১০.
রোকেয়া ছাত্র জীবনে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতা লেখার প্রেরণা পেয়েছিল। তখন সে ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলের বাংলার স্যার কবিতা লিখতেন। একদিন রোকেয়া তাকে বলল, স্যার আমাকে একটা কবিতা লিখে দেবেন? কবিতাটা হবে গরিবদের নিয়ে লেখা।
স্যার বলল, এখন সময় নেই, পরে লিখে দেব।
এক মাস কেটে যাওয়ার পরও স্যার কবিতাটা লিখে দিলেন না।
এর মধ্যে রোকেয়া স্যারকে অনেকবার তাগিদ দিয়েছে। প্রত্যেকবারে স্যার একই কথা বলেছেন। শেষে রোকেয়া স্যারের উপর অভিমান করে নিজেই কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত নিল। সে প্রথম যে কবিতাটা লিখল, তা সেই স্যারকে নিয়ে
স্যার তুমি কবি বলে লিখ কত কবিতা,
বিশ্বকবি হলে তুমি, পাব কি আর দেখা?
নিজে নিজে কত লিখ আমার জন্য সময় নাই,
মাসখানেক পিছু ছুটে বিফল হলাম তাই।
ঠিক করলাম স্যারকে আর কবিতার কথা বলব নাহি,
এবার থেকে নিজেই লিখে হব কবির ছাত্রী।
এরপরও রোকেয়া অনেক কবিতা লিখেছিল। সেসব হারিয়ে ফেলেছে। অপারেশনের পর বাপের বাড়িতে এসে নিজেকে ভুলে থাকার জন্য আবার কবিতা লিখতে শুরু করল। কুমিল্লায় আপার বাসায় থাকার সময় বাড়িওয়ালার মেয়ে ফাতেমার। সঙ্গে রোকেয়ার বেশ ভাব হয়। তাদের একটা সুন্দর ফুলের বাগান আছে। দুজনে সেই বাগানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করত। বাড়িতে এসে সেই ফুলের বাগানের কথা স্মরণ হতে একটা কবিতা লিখল
ছোট কিংবা বড় ফুল সুবাস ভরা হলে,
তারই ঘ্রাণে ভ্রমরেরা আসে দলে দলে।
ফুলের মত এমন গুণ যদি থাকে তোমার,
বিশ্ব মাঝে তোমার মত হবে না কেউ আর।
কম বয়সে প্রয়াস কর ফুলের মত হতে।
তোমার কথা শুনবে সবে চলবে তোমার পথে।
তারপর রোকেয়া নিজেকে নিয়ে একটা কবিতা লিখল। কবিতাটির নাম দিল প্রেম।
প্রেম কারো জন্য বেহেশতের ফল,
কিন্তু আমার জন্য চোখের জল।
প্রেম সার্থক, একথা কখনো শুনিনি,
নিজের জীবনেও তার সফলতা দেখিনি।
স্বামীকে চেয়েছি আমি প্রেমের ডোরে বাধতে,
কিন্তু হেরে গেছি আমি পারি নাই তাকে ধরতে।
তারপর আবার প্রেম নামক মরীচিৎকার পিছনে,
তৃষ্ণার্ত বুক নিয়ে কত ছুটেছি জানিনে।
তবু যুগ যুগ ধরে প্রেমিকের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি,
জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে এখন ও বেঁচে আছি।
তাই ভাবি, হয়তো প্রেম কারো জন্য বেহেশতের ফল,
কিন্তু আমার জন্য শুধু চোখের জল।
রোকেয়া দিনের পর দিন অসংখ্য কবিতা লিখে চলল। এভাবে আরো দুবছর পার হয়ে গেল।
একদিন হঠাৎ হারুনের মেজ ভাই শামসু রোকেয়ার সঙ্গে দেখা করতে এল।
শামসুকে দেখে রোকেয়ার মনটা মুহূর্তের জন্য আনন্দে উথলে উঠল। ভাবল, হারুনও হয়তো এসেছে। সেই ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, মেজ ভাই, কি খবর? কবে বিদেশ থেকে এলে? তোমার ভাইয়াও এসেছে নাকি?
শামসু বলল, খবর মোটামুটি ভালো। কিন্তু ভাইয়া আসেনি। আমি গতকাল এসেছি। তোমাকে একটা কথা বলছি ভাবি, শুনে তুমি খুব দুঃখ পাবে, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি আর ভাইয়ার আশায় থেক না। যদি থাক, তাহলে তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। তার চেয়ে তুমি নতুন সংসার কর।
রোকেয়া শুনে চমকে উঠে কিছুক্ষণ বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তার মনে হল, সে আর এ পৃথিবীতে নেই।
অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কি মনে করেছ, আমি তোমার ভাইয়ার জন্য পাগল হয়ে আছি? সে আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?
শামসু বলল, না ভাবি, তা নয়।
রোকেয়া বলল, তবে তুমি এমন কথা বললে কেন?
শামসু বলল, আমার যা বলা কর্তব্য তা বলেছি। কারণ আমি জানি, ভাইয়া দেশে আর আসতে পারবে না।
রোকেয়া বলল, কেন?
শামসু বলল, ভাইয়া একটা খুব বড় বিপদে পড়েছে। সেই বিপদ থেকে কোনোদিন উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয়।
রোকেয়া বলল, কি বিপদ? কিসের বিপদ? তোমার ভাইয়া কি সেখানে আবার বিয়ে করেছে?
শামসু বলল, না।
তবে কি জুয়া ও মদে আসক্ত হয়ে পড়েছে?
না, তা নয়।
তবে কি মেয়েদের পেছনে হাঁটছে?
না, তাও না।
তবে কিসের বিপদ, আমাকে বলতে হবে।
না, না, তা তোমাকে বলা যাবে না। সেকথা শোনারও তোমার দরকার নেই। বরং তুমি তোমার জীবন নষ্ট না করে অন্য কোথাও সংসার পাত।
তুমি বার বার ঐকথা বলছ কেন? তোমার ভাইয়া কি ঐকথা আমাকে বলতে বলেছে?
না, সে বলেনি। আমি তার বিপদের কথা জানি বলে বলতে এলাম।
মেজ ভাই, তুমি কি মনে কর আমার একার জীবন নষ্ট হচ্ছে? তোমার ভাইয়ার জীবন নষ্ট হচ্ছে না? আল্লাহপাকের ইচ্ছায় তোমার ভাইয়ার কথা স্মরণ রেখে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব, তাতে আমার কোনো কষ্ট হবে না।
বেশ, তুমি যা ভালো বুঝ কর। আমি যা ভালো বুঝেছিলাম, তা বলে গেলাম। তারপর সে চলে গেল।
শামসু চলে যাওয়ার পর রোকেযা ভাবতে লাগল, হারুনের কি এমন বিপদ হতে পারে, যা সে জেনেও বলতে পারল না?
তাহলে কি সংসারের অশান্তির ভয়ে সে আসছে না? না কি সত্যি তার সেখানে কোনো বিপদ হয়েছে। শেষে ভাবল, তাকে একটা চিঠি দিয়ে আসল ঘটনাটা জানতে চাইবে। পরক্ষণে আবার ভাবল, কি হবেই বা চিঠি দিয়ে? কত চিঠি তো দিলাম। এমনকি মৃত্যুশয্যার খবরও জানালাম। সে সময় মরে গেলে এতদিনে কবরে ঘাস গজাত। কই, তখন তো এল না বা একটা চিঠিও দিল না। এখন বেঁচে আছি শুনে কি আর চিঠি দেবে? এসব কথা ভাবতে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।
এমন সময় রোকসানা স্কুল থেকে ফিরে মাকে কাঁদতে দেখে বলল, তুমি কাঁদছ। কেন আম্মু? মেজ চাচাকে চলে যেতে দেখলাম। সে কি তোমাকে কিছু বলেছে?
রোকেয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর সামলে নিয়ে চোখ-মুখ মুছে পাগলের মত মেয়ের দুগালে চুমো খেয়ে বলল, তোমার চাচা কি তোমাকে কিছু বলেছে?
রোকসানা বলল, না আম্মু, সে তো আমাকে দেখেনি। তুমি এখন আমাকে খেতে দেবে, চল। আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
রোকেয়া মেয়েকে খেতে দিয়ে নিজের রুমে এসে খাটে বসে আল্লাহ পাকের কাছে। ফরিয়াদ করল, আল্লাহ, তুমি আমার তকৃদির এরকম করলে কেন গো আল্লাহ? আমি কিভাবে সারাটা জীবন কাটাব, তুমি বলে দাও। এত বছর সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে শেষ পর্যন্ত আমি কি পেলাম? তারপর সে দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।