কিসসা প্যায়ার কা
৩ মে ২০১৭।
একটা ভয়ার্ত কণ্ঠ ভেসে এল ফোনের ওপার থেকে, ‘স্যর, হৃদয়পুরের শুভায়ন কলোনি থেকে বলছি। তারপর এক মিনিটের একটু স্তব্ধতা। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ডিউটি অফিসার, ‘দূর মশাই, বলুন না কি বলতে চান?’
সাত সকালে বারাসত থানার ফোনটা এরকম বেজে ওঠে রোজ। কলকাতার গা লাগোয়া হওয়ায় শহরতলির এই অংশগুলোতে খুচখাচ অপরাধ লেগেই থাকে। বিশেষ করে রাতের দিকে। ফলে সকাল থেকে নাগাড়ে বাজতে থাকে থানার ল্যান্ডলাইনটা। থামার যেন নাম নেয় না। সেদিন আরও একবার বেজে উঠতেই মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অফিসার দায়সারা ভাবে রিসিভারটা তুললেন, ‘হ্যালো, ডিউটি অফিসার গোস্বামী বলছি। বলুন।’
‘না, স্যর। এখানে একটা মার্ডার হয়ে গেছে। কোথায়? জায়গাটার নাম ভালো ভাবে শুনতে না শুনতেই কেটে গেল ফোনটা। সকাল সকাল মেজাজটা গরম হয়ে গেল ডিউটি অফিসারের। ওই যে কথায় বলে না, ‘মনিং শো’জ দ্য ডে’। আজ কার মুখ দেখে যে থানায় মর্নিং ডিউটিটা করতে এসেছিলেন কে জানে। সারাদিন ধরে এখন এই হ্যাপা চলবে।
মিনিট কুড়ির মধ্যে পুলিশের একটি দল পৌঁছে গেল ঘটনাস্থলে। বাইরে থেকে তালাবন্ধ ঘরে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। পুরো ঘরটা ভেসে গিয়েছে রক্তের স্রোতে। এ মুখ থেকে সে মুখ। খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগলো না। এলাকার বাসিন্দারা ভিড় জমালেন বাড়ির সামনে। চারদিকে নানা রকমের টিকাটিপ্পনি। কেউ বললেন, “আরে ভদ্রলোককে তো চিনি। খুব ভালো লোক ছিলেন। অন্য একজনের গলায় শোনা গেল, “হ্যাঁ দিদি, ঠিকই বলছেন, এই তো গেল পরশু রাস্তায় দেখা হল, কতক্ষণ কথা বললেন। বাড়ির সবার খোঁজখবরও নিলেন।’ এরকম আরও আনেক কিছু।
টপাটপ ক্যামেরার শাটার টিপতে থাকলেন পুলিশের ফটোগ্রাফার। প্রাথমিক ভাবে বোঝা গেল, মৃতের মাথার পিছন দিকে ভারি কোনও বস্তু দিয়ে বেশ কয়েকবার আঘাত করা হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের দাগও দেখা যাচ্ছে। যেন প্রবল আক্রোশে কুপিয়ে মারার চেষ্টাও করেছে আততায়ী। এমনকী, খুনি হাতের শিরাও কেটে দিয়েছে মৃত্যু নিশ্চিত করতে। নিহতের নাম অনুপম সিংহ। পেশায় ট্রাভেল এজেন্ট। স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়িতে ভাড়ায় থাকতেন। পাশের পাড়ায় শ্বশুড়বাড়ি।
ঘরের জিনিসপত্র অগোছালো থাকার কোনও চিহ্ন নেই। সারা বাড়িতে একটু অন্যরকম ক্লু বলতে, মেঝেতে পাওয়া একটি পোড়া সিগারেটের ফিল্টারের শেষ অংশ। তাতে আঙুলের ছাপ বা অন্য কোনও কিছু পাওয়া যায় কি না জানতে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল তড়িঘড়ি। বাড়ির দেরাজের নিচে দেখা গেল একটা সোনার আংটিও হেলায় পড়ে রয়েছে। পুলিশের ভাষায় বলতে গেলে, যে কোনও খুনের একটা মোটিভ থাকে। কোনও রকম আর্থিক বিষয়ের জন্য হলে তাকে বলে ‘মার্ডার ফর গেইন।’ কিন্তু সেই তত্ত্বটা এক্ষেত্রে খাটল না। যেখানে যা যা থাকার কথা, সবই রয়েছে যথাস্থানে। তদন্তকারীদের অনুসন্ধানে উঠে এল, মৃতের স্ত্রী মনুয়া ২ তারিখ, অর্থাৎ ঘটনার আগের দিন সকালে অসুস্থতার কারণে চলে গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি। ফলে ঘরে অনুপম একাই ছিলেন। তাঁর বাবা—মা ও অন্য আত্মীয়রা দীর্ঘদিন ধরে থাকেন বাংলাদেশে। সেখানে আদি বাড়ি। নতুন বিয়ে হওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় অনুপম ব্যাঙ্ককও ঘুরে এসেছেন। স্থানীয় সবার সঙ্গে তাঁর ব্যবহারও ছিল অত্যন্ত মধুর। পারিবারিক অশান্তি থাকার কথা নয়। প্রতিবেশীরা নিশ্চিত করলেন, স্যর, দু’জনের সম্পর্ক তো বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু কার মনে কী আছে, কে বলতে পারে?’
এটা কি কোনও ব্যবসায়িক শত্রুতা? নাকি পিছনে রয়েছে অন্য কোনও কারণ? কেন খুন হতে হল এই ট্রাভেল এজেন্টকে? প্রথম দু’একদিন তদন্তে তেমন নতুন কোনও কিছু হাতে এল না। অত্যন্ত সুনাম থাকা এই ট্রাভেল এজেন্টের মৃত্যুতে কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় এলাকার মানুষের ক্ষোভ বাড়তে শুরু করল ধীরে ধীরে। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের অভিযোগ, এই খুনের ঘটনার তদন্তে পুলিশ তেমন ভাবে গা লাগাচ্ছে না।
এরপর সংবাদ মাধ্যমেও শুরু হল পুলিশের বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনা। জড়িয়ে পড়ল রাজনৈতিক দলগুলি। টিভির পর্দায় সান্ধ্য বিতর্কের আসরে চলল এই বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ইস্যু কে হাতছাড়া করতে চায়? তবে সবাইকে অবাক করে পুরোপুরি শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই অনুপমের বিধবা স্ত্রী মনুয়া মজুমদার থানার সামনে এসে বিক্ষোভে সামিল হলেন। এই লড়াইকে কার্যত আন্দোলনের রূপ দিতে রোজ তাঁর সঙ্গে জুটতে শুরু করলেন এলাকার কয়েকশো মানুষ। বেড়ে চলল প্রতিবাদের মাত্রাও। এবারে সত্যি কিছুটা চাপে পড়ে গেলেন পুলিশের সিনিয়র অফিসাররা। মরিয়া চেষ্টা শুরু করলেন তাঁরাও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অন্ধকারে হাতড়েও যখন তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তদন্তকারীরা সিদ্ধান্ত নিলেন তাহলে একবার অনুপমের মোবাইলের তথ্য সংগ্রহ করা যাক। তাতেও লাভের লাভ কিছু হল না। কল ডিটেইলস রেকর্ড দেখাল, মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও স্ত্রী মনুয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন অনুপম। এবং সেটা বেশ কয়েকবার। স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে বার বার কথা বলার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তাছাড়া তাঁদের বিয়েও খুব বেশিদিন হয়নি। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, সে দিন যেন অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই কথা বলেছেন তাঁরা। বিশেষ করে বেশি ফোন গিয়েছে মনুয়ার মোবাইল থেকে। তাতেও নির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্তে পৌছানো শক্ত। ঠিক এই সময়ে পুলিশের হাতে এল একটি ভিডিয়ো ফুটেজ। যা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিয়ের মাস দুয়েকের মাথায় ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে স্বামী—স্ত্রী গিয়েছেন দত্তপুকুরের একটি বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে। সঙ্গে থাকা অন্য সঙ্গীদের বায়নার ঠেলায় দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসতে হয়েছে তাঁদের। তাঁরাও বলেছেন একে অন্যর সম্পর্কে।
মনুয়া: আমি বাড়ির একমাত্র সন্তান। আমার পরিবার অনেক বড়, তবে ও আমাদের ফ্যামিলিকে খুব সাহায্য করে।
অনুপম: মাত্র কয়েকমাসে তেমন কিছু বলা কঠিন, তবে ও খুব কেয়ারিং। একটু দেরি হলেই ফোন করতে থাকে। আমাদের বাড়িতে ১৮/১৯ জন মেম্বার। আমি সবার বড়। তবে পরিবার সম্পর্কে ওর দায়িত্ববোধ দেখে বুঝেছি আমার জন্য একদম পারফেক্ট।
দু’জনের এই সম্পর্ক ও স্বাভাবিক জীবন—যাপনের ছবিটা পাড়া প্রতিবেশীদের কথাতেও নিশ্চিতভাবে উঠে আসে তদন্তকারীদের কাছে।
তাহলে খুনটা কে করল? মোটিভটাই বা কী? কোনও দিক থেকেই কোনও ক্লু মিলছিল না। বাড়িতে গিয়ে এবং থানায় ডেকে দফায় দফায় নিহতের স্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তাও বলে। কোনও শত্রুর কথা তিনিও বলতে পারেননি। বরং জিজ্ঞাসাবাদের অধিকাংশ সময়টাই স্বামীর শোকে কাতর মনুয়া, পুলিশের সিনিয়র অফিসারদের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘স্যর, আপনারা অপরাধীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করুন, একমাত্র তাহলেই আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে।’ আবার, বাইরে বেরিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। এতেই শেষ নয়, সংবাদমাধ্যমে সোচ্চার হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে। টিভি চ্যানেলগুলোতেও কয়েকদিন ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন, খুনি কে?
দিনের পর দিন তদন্তের ব্যর্থতায় তদন্তকারীদের অবস্থাও তখন শোচনীয়। এক সোর্স এসে খবর দিল অনুপম নাকি হাওয়ালা কারবারের সঙ্গেও যুক্ত। উড়ে আসা খবর হলেও সে মুহুর্তে কোনও কিছু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ যেন,‘উড়াইয়া দেখ ছাই’। তাই দিন দুয়েক সেই তথ্যের পিছনেও সময় ব্যয় হল। কিন্তু না। সে গুড়ে বালি। পুরোটাই ভুয়ো।
একেবারে প্রথম থেকে কেসটা ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে একদিন এক সিনিয়র অফিসারের মনে হল, আচ্ছা, মনুয়ার ফোনের সিডিআর বা কল ডিটেইলস রেকর্ড কি কখনও খতিয়ে দেখা হয়েছে? আসলে, এই ধরনের খুনের ঘটনা নিয়ে তার কয়েকদিন আগে একটা ক্রাইম থ্রিলার পড়ে ফেলেছিলেন ওই পুলিশ কর্তা। আচমকা একটি মামলার সঙ্গে এই খুনের ঘটনার খানিকটা সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন তিনি। অতএব, যা ভাবা তাই কাজ। ডেকে পাঠানো হল মামলার মূল তদন্তকারী অফিসারকে। তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, ‘না, স্যর। এখনও পর্যন্ত সেটা করা হয়নি। ওই অ্যাঙ্গেলটা বাদ রয়ে গিয়েছে।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পাঠানো হল সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে। সঙ্গে বিশেষ নোট, ‘ভেরি ভেরি আর্জেন্ট। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাতে এসে গেল সিডিআর। শুরু হল নম্বর মিলান্তির খেলা। আর সেখান থেকেই পুরো রহস্যটা একদম ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিল। তালিকা থেকে আবিষ্কার করা গেল একটি অদ্ভুত নম্বর। যে নম্বরে দীর্ঘদিন ধরে, দিনে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ফোন করে কথা বলতেন মনুয়া। কে এই ব্যক্তি? এত কিসের কথা তাদের মধ্যে?
অজানা প্রশ্নের তথ্যতালাশ শুরু করলেন তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দারা তাজ্জব হয়ে দেখলেন, ৩ মে অনুপমের দেহ ঘরে পড়ে থাকার ঠিক আগের দিন যতবার মনুয়া কথা বলেছেন স্বামী অনুপমের সঙ্গে, তার থেকে অনেক বেশি কথা বলেছেন ওই একটি নম্বরে। এ বার শুরু হল সেই অজানা নম্বরের পিছনে দৌড়াদৌড়ি। তাতে অবশ্য বেশি সময় বরবাদ করতে হল না। মোবাইল টাওয়ারের সূত্র বলে দিল, বারাসত থেকে বেশ কিছুটা দূরে অশোকনগরের বাসিন্দা অজিত রায় ওরফে বুবাই এই ফোনটি ব্যবহার করেন।
কে এই তৃতীয় চরিত্র অজিত? এবার শুরু হল তাঁর উপর নজরদারি। কান পাততেই উঠে এল, খুনের ঘটনার পরেও মনুয়ার সঙ্গে অজিতের প্রতিদিন বেশ কয়েকবার করে কথা চলছে। দুটি ফোনই ইন্টারসেপশনে নিয়ে নিলেন পুলিশ কর্তারা। তাতেই চিচিং ফাঁক, তাঁরা নিজেদের মধ্যে এমন কথা বলছেন, যা দু’জনের ঘনিষ্ঠতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমনকী, তাঁদের মধ্যে অনুপমের খুনের তদন্তে পুলিশি ব্যর্থতা প্রসঙ্গেও হচ্ছে বেশ হালকা চালে কথাবার্তা, ‘তুমি তো দারুন দিচ্ছ। রোজ থানার সামনে গিয়ে আরও লোক জমা করে দাও, তাহলে পুলিশকে চাপে রাখা যাবে। আর কয়েকজন রিপোর্টারের নম্বর জোগাড় করে আমি পাঠাচ্ছি। এদের ফোন করে বলবে রোজ খবরটা করতে। তাতেই কাজ হবে। এক—দেড়মাস এভাবে চালাতে পারলে আর কারও কোনও সন্দেহ থাকবে না। তারপর শুধু আমি আর তুমি।’ পুলিশের বুঝতে এক মিনিটও সময় লাগল না, এটাই সেই অজিতের গলা।
আবার ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল একটি মহিলা কণ্ঠ, ‘ঠিকঠাক করতে পারছি বলছো। শোনো না, আমার খুব ভয় হচ্ছে। একদিন দেখা করা যায়? সামনা—সামনি বেশ কিছু আলোচনা করা দরকার আমাদের। যেমন ধরো, যদি বাংলাদেশ থেকে ওঁর বাবা—মা চলে আসেন?’ আত্মবিশ্বাসী অজিত ভরসা জোগান, ‘সুইটহার্ট, আর কোনও সমস্যা নেই। ভালো দিন আসছে আমাদের জীবনে। তাছাড়া তুমি তো জানো, আমার ডিভোর্সের সব কিছু রেডি করে ফেলেছি। কয়েকদিনের মধ্যে সেটাও হয়ে যাবে।’
সেই দিন আর আসতে দিতে রাজি ছিলেন না পুলিশ কর্তারা। পরিকল্পনার পাকা ধানে মই দিতে একে একে দুই মিলে যেতেই সময় নষ্ট না করে অশোকনগর থেকে তুলে আনা হল অজিতকে।
তারপর জেরার পর্ব। কিন্তু পুলিশের ভাষায়, অজিত ‘খলিফা মাল’। তেমন কিছু কাজকর্মও করেন না। প্রথম দিন শত চেষ্টাতেও মুখ খোলানো গেল না তাঁকে। কোনও কথাই বললেন না তিনি। বরং ক্রমাগত চমকে গেল পুলিশকে, ‘জানেন আমি কে? কার ভাই?’ তদন্ত যখন, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, কোনটা কখন কাজে লেগে যায় কে জানে? একটু খোঁজ নিতেই পুলিশ হদিশ পেল, শাসকদলের এক নেতার ঘনিষ্ঠ অজিত। ডেকে পাঠানো হল সেই নেতাকে। সব শুনেটুনে সাফ বলে দিলেন তিনি, এরকম হাজার আত্মীয় আমার, ফালতু লাফড়া কেসে আমি ঢুকব না। ততক্ষণে পাশের ঘরে মনুয়াকেও ডেকে নিয়ে আলাদা করে জেরা শুরু করেছে পুলিশ। অবশেষে, খুনের প্রায় দু’সপ্তাহ বাদে টানা জেরার মুখে অজিত আর মনুয়া স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন তাঁদের ষড়যন্ত্র আর খুনের পরিকল্পনার কথা।
কী সেই ষড়যন্ত্র ? জেরাতে উঠে এল, বারাসতের এক শাসকদলের কাউন্সিলরকে ধরে বছর খানেক আগে পুরসভার শিক্ষা বিভাগে অস্থায়ী ভিত্তিতে একটা কাজ জুটিয়ে নেন মনুয়া। অনুপমের সঙ্গে তাঁর প্রায় ৬ বছরের প্রেম। দু’জনে বিয়ের পর শুভায়ন কলোনিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন। বিবাহিত জীবনের শুরুটাও ঠিকঠাক ছিল। সমস্যা শুরু হয় কয়েকমাস যেতে না যেতেই। স্বামী অনুপমের শারীরিক দুর্বলতার কারণে একাধিক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেন মনুয়া। আচমকা বছর খানেক আগে একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে কলেজের বন্ধু অজিতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাঁর। পুরনো পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁদের মধ্যে। এবং শেষ পর্যন্ত ওই সম্পর্কটা টিকে যায়। এমনকী, একটা সময় দু’জনের শারীরিক সম্পর্কের জেরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন মনুয়া মজুমদার। বারাসতের একটি নার্সিংহোমে গোপনে গর্ভপাতও করাতে হয় তাঁকে। মাস ছয়েক আগের সেই ঘটনার পর তাঁরা বিয়ে করবেন বলে ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু অনুপমের মত অত টাকাপয়সা যে নেই অজিতের। তাহলে কী হবে? একদিন দুর্বল মুহূর্তে অজিত সেই প্রশ্নটাই করে বসেন মনুয়াকে, আমার অত আর্থিক সঙ্গতি নেই। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে?’ প্রেমিকের চুলে বিলি কেটে মনুয়া জবাব দেন, ‘আমি টাকা ভালোবাসি না। শুধু ভালোবাসি তোমাকে।’ শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বে পড়ে যান দু’জন। এই সম্পর্কের মাঝে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে অনুপম। প্রেমের পথটা মসৃণ করার জন্য পথের কাঁটাকে ডিভোর্স দেওয়ার চেয়ে একেবারে সরিয়ে দেওয়াই তাঁদের কাছে সহজ ও সুবিধাজনক বলে মনে হয়। যেহেতুঁ অজিত ওরফে বুবাই প্রায় কিছুই করতেন না, তাই অনুপমের মৃত্যুর পর স্ত্রী হিসাবে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তিও পেয়ে যাবেন মনুয়া, এই অঙ্কের হিসেবটাও কষে ফেলেন। কোনও একদিন বিছানায়, এক দুর্বল মুহূর্তে অজিতকে দিয়ে খুন করার প্রতিশ্রুতিও আদায় করে নেন অনুপমের স্ত্রী।
পরিকল্পনা অনুসারে, ২ মে, ২০১৭—এর দুপুরে অফিস গিয়ে স্রেফ সইটুকু করে অসুস্থতার অজুহাতে ফিরে আসেন মনুয়া। তারপর শুভায়ন কলোনির বাড়িতে অজিতকে ডেকে নেন। অশোকনগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে মায়ের কাছে ১০০ টাকা চান অজিত। আমার কাছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা রয়েছে’ জবাব দেন । তাই দাও। কলকাতায় একটা কাজের খোঁজ এসেছে। সেখানে যাব। মাথা চুলকোতে চুলকোতে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে রওনা দেন অজিত। দু’জনে সেদিন একসঙ্গে বেশ কিছুটা ঘনিষ্ঠ সময় কাটান নবপল্লীর শুভায়ন কলোনির বাড়িতে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেওয়াই শুধু নয়, নাট্য রূপান্তরের মত করে মনুয়া দেখিয়ে দেন, দরজার লক খুলে কীভাবে ঢুকবেন অনুপম। কোথায় অফিসের ব্যাগ রাখবেন, জুতো খুলবেন। তারপর বেসিনের সামনে গিয়ে অন্যান্য দিনের মতো প্রথমেই কেমন করে হাত—মুখ ধোবেন। আর সেই সময় ঠিক কোথায় লুকিয়ে থাকতে হবে অজিতকে। এভাবে প্রত্যেকটি জিনিস পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে মনুয়া ঘরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা মোছামুছি করে দরজা লক করে বেরিয়ে যান পাশের পাড়ায় নিজের বাড়ির দিকে। তাঁর অবশ্য যাওয়ার ইচ্ছে খুব একটা ছিল না। মন চাইছিল, ঘরের এক কোণে আলমারির পাশে লুকিয়ে থেকে পুরো অপারেশনটা নিজের চোখে দেখার। কিন্তু কথায় বলে না, সবার সব ইচ্ছে মেটে না। স্রেফ একটা বাহানা দেওয়ার জন্য মনুয়া বাড়িতে আগাম বলে রেখেছিলেন, শরীরটা খারাপ। আর যায় কোথায়! দুপুর থেকে ঘন ঘন ফোন আসা শুরু করে চিন্তিত মার মোবাইল থেকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিতরে অজিতকে একা রেখে চলে যেতে হয় বাড়ির দিকে। তবে যাওয়ার আগে জানিয়ে যান, যখন কাজটা অজিত করবেন তখন যেন পকেটে ফোনটা অন করে রেখে দেওয়া হয়। যাতে অন্যপ্রান্ত থেকে অনুপমের শেষ চিৎকারটা পৌঁছে যায় তাঁর কানে। সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বিকেল থেকে ঘন ঘন অনুপমকে ফোন করা শুরু করলেন মনুয়া। স্বামীর সঠিক অবস্থান জানার জন্য। আর একইসঙ্গে সেই সমস্ত তথ্য জানিয়ে দিতে থাকলেন অজিতকে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে, ঘরের ভিতরে ফিউজ খুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে আলো না জ্বলে। ফলে অন্ধকারে কতক্ষন আর একা একা বসা যায় ? টাইম পাস করতে মিনিট পনের’র মধ্যে অজিত খুলে ফেলেন সঙ্গে আনা রামের বোতলটা। পেটে তরল না গেলে এসব কাজ করা যায় নাকি?’ ফাঁকা ঘরে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন তিনি।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ট্রেন এসে ঢুকল হৃদয়পুর স্টেশনে। স্ত্রী চিন্তা করছে, এই ভাবনা থেকে অনুপম ফোন করলেন মনুয়াকে। আমি এই স্টেশন থেকে রওনা দিচ্ছি। টোটোতে ভাবছি চলে যাব। উত্তর আসে, অন্ধকার রাস্তা সাবধানে এস। মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের কথা দু’জনের। আধঘণ্টার ভিতর শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছে যান অনুপম। রাতে স্বামী—স্ত্রী জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। তারপর একটু রেস্ট নিয়ে অনুপম রওনা দেন বাড়ির দিকে। এ বাড়ি থেকে ফোন চলে যায় অপেক্ষারত অজিতের মোবাইলে। মনুয়া তাকে সাবধান করে দেন এই বলে যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুপম ঘরে ঢুকছেন, ফলে এই সময়টা বাড়তি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বাড়ির দরজায় যখন লক খুলছেন অনুপম, সেই সময়ে অজিত ফোন করেন মনুয়াকে। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ওপ্রান্ত থেকে নির্দেশ আসে, এই কলটাই অন রাখতে। যথারীতি, অভ্যাস অনুযায়ী অনুপম ঘরে ঢুকে ব্যাগ রেখে, জুতো খুলে, বেসিনে মুখ ধোওয়ার জন্য মাথা নিচু করেন। আর সেই সময়ে আচমকা পিছন থেকে লুঙ্গিতে পেঁচানো লোহার রড বার করে তা দিয়েই সজোরে মাথায় আঘাত করেন অজিত। প্রথমবার মাথায় না লেগে ঘাড়ের কাছে আঘাত লাগে। অন্ধকারে বাধা দিতে গিয়ে অনুপম একহাতে অজিতের গেঞ্জি টেনে ধরতেই ছিড়ে যায়, অন্য হাতে চুলে টান দিতেই দ্বিতীয়বার মাথায় রডের আঘাত করেন অজিত। চিৎকার করে সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন অনুপম। বাড়িতে বসে অজিতের অন করা ফোন থেকে সেই আর্ত চিকার ও প্রান্তে কানে যায় মনুয়ার। মৃত্যু নিশ্চিত করতে অজিত এবার সবজি কাটার ছুরি দিয়ে জ্ঞান হারানো অনুপমকে কসাইদের মতো কোপাতে থাকেন। এরপর মৃতদেহের সামনে বসে ডান হাতের শিরাও কেটে দেন। গোটা ঘর ততক্ষণে ভেসে গিয়েছে রক্তে। খুনের পর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ধীরে সুস্থে হাঁটাহাটি করতে করতে ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেন অজিত। ঠান্ডা মাথায় পুরো ছবিটা ফোনে ব্রিফ করা শুরু করেন মনুয়াকে। ফোনেই ভেসে আসে মনুয়ার উত্তেজিত গলা, ‘একবার সব শেষবারের মতো চেক করো। খুব সাবধানে দেখে নাও যাতে কোথাও কোনও হাতের ছাপ বা কোনও চিহ্ন না থাকে।’ অজিতের গলায় তখন যেন অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি, ‘কোথাও কোনও চিহ্ন নেই ডার্লিং। তোমার এনে দেওয়া গ্লাভস পরে পুরো কাজটা করেছি।’ কাজ শেষ হতেই অজিত পোশাক পাল্টে দরজার লক বাইরে থেকে টেনে দিয়ে বেরিয়ে আসেন। পিঠের ব্যাগে লোহার রড আর ছুরি ভরে নিয়ে স্বাভাবিক চেহারায় পৌঁছে যান ষষ্ঠীতলায় মনুয়ার বাড়ির সামনে। কানে ফোন দিয়ে ততক্ষণে ছাদে চলে এসেছেন মনুয়াও। ঠিক নীচে এসে অজিত হাত নেড়ে জানান দেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ তারপর সুযোগ বুঝে পাশের ঝােপে ফেলে দেন খুনে ব্যবহৃত সব হাতিয়ার। যাতে প্রমাণ লোপাট হয়ে যায় সহজে। এবার হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা বাস ধরে রাতেই চলে আসেন শোভাবাজার। বহুদিন ধরে চেনা একটা মদের দোকানে ঢুকে আকণ্ঠ মদ্যপান করেন রাতভর। ভোর পাঁচটা বাজতেই আরও একটা বাস ধরে সোজা দক্ষিণেশ্বর মন্দির। সেখানে মায়ের কাছে মাথা ঠুকে নিজের বাড়ি ফিরে যান অজিত।
মোবাইল ফোনের প্রমাণ আর পুলিশের টানা জেরায় একটা সময় ভেঙে পড়ে দু’জনের যৌথ প্রচেষ্টা। আসল ঘটনা কবুল করে ফেলেন তাঁরা। মনুয়ার অভিনয় ভালো হলেও চিত্রনাট্য কাঁচা হওয়ার কারণে ভেস্তে যায় সবকিছু। যদিও একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে পুলিশকে জেরার জবাবে বেশ গলা উঁচিয়ে বলেন, “আমি অনুপমের সঙ্গে প্রেম করছিলাম ঠিকই, তবে সঙ্গে এমএ—টাও পড়ছিলাম। আমার অমতে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ে আটকাতে আমি একবার আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিলাম। তবুও কেউ কথা শোনেনি। বিয়ের পর থেকে অনুপম আমার প্রিয় বিষয় নাচ বন্ধ করিয়ে দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপও করতে দিত না। সন্দেহ করত খুব। এ থেকেই রাগ জন্মায় আমার। সেই হাস্যকর যুক্তি অবশ্য ধোপে টেকেনি। অনুপমকে খুনের ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মনুয়া মজুমদার ও প্রেমিক অজিত রায় ওরফে বুবাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার প্রায় আড়াই বছর বাদে লম্বা আইনি লড়াইয়ের পর অভিযুক্ত দু’জনকে যাবজ্জীবন সাজার নির্দেশ দেয় বারাসত আদালত।
সব শেষেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। শুধুই কি মোবাইলের কথোপকথন নাকি এর নেপথ্যে লুকিয়ে ছিল আরও বেশি কিছু? তদন্তকারীদের বক্তব্য, আরও দুটি প্রমাণ এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে এবং তার মধ্যে একটি দেরাজের নীচ থেকে উদ্ধার করা অনুপমের সেই সোনার আংটি। ঘটনা হল, অত দামি সোনার আংটি ওভাবে সামনে পড়ে থাকতে দেখেও আততায়ী না নেওয়ায় গোয়েন্দারা বুঝে যান আর যাই হোক, এটা ‘মার্ডার ফর গেইন’ নয়। তাহলে কী? এর উত্তরও ছিল সহজ। খুনের পর রোজ কথা বলতে গিয়ে প্রেমের নেশায় একদিন অজিত ফোনে মনুয়াকে জানিয়েও দেন, ‘বিবাহ বার্ষিকীতে তোমার দেওয়া ওই আংটি আমি সেদিন অনুপমের হাত থেকে খুলে ফেলে দিয়েছি। চোখের সামনে ওটা সহ্য হচ্ছিল না। এই প্রতিহিংসাই কার্যত হেঁটে হেঁটে ক্লু হিসেবে চলে আসে পুলিশের কাছে। আর দ্বিতীয়টি? খুনের পর ওই ঘরে অজিতের বেখেয়ালে সিগারেটের টুকরো ফেলে যাওয়া। যার সঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং আততায়ীর মুখ থেকে নিঃসৃত লালা মিলে যায় ফরেনসিক পরীক্ষায়। বৈজ্ঞানিক নথি হিসেবে যা পরে মান্যতা পায় আদালতেও।
এই মামলার উদাহরণ টেনে তাই বলা যায়, আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত নয়।