কিসের লজ্জা
পুণায় আসার তিন চার বছর পরে একটি লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এবং তাঁর বিচিত্র ব্যবহার দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। হয়তো অবাক হবার কিছু নেই, অনুরূপ অবস্থায় পড়লে আমিও এইরূপ ব্যবহার করতাম। যতদূর মনে পড়ছে লোকটির নাম ছিল রাম বিনায়ক জোশী। সংক্ষেপে রাম জোশী। জাতিতে ব্রাহ্মণ।
পুণায় আমার প্রথম মারাঠী বন্ধু ছিলেন শ্রীযুক্ত ডিকে। আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, এখন দেহরক্ষা করেছেন। যতদিন সচল ছিলেন, সুবিধা পেলেই আমার বাড়িতে আসতেন, আমিও সুবিধা পেলে তাঁর বাড়িতে যেতাম। দুটো বাড়ির মধ্যে ব্যবধান ছিল আন্দাজ আধ মাইল।
শ্রীযুক্ত ডিকের বাড়িটি ছিল দোতলা; তার ওপর তলায় তিনি থাকতেন, আর নীচের তলায় যিনি ভাড়াটে ছিলেন তাঁর নাম রাম জোশী। যখনই শ্রীযুক্ত ডিকের কাছে যেতাম, দেখতাম রাম জোশী সদর দরজার সামনে টুল পেতে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। লোকটির বয়স হয়েছে, থলথলে মোটা গোছের শরীর। তাঁর গৃহিণীকেও দেখেছিলাম, রোগা লম্বা ধরনের মহিলা, এককালে সুন্দরী ছিলেন, এখন শুষ্ক বংশদণ্ডে পরিণত হয়েছেন। বাড়িতে ছেলেপুলে কেউ চোখে পড়েনি।
আমি এলেই রাম জোশী খবরের কাগজের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতেন। কী দেখতেন ভগবান জানেন। পুণায় এসে লক্ষ্য করেছি ভিন্ন প্রদেশের লোক সম্বন্ধে মারাঠীদের কৌতুহলের অন্ত নেই। তবে তারা গায়ে পড়ে কারুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও করতে চায় না।
একদিন কথাচ্ছলে শ্রীযুক্ত ডিকে রাম জোশীর কথা বলেছিলেন। রাম জোশী পোস্ট অফিসের কর্মচারী ছিলেন, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। তাঁর দুই ছেলে পুণার বাইরে চাকরি করে, মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী একা একা থাকেন।
রাম জোশী সম্বন্ধে এইটুকুই জানা ছিল। তারপর আমার বন্ধু মারা গেলেন, আমার ওদিকে যাওয়া বন্ধ হল। রাম জোশীর কথাও আর মনে রইল না।
একদিন সান্ধ্য ভ্রমণের পর বাড়ি ফিরছি, দেখলাম আমার ফটকের কাছে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে দেখে চিনতে পারলাম না, সে সামনে ঝুঁকে বিনীতভাবে নমস্কার করল, থেমে থেমে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘আমাকে চিনতে পারবেন না, আমি ডিকে সাহেবের বাংলার নীচের তলায় থাকি। আমার নাম রাম বিনায়ক জোশী!’
তখন চিনতে পারলাম। লোকটির চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, চোখে একটা ব্যাকুল বিহ্বল ভাব। আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম—কী চান রাম জোশী!
ফটকের ভিতর দিকে চেয়ার পাতা ছিল, রাম জোশীকে নিয়ে গিয়ে বসালাম, বললাম, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? কিছু দরকার আছে কি?’
রাম জোশী চেয়ারের প্রান্তে বসে ঘাড় নীচু করে রইলেন, লজ্জায় যেন ভেঙে পড়ছেন। ঘাড় না তুলেই জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘আমি বড় বিপদে পড়ে এসেছি। ডিকে সাহেবের কাছে শুনেছিলাম আপনি জ্ঞানী ব্যক্তি—‘
আমি কত বড় জ্ঞানী ব্যক্তি তা আমিই জানি; কিন্তু ব্যাপার কি? রাম জোশী বিপদে পড়ে নিজের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের কাছে না গিয়ে আমার মতো সম্পূর্ণ অপরিচিত জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে এলেন কেন? সতর্কভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি বিপদ?’
রাম জোশী আর ঘাড় তোলেন না, কথাও বলেন না। শেষে অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘আমার স্ত্রী—’
চকিত হয়ে বললাম, ‘আপনার স্ত্রী!’
এবার রাম জোশী জোর করে ঘাড় তুললেন, ঝোঁক দিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রী। ত্রিশ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, তিনি তিনটি সন্তানের মা। আমি জানি তাঁর মতো সুশীলা সাধ্বী স্ত্রী হয় না। কিন্তু—’
‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু কিছুদিন থেকে কী হয়েছে জানি না, তিনি—তাঁর রাগ ভীষণ বেড়ে গেছে, আমাকে অশ্লীল গালাগালি দিচ্ছেন, অশ্লীল কথা বলছেন। বাবুজি, তিনি জীবনে কখনো অশিষ্ট কথা বলেননি। কিন্তু এখন—’
এবার আমি লজ্জায় অধোবদন হলাম। ক্ষীণকণ্ঠে বললাম, ‘কিন্তু এ বিষয়ে আমি কি করতে পারি?’
রাম জোশী বললেন, ‘আপনি জ্ঞানী লোক, নিশ্চয় এর প্রতিকার জানেন। বাবুজি, আমি বড় মনঃকষ্টে আছি, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন।’
আমি আরো দিশাহারা হয়ে গেলাম। এটা কি রোগ? আর যদি রোগই হয় আমি তার প্রতিকারের কী জানি? ফ্যালফ্যাল করে রাম জোশীর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
তিনি হাতের আস্তিনে চোখ মুছে বললেন, ‘বেশী কি বলব বাবুজি, আমার স্ত্রী বলছেন আমার ছেলেমেয়েরা আমার নয়।’
লজ্জায় শিউরে উঠলাম। বৃদ্ধ বয়সে ভদ্রলোকের এ কী বিড়ম্বনা! বুঝতে পারলাম কেন তিনি নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসেছেন। আমি বিদেশী, আমার কাছে তাঁর লজ্জা কম। নিজের আত্মীয়স্বজনকে প্রাণ গেলেও তিনি একথা বলতে পারতেন না।
রাম জোশী আবার বললেন, ‘বাবুজি, আপনি একটা উপায় করুন। নিশ্চয় আপনি এর দাবাই জানেন। এ একটা রোগ, আমার স্ত্রী রোগের মুখে মিথ্যে কথা বলছেন। তাঁর স্বভাব আমি জানি, এ সব মিথ্যে কথা।’
হঠাৎ মনে পড়ে গেল। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বই নিয়ে নাড়াচাড়া করা অভ্যাস আছে, মনে পড়ল কোন্ একটা ওষুধে এই রকম লক্ষণ দেখেছি। কি নাম ওষুধটার—হায়োসায়ামাস্! কিন্তু আমি বাড়িতে যে ছোট্ট হোমিও ওষুধের বাক্স রাখি তাতে হায়োসায়ামাস্ নেই; অত তেজালো ওষুধ আমার দরকার হয় না, পারিবারিক ব্যবহারের জন্যে নক্স ভমিকা পল্সেটিলা বেলেডোনা সাল্ফার এই রকম সাদাসিধে ওষুধই যথেষ্ট। আমি রাম জোশীকে বললাম, ‘দেখুন, আমার মনে হয় হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রে এর দাবাই আছে। আপনি বরং একজন হোমিও ডাক্তারের কাছে যান।’
তিনি ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘কিন্তু আমি যে হোমিও ডাক্তার কাউকে চিনি না।’
আমি চিনি। তুলসী বাজারের মোড়ে ডাক্তার জি. বি. সাঠের হোমিও ডাক্তারখানা আছে, আমি মাঝে মাঝে ওষুধ কিনতে সেখানে যাই; ডাক্তার সাঠের সঙ্গে মুখ চেনাচিনি আছে। সেই কথা রাম জোশীকে বললাম। তিনি প্রথমে গাঁইগুঁই করলেন, স্বজাতীয় ডাক্তারের কাছে যাবার ইচ্ছে নেই। শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন, আমার হাত ধরে মিনতি করে বললেন, ‘আপনি সঙ্গে চলুন, আমি একা যেতে পারব না।’
রাত হয়ে গেছে, কিন্তু উপায় কি? রাম জোশীকে নিয়ে ডাক্তার সাঠের ডাক্তারখানায় গেলাম। দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে এলাম। আসার সময় রাম জোশী কৃতজ্ঞতায় গলদশ্রু হয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ বাবুজি, বহুৎ সুক্রিয়া।’
তিন দিন পরে রাম জোশী আবার আমার বাড়িতে এলেন। আজ তাঁর মুখ বেশ প্রফুল্ল। বললেন, ‘ওষুধ ধরেছে। ডাক্তার সাঠে ভারি বিচক্ষণ লোক, উনি কাউকে কিছু বলবেন না।’
তারপর মাসখানেক রাম জোশীর আর দেখা নেই।
একদিন বিকেলবেলা ডাক্তার সাঠের ডাক্তারখানায় ওষুধ কিনতে গেছি, ডাক্তার আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। প্রশ্ন করলাম, ‘রাম জোশীর স্ত্রীর খবর কি?’ সাঠে বললেন, ‘সেরে গেছে।’
মনটা খুশি হল। বললাম, ‘কি ওষুধ দিয়েছিলেন?’
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘ওষুধের নাম বলতে নেই।’
‘হায়োসায়ামাস্?’
ডাক্তার চোখ বড় করলেন, কিন্তু হাঁ-না কিছু বললেন না।
ফেরার পথে ভাবলাম রাম জোশীর সঙ্গে দেখা করে যাই। শ্ৰীযুক্ত ডিকে মারা যাবার পর আর ওদিকে যাইনি।
সদর দরজায় বসে রাম জোশীর স্ত্রী ডাল বাচছিলেন, আমাকে দেখে লজ্জায় ব্যাকুল হয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন। এবং একটু পরেই রাম জোশী এসে দোরের সামনে দাঁড়ালেন।
আমি বললাম, ‘কি জোশীজি, বাড়ির খবর ভাল তো?’
রাম জোশী আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রূঢ় স্বরে বললেন, ‘কে তুমি! তোমাকে আমি চিনি না।’ এই বলে দড়াম করে দোর বন্ধ করে দিলেন।
লাঞ্ছিত মুখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম—এটা কী? লজ্জা? কিসের লজ্জা? আমি তো সবই জানি।
১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩