তেতাল্লিশ
বাড়ির উত্তরদিকে জঙ্গলের ধারে গাড়ি রেখেছে রানা ও ফক্স। প্রাচীর টপকে বাগানে নামার মাত্র ষোলো মিনিটের ভেতরে কবজা করেছে ক্রিস্টোফার গানকে। বাগানের পাঁচ একর জমির দু’দিকে গেছে ওরা দু’জন। মোটরওয়ের এক দোকান থেকে কেনা ফোন ইয়ারবাড ও মাইকের মাধ্যমে আলাপ করেছে নিজেদের ভেতরে। ব্রিটিশ মিলিটারি থেকে প্রশিক্ষিত কমাণ্ডো ওরা, সময় নেয়নি বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা সিস্টেম বিকল করে দিতে। তখন দেখেছে বাগানে টহল দিচ্ছে দুই গার্ড। মোটা এক গাছের গোড়ায় কুকুরের মত প্রস্রাব করছিল তাদের একজন। মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে তাকে অজ্ঞান করেছে রানা। বিশ সেকেণ্ড পর ফক্সের আক্রমণে কিছু বোঝার আগেই বেহুঁশ হয়েছে অন্যজন। কাজে কোথাও কোন ত্রুটি নেই রানা ও ফক্সের। চার হাত-পায়ে গ্যাফার টেপ মুড়িয়ে দুই গার্ডকে ওরা করে দিয়েছে প্রায় মিশরীয় মামির মত। মুখে টেপ আটকে তাদেরকে টেনে নিয়ে গিয়ে রেখেছে ঝোপের ভেতরে। দখল করেছে লোকদুটোর আগ্নেয়াস্ত্র ও অ্যামিউনিশন। এরপর ওদের দেরি হয়নি বাড়ির কাছে পৌঁছে যেতে।
পুবের একতলা দালান আগে ব্যবহার করা হতো স্টোরহাউস হিসেবে, পরে বদলে নেয়া হয়েছে আধুনিক অ্যানেক্স-এ। কার পার্কিঙে আছে গার্ডদের ব্যবহৃত মার্সিডি এসইউভি। ক্রিস্টোফার গানের বাড়ির জানালা আঁধার হলেও অ্যানেক্সের দুটো ঘরের জানালায় আছে বৈদ্যুতিক বাতির হলদে আলো। এই দালানের জানালায় গিয়ে উঁকি দিয়েছে রানা ও ফক্স। লিভিংরুমের সোফায় বসে স্পোর্টস চ্যানেলে ফুটবল খেলা দেখছে দুই গার্ড। গির্জা থেকে ফেরার সময় রোল্স রয়েসের সামনের সিটে ছিল তারা। কিচেনে আছে আরও দু’জন। সামনের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা চা বা কফির মগ। রানা ও ফক্স বুঝে গেছে, ক্রিস্টোফার গানের বডিগার্ড দলে সবমিলিয়ে আছে ছয়জন। তাদের দু’জনকে আগেই বাগানে পেয়ে গেছে ওরা।
দালানের সদর দরজা ভিড়িয়ে রাখা। ভেতরে ঢুকে রানা ও ফক্স দেখল সামনে ম্লান আলোকিত সরু এক করিডর। নিঃশব্দে দ্বিধাহীনভাবে কাজে নামল ওরা। আওয়াজ করলেও সেটা চাপা পড়ত টিভির শব্দে। ক্রিস্টোফার গান বহু টাকা খরচ করে পেশাদার গার্ড ভাড়া করলেও তাদের চেয়ে কাজে ঢের দক্ষ রানা ও ফক্স। গার্ডদেরকে অপেশাদার বলেই মনে হয়েছে ওদের। সৈনিকের প্রথম আইন হচ্ছে: সবসময় হাতের কাছে রাখতে হবে অস্ত্র। অথচ, কোট হ্যাঙারে ঝুলছে শোল্ডার হোলস্টারে চারটে কালো অটোমেটিক পিস্তল। স্লিঙে আছে দুটো এমপিএক্স সাবমেশিন গান। পাশের টেবিলে স্পেয়ার ম্যাগাযিন, খুলে রাখা সাইলেন্সার ও ওয়াকি-টকি। ভুল করারও সীমা থাকা উচিত, এরা যেন সেটা টপকে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।
বাগানে দুই গার্ডের কাছ থেকে পাওয়া পিস্তল পকেটে রেখে দুই এমপিএক্স সাবমেশিন গান হাতে তুলে নিল রানা ও ফক্স। অস্ত্রদুটো ফুল-অটো কনফিগারেশন মডেলের। প্রতি মিনিটে গুলিবর্ষণ করবে আট শ’ রাউণ্ড। বিকট শব্দ মৃদু করতে ওটার সঙ্গে রয়েছে ইন্টিগ্রাল সাউণ্ড সাপ্রেসর। ম্যাগাযিনে বত্রিশ রাউণ্ড। অস্ত্রের সঙ্গে আছে ট্যাকটিকাল লাইট ও লেযার। পুরনো হেকলার অ্যাণ্ড কচ সাবমেশিন গানের চেয়ে ঢের আধুনিক। রানার দিকে চেয়ে সোনালি এক চওড়া হাসি দিল ফক্স।
জবাবে লিভিংরুমের দরজা দেখাল রানা। আঙুলে একে একে তিন গুনল। পরক্ষণে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল ঘরে। টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিস্মিত চোখে ওকে দেখল লোকদু’জন। সামনেরজনের মাথার তালুতে খটাস্ করে এমপিএক্স-এর নল নামাল রানা। ওদিকে তীরবেগে কিচেনে গিয়ে ঢুকেছে ফক্স। এদিকে যার মাথায় বাড়ি দিয়েছে রানা, মেঝেতে পড়তে গিয়েও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গেল সে। কিন্তু তখনই তার গলায় লাগল রানার বুটপরা জোরালো এক লাথি। ধড়াস্ করে মেঝেতে পড়ার আগেই জ্ঞান হারাল লোকটা। তার সঙ্গী অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান লোক। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিস করল রানা, ‘স্স্স্!’
ওদিকে কিচেনের দু’জনকে বাগে পেতে সময় নেয়নি ফক্স। ডানদিকেরজনের গলায় জোর এক ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়েছে পেছনের দেয়ালে। অন্যজনের নাক ভচকে গেছে সাবমেশিন গানের নলের গুঁতো খেয়ে। পাঁচ মিনিট পেরোবার আগেই লিভিংরুমে চার গার্ডকে জড় করল ওরা। অস্ত্রের মুখে তাদেরকে বন্দি করে রাখল রানা। আর এই সুযোগে একে একে চারজনের হাত-পা টেপ দিয়ে মুড়িয়ে দিল ফক্স। রোল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে মুখে আটকে দিল টেপ। লিভিংরুমের বাতি নিভিয়ে দেয়ার আগে বলল, ‘এবার চুপচাপ বিশ্রাম নাও!
অ্যানেক্স থেকে সোজা বাড়ির ভেতরে গেছে এক করিডর। স্টিভ হ্যারিসের বাড়ির চেয়ে ক্রিস্টোফার গানের বাড়ি অনেক বিলাসবহুল। নিচতলা সার্চ করল রানা ও ফক্স। কোন ঘরেই কেউ নেই। ওপরতলায় বোধহয় শুয়ে পড়েছে ডায়ানা গান। অবশ্য ক্রিস্টোফার গান বিছানায় গেছে বলে ভাবছে না রানা। ওপরদিক লক্ষ্য করে আঙুল তাক করল ও। তাতে মাথা দোলাল ফক্স। এবার দোতলায় গিয়ে ধরবে হারামি লোকটাকে।
মার্বেল দিয়ে বাঁধাই করা মেইন হলওয়ে থেকে ওপরে গেছে চওড়া সিঁড়ি। কোথাও কোন আলো নেই। সিঁড়ির দিকে ওরা পা বাড়াতেই দোতলায় জ্বলে উঠল কম ওয়াটের বাতি। হালকা পায়ে কে যেন হাঁটছে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে অন্ধকারে মিশে গেল ওরা। এক মিনিট পেরোবার আগেই নিচতলায় নেমে এল ক্রিস্টোফার গান। তার পরনে এখনও বাইরে যাওয়ার পোশাক। একহাতে ব্র্যাণ্ডির ক্রিস্টালের গ্লাস। অন্যহাতে সিগার ও দামি লাইটার। একটু টলছে। রানা ধারণা করল, এরইমধ্যে বেশ কয়েক পেগ মদ গিলে নিয়েছে লোকটা। আজ ছিল মেয়ের ফিউনেরাল, তাই বিষাদ চেপে রাখতে মদ্যপান করলে সেটাকে অস্বাভাবিক ভাববে না কেউ। কিন্তু খুব রহস্যময় হচ্ছে লোকটার ঠোঁটের তৃপ্তির হাসিটা। নিজেকে নিয়ে মেতে আছে, খেয়াল নেই এখন আর নিচতলায় একা নয় সে।
হলওয়ে ধরে এগোল ক্রিস্টোফার গান। তার কয়েক ফুট পেছনে পৌঁছে গেল রানা। এবার যে-কোন সময়ে দরজা খুলে বাগানে বেরোবে লোকটা। রানা ভাবল, বাগানে গেলেই তাকে বন্দি করবে ওরা। হাতের ইশারায় পিছু নিতে বলল ফক্সকে। দরজা খুলে আকাশের দিকে তাকাল ক্রিস্টোফার গান। কবাট বন্ধ না করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে’ নেমে পড়ল নুড়িপাথরের ড্রাইভওয়েতে। ধীরপায়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল বাগানে।
চাঁদের আলোকিত এলাকা এড়িয়ে পিছু নিল রানা ও ফক্স। উত্তরদিকে চলেছে ক্রিস্টোফার গান। জানা নেই, প্রাচীর টপকে বাগানে নেমেছে দু’জন যুবক।
দুধসাদা জ্যোৎস্নায় ভাসছে সামারহাউসের প্যাভিলিয়ন। ওদিকেই চলেছে ক্রিস্টোফার। হয়তো ওখানে চেয়ারে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে ফুঁকবে সিগার। একবার পেছনে বাড়িটার দিকে তাকাল রানা। দোতলায় আলো নেই। এমন কেউ নেই যে পিছু নেবে ওদের।
সামারহাউসের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ক্রিস্টোফার গান। কিন্তু তখনই সামনে বেড়ে পেছন থেকে খপ্ করে তার মুখ চেপে ধরল রানা। অন্যহাতে হ্যাঁচকা টানে পিছিয়ে নিল তাকে। তাল হারিয়ে রানার পায়ের কাছে পড়ল ক্রিস্টোফার গান। হাত থেকে সিমেন্টের চাতালে নেমে ঠং-ঠনাৎ শব্দে ভাঙল ক্রিস্টালের গ্লাস। লোকটার দু’পা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে পিছিয়ে গেল রানা। পরক্ষণে সাবমেশিন গানের নলের বাড়ি মাথায় পড়তেই প্রায় অচেতন হলো সাংসদ। রানা চাইছে, তার যেন চেতনা থাকে। ক্রিস্টোফার গানের গোড়ালি, দুই হাঁটু ও কবজি গ্যাফার টেপ দিয়ে মুড়িয়ে দিল ফক্স। হাতের ইশারায় লোকটার মুখে টেপ লাগাতে নিষেধ করল রানা। ড্যাব-ড্যাব করে ওদেরকে দেখছে সাংসদ। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। তার মুখে এমপিএক্স-এর বাতি তাক করে সুইচ টিপল রানা। উজ্জ্বল আলোয় কুঁচকে গেল লোকটার চোখ। রানা বলল, ‘সাহায্যের জন্যে চিৎকার করলে গুলি করে বুক ফুটো করে দেব। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ, মিস্টার গান?’
‘ক্ব-কে… কী হচ্ছে এসব?’
অস্ত্রের নলের ডগা দিয়ে তার বাম গাল ছড়ে দিল রানা। ‘একদম চুপ! মন দিয়ে শুনবে আমার কথা। কিছু জিজ্ঞেস না করলে নিজে থেকে মুখ খুলবে না। যদি একটা কথাও মিথ্যা বলতে শুনি, সঙ্গে সঙ্গে গুলি করব। আমার কথা তোমার মাথায় ঢুকেছে?’
‘শুয়োরের বাচ্চা, এটা কিন্তু একটা প্রশ্ন, বুঝেছিস?’ জানাল ফক্স।
মৃদু মাথা দোলাল ক্রিস্টোফার। ‘আ… আমি বুঝেছি।’
‘আমরা কিডন্যাপার নই,’ বলল রানা। ‘বাড়িতে চুরি করতেও আসিনি। তুমি সিনিয়র এমপি বা ভবিষ্যতের প্রাইম মিনিস্টার, সেজন্যেও তোমাকে আটক করিনি। তোমার মেলা টাকা আছে, বা কত ক্ষমতা দেখাতে পারো, সেসব নিয়েও ভাবছি না। আমরা শুধু জানতে চাই একটা ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে: দ্য হ্যাভোক ক্লাব।’
রানার কথা ডিনামাইটের মত বিস্ফোরিত হলো লোকটার মগজে। হাঁসের ডিমের মত বড় হয়ে উঠল লালচে দু’চোখ। ঝুলে গেল নিচের চোয়াল। কয়েক মুহূর্ত পর তোতলাতে শুরু করে বলল, ‘আ… আ… আমি… তো… কিছুই বুঝছি না!’
অস্ত্রের নল দিয়ে তার গাল চিরে দিল রানা। ‘আবার যদি শুনি বলেছ: ‘কিছুই বুঝছি না!’ তো ধরে নেব মিথ্যা বলতে শুরু করেছ। এবং সেক্ষেত্রে কী হবে, আগেই বলেছি।’
‘শালা, তুই সত্যিই পচে যাওয়া লোক,’ বলল ফক্স। ‘শার্লন হলের ব্যাপারে আমরা সবই জানি। এটাও অজানা নেই যে কী ঘটেছে নেলির কপালে। আমি নিজে ওকে খুন হতে দেখেছি।’
‘সুতরাং বাঁচতে চাইলে সত্যি কথা বলবে,’ বলল রানা। ফড়ফড় করে টেনে খুলল ক্রিস্টোফার গানের দুই হাঁটুর টেপ। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল, সে যেন হাঁটু মুড়ে বসে।