কিরমান ডাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় জীবন
সড়কে ওঠে জগু বলল, একখান বিড়ি দেও গুরু।
কিরমান তার খোঁড়া পাটা টেনে হাঁটছিলো। বয়েস হল তিন কুড়ির ওপর। গতরে আগের তাকত নেই। কামকাজ ছেড়ে দিয়েছে মেলা দিন। তবুও চারপাঁচ দিন ধরে জগুর ঘ্যানঘ্যানানি, খোঁচাখুচি তাকে আজ বাড়ি থেকে বের করেছে।
কাল সন্ধ্যায় জগু এসে বলল, কাইলই তো আডের দিন। যুদি যাইতে চাও তাহলে আমারে কইয়া দেও। তুমি গেলে যাইবা নইলে সাফ কথা কইয়া দিবা। আমি পুব পাড়ার আমিনদ্দিরে লইয়া যামু।
শুনে কিরমান উদাস গলায় বলেছিল, হ, হেইডাই কর জউগ্যা। আমার ম্যালা বয়স অইছে। তগ লাহান জুয়ানকি নাই শইল্লে। কাম কাইজ ছাইড়া দিছি। আমারে লইয়া গেলে তর সুবিদা অইব না।
জগু বলল, সুবিদা অসুবিদার কিছু নাই। তুমার কোনও কাম করন লাগব না। তুমি খালি আমার লগে লগে থাকবা। তুমার যা একখান চেহারা, হেইডা দেকলে মানুষে বাবাগো কইরা চিইক্কাইর দিব। তুমার চাওনও লাগব না, লগে যা আছে বাজান কইয়া দিয়া দিব। লুঙ্গির কোচড় থেকে বিড়ি বের করেছিল কিরমান। তারপর ধরিয়ে প্রথম টানের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। চেহারাখান কি আর এই রকম বদখত আছিল রে! তুই তো পোলাপান মানুষ! বয়েসকালের চেহারাখান দেহচ নাই আমার। রাজা বাদশার লাহান চেহারা আছিল। শইলের রংখান আছিল কালাই। তয় চেহারাখান আছিল! মাইয়া মাইনষে একপলক দেইক্কাই মইজ্জা যাইত। তর ভাউজরে আনছিলাম ডাকাতি কইরা। নশংকরের মাইয়া। আমার দলে তখন সতরজন মানুষ। তর ভাউজ আছিল বহুৎ বড় গেরস্ত ঘরের মাইয়া। বচ্ছরেরডা খাইয়া থুইয়া হাজার দুই হাজার মোণ ধান বেচত। পাট কাউন বেচত হের বাপচাচারা। দিঘিরপাড়ের আডে একবার আষ্টশ মোন ধান বেচছে হেরা। আমার কাছে খবর আইল বিয়ালে। বাইট্টা জহা আছিল আমার খবরদার। জহারে তুই দেহচ নাই। কলেরা অইয়া মরছে হালায়। তয় জহার কাছে খবর পাইয়াই বেবাকতেরে ডাইকা আনাইলাম। নগদ টেকা আছে নশংকরের গেরস্তবাড়ি। ল যাই। গেলাম। বুজলী। সতরজনে মিল্লা গেলাম। পরনে লুঙ্গি। খালি শইল্লে চপচপা কইরা কইরা তেল মাখাইলাম। জাইপটা যুদি কেউ ধইরা হালায় পিচলাইয়া যাওন যাইব। লুঙ্গির উপরে মাজায় লাল একখান কইরা গামছা গিট্ট দিয়া বান্দা। মুখে বান্দা কালো একখান কইরা কাঁপোড়। হাজার চাইয়া দেখলেও চিনোন যাইব না।
ডাকাতি তো করলাম। বাড়ির বেবাক মরদরে চৌচালা ঘরের খামের লগে বাইন্দা, কাডের সিদুক ভাইঙ্গা টেকা-পয়সা লইলাম। মাইয়ামানুষের গতর থিকা খুইল্লা লইলাম সোনার চুরি হার অনন্ত দুল বেবাক। একটা যুবতি মাইয়া আছিল বাইত। গলায় হার, কানে দুল, বাজুতে কঙ্কন। না চাইতে বেবাক খুল্লা দিল। মাইয়াখান এত সোন্দর, দেইক্কা আমার চোক্কে পলক পড়ে না। চাইয়া থাকতে থাকতে দেহি, হের মাজায় মোড়া একখান বিছা। দশ বার ভরির কম সোনা অইব না। দেইক্কা মাইয়াডার চেহারাসুরৎ ভুইল্লা আমি হের মাজায় আত দিতে গেছি, ফাল দিয়া উটল। খবরদার শইল্লে আত। দিবা না। হুইন্না আমি টাসকা লাইগা গেলাম। অই ছেমড়ি কচ কী! আ! শইল খান কি সোনা দিয়া বানদাইছ? আইচ্ছা আত দিমু না। বিছাখান দিয়া দে।
হেয় কয় কী, না দিমু না। কাইটা হালাইলেও দিমু না। এইডা আমার মার মরণের সুময় আমারে দিয়া গেছে। নিতে অইলে আমারে মাইরা হের বাদে নেও।
হুইন্না আমার মাথাডা দুইখান পাক খাইল। কুন কথা না কইয়া হের আত দরলাম। তর বিছা নেওনের কাম নাই আমার। তুইই তাহলে ল আমার লগে। তার বাদে বুজলি জউগ্যা, আত দইরা টাইন্না দুই আড়াই মাইল রাস্তা, হেঁচড়াইয়া লইয়াইলাম এই বাইত। মাইয়া খান কেমুন দেক, এতাহানি রাস্তা আমি টাইন্না হেচড়াইয়া লইয়াইলাম, একবারও আওয়াজ দিল না। ইট্টুও কানল না। ল এক খান বিড়ি খা জউগ্যা, বলে কেঁচড় থেকে আবার বিড়ি বের করছিল কিরমান। নিজে ধরিয়েছিল, জগুকে দিয়েছিল।
জগুর তখন এসব কথা শোনার সময় নেই। চার পাঁচদিন ধরে সে লেগে আছে কিরমানের পেছনে। কিরমানকে নিয়ে হাটের দিন কাজে যাবে। কিন্তু রাজি হচ্ছে না লোকটা। সারাজীবন মানুষের গলা কেটেছে, সিন্দুক ভেঙেছে, আর এই শেষ বয়সে এসে সাধু সেজেছে কিরমান। কথাটা ভেবে চারপাঁচ দিনের মধ্যে এই প্রথম ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছিল জগু। আজই শেষ। কাল দিঘিরপাড়ের হাট। শালা রাজি হবে। নয়ত পুব পাড়ার আমিনুদ্দিনকে দলে নেবে জগু। আয়বরকত যে ভালো হবে জানে। হাট সেরে, কোমরে তহবিল বেঁধে বেপারিরা রাত বেরাত বাড়ি ফেরে। একজনকে ধরতে পারলেই কাজ ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে।
বিড়ি টানতে টানতে কিরমান আবার একটু উদাস হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যার পরপরই চাঁদ উঠেছিল আকাশে। জ্যোৎস্না ছিল। সেই জ্যোৎস্নায় বাড়ির দাওয়ায় বসা দুজন মানুষ। হাতে জোনাকির মতোন জ্বলছিল বিড়ি। জ্যোত্সায় কিরমানের বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে জগু কী যেন কী কারণে, বুকের ভেতরে নদীর স্রোতের মতো ছটফটানি থাকা সত্ত্বেও ওঠে যেতে পারে না। কথা বলতে পারে না। চুপচাপ থাকে। বিড়ি টানে।
কিরমান বলল, বাইত আইন্না মাইয়াডারে ঘরে উডাইলাম। কুপি আঙ্গাইয়া নিজের মুখের পট্টিখানা খুলোম। খুইল্লা চাইয়া দেহি কী, মাইয়াডা পিটপিট কইরা আমারে দেহে। বুজলাম আমারে হের মোনে ধরছে। ধরব না ক্যা! চেহারাখানা তো আল্লায় দিলে আছিল। রাজা-বাদশার লাহান আছিল। বুজলি জউগ্যা, তরে কইলাম না মাইয়া মাইনষে আমার চেহারা দেখলে মইজ্জা যাইত।
জগু বলল, খালিসেন ভাউজে মজছিল। আর কেউ তো মজে নাই। শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে একটু হাসে। হ, তর ভাউজেই মজছিল। ম্যালাদিন বাদে আমারে কইছিল, তুমার চেহারাসুরৎ যুদি খবিসের লাহান অইত তাইলে আমি তুমার লগে থাকতাম না।
হ, ঐ একজনের কাছেই তুমার চেহারা ভালা আছিল, জগুর গলায় শ্লেষের ভাব। ব্যাপারটা টের পেয়ে কিরমান বলল, বেডা তরা তো অহনতরি পোলাপান। মাইয়া মাইনষের মোন তরা কী বুঝবি! একখান মাইয়া মাইনষের মোন দেইখা বেবাক মাইয়া মাইনষের মোনের আসল গুমরডা বুজা যায়। ভালমন্দের জাগায় বেবাক মাইয়া মানুষ এক রকম।
হ, যা কইতাছিলাম। মাইয়াখানরে তো পয়লা দেইখাই আমার মোনে ধরছিল। বাইত আইনা যহন বুজলাম আমারেও হের মোনে ধরছে, তখন সোনাদানা টেকা-পয়সা যা ভাগে পাইছিলাম বেবাক হের পায়ের সামনে হালায় দিলাম। মুলাম গলায় কইলাম, আইজ থিকা আমার বেবাক জিনিস তর। তুই খালি আমার লগে থাকিচ। ছাইরা যাইচ না। যায় নাই রে। কুনদিন যায় নাই। এগার বছর আমার লগে ঘর কইরা মরল। আমার জীবনে সেরা দিন গেছে ঐ এগার বছর। ডাকাতি আমি ছাইরা দিছিলাম। হেয় কইছিল, আমি তুমার লগে থাকুম তুমি যুদি মাইনষের মাথায় বারি দেওন ছাইরা দেও।
চুরি-ডাকাতি ছাইরা দেও।
হুইনা আমি কইলাম, তাইলে তরে আমি খাওয়ামু কী! নিজে খামু কী!
হেয় কইল, তুমার গতর আছে না। গতর খাড়াইয়া কাম করবা। দিন বাদে নাইলে একসন্দা খামু। আমার কুন দুখ থাকব না।
ছাইরা দিলাম। ডাকাতি করন ছাইরা দিলাম আমি। নিজের তো আর খেতখোলা আছিল না। মাইনষের খেতে কামলা দিতাম। আমার কুনো দুখ আছিল না। যেদিন কামলা দিতাম হেদিন ভরপেট খাওন জুটত। না দিতে পারলে, কাম না পাইলে দুইজনে না খাইয়া থাকতাম। তাও দুখ আছিল না। সুখে নিদ যাইতাম।
তয় ভাউজের তর একখান দোষ আছিল। পেটখান আছিল হের বাজা। পোলাপান অয় নাই। এইডা মোনে অয় আগে থিইকাই জানত হেয়। নাইলে আমি টাইন্না লইয়াইলাম এত বড় ঘরের মাইয়া ডাকাতইতের লগে চুপচাপ আইয়া পড়ছিল কেমনে! হেয় জানত বাজা মাইয়ামাইনষের বিয়া কইরা কেঐ ঘরে রাখব না। খেদাইয়া দিব। নিজে থিকা যে হেরে লইয়া যাইতাছে, মানুষ অইলে হেয় তারে কুনদিন খেদাইয়া দিব না।
আমিও খেদাইয়া দেই নাই। বুকে তুইল্লা রাখছিলাম। হেয় আমারে পুচ করতো, পোলাপানের লেইগা তুমার মোন কান্দে না?
কইতাম, কান্দে।
তাইলে?
তাইলে কী?
আমার তো বাজা পেট। পোলাপান অইব না।
না অইলে কী করুম। আমার কপালে পোলাপান নাই।
দুখ অয় না?
অয়। তাইলে?
তাইলে কী! তুই বাজা না অইয়া আমি যুদি খোজা অইতাম, তাইলে কী করনের আছিল।
অনেকক্ষণ ধরে এসব প্যাচাল শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, এই হগল কিচ্ছা হুনতে আমি আহি নাই। কামের কতা কও। তুমি যাইবা? নাইলে সাফ কতা কইয়া দেও। আমি আমিনদ্দির কাছে যাই।
কিরমান কোনও কথা বলে না। আনমনে একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের চাঁদ দিনে দিনে আধখানা হয়ে গেছে। কমজোরি একটা জ্যোৎস্না কিরমানের বাড়ির ওপর, গাছপালার ওপর শুকনো কলাপাতার মতো লেপটে আছে। ঘরে মাটির গাছার ওপর বসে টিমটিম করে জ্বলছিল একটি কুপি। একবার ঘরটার দিকেও তাকায় কিরমান। আহা, এই ঘরডায় এগার বচ্ছর আছিল গেরস্তবাড়ির মাইয়াডা। হেয় আইজ নাই। ঘরডা বহুদিন ধইরা আন্দার অইয়া রইছে। কুপি আঙ্গাইলেও আন্দারডা যায় না। বুক কাঁপিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।
জগু বলল, আমিনদ্দির কাছে গেলে কইব গুরুরে থুইয়া আমার কাছে আইছচ ক্যারে? টিটকারি দিব আর হাসব। হেইডা আমার ভাল্লাগব না দেইখাই তো তুমারে এতদিন ধইরা কইতাছি। তুমি তো আইজকাইল আর মাইনষের মইদ্দে নাই। থাকলে ধিকটা তুমার থাকত। জিদটা তুমার থাকত। আমিনদ্দি যহন কইব, হ বেডা থো তগ কিরমাইন্নার কতা। অমুন কত ডাকাইত দেকলাম। বুড়া অইলে বেবাক হালায় মেকুর অইয়া যায়। তহন তুমার ইজ্জতখান থাকব কই! এইডা খালি আমারে কও।
একথা শুনে কিরমানের ভেতর হঠাৎই যৌবনকালের ক্রোধটা একটুখানি ফিরে আসে। বুড়ো বয়সে যখন তখন গলায় খানিকটা শ্লেষ্ম জমে থাকে। খুক খুক করে দুখানা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কিরমান। তারপর বলে, তয় তুই আমারে নিবিই জউগ্যা?
আবছা জ্যোত্সায় জগু এবার দাঁত কেলিয়ে হাসে। তুমি কী কও গুরু! না নিলে তুমার কাছে বিলায়ের লাহান এমুন ঘুরঘুর করিনি। তুমি আমারে যাই মোনে কর গুরু আমি কইলাম তুমার ভালাডাই চাই। তুমি বুড়া অইয়া গেছ, কামকাইজ কর না, কী দিয়া কী খাও আল্লায়ই জানে। আমি চাই আমার লগে থাইকা থাইকা দুই চাইরডা পয়সা কামাও তুমি। নাইলে খাইবা কী? দিন যাইব কেমনে?
শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে হেসেছে। মাইনষের খাওনদাওন আল্লার আতে। পেড দিছে হেয় খাওনও দিব হেয়। এইডা তর ভাউজে হিগাইছিল আমারে। হ। কতাডা হাচাই। আমি কুনদিন না খাইয়া থাকি নাই। পেডের ভাত আল্লায় জোগাইয়া দিছে।
মাথার বাবড়ি চুল ঝাঁকানি দিয়ে, ভাটার মতো চোখ দুটো পিটপিট করে, মুখের আগাছার মতো দাড়ি গোঁফে অযথা একবার হাত বুলিয়ে জগু বলল, তয় একখান কতা জিগাই তুমারে।
আবছা জ্যোত্সায় জগুর চোখ পিটপিটানিটা দেখতে পায় না কিরমান। বলল, জিগা।
তুমি কুন কামকাইজ করো না। জমিজিরাতও নাই তুমার। থাকনের মইদ্যে আছে এই দশ কদম বাড়িখান আর ঐ একখান ছাপড়া ঘর। তুমি ভাত পাও কই? আর এই যে নিমিষে নিমিষে বিড়ি খাও, এই হগল আহে কইথিকা?
আল্লায় দেয়।
আল্লায় তুমার কাছে ফিরিশতা পাডায়নি?
তুই ছাড়া আমার কাছে যারা আহে তারা ফিরিশতার লাহানই। আমার সাগরেদ আছিল বার তের জন। শেষকালে সেন তুই আইলি। তুই তো একখান খাডাস। আর অরা অইল ফিরিশতা। অহনও ডাকাতি কইরা যা পায় রাইতে আইয়া আমার গুরুদক্ষিণাডা দিয়া যায়। কামকাইজে যাওনের আগে কইয়া যায়, বুদ্ধি লইয়া যায়। একথায় জগুর মনে একটু দুঃখের ভাব হয়। গলা নরম করে সে বলল, আমারে তুমি দোষ দিতে পার না গুরু। তুমি কামকাইজ ছাইরা দেওনের পর আমারে আর কেউ দলে লইতে চায় না। আমার বলে সবাব খারাপ। ডাকাতির সোনাদানা, টেকাপয়সা বলে আতে পাইলে আমি চুরি করি। হামলাইয়া রাখি। যারা এমুন অবিশ্বাস করে তাগো লগে কাম করুম কেমনে! কিরমান রামদার মতো ধারালো গলায় বলল, চুরির অব্যাস তো তর আছেই জউগ্যা। এইডা মিত্যা কতানি! আমার লগে শেষবার তুই যহন বাইনখাড়া ডাকাতি করতে গেছিলি, একখান অনন্ত তুই হামলাইয়া রাকছিলি না! পরে কোকসায় আমার লাত্তি খাইয়া সেন বাইর করলি। মোনে নাই? আ?
জগু এবার খুব দমে যায়। বার দুয়েক ঢোক গিলে খড়নাড়ার মতো শুকনো গলায় বলল, হ, ঐ একবারই তো করছিলাম। কী করুম কও। আমার সংসার বড়। নয়খান পোলাপান। বুড়ো মা আছে, একখান রাড়ি বইন আছে। বইনের আণ্ডাবাচ্চা তিনডা। ডাকাতি কইরা ভাগে যা পাই হেতে ভাত জোডে না।
তর কুনদিন জুটব না। চোরডাকাইতগও নিয়মনীতি থাকন লাগে। বুজছ? তর কুনও নিয়মনীতি নাই। হেইবার আমি লগে না থাকলে দলের মাইনষে তরে কাইট্টা রজতরেখার পাইতে হালায় দিত। কেঐ খবর পাইত না। তর সংসারে খাঐন্না মানুষ বেশি, হেইডা দলের মাইনষেরে কইলে হেরা দয়া কইরা তরে বেশি দিত। আপদে বিপদে তরে সাহাইয্য করত। তুই চুরি করল্লি ক্যা?
জগু মন খারাপ করে বলল, হ, হেই পাপেঐ তো আইজকাইল ভাত জোডে না। নাইলে তো দলেঐ থাকতাম। ছেচড়ামি করন লাগত না। কিরমান বলল, ভাত জোড়ে না দেইক্কাঐ এবার তর লগে আমি যামু। চিন্তা করি না। আমারে দিয়া যুদি তর সংসার কয়দিন ভালা কইরা চলে, হেইডা আমি করুম। তয় হোন, তরে একখান কিচ্ছা কই। এক চোররে হের ওস্তাদে হিগাইছিথল, কুনদিন মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না, কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, চুরি করতে গিয়া মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়ামানুষ অইল মায়ের জাত। হেগ ইজ্জতের উপর জোরজুলুম করবি না। এই তিন কতা যুদি না মানচ, তাইলে দেকবি হাজার সোনাদানা চুরি করলেও জইরা আইব না তর। বউ পোলাপান না খাইয়া মরব। চোরায় ওস্তাদের কতা মাতায় লইয়া পয়লা দিন গেছে চুরি করতে। সিং দিয়া এক গেরস্তের ঘরে হানছে। হাইন্দা দেহে কী, ঘরের মইদ্যে টেমি জ্বলতাছে। দেইখা চোরায় আঐলে খাড়াইছে। খাড়াইয়া দেহে গেরস্তের বউখান বিচনায় হুইয়া রইছে, আর হের মরদে মাতার সামনে বইয়া বউর মাতা আতাইয়া দিতে দিতে কইতাছে, ও বিবিসাব ওডেন। উইট্টা আমারে ভাত দেন। বউডায় কয় কি, নাআ আমিইই উটতেএএ পারুমমম না আআ, আতে পায়ে আইজ সাদ কইরা আলতা দিছি। তুমারে ভাত বাইরা দিলে আমার আতের আলতা বিনাশ অইয়া যাইব। হুইনা মরদে কয় হায় হায় এইডা আমারে আগে কইবেন না। সব্বোনাশ, আপনের আতের আলতা উইট্টা গেলে তো বিষণ খেতি অইয়া যাইব। ভাত আমি নিজেই বাইরা খাইতাছি। আপনে নিদ যান। মোনের আনন্দে নিদ যান। আর রোজ আপনে আতে পায়ে আলতা দিবেন। আমার বুকের উপরে আপনের পাও দুইখান উড়াইয়া নিদ যাইবেন। তাইলে পাওয়ের আলতাও নষ্ট অইব না। এই কতা কইয়া গেরস্তে গিয়া ভাত বাড়তে বহে। দেইখা। চোরার মোনে অইল ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিল, মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না। চোরা ফিরত আইল। চুরি করল না। আর এদিকে চোরার ঘরে কইলাম ভাত নাই। বউ পোলাপান না খাইয়া রইচে। নিজে না খইয়া রইচে। খিদায় হারা রাতইত নিদ আহে না চোরার। পোলাপান কান্দে। বউ খিদার চোডে বইক্কা চোরার মরা বাপ জিন্দা করল হারা রাইত। পরদিন চোরায় হারাদিন না খাইয়া থাইকা রাইতে আবার গিয়া এক গেরস্তের ঘরে সিং কাটল। নিশি রাইতে বাড়ির বেবাক মাইনষে নিদ যাইতাছে। তয় একজন খালি জাগনা। বাড়ির মরদড়া। হেয় নিশি রাইতে টেমি জ্বালাইয়া রেজগি পয়সা। গুণতাছে। তিন চাইর টেকার রেজগি গুনতাছে এমুন কায়দা কইরা য্যান কুনো আজ অয়। দুনিয়ার কেঐ য্যান না বোজে। একখান কইরা পয়সা গুণে আর চোরের লাহান। চাইরমিহি চায়। কেঐ আবার দেখলোনি। পয়সার আওয়াজ আবার কেঐ হুনলনি। চোরায় আঐলে খাড়াইয়া খাড়াইয়া বেবাক দেহে। পেডে খিদা। খাড়াইয়া থাকতে থাকতে চোরের ঠ্যাংয়ে বিষ ধইরা যায়। গেরস্তে তিন চাইর টেকার রেজগি গণা আর শেষ অয় না। একখান পয়সা বিশ পঞ্চাশবার কইরা গণে। মোরগে বাগের লগে লগে পয়সাডি একখান ত্যানায় বান্দে গেরস্তে। তারবাদে ছনের ঘরের চালের ভিতরে গুইজ্জা। রাখে। না জানলে দুনিয়ার কেঐ বুঝবো না চালের ছনের মইদ্যে পয়সা হামলাইয়া রাকছে গেরস্তে। টেমি নিবাইয়া গেরস্তে তারবাদে হুইয়া পড়ে। চোরায়তো বেবাকঐ দেখছে। ইচ্ছা করলে চালের ছনের মইদ্যে আত দিয়া পোটলাডা লইয়া লইতে পারে হেয়। তয় চোরায় কইলাম লইল না। ওস্তাদে কইছিল কিরপিনের বাইত চুরি করবি না। পেডে দুই দিনের খিদা লইয়া চোরা ফিরত আইল। বাইত আইয়া দেহে খিদার চোডে বেবাক পোলাপান চিইক্কার পাড়তাছে। খালি আতে চোরায় ফিরছে দেইখা বউ মুইরা পিছা লইয়া বাইরে আইল। পোলাপানের খাওন দিতে পারো না জন্ম দিছ ক্যান। বাইরও বাইত থনে।
মোনের দুখে বাইতথন বাইর অইয়া গেল চোরায়। গিয়া এক জঙ্গলে বইয়া রইল হারাদিন। তারবাদে হাইঞ্জাকালে জিদ কইরা জঙ্গল থন বাইর অইল। তিন কোশ দূরে রাজার বাড়ি। আইজ রাজার বাইতঐ চুরি করতে যাইব। যা আছে বরাতে। চুরি আইজ করব। চুরি না কইরা বাইত ফিরব না। খিদায় জান যায়। রাজবাড়ি যাইতে যাইতে রাইনিশি অইয়া গেল। রাজার বাইত তো, বুজলি জউগ্যা, ম্যালা পাইক পেয়াদা পাহারাদার। চোরায় বহুৎ তদবির কইরা ভিতর বাইত গিয়া হান্দায়। তারবাদে যাইতে যাইতে এক্কেরে রাজকন্যার ঘরে। গিয়া দেহে ঘরের মইদ্যে সোন্দর একখানা ঝাড়াবাত্তি জ্বলতাছে। পালঙ্কে হুইয়া নিদ যাইতাছে রাজকন্যায়। রাজকন্যার গাও ভরা মণি মাণিক্য হিরা জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেতভারে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও ভরা মণি-মাণিক্য, হিরা, জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেভোরে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও থিকা বেবাগ গয়না খুইলা লইতে পারে চোরায়। চোরায় পাগলের লাহান আত দিতে যায়। তহনঐ মোনে অয় ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিলো বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিচ না। চোরায় থাইমা যায়। তহন রাজকন্যার এক দাসী আইতে লইছিলো কন্যার ঘরে। চোরারে তো দেইখা হালায়। দেইখা হালানের লগে লগেঐ চিইক্কার মারে। আর যাইবা কই। পাইকপেয়াদারা আইয়া চোরারে ধইরা হালায়। পরদিন বিয়ানে আতবান্দা চোরারে দরবারে লইয়া যায় পাইক পেয়াদারা। চোরার বিচার অইব। ঐ রাইজ্যে চুরির শাস্তি গর্দান। ডরে চোরার কইলজা হুঁকাইয়া যায়। রাজ দরবারে হেয় আর খাড়াইয়া থাকতে পারে না। শইল্লে কাঁপন ধইরা গেছে। আত পাও ঠকঠক কইরা কাপতাছে। সিঙ্গাসনে বইয়া রাজায় জিগাইল, তুই রাজকন্যার ঘরে হানছিলি ক্যা?
চোরায় মোনে করল, গর্দান যহন যাইব তাইলে আর মিত্যা কতা কইয়া ফায়দা কী। হাঁচা কতা কইয়াঐ মরি। কইল, চুরি করতে হুজুর।
তাইলে চুরি না কইরা খাড়াইয়া রইছিলি ক্যা?
হাঁচা কতা কমু হুজুর?
ক।
হুইনা মোনে ইট্টু বল পায় চোরায়। কয়, আমার ওস্তাদে কইয়া দিছিল বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়াছেইলারা মার জাত। আর কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, মাগীর ভাউরার ঘরে চুরি করবি না। আমি বউ পোলাপান লইয়া তিন দিন ধইরা না খাইয়া রইছি। তিনদিনঐ চুরি করতে গেছি। পয়লা রাইতে যার বাইত গেছি, হেয় দেহি মাগীর ভাউরা। চুরি করতে পারি নাই। পরদিন একবাইতে গেছি। গিয়া দেহি হেই বেডা জাত কিরপিন। চুরি করতে পারি নাই। কাইল রাইতে আইছিলাম আপনের বাইত। রাজকন্যার ঘরে গিয়া দেহি হের গাও ভরা মণিমাণিক্যের গয়না। খুলতে গিয়া ওস্তাদের কতা মোনে অইছে। ওস্তাদে কইছিল বেগানা মাইয়ামাইনষের শইল্লে আত দিচ না। হের লাইগা চুরি করতে পারি নাই। ধরা পইরা গেলাম।
বেবাক কতা হুইনা চোরারে রাজায় ছাইরা দিল। লগে ম্যালা ধনরত্ন দিল, জাগাজমিন দিল। বুজছচ জউগ্যা। নিয়মনীতি মাইন্না চল্লে হেই মাইনষে কুনদিন বিপাকে পড়ে না। ভাতে মরে না। তর কুন নিয়মনীতি নাই দেইক্কা এই দশা অইছে।
কিচ্ছা শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। বলল, এত প্যাচাইল পাইরো না তো। বুইড়া অইয়া গেলে মাইনষে কামের থিকা আকামের কতা বেশি কয়। তুমি কাইল আমার লগে যাইবা। বিয়ানে আইয়া আমি তুমারে লইয়া যামু।
কিরমান আর কোনও কথা বলেনি।
জগু চলে যাওয়ার পরও একাকী অনেকক্ষণ দাওয়ায় বসে থেকেছে কিরমান। বসে বসে বিড়ি টেনেছে। কিরমানের ছাপড়া ঘরের ওপর, ঘরের পেছনকার গাছপালার ওপর ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না পড়ে ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল। ঘরের ভেতর জ্বলছিল কুপি। তার ছিটকে আসা আলো এবং ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্নায় দাওয়ায় বসে থাকা কিরমানকে মনে হচ্ছিল প্রাচীন ঝোপঝাড়ের মতো। বিড়ির একবিন্দু আগুনকে মনে। হচ্ছিল জোনাকি পোকার মতো। অনেক রাতে গ্রীষ্মকালের উষ্ণতা কমে গিয়ে পৃথিবী যখন শীতল হতে শুরু করে, গাছপালা আর মাটি থেকে যখন ওঠতে শুরু করে কোমল শীতলতা, তখন কিরমান উঠে গেছে তার ঘরে। তারপর হাঁড়ি থেকে দুপুরে বেঁধে রাখা ভাত সালুন বাসনে নিয়ে যখন খেতে বসেছে, তখন বহুকাল বাদে তার মনে পড়েছে। গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা। এগার বছর কিরমানের সঙ্গে ঘর করেছিল। পুরনো অভ্যেস বদলে কিরমান যখন দিনে দিনে মানুষ হয়ে উঠেছে তখুনি কলেরায় মরল। মরে কিরমানকে আবার ডাকাত করে দিয়ে গেল। সাগরেদরা ম্যালা চেষ্টা তদবির করেও এগারো বছর কিরমানকে দলে নিতে পারেনি। গেরস্তবাড়ির মেয়েটি মারা যাওয়ার পর আবার তারা এসে ফুসলাতে লাগল। একদিন, দুদিন। কিরমান আবার ডাকাত হয়ে গেল। দিন যাচ্ছিল সুখেই। গেরস্তবাড়ির মেয়েটার শোক ডাকাতের উন্মাদনায় ভুলতে চাইছিল কিরমান। মারটা খেয়ে গেল চরে ডাকাতি করতে গিয়ে। দলের সবাই পালাতে পেরেছিল। ধরা পড়ে গেল কিরমান একা। তারপর হাজার লোকের মার। দুখানা থান ইট হাঁটু আর পায়ের পাতার মাঝখানে রেখে দুদিকে ওঠে দাঁড়াল চউরা দুই তাগড়া জোয়ান। হাড়টা কালিবাউসের শুকনো কাঁটার মতো মট করে ভেঙে গেল। তারপর সেই দুই জোয়ানের একজন গজাল দিয়ে খুঁচিয়ে তুলল কিরমানের একটা চোখ। আরেক জোয়ান খেজুর গাছ চাছার ছেনি দিয়ে আস্তেধীরে চাঁছল কিরমানের দুগালের চামড়া। তারপর রজতরেখার তীরে ফেলে রেখে দিল।
তবু জানে বেঁচে এসেছিল কিরমান। কিন্তু শরীরে যে ভাঙ্গনটা ধরল, তা আর সারল না। শরীরের কতা মনে পড়লেই গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা মনে পড়ে। মরে গিয়ে জীবনটা অন্যরকম করে দিয়ে গেল কিরমানের।
কালরাতে এসব কথা খুব মনে পড়েছিল কিরমানের বহুকাল বাদে। তারপর আর ঘুম আসেনি কিরমানের। সারারাত জেগে থেকেছে। বিড়ি টেনেছে। তারপর সকালবেলা ওঠে সারা শরীরে চপচপ করে তেল মেখেছে কিরমান। খালি গা, নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া লুঙ্গি। কোমরে কিরমান বেঁধেছে লাল গামছা। শক্ত করে। তারপর জগুর সঙ্গে যখন পথে নেমেছে তখন কিরমান বহুকাল বাদে আবার ফিরে গেছে তার যৌবনে। সে একটা দিন ছিল। উন্মাদনার দিন। বিড়ি ধরিয়ে জগু বলল, সড়ক দিয়া যাইবানি গুরু?
কিরমান একটু আনমনা ছিল। চমকে ওঠে বলল, যেহনদা গেলে হবিরে যাওন যায় হেই পথেই ল। আমি বুড়া মানুষ, ল্যাংড়া। বেশি আটতে পারুম না।
তাইলে গাংপাড় দিয়া যাইগা। কাইশবনের ভিতরদা। পথ সোজা অইব। হবিরে যাওন যাইব।
ল।
তারপর দুজন মানুষ সড়ক ছেড়ে নাবালে, কাশবনের ভেতর নেমে যায়। সড়কটা এসেছে মুন্সিগঞ্জ থেকে। তারপর টঙ্গিবাড়ি হয়ে খানিকটা ঘুরপথ চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই সড়কে উঠেছিল দুজন।
কিরমানের মতো জগুরও খালি গা, চপচপ তেলমাখা কিরমানের ছিল ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু জর হাতে ছিল ছালার একখানা থলি। তাতে কী আছে কিরমান জানে। ধারালো একখানা হাতখানেক লম্বা দা আর একখানা গুরু জবাই করার ছুরি। থলি হাতে জগুকে দেখে কেউ বুঝবে না কী উদ্দেশ্যে চলেছে মানুষটা।
সড়কে ম্যালা হাটুরে ছিল। জগুকেও দেখাচ্ছিল হাটুরেদের মতো। তার পেছনে কিরমানকে মনে হচ্ছিল ল্যাংড়াখোঁড়া ভিক্ষুকের মতো। যেন দিঘিরপাড়ের হাটে ভিখ মাগতে চলেছে।
কাশবনের ভেতর দিয়ে, রজতরেখার গা ঘেঁষে চিরল একটা পথ সোজা চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। তাড়াতাড়ি হাট ধরতে দুচারজন কারবারি এই পথে চলাচল করে। বিকেলবেলা, কোমরে টাকার তহবিল বেঁধে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছুবার লোভেও ফেরে কেউ কেউ। সেরকম একজনকে পেলেই কাজ হয়ে যাবে।
সকালবেলার রোদ খুব তেজি ছিল সেদিন। গভীর কাশবনের ভেতরে রোদ পড়ে তা থেকে ছিটকে উঠছিল দমবন্ধ করা একটা গর্মি ভাব। ল্যাংড়া পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের তেল চকচকে শরীরে ফুটে উঠছিল শিশির বিন্দুর মতো ঘাম। ক্রমে দরদরিয়ে নামতে থাকে সেই ঘাম। বিকৃত মুখটা গরমে আরো বিকৃত হয়ে গেছে। নাক মুখ দিয়ে বেরুচ্ছিল গরম হাওয়া। হাসফাস করতে করতে তবুও হাঁটে কিরমান। থেমে থেমে। বহুকাল বাদে এতটা পথ হাঁটছে সে। হাঁটাও যে এত কষ্টের কোনোকালে টের পায়নি কিরমান। তবুও হাঁটে। শেষ কষ্টটা তাকে আজ করতে হচ্ছে। তবে নিজের জন্য নয়। জগুর জন্যে। তার অছিলায় যদি জর সংসারের মানুষজন দুবেলা পেট ভরে। খেতে পায় ক বেলা।
জগু হাঁটছিল বেশ দ্রুত। তার কোনো ক্লান্তি নেই। উদ্দীপনা আছে। কাশবনের গরমে সেও খুব ঘেমেছে। ঘামে ভেজা শরীর রোদে চকচক করছে। কিরমানকে ফেলে বারবারই বহুদূর এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তারপর কাশবনের আড়াল পড়ে গেলেই কিরমানের জন্যে অপেক্ষা করছিল। কিরমান কাছাকাছি এলে দাঁত কেলিয়ে বলছিল, কী অইল গুরু আটতে পার না?
আগের লাহান কি আর পারিরে। একখান পাও ল্যাংড়া। তিনকুড়ি বয়েস অইল।
তাইলে ইট্টু বহ। জিরাও।
একথায় কিরমানের ভেতর যৌবনকালের চিতাবাঘটা লাফিয়ে ওঠে। জেদে সারা শরীর ছটফটিয়ে ওঠে। হেইদিনকার পোলা জউগ্যা, অর কাছে আমি নত অমু! আমার ল্যাংড়া পাওডার বলও তো রাখে না শইল্লে। বুড়া অইচি কী অইছে। পাওডা ল্যাংড়া না অইলে। আমার লগে আইট্টা পারতনি!
মুখে এসব কথা জগুকে সে বলে না। হা করে শ্বাস টানতে টানতে বলে, না জিরান লাগব না বেডা। কী মোনে করচ তুই আমারে! ল্যাংড়া অইছি কী অইচে, বুড়ী অইচি কী অইছে! মইরা গেছিনি। তর লাহান দুই জুয়ানে অহনেও কাবু করতে পারব না আমারে। জগু বলল, হেইডা জানি গুরু। তয় তুমি অমুন আবজাব করতাছ ক্যা?
গরমে। দেহচ না কেমুন গরম পড়ছে আইজ।
হ। সড়কে কইলাম এত গরম লাগে না। কাইশ্যাবোনে গরমডা বেশি লাগে। হের লেইগাঐ আইজ এই পথে কেঐ নামে নাই। নাইলে এহেনদা তো ম্যালা মাইনষে আডে যায়।
তয়?
তয় কী?
এহেনদা কেঐ না আইলে তর কাম অইবনি?
বিয়ালে আইব। দেইখো নে। হবিরে বাইত যাওনের লেইগা বেবাক কারবারিরা এহেনদা আডেতথন আহে। বিয়ালে কাইশ্যাবোনে এমুন গরম থাকে না।
কিরমান কোনও কথা বলে না। পা টেনে টেনে হাঁটে।
বেলা যত বাড়ছিল রোদ তত তীব্র হচ্ছিল। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। স্থির কাশবন থেকে রোদের তোড়ে চুটপুটে একধরনের আওয়াজ উঠছিল। আর নিঃশব্দে উঠছিল উষ্ণতা। মানুষের জানপরান আইঢাই করার মতো উষ্ণতা। এসবের ভেতর দিয়ে পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের কেবল মনে হয় কত দূর দিঘিরপাড়। কিরমানের বাড়ি থেকে দিঘিরপাড়ের দূরত্ব ছয় মাইল। সেটা সড়কের ঘুরপথে গেলে। কাশবনের এই রাস্তা ধরে গেলে মাইল দেড়েক কমে আসে।
কতদূর এল তারা। জগুকে জিজ্ঞেস করলে জগু খ্যাক খ্যাক করে হাসবে। বেবাক ভুইলা গেছ গুরু। এইডা কুন কতা অইল! কতবার ডাকাতি কইরা এই জঙ্গলে বইয়া ভাগ করছি না আমরা!
সত্য কথা। ম্যালাদিন ডাকাতির মালসামান, টেকা-পয়সা গয়নাগাঁটি এই জঙ্গলে বসে ভাগ করেছে তারা। সন্ধ্যের মুখে মুখে বড় ধানচালের আড়তটায় হানা দিয়েছিল। চার পাঁচ বেপারি বসে তখন টাকা গুণছিল। ছুরি উঁচিয়ে সেই সব টাকা নিয়ে তারা এসে ঢুকেছিল এই জঙ্গলে। তারপর চাঁদের আলোয় ভাগ বাটোয়ারা করেছিল। মনে আছে। কতোদূর এল, একথা তাহলে জগুকে জিজ্ঞেস করে কেমন করে!
কিন্তু কিরমানের যে আর চলে না। নাকমুখ দিয়ে ঝা ঝা করে বেরুচ্ছে উষ্ণতা। ল্যাংড়া পাটা টনটন করে। বুকের ভেতরটা হাঁসফাস করে। তেষ্টায় গলাটা হয়ে গেছে চৈত্রের মাঠ। কিরমান আর পারে না। ডাকাতি করতে এসে শেষমেষ বুক ফেটে মরবে নাকি!
তখুনি গলায় আবার সেই হা হা করা তেষ্টা। একটুখানি জিরিয়ে নেবার ফলে কিরমান এখন খানিকটা ধাতস্থ। দুহাতে মাটি ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় সে। দেখে জগু বলল, কী অইল গুরু?
পানি খামু।
তারপর হাঁটু অব্দি জলে নেমে দুআজলা ভরে জল খায় কিরমান। অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে খেয়ে পেটটা ঢোল করে ফেলে। তারপর নদী থেকে ওঠে আসবে, কিরমানের চোখ যায় মাঝনদীতে। সেখানে জলের তলা থেকে উপরে ঠেলে উঠছে মোলায়েম মাটির চর। দেখে কিরমান বুঝতে পারে নৌকা নেই কোন নদীতে।
বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।
নদী থেকে ওঠে জগুর পাশে বসে কোচর থেকে বিড়ি বের করে সে। নিজে ধরায়, জগুকে ধরিয়ে দেয়। তারপর নদীর দিকে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ঐ জউগ্যা গাঙ্গে চর পড়ল কবেরে?
জগু নড়েচড়ে বলল, দুই সন ধইরা। অহনও চরটা পুরা জাইগ্যা উডে নাই। আহেবার উইট্টা যাইব।
আহারে এই নদীখান কী আছিল আগে! বাইষ্যাকালে ত্যাজ আছিল কী! খরালিকালেও আদাঘন্টা লাগত পার আইতে। আডের দিন কত মহাজনী নাও থাকত গাঙ্গে। আইত, যাইত। মাল্লারা গাইত। ছিপ নাও লইয়া কতবার ডাকাতি করছি আমরা এই গাঙ্গে। আহারে। দিন বদলাইয়া গেছে। তহন আমার শইল্লেও জুয়ানকী আছিল, গাঙ্গেও পানি আছিল। অহন আমিও বুড়া অইচি গাঙ্গেও চর পইরা গেছে।
কোমর থেকে গামছা খুলে বীভৎস মুখটা গলাটা মুছল কিরমান। জগু থলি থেকে দাটা ছুরিটা বের করেছিল। দাটা তার পায়ের কাছে পড়া, ছুরিটা হাতে। আঙুলের ডগায় ধার পরীক্ষা করে সে খচ করে ছুরিটা বসিয়ে দিল নদীর তীরের নরম মাটিতে। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে ওঠে সিরসিরে একটা হাওয়া। নদীর জল ছিল স্থির। জলের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা কোমল মাটির চর রোদ পেয়ে ছুরির ধারের মতো চকমক করছিল। সিরসিরে হাওয়ায় জলের স্থিরতা ভেঙ্গে যায়। পেছন থেকে কাশপাতা নত হয়ে লুটোপুটি খায় কিরমান আর জগুর শরীরে।
বিড়ির ধোঁয়া বাতাসে মেশাতে মেশাতে জগু বলল, মোনে অয় দিন ভালাঐ যাইব গুরু।
অত বড় মারটা খেয়ে মরেনি। আর আজ যদি জগুর সঙ্গে মামুলি একটা কাজে এসে মরে তাহলে সাগরেদরা কোনোদিন গুরু বলে তার নাম মুখে আনবে না। ঘৃণা করবে। গালাগালি দিয়ে তার নামের ওপর থুতু ছেটাবে। সে বড় লজ্জা, সে বড় অপমান। কী করা যায়? হাটে আর বুদ্ধি খোঁজে কিরমান। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে জগুকে ডাকে। ঐ জউগ্যা, হোন।
জগু বেশ অনেকটা এগিয়েছিল। কিরমানের ডাকে পেছনে কিরে তাকায়। কী কও? আডেঐ যাবিনি?
না।
তাইলে!
তাইলে কী?
ল এহেনেঐ বইয়া থাকি। আড তো আর বেশি দূর না।
হ ভালা কথা কইছ। লও বহি।
চিরল পথটা ছেড়ে দুজন মানুষ তারপর নদীর একেবারে কাছে চলে এল। পেছনে কাশবন রোদ আটকে রেখেছে। এমন একটা জায়গায় বসে আকাশের দিকে তাকাল কিরমান। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। কতোক্ষণ বসে থাকতে হবে আল্লাহ মালুম।
তবুও বসতে পেরে জানটা বেঁচে গেছে কিরমানের। এখন একটু জিরিয়ে ভরপেট পানি খেয়ে নিলে, তারপর বিড়ি ধরালে অপেক্ষা করতে কষ্ট হবে না।
পানি খাওয়ার কথা ভাবতেই শুকনো গলাটা, বৃষ্টির অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকা চষা জমির মতো হা হা করে ওঠল কিরমানের। ইচ্ছে হল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যত ইচ্ছে পানি খায়। কিন্তু ল্যাংড়া পা টেনে এত দূর হেঁটে আসার সঙ্গে সঙ্গে পানি খেলে বুকে বাঁধ পড়ে মরবে। জগুর সঙ্গে ডাকাতি করতে এসে মরণ। নামের ওপর থুতু ছিটাবে সাগরেদরা।
কিরমান অপেক্ষা করে। নদীর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। তারপর একটা ব্যাপার খেয়াল করে চমকে ওঠে। রজতরেখা তো দিঘিরপাড়ের হাট ছুঁয়ে পদ্মায় গিয়ে পড়েছে। আগে তো হাটের দিন নদীতে ম্যালা মহাজনী নাও থাকত। মাল নিয়ে হাটে যেত, ফিরে আসত। আজ নৌকা নেই কেন নদীতে!
কিরমান কোনও কথা বলে না। উদাস চোখে নদীর যেখানটায় চর ক্রমশ জেগে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে বিড়ি টানে।
বিড়িতে পুরু দম নিয়ে সুখটান দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে জগু ডাকল, গুরু।
যেন নদীর জলে ডুব মেরেছিল কিরমান। জগুর ডাকে মাথা তুলে বলল, কী কচ?
তুমারে অমুন লাগতাছে ক্যা?
জগুর দিকে মুখটা ফ্যাকাশে করে একটু হাসে কিরমান। কেমুন?
মোনে অয় শইলডা তুমার ভালা না।
কিরমান আবার নদীর দিকে মুখ ফেরায়। বিষণ্ণ গলায় বলে, না শইল ভালাঐ আছে। যা দেহচ হেইডা অইল বয়েস। বয়েস অইলে দুনিয়ার বেবাক জিনিসেরই চেহারা বদলাইয়া যায়। গাঙ্গডারে দেহচ না, কী আছিল আর কী অইয়া গেছে।
হ। তয় তুমারে একখান কতা কই গুরু। তুমি এমুন নামকরা ডাকাইত অইলে কী অইব কতাবার্তা কও বহুত গ্যানি মাইনষের লাহান। হুনলে মোনডা কেমুন করে।
তারপর আবার সব চুপচাপ। নদীর জল আগের মতোই স্থির হয়ে আছে। সাদা মাটির চর জলের তলায় ওঠে দাঁড়াবার জন্যে উতলা হয়ে আছে। কাশবন অবিরাম ছড়িয়ে যাচ্ছিল উষ্ণতা আর চুটপুটে শব্দ। নদীর পাড়ের ভাঙ্গনের গর্তে বাসা বেঁধে আছে। দুনিয়ার গাঙ শালিক। তাদের উড়াউড়ি আর কিচিরমিচিরের শব্দে নির্জন এলাকাটি ছিল মুখর হয়ে। কিরমান নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সব। পেছনে কাশবনের ছায়া দীর্ঘ করে কখন বিকেল হয়ে যায় টের পায় না সে।
নদীপাড়ের নরম মাটিতে গাঁথা ছুরিটা টেনে তুলে লুঙ্গিতে খুব যত্ন করে মোছে জগু। তারপর বলে, আমার আতে থাকব এই ছুরিডা। আর তুমি লইবা দাওখান। তুমার কিছুই করন লাগব না। যা করনের আমিই করুম। তুমি খালি দাওডা লইয়া আমার সঙ্গে খাড়াইয়া থাকবা।
কিরমান কোনও কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে কীরকম একটা লজ্জা খেলা করে তার। হায়রে জীবন! একটা সময় ছিল তখন ডাকাতি করতে গিয়ে কে কীভাবে কাজ করবে তা বুঝিয়ে দিত কিরমান। আর আজ তাকেই উল্টো সব বুঝিয়ে দিচ্ছে জগু।
মনটা কেমন মেন্দা মেরে থাকে কিরমানের। নদীর দিকে তাকিয়ে আবার বিড়ি বের করে।
সন্ধের মুখেমুখে মানুষের শব্দ পেল তারা। দূর থেকে কথা বলতে বলতে আসছিল দুতিনজন। সেই শব্দ পেয়েই ছুরি হাতে ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফ দিয়ে ওঠল জগু। ফিসফিস করে বলল, গুরু আইতাছে। মুখে নদীর স্রোতের মতো উত্তেজনা ছিল তার। দেখে কিরমান খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, যা তুই রেকি কইরা আয়।
হ যাইতাছি, বলে শেয়ালের মতো গুঁড়ি মেরে, নিঃশব্দে কাশবনের ভেতর মিলিয়ে যায় জগু। জগু চলে যাওয়ার পর কেমন একটা একাকিত্ব চারদিক থেকে চেপে ধরে কিরমানকে। ডাকাতি করতে এসে এই প্রথম তার বুকের ভেতর রজতরেখার মতো একটা ভয় মাথা ঠেলে উঠতে চায়। হাত-পা কেমন অবশ লাগে। নিজেকে মনে হয় প্রাচীন কালের বটবৃক্ষের মতো। অনন্তকাল ধরে যেন শেকড়বাকড় নামিয়ে দিয়ে এই নদীতীরে বসে আছে। এই সময় চোখেমুখে বিশাল উত্তেজনা নিয়ে ফিরে আসে জগু। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ওড গুরু। কাম অইয়া গেছে। বেপারি আইতাছে একজন। কোমরের বান্দা তফিলডা পিরনের ফাঁক দিয়া দেহা যায়।
কিরমান ঠাণ্ডা গলায় বলল, একলানি?
না লগে আর দুইজন আছে। আরে হেতে কী! তুমার চেহারা আর আমার ছুরি দেকলে দেইখোনে বেপারিরে হালাইয়া কেমতে আর দুইজন দৌড় দেয়।
কিরমান দুহাতে মাটি ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর দাটা হাতে নিয়ে পা টেনে টেনে জগুর পেছনে হাঁটে।
চিরল পথটার কাছাকাছি এসে কাশবনের আড়ালে নিঃশব্দে ওঁৎ পাতে দুজন মানুষ। জগু ফিসফিস করে বলল, আমি পয়লা গিয়ে সামনে খাড়ামু। তারবাদে তুমি।
কিরমান কথা বলে না। শুধু মাথাটা একবার নাড়ে।
লোকগুলো কাছাকাছি চলে এলে গরু জবাই করার আধহাত লম্বা ছুরিটা হাতে লাফ দিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জগু, যা আছে দিয়া দেও। চিইক্কর মারবা না।
কিরমান আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল। হাত-পা কেমন অসাড় লাগছে তার। নড়াচড়া করবে, শরীরে বল পায় না কিরমান। কাশবনের ফাঁকফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখে তিনজন লোক উদ্যত ছুরি হাতে জগুকে সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেপারির মতন লোকটা দুহাতে চেপে ধরেছে তার কোমরে বাধা তহবিলটা।
জগু আবার বলল, দেও। হবিরে দেও নাইলে ছুরি হান্দাইয়া দিমু। বলে বেপারি মতন লোকটার কোমরের দিকে একটা হাত বাড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দুপাশের দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। মুহূর্তে জগুর হাতের ছুরিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। লোক দুটো কায়দা করে ফেলল জগুকে। দেখে বেপারি মতন লোকটা পাল খাওয়ার অপেক্ষায় থাকা গরুর মতন গলা খুলে চেঁচাতে লাগল, ডাকাইতে ধরছে, ডাকাইতে ধরছে। আউগগারে ডাকাত ধরছে। জগুকে নিয়ে অন্য দুজন তখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিরমান বুঝতে পারল সুবিধা করতে পারছে না জগু। এখন তার সামনে গিয়ে। দাঁড়ানো উচিত। দা হাতে ঐ চেহারার আরেকজনকে দেখলে লোকগুলো কাবু হয়ে যাবে।
কিন্তু কিরমানের পা চলে না। শরীরটা অবশ লাগে। বুকের ভেতর কেমন কেমন করে। তখন হঠাই বাইন মাছের মতো পিছলে গেল জগু। তারপর লাফিয়ে ওঠে কাশবন পাথালে ছুটতে শুরু করলো। ঐ ডাকাইত যায়, ধর ধর বলে লোক তিনটেও ছুটতে শুরু করে জগুর পেছন পেছন। দা হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে কিরমান। বুক কাঁপিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।