পঁচিশ
উইণ্ডশিল্ডে জমা ঝিরঝিরে বৃষ্টি সরাতে গিয়ে সড়াৎ-সড়াৎ শব্দে এদিক-ওদিক চলছে ওয়াইপার। উত্তর ইংল্যাণ্ডের লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার পাশ কাটিয়ে গ্লাসগো লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে ট্র্যানসিট ভ্যান। পালা করে ড্রাইভ করছে ওয়াকার ও রামিন। অতিদীর্ঘ এ-পথে কিছুতেই কাটছে না বিরক্তি। গান শুনতে গিয়ে দেখা গেল, রেডিয়ো একেবারেই নষ্ট। গ্লাভ্স্ বক্স হাতড়ে ওরা পেল ছোট এক শক্তিশালী বিনকিউলার ও পুরনো এক সিডি। তবে সিডি-প্লেয়ারে সোনালি চাকতি ভরে ইতালিয়ান ক্লাসিকাল মিউযিক শুনে জীবন সম্পর্কে চরম বিতৃষ্ণা জন্মে গেল ওদের দু’জনের মনে।
তিলতিল করে পেরোচ্ছে একেকটা মুহূর্ত। ভীষণ ক্লান্তি ও বেদম খিদে নিয়ে চুপ করে বসে আছে ওরা। একটু আগের সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেল তুমুল মুষলধারা, গাড়ির ছাতে বাজাতে লাগল দামামা। সূর্য ঢাকা পড়েছে কুচকুচে কালো মেঘে। এম৬ সড়কে কার্লিসল পেরোবার পর ওরা থামল ম্যাকডোনাল্ডসের এক আউটলেটে। পাশেই রিফিউয়েল পাম্প। তেল নিতে ভ্যান নিয়ে ওখানে গেল রামিন। এদিকে ছোট এক দোকানে ঢুকল ওয়াকার। কিনল কমদামি দুটো স্যামসাং স্মার্টফোন। আগেই ও-দুটোয় দেয়া আছে পঞ্চাশ পাউণ্ড ক্রেডিট। পরের দোকান বুটিকের। ওখান থেকে সানগ্লাস ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের এমবস করা কমলা বেসবল ক্যাপ কিনে নিল ওয়াকার। ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকে সংগ্রহ করল দুটো চিবার্গার-অ্যাণ্ড-ফ্রাই আর দুই বোতল বড় কোক। দোকান থেকে বেরিয়ে দেখল পার্কিঙে পৌঁছে গেছে রামিন। দেরি না করে গাড়িতে গিয়ে উঠল ওয়াকার।
চিযবার্গার, ফ্রাই ও কোক সাবড়ে দিয়ে দুই স্মার্টফোনে নিজেদের কন্ট্যাক্ট লিস্টের নাম ও নম্বর তুলল রামিন। কাজটা শেষে ওয়াকারের আনা ক্যাপ ও সানগ্লাস দেখে ভুরু কুঁচকে গেল ওর। ‘এসব কীসের জন্যে?’
‘আমার নতুন ছদ্মবেশ।
আহত চোখে ওয়াকারকে দেখল রামিন 1 ‘আর আমারটা?’
‘তোমার তো লাগবে না। তুমি হচ্ছ স্কটল্যাণ্ডে ফুলে লাল হওয়া বুড়ো আঙুলের মত, যে-কেউ চোখ টেরা করে দেখবে। কী হলো, এভাবে দেখছ যে? তোমার গায়ের রঙ বাদামি, সেই দোষ কি আমার?’
‘বুঝলাম। ভ্যানে আমাকে আত্মগোপনে থাকতে হবে।
এবারও ট্র্যানসিট ভ্যান ড্রাইভ করল রামিন। পাশে বসে ড্যাশবোর্ডে দু’পা তুলে দিল ওয়াকার। বার্নার ফোন দিয়ে অনলাইনে দেখল কিনলোকার্ড গ্রাম ও আশপাশের ম্যাপ। ‘রানা কোন এক দুর্গের কথা যেন বলেছিল? ওই যে, যেটার পুলিশ স্টেশনে চাকরি করে মেয়েটা?’
‘ফোর্ট উইলিয়াম।’
‘গুড!’
‘কী দেখছেন?’
‘খুঁজছি মেয়েটার কাজের শিডিউল।’
স্কটল্যাণ্ডের পুলিশ ওয়েবসাইটে ঢুকেছে ওয়াকার। স্টেশনের ফোন নম্বর পেলেও ওখানে ডায়াল করল না। রামিনের দিকে চেয়ে স্কটিশদের সুরে বলল, ‘ভেড়ার মাংস তো দারুণ রান্না করেছ, ডার্লিং! এবার দু’জনে মিলে ন্যাংটো হয়ে বিছানায় গিয়ে…’ খিকখিক করে শয়তানি হাসি হাসল সে। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘কী, এতে কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে?’
‘জানতাম না ব্যাটা আস্ত এক গে! বিড়বিড় করল রামিন।
‘ওদিকের সবার মত কথা বলতে পারলে হাসতে হাসতে মিশে যেতে পারব ওদের সঙ্গে।’
‘কিন্তু অত বিশ্ৰী উচ্চারণ পাবেন কোথায়?’ মাথা নাড়ল রামিন।
‘আমার তো মনে হয় ভালই করছি।’
‘গলার স্বর আরও নিচু করুন। আপনার কথা তো খেঁকশেয়ালের ডাকের মত শোনাচ্ছে!’
‘ধুর, ব্যাটা!’ কল বাটনে চাপ দিয়ে ফোনের স্পিকার চালু করল ওয়াকার। কয়েক মুহূর্ত পর পুলিশ স্টেশনের মেইন ডেস্ক থেকে ফোন রিসিভ করল এক নারীকণ্ঠ। তার উচ্চারণ আরও মারাত্মক। ওয়াকার ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, এক্ষুণি ওর চাই পিসি জেসিকাকে। ‘নাম আমার ম্যাকআর্থার! অ্যালভি ম্যাকআর্থার! কথা বলছি কিনলোকার্ড গ্রাম থেকে। জরুরি সাহায্য চাই… চার্লস্… মানে আমার বেড়ালটা…. বাগানের সবচেয়ে উঁচু গাছের মগডালে গিয়ে উঠেছে… না- না, আগেও ওই একই কাজ করেছে। ফ্রিয়ের সেরা টিউনা মাছ দেখিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। ওদিকে গ্যারাজে মই থাকলেই বা কী, আমার আবার ওপরে উঠলে মাথা বনবন করে ঘোরে। এজন্যেই পিসি জেসিকাকে খুব দরকার। পেড়ে দিয়ে যাক আমার চার্লসকে।’
গাড়ি ড্রাইভ করছে রামিন, চেপে রেখেছে হাসি।
‘সাহসী মেয়ে, আগেও ধরে এনেছে। তাই ভাবলাম এবারও এসে সাহায্য করুক। …অ্যাঁ? এসব আবার কী বলছেন, আপনাদের পুলিশ স্টেশনে মেয়েটা নেই? ….তো গেছে কোথায়? এখন চার্লসকে উদ্ধার করবে কোন শালী?’
‘ওর ডিউটি তো আগামীকাল সকালে। দুঃখিত, আপাতত ওদিকে আমাদের ফোর্সের কেউ নেই। কেউ গেলেও একঘণ্টার বেশি লাগবে আপনার বাড়িতে পৌছুতে। তাই মনে হচ্ছে, আপনি নিজেই একটু কষ্ট করে যোগাযোগ করুন পিসি জেসিকার সঙ্গে। হয়তো তার বাড়িতেই পাবেন।’
‘ঠিক আছে, মিস, উপকার তো কচুও করতে পারলে না, এখন হেঁটে গিয়ে খুঁজে আনতে হবে মেয়েটাকে! চার্লসকে তো আর এভাবে মেরে ফেলতে পারি না!’ ভয়ানক হুঁকরে কাশি শুরু করে কল কেটে দিল ওয়াকার। বিজয়ীর চোখে দেখল রামিনকে। ‘কী বুঝলে, বাছা? আমি হচ্ছি দ্য বস্!’
‘মহিলা কি সত্যিই আপনার কথা বিশ্বাস করেছে?’
‘অবশ্যই! বাড়িতেই আছে জেসিকা। আগামীকাল সকালে ওর ডিউটি।’
সন্ধ্যায় জেসিকার ডিউটি থাকলে কিনলোকার্ড গ্রাম থেকে তিরিশ মাইল দক্ষিণে ফোর্ট উইলিয়ামে হাজির হতো ওরা।
‘দয়া করে আর কখনও বুড়োর অভিনয় করবেন না, বলল রামিন। ‘কাঁচা অভিনয় দেখে খুন হয়ে যাব!’
কিনলোকার্ড গ্রামের উদ্দেশে চলেছে ট্র্যানসিট ভ্যান। স্কটিশ বর্ডার পেরোলে রামিনকে বিশ্রাম দিতে গাড়ি চালাল ওয়াকার। গ্লাসগোর মোটরওয়ে পেছনে ফেলে সামনে পড়ল অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা। যানবাহনের ভিড়ও কমে গেল। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় বড় রাস্তা থেকে নেমে হাইল্যাণ্ডের কিনলোকার্ড গ্রামের দিকে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথে নামল ট্র্যানসিট ভ্যান। চারপাশ থেকে চেপে এল কুয়াশাময় পাহাড়, ঘন জঙ্গলে ভরা উপত্যকা ও গভীর লক। পরিবেশ যেন একপলকে হয়ে গেল মধ্যযুগীয়।
সন্ধ্যার আবছায়া রাতের আঁধারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ওরা পৌঁছে গেল কিনলোকার্ড গ্রামে। রানার কন্ট্যাক্ট বুকের ঠিকানা অনুযায়ী গুগল ম্যাপ দেখে জেসিকার বাড়ির পথ খুঁজে নিল রামিন।
দু’জনই আত্মবিশ্বাসী, কারও জানার কথা নয় এই গ্রামে এসেছে ওরা। নরম্যাণ্ডির রানা এজেন্সি বা রানার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই ট্রুম্যানের হালকা মালামাল পরিবহনের কর্মীদের। মাথায় বাঘের এমবস করা বেসবল ক্যাপ পরে বিলটা চোখের কাছে নামিয়ে নিল ওয়াকার। লোকচক্ষু এড়াতে সিট থেকে নেমে পেছনের বাঙ্কে গিয়ে বসল রামিন। রানার কাছে শুনেছিল বাদামি পুরনো এক ল্যাণ্ড রোভার ব্যবহার করে জেসিকা। জানালা দিয়ে পথের ধারে এক বাড়ির সামনে গাড়িটা দেখল।
‘ওই যে!’ নিচু গলায় বলল ওয়াকার।
গ্রাম্য পথ থেকে একটু ভেতরে জেসিকার ভাড়া করা ছোট্ট বাড়ি। চারপাশে হাঁটু সমান দেয়াল। বাড়ির সামনে বারান্দার ছাতের হুক থেকে ঝুলছে বাস্কেটে কিছু ফুলগাছ ও লতাপাতা। জানালা-পথে হামলে পড়েছে গোলাপে ভরা একটি কাঁটাঝাড়। বাগানে ফুলের কিছু টব। একটু দূরে বার্ড টেবিল। বাড়ির রটআয়ার্নের গেট কারুকাজ করা। যে-কেউ বুঝবে, এ-বাড়িতে বাস করে রুচিশীল এক মহিলা। দু’পাশের বাড়ির বাগানও গোছানো। ঘনিয়ে এসেছে রাতের আঁধার। কোথাও নেই বিশৃঙ্খলা বা হৈ-চৈ। পথের বাঁকে জেসিকার ল্যাণ্ড রোভারের আগে-পিছে প্রতিবেশীদের কিছু গাড়ি। চলাচলের সুবিধের জন্যে ওগুলো তেড়চাভাবে রেখে সামনের চাকা তুলে দেয়া হয়েছে ফুটপাথে। বুড়ো এক কালো জার্মান শেফার্ড সঙ্গে নিয়ে সান্ধ্য ভ্রমণে বের হয়েছেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক, হাতে কুকুরের ভারী চেইন। ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে বুড়ো সারমেয়। ওটার চেয়েও ধীরগতিতে হাঁটছেন বৃদ্ধ। বয়সে যা হয়, ফুরিয়ে গেছে যৌবনের উচ্ছ্বাস। আজ শুধু অপেক্ষা জগৎ হতে বিদায় নেয়ার।
ধীরগতি তুলে জেসিকার বাড়ি পেরোল ওয়াকার। বাড়ির জানালা দিয়ে দেখেছে লিভিংরুমে চলছে টিভি। নেটপর্দার ওদিকে কারও নড়াচড়া নেই। চল্লিশ গজ দূরেই বামে স্কয়্যার। ওটার একপাশে ছোট মিউনিসিপ্যাল পার্কে কিছু গাছ ও নিচু বেঞ্চ। অন্যদিকে মস্ত ঘড়িসহ টাওয়ার ও গ্রামের হল, পাবলিক টয়লেট ও প্রাচীন আমলের লাল এক ফোনবক্স। সম্ভবত ওটা ব্রিটেনের শেষ ফোনবুথ। টয়লেটের বাইরে প্লামারের এক ভ্যান। টয়লেট ও গ্রামের হলের মাঝে তিনতলা চিকন এক দালান। ওটার জানালাগুলো বোর্ড দিয়ে বন্ধ। একটি জানালার সাইনবোর্ডে লেখা: অবশ্যই ভাড়া হইবে।
বামে বাঁক নিয়ে স্কয়্যার পেছনে রেখে গ্রামের মুদি দোকান লক্ষ্য করে চলল ওয়াকার। একপাশে পড়ল ধূসর পাথরের গির্জা ও দেয়ালে-ঘেরা কবরস্তান। একটু পর টি- জাংশন দেখে ওয়াকার বুঝল, আবারও ফিরতে পারবে একই পথে। যদিও দ্বিতীয়বার জেসিকার বাড়ি পাশ কাটাবার ইচ্ছে ওর নেই। এক শ’ গজ আগেই রাখল গাড়ি। এমন এক জায়গা বেছে নিয়েছে, যেখান থেকে পরিষ্কার দেখবে মেয়েটার বাড়ি ও স্কয়্যার। এদিকে কুকুরটাকে ছেড়ে পার্কের বেঞ্চে বসেছেন বৃদ্ধ। কুকুরটা ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করছে মোটা এক গাছের গোড়ায়।
‘রানার কাছে শুনেছি, চোখ নাকি তোমার বাজপাখির মত,’ পেছনে তাকাল ওয়াকার। ‘তো বলো দেখি কী বুঝলে?’
জেসিকার ওপরে চোখ রেখেছে,’ জানাল রামিন। ওর দৃষ্টি আগেই ছিল ২০/১০, তার ওপরে রানার কঠোর প্রশিক্ষণে দক্ষ স্নাইপার হয়ে উঠেছে রামিন। অর্জন করেছে ফোটোগ্রাফিক মেমোরি। একবার চট্ করে দেখলে বহুকিছু মনে রাখতে পারে।
‘সবমিলিয়ে দুটো সার্ভেইলেন্স ভেহিকেল,’ বলল রামিন। ‘প্রথমটা পথের ডানে জেসিকার বাড়ির তিরিশ গজ আগে। কালো মার্সিডিয-বেন্য জি-ক্লাস। জানালার কাঁচ কালো। গাড়ির ভেতরে আছে অন্তত দু’জন।’
‘ঠিক,’ মৃদু মাথা দোলাল ওয়াকার।
দূরের স্কয়্যার দেখাল রামিন। ‘দ্বিতীয় গাড়ি পাবলিক টয়লেটের কাছে। সত্যি কেউ পানির পাইপ বা কল মেরামত করাতে মিস্ত্রি ডাকলে, রাত নামার আগেই কাজ শেষ করে বিদায় নেয়ার কথা ছিল। তা ছাড়া, ভ্যান আছে অদ্ভুত অ্যাঙ্গেলে, যাতে পেছনের জানালা দিয়ে দেখতে পারে জেসিকার বাড়ি। ভ্যানের কাঁচে কালো রঙ থাকলেও কিছু অংশে নেই। তাই মনে হচ্ছে, পেছনে ট্রাইপডে স্কোপ বা বিনকিউলার রেখে ওদিকটা দেখছে কেউ।
‘দলে ক’জন?’ মনের কথা চেপে জানতে চাইল ওয়াকার। ভাবছে, দেখা যাক রামিন কী বলে।
মাথা নাড়ল রামিন। ‘বলা মুশকিল। কম করে হলেও মার্সিডিযে দু’জন। অন্য তিনজন ভ্যানে। তা হলে সবমিলিয়ে পাঁচজন। প্রথমবার ওদিকে গিয়ে একজনকে দেখেছি পার্কের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ফুঁকতে। পরনে সবুজ জ্যাকেট। মাথার এলোমেলো চুল লালচে। মেয়েটার বাড়ির দিকে মুখ করে বসে কথা বলছিল ফোনে। কিন্তু বৃদ্ধ তাঁর কুকুর নিয়ে পার্কের কাছে যেতেই উধাও হয়েছে। বোধহয় ফিরে গেছে ভ্যানে, বা ঢুকে পড়েছে ফাঁকা দালানে। ওটা ওদের আস্তানা হলে ওখানে আছে আরও ক’জন। পালা করে দেখছে ওপরের জানালা দিয়ে। ওগুলো আবার বোর্ড দিয়ে বন্ধ করা নয়। আপাতত আর কিছুই বলতে পারব না।’
ওর মত একই ধারণা পোষণ করছে ওয়াকার। ‘তো ধরো আটজন। আরও বেশিও হতে পারে। আগে এদের চেয়ে ঢের ভাল নজরদারী করতে অনেককে দেখেছি। তারা চারদিকে চোখ রাখত। সর্বক্ষণ চক্কর দিত তাদের গাড়ি। মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে বেরোলে ফোনে বা রেডিয়োতে বোধহয় যোগাযোগ করবে এরা।
‘আপনার কি মনে হয় এরা সরকারি এজেন্ট?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল রামিন।
‘জানি না। তবে যারাই হোক, দলে ভারী। চোখ রাখছে নিঃসঙ্গ এক মেয়ের ওপরে।’
‘মাসুদ ভাই আসতে পারেন ভেবেই হয়তো এতটা সতর্ক,’ বলল রামিন। ‘ভাল করেই জানে উনি কতটা বিপজ্জনক। কাজেই, ধরে নিন সঙ্গে করে আগ্নেয়াস্ত্র এনেছে এরা।’
‘হ্যাঁ, আর সেজন্যেই কোন ঝুঁকি আমরা নেব না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ওয়াকার। কঠোর হয়ে গেছে ওর চোখের ভাষা।
‘এবার কী করতে চান?’ জানতে চাইল রামিন
‘চুপচাপ অপেক্ষা করব,’ বলল ওয়াকার।
আঁধার রাতে নির্জন পথ হয়ে গেছে কবরের মত থমথমে। ওরা আলাপ করে নিল, প্রতি দু’ঘণ্টা পর পালা বদল করে চারপাশে চোখ রাখবে। প্রথমে দায়িত্ব নিল ওয়াকার। মিলিটারি স্পেশাল ফোর্সে কমাণ্ডো রেইডে বহুবার গেছে, তাই ধৈর্যের অভাব নেই ওর। ওদিকে রানার কাছে কঠিন ট্রেইনিং নিয়েছে রামিন। তাই কাজে কোন ত্রুটি রাখবে না সে। অনেকে যোদ্ধাজীবন রোমাঞ্চকর ভাবলেও নানান সমস্যার কথা ভাবে না। প্রস্রাবের জন্যে কোকের বড় দুই বোতল কাছে রেখেছে ওয়াকার ও রামিন।
রাত এগারোটায় নিভে গেল জেসিকার লিভিংরুমের বাতি। এক মিনিট পর আলো জ্বলল দোতলার বাথরুমে। স্নানের জন্যে বিশ মিনিট ব্যয় করল মেয়েটা। এরপর বেডরুমের পর্দার ফাঁক গলে এল নীলচে আভা। এগারোটা বত্রিশ মিনিটে নিভে গেল আলো। আশপাশের বাড়ি ডুবে গেছে ঘুটঘুটে আঁধারে। তবে একটু দূরের এক বাড়িতে রাতজাগা পেঁচার মত জেগে রইল এক প্রতিবেশী। রাত একটায় ঘুমাতে গেল সে।
অনেকক্ষণ পর প্লামারের ভ্যান থেকে নামল এক লোক। চোরের মত গিয়ে ঢুকল পার্কে। দূর থেকে রামিন দেখল, আঁধারে জ্বলজ্বল করে উঠে আবারও নিষ্প্রভ হচ্ছে সিগারেটের ছোট্ট কমলা ফুলকি। বারো মিনিট পর ভ্যানে ফিরল সে। সময়টা নোটবুকে টুকে নিল রামিন। চোখ বোলাল চিকন দালানের ওপরে। ভাবছে, ওখানে তারা কয়জন?
একঘণ্টা পর এল ওয়াকারের পালা। বাঙ্কে শুয়ে পড়ল রামিন। কালো মার্সিডিয-বেন জি-ক্লাস থেকে নেমে জেসিকার বাড়ির সামনে গেল এক লোক। থেমে হাতের দুই মুঠো ভরল প্যান্টের পকেটে। আবার হাঁটতে লাগল। ওয়াকার ধারণা করল, প্লামারের ভ্যানে কারও সঙ্গে কথা বলবে সে। যদিও সেটা না করে ঢুকল পাবলিক টয়লেটে। গাড়িতে বসে বোতলে জলবিয়োগ করার মত সতর্ক নয় সে। পাঁচ মিনিট পর বেরোল পাবলিক টয়লেট থেকে। স্কয়্যারের সোডিয়াম বাতির আলোয় উস্কোখুস্কো চুল দেখাল লাল বর্ণের। যুবক গিয়ে উঠল মার্সিডিয়ে। একবারের জন্যেও ব্লাডার খালি করতে বের হয়নি তার সঙ্গী।
নোটবুকে তথ্যগুলো টুকে রাখল ওয়াকার।
ভোর চারটায় বাঙ্ক থেকে নেমে পড়ল রামিন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাতের এ-সময়ে সবচেয়ে অসতর্ক থাকে মানুষ। এটাই হামলা করার সেরা মুহূর্ত। ‘ওদেরকে বন্দি করতে চান?’ জানতে চাইল ও।
‘পারলে খুশি হতাম। তবে দলে তারা অনেক। তা ছাড়া, সরু দালানে কয়জন, তা-ও জানি না। কাজেই কোন ঝুঁকি নেব না।’
এরপর নতুন কিছুই ঘটল না। এল ম্লান এক বিষণ্ণ ভোর। মুখ গোমড়া করেছে আকাশ। একটু পর অঝোরে নামল ঝমঝমে বৃষ্টি। ভ্যানের ছাতে উঠল তবলার ঝোড়ো বোল। আধঘণ্টা পর থেমে গেল আকাশের হুতাশ ভরা ক্রন্দন।
সকাল সাতটায় বাড়ি ছেড়ে বেরোল জেসিকা। মাথায় নীল ক্যাপ, পরনে নিভাঁজ ইউনিফর্ম, পায়ে চকচকে জুতো। দীর্ঘ চুলের পুরু বেণী দোলাতে দোলাতে গিয়ে উঠল ল্যাণ্ড রোভারে। পথের ধারে কালো মার্সিডিয-বেন্য জি-ক্লাস বা প্লামারের ভ্যানের দিকে না চেয়ে নিশ্চিন্তে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল পুলিশ স্টেশন লক্ষ্য করে।
ওয়াকার ও রামিন বুঝে গেল, মেয়েটা জানে না চোখে চোখে রাখা হয়েছে ওকে। স্কয়্যারে পৌঁছে বাঁক নিয়ে চলে গেল বাদামি ল্যাণ্ড রোভার। এক সেকেণ্ড পর চালু হলো কালো মার্সিডিযের ইঞ্জিন। পিছু নেয়ার জন্যে ছিটকে এগোল গাড়িটা। আগের জায়গায় রয়ে গেছে প্লামারের ভ্যান।
হাতঘড়ি দেখল রামিন। বাজে এখন সাতটা দুই মিনিট।
‘আজকে বোধহয় আমাদের মেলা কাজ!’ বলল ওয়াকার।