1 of 2

কিলিং মিশন – ৯

নয়

এক এক করে প্রতিটি ঘর আবারও ঘুরে দেখল রানা। বেডরুমে আছে ফক্সের ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র। সেগুলোর ভেতরে রয়েছে দুটো সুইস হাতঘড়ি। দাম অন্তত আট লাখ টাকা। ওগুলো ফেলে গেছে খুনিরা। অর্থাৎ আরও জরুরি কিছু খুঁজছিল। লিভিংরুমের সোফার মতই উল্টে দিয়ে গেছে বেডের ম্যাট্রেস।

বাথরুমের ছোট কাবার্ডের জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। বেডরুম, বাথরুম বা লিভিংরুমের মতই তচনচ করা হয়েছে কিচেন। চুলার পাশে থেমে রানার ধারণা হলো, পারতপক্ষে কিচেন ব্যবহার করত না ফক্স। খুলে রাখা হয়েছে ফ্রিযের ডালা। কুকারের পাশে নীল কাগজে লেখা: ত্রিনিদাদ চলেছি। পরে দেখা হবে, দোস্ত!

ওই নোট ভাল করেই দেখেছে খুনির দল।

রানা বুঝে গেল: আর যেখানেই যাক, ত্রিনিদাদে যায়নি ফক্স। আবারও ফিরল লিভিংরুমে। দু’হাতে সোজা করল বুকশেলফ। তাকগুলোয় চোখ বোলাল। অসংখ্য ক্লাসিক বই পড়ত ফক্স। আরও আছে ইউরোপের ঐতিহাসিক কাহিনী, জাগানি দর্শন, ভারতীয় মেডিটেশন বিষয়ক বই। রানার মনে পড়ল, শান্ত ধরনের হাসিখুশি মানুষ ছিল ফক্স।

দুটো শেলফে সিডি ও ডিভিডি। বেশিরভাগই ক্লাসিকাল মিউযিক ও ভিডিয়ো। একদিকে স্প্যানিশ গানের সিডি নিচের শেলফে জুয়েলারি কেসে একটা ছবি। ওটাতে দেখা যাচ্ছে লোকগুলোর হাতে গিটার। লাল পোশাকে নেচে চলেছে কৃষ্ণকেশী ক’জন সুন্দরী। কিন্তু এসব থেকে জরুরি কোন তথ্য পাওয়ার উপায় রানার নেই। বুকশেলফ থেকে সরতেই ওর পা পড়ল কাঁচভাঙা এক ছবির ওপরে। থমকে নিচু হয়ে ওটা তুলল রানা। ছবিটাকে কোন গুরুত্ব দেয়নি অনুপ্রবেশকারীরা।

মেঝেতে আরও বেশকিছু ছবি। তাতে আছে স্প্যানিশ গিটার হাতে কেউ না কেউ। সবার পরনে স্পেনের গ্রাম্য পোশাক। একটা ছবির কোণে লেখা: ভুলে যেয়ো না – রিটা ক্যাম্পো।

‘স্পেন… স্পেন… স্পেন!’ বিড়বিড় করল রানা।

বাথরুমের আরেকটা ছবির কথা মনে পড়ল ওর। দ্রুত গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। শাওয়ারের উল্টোদিকের দেয়ালে ঝুলছে ছোট্ট ছবিটা। মন দিয়ে ওটা দেখল রানা। এই ছবি লিভিংরুমের অন্যান্য ছবির মত নয়। অনেক যত্ন নিয়ে আঁকা তৈলচিত্র। গ্রাম্য দৃশ্য। পাহাড় আর ছোট এক জনপদের।

গ্রামের পেছনে বিশাল রুক্ষ পাহাড়। লালচে পাথরের বাড়ির ছাত লাল টেরাকোটা দিয়ে তৈরি। প্রতিটি বাড়ির চারপাশে উঁচু বারান্দা। গ্রামের মাঝ দিয়ে পাহাড়ের বুকে গেছে সরু, আঁকাবাঁকা

আঁকাবাঁকা পথ। গভীর রাতে ফক্সের অ্যাপার্টমেন্টে রানা যেন শুনতে পেল গ্রাম্য এলাকায় ঝিঁঝির কর্কশ ডাক। বুনো ল্যাভেণ্ডারের সুবাসে ম-ম করছে পাহাড়ি হাওয়া। তপ্ত রোদে উষ্ণ হচ্ছে প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড। তৈলচিত্রের গ্রাম্য এলাকাটায় নিজেকে কল্পনা করল রানা। ওর মন বলে দিল, ঠিক এভাবেই বারবার স্পেনের ছবিটা দেখেছে ফক্স।

ওই গ্রাম থেকে যেন ভেসে এল গিটারের ঝঙ্কার। পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে সুরের মূর্ছনা। ডানা মেলে দূরাকাশে ভাসছে একটা-দুটো অলস চিল। তৈলচিত্রের দিকে চেয়ে হঠাৎ করেই আড়াই বছর আগের এক ঘটনা মনে পড়ল রানার।

ইউএন-এর শান্তি মিশনে ওরা তখন ছিল কঙ্গোয়। ওই এলাকা ছিল ভিনগ্রহের রুক্ষ পাহাড়ি অঞ্চলের মত। ভয়ানক নিষ্ঠুর ওঅর লর্ড রক্তলোলুপ লুলুম্বা কিনাচি ও তার নরপিশাচ সৈনিকদলের বিরুদ্ধে লড়ছিল ওরা। যে-কোন সময়ে হামলা হবে ওদের ওপর। রানাদের কাছে খবর ছিল, আরও দু’দিন পর দলে যোগ দেবে আরও বিশজন সৈনিক।

সেদিন বিকেলে প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে এসেছিল ওরা। মাইলখানেকের মধ্যে শত্রুপক্ষের কেউ ছিল না। তবুও ওরা ছিল অস্ত্র হাতে সতর্ক। রাতের আঁধারে পোর্টেবল স্টোভে বগবগ শব্দ তুলছিল পানি ভরা কফির পট। সবাই জানত ভাল কফি তৈরি করেন বাঙালি মেজর মাসুদ রানা। প্রত্যেকে টিনের মগ হাতে অপেক্ষা করছিল। নিচু গলায় চলছে আলাপ। বারোজন সৈনিকের চারজন এসএএস ফোর্সের। ওদের নেতৃত্বে ছিল উইলবার ফক্স। অন্যরা রানার অধীনে বাংলাদেশ আর্মির সৈনিক। ইউএন দপ্তর থেকে এই দুই দলের প্রধান করা হয়েছিল রানাকে।

‘কপাল!’ হঠাৎ বিড়বিড় করল হ্যারি শেল্ডন। ‘শালারা আমাদেরকে খুন হতে এখানে পাঠিয়েছে!’ চারদিন পর ভোরে সাবমেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণের সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণে বুক ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা গিয়েছিল ও।

কফি ভরা মগ সবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল রানা, ‘তা হলে না-ই বা আসতে, হ্যারি!’

‘তাতে যে সম্মান থাকত না?’ বলল শেল্ডন। ‘চাকরি থেকে কান ধরে বের করে দিত। জেল তো হতোই, বড় ধরনের জরিমানাও গুনতাম।’

‘আমলা শালারা কখনও খুন হওয়ার ঝুঁকি নেয় না, এটাই সত্যি, বলল রিচ বোলান।

দক্ষ সৈনিক হলেও ব্রিটিশদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট উইলবার ফক্স। আবার ওর হাতেই এসএএস ফোর্সের নেতৃত্ব। ম্যাগ শ’ রবার্ট বলল, ‘চুপচাপ এত কী ভাবছ, ফক্স?’

‘শুনছ, কেমন ফিসফিস করে বইছে পাহাড়ি মিষ্টি হাওয়া?’ বলল ফক্স। ‘স্বর্গেও হয়তো এমনই সুন্দর পরিবেশ।’

‘পাগলের কথা শোনো,’ হ্যারি শেল্ডনের কানে ফিসফিস করল রিচ বোলান।

রানা শুনে ফেলেছে ওর কথা। বুঝে গেল, এবার ফক্সকে খোঁচাতে শুরু করবে ব্রিটিশ সৈনিকেরা। সবার তর্ক ঠেকাতে গিয়ে রানা বলল, ‘আমি বোধহয় তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, ফক্স। বিশাল প্রকৃতির মাঝে এলে সত্যিই উদাস হয় মন। জানতে ইচ্ছে করে: কেন এত সংঘাত এই পৃথিবীতে!’

মাথা দোলাল ফক্স। ‘একদিন হয়তো আমার যথেষ্ট টাকা হবে। আর তখন নির্জন এক পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে বাকি জীবন পার করে দেব। আর ফিরব না ব্রিটেনে।’

‘তো শেষমেশ কোথায় থিতু হবে?’ জানতে চাইল রানা।

দূরে চেয়ে রইল ফক্স। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি। ‘বছরখানেক আগে ছুটি পেয়ে স্পেনে গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম অ্যারাগন। পিরানিজ পর্বতমালার ভেতরে। পুবে কাটালোনিয়া ও নাভারা। পশ্চিমে লা রিয়োজা আর ক্যাস্টিয়া ওয়াই লিয়ন। গুয়াদালাভিয়ার নদীর তীরে ছোট্ট এক গ্রাম, পাহাড়ের কোলে। আগে কখনও এত সুন্দর গ্রাম আমি দেখিনি। আর ওখানেই পরিচয় হয়েছে মিষ্টি এক মেয়ের সঙ্গে। ও কথা দিয়েছিল, আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।’

ফক্সের কথা শুনে শিস দিল ওর দলের সৈনিকেরা।

‘এতক্ষণে ব্যাটা কাজের কথায় এসেছে,’ বলল বোলান। হাসিঠাট্টা করত, কিন্তু ইশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিল রানা।

‘ওর নাম রিটা,’ নিচু গলায় বলল ফক্স। অস্ফুট হেসে

মাথা নাড়ল। ‘রিটা ক্যাম্পো। আমি কখনও ওকে ভুলব না। সময়টা ছিল যেন উড়ে যাওয়ার। রানির সৈন্যবাহিনীতে চাকরি করি বলে ফিরতে হয়েছে ব্রিটেনে। তবে কিছু টাকা জোগাড় হলেই অবসর নিয়ে চলে যাব রিটার কাছে।’

‘ব্যাটার আর খেয়ে কাজ নেই, স্পেনে যাবে!’ কনুই দিয়ে হ্যারি শেল্ডনের কোমরে খোঁচা দিল রিচ বোলান।

‘রিটা বলেছিল নিয়মিত যেন চিঠি দিই। ফোন ওর পছন্দ নয়। এদিকে চিঠি লেখার অভ্যেস আমার আবার নেই। গত একবছরে আমাদের ভেতরে আর যোগাযোগ হয়নি। হয়তো এরই ভেতরে কাউকে বিয়ে করেছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফক্স। ‘ওদিকের কমবয়েসীরা প্রথম সুযোগে চলে যায় বড় শহরে। তবে… হ্যাঁ, আমি ঠিকই ফিরব ওই গ্রামে। জেনে নেব অপেক্ষা করছে কি না রিটা। যদি দেখি কাউকে ভালবাসে বা বিয়ে করেছে, আড়াল থেকে ওকে একবার দেখে চলে যাব অন্য কোথাও। মুক্ত জমি… বিশাল আকাশ… উঁচু পাহাড়… কলকল করে বয়ে যাওয়া নদী… ওই অঞ্চল আসলেই স্বর্গ। না, আরেকবার আমি যাব। …আর রিটা? হয়তো দেখা পাব ওর!’

নাক দিয়ে ঘোৎ শব্দ করল ম্যাগ শ’ রবার্ট। ‘তুমি আসলে আস্ত একটা গাধা, ফক্স। যুদ্ধের সময় এসব ভাবতে গিয়ে লুলুম্বার সৈনিকদের গুলি খেয়ে শেষে মরবে।’

চুপ করে থাকল ফক্স। ফিসফিসে হাওয়া এসে ভেঙে দিল চারপাশের নীরবতা। ফক্সের মনের গভীর আকুতি যেন নিজের বুকেও টের পেল রানা। কয়েক মুহূর্ত ভেবে ও বলল, ‘মনের কথা খুব গুছিয়ে সুন্দর করে বলেছ, ফক্স। তোমার অবশ্যই যাওয়া উচিত রিটার সঙ্গে দেখা করতে।’

এ-মুহূর্তে ফক্সের অ্যাপার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে বহুকিছু বুঝে গেল রানা। আরও কিছুক্ষণ বাথরুমের দেয়ালে ঝুলন্ত তৈলচিত্র দেখল। তারপর হুক থেকে ওটা খুলে নিল। কালো কাঠের তৈরি ফ্রেম। যাতে ধুলোবালি না লাগে, তাই ছবির পেছনে সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে বাদামি কাগজ। তৈলচিত্রের নিচে সই করেছে শিল্পী: দু’হাজার আঠারো। রিটা ক্যাম্পো। নিচে ছোট্ট করে লেখা: আলদারিসিন, অ্যারাগন।

বিড়বিড় করল রানা: ‘আমি বোধহয় তোমাকে খুঁজে পেয়েছি, ফক্স!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *