বত্রিশ
মৃত লোকটার কাছে বডি ক্যাম দেখে, রানা বুঝে গেছে, ক্লিনআপ ক্রু কাজ শেষ করে রিপোর্ট দেবে সেজন্যে অপেক্ষা করেনি লিয়োনেল। নিজের চোখে দেখেছে লাইভ দৃশ্য। ভাল করেই জেনে গেছে খুন করা হয়েছে তার লোকদেরকে।
বুকে গুলি লাগলে যেভাবে চমকে ওঠে মানুষ, ভাঙা ক্যামেরা দেখে সেভাবেই আঁৎকে উঠেছে রানা। ওরা যে ব্রিটেনে ফিরে এসেছে, সেটা এখন জানে লিয়োনেল। এবার বাড়তি কোন সময় পাবে না ওরা। আরও বড় কথা: ফক্স বেঁচে আছে সেটা জেনে গেছে লোকটা। সুতরাং প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হয়তো খুন করবে জেসিকাকে।
সেই রাতে ক্যামেরার জন্যে শার্লন হলে ধরা পড়েছিল ফক্স। আর আজ একইভাবে ফাঁদে পা ফেলেছে রানা। এবং সেজন্যে হয়তো ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে জেসিকার।
কেমন এক ঘোরের ভেতরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রানা। পেছন থেকে জানতে চাইল ফক্স, ‘কোথায় যাচ্ছেন, বস্?’
চুপ করে থাকল রানা। বুকের মাঝে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। এক এক করে মনে পড়ছে জেসিকার সঙ্গে কাটিয়ে দেয়া সুন্দর মুহূর্তগুলো। মেয়েটাকে খুন করবে লিয়োনেল। কোনভাবেই সেটা ঠেকাতে পারবে না ও। নিজেকে চরম ব্যর্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে ওর।
‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, কমপিউটার নিয়ে আসি, ‘ বলে দোতলায় উঠল ফক্স। হারিয়ে গেল দীর্ঘ প্যাসেজে।
ল্যাপটপ নিয়ে আর ভাবছে না রানা। হ্যারিসের রক্তাক্ত লাশ পাশ কাটিয়ে মন্থর পায়ে গিয়ে থামল সদর দরজার সামনে। কবাট খুলে চেয়ে রইল দূরে মেইন গেটের দিকে। ভাল করেই বুঝে গেছে, ওর আর কিছুই করার নেই। জেসিকা এবার গুম হবে চিরকালের জন্যে।
মিনিট পাঁচেক পর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ফক্স, হাতে কালো রেযার ব্লেড ১৭ ল্যাপটপ। নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘আপনি সুস্থ বোধ করছেন তো? মুখটা খুব ফ্যাকাসে লাগছে।’
‘না, ঠিক আছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।
‘তো, চলুন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই,’ বলল ফক্স। ‘হয়তো গুলির শব্দ পেয়েছে কাছের প্রতিবেশীরা। এমনিতেই এ-বাড়িতে অনেক বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছি।’
গাড়ির কাছে যেতে গিয়ে রানার মনে হলো হাজারো মাইল পথ হেঁটে চলেছে ও। একটু পর ফক্স বলল, ‘আমিই বরং ড্রাইভ করি।’ হাত বাড়াতেই নীরবে ওর কাছে চাবি দিল রানা। নিজে দরজা খুলে উঠে পড়ল প্যাসেঞ্জার সিটে। পেছনের সিটে ল্যাপটপ রেখে গাড়ি নিয়ে রওনা হলো ফক্স। যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে চাইছে এ-এলাকা থেকে। এখনও স্থির করেনি কী করবে। দু’পাশে জঙ্গল রেখে সরু পথ গেছে বহুদূরে। সামনে পড়ল গলফ কোর্স ও বিস্তৃত ফসলের সবুজ মাঠ। বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর পথের ধারে থামল ফক্স। ইঞ্জিন বন্ধ করে ঘুরে তাকাল রানার দিকে।
থমথম করছে রানার মুখ।
‘আমি একা কিছুই করতে পারব না, বস্,’ বলল প্রাক্তন সৈনিক। ‘এখন কী করবেন বলে ভাবছেন?’
‘ওরা খুন করবে ওকে,’ ভোঁতা গলায় বলল রানা।
‘সেটা না-ও করতে পারে,’ জানাল ফক্স। ‘তুরুপের তাস হিসেবে হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে।’
‘হয়তো,’ বলল রানা। ‘তবে শেষমেশ খুন করবে।’
‘জানার উপায় ছিল না এদের কাছে বডি ক্যাম আছে,’ বলল ফক্স। ‘দোষটা তো আর আমাদের নয়, বস্।’
‘হয়তো ভাল করতাম স্কটল্যাণ্ডে গেলে,’ বলল রানা।
‘আপনিই বলেছেন, সেটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ,’ মনে করিয়ে দিল ফক্স। ‘ওখানে না যাওয়ার অন্তত দশটা কারণ দেখাতে পারি। তা ছাড়া, আপনি স্পেনে না গেলে এতক্ষণে হুকওয়ালা লোকটার গুলিতে লাশ হয়ে যেতাম।’
‘একজনকে প্রাণে বাঁচিয়ে চিরকালের জন্যে হারিয়ে বসেছি আরেকজনকে,’ বিড়বিড় করল রানা।
‘আবারও বলছি, বস্, দোষটা কিন্তু আমাদের নয়।’
চুপ করে পাশের সবুজ জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইল রানা।
‘এবার আপনার ফোনটা আমাকে দিন,’ বলল ফক্স। ‘এটা জরুরি।’
নিজের ফোনের সঙ্গে হ্যারিসেরটাও পকেট থেকে বের করল রানা। ওর হাত থেকে নিয়ে গ্লাভস্ বক্সে পলিটিশিয়ানের ফোন রেখে দিল ফক্স। রানার ফোন হাতে জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন তো মেয়েটার নম্বর কী?’
মুখস্থ ফোন নম্বর গড়গড় করে বলে গেল রানা।
জেসিকার মোবাইল ফোনে কল দিল ফক্স।
কিন্তু ওদিক থেকে এল না কোন জবাব।
‘ডিভাইস অফ করে রেখেছে। ল্যাণ্ড ফোনের নম্বর জানেন?’
ল্যাণ্ড ফোনের নম্বরও জানাল রানা। কিন্তু ফক্স কল দিলেও ফোন ধরল না কেউ।
‘শালার কপাল!’ বিড়বিড় করল ফক্স। অনলাইনে পিসি জেসিকা থমসন স্কটল্যাণ্ড লিখে সার্চ দিতেই পেল ফোর্ট উইলিয়ামের স্টেশনের ফোন নম্বর। ওখানে যোগাযোগ করতেই এক রিসেপশনিস্ট জানিয়ে দিল, লাঞ্চের জন্যে বাইরে গেছে জেসিকা। একটু পর ফিরবে।
চট্ করে হাতঘড়ি দেখল ফক্স। এখন বাজে একটা বিশ মিনিট। মহিলার কাছে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি জানেন লাঞ্চের জন্যে কোথায় গেছে পিসি জেসিকা?’
‘দুঃখিত, স্যর। এ-ধরনের তথ্য আমরা দিই না। তবে যে-কোন সময়ে ফিরবে। লাঞ্চ টাইম তো ফুরিয়ে এল।’
‘বুঝতে পেরেছি। ও ফিরলে যেন ফোন করে, সেটা কি বলতে পারবেন ওকে? দয়া করে বলবেন, আমাকে ওর ফোন নম্বর দিয়েছেন মাসুদ রানা।’ বার্নার ফোনের নম্বর মহিলাকে দিল ফক্স। ‘প্লিজ, তাকে জানাবেন যে বিষয়টা খুবই জরুরি।’
খবর পৌছে দেবে কথা দিল রিসেপশনিস্ট। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কল কেটে দিল ফক্স। রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘বস্, মেয়েটা খুন হয়নি। অর্থাৎ, এখনও দূরে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়ার কথা তাকে বলার সুযোগ আছে।’
টু শব্দ করল না রানা। ভাল করেই জানে, সত্যিকার অর্থে জেসিকার কোন সাহায্যে আসতে পারবে না ওরা।
‘মেয়েটাকে বলব দ্রুত যেন লুকিয়ে পড়ে। পরে আপনার কোন বন্ধু ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেবে।’
এবারও নীরব থাকল রানা।
জেসিকা আছে শত শত মাইল দূরে স্কটল্যাণ্ডে। নির্দেশ পেলেই ওকে খুন করবে লিয়োনেলের লোক।
নিজে রানা কিছুই করতে পারবে না।
‘হঠাৎ করে একেবারে বোবা হয়ে গেলেন কেন, বস্?’
‘আমার কারণেই এতবড় বিপদে পড়েছে জেসিকা।’
‘কিন্তু দোষটা তো আর আপনার নয়। ভাল করেই জানি, জীবনের তোয়াক্কা না করে বহু মানুষের উপকার করেছেন আপনি। আর সেজন্যেই আপনাকে মনে মনে মেনে নিয়েছি আমার হিরো হিসেবে। আগে কখনও এই কথাটা বলিনি।’
রানার বাহুতে হাত রাখল ফক্স। বস্, সব শেষ হয়ে যায়নি। নিজেকে দোষী ভাববেন না। আমরা হয়তো ধ্বংস করে দেব শুয়োরগুলোর খোঁয়াড়।’
‘হয়তো,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘তবে তাতে প্রাণে বাঁচবে না জেসিকা।’
কবজি উল্টে ঘড়ি দেখল ফক্স। বাজে দুপুর একটা একত্রিশ মিনিট। একবার ভাবল তর্ক জুড়বে, কিন্তু তখনই ওর হাতে বেজে উঠল রানার বার্নার ফোন। স্পিকার অন করে কল রিসিভ করতে দেরি করল না ও।
স্পিকারের মাধ্যমে ভেসে এল ভারী পুরুষকণ্ঠ।
বিস্মিত চোখে পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও ফক্স।