কিলিং মিশন – ৫৪

চুয়ান্ন

হেলিকপ্টারের হঠাৎ এই আগমনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে রানা, ওয়াকার ও ফক্স। পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। ওদের ধারণা, গোলাগুলিতে গো-হারা হেরে পুলিশের কাছে নালিশ করেছে সিকিউরিটির লোকেরা। শার্লন হলে দ্রুত পৌঁছুবার জন্যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে স্পেশাল ওয়েপন্স অ্যাণ্ড ট্যাকটিক্স টিম। এবং সেক্ষেত্রে হাজির হবে আরও পুলিশ হেলিকপ্টার। সেগুলো থেকে নেমে সোয়্যাট টিমের সদস্যরা ঘিরে ফেলবে শার্লন হল।

ছুটে গিয়ে জানালার শিকে গাল ঠেকাল রানা। ওর চোখে পড়ল বাড়ির পাশে জঙ্গলের কাছে নামছে হেলিকপ্টার। ব্রিটেনের পুলিশ হেলিকপ্টার কালো-হলদে হলেও চাঁদের আলোয় যেটা দেখেছে রানা, ওটা কমলা-সাদা। সেজন্যেই ওর মনে হলো, হেলিকপ্টারটা এসেছে ব্যালার্ড ও ক্যাসিডিকে তুলে নেয়ার জন্যে।

‘রানা?’ ঘরের দরজার কাছ থেকে ডাকল ওয়াকার

এরই ভেতরে ঘুরে দরজার দিকে ছুটছে রানা। হ্যাঁচকা টানে গিয়ে খুলল কবাট। ওর গম্ভীর মুখ দেখে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে ফক্স। চাপা স্বরে বলল, ‘বস্, আমিও আসছি!’

ওদের পর পর ঘর ছাড়ল ওয়াকার। দরজা খোলা পাবে ভেবে ভিড় করে এগোল ক্লাবের সদস্যরা। তবে তাদের নাকের কাছে দড়াম করে কবাট বন্ধ করল ওয়াকার। সময় লাগল না বাইরে থেকে ভারী বল্টু আটকে দিতে। ঘর থেকে এল চিৎকার ও গালাগালি। দরজায় লাথি বসাল কয়েকজন। অবশ্য ওক কাঠের কবাট অনেক বেশি মজবুত।

ভোজকক্ষের বাইরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ডিগবার্টের রাইফেল রেখে গেছে রামিন। না থেমে অস্ত্রটা হাতে নিল রানা। ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল ক্লাব সদস্যদের জন্যে সাজিয়ে রাখা লাউঞ্জে। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো টপকে বেরিয়ে এল বাইরে। বেশকিছু গাছের ওদিকে নেমেছে হেলিকপ্টার। তীব্রবেগে ঘুরছে রোটর, ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রচণ্ড হাওয়া। মাতালের মত দুলছে গাছের শাখা-প্রশাখা। যাতে চট করে আকাশে উঠতে পারে, তাই টারবাইনের গতিহাস করেনি পাইলট। রানা বুঝে গেল, আরোহীরা হেলিকপ্টারে উঠলেই রওনা হবে সে।

এক সিকিউরিটি গার্ডের লাশ টপকে ওদিকে ছুটল রানা। চাঁদের ম্লান আলোয় দেখল, ঘাসে ছাওয়া লন ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাঝারি এক মাঠে। সেখানে অবতরণ করেছে হেলিকপ্টার। ওদিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে দু’জন লোক। রোটরের হাওয়ার দাবড়ি খেয়ে কুঁজো হয়ে গেছে তারা। রানা ও তাদের মাঝের ব্যবধান বড়জোর এক শত গজ। এদের একজন অতিবয়স্ক লোক, টলমল করছে হাঁটতে গিয়ে। দেহের ভর চাপিয়ে দিয়েছে লাঠির ওপরে। অন্যজনের বয়স কম হলেও যুবক নয় সে। লম্বা নয়, খাটো নয়, মোটা নয়, চিকনও নয়। রোটরের হাওয়ায় উড়ছে মাথার ধূসর অগোছাল চুল। হেলিকপ্টারের রঙিন আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে চোখের চশমার কাঁচ।

তাকে চিনল রানা। অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেলের আসল নাম রিপার ক্যাসিডি কি না, সেটা নিয়ে কোন মাথা-ব্যথা নেই ওর। বড় কথা, শার্লন হল এখনও ত্যাগ করতে পারেনি সে। যেভাবেই হোক, বুঝেছে এখানে হাজির হবে রানা ও ফক্স। তাই চেয়েছে ঝামেলা শুরু হওয়ার আগেই পালিয়ে যেতে। হেলিকপ্টার আসবে সেজন্যে বুড়োকে নিয়ে লুকিয়ে ছিল প্রাসাদে।

ব্যালার্ড ও ক্যাসিডিকে কোনভাবেই পালিয়ে যেতে দেবে না রানা। ছুটবার গতি বাড়ল ওর। যদিও বিশ গজ যেতে না যেতেই বুঝে গেল; কাছে যাওয়ার আগেই আকাশে উঠবে হেলিকপ্টার। খোলা হ্যাচের কাছে চলে গেছে ক্যাসিডি। বুড়োটাকে ঠেলে তুলল হেলিকপ্টারে। পরক্ষণে নিজেও উঠল কেবিনে। টান দিয়ে বন্ধ করল হ্যাচ। আরও তীক্ষ্ণ হলো টারবাইনের গর্জন। চারপাশে টর্নেডোর মত জোর হাওয়া ছড়াল রোটর। স্কিডের ওপরে দুলে আকাশে ভেসে উঠল হেলিকপ্টার। নাক নিচু করে লেজ তুলে রওনা হয়ে গেল। কাত হয়ে বাঁক নিয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে। আর কিছুই করার নেই রানার। বিকট আওয়াজে তালা লেগে গেল ওর কানে। মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার যেতেই ঝোড়ো বাতাস ছিঁড়ে নিতে চাইল মাথার চুল ও পোশাক। থমকে গিয়ে ঘুরে হেলিকপ্টারটা দেখল রানা। ওর দিকে ছুটে আসছে ফক্স ও ওয়াকার। মাত্র কয়েক মুহূর্তে শার্লন হলের ছাতের কাছে পৌঁছে গেল যান্ত্রিক ফড়িঙ। এবার হারিয়ে যাবে চোখের আড়ালে।

তিক্ত মনে ডিগবার্টের রাইফেল কাঁধে তুলল রানা। স্কোপের ভেতর দিয়ে দেখল হেলিকপ্টারের ককপিটের আলো। টার্গেট এত কাছে যে ফোকাস করা অসম্ভব। রাইফেলের বোল্ট টেনে চেম্বারে লাপুয়া ম্যাগনাম .৩৩৮ কার্তুজ ভরল রানা। ওর তর্জনী বসে গেল মসৃণ, বাঁকা ট্রিগারে। পরক্ষণে গুলি পাঠাল ককপিট লক্ষ্য করে। কানের কাছে শুনল কড়াৎ আওয়াজে গর্জে উঠেছে রাইফেল। রিকয়েলের জোর ঝাঁকি খেল ডান কাঁধে। শক্তিশালী হলেও রাইফেলটা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্‌ট্ ওয়েপন

ওয়েপন নয়। .২২ ক্যালিবারের অস্ত্র দিয়ে হাতি শিকার যেমন প্রায় অসম্ভব, ওর রাইফেল দিয়েও হেলিকপ্টার ফেলে দেয়া তেমনি দিবাস্বপ্নের মত। অবশ্য আজ সত্যিই খেপে গেছে রানা। বোল্ট টেনে ইজেক্ট করল গুলির খোসা। বোল্ট সামনে ঠেলে নতুন গুলিসহ লক করল চেম্বার। প্রাসাদের ছাতের ওপর গিয়ে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার। এদিকে রানার কাছে পৌঁছে গেছে ওয়াকার ও ফক্স। চিৎকার করে কী যেন বলল ওয়াকার। যদিও কিছুই শুনল না রানা। পূর্ণ মনোযোগ টার্গেটের ওপরে।

আবারও গুলি ছুঁড়ল রানা। ওর হিসাব সঠিক হলে ম্যাগাযিনে আছে আরও ছয়টা গুলি। হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে বিদ্যুদ্বেগে একের পর এক গুলি করে ম্যাগাযিন খালি করল রানা। আর তখনই বুঝল, গুলি করার আর কোন প্রয়োজন আসলে নেই!

হঠাৎ এয়ারক্রাফটের পেছনে ভক করে ভেসে উঠেছে দৈত্যের মত কালো এক তেলতেলে ধোঁয়া। চাঁদটাকে আড়াল করে দিল ওটা। বদলে গেছে টারবাইনের গর্জন। বিকট যান্ত্ৰিক খট খটাং-খট শব্দ এল ভাসমান হেলিকপ্টার থেকে। রানার গুলিতে নষ্ট হয়েছে জরুরি কোন যন্ত্রাংশ। ভীতিকরভাবে কাত হলো হেলিকপ্টার। নিচে ঝুঁকে গেল ওটার নাক। হলদে আগুনের শিখা ও ঘন ধোঁয়ায় ভরে গেল হেলিকপ্টারের লেজ। সাঁই করে প্রাসাদের ছাত লক্ষ্য করে নেমে এল আগুনে ভরা আকাশযান।

হতবাক হয়ে ওদিকে চেয়ে রইল রানা। শুনতে পেল ফক্সের চিৎকার: ‘আশ্চর্য! শালারা সত্যিই পড়ে যাচ্ছে!’

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল দ্রুতগামী হেলিকপ্টার। বিকট ধুম শব্দে আছড়ে পড়ল শার্লন হলের ছাতে। হাজার টুকরো হয়ে গেল রোটর। একেক অংশ শ্রেপনেলের মত ধারালো। তীব্রবেগে প্রাসাদের ছাতে ডিগবাজি দিচ্ছে জ্বলন্ত হেলিকপ্টার। ওটার আঘাতে পলকা কাঠের মত ধসে গেল শতবছর বয়সী পাথুরে ছাত। চারপাশে ছড়াল আগুনের বিশাল এক হলদে ফুটবল। আকাশ চাটতে লাগল শিখাগুলো। উজ্জ্বল আলোয় চোখ কুঁচকে গেলেও কপালে হাত রেখে ওদিকে চেয়ে রইল রানা। হুড়মুড় করে ধসে পড়ছে পাথরের বিশাল ছাত। এয়ারক্রাফটের ফাটা ট্যাঙ্ক থেকে গড়াচ্ছে শত শত লিটার ফিউয়েল। আগুনের স্পর্শে দপ করে জ্বলে উঠেছে দাহ্য তরল। হাজার হাজার ডিগ্রি উত্তাপে স্রেফ নরক হয়ে গেছে প্রাসাদের ওপরদিকের তলা। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মত জানালা দিয়ে ভকভক করে বেরোল আগুনের হলদে হলকা।

চুপচাপ দেখছে ওয়াকার ও ফক্স, চোখে অবিশ্বাস। শার্লন হলের দিকে কয়েক পা ছুটেও থেমে গেছে রানা। ওদিক থেকে এল গনগনে উত্তাপ। তখনই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ ঘটল প্রাসাদের ভেতরে। থরথর করে কাঁপল চারপাশের জমিন। আকাশচ্যুত হেলিকপ্টারের পোড়া ফিউজেলাজ নিচে পড়ে ফাটিয়ে দিয়েছে প্রাসাদের মেইন গ্যাস লাইনের পাইপ

লেলিহান আগুনে পুড়ছে শার্লন হল। ধসে গেল প্রাসাদের ওপরের চারটে তলা। সেই ভীষণ ওজনে ভেঙে পড়ল নিচতলার ছাত। শোঁ-শোঁ শব্দে ভোজকক্ষের জানালা গলে বেরিয়ে এল আগুনের ঝড়। একপলকে ওখানে তৈরি হলো বিশাল গভীর এক গর্ত। আকাশ চেটে দিল লকলকে আগুন ও ঘন ধূসর ধোঁয়া। কারও সাধ্য নেই বেঁচে থাকবে ভোজকক্ষে।

হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা সবসময় চেয়েছে পৃথিবীর বুকে নরক তৈরি করতে। আর আজ সেটা পেয়েও গেছে তারা।

‘মাথায় ছাত পড়ে বা আগুনে পুড়ে মরেছে শালারা,’ চাপা শ্বাস ফেলল ফক্স।

‘ভাজি হওয়া সব শয়তান,’ বিড়বিড় করল ওয়াকার।

কী যেন বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল রানা।

লনে ধূসর ধোঁয়া ও ধিকিধিকি কমলা আগুনের কুণ্ডের মাঝ দিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে কে যেন!

প্রথমে ওটাকে আহত কোন জন্তু বলে মনে হলো রানার। পরক্ষণে বুঝল, তা নয়। লোকটার কাপড়চোপড় ছেঁড়া ও ময়লা। লনে ছেঁচড়ে এগোচ্ছে পঙ্গু ভিক্ষুকের মত। মুখ ভেসে যাচ্ছে তাজা রক্তে। চোখে চশমা নেই। যেন আহত এক মাকড়সা। পেছনে টেনে নিচ্ছে ভাঙা পা।

হেলিকপ্টার ডিগবাজি দিতেই কেবিন থেকে ছিটকে পড়েছে রিপার ক্যাসিডি। ছাত ধসে যেতেই ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পাথুরে স্ল্যাবের সঙ্গে পিছলে নেমে এসেছে নিচতলায়। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও দিব্যি বেঁচে আছে!

এখন চাইলে এক গুলিতে তাকে খুন করতে পারবে রানা। যদিও সেটা না করে রাইফেলটা ওয়াকারের হাতে দিল। কোমর থেকে নিল প্রিয় ওয়ালথার। নিচু গলায় বলল, তোমরা একটু অপেক্ষা করো।’

প্রাসাদের দিকে হেঁটে চলল রানা। লনের ধোঁয়ায় জ্বলছে ওর চোখ। প্রচণ্ড তাপ এসে লাগছে গায়ে। রানা যেন হাঁটছে নরকের মাঝ দিয়ে। হাতে ওয়ালথার। খুব শান্ত হয়ে গেছে ওর মন।

ভাঙা পা ছেঁচড়ে শার্লন হল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে রিপার ক্যাসিডি। রানার মনে হলো, সে গিয়ে নেমে পড়বে লেকে। কিন্তু তা নয়। চোখের কোণে দেখেছে ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে এগিয়ে আসছে কে যেন। থমকে কনুইয়ে ভর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিপার ক্যাসিডি। কয়েক মুহূর্ত পর তার কাছে পৌছে গেল রানা। ওকে চিনতে পেরে ভাঙা স্বরে বলল লোকটা, ‘ও, তুমি! মাসুদ রানা!’

দাঁড়িয়ে পড়েছে রানা। লন ও লেকের ওপরে ধূসর কুয়াশার মত করে ভাসছে ধোঁয়ার চাদর। প্রাসাদসহ চিরকালের জন্যে ধ্বংস হয়ে গেছে দ্য হ্যাভোক ক্লাব। সদস্যরাও প্রায় সবাই শেষ। কিন্তু শুধু রয়ে গেছে তাদের এক নিষ্ঠুর নেতা। কাজেই এবার শেষ করে দিতে হবে তাকে।

‘আবারও দেখা হওয়ার কথা নয়, সহজ সুরে বলল রানা। ‘কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমার করা প্ল্যান সঠিক ছিল না। তাই না, লিয়োনেল?’

‘আমার আসল নাম রিপার ক্যাসিডি।’

‘সেটা আমি জানি,’ বলল রানা। ‘তবে আমার কাছে তুমি প্লেনের সেই লোক, যে জীবনের সেরা ভুল করেছে আমাকে এসবে জড়িয়ে।’

‘সত্যিই তুমি অদ্ভুত মানুষ। প্রতি পদে এগিয়ে ছিলে।’

‘সবসময় নয়,’ স্বীকার করল রানা।

‘তো এবার এসেছ আমাকে খুন করতে? মনে রেখো, মৃত্যু এখন আমার কাছে প্রাণ ফেরত পাওয়ার মতই।’ খক- খক করে কাশতেই তার ঠোঁটের কশ বেয়ে নামল তাজা রক্ত।

রিপার ক্যাসিডি বোধহয় মারা যাচ্ছে, তবে সেটা আবার না-ও হতে পারে। মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘ফুরিয়ে গেছে তোমার সময়। যদিও মাটিতে পড়ে যাওয়া কাউকে কখনও গুলি করব না আমি।’

‘তুমি সত্যিকারের বীরপুরুষ,’ কর্কশ হাসল ক্যাসিডি। ‘তো সাহায্য করো উঠতে। মনে তো হচ্ছে না যে নিজে থেকে উঠে দাঁড়াতে পারব।’

কয়েক পা এগিয়ে বামহাত বাড়িয়ে দিল রানা। ওর বাহু ধরল ক্যাসিডি। বাজেভাবে আহত ও রক্তাক্ত সে। তীব্র ব্যথায় মুখ কুঁচকে গেলেও সব সহ্য করার প্রশিক্ষণ আছে তার। বাহু ধরে তাকে টেনে তুলল রানা। নিজে থেকে দাঁড়াতে পারবে না ক্যাসিডি। হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলছে হাড় চুরচুর হওয়া ভাঙা পা। লকলকে আগুনের আভায় সরীসৃপের মত চকচক করছে লোকটার দুই চোখ। মৃদু হেসে বলে উঠল, ‘তুমি সত্যিই নির্বোধ, রানা!’

কথাটা শেষ করেই ছেঁড়া কোটের পকেটে বিদ্যুদ্বেগে হাত ভরল সে। পরক্ষণে বের করল কোল্ট অটোমেটিক পিস্তল। রানার নাক বরাবর নল তাক করেই গুলি ছুঁড়ল। ব্যারেল থেকে ছিটকে বেরোল নীল-সাদা ফুলকি। আগুনের শিখার শোঁ-শোঁ শব্দের ভেতরে বোমার মত আওয়াজ তুলেছে পিস্তলটা।

ক্যাসিডি নড়তেই এক সেকেণ্ডের চারভাগের একভাগ সময়ে রানা বুঝে গেছে, নোংরা কোন কৌশল করবে সে। চিরকাল সুযোগ বুঝে ছোবল দিয়েছে ক্যাসিডির মত সরীসৃপেরা। তবুও রানা স্থির করেছিল সমান সমান সুযোগ দেবে। সেক্ষেত্রে লোকটাকে খুন করতে দ্বিধা হবে না ওর মনে। সেদিন বিমানে কথা হওয়ার পর ক্যাসিডিকে খুন করার জরুরি তাগিদ এসেছিল ওর অন্তর থেকে।

ঝড়ের বেগে হাতের ঝাপটা দিয়ে ক্যাসিডির অস্ত্রের নল একদিকে সরিয়ে দিয়েছে রানা। গালে মাযল ফ্ল্যাশের আঁচ লাগলেও গুলি গেছে কানের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে। মুহূর্তে লোকটার কবজি মুচড়ে পিস্তল কেড়ে নিয়ে লনে ফেলল রানা। একপায়ে দাঁড়াতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে গেল ক্যাসিডি। কিন্তু কাঁধ ধরে তাকে সিধে করে রাখল রানা। লোকটার থুতনির নিচে ওয়ালথারের মাযল গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এই গুলিটা জেসিকার তরফ থেকে।

পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার। লাশ হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ার আগেই ঘুরে ওয়াকার ও ফক্সের দিকে চলল রানা।

পেছনে দাউ-দাউ করে জ্বলছে বিধ্বস্ত শার্লন হল। বাতাসে পোড়া মাংসের বিশ্রী দুর্গন্ধ।

রানার দিকে এগিয়ে এসেছে ফক্স ও ওয়াকার। ফক্সের মুখে ফুটেছে সোনালি চওড়া হাসি। রানার কাঁধ চাপড়ে দিল ওয়াকার। ‘শেষমেশ খেল খতম, তাই না, দোস্ত?’

‘আপাতত,’ বলল রানা। চোখ রাখল ফক্সের চোখে। এবার কী করবে বলে ভাবছ তুমি?’

কাঁধ ঝাঁকাল যুবক। ‘কখনও শুনিনি কোন মিথ্যা কথা আপনি বলেছেন। তাই জানি, স্পেনে সত্যিই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে রিটা। তাই আমার উচিত ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা। ওকে নিয়ে আলদারিসিন গ্রামে ফিরে গির্জায় গিয়ে বিয়ে সেরে নেব। দু’জনে মিলে গড়ে তুলব ছোট একটা খামার। এ দেশে আর কখনও ফিরব না।’

‘সেটাই বোধহয় তোমার জন্যে ভাল,’ বলল রানা।

‘তবে একটা কথা, বস্, বুকে ভীষণ চোট পাব আমাদের বিয়েতে আপনি অনুপস্থিত থাকলে। দুনিয়াতে আপনি ছাড়া আমার এমন কেউ নেই, যে বিয়ের সময়ে বেস্ট ম্যান হবে।’

মৃদু হাসল রানা। ‘আমার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দেব তোমাকে। বিয়ের দিন স্থির করা হলে জানিয়ে দেবে। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই হাজির হব।’

‘আর বসের বন্ধুরা তো কখনও আমার কোন ক্ষতি করবে না, তাই না?’ ওয়াকারের দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসল ফক্স। ‘যদি সম্ভব হয়, আমার বিয়েতে আসবেন আপনি, রামিন আর ডিগবার্ট। ওদের দু’জনের হয়ে কথা দিচ্ছেন তো?’

মাথা দোলাল ওয়াকার। ‘নিশ্চয়ই! দরকার হলে ওদের ঘাড় ধরে তোমার বিয়েতে নিয়ে যাব!’

‘এবার চলো, এখান থেকে বিদায় হই, বলল রানা।

জঙ্গলের দিকে চলল ওরা। প্রাচীর টপকে হারিয়ে যাবে বহুদূরে কোথাও। কেউ কখনও জানবে না, সোনার মত খাঁটি হৃদয়ের বেপরোয়া ক’জন এসেছিল শার্লন হলের নরকে। আর তাদের নেতৃত্বে ছিল মাসুদ রানা নামের দুঃসাহসী, দুর্ধর্ষ এক বাঙালি যুবক।

****

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *