এক
দুর্ভেদ্য অরণ্য। আকাশছোঁয়া মহীরুহ। ঘন পাতার ফাঁক গলে নেমে এসেছে পূর্ণিমার চাঁদের রুপালি জ্যোৎস্না।
সময়টা মার্চের শেষার্ধ।
কিছুদিন আগে কুয়াশার ধূসর চাদর গায়ে বিদায় নিয়েছে শীতের থুথুরে বুড়ি। বদলে এসেছে চিরতরুণী রানি অপরূপা বাসন্তী দেবী। তারই মায়াজাদুর ছোঁয়ায় বনভূমির মেঝেতে পুরু গালিচার মত বিছিয়ে আছে ঝরে যাওয়া নীল অপরাজিতা, চারপাশ ম-ম করছে ফুলের অদ্ভুত মিষ্টি সুবাসে। অবশ্য এসবে একদম মন নেই যুবকের; কয়েক ঘণ্টা আগে ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণ উপকূল থেকে এসে পৌঁছে গেছে পশ্চিম সাসেক্স কাউন্টির নির্জন এক বাড়ির বাগানে।
পেশাদার খুনির নাম উইলবার ফক্স। এ-কাজে পাবে এক লাখ পাউণ্ড। এদিকে নির্দেশ অমান্য করলে নিজেও খুন হবে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক দলনেতার হুকুমে।
আজ চরম দুর্ভাগ্য ভর করেছে উইলবার ফক্সের ওপরে। বিকেলে লোকটাকে খুন করবে, এমনসময় শুরু হলো বিশ্রী ধরনের ঝামেলা। স্থির করা ছিল সাতটার সময় খুন হবে তার টার্গেট। তখন একা থাকে সে। কিন্তু উনিশ শতকের বাড়িটার সাজানো-গোছানো বাগানে উইলবার ফক্স ঢুকতেই, কোথা থেকে এসে মেইন গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল খয়েরি রঙের ল্যাণ্ড ক্রুযার। ড্রাইভওয়ের নুড়িপাথরে কড়মড় শব্দ তুলে কড়া ব্রেক কষে থামল স্টিভ হ্যারিসের প্রিমিয়ো গাড়িটার পাশে।
প্রকাণ্ড এক গাছের ওদিক থেকে চেয়ে রইল উইলবার ফক্স। চাপা ধুপ শব্দে খুলে গেল ল্যাণ্ড ক্রুয়ারের চার দরজা। গাড়ি থেকে নামল স্টিভ হ্যারিসের তিন নম্বর প্রাক্তন স্ত্রী, তার দুই ছেলেমেয়ে ও বুড়ি এক আয়া। তালাকপ্রাপ্তা এই স্ত্রী হয়ে উঠেছে পঞ্চান্ন বছর বয়সী হ্যারিসের গলার কাঁটা। গাড়ি থেকে নেমে এদিকে-ওদিকে তাকাল সাত বছরের ডেভিড ও পাঁচ বছর বয়সী লায়লা। ভাড়াটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিল – ম্যালোনের কাছ থেকে উইলবার ফক্স জেনে নিয়েছে, মায়ের সঙ্গে ব্রাইটন শহরে মনোরম এক বাংলো-বাড়িতে থাকে বাচ্চাদুটো। তাদের মা-বাবার তালাক হওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে এই বাড়িতে। সন্দেহের বশে স্বামী তালাক দেয়ায় আদালতের নির্দেশে তিন মিলিয়ন পাউণ্ড পেয়েছে যুবতী ক্যাথি হ্যারিস। কাজেই চরম বিলাসিতার অবকাশ আছে তার। বেশকিছু দিন ধরেই ধনী সব যুবক জুটিয়ে নিয়ে নামি হোটেল ও দামি রিসোর্টে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে সে। তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই উইলবার ফক্সের, কিন্তু যুবতী এভাবে হঠাৎ করে চলে আসায় বাধা পড়েছে ওর কাজে।
খুলে গেল বাড়ির সদর দরজা। সম্ভ্রান্ত ইংরেজদের মত ঢিলা ক্রিকেট জাম্পার ও ঢলঢলে প্যান্ট পরনে বেরিয়ে এল স্টিভ হ্যারিস। সূর্যের লালচে আলোয় চিকচিক করছে মাথার পাকা রুপালি চুল। তিক্ত হয়ে আছে তার চেহারা।
‘আব্বু!’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল লায়লা।
‘আব্বু!’ জোরে ডাক দিল ডেভিড।
হ্যারিসের দিকে ছুটে গেল তার দুই ছেলেমেয়ে। লায়লা ঝুলে পড়ল বাবার কনুই ধরে। ফোনের সঙ্গে যুক্ত করা যুম টেলিফোটো লেন্স-এর মাঝ দিয়ে হ্যারিসকে দেখছে ফক্স।
পাথরের মত কঠিন মুখে কনুই ছুটিয়ে নিল পলিটিশিয়ান। প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক বোধহয় জমাট বরফের চেয়েও কঠিন। মহিলাও দাঁড়িয়ে আছে আড়ষ্ট হয়ে। হ্যারিস বোধহয় ভাবছে, কখন বিদায় নেবে দুশ্চরিত্রা ক্যাথি চট্ করে হাতঘড়ি দেখল সে। জরুরি কাজ আছে বোধহয়। হঠাৎ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যাথি চলে আসায় খুব বিরক্ত।
দু’চার কথা সেরে গাড়িতে উঠল অদ্ভুত অপরূপা সুন্দরী ক্যাথি। একটু পর নির্জন রাস্তার বাঁকের ওদিকে হারিয়ে গেল তার ল্যাণ্ড ক্রুযার। তাতে ফক্স খুশি হলেও হ্যারিসের জিম্মায় ছেলেমেয়ে ও বুড়ি আয়াকে রেখে গেছে যুবতী। নিজে বোধহয় চলেছে পেশিবহুল একাধিক নাগরের সঙ্গে বিছানায় উদ্দাম-আনন্দে মাতোয়ারা হতে। প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচজন তাগড়া যুবকের সঙ্গে মিলিত না হলে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তার জীবন।
এখন আর অপেক্ষা না করে কোন উপায় নেই, বুঝে গেল ফক্স। পেশাদার অন্য খুনি হলে হ্যারিসকে এখনই খুন করত। কিন্তু কিছু নীতি মেনে চলে ফক্স। দশ কোটি পাউণ্ড পেলেও বাচ্চাদের সামনে তাদের বাবাকে হত্যা করবে না সে। কঠোর ট্রেইনিং ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছে বলে, ওর জানা আছে কীভাবে ধৈর্য ধরতে হয়। ঝোপের মধ্যে বসে বাড়ির ওপর চোখ রাখল ফক্স।
রাত সাড়ে নয়টায় বাড়ি ছেড়ে আবারও বেরোল স্টিভ হ্যারিস। চট্ করে গিয়ে উঠল প্রিমিয়ো গাড়িতে। পরনে কালো রঙের সুট। গলায় নিভাঁজ টাই। পায়ে কালো শ্য। হাতে কমোডো ড্রাগনের চামড়া দিয়ে তৈরি ওভারনাইট ব্যাগ। ফক্স ধারণা করল, বাচ্চাদেরকে আয়ার কাছে গছিয়ে অন্য কোথাও ফুর্তি করতে চলেছে পাষণ্ড বাবাও। এ-ব্যাপারে এজেন্সি থেকে কিছুই বলা হয়নি ওকে। ক্যাথি বিকেলে হাজির না হলে বহু আগেই কাজ শেষ করে উধাও হতো ও।
মেইন গেট পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় গিয়ে পড়ল স্টিভ হ্যারিসের প্রিমিয়ো। ততক্ষণে বাগানের পাঁচিল টপকে ঝোপের পাশে রাখা ফোর্ড মাস্ট্যাঙে গিয়ে উঠেছে ফক্স। তার চুরি করা গাড়িটার নেমপ্লেট ভুয়া। পরের তিন মিনিটে পৌঁছে গেল হ্যারিসের গাড়ির এক শ’ গজ পেছনে। সরু গ্রাম্য পথে ঝোড়ো বেগে ছুটে চলেছে হ্যারিস। ফক্সের মনে হচ্ছে, খুব চেনা কোথাও যেতে তাড়া আছে লোকটার।
সামনে সুযোগ এলে তাকে খতম করে দেবে ফক্স। রাজনৈতিক নেতা জানে না তার পিছু নিয়েছে প্রশিক্ষিত খুনি। সতর্কতার সঙ্গে দুই গাড়ির মাঝে এক শ’ গজ ব্যবধান রেখে এগিয়ে চলেছে ফক্স। এ২৩ এবং এম২৫ মহাসড়ক ধরে পঞ্চাশ মাইল গিয়ে সারের উত্তরদিকে পৌছল স্টিভ হ্যারিস। ফক্সের মনে হলো, সে যাবে গিল্ডফোর্ডে। অবশ্য একটু পর মহাসড়ক ছেড়ে গ্রাম্য পথে আবারও নামল পলিটিশিয়ান। বাঁদরের লেজের মত তার পেছনে ঝুলে রইল ফক্স। দশটা পঞ্চান্ন মিনিটে সারে কাউন্টির জঙ্গল-ঘেরা বিশাল এক এস্টেটের গেট দিয়ে ঢুকল হ্যারিসের প্রিমিয়ো। সে যেন সন্দেহ না করে, তাই স্বাভাবিক বেগে জায়গাটা পার হলো ফক্স। দু’সারি প্রাচীন ওক গাছের মাঝে কারও ব্যক্তিগত পথে চলেছে প্রিমিয়োর রক্তিম ব্যাক-লাইট। গেটের পাথুরে কলামে লেখা: শার্লন হল। বিশাল সব গাছে ভরা ঘন জঙ্গল আড়াল করে রেখেছে বাড়িটাকে।
সিকি মাইল গিয়ে গাছের জটলা দেখে ওখানে গাড়ি রাখল উইলবার ফক্স। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে পায়ে হেঁটে ফিরে এল শার্লন হলের কাছে। এস্টেট ঘিরে পাথরের উঁচু দেয়াল। ওটা অনায়াসে পেরিয়ে ওদিকের জঙ্গলে নামল ফক্স। সতর্ক পায়ে চলল বাড়িটার দিকে। একটু পর গাছের সারির আড়াল থেকে চোখ রাখল ব্যক্তিগত পথের ওপরে। দূরে চেক-পোস্টে থামছে একের পর এক গাড়ি। ড্রাইভাররা জানালার কাঁচ নামিয়ে কার্ড দিতেই ওটার ওপর চোখ বুলিয়ে হাতের ইশারা করছে একদল সিকিউরিটি গার্ড। প্রাসাদের মত প্রকাণ্ড বাড়ির উঠনে থেমে গাড়ির পেছন-দরজা খুলছে ড্রাইভার। আরোহীরা গিয়ে ঢুকছে বাড়িটাতে। ফক্স বুঝে গেল, আজ মস্ত ধনীদের জন্যে জমজমাট এক পার্টি হবে।
রাত বাজে এগারোটা তেইশ। আগেই ফক্সের উচিত ছিল এজেন্সিতে যোগাযোগ করা। লণ্ডনে ওর নিয়োগকর্তারা বোধহয় ধরে নিয়েছেন বাজে ধরনের ঝামেলায় পড়েছে ও।
এ-মুহূর্তে ভাবছে ফক্স: হার মেনে মিশন বাতিল করে দেবে, নাকি টার্গেটকে শেষ করার জন্যে এখানে রয়ে যাবে?
জীবনে বহু বাধাবিঘ্ন এলেও কখনও পরাজয় মেনে নেয়নি ফক্স। এখন কী করবে সেটা ভাবার আগেই নিঃশব্দে চেক- পয়েন্টে সিকিউরিটি গার্ডদের পাশে থামল কালো এক রো রয়েস। ওটার জানালার কাঁচ নামিয়ে গার্ডের হাতে আমন্ত্রণপত্র দিল ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে পরখ করল সামনের চাকা। দরজা খুলে যাওয়ায় গাড়ির কেবিনে জ্বলে উঠেছে হলদেটে আলো। মৃদু সে-আলোয় হঠাৎ করেই ফক্স চিনে গেল গাড়ির পেছন-সিটের দু’জনকে। যে এজেন্সির হয়ে খুনের কাজ করে ও, ওটার হর্তাকর্তাদের সঙ্গে মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে ওর। তাদের মধ্যে ক্ষমতাশালী এ- দু’জনকে ভাল করেই মনে আছে। ডানদিকের লোকটার বয়স অন্তত নব্বুই। ঝুলঝুল করছে মুখ, গলা ও হাতের কোঁচকানো ত্বক। কাঠির মত চিকন দেহ। পরনে কালো সুট। দু’হাঁটুর মাঝে কারুকাজ করা কাঠের কালো ওয়াকিং স্টিক। আগে কখনও ওই জিনিস অন্য কারও কাছে দেখেনি ফক্স। সাদা হাতল শিকারি পাখির মাথার মত। তীক্ষ্ণ চঞ্চ। পাখির চোখ রুবি পাথরের তৈরি। বৃদ্ধকে জীবনে মাত্র একবার দেখলেও ওই লাঠির কথা মনে রয়ে গেছে ফক্সের। বামদিকের লোকটা বয়সে বৃদ্ধের অন্তত ত্রিশ বছরের ছোট। গত দু’বছরে বেশ ক’বার অফিসে ডেকে ওর সঙ্গে কথা বলেছে সে।
চেক-পয়েন্ট পেরিয়ে প্রাসাদ-আঙ্গিনায় গিয়ে থামল রোলস রয়েস। ওটার দুই আরোহীকে এই পার্টিতে দেখে বিস্মিত বোধ করছে ফক্স।
এদের নির্দেশেই না আজ খুন হবে স্টিভ হ্যারিস?
সেক্ষেত্রে এরা একই পার্টিতে কেন?
ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক!
তা হলে আসলে হচ্ছেটা কী?
বসদের নির্দেশ এলে প্রশ্ন না তুলে কাজ শেষ করে ফক্স। কিন্তু এখন খচ খচ করছে ওর মন। এরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হলেও নিজেদেরই একজনকে খতম করে দিতে চাইছে!
চেক-পয়েন্ট থেকে সরে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বিশাল প্রাসাদের দিকে গেল ফক্স। ভাবছে, এ-বাড়িতে যে-লোক বাস করে, তার আছে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউণ্ড। নিশিরাতের কালো সাগরে ভাসমান প্রমোদতরী থেকে যেমন ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ে, তেমনই উজ্জ্বল প্রভা আসছে প্রতিটি জানালা থেকে। দিন করে দেয়া ফ্লাডলাইটের কিরণ পড়েছে নিয়মিত ছেঁটে রাখা ঘাসে ছাওয়া বিশাল লনে। প্রাসাদের পেছনের লন ঢালু হয়ে মিশে গেছে কালো জলের বড় এক লেকে। জলাশয়ের মাঝে জঙ্গলে ভরা ছোট দ্বীপটা ডুবে আছে রহস্যের আবছায়ায়। বিশাল ম্যানরের আলোভরা জানালার দিকে চেয়ে ফক্স দেখল, অতিথিরা সংখ্যায় হবে কমপক্ষে পঞ্চাশজন। কয়েকটা জটলা তৈরি করে গল্পগুজব করছে। কারও কারও হাতে সোনালি তরলের গ্লাস। বড় কোন উপলক্ষ আছে বলে সবার পরনে দামি সুট। গলায় টাই। ফক্স লক্ষ করল, পার্টিতে আসেনি কোন মহিলা।
জঙ্গলের ধারে থেমে শক্তিশালী কমপ্যাক্ট টেলিফোটো লেন্স ব্যবহার করল ফক্স। স্টিভ হ্যারিসকে খুঁজছে ওর চোখ। কিন্তু ভিড়ের ভেতরে নেই লোকটা। ফক্স ভাবল, আজ হয়তো খুন করতে পারবে না তাকে।
ওর জানা নেই, একটু পর দেখবে ভয়াবহ এক দৃশ্য।
রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে দপ করে নিভে গেল শার্লন হলের সব বাতি। চারপাশে নেমে এল ভুতুড়ে থমথমে পরিবেশ। আলো বলতে রইল শুধু লেকের দিগন্তে থালার মত পূর্ণিমার ঘোলাটে চাঁদ। নীরবে পেরোল বেশ কয়েক মিনিট, তারপর মাঝরাতের আগেই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা।
প্রাসাদের খিড়কি দরজা খুলে একসারিতে বেরোল একদল লোক। লনের ঘাস মাড়িয়ে লেকের ধারে গিয়ে থামল তারা। প্রত্যেকের পরনে গোড়ালি-ঢাকা কালো আলখেল্লা। মাথায় অবগুণ্ঠন। মুখের মুখোশটা শিকারি পাখির মুণ্ডের মত। নাকের জায়গায় তীক্ষ্ণ চঞ্চু। এজেন্সির বৃদ্ধ নেতার ওয়াকিং স্টিকের হাতলের কথা মনে পড়ে গেল ফক্সের।
লেকের ধারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দ্বীপের দিকে চেয়ে রইল তারা। জঙ্গল থেকে নিজেও ওদিকে তাকাল ফক্স। ওর মনে হলো এবার ঘটবে খুব অস্বাভাবিক কিছু। কয়েক মুহূর্ত পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সবাইকে। কিন্তু একটু পর হাল ছেড়ে দিল। আলখেল্লা, হুড ও মুখোশের জন্যে বোঝার উপায় নেই কে আসলে স্টিভ হ্যারিস। সে হয়তো নেই-ই ওই দলে! পোশাকের জন্যে সবাই দেখতে একইরকম হলেও একজন তার ব্যতিক্রম। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়াকিং স্টিকে ভর করে লেকের তীরে যাওয়ার সময় তাকে চিনে নিয়েছে ফক্স। এজেন্সির বড়কর্তা সেই বৃদ্ধ!
এখানে আসলে কী ঘটছে? – ভাবল ফক্স। ওর মনে হলো, ভিডিয়ো করা উচিত, নইলে পরে ভাববে এসব দৃশ্য দেখেছে দুঃস্বপ্নে। কথাটা ভাবতেই ফোনের ক্যামেরা চালু করে রেকর্ড বাটন টিপল ও।
এদিকে নিচু গলায় কী যেন বলতে লাগল লোকগুলো। একটু পর গুঞ্জন হয়ে উঠল ছন্দবদ্ধ প্রার্থনা। কেমন শিরশির করে উঠল ফক্সের বুক। ইংরেজিতে কথা বলছে না কেউ। আগে কখনও এ ভাষা শোনেনি ফক্স। ক্রমেই জোরালো হচ্ছে সম্মিলিত স্বর। এরপর রাত বারোটায় হঠাৎ করে দ্বীপে দপ করে জ্বলে উঠল আগুনের বড় এক কুণ্ডলী। লালচে আভায় ফক্স দেখল, দ্বীপের বালিয়াড়িতে অন্যকিছু। চট্ করে দু’চোখ কচলে নিল। আবারও তাকাল দ্বীপের দিকে। একটু আগেও আঁধারে ডুবে ছিল বিশাল মূর্তি। লকলকে শিখায় এখন দৃশ্যমান। নিরেট পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য। উচ্চতা কমপক্ষে পঞ্চাশ ফুট। দেহটা মানুষের হলেও অদ্ভুত মুণ্ড চকাপাখির মাথার মত। চোখা চঞ্চ। অগ্নিশিখার আলোছায়ায় লেকের এদিকের জলে এসে পড়েছে মস্ত মূর্তির অপ্রাকৃত প্ৰতিবিম্ব।
কর্কশ স্বরে চিৎকার জুড়ল প্রার্থনারত লোকগুলো। কী যেন বলছে একটু পর পর। ওটা বোধহয় অজানা কোন ধর্মের জপের বুলি। পাগল হয়ে গেছে তারা। দ্বীপে মূর্তি ঘিরে ভুসভুস করে আকাশে উঠতে লাগল ঘন ধূসর ধোঁয়া।
এপর্যন্ত দেখেই উইলবার ফক্সের উচিত ছিল বিদায় নেয়া। ভাল করত কম্পাউণ্ড ত্যাগ করলে। কিন্তু কীসের এক নেশায় পড়ে রয়ে গেল। ভাবছে: হ্যালুসিনেশনের শিকার হলাম নাকি? মন বারবার মানা করলেও দ্বীপের দিকে চেয়ে রইল ফক্স।
এরপর যা ঘটল, হতবাক হওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকল না ওর। দ্বীপে দেখা গেল কয়েকজন লোক। ফোনের ক্যামেরা যুম করে ম্যাক্সিমাম ম্যাগনিফিকেশন ব্যবহার করল ফক্স। ধোঁয়ার ওদিক থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’জন। তাদের পরনে আলখেল্লা, মুখে মুখোশ। হাতে উঁচু করে ধরেছে জ্বলন্ত মশাল। কিন্তু তৃতীয়জন তাদের কেউ নয়। এক মহিলা। মাথার চুল সোনালি। পরনে গাউনের মত ঢিলা সাদা পোশাক। দূর থেকে তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল না ফক্স। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর বুঝল, ওই মেয়ে বড়জোর কিশোরী বা তরুণী।
নিজের ইচ্ছায় দ্বীপে যায়নি। পাখির মুণ্ডের মত মুখোশ পরা লোকদু’জন শক্ত হাতে ধরেছে তার দু’হাত। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল মূর্তির দিকে। ওখানে আছে পাথরের একটি বেদি। দুর্বলভাবে বাধা দিচ্ছে মেয়েটা। এদিক-ওদিক হেলে পড়ছে ওর মাথা। ড্রাগসের কারণে বোধহয় প্রায় অচেতন। বেদিতে ঠেসে ধরে ওকে আটকে রাখল লোকদু’জন। বেচারির কবজি থেকে ঝুলছে চামড়ার ফিতা। হাত দু’দিকে টেনে পাথরের বেদির লোহার দুই কড়ায় বাঁধা হলো দুই ফিতা। এলোমেলো সোনালি চুলে ঢাকা পড়ল তরুণীর মুখ। লোকগুলো সরে যেতেই ধোঁয়ার ওদিক থেকে এবার বেরোল চতুর্থজন। তার পরনের আলখেল্লা টকটকে লাল রঙের। বুকে সোনালি অচেনা সিম্বল। অন্যদের চেয়ে বেশি কারুকাজ করা তার মুখোশ। মাথায় অনেকটা বিশপদের ব্যবহার করা আনুষ্ঠানিক মুকুটের মত। অবশ্য এ লোকের মাথার মুকুটে মর্দা ছাগলের প্যাঁচানো দুটো শিং, চকচক করছে লালচে শিখার আভায়। তার বামহাতে রাজদণ্ড, ডানহাতে ইস্পাতের ঝিকঝিকে দীর্ঘ ড্যাগার।
লেকের এপারে খেপে উঠেছে সবাই। শিংওয়ালা গিয়ে থামল হাত-বাঁধা মেয়েটার সামনে। দু’হাতে উঁচু করে ধরেছে রাজদণ্ড ও ড্যাগার। মহা উল্লাসে ফেটে পড়ল এদিকের তীরের লোকগুলো। তাদের উদ্দেশে চিৎকার করে কী যেন বলল লাল আলখেল্লা। ভাষা না জানলেও ফক্স টের পেল, এবার ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। শিংওয়ালা বোধহয় অস্বাভাবিক এই অনুষ্ঠানের যাজক। তার অধীনে বসন্ত-বিষুবের রাতে অশুভ-পূজা করতে এসেছে এরা!
নিজে কখনও কখনও নিষ্ঠুরভাবে মানব-হত্যা করেছে ফক্স। তাই ভেবেছিল দুনিয়ার ভয়াবহ সব ঘটনা ওর দেখা হয়ে গেছে। নতুন কোন কিছুই আর চমকে দেবে না। অথচ সামনের দৃশ্য দেখে মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেল ওর গলা। হাতের আঙুল কাঁপছে বলে শক্ত করে ধরল ফোন। চুপচাপ ফোনের ভেতরে ধারণ করছে ভিডিয়ো।
ধীর ভঙ্গিতে দলের একজনের হাতে রাজদণ্ড দিল লাল আলখেল্লা পরা যাজক। ঘুরে মুখোমুখি হলো মেয়েটার। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিল বেচারির সাদা গাউন। হুঙ্কার ছাড়ল এপারের সবাই। ছেঁড়া গাউন মাটিতে পড়ে যেতেই দেখা গেল মেয়েটা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বিকট শব্দে প্রার্থনা করতে লাগল এদিকের তীরের লোকগুলো।
মেয়েটার আরও কাছে গেল যাজক। ভিড় করা লোকগুলোকে দেখাতে গিয়ে উঁচু করে ধরল হাতের ড্যাগার। আগুনের লালচে আভায় চকচক করছে করাতের মত খাঁজকাটা অস্ত্রটার বাঁকা, দীর্ঘ ফলা। পরক্ষণে বাম থেকে ডানে মেয়েটার ঘাড় লক্ষ্য করে ড্যাগার চালাল সে। বেচারির কত যন্ত্রণা হচ্ছে ভাবতে গিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল ফক্স। ড্যাগারের পোঁচে ঘাড় থেকে গলা ও বুকে ঝরঝর করে ঝরল টকটকে লাল রক্ত। সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল যাজক। কী যেন করছে। কয়েক মুহূর্ত পর একপাশে সরে যেতেই দেখা গেল, মেয়েটার পেট খুঁচিয়ে তৈরি করেছে পাঁচ কোণওয়ালা রক্তাক্ত এক নক্ষত্র!
ফক্স বুঝে গেছে, যা ঘটছে তার সবই চরম বাস্তব। কেউ ওখানে অভিনয় করছে না। সত্যিই চোখের সামনে খুন করা হচ্ছে নিরীহ এক তরুণীকে!
মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ফক্স। কিন্তু তখনই চোখের কোণে দেখল মারাত্মক এক দৃশ্য। ড্যাগারের ধারালো ফলা দিয়ে বেচারির গলা দু’ফাঁক করে দিল যাজক। এখন দুনিয়ার সেরা সার্জন এলেও প্রাণে বাঁচাতে পারবে না মেয়েটাকে। আগুনের কুণ্ডলীর ভেতরে শক্তিশালী বোমার মত বিস্ফোরিত হলো কিছু। অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে ফেটে পড়ল এপারের সবাই।
টলমলে পায়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে প্রাচীর লক্ষ্য করে ছুটল ফক্স। কিন্তু একরাশ শুকনো ডাল লাগল ওর কপাল ও মুখে। মাথা নিচু করে নিল। মানুষ খুন করতে এসে যা দেখেছে, তাতে ওর মনে জন্মে গেছে এজেন্সির প্রতি চরম বিদ্বেষ। আর তাই ওই সংগঠনের হয়ে আর কখনও কোন মানুষকে খুন করবে না। এবার এমন কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে, যেখানে ওকে খুঁজে পাবে না কেউ।
প্রাচীরের দিকে ছুটতে গিয়ে মস্তবড় ভুল করেছে ফক্স। লতায় ভরা মোটা এক গাছের কাণ্ড থেকে ওকে দেখছে ছোট এক কাঁচের বৃত্তাকার চোখ। ওটা আসলে দামি কোন ভিডিয়ো ক্যামেরার লেন্স!
ফক্স বুঝে গেল, এ-মুহূর্তে স্ক্রিনে ওকে দেখছে ওয়াচরুমের ক্যামেরা অপারেটর!