1 of 2

কিলিং মিশন – ২২

বাইশ

‘শেষমেশ তো খুন হলাম- এইবার?’ জানতে চাইল ফক্স।

দেড় শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে রানার গাড়ি। সাঁই-সাঁই করে পিছনে পড়ছে কালো ফিতার মত আঁকাবাঁকা পথ। ‘যাদের হয়ে কাজ করতে, তাদের সম্পর্কে বলো।’

‘কাউকে চিনি না,’ বলল ফক্স। ‘অফিসের ঠিকানা আসলে ভুয়া। একেক সময় একেক অফিসে ডাকত। একমাত্র সূত্র শার্লন হল। ওটার মালিকের সঙ্গে এদের সম্পর্ক না থেকেই পারে না। হয়তো ওখানে গিয়ে দু’একজনকে তুলে আনলে অনেক কিছুই আমরা জানব। পরে ঠিক করবেন কী করা যায়।’

একই কথা ভেবে পরে চিন্তাটা বাতিল করেছে রানা। ‘তোমার তো জানা আছে ওই বাড়ির সিকিউরিটি কেমন। একবার ক্যামেরায় ধরা পড়লে খবর যাবে লিয়োনেলের কাছে। সে দেরি করবে না স্কটল্যাণ্ডে ফোন করতে।’ মাথা নাড়ল রানা। ‘এতবড় ঝুঁকি নেব না। তা ছাড়া, মনে হয় না কারও বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয় শার্লন হল। তথ্য পাওয়ার জন্যে অন্য কোন পথ খুঁজতে হবে।’

‘তো আপনিই বলুন কী করবেন?’

‘যাকে খুন করতে গিয়েছিলে, তার কাছ থেকে হয়তো কিছু জানতে পারব।’

‘পশ্চিম সাসেক্সের এক গ্রামে তার বাড়ি,’ বলল ফক্স।

ইউরোপের ম্যাপ মনে মনে দেখে নিয়ে দূরত্বের হিসাব কষল রানা। ফ্রান্স-স্প্যানিশ সীমান্ত থেকে সড়কপথে ক্যালেই প্রায় এগারো শ’ কিলোমিটার, অর্থাৎ সাত শ’ মাইলেরও বেশি। ইংলিশ চ্যানেল পেরোলে আরও কয়েক ঘণ্টা লাগবে সাসেক্সে যেতে। ঝোড়ো বেগে গেলেও দুপুরের দিকে পৌঁছুবে। এতকাল পৃথিবী ছোট শোনার পর আজ হঠাৎ রানার মনে হলো, এই দুনিয়াটা এত বড় না হলেও পারত।

‘লোকটা হুমকি হয়ে উঠছে বলেই তাকে খুন করতে চেয়েছে,’ বলল রানা। ‘সুতরাং তাকে হাতে পেলে বহুকিছুই জানব আমরা।’

‘সমস্যা হচ্ছে, সে নিজেই ছিল মস্ত বিপদে,’ বলল ফক্স। ‘হয়তো এরই ভেতরে খুন হয়ে গেছে।’

কথা ঠিক।

নিচু কণ্ঠে বলল রানা, ‘সে আসলে কে, ফক্স?’

তিক্ত হাসল যুবক। ‘খুনের পেশা যখন ছেড়ে দিয়েছি, তাই বলতে দ্বিধা নেই। তার নাম স্টিভ হ্যারিস।’

আবছাভাবে মগজে ঘণ্টি বাজল রানার। ‘পুরো নাম স্যর স্টিভ হ্যারিস? ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি?’ লেবার পার্টির ওই সদস্য একসময় রাজনীতিক হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। পরে আরও যোগ্যদের খ্যাতির নিচে চাপা পড়ে গেছে তার সুনাম।

‘ওই লোকই। সুট পরা ধূসর চুলের বয়স্ক এক হারামি।’

‘অবাক হচ্ছি যে তার বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ড নেই।’

‘অত টাকা কোথায় তার,’ বলল ফক্স। ‘শুনেছি লোকসান করে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।’

‘ব্রিটিশ একজন এমপি খুন হলে হৈ-চৈ হবে।’

‘বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার সময় গুলিতে মরত,’ বলল ফক্স। ‘ইংল্যাণ্ডের গ্রামাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার যে বাজে হাল, সে খুন হলে সন্দেহ করত না কেউ। পশ্চিম সাসেক্সের বদলে সারে কাউন্টির শার্লন হলে তাকে খুন করলে, লাশ এনে রাখতাম তার বাড়িতে। দলের হর্তাকর্তারা সেটাই চেয়েছিল।’

‘ধরলাম শার্লন হলে খুন করে লাশ সাসেক্সে তার বাড়িতে নিয়ে গেলে, কিন্তু তার গাড়ির কী করতে?’

কাঁধ ঝাঁকাল ফক্স। ‘এসব নিয়ে ভাবতে হতো না। যা করার দলনেতা করত। আমি ছাড়াও অনেকেই তার হয়ে কাজ করে।’

তথ্যটা নীরবে হজম করল রানা।

‘সেদিন আয়া আর বাচ্চাদুটো না এলে খুন হতো হ্যারিস। অবশ্য বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও আমার কোন লাভ হয়নি। আমি তো আর মহিলা বা বাচ্চার সামনে তাকে খুন করব না।’

দস্যু রবিন হুডের মতই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, অসহায় মানুষ বা বোবা পশুর কোন ক্ষতি করে না ফক্স, মনে পড়ল রানার। ‘তোমরা চলে যাওয়ার আগে সেই বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, সেভাবে সব সাজাতে?’.

মাথা নাড়ল ফক্স। ‘না, খুন করে উধাও হতাম আমি। তখন কাজে নামত আরেক দল। পুলিশের জন্যে ছড়িয়ে দিত ভুল সব সূত্র।’

তোমার জানা নেই, হ্যারিসকে কেন খুন করতে চেয়েছে?’

‘আমাকে কিছু বলেনি। আপনি নিজেই তো বললেন, আমার বসের জন্যে হুমকি হয়ে উঠেছিল সে।’

সামনে মোটরওয়ে সার্ভিস স্টেশন দেখে ওখানে থামল রানা। ফিউয়েলে ভরে নিল গাড়ির ট্যাঙ্ক। হতক্লান্ত শরীরে শক্তি ফেরাতে দোকান থেকে কিনল কয়েকটা এনার্জি বার। ফক্সের সঙ্গে গাড়িতে বসে চকোলেট চিবুতে চিবুতে পকেট বার। থেকে নিল স্মার্টফোন। ইণ্টারনেটে ঢুকে দেখল অনলাইন নিউয চ্যানেল। একটু পর বুঝল, ইদানীংকালে কোন ব্রিটিশ সিনিয়র এমপিকে খুন করা হয়নি।

মিনিট পাঁচেক পর হাল ছেড়ে স্মার্টফোন রেখে রানা বলল, ‘হয়তো মিডিয়াকে এড়াতে পেরেছে লিয়োনেল। অথবা এখনও বেঁচে আছে স্টিভ হ্যারিস।’

চকোলেটের মোড়ক ́ গাড়ির পাশে ডাস্টবিনে ফেলল ফক্স। ‘বেঁচে থাকলেও যে-কোন সময়ে মরবে।’

‘আমি তাকে জীবিত চাই,’ বলল রানা

‘তাকে খুন করতে পারলে আজ এত বিপদে পড়তাম না।’ রানার দিকে তাকাল ফক্স। ‘হয়তো জানেন না, স্টিভ হ্যারিস মরলে অনেক উপকার হবে দুনিয়ার।

শার্লন হলের দ্বীপে মেয়েটার করুণ মৃত্যু দেখেছে বলেই এ-কথা বলেছে ফক্স, বুঝে গেল রানা।

‘সেই পার্টিতে যারা গিয়েছিল, তারা আসলে পশুর চেয়েও অনেক অধম। এমনি এমনি তো আর প্রায় সব ধর্মে শয়তানের অনুসারীদেরকে মহাপাপী বলেনি!’

‘তুমি কি ধর্ম বিশ্বাস করো?’ জানতে চাইল রানা।

‘স্রষ্টাকে কখনও নিজের চোখে দেখিনি। আছে, এমন কোন প্রমাণও কখনও পাইনি। তাই তাকে নিয়ে আমার ভেবে কী লাভ? সে এমন এক মালিক, যে নিজের বাড়ি ভেঙে পড়লেও কিছুই করে না। কিন্তু পৃথিবীতে আছে অশুভ বহুকিছু। নিজেই অনেক খারাপ কাজ করেছি।’ কাঁধ ঝাঁকাল ফক্স। ‘আপনার কী মনে হয়, সত্যিই আকাশে কেউ বসে আছে?’

কিছুক্ষণ ভেবে বলল রানা, ‘আমি জানি না। তবে শয়তান নয়, আমাদের এই লড়াই তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। তাদের মৃত্যু হলে অশুভ শক্তিও আর থাকবে না।’

‘সেক্ষেত্রে অসংখ্য নরাধমকে খতম করতে হবে।’

‘আমরা আমাদের সাধ্যমত করব, বলল রানা।

‘টাকার লোভে অনেকেই মানুষ-শিকার করে,’ বলল ফক্স। ‘হ্যারিস বেঁচে থাকলেও চোখ রাখা হয়েছে তার ওপর। প্রথম সুযোগে খতম করে দেবে। হয়তো এ-মুহূর্তে খুন হচ্ছে।

‘সুতরাং দ্রুত ফিরতে হবে ব্রিটেনে,’ বলল রানা।

ভোর চারটেয় দক্ষিণ ফ্রান্সের পুবাকাশে ফুটল লাল ছোপ। অবশ্য সময় লাগবে সূর্যোদয় হতে। আরও বারোঘণ্টা স্বাভাবিক বেগে গাড়ি-চালনা করা হলে রানা ও ফক্স পৌঁছুবে সাসেক্সের সেই গ্রামে। রানা যেন বিশ্রাম পায়, তাই ড্রাইভ করল ফক্স। তুমুল বেগে ছুটে চলল ক্যালেই লক্ষ্য করে।

চোখ বুজে সিটে হেলান দিলেও ঘুরে-ফিরে জেসিকার মুখ ভেসে উঠছে রানার মনের আয়নায়।

‘হ্যারিসকে কেন খুন করতে চাইছে?’ অনেকক্ষণ পর দিগন্তে সোনালি রোদ হেসে উঠতেই আনমনে বলল ফক্স।

চুপ করে থাকল রানা। ওরা জানে না, এ-মুহূর্তে স্টিভ হ্যারিসের কথাই ভাবছে অন্য কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *