1 of 2

কিসমৎ

কিসমৎ

ছোটো ভাই সুরেশ শয্যাগত হয়ে পড়েছে। অসুখটা ব্লাড-প্রেশার। সুখেন্দুর সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছি। সে আমার বন্ধু ও বিখ্যাত ডাক্তার।

সুখেন্দুর দেখা পেলুম তার ডিসপেন্সারিতে। সে মন দিয়ে সুরেশের রোগের সব লক্ষণ শুনে বললে, ‘ভয়ের কারণ নেই। আজ ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছি, কাল সকালে নিজে গিয়ে দেখে আসব রোগী কেমন আছে।’

সে কাগজ-কলম নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লেখবার উদ্যোগ করছে, এমন সময় ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে এক অদ্ভুত মূর্তি।

আগন্তুক নারী। কিন্তু এমন তার চেহারা, দেখলেই শিউরে উঠতে হয়। প্রথমেই নজরে পড়ে তার দেহের শীর্ণতা ও দীর্ঘতা। সে এত রোগা যে তার হাড় ক-খানা কেবল চামড়া দিয়ে ঢাকা আছে বললেই হয়। আর অধিকাংশ পুরুষের চেয়ে সে মাথায় উঁচু। তার বয়সও আন্দাজ করা সহজ নয়! ত্রিশও হতে পারে, পঞ্চাশও। পায়ে জুতো আছে বটে, কিন্তু তার বেশভূষা আধুনিক নারীর মতো নয়।

তারপরেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার ভয়াবহ গায়ের রং। তা হচ্ছে একেবারেই মৃতদেহের মতো— পাণ্ডুর এবং রক্তহীন। অন্তত দুই দিনের বাসি মড়ার দেহের রং হয় এমনিধারাই। আমি দুই দিনের বাসি মড়া কখনো দেখিনি। তবু কেন জানি না, এই কথাই মনে হল।

সুখেন্দুরও মুখে-চোখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের ভাব।

নারী অতি ক্ষীণ ও অস্পষ্ট স্বরে বললে, ‘আমি ডাক্তার এস. বসুর কাছে এসেছি।’

সুখেন্দু বললে, ‘আমারই ওই নাম। বসুন। আপনার কি কোনো অসুখ করেছে?’

নারী বসল না, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘অসুখ কী?’

‘তাই জানবার জন্যেই তো আপনার কাছে এসেছি!’ স্বর ক্ষীণ হলেও তার মধ্যে পাওয়া গেল যেন ব্যঙ্গের আভাস।

সুখেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে একটা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, ‘বেশ, আমার সঙ্গে আসুন।’

নারীও তার পিছনে পিছনে চলল এবং পাশের ঘরে প্রবেশ করবার আগে হঠাৎ আমার দিকে একটা দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে।

আমার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! আমি দেখলুম দুটো মাছের চোখ— সম্পূর্ণ ভাবহীন দুটো মরা মাছের চোখ!

খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার ও রোগিণী দুজনেই পাশের ঘর থেকে ফিরে এল।

সুখেন্দু টেবিলের ধারে বসে কলম হাতে নিয়ে শুধোলে, ‘আপনার নাম?’

‘আমোদিনী দেবী।’

ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে সুখেন্দু বললে, ‘দুটো ওষুধ লিখে দিলুম, ব্যবহার করে কেমন থাকেন জানাবেন।’

দর্শনীর টাকা টেবিলের ওপরে রেখে, ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগিণী দরজার দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগে আর একবার হঠাৎ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে গেল।

আবার দেখলুম, সম্পূর্ণ সেই দুটো মরা মাছের মতো চোখ!

মনের অস্বস্তি মনেই চেপে সুখেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ওর কী অসুখ হয়েছে?’

‘অ্যানিমিয়া, বিষম অ্যানিমিয়া। ও বেঁচে আছে কেমন করে বুঝতে পারলুম না।’

দুই

বাড়ির দিকে ফিরছি।

গাড়ির ভিতরে বসেই দেখতে পেলুম, রাস্তার ফুটপাথের ওপরে দাঁড়িয়ে আমার বাড়ির বৈঠকখানার জানালার দিকে তাকিয়ে একটা নারীমূর্তি। যেমন রোগা, তেমনি ঢ্যাঙা তার চেহারা।

গাড়ির শব্দে চমকে ফিরে চকিতে একবার চেয়ে দেখে মূর্তিটা হনহন করে চলে গেল। তাকে দূর থেকে চিনতে পারলুম না বটে, কিন্তু কেন জানি না, আবার মনে পড়ল সুখেন্দুর ডিসপেন্সারির সেই অদ্ভুত রোগিণীর কথা।

আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, আমার বাড়ির বৈঠকখানার দিকে তাকিয়ে মূর্তিটা কী দেখবার চেষ্টা করছিল?

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সেটা বুঝতে দেরি লাগল না।

বৈঠকখানার ভেতরে বাড়ির সব লোক এসে জড়ো হয়েছে। সকলেই হায় হায় করছে। নিশ্চয়ই ঘটেছে একটা কোনো অঘটন।

ভিড় সরিয়ে ভিতরে ঢুকলুম। একখানা ইজিচেয়ারের ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে আমার ছোটোভাই সুরেশের চৈতন্যহীন দেহ। তার দুই হাত আড়ষ্ট, বিস্ফারিত চক্ষু নিবদ্ধ হয়ে আছে রাস্তার ধারের জানলার দিকে এবং তার মধ্যে ফুটে উঠেছে এক প্রচণ্ড আতঙ্কের ভাব!

কিন্তু কেন? জানলার ভিতর দিয়ে পথের ওপরে কী বা কাকে দেখে সুরেশ এতটা ভয় পেয়েছিল?

তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডেকে আনা হল। তিনি সব দেখেশুনে বললেন, ‘আর কোনো আশা নেই। রোগীর হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে অত্যধিক রক্তের চাপে।’

তিন

মৃতদেহ নিয়ে এসেছি নিমতলার শ্মশানঘাটে।

দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠেছে চিতার আগুন। বড়ো নিষ্ঠুর ওই চিতা। মানুষ যাদের ভালোবাসে তাদেরই গ্রাস করা তার ধর্ম।

সংসারে আপন বলতে ছিল কেবল আমার এই ভাইটি। সেও আমাকে ফেলে চলে গেল। দুনিয়ায় আজ আমি একা।

চিতার কাছে উবু হয়ে বসে গালে হাত দিয়ে এইসব কথা ভাবছি। আচম্বিতে মুখ তুলে আমার দুই চক্ষু হয়ে উঠল সচকিত।

খানিক তফাতে একদল কৌতূহলী লোকের মাঝখানে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদীর্ঘ, কঙ্কালসার নারীমূর্তি। সেই রোগিণী! মরা মাছের মতো দুটো নিষ্পলক ড্যাবডেবে চোখে সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকেই।

আমার সর্বাঙ্গের ভিতর দিয়ে খেলে গেল যেন উত্তপ্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ!

কিন্তু এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠেই দেখি, সেখান থেকে অদৃশ্য হয়েছে সেই রহস্যময়ী নারীমূর্তি!

চার

কেটে গিয়েছে প্রায় এক বৎসর।

মানুষ একেবারে একলা থাকতে পারে না। একটি স্প্যানিয়েল কুকুর পুষেছি। সে আমার অষ্টপ্রহরের সঙ্গী— নাম তার রোভার। তাকে আমি ভালোবাসি, সে মানুষ হলেও তাকে আমি আরও বেশি ভালোবাসতে পারতুম না।

সেদিন বৈকালে গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়ে কার্জন পার্কের একখানা বেঞ্চির ওপরে বসে বিশ্রাম করছিলুম।

রোভার আপন মনে খেলা করে বেড়াচ্ছিল ঘাস-জমির এখানে-ওখানে। তারপর সে ছুটতে ছুটতে চলে গেল আমার পিছন দিককার একটা ঝোপের ওপাশে।

মিনিট খানেক পরেই সে ক্রুদ্ধস্বরে ঘেউ ঘেউ গর্জন করে উঠল এবং পরমুহূর্তেই শুনলুম তার আর্ত চিৎকার।

তাড়াতাড়ি উঠে ঝোপের ওধারে ছুটে গেলুম।

প্রথমটা রোভারকে দেখতে পেলুম না। তার বদলে দেখলুম, একটা নারীমূর্তি মাটির ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কী যেন লক্ষ করছে।

আমার পদশব্দে চমকে উঠে ফিরে দেখেই সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং হন্তদন্তের মতো দ্রুতপদে চলে গেল সেখান থেকে। কিন্তু দেখামাত্রই তাকে চিনলুম, সে সেই দীর্ঘ, কৃশ ও পাণ্ডু রোগিণী— দুই চোখ যার মরা মাছের মতো বিস্ফারিত ও ভাবহীন!

সে যেখানে হুমড়ি খেয়ে ছিল, সেখানে আড়ষ্ট হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রোভারের দেহ। দৌড়ে গিয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে বুঝলুম, সে আর বেঁচে নেই। আমার বলবান, স্বাস্থ্যবান ও সুবৃহৎ কুকুর, আচম্বিতে মারা পড়ল কেমন করে?

হঠাৎ খিল-খিল করে শুকনো হাসি শুনেই মুখ তুলে দেখি, খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই বীভৎস রোগিণী! ক্ষীণ অথচ খনখনে গলায় সে বলে উঠল— ‘আসব, আবার আমাদের দেখা হবে!’

নিদারুণ ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল আবার সর্বাঙ্গ। দুই হস্ত মুষ্টিবদ্ধ করে মারমুখো হয়ে আমি বেগে ছুটে গেলুম তার দিকে।

কিন্তু তাকে আর ধরতে পারলুম না। আশ্চর্য ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে সে চলে গেল আমার নাগালের বাইরে এবং তারপর হারিয়ে গেল চৌরঙ্গির সচল জনতারণ্যে।

পাঁচ

কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। আজ তিন বৎসর ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি ভারতের দেশে দেশে। সেই শরীরী অমঙ্গল এখনও আমাকে দেখা দেয়নি।

কিন্তু আমার মন বলে— এখনও সে আছে আমার পিছনে পিছনে, শেষবারের মতো আবার তার চরম দেখা পাব যেকোনো দিন— যেকোনো মুহূর্তে!

সে কি আমার নিয়তি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *