কিশোরীমোহনপুরের রয়েল বেঙ্গল – প্রচেত গুপ্ত

কিশোরীমোহনপুরের রয়েল বেঙ্গল – প্রচেত গুপ্ত

আমি দম বন্ধ করে বললাম, ‘তারপর?’

সায়নের ছোটোমামা একটু সময় চুপ করে থেকে বললেন, ‘তারপরই হল আসল গোলমাল। বাঘ গেল উধাও হয়ে। ভ্যানিশ হয়ে গেলও বলতে পারো। গোটা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। সবার মাথায় হাত। কোথায় গেল, বাঘ তো পাখি নয় যে উড়ে যাবে!’

সায়নের ছোটোমামাকে আমরাও ছোটোমামা ডাকি। মাঝে মধ্যে রবিবার করে উনি সায়নদের বাড়ি আসেন। খবর পেয়ে আমরাও চলে যাই। এখন গল্প বলার লোক একদম কমে গিয়েছে। এই মানুষটা দারুণ গল্প বলতে পারেন।

অঙ্কুর সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসল। চোখ বড়ো-বড়ো করে বলল, ‘নিশ্চয়ই পালিয়ে গিয়েছে?’

ছোটোমামা মাথা নেড়ে বললেন, ‘পালানো কঠিন। ধানখেতের খানিকটা জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে রাস্তা। সেদিকে ফরেস্ট গার্ডরা বন্দুকে ঘুমপাড়ানি গুলি পুরে বসে আছে।’

কিংশুক বলল, ‘ছোটোমামা, বাঘটা ভূত-টুত নয় তো?’

সায়ন ধমক দিয়ে বলল, ‘তুই চুপ কর তো। বাঘ কখনো ভূত হয়?’

আমি মোড়ার উপর বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম। আমরা পকোড়া খেতে চেয়েছিলাম। ছোটোমামা বলেছেন, ‘ওসব পকোড়া, স্যাণ্ডউইচ, পিৎজা আমার চলবে না বাপু। মুড়ি, আলুর চপ চাই। নইলে মাথায় গল্প আসবে না।’

‘আমরা গল্প শুনতে চাই,’ সবাই মুড়ি, আলুর চপের জন্য হাত তুললাম। সায়নের মা তেল-আচার দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছেন। আমরা সায়নদের ড্রয়িংরুমে বসে মুড়ি, আলুর চপ আর বেগুনি খাচ্ছি। বললাম, ‘ঝোপ-জঙ্গল সব দেখা হয়েছিল তো?’

সায়ন দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘না, হয়নি। তোর জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল। তুই গেলে তারপর কাজ শুরু হবে।’

ছোটোমামা বললেন, ‘আহা, রাগারাগি কেন? কিশোরীমোহনপুর গ্রামের সকলেরই তো চিন্তায় চুল খাড়া হয়ে গিয়েছে। দিন-দুপুরে একটা বাঘ গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেলটা কোথায়?’

রবিবারের সকাল। ছোটোমামা এসেছেন খবর পেয়ে আমি, অরণি, কিংশুক, অঙ্কুর, নন্দন চলে এসেছি সায়নদের বাড়ি। অরণি বলল, ‘এবার পুজোয় আমরা বাঘ দেখতে যাচ্ছি।’

নন্দন মজা করে বলল, ‘বাঘ দেখতে? চিড়িয়াখানায় যাবি নাকি?’

কিংশুক বলল, ‘চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কী দরকার? আমি তোকে বাঘের ক-টা ভালো ফোটো মেল করে দিচ্ছি, বাড়িতে সেগুলোই দেখে নিস।’

অরণি মুচকি হেসে বলল, ‘আমি কিছুই মনে করব না। কারণ, আমি যাচ্ছি মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় টাইগার স্যাংচুয়ারি দেখতে। আশা করি, তোরা নাম শুনেছিস। যদি না শোনা থাকে, তাহলে আমার কাছ থেকে জেনে নে। বান্ধবগড় হল বাঘেদের রিজার্ভ ফরেস্ট। খুব বিখ্যাত। গোটা পৃথিবী থেকে টুরিস্টরা এখানে বাঘ দেখতে আসেন। জঙ্গলের ভিতর দারুণ-দারুণ সব বাংলো। রাতে বাঘের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। জানলার পরদা সরিয়ে দেখতে পাবি, গেটের বাইরে বাঘ ঘুরঘুর করছে। আবার দিনে বা রাতে জিপ নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরেও বাঘ দেখা যায়।’

অরণির কথা শুনে আমাদেরই চোখ চকচক করে উঠল। কিংশুক বলল, ‘ইস! সামনা-সামনি বাঘ দেখার মতো উত্তেজনা আর কীসে আছে?’

ছোটোমামা এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথা শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘বেড়াতে যাচ্ছ যাও, কিন্তু ও বাঘ দেখার মধ্যে আর উত্তেজনা কোথায়? ও তো প্রায় চিড়িয়াখানার মতোই হল। সুন্দরবনের বাঘের মুখোমুখি যদি পড়তে, একটা ব্যাপার ছিল। বাঘ দেখা কাকে বলে বুঝতে!’

আমরা গল্পের গন্ধে নড়ে বসলাম। বললাম, ‘বাঘ দেখেছেন ছোটোমামা?’

ছোটোমামা মুচকি হেসে বললেন, ‘দেখেছি, তবে জিপ গাড়ির মাথায় চড়ে নয়। একেবারে তিন হাতের মধ্যে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ফটফটে দিনের আলোয়, তখন ক-টা বাজে? এই ধরো, সকাল ন-টা-সাড়ে ন-টা। কলকাতায় অফিস-টাইম যাকে বলে।’

সায়ন বলল, ‘গল্পটা বলতে হবে।’

আমরাও একসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলতেই হবে।’

ছোটোমামা বললেন, ‘গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।’

কিংশুক বলল, ‘তা-ই বলুন।’

ছোটোমামা বলতে শুরু করলেন, ‘তিন বছর আগের ঘটনা। আমি তখন কলকাতা থেকে বদলি হয়ে ক্যানিংয়ের কাছে একটা অফিসে বসি। অফিসের জানলা দিয়ে মাতলা নদী দেখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে, একবার সুন্দরবন দেখে আসব। এখানে এসে সুন্দরবন দেখতে না যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। এই সুযোগ দুম করে এসেও গেল। আমাদের অফিসে পিয়োনের কাজ করে সহদেব, ভারি ভালো ছেলে। সে একদিন ঘরে এসে বলল, ‘‘স্যার, আমার গ্রামের বাড়িতে দুটো ডাল-ভাত খেতে হবে’’।’

আমি বললাম, ‘তোমার গ্রাম কোথায়?’ সহদেব বলল, ‘একেবারে সুন্দরবনের গায়ে, কিশোরীমোহনপুর।’

আমি বললাম, ‘বা:, ভারি সুন্দর নাম তো!’ সহদেব বলল, ‘আমাদের গ্রামটাও সুন্দর স্যার। কাছেই নদী। নদীর নাম ঠাকুরান। নদী পেরোলেই জঙ্গল। আজমলমারি জঙ্গল। দুটো দিন যদি থাকেন, তাহলে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের দিকটা ঘুরিয়ে আনব। ভাগ্য যদি ভালো হয়, বাঘ দেখা হয়ে যেতে পারে।’

‘তোমরা তো জানো, গ্রামের মানুষ কত আন্তরিক হয়! তাদের নেমন্তন্ন ফেরানো খুব মুশকিল। তা ছাড়া সুন্দরবন আর বাঘ দেখার সুযোগ কে ছাড়ে! এক শনিবার বিকেলে কিশোরীমোহনপুরে গিয়ে হাজির হলাম। সত্যি চমৎকার গ্রাম। সহদেবের বাড়িটাও চমৎকার। খিড়কির দরজা খুললেই একটা মন ভালো করে দেওয়া পুকুর। টলটলে জল। লাল সিমেন্টে বাঁধানো ঘাট। পুকুর শেষ হলে যত দূর চোখ যায়, ধানখেত চলেছে।’ সহদেব বলল, ‘ধানখেত শেষ হলেই ঠাকুরান নদী। নদীপথে কিছুটা গেলে জঙ্গল।’

‘জার্নিতে খুব ক্লান্ত ছিলাম। খাওয়ার পর ঠিক হল, পরদিন দুপুরে সুন্দরবন যাত্রা। সহদেব লঞ্চের ব্যবস্থা করবে। দুপুরে খাওয়ার পর রওনা হব। রাত কাটাব নদীতে। পরদিনও নদী, খাঁড়ি ধরে যতটা পারি ঘুরে ফিরে আসব সন্ধ্যের আগে।’

ছোটোমামা চুপ করলেন। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বললাম, ‘সত্যিকারের বাঘের দেখা কি পেলেন?’

ছোটোমামা হেসে বললেন, ‘পেলাম, তবে জঙ্গলে নয়। একেবারে গ্রামের ভিতরে।’ একটু থেমে ছোটোমামা শুরু করলেন, ‘পরদিন সকালে লুচি, আলুর দম দিয়ে জলখাবার খাওয়ার পর সহদেব বলল, ‘‘স্যার, আপনি গ্রামটা একটু ঘুরে দেখুন, আমি ততক্ষণে লঞ্চের ব্যবস্থা করে ফেলি। বারোটা নাগাদ রওনা দেব’’।’

‘আমি বেরিয়ে পড়লাম। আগেই তো বলেছি, গ্রামটা সুন্দর। আমি গোটা গ্রামটাই প্রায় চষে ফেললাম। তারপর ফেরার জন্য ধানখেতের পাশ দিয়ে চলে-যাওয়া মেঠো পথ ধরলাম। ধানখেত ধরে গেলে একেবারে শেষ প্রান্তে সহদেবের বাড়ি।’ ছোটোমামা দম নেওয়ার জন্য চুপ করলেন।

সায়ন বলল, ‘তারপর কী হল?’

ছোটোমামা এবার নীচু গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘তখনই পাশের ধানখেতের খানিকটা জায়গা নড়ে উঠল যেন! কীসে নড়ল, হাওয়ায়? নিশ্চয়ই তাই হবে। তারপর খানিকটা খসখসে আওয়াজ। আওয়াজটা ঠিক ধান গাছের হাওয়ায় দোলার মতো নয়। মনে হল, কে যেন নড়ছে। মুহূর্তের জন্য বিটকেল একটা গন্ধ পেলাম। গন্ধটা কেমন চেনা চেনা। আগেও কোথাও যেন পেয়েছি। নিমেষে মনে পড়ল, চিড়িয়াখানায়। সঙ্গেসঙ্গে বাঘটাকে দেখতে পেলাম। বাঘ নয়, বাঘের মুখ। সেই মুখ ধান গাছের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার! কী মারাত্মক! বুঝতে পারলাম, শরীরের সব রক্ত যেন আতঙ্কে জমে যাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছি না। মাত্র তিন হাত দূরে থাকা রয়েল বেঙ্গল আমাকে সম্মোহন করে ফেলেছে। মনে হল, হঠাৎ মানুষ দেখে বাঘটাও যেন ঘাবড়েছে। ঘোর কাটতেই বিপদ বুঝতে পারলাম। আমি পালাতে পারলাম না। ভাবতে না ভাবতেই চাপা গরগর আওয়াজ তুলে সুন্দরবনের মহারাজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন, মিলিয়ে গেলেন ধানখেতে। এরপর আমি যে কীভাবে সহদেবের বাড়ি পৌঁছেছিলাম, সে শুধু আমিই জানি।’

ছোটোমামা থামলেন। আমরাও যেন আর কথা বলতে পারছি না। ফের গল্প শুরু হল।

‘বাড়ি গিয়ে ঘটনাটা বলতেই সহদেব ছিটকে বেরিয়ে পড়ল। সুন্দরবনের গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়া নতুন কিছু নয়। এতে ভয়ংকর কান্ড হয়। গোরু, ছাগল তো মরেই, এমনকী মানুষও টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলে।

আধঘণ্টারও কম সময়ে গোটা গ্রাম জেনে গেল। লাঠিসোঁটা, বল্লম, যে যা পারল হাতে নিয়ে ছুটে গেল ধানখেতের দিকে। আমার তখন ভয় করতে শুরু করেছে। ভুল দেখিনি তো? তাহলে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে! না, ভুল দেখিনি। ধানখেতে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। ধানখেত পার হয়ে আলপথ ডিঙিয়ে সেই পায়ের ছাপ উধাও। বলতে পারো ভ্যানিশ আর তারপর শুরু রহস্য।’

চা শেষ করে কাপ নামিয়ে রাখলেন ছোটোমামা। বললেন, ‘গ্রামের মধ্যে বাঘ ঢুকে লুকিয়ে পড়া যে কী ভয়ংকর ব্যাপার, তা কেবল সুন্দরবনের মানুষই জানেন। গ্রামের মানুষ ধানখেত ঘিরে ফেলল। খবর দেওয়া হল গোসাবার ফরেস্ট অফিসে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিরাট দলবল নিয়ে রেঞ্জার বিমল পান্ডে চলে এলেন। সেই দলে দেখি বন্দুকও আছে, আবার ঢাক, ঢোল, পটকা, কাঁসরঘণ্টা, জালও আছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের অফিসার নিলয় গুহও বন্দুক নিয়ে এসে হাজির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যে। তিনি ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে বাঘ, ভল্লুক ঘুম পাড়াতে ওস্তাদ। অনেকে তাঁকে ঘুমপাড়ানি অফিসার নামে ডাকে। নিলয়বাবু আমাকে ধানখেতের পাশে নিয়ে গেলেন। আমি দেখিয়ে দিলাম ঠিক কোন জায়গায় বাঘটাকে আমি দেখেছি।’ নিলয়বাবু বললেন, ‘বাঘটা নিশ্চয়ই আজমলমারির জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঠাকুরান নদী পার হয়ে এসেছে।’

‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন জাল দিয়ে ধানখেতের খানিকটা ঘিরে ফেলল। একদিকে গাছের উপর বন্দুক নিয়ে বসলেন অফিসার আর রেঞ্জারবাবু। তারপর তেড়ে ঢাক-ঢোল, টিনের ক্যানেস্তারা পেটানো শুরু হল। বাপরে! কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। সেই সঙ্গে ফাটানো হচ্ছে পটকা। ধানখেত ঘিরে ফেলা জালটিকে ধীরে-ধীরে চারপাশ থেকে ছোটো করে আনা হচ্ছে। পরিকল্পনা হল, বাঘ খোলা দিক দিয়ে পালাবে। বেরিয়ে আসবে ধানখেত থেকে। আর তখনই গুলি ছোড়া হবে। কোথায় কী? জাল গুটিয়ে গেল, বাঘ ধানখেত থেকে বেরোলো না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মীরা ঘোষণা করলেন, ‘‘বাঘবাবাজি ধানখেতে লুকিয়ে নেই। তিনি অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়েছেন’’।’

অরণি বলল, ‘কোথায় গা ঢাকা দিল?’

নন্দন বলল, ‘অত বড়ো একটা চেহারা নিয়ে গা ঢাকা দেওয়া যায় নাকি?’

কিংশুক ঢোক গিলে বলল, ‘অসম্ভব।’

ছোটোমামা বললেন, ‘কিছুই অসম্ভব নয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রাণীটি অত্যধিক বুদ্ধিমান শুনেছিলাম। কিন্তু তার বুদ্ধির পরিমাণ যে এতখানি, তা জানতাম না। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, বাঘ ধানখেতে নেই, গ্রামের মানুষের আতঙ্ক আরও দশ গুণ বেড়ে গেল। নিলয়বাবু এবার বললেন, ‘‘গ্রামের ভিতরে ঢুকে তল্লাশি করতে হবে’’।’

‘তাই শুরু হল। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। সবার আগে বন্দুক হাতে নিলয়বাবু আর পান্ডে। পিছনে লাঠিসোঁটা, বল্লম নিয়ে একদল, তার পিছনে কয়েক-শো গ্রামের মানুষ। বাঘের টিকিও দেখা গেল না। এমনকী বাঘটা তার পায়ের ছাপটুকুও কোথাও রাখেনি। এদিকে বেলা পড়তে শুরু করেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হব-হব করছে। রেঞ্জারবাবু বললেন, ‘‘যে করেই হোক অন্ধকার নামার আগে খোঁজ চাই। যদি বাঘ গ্রাম ছেড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রমাণটাও দরকার। নইলে ধরে নিতে হবে গ্রামেই গা ঢাকা দিয়ে আছে। রাতে গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি যা পাবে নিয়ে যাবে। মানুষ পেলেও ছাড়বে না’’।’

ছোটোমামার কথার মাঝে অরণি কাঁপা গলায় বলল, ‘বাঘ গ্রামে রয়ে গেল?’

ছোটোমামা হেসে বললেন, ‘সেটাই তো এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। বাঘ কী রয়ে গেল? নাকি সবার অলক্ষ্যে অন্য কোনো পথে ফিরে গিয়েছে ঘন জঙ্গলে? নাকি এমন কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। নিলয়বাবু বললেন, ‘‘ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। গ্রামের সবাইকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। রাতে ঘর ছেড়ে কিছুতেই বেরোনো চলবে না। যদি খুব দরকার হয়, তবে দল বেঁধে বেরোতে হবে। সঙ্গে যেন মশাল বা জোরালো আলো থাকে’’।’

‘ঠিক হল, বাঘের জন্য ফাঁদ পাতা হবে। দুটো ছাগল বেঁধে রাখা হবে গ্রামের দু-দিকে। একদিকে ঘুমপাড়ানি গুলির বন্দুক নিয়ে পাহারায় বসবেন রেঞ্জার বিমল পান্ডে, অন্যদিকে নিলয় গুহ। বাঘ যদি সত্যি গ্রামে থেকে যায়, তাহলে টোপ গিলতে আসবেই। তখনই গুলি করে…।’ আমি বললাম, ‘আর যদি না আসে?’ নিলয়বাবু হেসে বললেন, ‘আসবেই। আপনার বন্ধু সারাদিন কিছু খেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। নিশ্চয়ই তার খিদে পেয়েছে। আপনাকে দেখা দিয়ে যে বেমালুম উবে গেল, তাকে আপনার বন্ধু বলব না? মশাই, ‘‘টাইগার লাক’’ বলে একটা ব্যাপার আছে। বাঘ দেখার ভাগ্য। আপনি লঞ্চে চেপে বনে বাঘ দেখতে যাবেন ভেবেছিলেন, আর উনি নিজে এসে দেখা দিয়ে গেলেন।’

আমি বললাম, ‘আপনাদের সঙ্গে রাত জাগতে পারি?’ পাশেই বিমল পান্ডে ছিলেন। বললেন, ‘ইমপসিবল। একটা কিছু হয়ে গেলে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হবে। আমরা কাউকেই অ্যালাউ করব না।’

‘আমি জেদ ধরলাম। আমাকে সঙ্গে নিতেই হবে। যেহেতু বাঘটাকে কেবল আমিই দেখেছি, আমার থাকার অধিকার আছে।’ নিলয়বাবু খানিকটা ভেবেচিন্তে বললেন, ‘তৈরি হয়ে আসুন। গাছে মাচা বেঁধে থাকতে হবে কিন্তু!’

‘আমি উত্তেজনায় ফুটছি। নিজেকে জিম করবেটের মতো মনে হচ্ছে। দেরি না করে ছুটলাম সহদেবের বাড়ি। অল্প কিছু খাব। সহদেবের পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে নেব। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে হবে। রাত জাগতে হবে না?’

ছোটোমামা থামলেন। আমরাও চুপ করে রইলাম, কথা বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে, নিজেরাই সেই কিশোরীমোহনপুর গ্রামে রয়েছি। উধাও হয়ে যাওয়া বাঘকে খুঁজছি।

সায়ন বলল, ‘তুমি সারারাত জেগে বসে রইলে?’

ছোটোমামা বললেন, ‘দরকার হল না।’

ছোটোমামা আড়মোড়া ভেঙে বললেন, ‘বাড়ি ফিরে সহদেবের কাছে একটা গামছা চাইলাম। বললাম, ‘‘ঝট করে অল্প কিছু খেতে দাও, আমি পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসি। যার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, তার শেষ পর্যন্ত কী হল, জানতে হবে না?’’ আমি খিড়কির দরজা খুলে পুকুরের দিকে চলে গেলাম। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বাঁধানো ঘাটে। নেমে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে, তখনই গরগর আওয়াজ।’

ছোটোমামা চুপ করে আমাদের সকলের দিকে তাকালেন। আমাদের চোখের পাতা কী পড়ছে? মনে হয় না।

ছোটোমামা ফিসফিস করে বললেন, ‘পুকুরঘাটের আড়ালে সে বসেছিল চুপটি করে, গা ঢাকা দিয়ে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যেন অপেক্ষা করেছিল আমারই জন্য। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর জলে লাফ দিল। আলতো আওয়াজ করে অত বড়ো শরীরটা নিয়ে নি:শব্দে সাঁতরে পার হয়ে গেল চোখের নিমেষে। জল থেকে উঠে মিশে গেল ওপারের অন্ধকারে, ধানখেতের মধ্যে। বুঝতে পারলাম, বাতাস উলটো দিকে বইছে বলে বাঘের গায়ের গন্ধও কেউ পায়নি। অথবা বুদ্ধিমান মহারাজ বাতাসের উলটো দিকেই এসে লুকিয়ে ছিল এতক্ষণ। সকালেই সহদেব আমাকে বলেছে, তার বাড়ির পিছনে ধানখেত পেরোলে জঙ্গলে যাওয়ার নদী। গভীর রাতে বাঘ নিশ্চয়ই লম্বা সাঁতার দিয়ে নিজের আস্তানায় পৌঁছে যাবে। আমি পুকুরে ক-টা ডুব দিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম।’

সায়নদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সেই না-দেখা বাঘটার জন্য আমাদের মন কেমন করছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *