কিষ্টোলাল
হরিবিলাসবাবুর ছেলে রামবিলাস বার দুয়েক ম্যাট্রিক ফেল করে বাড়ি থেকে ফেরার হয়েছিল। হরিবিলাসবাবু আমাদের পাড়াতেই থাকতেন; শরীর বাতে পঙ্গু কিন্তু পয়সা-কড়ি আছে। ঘরে বসে যতদূর সম্ভব ছেলের খোঁজ-খবর করলেন, কলকাতার কাগজে হাহুতাশপূর্ণ বিজ্ঞাপন দিলেন। কিন্তু রামবিলাস ফিরে এল না। সে বাপের ক্যাশ-বাক্স ভেঙে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়েছিল, টাকা যতদিন না ফুরোবে ততদিন রামবিলাস বাড়িমুখো হবে না এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।
একদিন হরিবিলাসবাবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমার কাছে এসে উপস্থিত। হাতে এক-তাড়া নোট এবং একটি ফটোগ্রাফ। বললেন, ‘পাজিটার সন্ধান পেয়েছি। দিল্লীতে গিয়ে লুকিয়ে আছে।’
বললাম, ‘বলেন কি? একেবারে দিল্লী!’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আমার পাটনার এক বন্ধু দিল্লী গিয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন। একবার রাস্তায় তাকে দেখেছিলেন, ছোঁড়া দূর থেকে তাঁকে দেখেই কেটে পড়ল।’
‘হুঁ। এখন তাকে ধরবেন কি করে?’
‘আমার তো অবস্থা দেখছ ভায়া, নড়বার ক্ষমতা নেই। তা বলছিলাম কি, তুমি তো এখন কাজকর্ম কিছু করছ না, তুমি যদি যাও। পাজিটার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবে।’
প্রস্তাবটি খুবই স্পৃহণীয়। সে আজকের কথা নয়, তখন বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক চলছে। আমি তখন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে মুঙ্গেরে বসে আছি এবং পিতৃ-অন্ন ধ্বংস করছি। পরের পয়সায় দিল্লী সফরের এত বড় সুযোগ ছাড়া যায় না। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
ওপরে যা লিখলাম তা এই আখ্যায়িকার ভূমিকা, আসল কাহিনী নয়। আসল কাহিনীর সঙ্গে রামবিলাসের যোগসূত্র খুবই সামান্য, সে আমার দিল্লী ভ্রমণের নিমিত্ত মাত্র।
একদিন ভোরবেলা দিল্লী পৌঁছুলাম। শীতের মরসুম শেষ হয়ে আসছে, তবু ভোর পাঁচটার সময় দিল্লী শহর কুয়াশার ভোট কম্বল মুড়ি দিয়ে তন্দ্রাসুখ উপভোগ করছে। স্টেশনের উঠানে টাঙার দল কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা টাঙার পাশ দিয়ে গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাড়া যাবে?’
গাড়োয়ান টাঙায় বসে বিড়ি টানছিল, নেমে এসে বিশুদ্ধ উর্দুতে বলল, ‘কোথায় যেতে হবে?’
গাড়োয়ানের চেহারা চাবুকের মতো লিকলিকে। চুস্ত পাজামা ও চুড়িদার কুর্তায় আরও লিকলিকে দেখাচ্ছে। রঙ তামাটে ফরসা, চোখে সুর্মার রেশ, ঠোঁটের দুই কোণে গতরাত্রির পানের ছোপ শুকিয়ে আছে; মাথায় রোমশ পশমের ঝাঁকড়া টুপি। বয়স আন্দাজ পঁচিশ। মনে হল লোকটি বোধহয় পাঞ্জাবী মুসলমান।
বিশুদ্ধ উর্দু বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে পারি। বললাম, ‘আগে একটা মাঝারি ভাড়ার হোটেলে যাব, সেখানে মালপত্র রেখে শহর দেখতে বেরুব।’
গাড়োয়ান বলল, ‘বহুত খুব। আপনাকে আমি দিল্লী দেখিয়ে দেব। কিন্তু আগেই হোটেলে যাবার দরকার কি! শহর দেখে বিকেলবেলা হোটেলে যাবেন। তাতে ভাড়া কম লাগবে।’
‘কিন্তু আমার মালপত্র রাখব কোথায়?’
সঙ্গে ছিল ছোট স্যুটকেস এবং বিছানা, একটা কুলি মাথায় নিয়ে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়োয়ান একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই মাল? এ আমার টাঙাতেই রাখা চলবে।’
মুহূর্ত মধ্যে মাল টাঙার খোলের মধ্যে রেখে গাড়োয়ান বলল, ‘চলুন তাহলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া যাক। কুতুব দেখবেন তো?’
দেখলাম সে আমার নগর দর্শনের সমস্ত দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। কুলির পয়সা চুকিয়ে দিয়ে টাঙায় উঠে বসলাম, বললাম, ‘নিশ্চয়। তাছাড়া লালকেল্লা, আর যা-যা দেখবার আছে—’
‘বহুত খুব। সারাদিন লাগবে।’
‘কত ভাড়া নেবে বললে না তো?’
‘সারাদিনের জন্যে পাঁচ টাকা।’
‘বেশ, দেব।’
আকাশে সূর্য উঠি-উঠি করছে, রাস্তা জনবিরল। গাড়োয়ান তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
আধ মাইল রাস্তা যাবার পর সে ঘ্যাঁচ করে টাঙা থামাল। আমি সামনের আসনে তার পাশে বসেছিলাম, ঘাড় ফিরিয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার। এখানে কী?’
সে বলল, ‘খাবারের দোকান। সারাদিন বাইরে বাইরে কাটবে, ভাল করে খেয়ে নিন।’
‘তুমিও এস।’
দু’জনে খাবারের দোকানে গিয়ে বসলাম। গাড়োয়ানকে ফরমাস করতে বললাম। সে ফরমাস দিল, সদ্য ভাজা জিলিপি আর গরম দুধ। পেট ভরে খেলাম। কিছু শুকনো খাবার—লাড্ডু, সামোসা, শেও-ডালমুট—সঙ্গে নিলাম। দুপুরবেলা দরকার হবে।
গাড়োয়ান পানের দোকান থেকে এক ডিবে পান ভরে নিল। তারপর আবার যাত্রা শুরু হল। শহরের এলাকা পার হয়ে গাড়োয়ান মৃদু গলায় গান গাইতে গাইতে চলল—বাবুল মোরি নৈহর ছুটো যায়—
কুতুব মিনার শহর থেকে এগারো মাইল, আগে সেখানেই যাচ্ছি। নয়াদিল্লী তখন সবে তৈরি হচ্ছে, তেপান্তর মাঠের ভিতর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা চলেছে, মাঠের ওপর বাঘ-বন্দী খেলার ছক তৈরি হয়েছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাড়ির ভিত মাটি ছাড়িয়ে মাথা তুলেছে।
গাইতে গাইতে গাড়োয়ানটা আমার দিকে তাকাচ্ছে, তার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে আছে। তারপর সে অপরূপ বাংলা ভাষায় কথা বলল, ‘আপনি তো বাংগালী হচ্ছেন।’
অবাক কাণ্ড। আমি পুলকিত হয়ে বললাম, ‘আরে, তুমি বাংলা জান?’
সে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘হামিও বাংগালী হচ্ছি। হামার নাম কিষ্টোলাল গাঙ্গোলী।’
চমৎকৃত হয়ে চেয়ে রইলাম। বাঙালীর ছেলে! অথচ চেহারায় বাঙালীত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতদিন এ কাজ করছ?’
সে বলল, ‘এ টাঙা চালানো? সে বহুৎ দিন। দশ-বারো বরষ।’
মনে একটু কষ্ট হল। বাঙালী ব্রাহ্মণের ছেলে, বাপ হয়তো দিল্লীতে থাকত, অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল, অনাথ ছেলেটা পেটের দায়ে টাঙা চালাচ্ছে। এতক্ষণ মনে মনে তাকে একটু নীচু নজরে দেখছিলাম, এখন সামাজিক পার্থক্য ঘুচে গেল। কিষ্টোলাল আর আমি সমপর্যায়ের মানুষ।
তারপর সারাদিন আমরা দু’জনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম। কুতুব দেখলাম, লালকেল্লা দেখলাম। ছোটখাটো অনেক কিছু দেখা হল না, সন্ধ্যে হয়ে গেল। কিন্তু কিষ্টোলালের সঙ্গে আমার প্রণয় গভীর হল।
লালকেল্লা দেখে টাঙায় উঠলাম, বললাম, ‘ভাই কিষ্টোলাল, আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল আবার দেখা যাবে। তোমার ঘোড়াটা বোধ হয় লোহা দিয়ে তৈরি, তোমার শরীরও তাই। কিন্তু আমার গতর চূর্ণ হয়ে গেছে।’
কিষ্টোলাল খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল, ‘চলুন আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।’
টাঙা আবার চলল। যেতে যেতে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল রামবিলাসের কথা। যার খোঁজে দিল্লী এসেছি তার কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। বললাম, ‘কিষ্টোলাল, তুমি তো সর্বদাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াও, রামবিলাস নামে একটা ছেলেকে দেখেছ?’
‘রামবিলাস! সে কৌন আছে?’
তখন রামবিলাসের কেচ্ছা বললাম, শুনে কিষ্টোলাল গরম হয়ে উঠল। বলল, ‘বড়া শয়তান লৌণ্ডা আছে, ঘর ছেড়ে ভেগেছে! আচ্ছা, হামি খবর নিবে।’
তারপর কিষ্টোলাল এক পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ফটকে টাঙা ঢোকালো। প্রকাণ্ড হাতা, মাঝখানে দোতলা বাড়ি; বাড়ির সামনে টেনিস কোর্ট, দু’পাশে ফুলের বাগান; বাড়ির ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললাম, ‘ও কিষ্টোলাল, এ কোথায় নিয়ে এলে। এই তোমার মামুলি হোটেল নাকি?’
কিষ্টোলাল মুচকি হেসে বলল, ‘হোটেল না, হামার পিতাজির বাড়ি।’
ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। কিষ্টোলাল বলে কী! ঠাট্টা করছে নাকি? টাঙা গাড়ি-বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। কিষ্টোলাল হাঁক ছাড়ল, ‘প্যারেলাল! গুলাব সিং! মেহদি মিঞা! ইধর আও, সাহেব আয়ে হৈঁ, সামান উতারো।’
গোটা চারেক চাকর ছুটে এল, টাঙা থেকে আমার সামান নামাতে লাগল। কিষ্টোলাল টাঙা থেকে নেমে বলল, ‘আসুন।’
আমরা বাড়ির বারান্দায় উঠলাম। ইতিমধ্যে একটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ভিতর দিক থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন, বললেন, ‘কি রে কেষ্ট, তুই এলি!’
আমি বিস্ময়াহত হয়ে দেখছি, কিষ্টোলাল গিয়ে বাপের হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করল, উর্দুতে বলল, হ্যাঁ, আমার একটি বন্ধুকে নিয়ে এসেছি। ইনি বাংগালী, দু’-চার দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন।’
কিষ্টোলালের বাবা স্মিতমুখে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘আসুন।’
পরে জানতে পেরেছিলাম তাঁর নাম প্রিয়নাথ গাঙ্গুলী, দিল্লীর একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যারিস্টার। শীর্ণ লম্বা চেহারা, ফর্সা রঙ, কপালের দুই পাশে টোল খেয়েছে, গালে মাংস নেই, কেশবিরল মাথাটা গম্বুজের মতো উঁচু হয়ে আছে। কিষ্টোলালের সঙ্গে তাঁর চেহারা মিলিয়ে দেখলাম, কাঠামো একই, কালক্রমে কিষ্টোলালও তার বাবার মতো হয়ে দাঁড়াবে।
মন থেকে বিস্ময় কিছুতেই যাচ্ছে না। কিষ্টোলালের বাপ যদি এমন ধনী ব্যক্তি তবে সে টাঙা হাঁকায় কেন? বাপ-ব্যাটায় অসদ্ভাবও তো নেই। তবে ব্যাপার কি?
প্রিয়নাথবাবু সমাদর করে আমাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। ছেলেকে বললেন, ‘কেষ্ট, তুই আজ এখানেই থেকে যা না।’
কিষ্টোলাল বলল, ‘না বাবুজি, ঘোড়াটা থকে আছে, আমি এখনি যাব।’
প্রিয়নাথবাবু আর কিছু বললেন না, মেহদি মিঞাকে মুর্গি কাটবার হুকুম দিয়ে ভিতর দিকে চলে গেলেন।
কিষ্টোলাল আমার কাছে এসে খাটো গলায় বলল, ‘ভাড়াটা দেবেন নাকি? তাহলে আজ রাত্তিরে একটু খানা-পিনার ব্যবস্থা করি।’
আমি তাকে ভাড়ার পাঁচটা টাকা দিলাম, সে টাকা পকেটে রেখে বলল, ‘আমার বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে এলে বাবুজি খুশি হন।— আচ্ছা, আজ তাহলে চলি। কাল সকালে আবার আসব।’
প্রিয়নাথবাবু দু’ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখলেন কিষ্টোলাল অন্তর্হিত হয়েছে। একটু ম্লান হেসে তিনি আমার পাশে বসলেন, বললেন, ‘কেষ্ট পালিয়েছে! পালাবেই তো, বাড়িতে যে বাঘ আছে।’
প্রিয়নাথবাবুর ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু কিষ্টোলাল চলে যাবার পর আমি বিলক্ষণ অস্বস্তি বোধ করছিলাম, অপ্রতিভভাবে বললাম, ‘কেষ্ট আমাকে আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল। আপনি আমাকে চেনেন না, নাম পর্যন্ত জানেন না। আপনার নিশ্চয় খুব অসুবিধা হবে।—’
প্রিয়নাথবাবু শান্ত স্বরে বললেন, ‘কোনও অসুবিধা হবে না। কেষ্ট যখন অতিথি নিয়ে আসে আমার ভালই লাগে। কয়েক মাস আগে একপাল আমেরিকান টুরিস্ট নিয়ে হাজির হল। তারা দু’দিন বাড়িতে ছিল, আমার এক কেস হুইস্কি সাবাড় করে দিয়ে গেল। কিন্তু ভারি আমুদে, যতদিন ছিল ভালই লেগেছিল।’ একটু থেমে বললেন, ‘আমার আর কেউ নেই, এত বড় বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। কেষ্ট যখন বন্ধুদের নিয়ে আসে মনে হয় তবু আমার আপনার লোক আছে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি একলা থাকেন?’
প্রিয়নাথ বললেন, ‘তা একলা বৈকি। কেষ্ট আমার একমাত্র সন্তান। ওর মা বহুদিন মারা গেছেন। এখন কেবল—’
এই সময় একটি অপরূপ সুন্দরী যুবতী ট্রের ওপর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকল। চোখ-ঝলসানো রূপ, কিন্তু মুখখানি বিষন্ন গম্ভীর। আমি একবার তাকিয়েই ঘাড় নীচু করে ফেললাম। প্রিয়নাথ শুষ্ক স্বরে বললেন, ‘কেষ্টর বৌ—আলপনা।’
আমার মনের মধ্যে বিস্ময় বেড়েই চলেছে। কেষ্টর বৌ আছে! নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে গজগজ করে উঠল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করাও যায় না। আলপনা চা ঢেলে আমাদের দিল, তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে গেল।
চা পান শেষ হলে প্রিয়নাথবাবু বললেন, ‘আপনি বোধ হয় স্নান করবেন?’
বললাম, ‘হ্যাঁ। গায়ে সারাদিনের ধুলো জমেছে।’
প্রিয়নাথবাবু ডাকলেন, ‘আলপনা!’
আলপনা দোরের কাছে এসে দাঁড়াল, বলল, ‘বাথরুমে গরম জল দেওয়া হয়েছে।’ তার গলাটিও বেশ মিষ্টি।
প্রিয়নাথ আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। এটি আমার শয়নকক্ষ। সাজানো ঘর। বিছানা পাতা রয়েছে, খাটের পাশে আমার স্যুটকেস। প্রিয়নাথ বললেন, ‘পাশেই বাথরুম, স্নান করে নিন। সাড়ে আটটার সময় খাবার দেবে।’
গরম জলে স্নান করে শরীর সুস্থ হল, কিন্তু মন থেকে কিষ্টোলালের রহস্যময় জীবন-প্রশ্ন দূর হল না। প্রিয়নাথবাবু যে বলেছিলেন, বাড়িতে বাঘ আছে, তা কি আলপনাকে লক্ষ্য করে? আলপনা দেখতে এত সুন্দর, তবে কি তার স্বভাবে কিছু দোষ আছে?
সাড়ে আটটার সময় প্রিয়নাথবাবু এবং আমি টেবিলে খেতে বসলাম। আলপনা আমাদের সঙ্গে বসল না, নিঃশব্দে নানারকম অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করল।
খাওয়া শেষ হলে আমরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম। প্রিয়নাথ বললেন, ‘আলপনা, তুমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়। আর, প্যারেলালকে পাঠিয়ে দাও।’
আলপনা চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে প্যারেলাল নামক ভৃত্য এসে বোতল আর গ্লাস রেখে গেল।
প্রিয়বাবু আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করলেন; আমি মাথা নাড়লাম। তিনি তখন নিজের জন্যে সোডা মিশিয়ে এক গ্লাস তৈরি করলেন। আমি সিগারেট ধরালাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। প্রিয়বাবু মাঝে মাঝে গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন। শেষে আমি বললাম, ‘কেষ্টকে আমার খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু ওর ব্যাপার কিছু বুঝলাম না।’
প্রিয়বাবু বললেন, ‘আমি ওর বাপ, আমিই বুঝিনি তা আপনি বুঝবেন কোত্থেকে।’
অতঃপর গেলাসে চুমুক দিতে দিতে প্রিয়বাবু তাঁর ছেলের জীবনচরিত আমাকে শোনালেন।
কেষ্টর মা মারা যান যখন তার বয়স দশ বছর। বাড়িতে আর কেউ নেই, কেবল ঝি চাকর। আমি সারাদিন কোর্টে কাজ করি, সকাল বিকেল মক্কেল নিয়ে বসি। কেষ্ট ঝি-চাকরের কাছেই মানুষ হতে লাগল।
কেষ্ট তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ছোটলোকের ছেলেদের সঙ্গে লাট্টু ঘুরিয়ে পতং উড়িয়ে বেড়াতে লাগল। আমার কানে যখন কথাটা এল তখন আমি দু’ একটা চড়-চাপড় মারলাম, কিন্তু তাতে কোনোই ফল হল না। আমি কোন দিক দেখব, ভাবলাম দূর ছাই, যা ইচ্ছে করুক, বয়স বাড়লে বুদ্ধি পাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হাজার হোক, ভদ্রবংশের ছেলে। রোজগার তো আর করতে হবে না, আমি যা রেখে যাব তাই যথেষ্ট। লেখাপড়া নাই শিখল। লেখাপড়া শিখেও তো কত ছেলে হনুমান হয়।
ওর যখন সতেরো-আঠারো বছর বয়স তখন ও আমার কাছে তিনশো টাকা চাইল। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা দিলাম। ও মাঝে মাঝে আমার কাছে দু’ দশ টাকা চাইত, আমি টাকা দিতাম। জানতাম টাকা না দিলে চুরি করতে শিখবে।
তিনশো টাকা পেয়ে কেষ্ট একটা টাঙা আর একটা ঘোড়া কিনে এনে আস্তাবলে রাখল। আমি একটু বকাবকি করলাম। আমার একটা বগী গাড়ি, একটা ফিট্ন এবং দুটো ঘোড়া রয়েছে, আবার টাঙা কেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে।
কেষ্ট টাঙা হাঁকিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। শহরের যত টাঙাওয়ালা সবাই তার বন্ধু। সে মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে আসত, অনেক রাত পর্যন্ত আস্তাবলে খানা-পিনা হৈ হুল্লোড় করত। আবার কেষ্ট মাঝে মাঝে বাড়ি আসত না, বন্ধুদের আড্ডায় হৈ হুল্লোড় করত।
এইভাবে বছর পাঁচেক কেটে গেল। কেষ্ট বাংলায় কথা বলা প্রায় ভুলে গেল, উর্দুতেই কথা বলে; তার পোশাক পরিচ্ছদও টাঙাওয়ালা গাড়োয়ানের মতো; মাথায় টুপি পরে, চোখে সুর্মা লাগায়। আমার বন্ধুরা ক্রমাগত আমাকে খোঁচাচ্ছেন—ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল, ছোটলোক হয়ে গেল, তুমি দেখছ না। আরে আমি কি করব। যার যেমন ধাত, গাধা পিটিয়ে কি ঘোড়া করা যায়। তবে একটা কথা বলব, ছোটলোকদের সঙ্গে মিশলেও ওর মনটা ছোট হয়ে যায়নি। উঁচু ঘরে জন্মেছিল, মেজাজটা উঁচুই আছে। সহবতটা শুধু মন্দ।
এক বন্ধু উপদেশ দিলেন, ছেলের বিয়ে দাও, তাহলে ঘরে মন বসবে। ভাবলাম, মন্দ কথা নয়। অনেক খুঁজে একটি লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মেয়ে যোগাড় করলাম। কেষ্ট প্রথমটা তানানানা করেছিল, তারপর রাজী হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে গেল। আলপনাকে আপনি দেখেছেন, রূপেগুণে অমন মেয়ে পৃথিবীতে নেই।
কেষ্ট বিয়ের পর সাত দিন বাড়িতে ছিল, তারপর দুপুর রাত্রে টাঙা নিয়ে নিরুদ্দেশ। সেই যে পালাল, ছ’মাস আর বাড়ি-মুখো হল না।
আমার শাস্তিটা একবার বুঝে দেখুন। একটা মেয়ের সর্বনাশ করলাম। ছেলেটা আগে তবু বাড়িতে থাকত, এখন ন’মাসে ছ’মাসে একবার আসে; হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে যায়, আলপনার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করে না।
প্রিয়বাবু গেলাস শেষ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন—‘এইভাবে তিন বছর চলছে। জানি না কোনোদিন কেষ্টর মতিগতি ফিরবে কিনা। কেন বৌকে ফেলে চলে গেল তাও কিছু বলে না। আমার কাছে টাকা চায় না, টাঙা ভাড়া খাটিয়ে খায়। আমি আর কি করতে পারি। আলপনাকে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছি, সে এখন বি. এ. পড়ছে। —’
মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে-রাত্রে কিষ্টোলালের বিচিত্র দুর্মতির কথা ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ জেগে রইলাম।
পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠেছি, কিষ্টোলাল টাঙা নিয়ে এসে হাজির। প্রিয়বাবু তখন বৈঠকখানায় মক্কেল নিয়ে বসেছেন। কিষ্টোলাল তাড়াতাড়ি আমাকে টাঙায় তুলে টাঙা হাঁকিয়ে দিল। পাছে বৌ-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাই বোধহয় বেশীক্ষণ রইল না।
আমি বললাম, ‘এত তাড়া কিসের? আর কী দেখবার আছে?’
কিষ্টোলাল বলল, ‘আভি বহুৎ চিজ্ দেখার আছে। জুমা মসজিদ, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, হুমায়ুঁ বাদশার কবর, সফদরজঙ্গ, যন্তর-মন্তর। ঔর দো দিন লাগবে।’
কিছু দূর যাবার পর আমি বললাম, ‘কিষ্টোলাল, তোমার ঘরে এমন বৌ, তুমি ঘরে থাক না কেন?’
কিষ্টোলাল চকিত চোখে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে একটা দুষ্টুমির ভাব খেলে গেল। সে বলল, ‘আলপনাকে দেখেছেন!! খুবসুরৎ ছোরি আছে।’
যেন নিজের বৌ নয়, অন্য কার কথা বলছে। বললাম, ‘অমন খুবসুরৎ মেয়ে খুব কম দেখা যায়। তুমি ওর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াও কেন?’
কিষ্টোলাল কিছুক্ষণ মিটিমিটি হাসল, তারপর বলল, ‘খুবসুরৎ তো আছে, লিখা পঢ়া ভি বহুৎ জানে। লেকেন—দিল বৈঠতা নেই।’
‘তার মানে! ওর স্বভাব কি ভাল নয়?’
‘স্বভাব ভি বহুৎ আচ্ছা, লেকেন—’ কিষ্টোলাল মনের কথাটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না।
আর কিছু বলা চলে না। বলবার কী বা আছে। ও যদি নিজের বৌকে পছন্দ না করে আমি মাথা গলাতে যাই কেন?
খানিক পরে কিষ্টোলাল নিজেই অন্য কথা পাড়ল। সাঁই সাঁই করে চাবুক ঘুরিয়ে ঘোড়াকে গালমন্দ দিয়ে বলল, ‘আপনার রামবিলাসের খোঁজে লোক লাগিয়েছি, এখনো পাত্তা পাওয়া যায়নি।’
আমি বললাম, ‘তার পাত্তা কি সহজে পাওয়া যাবে। সে গা ঢাকা দিয়ে আছে।’
‘মিলেগা মিলেগা’ বলে কিষ্টোলাল গান ধরল—
‘নজর বাঁচাকে হম্সে প্যারে
ছুপ্ কিঁউ যাতে হো–’
দিল্লী শহরের পুরাকৃতি দেখতে খুবই ভাল লাগে, কিন্তু অসুবিধা এই যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে অনেক সময় নষ্ট হয়। সেদিন দুটো জায়গা দেখতেই বেলা একটা বেজে গেল। বললাম, ‘কিষ্টোলাল, বেজায় ক্ষিদে পেয়ে গেছে। চল, কোথাও গিয়ে খাওয়া যাক।’
কিষ্টোলাল হেসে বলল, ‘খোদাবন্দ্, খানা তৈয়ার।’
এবার কিষ্টোলাল আমাকে যেখানে নিয়ে এল সেটা শহর বাজার নয়, একটা এঁদোপড়া বস্তি। গলির মধ্যে ছোট ঘোট একতলা বাড়ি, বেশীর ভাগই খাপরার ছাউনি, দু’ একটা পাকা বাড়ি আছে।
কিষ্টোলাল একটি ছোট্ট চুনকাম-করা কুটিরের সামনে টাঙা দাঁড় করালো। কুটিরের দোর বন্ধ ছিল, টাঙা থামতেই একটুখানি ফাঁক হল; ফাঁকের মধ্যে দিয়ে একটি মেয়ের হাসি-মুখ দেখতে পেলাম।
কিষ্টোলাল টাঙা থেকে লাফিয়ে নেমে বলল, ‘জান্কি, আয়, ঘোড়াটাকে দানাপানি দে।’
আমিও নেমে পড়লাম। মেয়েটি এসে ঘোড়ার রাশ ধরে নিয়ে গেল।
কিষ্টোলাল দোরের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করল,—‘আসুন, আমার গরিবখানায়।’
আমাকে মাথা নীচু করে ঘরে ঢুকতে হল, নইলে চৌকাঠে মাথা ঠুকে যাবে। পাশাপাশি ছোট দুটি ঘর, সামনের ঘরের মেঝেয় শতরঞ্জির ওপর জাজিম পাতা, পাশের ঘরটি রান্নাঘর। আসবাবপত্র খাট পালঙ্ক কিছু নেই, কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
জাজিমের ওপর বসে বললাম, ‘এটা তোমার বাসা। এখানেই খাবার ব্যবস্থা?’
কিষ্টোলাল আমার পাশে বসে বলল, ‘জি।’
‘মেয়েটি কে?’
কিষ্টোলাল গলার মধ্যে গিল্গিল্ করে হাসল, আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘জান্কী, আমার দিল্কি পিয়ারী।’
গুম হয়ে গেলাম। যা সন্দেহ করেছিলাম, তা মিথ্যে নয়।
কিছুক্ষণ পরে জান্কী ফিরে এল। কিষ্টোলাল বলল, ‘জান্কি, ইনি আমার দোস্ত, আমার জাত-ভাই, অনেক দূর মুলুক থেকে এসেছেন। যাও, জলদি খাবার নিয়ে এস। এঁর ভারি ভুখ্ লেগেছে।’
‘আভি লাঈ।’ জান্কীর মুখে এক ঝলক হাসি খেলে গেল, সে রান্নাঘরে ঢুকল।
জান্কী নিম্নশ্রেণীর মেয়ে, বয়স উনিশ-কুড়ি। কৃশাঙ্গী, লম্বা ধরনের গড়ন, রঙ ময়লা। রূপে সে আলপনার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের কাছেও লাগে না। কিন্তু তবু সুশ্রী বলতে হবে। হাসিটি স্বতঃস্ফূর্ত, চঞ্চল চোখ দুটিও হাসি ভরা। গলার স্বরে তীক্ষ্ণতা নেই। মনে হয় স্বভাবটি প্রসন্ন এবং জটিলতাবর্জিত।
অচিরাৎ খাবার এসে পড়ল। পদ বেশী নয়, এক জামবাটি মাংস, ফুল্কা রুটি আর চুকন্দরের আচার। জাজিমের ওপর জামবাটি টেনে নিয়ে বসে গেলাম।
মাংস মুখে দিয়ে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলাম। কালিয়া কোর্মার মতো স্বাদ নয়, এ স্বাদ একেবারে অন্যরকম। আরো বলিষ্ঠ, আরো উপাদেয়। ঝাল একটু বেশী, কিন্তু পেঁয়াজের নামগন্ধ নেই।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে রেঁধেছে?’
কিষ্টোলাল বলল, ‘জান্কী রেঁধেছে, আর কে রাঁধবে? ভাল হয়নি?’
বললাম, ‘অপূর্ব হয়েছে। মাংসের এমন রান্না আগে কখনও খাইনি। কী দিয়ে রেঁধেছে?’
কিষ্টোলাল হো হো করে হেসে উঠল, ‘স্রেফ্ আদা রসুন আর গরমমশলা, রসুন বেশী লাগে। এর নাম—মদের চাট্।’
মদের চাট্। আগে কখনও খাইনি। যদি জানতাম মদের সঙ্গে এমন চাট্ পাওয়া যায়—
আকণ্ঠ রুটি-মাংস খেয়ে জাজিমের ওপরেই লম্বা হলাম। পান চিবোতে চিবোতে ভাবতে লাগলাম, শুভক্ষণে কিষ্টোলালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এখানে এসে বিনা খরচে আছি, বিনা খরচে রাজভোগ খাচ্ছি। কিষ্টোলালের প্রবৃত্তি যত নিম্নগামীই হোক, তার মেজাজটা ভারি উঁচু আর দরাজ। গ্রহনক্ষত্রের কীরকম যোগাযোগ ঘটলে এরকম মানুষ জন্মায়?
সঙ্গে সঙ্গে আলপনার কথাও মনে পড়ল। অতি বড় সুন্দরী না পায় বর। আলপনা স্বামীকে পেয়েও পেল না। অথচ না পাওয়ার কোনও ন্যায্য কারণ নেই। বিচিত্র সংসার!
একবার কৌতুহল হল কিষ্টোলালকে জিজ্ঞেস করি জান্কীকে সে বিয়ে করেছে কিনা। কিন্তু প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেলাম। থাক, কাজ নেই। কিষ্টোলাল হাঁ-না যেমন উত্তরই দিক, আমার মন খারাপ হয়ে যাবে।
বেলা তিনটে নাগাদ উঠে পড়লাম। দিল্লীর পুরাকৃতি অপেক্ষা করে আছে, তাকে নিরাশ করা চলবে না।
সেদিন প্রত্ন-দর্শন শেষ করে প্রিয়নাথবাবুর বাড়িতে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। দেখলাম প্রিয়নাথবাবু ড্রয়িংরুমে পুত্রবধূর সঙ্গে দাবা খেলছেন।
কিষ্টোলাল আমাকে নামিয়ে দিয়ে ভাড়া নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল, বলে গেল কাল সকালে আবার আসবে। যা কিছু দ্রষ্টব্য বাকি আছে কালকের মধ্যে শেষ করা যাবে।
প্রিয়নাথবাবু আমাকে ডেকে নিলেন যেন আমি বাড়ির একজন হয়ে গেছি। আলপনা চা এনে দিল। আজ সে আমাদের কাছেই বসে রইল, উঠে গেল না। চা খেতে খেতে অলসভাবে গল্প করতে লাগল; কোথায় কী দেখলাম এই সব। কিষ্টোলালের কথা এড়িয়ে গেলাম। যতবার আমার চোখ আলপনার ওপর পড়ল ততবার আমার জান্কীর কথা মনে পড়ল। আলপনার তুলনা নেই; ধীর শান্ত মিতভাষিণী। কিন্তু জান্কীর মতো মদের চাট্ রাঁধতে পারে কি?
তারপর স্নান করে যথারীতি ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আলপনার সঙ্গে জান্কীর তুলনাটা কিন্তু মনের মধ্যে চলতেই লাগল। রাজহংসী আর গৃহকপোতী—ইলিশ মাছ আর মৌরলা মাছ—মুর্গির রোস্ট আর মদের চাট্—
পরদিন সকালে টাঙায় চড়ে বেরিয়েছি, কিষ্টোলাল বলল, ‘আপনার রামবিলাসের পাত্তা পেয়েছি। কঞ্জর—কটা চোখ—না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবিটা তোমাকে দেখানো হয়নি; বেরালের মতো কটা চোখ। কোথায় পেলে তাকে?’
‘শহরতলির একটা মুসাফিরখানা আছে। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে জুয়ার আড্ডায় গিয়ে জুয়া খেলতে বসে।’
‘জুয়া খেলতে বসে! বল কি?’
‘হাঁ। লৌণ্ডা পাকা জুয়াড়ী আছে।’
‘তবে উপায়! চল, এখনি তাকে ধরি গিয়ে।’
কিষ্টোলাল মাথা নেড়ে বলল, ‘আভি ধরতে গেলে শিকার পালাবে। ওর পাকিটমে এখনো টাকা আছে।’
‘তাই নাকি? তাহলে—?’
কিষ্টোলাল কুটিল হেসে বলল, ‘আপনি বে-ফিকির থাকুন। আজ রাতকো হাম্ভি জুয়া খেলেগা। জুয়া খেলা কাকে বলে বাচ্চুকে শিখিয়ে দেব।’
সেদিন দিল্লী দর্শন শেষ করে ফিরে এলাম। ওদিকে রামবিলাসের একটা হেস্তনেস্ত আজ রাত্রেই হয়ে যাবে। আমার দিল্লীর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। —
সেই ক’দিনের জন্যে একটি ভদ্র পরিবারের সংসর্গ আমার মনে এমন একটা দাগ কেটেছিল যা চল্লিশ বছরেও মুছে যায়নি। প্রিয়নাথবাবুর অতিথিবাৎসল্য এবং উদার সহৃদয়তা, আলপনার লাবণ্যপূর্ণ গাম্ভীর্য, কিষ্টোলাল ও জান্কীর বিচিত্র খাপছাড়া জীবনযাত্রার কথা যখন মনে পড়ে তখনই ওদরে সম্বন্ধে একটা দুনির্বার কৌতুহল জেগে ওঠে। তারা এখন কোথায়? প্রিয়নাথবাবু নিশ্চয় বেঁচে নেই। কিন্তু কিষ্টোলাল আলপনা ও জান্কীর ত্রিকোণ-সমস্যার কি কোনও সমাধান হয়েছে? কিষ্টোলাল কি এখনও টাঙা হাঁকাচ্ছে?
বছর পাঁচেক আগে একবার দিল্লী গিয়েছিলাম। দিল্লী আর সে দিল্লী নেই; নতুন এবং পুরনো দিল্লী মিলে এক বিপুল ব্যাপার। তার জনসমুদ্রে কিষ্টোলালকে খোঁজার চেষ্টা করিনি।
কিন্তু যাক।—
পরদিন সকালে মালপত্র কিষ্টোলালের টাঙায় তুলে প্রিয়নাথবাবুর কাছে বিদায় নিলাম। তিনি বললেন, ‘আবার যদি এদিকে আসো আমার কাছেই থাকবে।’
বললাম, ‘আজ্ঞে, আর কোথাও থাকতে পারব না।’
হৃদয়ের পূর্ণতা সব সময় কথায় প্রকাশ করা যায় না, আমার হৃদয়ের পূর্ণতাও বোধ হয় অপ্রকাশিত রয়ে গেল। তাছাড়া আলপনা ও জান্কীর মাঝখানে আমার মনটা এমন ফাঁপরে পড়ে গিয়েছিল যে কিষ্টোলালকে ধরে কেবল ঠ্যাঙাতে ইচ্ছে করছিল। এরকম পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তার কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। জান্কীকে ছেড়ে কিষ্টোলাল যদি আলপনার কাছে ফিরে আসে, তাহলেই কি ভাল হয়! যদি ফিরে না আসে আলপনার মতো একটা মেয়ের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে!
দুত্তোর! যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, আমি কি করব। কিষ্টোলালের মনে কোনও ভাবনা নেই, সে নিজের পথ বেছে নিয়েছে, সেই পথে গাড়োয়ানী করে বেড়াক। আমার কিসের মাথাব্যথা।
টাঙায় উঠে গোঁজ হয়ে বসে রইলাম। কিষ্টোলাল টাঙা চালিয়ে দিল। কিছু দূর গিয়ে সে গুনগুন করে গান ধরল—
চলো ভাই মুসাফির য়ে জগ্ হ্যয় সরায়ে
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
সে বলল, ‘মুসাফিরখানায়, যেখানে আপনার রামবিলাস আছে। কাল রাত্রে তাকে ল্যাংটা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি!’
শহরতলির সরায়ে পৌঁছে দেখলাম রামবিলাস কাঁচামাচু মুখে দোরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, আর গোটা কয়েক ষণ্ডাগুণ্ডা গোছের লোক তাকে ঘিরে আছে। আমি টাঙা থেকে নামতেই সে আমাকে দেখতে পেল, ছুটে এসে আমার দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল—‘কাকাবাবু, আপনি এসেছেন আমাকে রক্ষে করুন। আমার সব টাকা ফুরিয়ে গেছে। সরাইওয়ালার পাওনা দিতে পারছি না। সে বলছে টাকা না দিলে আমাকে খুন করবে।’
আমি কিষ্টোলালের দিকে তাকালাম। সে টাঙা থেকে নেমে এসে চোখ টিপলো। বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই। আমি কাল জুয়াতে অনেক টাকা জিতেছি, আমি সরাইওয়ালার পাওনা চুকিয়ে দেব।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে লেন-দেন চুকিয়ে আমরা স্টেশনে গেলাম। ভাগ্যক্রমে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একটা পূর্বগামী ট্রেন আছে।
ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত কিষ্টোলাল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেন ছাড়ার দু’মিনিট আগে আমি তাকে আলিঙ্গন করে বললাম, ‘তোমার দিল্কি পিয়ারিকে বোলো তার রান্না আমার খুব ভাল লেগেছে। আবার যদি কখনো আসি, মদের চাট্ খাওয়াতে হবে।’
কিষ্টোলাল এক গাল হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
২৫ মে ১৯৬৫