সাত
পাঁচদিন আগের ঘটনা।
জঙ্গলে সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখেই উইলবার ফক্স বুঝে গেছে, এবার ওকে পালিয়ে যেতে হবে দূরে কোথাও। আজ রাতে যে ভয়ানক দৃশ্য দেখেছে, এরপর ওই সংগঠনের হয়ে মানুষ খুন করার কোন আগ্রহ আর ওর নেই। মনস্থির করেছে, প্রথম সুযোগে বেরিয়ে যাবে গ্রেট ব্রিটেন থেকে।
শার্লন হল ত্যাগ করতে গিয়ে কোন বিপদে পড়ল না ফক্স। পাঁচিল টপকে গাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে ভাবল, ওরা দেরি করবে না পিছু নিতে। কাজেই ওর হাতে বাড়তি কোন সময় নেই। একবার শত্রুপক্ষ ধরে ফেললে বাঁচতে দেবে না ওকে। এমনিতেই ব্যর্থ হয়েছে কিলিং মিশনে, তার ওপরে দেখেছে অশুভ-পূজার গোপন অনুষ্ঠান- সুতরাং সিকিউরিটির লোক প্রথম সুযোগে ওকে খুন করবে। তাদের জালে আটকে গেলে ওর লাশও খুঁজে পাবে না কেউ। ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে ফোর্ড মাস্ট্যাং গাড়ির কাছে পৌছল উইলবার ফক্স। ড্রাইভিং সিটে উঠে দরজা বন্ধ করে ভাবল, একটু পর গাড়ি আর অন্যসব ফেলে উধাও হতে হবে। ইঞ্জিন চালু করে ঘুরন্ত চাকার কর্কশ আওয়াজ তুলে রওনা হয়ে গেল।
মাত্র পাঁচ মিনিটে বারো মাইল পাড়ি দিয়ে হেডলাইটের আলোয় ফক্স দেখল সামনে ছোট এক গ্রাম। ওটার শুরুতেই ধূসর পাথরের চার্চ, পাশে কবরস্তান। একটু দূরে খামারবাড়ি। শীর্ণ নদীর ওপরে পাথুরে সেতু পেরিয়ে গ্রামের চত্বরে পৌঁছে গেল ফক্স। ডালপালা ভরা মস্ত এক ওক গাছের নিচে মাস্ট্যাং রেখে নেমে পড়ল। তিন মিনিটে খুলল গাড়ির সামনের ও পেছনের নম্বর প্লেট। ও-দুটো ফেলে দিল নদীতে। চোরাই ‘গাড়ির আইডি জানতে এবার সময় নেবে পুলিশ। চেসিস নম্বর আগেই তুলে নিয়েছে রাঁদা দিয়ে ঘষে। অবশ্য পুলিশ নয়, ওর ভয় ভয়ঙ্কর একদল খুনিকে। আজ অশুভ অনুষ্ঠান দেখার আগপর্যন্ত তাদেরই একজন ছিল ও।
গাড়ি রেখে আঁধার গ্রামের পথে হেঁটে চলল ফক্স। কয়েক শ’ গজ যাওয়ার পর পেয়ে গেল পছন্দমত এক ফোক্সভাগেন গাড়ি। ওটা একদম নতুন। ফক্স জানে, হাই-টেক গাড়ি চুরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ। কটেজের সামনের রাস্তায় পার্ক করা হয়েছে গাড়িটা। পকেট থেকে ছোট এক ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে চট করে বাটন টিপল ফক্স। সিগনাল পেয়ে নীরবে খুলে গেল গাড়ির দরজার চাবিহীন তালা। ওর ডিভাইস একইসঙ্গে জ্যাম করেছে কটেজে রয়ে যাওয়া গাড়ির চাবি। ফোক্সভাগেনের ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল ফক্স, দেরি হলো না রওনা হয়ে যেতে।
মাত্র আটত্রিশ মাইল দূরে লণ্ডন শহর। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে একুশ মিনিটে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। শহরের ভেতরে আবাসিক এলাকায় এসে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। হাঁটতে লাগল ওর ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্ট লক্ষ্য করে। ওটা আধমাইল দূরে। পুরনো বাড়িটার ওপরতলায় উঠে চাবি দিয়ে খুলল অ্যাপার্টমেন্টের দরজা। তৈরি পিস্তল হাতে গোছানো ডাইনিং রুমে ঢুকে ভাবল, এখানে এমন কিছু নেই যেজন্যে মন কাঁদবে ওর। কাজেই আর কখনও না ফিরলেও কোন ক্ষতি নেই।
কয়েক মুহূর্তে বুঝে গেল, কেউ নেই অ্যাপার্টমেন্টে। ওর মনে হলো হয়তো আরও কিছু সময় পাবে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। বাতি না জ্বেলে বেডরুমে ঢুকল ফক্স। রওনা হওয়ার জন্যে সবসময় তৈরি থাকে ওর ব্যাগ। ওটার ভেতরে আছে বাড়তি পিস্তল, টাকা ও ক’দিনের জন্যে পোশাক। ব্যাগ সংগ্রহ করে অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা লক করে নিচে নেমে এল ফক্স। ভুলেও গেল না চোরাই গাড়ির দিকে। পাঁচ মিনিট হেঁটে পৌঁছল সবচেয়ে কাছের পাতাল-রেল স্টেশনে। আজ শুক্রবার। নিয়মমত আসছে-যাচ্ছে ট্রেন। ব্যাগ থেকে ক্যাপ নিয়ে ওটা মাথায় চাপিয়ে ঢুকে পড়ল স্টেশনে। ক্যাপের দীর্ঘ পিকের জন্যে ওর মুখ দেখতে পাবে না সিসিটিভি ক্যামেরার লেন্স।
পরের ট্রেন আসতেই ওটায় উঠল ফক্স। চোখ রাখল আশপাশের ভিড়ে। একটু পর বুঝল, ওকে লক্ষ করছে না কেউ। সেইণ্ট জন’স উড স্টেশনে নেমে আরও মাইলখানেক হেঁটে পৌঁছে গেল প্রাইভেট এক সিকিউরিটি ফ্যাসিলিটির অফিসে। চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে ওটা। দামি কিছু রাখতে জুতোর বাক্সের মত ছোট সেফ ডিপোযিট বক্স থেকে শুরু করে বিশাল ওঅকইন ভল্ট আছে কাস্টমারের জন্যে। সিকিউরিটি যেমন স্টেট-অভ-আর্ট, তেমনি ব্যবহার করা হয় বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন সিস্টেম। দু’বছর হলো বোমা নিরোধক ছোট এক সেফ ডিপোযিট বক্স ভাড়া নিয়েছে ফক্স। ব্যক্তিগত ভল্টে রেখেছে দরকারি কিছু জিনিস। তার ভেতর রয়েছে ফুল-অটোমেটিক হেকলার অ্যাণ্ড কচ জিত ব্যাটল রাইফেল ও উয়ি সাবমেশিন গান। অবশ্য এবার ও-দুটো ওর লাগবে না। ভল্টে আরও আছে গত দু’বছরে আয় করা ছয় লাখ পাউণ্ড, এক লাখ ইউরো, ওর কয়েকটা ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, নিয়োগকর্তার দেয়া নকল পরিচয়পত্র ইত্যাদি। আগেই দুটো নকল পরিচয় তৈরি করে রেখেছে ফক্স। এবার কাজে লাগবে ওগুলো। জিম হকিন্স ও এমিল হল নামের পাসপোর্ট দেখলে কোন সীমান্তে ওকে দেখে সতর্ক হবে না ইমিগ্রেশন অফিসার। ফক্স মনস্থির করল, আপাতত ব্যবহার করবে জিম হকিন্সের পরিচয়।
ধূসর হোল্ডঅলে আছে প্রচুর টাকা। ব্যাগটা ভারী হলেও বহন করতে খুব কষ্ট হবে না ওর। পিস্তল ও গুলি ভেতরে রেখে ভল্ট লক করে বেরিয়ে এল ফ্যাসিলিটি থেকে। ভাল করেই জানে, আর কখনও ফিরবে না এই এলাকায়। শুধু তাই নয়, জীবনেও আর ফিরছে না ব্রিটেনে। নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে বিন্দুমাত্র দুঃখ এল না ওর মনে। এ দেশে এমন কিছুই নেই যা আকর্ষণ করবে ওকে। ফক্স ভাল করেই জানে এবার কোথায় চলেছে।
সিকিউরিটি ফ্যাসিলিটি থেকে দেড় মাইল হেঁটে নির্জন এক জায়গায় এসে থামল। একবার দেখল নিজের পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইডি কার্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র- তারপর ওগুলো ফুটপাথে রেখে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বেলে দিল। একটু পর ছোট্ট স্তূপে থাকল ছাই ও পোড়া প্লাস্টিক। আবারও রওনা হয়ে লণ্ডনের চেনা পথে হেঁটে চলল ফক্স। ভালভাবেই জানে, এতক্ষণে ওর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেছে ঠাণ্ডা মাথার একদল খুনি। সেখানে না পেয়ে ওর খোঁজে লণ্ডন শহরে ছড়িয়ে পড়বে তারা। তবে তাদের চেয়ে এক পা এগিয়ে আছে ফক্স। এবং এভাবেই চলতে হবে ওকে।
কয়েক ঘণ্টা পর জিম হকিন্সের পাসপোর্ট দেখিয়ে হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে লুক্সেমবার্গের বিমানে চাপল ফক্স। হ্যাণ্ড লাগেজ হিসেবে সঙ্গে নিয়েছে ধূসর হোল্ডঅল। একঘণ্টা পর বিমান রওনা হতেই বুঝল, পেছনে কোন সূত্র রেখে যাচ্ছে না ও। ভাবতে গিয়ে টের পেল, দু’বছর আগেই ওর উচিত ছিল এই কাজটা করা। গতরাতে শার্লন হলের পৈশাচিক সমাবেশ না দেখলে হয়তো বাকি জীবন ওই সংগঠনের হয়ে মানুষ খুন করে বেড়াত।
আজ মুক্ত এক মানুষ হিসেবে নিজেকে মনে হচ্ছে ওর। অন্তরটা বলে দিচ্ছে, নতুন করে যেন জন্ম নিয়েছে ও।
পরের দু’দিন বাস-রেল স্টেশন ও তাদের সিসিটিভি ক্যামেরা এড়িয়ে গেল। ট্রাক বা গাড়ি থামিয়ে হিচ-হাইক করে ফ্রান্স পেরিয়ে ঢুকে পড়ল নির্জন এলাকায়। ওখানে ওকে বিরক্ত করতে এল না কেউ।
তৃতীয় দিন পৌছে গেল স্বপ্নের সে-এলাকায়, যেখানে রুক্ষ পাহাড়ের কোলে আছে অদ্ভুত সুন্দর মনের মেয়েটির বাড়ি। ভেবে রেখেছে ফক্স, এবার বেছে নেবে নিশ্চিন্ত জীবন। মেয়েটা আজও ওর জন্যে অপেক্ষায় থাকলে চার্চে গিয়ে বিয়ে সেরে নেবে ওরা। দু’জন মিলে বাকি জীবন পার করবে সংসার ও সন্তান-সন্ততিদেরকে নিয়ে। সত্যিই হয়তো ভবিষ্যৎটা হবে বিপদ-আপদহীন।
ফক্স অবশ্য জানে না, ওকে খুঁজে বের করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওর প্রাক্তন মনিবেরা।
সুতরাং, কেউ না কেউ আসবে ওকে খুন করতে!