাকিলাহ বাজার বাসস্ট্যাণ্ডে এল। তারপর প্রায় পনের মাইল বাসে করে এসে চাঁদপুর নামল। হারুন তাদেরকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কিছু মার্কেটিং করল। তারপর তিনজনে একটা হোটেলে ঢুকে হারুন জুলেখাকে বলল, কি। খাবে বল।
জুলেখা বলল, আপাকে জিজ্ঞেস করুন।
রোকেয়া বলল, পরোটা ও কাবাবের অর্ডার দাও। পরে কোকাকোলা।
হারুন বলল, দুপুর তো হয়েই গেছে, ভাত খেলে হত না? ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।
রোকেয়া বলল, তাহলে তাই অর্ডার দাও।
হারুন তিন প্লেট বিরানীর অর্ডার দিল। সেই সঙ্গে কাবাবও দিতে বলল। খাওয়ার পর তিনজনে তিনটে কো-কো খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসে উঠল।
তারা যখন বদরপুর ফিরে এল তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। হারুন রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে তার শাশুড়ী বাধা দিয়ে বললেন, আজ আর তোমাদের যেয়ে কাজ নেই; কাল সকালে যেও।
হারুন তার মাকে জানে। আজ না গেলে রোকেয়াকে যা তা করে বলবে। সেই কথা ভেবে বলল, আম্মাকে বলে এসেছি আজ ফিরে যাব। না গেলে খুব চিন্তা করবে।
মেহেরুন্নেসা বললেন,তা হলে খাওয়া দাওয়া করে যাও।
সেদিন খাওয়া দাওয়া করে রাত এগারটায় হারুন রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
হানুফা বিবি তখন দুতিনজন জায়ের সাথে গল্প করছিলেন। ছেলে বৌকে ফিরতে দেখে তাদেরকে বললেন, হারুন এই বৌকে নিয়ে ঘর করলে ওর সর্বনাশ হয়ে যাবে। অলক্ষুণে মেয়ে হারুনের শরীরটা নষ্ট করে দিয়েছে। কি সুন্দর শরীর ছিল আমার হারুনের। তারপর হারুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে আমি বারবার বলছি, এই বৌকে ছেড়ে দে। এই বৌয়ের দ্বারা তোর কোনোদিন সুখ শান্তি হবে না। পেত্নীকে নিয়ে তুই পাগল হলি কেন? যা বলছি তা করছিস না কেন? তুই একে ছেড়ে দিয়ে দেখ, আমি তোর জন্য কত সুন্দর বৌ এনে দিতে পারি কিনা।
হারুন ও রোকেয়া তখন নিজেদের রুমে। রোকেয়া যাতে মায়ের কথা শুনতে না পায়, সে জন্যে তার দুকানে হারুন নিজের আঙ্গুল দিয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও রোকেয়া শাশুড়ীর সব কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বলল, ওগো প্রিয়তম, যাতে তোমার সুখ শান্তি হয় তাই কর। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
হারুন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, তুমিও এই কথা বলে আমার মনে ব্যথা দেবে? জেনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন ব্যর্থ। তুমি আমার দিকে চেয়ে অন্তত সহ্য কর। আল্লাহপাক একদিন না একদিন তার প্রতিফল দেবেন। রোকা তুমি কেঁদ না। তোমার চোখের পানি আমাকে ব্যথা দেয়। যে কটাদিন আছি তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই। এবার একটু হাস দেখি।
রোকেয়া চোখ মুছে মুছে মৃদু হেসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি তো চলে যাবে, আর আমি এখানে কিভাবে থাকব বলে দাও প্রিয়তম। এই কথা বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
হারুন তাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি তোমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি দেব। তুমিও তার উত্তর দিবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিক মত পড়বে। প্রতিদন ভোরে উঠে কুরআন তেলাওয়াৎ করবে।সময় করে তাজকেরাতুল আম্বিয়া ও তাজকেরাতুল আউলিয়া এবং কোরানের তফসির পড়বে। মা ফাতেমা, বিবি রহিমা ও উম্মেহাতুল মোমেনাদের জীবনী পড়বে। ঐ যে দেখছ আলমারী ওতে সব বই আছে। বেহেস্তী জেওর তুমি তো বিয়ের আগে পড়েছ। এখন আবার পড়ো। এই সমস্ত বই যদি পড়, তাহলে সংসারের দুঃখ কষ্ট অনুভব করতে পারবে না। মনে অনেক শান্তি পাবে। আর খুব সাবধানে চলাফেরা করবে। রাতে একা বাইরে যাবে না। শরীর খারাপ লাগলে ডাক্তারের কাছে যাবে। আব্বার সেবা যত্ন করো। আম্মা তোমার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, যা কিছু বলুক না কেন, সেসব মনে রাখবে না। তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করবে।
সে রাতে তারা ঘুমাল না। সারারাত আনন্দফুর্তি করে কাটাল। এর একদিন পর হারুন ঢাকায় এসে একদিন হোটেলে রইল। তারপরের দিনের ফ্লাইটে দুবাই চলে গেল।
.