চৌত্রিশ
পশ্চিম সাসেক্স।
আগুন ঝরা তপ্ত দুপুর, বাজে একটা একত্রিশ।
‘আপনি কাকে চান?’ ফোনে জানতে চাইল ফক্স।
‘তুমি আবার কে?’ বলে উঠল ভারী কণ্ঠ।
‘আমার নাম উইলবার ফক্স,’ জানাল প্রাক্তন সৈনিক।
‘শেয়াল-টেয়াল দিয়ে আমার চলবে না, রানা কোথায়?’
রানার হাতে ফোন দিল ফক্স। ‘আপনিই বরং কথা বলুন। লোকটা সুবিধের নয়।’
জনি ওয়াকারের কণ্ঠ চিনে গৈছে রানা।
‘হ্যালো, রানা?’ আরও গম্ভীর হলো ওয়াকারের কণ্ঠ।
রানা ধরে নিল, ওর অনুরোধ না রেখে নরম্যাণ্ডি থেকে কল করেছে জনি। ওর বন্ধুর ফোনের মাধ্যমে হয়তো প্রতিটি কথা, এখন শুনছে শত্রুপক্ষ। অবশ্য তাতে এখন আর কিছুই যায় আসে না। লিয়োনেল ভাল করেই জানে, ব্রিটেনে ফিরে এসেছে ফক্স আর ও।
এক সেকেণ্ড পর রানা টের পেল, ওয়াকার ফোন দিয়েছে ওর বার্নার মোবাইলে!
কিন্তু সেটা কেন করল?
জনির তো জানার কথা নয় এই ফোনে ওকে পাবে! ডিভাইসটা এখন থাকার কথা ওর অ্যাপার্টমেন্টের সেফ-এ!
নিজেও জনি কেন যেন ব্যবহার করছে বার্নার ফোন!
সব গোলমেলে লাগছে রানার কাছে। মনের ভেতরে ঘুরছে একই চিন্তা: আমার কারণে খুন হচ্ছে জেসিকা!
‘রানা? হ্যালো!’
‘জনি, ফোন দিয়েছ কেন? তুমি এখন কোথায়?’
‘ওই একই কথা তো আমিও জানতে চাইতে পারি, ‘ বলল ওয়াকার। ‘সে-রাতে উধাও হলে, তারপর কোন খোঁজই নেই!’
‘আসলে… কোথায় যে আছি… সেটা…’
‘ঠিক আছ তো? কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ।’
‘মস্ত এক ভুল করে ফেলেছি, জনি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘এবার ওরা খুন করবে জেসিকাকে, অথচ সেটা ঠেকাতে পারব না।’
ওর কথায় হাসল ওয়াকার।
বন্ধুকে হাসতে শুনে বিস্মিত হলো রানা।
জনি ওয়াকার বলল, ‘জেসিকার কথা বলছ, তা-ই না?’
‘তাতে এত হাসির কী আছে, জনি?’ বিরক্ত হলো রানা।
‘সবকিছু পযিটিভলি নেবে, বাছা,’ খুশিমনে পরামর্শ দিল ওয়াকার। পরক্ষণে বলল, ‘কিছুই হয়নি জেসিকার। সে ভাল আছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। আমরা বেঁচে থাকতে ওর কোন ক্ষতি হবে না!’
জনির কথা মগজে ঢুকছে না রানার। হতাশ হয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা হাসির নয়, জনি।’
‘তাই বলে এত সিরিয়াস হওয়ারও কিছু নেই।’
‘তুমি হয়তো জানো না, খুন হবে জেসিকা। অথচ কিছুই করতে পারব না।’
‘জেসিকাকে খুন করবে কেউ, সে-উপায় কি আসলে আছে?’ বলল ওয়াকার, ‘ও তো এখন দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে! তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় বলে হাত বাড়িয়ে রেখেছে, যাতে ফোনটা ওকে দিই।’
চমকে গিয়ে সিটে সোজা হয়ে বসল রানা।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল ওয়াকার, ‘দুটো কথা সবসময় মনে রাখবে, দোস্ত! প্রথম কথা: সত্যিই কি ভেবেছিলে সবকিছু গোপন করতে পারবে আমার কাছ থেকে? ওটা তো অসম্ভব! আর দ্বিতীয় কথা: বিপদে যদি পাশে না থাকে বন্ধু, তো তার বাঁচার দরকারটাই বা কী?’
‘জেসিকা এখন তোমার পাশে?’ বেসুরো কণ্ঠে বলল রানা।
বিশাল চওড়া সোনালি হাসি মেলে ওকে দেখছে ফক্স।
‘যদিও একটু ঘাবড়ে গেছে,’ বলল ওয়াকার। ‘জানত না ওর ওপরে চোখ রাখছে একদল খুনি। একটু আগে পিস্তল বের করে হুমকি দিচ্ছিল তাদের দু’জন। কিন্তু মগজটা উড়ে যেতেই আর কখনও কাউকে বিরক্ত করবে না। আমার সঙ্গে আছে রামিন। তিন শত ত্রিশ মিটার দূর থেকে চিরকালের জন্যে বিদায় করে দিয়েছে তাদেরকে।’
বিস্ময় সামলে নিল রানা। ‘তো রামিন এখন তোমার সঙ্গে?’
‘যাদের সঙ্গে তোমার লেগেছে, তারা জানেও না কোথা থেকে আমরা এসেছি। কাগজপত্র অনুযায়ী এখনও আছি নরম্যাণ্ডিতে। কাজে কোথাও কোন খুঁত নেই। এবার জেসিকাকে সঙ্গে নিয়ে উধাও হব স্কটল্যাণ্ড থেকে।’
হঠাৎ করেই রানার মনে হলো, পড়ে আছে বহু কাজ! এবার সেগুলো করতে গিয়ে কোন দুশ্চিন্তায় পড়বে না।
রানা কিছু বলার আগেই বলল ওয়াকার, ‘রামিনের কথা শুনে নরম্যাণ্ডিতে যেতে রাজি হয়েছে জেসিকা। এবার আমার ঐতিহাসিক বিমানে চেপে ফিরে যাব ফ্রান্সে। তোমার কি মনে হয় না, দারুণ এক সেসনা বিমান কিনে বিরাট জেতা জিতে গেছি?’
‘হয়তো, তবে নরম্যাণ্ডিতে নয়,’ মানা করল রানা। ‘ওকে নিয়ে যাও ব্রেযনেভের দুর্গে। ওখানে নিরাপদে থাকবে জেসিকা।’
ইউরোপের অর্থনৈতিক চালকশক্তি বলা হয় রাশান বৃদ্ধ বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেযনেভকে। তিনি জন্ম নেন জার্মানির রটওয়েইল শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আসেন ফ্রান্সে। নব্বুইয়ের দশকে হয়ে ওঠেন বিশ্বের দশজন বড়লোকের একজন। রানার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল লণ্ডনে বিসিআই চিফের এক পার্টিতে। ক’বছর পর ব্যবসায়িক এক প্রতিযোগী তাঁকে খুন করাতে চাইলে, তাকে পুলিশে দেয়ার জন্যে রানা এজেন্সির সাহায্য নেন তিনি। পরে তাঁর প্রিয় নাতনি ইউনাকে রাশা থেকে উদ্ধার করে এনেছিল বলে অন্তর থেকে কৃতজ্ঞ তিনি রানার কাছে।
‘তা-ই ভাল,’ বলল ওয়াকার। ‘বুড়োর দুর্গ পেন্টাগনের চেয়ে নিরাপদ। আমার বন্ধুর এয়ারস্ট্রিপে নামতে পারবে তাঁর গাস্ট্রিম। ওটাতে তুলে দেব জেসিকাকে।’
‘তা হলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করো,’ বলল রানা। ‘এবার ফোনটা দাও জেসিকার হাতে।’
‘এ-ছাড়া উপায় কী! এই মেয়ে ফোন হাতে পাওয়ার জন্যে যে-কোন সময়ে আমার কনুইটা উপড়ে নেবে!’
‘আরেকটা কথা, জনি। রামিন বা তোমার এই ঋণ আমি শোধ দিতে পারব না। তাই কোন ধন্যবাদও দেব না।’
‘বন্ধুদের ভেতরে আবার কীসের ধন্যবাদ!’
একটু আগেও রানা ভেবেছে, আর কখনও শুনবে না জেসিকার সুমধুর কণ্ঠ।
ভয় ও দুশ্চিন্তা নিয়ে জেসিকা বলল, ‘তুমি ভাল আছ, রানা?’ মৃদু কাঁপছে ওর গলা।
‘হ্যাঁ, ভাল আছি,’ বলল রানা। ‘তুমি?’
ওকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে ফক্স।
ওর জন্যে জেসিকা কতবড় বিপদে আছে, সেটা ভাবতে গিয়ে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে রানার। বেচারি এখন নিজের বাড়িতেও ফিরতে পারবে না। অনিশ্চয়তায় আছে ওর ক্যারিয়ার। হয়তো যখন-তখন আসবে হামলা। এসব বুঝেই লিয়োনেল ও তার দলের প্রতি প্রচণ্ড রাগ ও ঘৃণা তৈরি হয়েছে রানার মনে। স্থির করেছে: পশুগুলোকে এরপর থেকে যা-খুশি করতে দেবে না।
সব খুলে বলতে গিয়ে রানা বুঝল, গুছিয়ে বলা ওর পক্ষে কঠিন। তাই ব্যাখ্যায় না গিয়ে জানাল, জেসিকা এখন, নিরাপদ। ওর বন্ধু জনি ও ছোট ভাই রামিন সরিয়ে নেবে জেসিকাকে। যেন ভয় না পায় ও। জনি ও রামিন বেঁচে থাকতে ওর কোন বিপদ হবে না। আর… যারা নিজেদের স্বার্থের জন্যে এতবড় বিপদে ফেলেছে ওদেরকে, তাদেরকে কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না রানা।
কীভাবে ফোনালাপ করে লোকদুজনকে ফাঁদে ফেলেছে ওয়াকার, সেটা জানাল জেসিকা। ‘আগে কখনও কাউকে গুলি খেয়ে মরতে দেখিনি,’ বলল ও।
‘আমার কারণে ওরা তোমাকে খুন করত,’ বলল রানা।
‘আমার তা মনে হয় না। অন্য কোন প্ল্যান ছিল তাদের। হয়তো কিডন্যাপ করত।’
‘তুমি জানলে কী করে?’
‘কারণ, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পিস্তল তাক করে একজন বলেছে: ‘এবার আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে, মেয়ে!’ তোমার বন্ধু আর রামিন বাধা না দিলে বোধহয় কিডন্যাপ করত।’
জেসিকাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল লিয়োনেল, মনে আছে রানার। পরে বোধহয় বদলে নিয়েছে তার প্ল্যান। অবশ্য এখন এসব নিয়ে না ভাবলেও ওর চলবে। হঠাৎ করেই খুলে গেছে অবারিত পথ। কাউকে খুন করবে বলে হুমকি দিয়ে রানাকে আর মুঠোয় পুরতে পারবে না লিয়োনেল। এবার তাকে খুঁজে বের করে সব হিসাব মিটিয়ে দেবে ও।
‘রানা, কবে দেখা হবে?’ অধীর হয়ে বলল জেসিকা।
‘কয়েক দিন পর,’ বলল রানা।
‘এত দেরি?’
‘জরুরি কিছু কাজ শেষ না করলেই নয়, জেসিকা।’
‘আমার খুব ভয় লাগছে। ওরা তোমার ক্ষতি করবে।’
‘ভয় তো ওদেরই পাওয়া উচিত,’ বলল রানা।
‘তুমি আমাকে কথা দাও, খুব সাবধানে থাকবে।’
‘কথা দিলাম,’ নিচু গলায় বলল রানা।
‘জনি আমাকে গাড়িতে গিয়ে উঠতে বলছে।’
‘তা হলে ওদের সঙ্গে রওনা হও,’ বলল রানা।
‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’
‘আমিও, ছোট্ট করে বলল রানা। কল কেটে ফক্সের দিকে তাকাল। ‘এবার কাজে নামতে হবে।’
‘এতক্ষণে কাজের কথা বলেছেন, বস্।’
‘লুকিয়ে না থেকে সরাসরি আক্রমণে যাব। গত ক’দিন যে সুযোগ ছিল,লিয়োনেলের, ওটা এখন আর নেই।’
‘অবশ্য তার নামও আমরা জানি না,’ বলল ফক্স।
‘এটাও অজানা কারা চালায় সেই কাল্ট। বা কোথায় আছে তাদের আস্তানা। আমরা শুধু চিনি শার্লন হল। ওখানে মাঝে মাঝে জড় হয় তারা। কিন্তু পুরো বছরে হয়তো পার্টি করে মাত্র একবার।’
‘হ্যারিস ছিল তাদেরই একজন,’ বলল রানা। ‘সেজন্যে তার বইয়ে লিখতে পেরেছে নানান তথ্য।’
ভুরু কুঁচকাল ফক্স। ‘কিন্তু ল্যাপটপের সেই ফাইলের পাসওয়ার্ড না পেলে আমরা কিছুই জানতে পাব না। তাই না, বস্?’
‘ওটা ছাড়াও চলবে,’ গাড়ির গ্লাভ্স্ কম্পার্টমেন্ট থেকে হ্যারিসের বার্নার ফোন নিল রানা। ‘কথা বলব ম্যাণ্ডক অ্যাণ্ড কার্ক লিটারারি এজেন্সির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ওদের কাছে থাকার কথা হ্যারিসের বইয়ের বড় একটা অংশ।’