কিরকেট

কিরকেট

ক্লাবের ফ্যাক্স মেশিন দিয়ে অফিসে একটা খবর পাঠাবার চেষ্টা করছিলাম৷ এমন সময় মালি নরসিমা এসে বলল, ‘‘কালকেতুবাবু, একজন সাহেব রিপোর্টার আপনাকে ডাকছে৷’’

প্রায় আধঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছি৷ কিছুতেই ফ্যাক্সের নম্বর মেলাতে পারছি না৷ এমনিতেই যথেষ্ট বিরক্ত৷ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কোন দেশের রিপোর্টার?’’

‘‘জিজ্ঞেস করিনি৷ টেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভেতরে আসতে বললাম, এল না৷’’

‘‘প্রেস পাস নিতে এসেছে?’’

‘‘জানি না৷ কাল বিকেলেও একবার এসেছিল৷’’

‘‘ওকে বল, আমি ব্যস্ত৷ ওয়েট করুক৷’’

ক্লাবের তাঁবুতে এখন বেশ ভিড়৷ আগামীকাল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনাল ম্যাচ ইডেন গার্ডেন্সে৷ খেলবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা৷ আমাদের স্পোর্টস জার্নালিস্টস ক্লাবে তাই প্রচণ্ড ব্যস্ততা৷ দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক আর ফোটোগ্রাফার কলকাতায় এসেছেন৷ ম্যাচ কভার করতে যাওয়ার জন্য প্রেস পাস দরকার৷ আর সেটা দেওয়া হয় আমাদের ক্লাব থেকে৷ ম্যাচের আগের দিন অনেকেই তাই প্রেস কার্ড দেখিয়ে পাস নিতে এসেছেন৷ কেউ হাজির একটু আড্ডা মারার জন্য৷ কেউ কেউ আবার ক্লাব থেকেই খবর পাঠাতে ব্যস্ত তাঁর অফিসে৷ ফ্যাক্স মারফত, অথবা টেলিফোনে৷

ক্লাবে এসে রোজ আড্ডা মারার অভ্যেস আমার নেই৷ দিল্লি থেকে হঠাৎ আমার এক বন্ধু কলকাতায় হাজির৷ সেমিফাইনাল ম্যাচটা দেখতে চায়৷ ওর জন্য একটা টিকিট দরকার৷ ঘুরতে-ঘুরতে বিকেলের দিকে তাই ক্লাবে এসেছি, যদি একটা টিকিট জোগাড় করা যায়৷ বন্ধুটা এসে উঠেছে গ্র্যান্ড হোটেলে৷ ডিনারে নেমন্তন্নও করেছে৷ ক্লাবের সেক্রেটারি অলোক দাশগুপ্তর কাছ থেকে কোনোরকমে একটা টিকিট ম্যানেজ করে, ফোনে সেই বন্ধুকে বলেছি, রাত আটটায় ডিনারে আসছি৷ অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে এখন নেই৷ আর সেই খবরটাই সহকর্মীদের দিতে চাইছি ফ্যাক্স মারফত৷

দুপুরের দিকে একটা কাজে গিয়েছিলাম টলি ক্লাবের দিকে৷ হঠাৎ ওখানে দেখা রয় ডায়াসের সঙ্গে৷ গলফ খেলে ফিরছেন৷ মিনিট পনেরো একা কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম৷ শ্রীলঙ্কা টিম সম্পর্কে ডায়াস ভালো তথ্য দিয়েছেন৷ কথায়-কথায় বলে ফেললেন, ওপেনিং ব্যাটসম্যান জয়সূর্যের ফুড পয়জনিং মতো হয়েছে৷ সেমিফাইনাল ম্যাচটা নাও খেলতে পারেন৷ জয়সূর্য টিমের এক নম্বর ব্যাটসম্যান৷ তিনি না খেললে ভারতের বিরাট সুবিধা৷ এই খবরটা আর কেউ জানে না৷ এমনকী, শ্রীলঙ্কা রিপোর্টারদেরও জানানো হয়নি৷

বন্ধুর ওখানে ডিনার সেরে, রাতে অফিসে ফিরে রয় ডায়াসের ইন্টারভিউটা বড়ো করে লিখব৷ এই কথাটা ক্লাব থেকে ফোনেও বলে দিতে পারতাম সহকর্মী ইন্দ্রনীলকে৷ কিন্তু ক্লাবের টেলিফোনের সামনে এখন এত ভিড়, কথাটা বলতে গেলে পাঁচকান হয়ে যাবে৷ ডায়াস কলকাতায়, সম্ভবত কোনো রিপোর্টার তা জানেই না৷ যদি কেউ শুনে ফেলে, তাহলে ঠিক খুঁজে বের করবে৷ আমার আর ‘স্কুপ’ করা হবে না৷

এই কারণেই ফ্যাক্সে একটা ‘মেসেজ’ পাঠাচ্ছিলাম ইন্দ্রনীলের কাছে৷ অবশ্য সাঙ্কেতিক উপায়ে৷ মেসেজটা পড়ে কেউ বুঝতে পারবে না৷ এমনকী, আমাদের অন্য রিপোর্টাররাও না৷ ইন্দ্রনীলের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে৷ মেসেজ পড়লেই ও বুঝে নিতে পারবে৷ আর সেভাবে তৈরি থাকবে৷ বাইরে কোনো টুর্নামেন্ট কভার করতে গেলে, আমরা যদি কোনো স্কুপ নিউজ পাই, তাহলে সাঙ্কেতিক একটা মেসেজ পাঠিয়ে আমরা পরস্পরকে সতর্ক করে দিই৷ খবরটা যাতে অন্য কাগজে পাচার না হয়ে যায়, সেজন্যই এই সতর্কতা৷

ফ্যাক্স মেশিনে নম্বর মেলাতে আমি ব্যস্ত৷ ঘাড়ের কাছে অন্য একজনের মুখ৷ বলল, ‘‘কী খবর পাঠাচ্ছিস রে কালকেতু?’’

ঘাড় না-ঘুরিয়েই টের পেলাম, লোকটা কে৷ জগন্নাথদা, দৈনিক বাংলা কাগজের রিপোর্টার৷ ঠিক এসে হাজির হয়েছেন৷ উঁকি মেরে অন্যের কপি দেখা জগন্নাথদার স্বভাব৷ দু-একটা লাইন পড়ে নিতে পারলেই হল৷ তারপর সেই খবর বের করে নিতে অসুবিধে হয় না৷ জগন্নাথদাকে সব সময় আমি এড়িয়ে চলি৷ আসলে জগন্নাথদার মতো রিপোর্টারদের ফাঁকি দেওয়ার জন্যই আমি আর ইন্দ্রনীল ওই সাঙ্কেতিক উপায়টা বের করেছি৷

জগন্নাথদা উঁকিঝুঁকি মারছেন৷ তাতে কিছু আসে যায় না৷ একটু মজা করার জন্যই বললাম, ‘‘একটা ‘ইমপর্ট্যান্ট নিউজ’ পাঠাচ্ছি৷ কাউকে বলবেন না৷’’

‘‘কী নিউজ রে?’’

‘‘চুপ, কথা বলবেন না৷ শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিন৷’’ ফ্যাক্স মেশিনটার উপর ঝুঁকে পড়লেন জগন্নাথদা৷ বিড়বিড় করে আমার মেসেজেটা পড়তে লাগলেন :

ইন্দ্র, ম্যাচটা দেখতে মুর্তাজা

ফিরোজি কলকাতায় এসেছে৷ লোকটা চায়

না, এই খবর অন্য কেউ জানুক৷ পুরো গা

ঢাকা দিয়ে রয়েছে৷ আমি আজ সারা

বিকেল খুঁজেছি৷ লোকটার মাখামাখি

যার সঙ্গে, তাকে তুই ভালো চিনিস৷

সেই লোকটাই আমাকে একটা ৫

তারা হোটেলে নিয়ে গেল৷ ১০

মিনিট ধরে কথা হল৷ আই সি সি

ওকে তদন্তে পাঠিয়েছে৷ ই ও এম৷

পড়া শেষ করে জগন্নাথদা ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, ‘‘শেষে লিখেছিস ই ও এম৷ ওটার মানে কী?’’

ভীষণ হাসি পাচ্ছিল৷ সেটা চেপে বললাম, ‘‘এন্ড অফ মেসেজ৷’’

‘‘ওফ, তাই বল৷ আচ্ছা, এই মুর্তাজা লোকটাই বা কে?’’

এবার কপট রাগে বললাম, ‘‘এই এক মুশকিল জগন্নাথদা আপনাকে নিয়ে৷ কোনো খবরই রাখেন না৷ এ মাসের উইজডেনে এই লোকটার সম্পর্কে একটা বড়ো আর্টিকেল বেরিয়েছে৷ অফিসের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেটা দেখে নিন৷ প্লিজ জগন্নাথদা, একটা রিকোয়েস্ট, এই খবরটা অন্য কাউকে দেবেন না৷’’

‘‘তোর মাথা খারাপ নাকি? নিশ্চিন্ত থাক, অন্য কেউ জানতেও পারবে না৷ থ্যাঙ্ক ইউ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ৷’’ বলে জগন্নাথদা অন্য দিকে চলে গেলেন৷ সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম৷

আমি নিশ্চিত, মিনিট দশের মধ্যেই সারা ক্লাবে কারও জানতে বাকি থাকবে না, মুর্তাজা ফিরোজি নামে একজন কলকাতায় এসেছেন৷ অতীতে এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে৷

ফ্যাক্স মেশিনে নম্বর ‘পুশ’ করতে করতে আমার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল৷ অফিসের লাইন পাচ্ছি না৷ সন্ধের দিকে এই সময়টা খবরের কাগজের ফ্যাক্স মেশিন খুব ব্যস্ত থাকে৷ নানা জায়গা থেকে রিপোর্টাররা খবর পাঠান৷ লাইন পাওয়া খুব মুশকিল হয়ে যায়৷ ময়দানে আমাদের ক্লাবের তাঁবু থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার৷ ফ্যাক্সে চেষ্টা না করে, হেঁটে অফিসে গিয়ে, ইন্দ্রনীলের সঙ্গে কথা বলে এলেও বোধ হয় এত সময় লাগত না৷

বিরক্ত হয়ে ক্যান্টিনে এসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম৷ মেসেজটা কারও হাত দিয়ে পাঠাতে পারলে ভালো হত৷ মালি নরসিমার হাত দিয়েও পাঠানো যেতে পারে৷ আমি অফিস না পৌঁছোনো পর্যন্ত বাড়ি যাবে না ইন্দ্রনীল৷ সেটাই বাঁচোয়া৷ আসলে ওকে যে কথাটা জানাতে চাইছিলাম, সেটা হল ‘‘জায়গা রাখিস৷ ৫০ সি এম৷’’ আমার মেসেজের প্রতি লাইনের শেষ অক্ষরটা আলাদা করে নিলেই ইন্দ্রনীল বুঝতে পারবে৷ বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ অফিসে গিয়ে ম্যাচের প্রিভিউ লিখে এসেছি৷ রয় ডায়াসের এই ইন্টারভিউটা হঠাৎ পাওয়া৷ প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার জায়গা নেবে৷ সেটা আগে জানিয়ে রাখা ভালো৷ না হলে পাতায় অন্য খবরগুলো বসানো হয়ে গেলে নাইট ডিউটির রিপোর্টার মুশকিলে পড়বে৷

ক্যান্টিনে চায়ের দাম মেটাতে যাচ্ছি৷ হঠাৎ গেটের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, তুঁতে রঙের একটা মারুতি থেকে নামছে দৈনিক জাগরণের তন্ময় দত্ত৷ গাড়ি থেকে নেমে এলেন দিলীপ বেঙ্গসরকরও৷ তন্ময়ের সঙ্গে ক্রিকেটারদের ভীষণ ভাব৷ ক্রিকেট নিয়ে নয়, ক্রিকেটারদের নিয়ে গালগল্প লিখে ছেলেটা ইদানীং নাম করছে৷ ক্রিকেটারদের মশলা ম্যাচের বন্দোবস্তও করে দেয়৷ কমিশন নেয় সংগঠকদের কাছ থেকে৷ আরও অনেক গুজব আছে ওর সম্পর্কে৷ পারতপক্ষে ছেলেটাকে কাছে ঘেঁষতে দিই না৷

ক্রিকেটারদের সঙ্গে মাখামাখি আমি একেবারেই পছন্দ করি না৷ বেরি সর্বাধিকারী আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন৷ এখনকার ক্রীড়া-সাংবাদিকদের অনেকেই বেরি-দার নাম শোনেনি৷ কিন্তু একটা সময় উনি ক্রিকেট-লেখক হিসেবে খুব বিখ্যাত ছিলেন৷ আমরা যখন সাংবাদিকতার পেশায় প্রথম ঢুকি, তখন কথায় কথায় উনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘‘কালকেতু, যারা কারেন্ট প্লেয়ার, তাদের সঙ্গে কখনও ‘হবনবিং’ করবে না৷ করলে, তার বিরুদ্ধে তুমি লিখতে পারবে না৷ সেই প্লেয়ার খারাপ খেললেও তোমাকে কলম গুটিয়ে রাখতে হবে৷ তবে হ্যাঁ, প্লেয়ার খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর তুমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারো৷’’

এখন অবশ্য এসব উপদেশ কেউ মানে না৷ আজহার বা শচীন কোনো সাংবাদিকের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বললে সে ধন্য হয়ে যায়৷ এই তন্ময়কে আমি রবি শাস্ত্রীর ব্যাগ বইতে পর্যন্ত দেখেছি৷ সেজন্য ওর কোনো লজ্জা নেই৷ স্পোর্টস জার্নালিস্টস তাঁবুতে এসে মাঝেমধ্যে জুনিয়ার রিপোর্টারদের কাছে ও নাকি বারফাট্টাই মারে৷ আমাদের মতো কেউ থাকলে অবশ্য চুপ৷

গাড়ির চাবি আঙুলে ঘোরাতে-ঘোরাতে, বেঙ্গসরকরকে নিয়ে তন্ময় তাঁবুর ভেতরে ঢুকল৷ ওদের এড়াবার জন্যই আমি আর ভেতরে গেলাম না৷ ইন্দ্রনীলকে না হয়, গ্র্যান্ড হোটেলে সেই বন্ধুর ঘর থেকেই ফোন করে খবরটা দেব, এই ভেবে, গেটের দিকে পা বাড়ালাম৷

‘‘আরে, যাও কই?’’

ডান দিকে তাকাতেই দেখি, রুমি৷ বাংলাদেশের নামকরা সাংবাদিক৷ পুরো নাম মাসুদ আহমেদ রুমি৷ আসলে রুমি ডাকনাম৷ রুমির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অনেকদিনের৷ একসময়ে মুক্তিযোদ্ধা ছিল৷ ওকে দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল৷ ঢাকা থেকে ও যে আসছে, আমাকে জানায়ওনি৷ প্রশ্ন করলাম, ‘‘কবে এসেছ?’’

‘‘আইজই৷ তোমার অফিসে ফোন করছিলাম৷ ইন্দ্রনীল কইল, তুমি ক্লাবে থাকতেও পার৷ তাই আইলাম৷’’

‘‘সেমিফাইনাল স্টেজে এলে? আরও আগে এলে না কেন?’’

‘‘কী হইব আইয়া৷ বাংলাদেশ আই সি সি ট্রোফিতে হাইরা গেল৷ আমাগো ইন্টারেস্টও কইম্যা গেল৷ তুমি তো জানোই, আমি রাজাকার দ্যাশে যামু না৷ তাই ইন্ডিয়ার ম্যাচটা কভার করতে আইলাম৷’’

‘রাজাকার-দের দ্যাশ’ মানে পাকিস্তান৷ কথায়-কথায় রুমির রাগ এখনও বেরিয়ে আসে৷ ভারত কথাটা কখনও বলে না রুমি৷ সব সময় বলে ইন্ডিয়া৷ বললাম, ‘‘প্রেস পাস নিয়েছ?’’

‘‘হ৷ কী মনে হইত্যাছে, ইন্ডিয়া জিতব, ম্যাচটা?’’

‘‘জেতা উচিত৷’’

‘‘তোমাগো নূতন প্লেয়ারটা তো ভালোই খেলতেছে৷ হংকং থেইক্যা যারে তোমারা ইমপোর্ট করছ৷’’

‘‘মোহন চন্দ্রকুমারের কথা বলছ? হ্যাঁ, ছেলেটা দারুণ৷’’

‘‘তোমাগো কপাল ভালো৷ হঠাৎ একটা ওপেনার পাইয়া গ্যাছ৷ নাইলে শচীনরে দিয়া ওপেন করাইতে হইত৷’’

‘‘যা বলেছ৷’’

‘‘এই মোহন ছেলেটার একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিবা৷’’

‘‘এখন নেবে?’’

‘‘দিলে ভালো হয়৷ আমার আবার নয়টার আগে ঢাকায় খবর পাঠাইতে হইব৷’’

‘‘তাহলে চলো, খানিকক্ষণ লনে বসি৷’’

আমাদের ক্লাবের লনটা খুব চমৎকার৷ সবুজ ঘাস৷ চারদিকে ফুলের গাছ৷ গাছে আলো দিয়ে বেশ সাজিয়েছে অলোক৷ মাঝেমধ্যে রংবেরঙের বড়ো-বড়ো ছাতা৷ নীচে গোটাকয়েক চেয়ার পাতা৷ বিশ্বকাপের স্পনসর কোকাকোলা কোম্পানি সাংবাদিকদের জন্য প্রচুর বটল দিয়ে গেছে৷ ক্রেট থেকে দুটো বোতল তুলে আমরা ছাতার নীচে বসলাম৷ মার্চের মাঝামাঝি৷ তাই একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব৷

বোতলে চুমুক দিয়ে রুমি বলল, ‘‘মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তোমার কথা হইসে?’’

‘‘হ্যাঁ৷ হায়দরাবাদে৷ চ্যালেঞ্জার ট্রোফির সময়৷ পরে কটকেও কথা বলেছি৷’’

‘‘এইর’ম কিন্তু কখনও হয় নাই৷ অন্য একটা দ্যাশ থেইক্যা আইয়া স্ট্রেট ইন্ডিয়া টিমে, ওয়ার্ল্ড কাপ টিমে…আনবিলিভেবল৷’’

‘‘ঠিকই বলেছ৷ আসলে এই ছেলেটা হায়দরাবাদের৷ ওর বাবা-মা ইন্ডিয়ান সিটিজেন৷ কিন্তু গত পনেরো বছর ধরে হংকংয়ে৷’’

‘‘তোমার, না কার লেখায় পড়লাম, আজহার মাসসাতেক আগে যখন হংকংয়ে সিক্স-এ-সাইড ম্যাচ খেলতে যায়, তখনই অরে প্রথম দ্যাখে৷ মোহন বোধ হয় হংকং বি টিমের হইয়া মাত্র কুড়ি বলে একটা সেঞ্চুরি করসিল৷’’

‘‘হ্যাঁ৷ কথাটা আমিই লিখেছিলাম৷ নাগপুরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ান ডে ম্যাচের সময় আজহার অবশ্য বলেছিল, মোহন নাকি গাওস্করের আবিষ্কার৷ স্টার টিভিতে কমেন্ট্রি করার জন্য গাওস্কর প্রায়ই হংকং যান৷ মোহনকে বছরদেড়েক ধরে চেনেন৷ ছেলেটা ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেটেও খেলে গ্লাস্টারের হয়ে৷ সিক্স-এ-সাইড টুর্নামেন্টটার পর গাওস্কর ওর কলমে এই মোহন চন্দ্রকুমারকে ইন্ডিয়া টিমে নেওয়ার কথা প্রথম বলেন৷ আইনে নাকি আটকাবে না৷ উনিই লেখেন, চ্যালেঞ্জার ট্রোফিতে ডেকে মোহনের ‘ট্রায়াল’ নেওয়ার ব্যবস্থা হোক৷

‘‘ইন্ডিয়ার এই একটা জিনিস আমাগো ভালো লাগে, বুঝলা৷ ফরমার ক্রিকেটাররা খুব ইন্টারেস্ট নেয়৷’’

‘‘সেটা অবশ্য অন্য কারণে৷ সে-কথা থাক৷ মোদ্দা কথা হল, মোহনকে ইন্ডিয়া টিমে নেওয়াটা কাজে লেগেছে৷ দ্যাখো, চারটে ম্যাচে কিন্তু ছেলেটা তিনশোর ওপর রান দিয়েছে৷ লোকে তো এখন তুলনাই শুরু করেছে শচীনের সঙ্গে৷’’

‘‘এটা তুমি ঠিক কইলা না৷ শচীন হইল গিয়া শচীন৷ ‘জিনিয়াস’৷ মোহনের খেলা আমরা টিভিতে দেখসি৷ টেস্ট ম্যাচের ‘মেটিরিয়াল’ না৷ শচীনের সঙ্গে তুলনা কইরো না৷’’

রুমির মতো শচীন-ভক্ত আমি খুবই কমই দেখেছি৷ শচীন সম্পর্কে সামান্য সমালোচনাও ও সহ্য করতে পারে না৷ মোহনের সঙ্গে শচীনের তুলনা করার কথাটা ইচ্ছে করেই বলেছি, যাতে ও চটে যায়৷ বছরদুয়েক পর ওর সঙ্গে দেখা৷ পরীক্ষা করে দেখলাম, ওর শচীন-প্রীতি একটুও কমেনি৷

রুমিকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, ফের নরসিমা সামনে এসে দাঁড়াল৷ তারপর বলল, ‘‘কালকেতুবাবু, সেই সাহেবটা এখনও আপনার জন্য ওয়েট করছে৷’’

শুনে একটু অবাকই হলাম৷ লোকটা কে? আমার সঙ্গে তার এমন কী জরুরি দরকার যে, ঘণ্টাখানেক ধরে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? নিশ্চয়ই দরকারটা ব্যক্তিগত, না হলে লোকটা ভেতরে এসে কথা বলত৷ নরসিমাকে বললাম, ‘‘লোকটাকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়৷’’

‘‘ডেকেছিলাম৷ এল না৷’’

‘‘তা হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক৷ লোকটা কে যে, ডাকলেই আমাকে বাইরে যেতে হবে? যখন সময় হবে, তখন বেরোব৷’’

রুমি আমাদের কথা শুনছিল৷ কোকাকোলার বোতলটা খালি করে ও বলল, ‘‘আরে, চেইত্যা (রেগে) যাও ক্যান৷ কেউ হয়তো তোমার কাছে টিকিটের জন্য পাঠাইছে৷’’

‘‘টিকিট এখন কোত্থেকে পাব, বল৷’’

রুমি হাসল৷ তারপর বলল, ‘‘যাউক গিয়া৷ ক্রিকেটের কথা তো হইল৷ অখন পার্সোনাল কথা জিগাই৷ তুমি নাকি শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দাগিরি করতাছ৷’’

আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ‘‘কে বলল তোমাকে?’’

‘‘আনন্দমেলা’য় পড়সি৷ ঢাকায় তোমাগো আনন্দমেলা কাগজটা খুব বিকায়৷ পড়লাম, তোমাগো পঙ্কজ রায়ের সেই ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ব্যাটটা নাকি হারাইয়া গ্যাছিল৷ সেইটা স্মাগলাররা হংকং লইয়া যাইতেছিল৷ তুমি নাকি ধইরা ফেলছ?’’

ঘটনাটা খুবই সামান্য৷ পঙ্কজ রায় যে ব্যাটটা দিয়ে ওপেনিং পার্টনারশিপে বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে বিশ্বরেকর্ড করেন, কিছুদিন আগে সেটা ওঁর কুমারটুলির বাড়ির ‘শো-কেস’ থেকে চুরি হয়ে যায়৷ স্মাগলারদের একটা আন্তর্জাতিক চক্র সেটা হংকংয়ের এক পাগল ব্যবসায়ীর কাছে চালান করে দিচ্ছিল৷ অবশ্যই স্থানীয় একটি লোকের সাহায্য নিয়ে৷ কলকাতার এয়ারপোর্ট থেকে সেই অমূল্য ব্যাটটা আমি উদ্ধার করে দিই৷ সেই ঘটনাটা আনন্দমেলায় বেরিয়েছিল, কয়েক মাস আগে৷ রুমি সেই প্রসঙ্গ তোলায় আমি বললাম, ‘‘ওই একটু শখের গোয়েন্দাগিরি আর কী৷ বম্বেতে ব্রায়ান লারার গ্লাভস চুরি গিয়েছিল ড্রেসিংরুম থেকে৷ সেটাও, বাজি রেখে আমি খুঁজে দিয়েছিলাম৷’’

রুমি ভীষণ সিরিয়স, ‘‘ওই ঘটনাটা পড়ার পরই আমরা ঢাকায় তোমারে লইয়া খুব আলোচনা করসি৷ নেক্সট ক্রিকেট সিজনে একবার ঢাকা যাইতে পারবা৷ আর কইও না৷ ঢাকায়, ক্রিকেট, অহন ক্রিকেট খুব পপুলার হইসে৷ আবাহনী, মহামেডান, এই ক্লাবগুলি অহন খুব বিদেশি ক্রিকেটার আনতাছে৷ ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেইকা সব টেস্ট স্টার৷ তোমাগো অরুণলাল, শ্রীকান্ত কল্যাণী, উৎপল চ্যাটার্জিরাও খেলে৷ কিন্তু হইল কী, ফরেনাররা যাওয়ার পর থেইক্যা ঢাকা লিগে খুব আনএক্সপেক্টেড রেজাল্ট হইতাছে৷ ক্যান, সেইটা বাইর করার জন্য তান্নাভাই তোমারে দাওয়াত দিতে চায়৷’’

তান্নাভাই হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট সংস্থার কর্তা৷ আমার সঙ্গে ভালো আলাপ আছে৷ রুমির কথা শুনে হালকাভাবেই বললাম, ‘‘তোমাদের ওখানেও এসব হচ্ছে? ইন্টারেস্টিং৷’’

‘‘ওয়ার্ল্ড কাপের পরই আমাগো ওখানে ক্রিকেট শুরু হইব৷ চলো না৷ দিনকতক ছুটি লইয়া৷’’

‘‘ঠিক আছে, যাব৷’’

হাতঘড়ি দেখল রুমি৷ তারপর ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল৷ বলল, ‘‘প্রায় আটটা বাজে৷ অফিসে রিপোর্ট পাঠাইয়া, একবার আমাগো হাই কমিশনে যাইতে হইব৷ আমার এক বন্ধু এখানে প্রেস অফিসার৷ ডিনারে ডাকছে৷ কাইল মাঠে তোমার সঙ্গে দেখা হইব৷’’

একবার হাত মিলিয়ে রুমি গেটের দিকে এগোল৷ আমার হাতে তখনও সেই ফ্যাক্স মেসেজটা ধরা৷ অফিসে পাঠাবার শেষ চেষ্টা করে দেখি, ভেবে তাঁবুর ভেতরে ঢুকলাম৷ জনাতিরিশ-পঁয়ত্রিশ সাংবাদিক আর ফোটোগ্রাফার তখনও এদিকে-ওদিকে দাঁড়িয়ে অথবা বসে৷ বেঙ্গসরকরকে ঘিরে পাঁচ-ছ’জন৷ প্রায় গা ঘেঁষে তন্ময়৷ যেন আগলে রেখেছে৷

দেখে মুচকি হাসলাম৷ কলকাতাতেই যত আগ্রহ বেঙ্গসরকর-গাওস্করদের নিয়ে৷ বম্বেতে ওঁরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ ফিরেও তাকান না৷ বেঙ্গসরকররা অবশ্য কেউ হেঁটে যাওয়া-আসা করেন না৷ প্রত্যেকেই গাড়ি চাপেন৷ ক্রিকেটাররা আর যাই হোন, ফুটবলারদের মতো নন৷

ফ্যাক্স মেশিনের দিকে এগোবার সময়ই চোখাচোখি হয়ে গেল বেঙ্গসরকরের সঙ্গে৷ হাত তুলে ডাকলেন৷ না ডাকলে যেতাম না৷ উনি এখন ‘কলাম’ লেখেন কাগজে৷ দূরত্ব রাখাই ভালো৷

‘‘আরে, অজিতভাই তোমাকে বিকেল থেকে খুঁজছে৷ কোথায় ছিলে?’’

অজিতভাই মানে অজিত ওয়াড়েকর৷ বললাম, ‘‘তোমার সঙ্গে অজিত ভাইয়ের দেখা হল কোথায়?’’

‘‘তাজ বেঙ্গলে৷ এখন তোমাদের এখানে আসছি শুনে বললেন, ক্যালকাটা দাদা-র সঙ্গে দেখা হলে বলো, আমি খুঁজছি৷ বলবে, ওয়াতন কা লিয়ে৷’’

শেষের কথাটা শুনে হেসে ফেললাম৷ আমার কালকেতু নামটা শুনে অজিত ওয়াড়েকর অবাক হয়ে প্রথম দিন বলেছিলেন, এটা কী নাম দাদা? কালকেটুর বদলে ক্যালকাটা রাখলেই তো ভালো করতেন৷ আমাদের ডাকতে সুবিধে হত৷ আর ‘ওয়াতন কা লিয়ে’ কথাটা আমাদের দুজনের মধ্যে চালু একটা রসিকতা৷ এটা খুব ব্যবহার করেন আজহারউদ্দিন৷ সাংবাদিকরা কোনো কঠিন প্রশ্ন করলে, তা এড়াবার জন্য৷ ওয়াতন কা লিয়ে, মানে দেশের জন্য৷

ক্লাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে কারও-না-কারও সঙ্গে আড্ডায় জমে যাব৷ তাড়াতাড়ি বেরোনো দরকার৷ তাই বেঙ্গসরকরকে বললাম, ‘‘ঠিক আছে, অজিতভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নেব৷ চলি৷ একবার গ্র্যান্ড হোটেলে যেতে হবে৷’’

হঠাৎ তন্ময়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ বেঙ্গসরকর আমাকে এত সমীহ করে কথা বলছেন দেখে বোধ হয়৷ হয়তো জুনিয়রদের সামনে কখনও বারফাট্টাই মেরেছিল, বোম্বাইয়ের ক্রিকেটাররা ওকে ছাড়া কলকাতার আর কোনো সাংবাদিককে চেনেই না৷

ক্লাবের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম৷ আমাকে বাঁ দিকে যেতে হবে৷ ভবানীপুর মাঠের পাশ দিয়ে৷ ইডেনের টাওয়ারগুলোতে ফ্লাড লাইট৷ বিশ্বকাপের ময়দানের চেহারাই বদলে গেছে৷ শহিদ মিনার ঘিরেও প্রচুর আলো৷ শর্টকাট রাস্তা নিলাম গ্র্যান্ড হোটেল যাওয়ার জন্য৷ মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাশে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ ওদিক থেকেই কে যেন হঠাৎ আমাকে নাম ধরে ডাকল৷ ঘুরে তাকিয়ে দেখি, অপরিচিত একটা লোক৷

‘‘সার, আপনিই তো কালকেতু নন্দী?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’

‘‘সার, কাজারিয়া সাহেব আপনাকে এখুনি একবার দেখা করতে বলেছেন৷’’

‘‘জগমোহন কাজারিয়া?’’

‘‘হ্যাঁ সার৷ উনি আপনার জন্য ক্লাব হাউসে অপেক্ষা করছেন৷ জরুরি দরকার৷’’

‘‘দুপুরে ওঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল৷ তখন তো কিছু বললেন না৷’’

লোকটা অসহায়মুখে বলল, ‘‘কী জানি সার৷ আমাকে তো বললেন গাড়ি করে নিয়ে এসো৷’’

‘‘কোথায় গাড়ি?’’

‘‘ওই তো৷ সাদা মারুতি৷’’

কী মুশকিল! গ্র্যান্ডের দিকে যতবার পা বাড়াচ্ছি, একটা না একটা বাধা পড়ছে৷ সি এ বি-তে গেলে আধঘণ্টা সময় তো লাগবেই৷ তারপর ডিনার সেরে অফিস পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে যাবে৷ বাড়ি ফিরতে রাত্তির সাড়ে বারোটা৷

অনিচ্ছাসত্ত্বেও লোকটার সঙ্গে এসে বসলাম মারুতিতে৷ লোকটা গাড়ি চালাচ্ছে, আমি বাঁ পাশের সিটে৷ নিশ্চয়ই কাজারিয়া কোনো খবর দেবেন৷ না হলে ড্রাইভার পাঠিয়ে আমাকে তলব দিতেন না৷ এর আগেও, কয়েকবার সমস্যায় পড়ে কাজারিয়া এভাবে ডেকে নিয়ে গেছেন আমাকে৷ খুব ব্যস্ত লোক উনি৷ ফালতু কারণে গাড়ি পাঠাতেন না৷

ইডেনের আশপাশটা আলোয় ঝলমল করছে৷ গোষ্ঠ পালের মূর্তির কাছাকাছি অঞ্চলটা আগে অন্ধকারে ডুবে থাকত৷ সেখানে এখন দিনের আলো৷ গাড়ির জানলা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে একবার ভাবলাম, রাতে দিব্যি ওখানে ফুটবল খেলা যায়৷ একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম৷ হঠাৎ লক্ষ করলাম, মারুতিটা ডান দিকে ঘুরে যাচ্ছে৷ এ কী! সি এ বি-র দিকে তো যাচ্ছে না! আকাশবাণীকে বাঁ দিকে রেখে গাড়িটা সোজা দৌড়তে লাগল ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে৷ প্রায় নাইনটি কিলোমিটার বেগে৷

রেগেই ড্রাইভারকে বললাম, ‘‘ডালহৌসির দিকে যাচ্ছ কেন ভাই?’’

প্রশ্নটা করতেই পেছন থেকে কে যেন বলল, ‘‘টেক ইট ইজি ম্যান৷’’

উচ্চারণ শুনে মনে হল বিদেশি৷ ঘাড় ঘোরাতেই পেছনের সিটে লোকটাকে আবছা দেখতে পেলাম৷ চুল কোঁকড়ানো, মোটা গোঁফ৷ মুখে বেশ কাঠিন্যের ছাপ৷ বয়স আন্দাজ করতে পারলাম না৷ তা হলে, এই সেই সাহেব-রিপোর্টার, আমার জন্য ঘণ্টাখানেকেরও বেশি যে অপেক্ষা করছিল৷ জানলার কালো কাচ তোলা ছিল৷ আলোও নেভানো৷ পিছনের সিটে যে একজন বসে আছে, গাড়িতে ওঠার সময় তা লক্ষই করিনি৷

কড়া গলায় বললাম, ‘‘তুমি কে?’’

বলতে না-বলতেই ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা একটা ধাতব স্পর্শ পেলাম৷ সম্ভবত পিস্তল৷ তারপরই লোকটার গলা, ‘‘ডোন্ট বি সিলি৷ আদারওয়াইজ ইউ উইল বি ইন ট্রাবল৷’’

ঘটনাটা এত আকস্মিক ঘটল, বুঝে উঠতে পারলাম না, কী করব৷ মারুতি পেরিয়ে গেল জি পি ও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ফেয়ারলি প্লেস৷ ডালহৌসিতে এই সময় লোকজন থাকে না বললেই চলে৷ চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না৷ জীবনে কখনও এইরকম অবস্থায় পড়িনি৷ এই দুটো লোক কি আমাকে কিডন্যাপ করছে? করে এদের লাভ?

ঘাড় না ঘুরিয়ে, ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললাম, ‘‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা?’’ প্রশ্নটা বিদেশিকে লক্ষ করেই৷

সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর, ‘‘একটু পরেই তা জানতে পারবে৷ এখন চুপ করে বসে থাকো৷’’

কিন্তু চুপ করে বসে থাকার লোক তো কালকেতু নন্দী নয়৷ ডান পা সরিয়ে নিয়ে, ড্রাইভারের পায়ের ওপর দিয়েই চাপ দিলাম ব্রেকে৷ প্রচণ্ড একটা শব্দ…পুরো গাড়িটা কেঁপে উঠল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় একটা আঘাত টের পেলাম৷ জ্ঞান হারাবার ঠিক আগের মুহূর্তে চাপা স্বরে হিস হিস, ‘‘কন্ট্রোল দ্য কার৷ ডোন্ট স্টপ৷’’

রোজ খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা আমার অভ্যেস, যত রাতেই ঘুমোতে যাই না কেন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন৷ সাংবাদিকদের যে নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত, এটা শিখেছি সোল অলিম্পিক গেমস কভার করতে গিয়ে৷ ‘প্রেস ভিলেজ’-এ রোজ দেখতাম, বিদেশি সাংবাদিকরা সকালে দৌড়-ঝাঁপ করতেন৷ শরীর সুস্থ না থাকলে, ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব না৷ তা হলে মন ভালো থাকবে না৷ লেখাও ভালো হবে না৷

কলকাতায় থাকলে রোজ সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলতে যাই৷ আর বাইরে গেলে হোটেলের জিমনাশিয়ামে বা সুইমিং পুলে কিছুক্ষণ সময় কাটাই৷ এতে শরীরটা সারাদিন খুব সতেজ থাকে৷ গত এক মাস বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচ কভার করতে গিয়ে বিভিন্ন শহরে থেকেছি৷ তারই মধ্যে যতটা সম্ভব শরীরচর্চা করেছি৷

আজ ঘুম থেকে উঠতেই মাথাটা বেশ ভার-ভার লাগল৷ কিছুক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইলাম৷ মাথার ডান দিকে চিনচিনে একটা ব্যথা৷ সেটা কেন হচ্ছে, ভাবতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল৷ সাদা চামড়ার সেই বিদেশি লোকটা মারুতির ভিতর পিস্তলের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় মেরেছিল৷ কথাটা মনে হতে প্রচণ্ড রাগ হল সেই লোকটার উপর৷

আমাকে কেউ আঘাত না করলে, কাউকে আমি আঘাত করি না৷ কোথায় আছি, কীভাবে আছি, তা বুঝে ওঠার আগে ঠিক করে ফেললাম, বিদেশি লোকটাকে পালটা আঘাত না করা পর্যন্ত এখান থেকে বেরোব না৷

বিছানায় শুয়েই এবার ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলাম৷ গেস্ট হাউস ধরনের মনে হল৷ অথবা হোটেলের কোনো কামরা৷ ঝকঝকে, বেশ সুন্দর সাজানো৷ রঙিন ওয়াল পেপার মোড়া দেওয়াল, জানলায় ভারী পরদা, মেঝেতে কার্পেট৷ ড্রেসিংরুমের টেবিলের ওপর দেখলাম, একটা টেলিফোনও আছে৷ তার পাশে একটা বড়ো কোরিয়ান ‘ফ্লাওয়ার ভাস’৷ সেখানে সদ্য ফোটা ফুল৷ তার মানে, আমি ঘুমিয়ে থাকার সময়ই কেউ ফুল বদলে দিয়ে গেছে৷

বিদেশি লোকটা আমাকে ‘কিডন্যাপ’ করেছে৷ এখন আমার কাছে এটা পরিষ্কার৷ কিন্তু কেন করল, সেটা বুঝতে পারলাম না৷ সাংবাদিকতার পেশায় আছি৷ অনেক সময় অনেকের বিরুদ্ধে লিখতে হয়৷ তাদেরই কেউ কি আমাকে কিডন্যাপ করল? কিন্তু কেন?

প্রায় শবাসনে শুয়ে চিন্তা করছি৷ একবার মনে হল, পঙ্কজদার সেই ব্যাট চুরির কেসটা ধরে ফেলেছিলাম৷ স্মাগলাররা হংকংয়ের লোক৷ তাদেরই কেউ কি বদলা নিচ্ছে? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে৷ বদলা যদি নিতেই আসে, তা হলে কিডন্যাপ করবে কেন? ইচ্ছে করলে তো রাতের অন্ধকারে ‘মার্ডার’ করে, ডালহৌসি অঞ্চলে ফেলে দিয়ে পালাতেও পারত৷ যেই এই অপরাধটা করুক, যে কারণেই করুক, আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিতে চায়৷ অথবা চায় আমার কাছ থেকে কোনো খবর জানতে৷ না হলে জামাই আদর করে এইরকম একটা ঘরে শুইয়ে রাখত না৷

আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম৷ আমাকে লোকটার দরকার এবং তার ফয়দা হয়, এমন কোনো কারণে দরকার৷ যতক্ষণ না কেউ সামনাসামনি আসছে, ততক্ষণ বুঝতে পারব না৷ মনে মনে উত্তেজনা কমাতে থাকলাম৷ মাথাটা ঠান্ডা রাখতেই হবে৷

আর কয়েক ঘণ্টা পরে দুপুর দুটোয় বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ ইডেনে৷ ম্যাচে পৌঁছোতে না পারলে অফিসে হইচই পড়ে যাবে৷ কাল রাতে অফিসে যেতে পারিনি৷ রয় ডায়াসের ইন্টারভিউটাও পকেটে রয়ে গেছে৷ আজকের ম্যাচে সনৎ জয়সূর্য যে খেলতে পারছেন না, সেটা জানা সত্ত্বেও বের করতে পারিনি৷ খুব আপশোশ হতে থাকল৷ তেমনই রাগ, বিদেশি লোকটার ওপর৷

ভাগ্যিস, কাল ফ্যাক্স মেসেজটা আর অফিসে পাঠাতে পারিনি৷ রাতে ‘পেজ রিলিজ’-এর সময় ইন্দ্রনীল তা হলে মুশকিলে পড়ে যেত৷ চিন্তাও করত আমার জন্য৷ বাড়িতে ফোন করে কাউকে পেত না৷ ফোন তোলার লোক বাড়িতে নেই৷ মা দিন-দুই হল, দিদির বাড়ি বেড়াতে গেছেন৷ ফিরবেন বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর৷

বিছানা ছেড়ে উঠলাম৷ বালিশে সামান্য রক্তের দাগ৷ মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম, সামান্য কেটেছে৷ ফের চিনচিনে রাগ হতে শুরু করল৷ সেটা কমাবার জন্যই বাথরুমে ঢুকে চোখ-মুখে জল দিলাম৷ পাশেই ঝোলানো সাদা তোয়ালে৷ মুখটা মুছতেই নিজেকে একটু ‘ফ্রেশ’ লাগল৷ বাথরুমের জানলাটা কাচের৷ সেটা খুলে দিলাম৷ আশপাশের বাড়িগুলো দেখে এক নজরে মনে হল, অন্তত পাঁচতলার ওপরে কোনো বাড়িতে আছি৷

জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিলাম৷ নীচে ট্রাম লাইন৷ রাস্তায় বেশ ভিড়৷ পুরোনো আমলের সব বাড়ি-ঘর৷ রাস্তার দু’পাশে প্রচুর দোকান৷ ফুটপাত ভর্তি হকার৷ গাড়িগুলো দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ এই রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে৷

জানলাটা বন্ধ করে ফের ঘরে ঢুকে এলাম৷ আর তখনই খুট করে শব্দ হল দরজায়৷ নীল রঙের সাফারি সুট পরা এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন হাসিমুখে৷ বয়স চল্লিশের ওপরে৷ অসম্ভব ফরসা৷ কপালে চন্দনের সামান্য ফোঁটা৷ এক ঝলক লোকটাকে বাঙালি বলে মনে হল না৷

‘‘গুড মর্নিং৷ ভদ্রলোক বললেন, ‘‘ওধমের নাম রাজু কেডিয়া৷’’

লোকটাকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল৷ কোনো কথা বললাম না৷ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলাম৷

‘‘খুব গুসসা করেছেন মিঃ নোনদি?’’ কেডিয়া লোকটা সোফায় বসল৷ গলায় স্বাভাবিক ভদ্রতা, কিন্তু বেশ কর্তৃত্ব৷ এই লোকটা মানুষজনকে বেশ বশ করে রাখে৷

লোকটার চোখে চোখ রেখেই বললাম, ‘‘স্বাভাবিক৷’’

‘‘গুস্তাফি মাফ করবেন মোশাই৷ যে ছেলেটা আপনাকে আনতে গেছিল, একদম গিধধর৷ আপনি সোম্মানি লোক৷ সোম্মান দিয়ে আনতে বলেছিলাম৷’’

‘‘আমাকে এখানে এনেছেন কেন?’’

‘‘কুছু ইনফরমেশন নেওয়ার জন্য৷’’ বলেই কী যেন মনে পড়ল রাজু কেডিয়ার৷ বলল, ‘‘আরে রাম রাম, আপনাকে চায়ে-কোফি কুছু দেয়নি৷ শরম কী বাত৷’’

কেডিয়া সাফারির পকেট থেকে একটা কর্ডলেস ফোন বের করে, একটু পরে বলল, ‘‘এ বিহারি, গেস্ট রুমমে চায়ে ভেজ দেনা জলদি৷’’

লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম৷ গলায় সোনার মোটা চেন৷ আঙুলে একটা হিরের আংটি৷ পায়ে শস্তার চপ্পল৷ মুখে বিনয়ের ছাপ৷ এবার বলল, ‘‘মিঃ নোনদি, চার্লস যা করেছে, ফর দ্যাট আমি মাফি চাইছি৷ স্রিফ দু-চারটে ইনফরমেশান দিন, সোম্মানের সঙ্গে আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসব৷’’

‘‘কী ইনফরমেশান চান?’’

‘‘কিরকেট৷ আমার পান্টাররা সোব আপনার ফ্যান৷ উরা বোলেন, কিরকেট নিয়ে আপনি যা লিখেন, সোব সহি হয়ে যায়৷ সোবাই বলে, রাইটার হো তো নোনদি য্যায়সা৷’’

নিজের প্রশংসা শুনলে কার না ভালো লাগে৷ রাগ কমে আসছিল৷ বললাম, ‘‘আমাকে কিডন্যাপ করলেন কেন? আর ওই চার্লস লোকটাই বা কে?’’

‘‘ওয়েট করুন মোশাই৷ আগে চায়ে মুখে দিন৷ নাস্তা করুন৷ গরম গরম হালুয়া-কচৌরি খান৷ কাল রাতে তো একদম বেহুঁশ হয়ে ছিলেন৷’’

কেডিয়ার কথা শেষ হতে-না-হতেই দরজায় টকটক শব্দ৷ একটা লোক এক হাতে চায়ের ট্রে, অন্য হাতে গরম পুরি আর হালুয়ার প্লেট নিয়ে ঢুকল৷ লোকটার দুটো হাতই জোড়া৷ অথচ দরজায় শব্দ করল কী করে, মাথায় ঢুকল না৷ পরক্ষণেই মনে হল, দরজার বাইরে, নিশ্চয়ই আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে৷ দরকার পড়লে সে ঢুকবে৷ একটু সতর্ক হয়ে গেলাম৷

চা মুখে দিতে ইচ্ছে করছিল না৷ তবুও চুমুক দিলাম৷ মোষের দুধের চা, প্রচুর চিনি দেওয়া৷ এই ধরনের চা কলকাতার মাত্র একটা অঞ্চলেই পাওয়া যায়, বড়বাজার৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় এল, যেখানে আছি, সেই জায়গাটা বড়বাজার৷

গরম চা পেটে যেতেই মাথাটা সাফ হতে শুরু করল৷ নিজের মধ্যে ফিরে আসছি৷ লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘আপনার নাম তো বললেন রাজু কেডিয়া৷ কাম কী করেন জানতে পারি?’’

‘‘জরুর, জরুর৷ আমার একটা বেটিং সিন্ডিকেট আছে৷’’

এইবার নামটা আগেও শুনেছি বলে মনে হল, রাজকুমার কেডিয়া৷ লালবাজারে আমার এক বন্ধু আছে সুদীশ নাগ৷ ‘অ্যান্টি রাউডি’তে ছিল একসময়৷ সম্ভবত তার মুখেই শুনেছি৷ গতবছর কানপুরে মনোজ প্রভাকর আর নয়ন মোঙ্গিয়ার স্লো ব্যাটিং নিয়ে যখন অনেকে সন্দেহ করেছিলেন, ওরা বেটিংয়ে জড়িয়ে, তখন সুদীশ আমাকে ক্রিকেট আর হর্স রেসিংয়ে বেটিং নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছিল৷ বড়বাজারে নাকি বেটিং চালায় জাবরু বলে একজন৷ থাকে গণেশ টকিজের সামনে৷ আর রাজু কেডিয়া বেআইনি বেটিং চালায় ঘোড়দৌড়ের৷ ক্রিকেটের সঙ্গে তো রাজু কেডিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই?

এই কথাটা প্রশ্নের আকারে মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় কেডিয়া বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছেন৷ কিরকেট বেটিং আমি চালাতাম না৷ আমার ক্লায়েন্ট, মানে, পান্টাররা আমাকে এক বরস আগে নামাল৷ ওঁরা সেদিন বললেন, মিঃ কালকেটু নোনদি বলে এক রাইটার আছে…ছোড়িয়ে ওই সোব বাত৷ কুছু ইনফরমেশান দিন মিঃ নোনদি৷ আপনার নাফা হবে৷’’

‘‘বলুন, কী জানতে চান?’’

‘‘আজ ওয়ার্ল্ড কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ আছে৷ নাম্বার ওয়ান, কোন টিম জিতবে৷ মতলব, জিতার পসিবিলিটি আছে৷ নাম্বার টু, টোটাল কিতনা স্কোর হোগা৷ লো স্কোরিং হোবে, না টোটাল স্কোর অ্যাবাভ ফাইভ হান্ড্রেড হোবে৷’’

‘‘আগে থেকে কী এসব প্রেডিক্ট করা যায়?’’

‘‘তাজুব কি বাত! আপনি কী বোলছেন? আরে মোশাই, নিউজিল্যান্ড টিমটা যখন ইখানে খেলছিল, তখুন তো আপনিই প্রেডিক্ট করতেন৷ পান্টাররা তো আপনার লিখা পড়েই বেটিং করত৷ একটা ম্যাচে আপনি লিখলেন, বারিশ হবে৷ সোব অড চেঞ্জ হয়ে গেল৷ জাবরুর বহুত নুকশান হয়ে গেল৷’’

কেডিয়ার কথা শুনে উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলাম৷ ম্যাচের আগের দিন আমাদের ‘প্রিভিউ’ লিখতে হয়৷ উইকেটের চরিত্র, আবহাওয়া, দু-দলের শক্তি বিচার করে অনেক সময় ম্যাচ সম্পর্কে মন্তব্যও করতে হয়৷ আমার লাকটা ভালো, বেশির ভাগ সময়ই মন্তব্যগুলো ঠিক হয়ে যায়৷ আসলে আজহারউদ্দিন এবং অজিতভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো হওয়ায়, টিম সম্পর্কে কিছু তথ্য আমি আগে পেয়ে যাই৷ ওঁরাও আমাকে বিশ্বাস করে বলেন৷ ফলে ম্যাচ বিশ্লেষণ করতে আমার সুবিধে হয়৷

রাজু কেডিয়ার প্রশ্নটা শুনে এইবার আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম৷ লোকটা আমাকে লোভ দেখাচ্ছে৷ একটা বেআইনি কাজে জড়াতে চাইছে৷ দুটো প্রশ্নের জবাবই আমি জানি৷ সনৎ জয়সূর্য শ্রীলঙ্কা টিমে খেলছেন না৷ ভারতের ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা বেশি৷ আর এই ম্যাচটায় কোনোমতেই পাঁচশোর বেশি মোট রান হতে পারে না৷ টেনশনের ম্যাচ হবে৷ ইডেনের ‘আউট ফিল্ড’ বড়ো৷ চার রান, ছ’ রান কম হবে৷ কোনো দলই দুশো-সোয়া দুশোর বেশি রান করতে পারবে না৷ রাজু কেডিয়াকে যদি এইসব তথ্য দিই, তা হলে লুফে নেবে৷

তবু বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, ‘‘আমাকে এসব ফালতু কাজে জড়াবেন না৷ আমাকে ছেড়ে দিন৷ ইডেনে যেতে হবে৷’’

‘‘ধিরজ রাখিয়ে মিঃ নোনদি৷ আজকের ম্যাচে টু ক্রোর রুপিজ স্টেক হইয়াছে৷ বহুত টেনশন৷’’

‘‘দেখুন মিঃ কেডিয়া, এসব কাজের জন্য অন্য লোক আছে৷ তাদের নাম বলে দিচ্ছি৷ তারাও খুশি হবে আপনার হয়ে কাজ করতে পারলে৷’’

‘‘কার কোথা বলছেন মিঃ নোনদি?’’

‘‘এই ধরুন, তন্ময় দত্ত৷’’

হো হো করে হেসে উঠলেন কেডিয়া৷ তারপর বললেন, ‘‘ওহ, লোকটা বদমাশ আছে৷ কুছুদিন আগে পাকিস্তান যাবে বলে আমার কাছ থেকে রুপিয়া নিয়ে গেল৷ বলল, সোব পিলিয়ারদের সনে উনার দোস্তি আছে৷ ইমরান, আক্রাম, সালিম মালিক বগেরা বগেরা৷ একটা সেলুলার ফোন ভি সনে দিয়ে দিলাম৷ ইকদম গ্রাউন্ড থেকে যাতে আধা ঘণ্টা বাদ বাদ আমাকে সোব নিউজ দিতে পারে৷ লোকটা ইমানদারি করল না৷ ইতো বদমাশ, পরে শুনলাম, জাবরুর কাছ থেকে ভি রুপিয়া নিয়ে গেছে৷ ওকেও নিউজ দিয়েছে৷’’

হট করে মনে পড়ল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হওয়ার আগে একবার তন্ময়ের হাতে একটা সেলুলার ফোন দেখেছিলাম বটে৷ ক্লাবের টেন্টে জুনিয়ার ছেলেদের সেই ফোনটা দেখিয়ে তন্ময় বারফাট্টাই মারছিল৷ বলেছিল, অফিস দিয়েছে৷ মরুকগে যাক, আমার কী৷ আমি জেনেশুনে এইসব বুকমেকারকে সাহায্য করতে রাজি নই৷ কেডিয়াকে বললাম, ‘‘চার্লসও কি আপনার নিজের লোক?’’

‘‘বোলতে পারেন৷ লেকিন উর সনে আলাপ মাস চারেক আগে৷ ইয়ে আদমি রহতা হ্যায় হংকং মে৷ পিলিয়র মোহন চন্দ্রকুমারের গহরা দোস্ত৷’’

‘‘ও এখানে কী করতে এসেছে?’’

‘‘ওহ তো ফোটোগ্রাফার আছে৷ পিকচার খিঁছে৷’’

‘‘ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কেন?’’

‘‘আরে মোশাই, উকে বললাম এক, বেহুদা আদমি করে ফেলল আর এক৷ উকে বললাম, নিজের ইন্ট্রোডাকশন দিয়ে মিঃ নোনদিকে তাজ বেঙ্গলে নিয়ে এস৷ সন্ধ্যা ছটার মধ্যে আপনি সাড়ে আট তক বিজি রইলেন৷ ব্যস, প্ল্যান মুতাবিক কুছু হল না৷ পাগল আদমি…আপনাকে ইনজিওর করে ইখানে নিয়ে এল৷ এ আমার গেস্ট হাউস কাম অফিস৷ চার্লস ভি ইখানেই, অলগ কামরায় আছে৷’’

‘‘লোকটা ক্রিমিনাল অফেন্স করেছে মিঃ কেডিয়া৷’’

‘‘আমি মাফি চাইছি৷’’ কী যেন মনে পড়ল কেডিয়ার৷ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘বেটিংয়ের জন্য আমার এই ইনফরমেশান সোব সরকার৷ আপনি পাশে পাশে লিখে রাখবেন৷ এক ঘণ্টা বাদ আমি আসছি৷ প্লিজ, আমাকে ডোবাবেন না৷ নোমোস্কার, মিঃ নোনদি, চলি৷’’

আর কোনো কথা না বলে রাজু কেডিয়া বেরিয়ে গেলেন৷ দরজায় ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল৷ তার মানে, লক করে দিল৷ এতক্ষণ বিছানায় বসে কথা বলছিলাম৷ এবার সোফায় এসে বসলাম৷ ভীষণ খিদে পাচ্ছে৷ গরম পুরি-হালুয়া, এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে৷ খালি পেট থাকলে চিন্তা করতে পারব না৷ তাই খেতে শুরু করলাম৷ চনমনে খিদে, মন্দ লাগল না৷

সুদীশ এই কেডিয়া সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিল, তাতে চট করে ছাড়া পাব বলে মনে হল না৷ কিন্তু বেলা দুটোর মধ্যে আমাকে ইডেনে পৌঁছোতেই হবে৷ আমার আবার ম্যাচ রিপোর্ট করার কথা৷ সেমিফাইনাল ম্যাচে কোন রিপোর্টার কী করবে, সেইসব দায়িত্ব আমিই ভাগাভাগি করে দিয়েছি৷ ইডেনে আমাকে না দেখতে পেলে ইন্দ্রনীলরা ঘাবড়ে যাবে৷ মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে লাগলাম, কী করা যায়৷

রাজু কেডিয়া যে কাগজটা দিয়ে গেছেন, সেটাই পড়তে শুরু করলাম৷ পাঁচটা প্রশ্ন তাতে লেখা৷ (১) টস জিতলে ইন্ডিয়া ব্যাট করবে, না ফিল্ডিং৷ (২) ইন্ডিয়ার ব্যাটিংয়ে কে ওপেন করবে? (৩) কে খেলবে, যদি জাদেজা অসুস্থ হয়ে পড়ে? (৪) শচীন ঠিক কত নম্বরে নামবে? (৫) কুম্বলে যদি ভালো বল করতে না পারে, তাহলে আর কেউ স্ট্রাইক বোলার হিসাবে সাকসেসফুল হতে পারে কিনা৷

বার বার পড়তে লাগলাম প্রশ্নগুলো৷ পাঁচটার মধ্যে তিনটে প্রশ্ন সত্যিই অদ্ভুত৷ অন্তত আমার কাছে তাই মনে হতে লাগল৷ কে ব্যাটিং ওপেন করবে এবং শচীন ঠিক কত নম্বরে নামবে, এই দুটো প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে তেমন কঠিন নয়৷ কেননা মোহন চন্দ্রকুমার, মনোজ প্রভাকর আগের চারটে ম্যাচ ওপেন করেছে, আর শচীন নেমেছে চার নম্বরে৷ কিন্তু আমি জানি, ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট এই অর্ডারে ওদের সেমিফাইনাল ম্যাচটা খেলাতে চাইছে না৷ আমি জানি বলেই প্রশ্ন দুটো পড়ে আমার খটকা লাগল৷ টিমের দু-একজন ছাড়া এই ব্যাপারটা আর কেউ জানে না৷ শচীন ওপেন করবে মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে৷ মনোজ যাবে ছয় নম্বরে৷ রাজু কেডিয়ারা সম্ভবত এই খবরটা কারও মারফত পেয়েছেন৷ টিমের ভেতর অথবা কাছাকাছি কেউ ওঁদের খবর দিচ্ছেন৷ আমার কাছে ঝালিয়ে নিয়ে কেডিয়া আরও নিশ্চিত হতে চান৷

প্রশ্নমালা পড়ে আরও দুটো ব্যাপারে খটকা লাগল৷ জাদেজা অসুস্থ হলে…আর কুম্বলে ভালো বল করতে না পারলে…এই দুটো প্রশ্নের মানেটা কী? মাথামুন্ডু বুঝতে পারলাম না৷ লালবাজারে সুদেশ আমাকে একবার বলেছিল, একদিনের ম্যাচে এখন হিউম্যান ফ্যাক্টরের উপর কেউ বাজি ধরে না৷ আগে ধরত৷ যেমন প্রথম বলে কেউ আউট হবে কি না৷ কেউ সেঞ্চুরি পাবে কি না৷ কোন ক্যাপ্টেন টস জিতবে…এইসব৷ এই ধরনের বাজিতে গড়াপেটা করা সম্ভব৷ এখন একদিনের ম্যাচে স্রেফ দু-ধরনের বাজি৷ কোন দল জিতবে এবং দু-দল মোট কত রান করবে৷

সোফায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি, এমন সময় দরজায় ফের খুট করে শব্দ৷ দেখি, গতকালের সেই বিদেশি লোকটা৷ দেখেই প্রচণ্ড রাগ হল৷ কিন্তু লোকটার মনে কোনো অপরাধবোধ নেই৷ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘‘কাল রাতে তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি৷ তার জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম৷’’

একটা ঘুসিতে চার্লসের চোয়াল আমি ভেঙে দিতে পারি৷ কিন্তু সেটা করার সময় পরে পাব৷ ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘‘তোমাকে ক্ষমা করার কোনো প্রশ্নই নেই৷’’

‘‘তুমি রাগ করেছ বন্ধু৷ রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ নিশ্চয়ই তোমার মনে হচ্ছে, লোকটার চোয়াল ভেঙে দিই৷’’

আরে, লোকটা কি থট রিডিং জানে নাকি? কী করে বুঝল, ঠিক ওই ইচ্ছেটাই আমার করছে? একটু রেগেই বললাম, ‘‘যতক্ষণ না তোমাকে পালটা মারছি, ততক্ষণ আমি শান্তি পাব না৷’’

সোফায় পা ছড়িয়ে বসল চার্লস৷ হালকাভাবে বলল, ‘‘সে চেষ্টা করতে যেও না বন্ধু৷ আমি জানি, তুমি গজুকাই ক্যারাটের ব্লু বেল্ট৷ জানিয়ে রাখি, আমি কিন্তু কিও কুশিনে ব্ল্যাক বেল্ট করে রেখেছি৷’’

ফিকফিক করে হাসছে চার্লস৷ দেখে আমার গা জ্বলে গেল৷ লোকটা অসম্ভব বুদ্ধিমান৷ এর সঙ্গে লড়তে হবে বুদ্ধি দিয়েই৷ বললাম, ‘‘কী চাও?’’

‘‘দ্যাটস লাইক আ গুড ম্যান৷ আর্জেন্ট দরকার৷ তোমাদের টিমের মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে এক্ষুনি আমাদের একবার কথা বলতে হবে৷ কিন্তু প্রবলেমটা হচ্ছে, ও আমার বন্ধু, এ কথাটা বার বার বলা সত্ত্বেও হোটেল থেকে ওর ঘরে লাইন দিচ্ছে না৷ বলছে, সব ফোন টিমের ম্যানেজার অজিত ওয়াড়েকরের মাধ্যমে দেওয়া হবে৷ মিঃ ওয়াড়েকর কিছুতেই কথা বলতে দিচ্ছেন না মোহনের সঙ্গে৷ লাইনটা বার বার কেটে দিচ্ছেন৷ তুমি ফোন করলে উনি না করতে পারবেন না৷’’

‘‘এই কাজটা করে দিলে কি তোমরা আমাকে ছেড়ে দেবে?’’

‘‘এইট্টি পারসেন্ট, ইয়েস৷’’

‘‘হান্ড্রেড পারসেন্ট নয় কেন?’’

‘‘আরও একটা কাজ তোমাকে দিয়ে আমরা করাতে চাই৷ বেলা বারোটা- সাড়ে বারোটার সময়৷ দেন ইউ আর ফ্রি৷’’

কী ভেবে বললাম, ‘‘ঠিক আছে, কানেকশনটা দিতে বল৷’’

চার্লস পকেট থেকে একটা কর্ডলেস ফোন বের করল৷ তারপর নিজেই তাজ বেঙ্গলে ডায়াল করে বলল, ‘‘নাও, কথা বলো৷’’

অজিতভাইকে চাইলাম৷ এদিকে চার্লস উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবলে রাখা প্যারালাল ফোনের রিসিভারটা তুলল৷

‘‘অজিতভাই, কালকেতু বলছি৷’’

‘‘আরে, কাঁহা থে তু দাদা৷ কাল থেকে তোমাকে খোঁজ করছি৷ কর্নেল তোমাকে কিছু বলেনি?’’

কর্নেল মানে দিলীপ বেঙ্গসরকর৷ বললাম, ‘‘হ্যাঁ বলেছে৷ এত ব্যস্ত ছিলাম যে, ফোন করার সময় পাইনি৷ আমাদের টিম কী রকম শেপ-এ আছে?’’

‘‘গুড, ভেরি গুড৷ তবে আজ সকালে ইন্টারেস্টিং একটা ডেভেলপমেন্ট হয়েছে৷’’

‘‘কী সেটা?’’

‘‘দাদা, ফোনে বলা যাবে না৷ একটু আসতে পারবে বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ?’’

‘‘না অজিতভাই৷ সোজা মাঠে যাব৷’’

‘‘তুমি এলে ভালো হত৷ একটা ব্যাপারে ডিসকাশন করতাম৷ অজয় জাদেজা আর মনোজকে দিয়ে কেউ কেউ ওপেন করাবার কথা বলছে৷ জানি না, হঠাৎ কথাটা উঠল কী করে৷ একটু আগে একজন বোর্ড কর্তা এসেছিলেন৷ আকারে-ইঙ্গিতে তিনিও একই কথা বলে গেলেন৷’’

‘‘আজ্জুভাই কী বলছে?’’

‘‘ও তো চায়, মোহন আর শচীনকে খেলাতে৷’’

‘‘শচীন কী চাইছে?’’

‘‘ওর কোনো আপত্তি নেই৷’’

‘‘সানি গাওস্করের সঙ্গে কথা বলেছেন?’’

‘‘বলেছি৷ কোনো মন্তব্য করল না৷’’

‘‘অজিতভাই, আমি একটা খবর দিচ্ছি, শ্রীলঙ্কা টিমে আজ কিন্তু জয়সূর্য খেলছে না৷ আর যদি খেলেও, খুব একটা এফেক্টিভ হবে না৷’’

‘‘কেন?’’

‘‘কাল বিকেলের দিকে ওর ফুড পয়জনিং হয়েছে৷’’

‘‘আজ কোনো কাগজে তো বেরোয়নি৷’’

‘‘কেউ পায়নি৷’’

‘‘তাই বলো৷ তোমার কাগজেই তো আজ জয়সূর্যর ইন্টারভিউ বেরিয়েছে, শচীনের থেকে বেশি রান আমার চাই৷’’

‘‘ওগুলো সকালের দিকে নেওয়া ইন্টরাভিউ৷ যাক গে, আপনি কি ঠিক করলেন? জাদেজাকে দিয়ে ওপেন করালে, মোহনকে কোথায় নামাবেন?’’

‘‘তুমি যে খবরটা দিলে, তারপর তো আমাকে নতুন করে সব ব্যাটিং অর্ডার ভাবতে হবে৷’’

‘‘বি কেয়ারফুল অজিতভাই৷ খেলাটা ইডেনে৷ সারা ভারতের লোক এই ম্যাচটার দিকে তাকিয়ে আছে৷ খারাপ কিছু হলে, আপনি কিন্তু স্কেপগোট হয়ে যাবেন৷’’

‘‘ঠিকই বলেছ৷ ফাইনাল ডিসিশনটা আমাকেই নিতে হবে৷ আচ্ছা, তোমার কী মনে হচ্ছে, কালকেতু?’’

প্রশ্নটা এত আকস্মিক, কী উত্তর দেব চট করে ভেবে পেলাম না৷ বললাম, ‘‘মোহন ছেলেটা এত আন অর্থোডক্স, কী বলি বলুন তো৷’’

‘‘দ্যাখো, টস যদি জিতি তাহলে ব্যাট নেব না৷ রান চেজ করে জিততে চাই৷ সেজন্য ওপনিং পার্টনারশিপটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথম পনেরো ওভারের মধ্যে ৬০ বা ৬৫ রান তুলতেই হবে এবং কোনো উইকেট না হারিয়ে৷ না হলে পুরো ছকটাই ভেস্তে যাবে৷’’

‘‘অজিতভাই, মোহন ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে পারি?’’

‘‘শিওর৷ তবে ছেলেটা ঘরে আছে কিনা, দেখতে হবে৷ কাল রাতে ছেলেটা ঘণ্টাদুয়েকের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল৷ আলি ইরানি বলল, পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তোরাঁয় নাকি ডিসকো নাচছিল৷ এই ছেলেটা কোনো ডিসিপ্লিনের ধার ধারে না৷ হংকংয়ে মানুষ তো৷ বড্ড বেশি ফাস্ট লাইফ৷’’

হেসে বললাম, ‘‘রেস্তোরাঁয় যাক বা ডিসকোতে৷ ম্যাচটা জেতাক৷’’

‘‘প্রে টু গড কালকেতু৷ ওয়াতন কা লিয়ে৷ ফোনটা একটু ধরে থাকো৷ আমি দেখি ছেলেটা কাছাকাছি আছে কি না৷’’

চার্লসের দিকে তাকাতেই ইশারায় ও কর্ডলেস ফোনটা চাইল৷ আমি বসে রইলাম সোফায়৷ আজিতভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম ইংরেজিতে৷ বলাটা বোধ হয় ভুল হল৷ আগে খেয়াল হয়নি, চার্লস আমাদের প্রতিটি কথা শুনছে৷ অনেক খুঁটিনাটি খবর ও পেয়ে গেল৷ ও প্রান্তে মোহন চন্দ্রকুমার ফোন ধরেছে৷ চার্লস ওর সঙ্গে কথা বলছে৷ চিনা ভাষায়৷ যার এক বর্ণ আমি বুঝতে পারলাম না৷

দু-তিন মিনিট কথা বলে, বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে চার্লস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ ওর মনে তখন যুদ্ধজয়ের হাসি৷ আদৌ বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ কেন ও এত উৎফুল্ল৷

সকাল থেকে একটা সিগারেটও খাইনি৷ খুব ইচ্ছে করছিল৷ অন্য দিন বেলা দশটার মধ্যে গোটাতিনেক সিগারেট খাওয়া হয়ে যায়৷ পকেট হাতড়ে দেখলাম, প্যাকেট নেই৷ তবে লাইটার আছে৷ কে এনে দেবে আমাকে সিগারেট?

মনে আশা নিয়েই টেলিফোনের রিসিভারটা তুললাম৷ ও-প্রান্ত সাড়া পেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘বিহারি আছে? উসকো জেরা ভেজ দেনা৷’’ আধঘণ্টা আগে রাজু কেডিয়া ওই লোকটাকেই নাস্তা আনতে ডেকেছিল৷

‘‘বিহারি নেহি হ্যায় সাব৷ আফজল কো ভেজ দু৷’’

‘‘চলেগা৷’’

‘‘কেয়া চাহিয়ে সাব আপকো?’’

‘‘সিগারেট৷’’

‘‘ঠিক হ্যয় সাব৷ আভি ভেজ দেতা৷’’

মিনিটপাঁচেক পর আফজল লোকটা একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ঢুকল৷ লোকটা টেবিলের ওপর থেকে ডিশ আর চায়ের কাপগুলো গোছাতে গোছাতে হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ‘‘সাব, আপ রিপোর্টার হ্যায় না?’’

চমকে উঠে বললাম, ‘‘কী করে জানলে?’’

‘‘আপনাকে মহমেডান মাঠে দেখেছি৷ আমি মহমেডান ক্লাবের সাপোর্টার৷ আপনাকে উমরভাই খুব সম্মান করে৷’’

‘‘হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আমার খুব জানাশোনা আছে৷’’

‘‘সাব, আমাদের টিমটা কি আই এফ এ শিল্ড জিততে পারবে?’’

‘‘জেতা খুব কঠিন৷ আফজল ভাই, একটা কাজ করে দেবে?’’

‘‘বলুন৷’’

‘‘এখান থেকে কীভাবে বেরিয়ে যেতে পারব, বলবে?’’

‘‘আমার নোকরি চলে যাবে, সাব৷’’

‘‘তুমি পরে রিপোর্টারদের টেন্টে এসো৷ তোমার চাকরি আমি করে দেব৷’’

‘‘ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা সুইচ আছে সাব৷ ওটা দাবিয়ে দিন৷ রাস্তা পেয়ে যাবেন৷ তবে এখন নয়, মিনিটদশেক পরে৷’’

ডিশ-কাপ নিয়ে আফজল বেরিয়ে গেল৷ পা চালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেলাম৷ ভালো করে খুঁজতেই তলার দিকে একটা সুইচ দেখতে পেলাম৷ ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘণ্টাখানেক এই ঘরের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছি৷ কোনো কিছু চোখে পড়েনি৷ আজফল না বলে দিলে জানতেই পারতাম না, ঘরের একটা গোপন দরজা আছে৷ কেডিয়ারা ধান্দাবাজ লোক৷ কতরকম ব্যবস্থাই না এরা করে রাখে৷

মিনিট সাত-আট পরে সুইচটা টিপলাম৷ একটা ঘড় ঘড় আওয়াজ হল৷ কিছু একটা সরে গেল বলে মনে হল৷ কিন্তু ঘরের মধ্যে তার কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না৷ দেওয়াল, মেঝে, সিলিং—সবকিছু তন্ন তন্ন করে দেখলাম৷ না, কোথাও কোনো সামান্য ফাঁকও নেই৷ কী হল ব্যাপারটা? আওয়াজটা যে নিজের কানে শুনেছি৷ কী ভেবে বাথরুমে ঢুকলাম৷ ঢুকেই দেখি, বেসিনের পাশে একটা দরজা হাঁ করে খোলা৷

ছোট্ট একটা কাঠের সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে৷ মিনিটখানেক কান পেতে রইলাম৷ না, নীচ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই৷ খুব সাবধানে পা রাখলাম সিঁড়িতে৷ হাতের কাছেই একটা সুইচ৷ নিশ্চয়ই দরজাটা বন্ধ করার৷ কী ভেবে সেটা টিপে দিলাম৷ ঘর্ঘর শব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল৷ সঙ্গে-সঙ্গে সিঁড়িতে রাতের অন্ধকার নেমে এল৷ কী ভেবে ফের সুইচ টিপে দরজাটা খোলা রাখলাম৷

পকেটে লাইটার ছিল, জ্বালালাম৷ ফিকে আলোয় পা টিপে টিপে নেমে এলাম নীচে৷ ছোট্ট ঘর, জানলা-দরজা বলে কিছু নেই৷ কয়েকটা স্টিলের আলমারি, একটা ইজিচেয়ার৷ মনে হল, অ্যান্টি চেম্বার গোছের কিছু৷ নিশ্চয়ই পাশের ঘরে যাওয়ার কোনো দরজা আছে৷ দেওয়ালে নজর বোলাতে-বোলাতে হঠাৎ একটা হ্যান্ডেল পেয়ে গেলাম৷ দরজার পাশেই একটা সুইচবোর্ড৷ মাত্র দুটি সুইচ৷ একটা টিপতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল ঘরটা৷

এই ঘরে একটু আগে নিশ্চয়ই কেউ ছিল৷ ইজিচেয়ারের লম্বা হাতলে একটা ফাইল রাখা৷ ঘরের বাতাসে মৃদু গন্ধ আতরের৷ হঠাৎ মনে পড়ল, রাজু কেডিয়ার কানের পেছনে আতর-ভেজা একটুকরো তুলো দেখতে পেয়েছিলাম৷ তার মানে রাজু কেডিয়া একটু আগে এই ঘরে এসেছিল৷ চেয়ারের হাতল থেকে ফাইলটা তুলে পাতা ওলটাতে লাগলাম৷ কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না৷

প্রথম পাতায় লেখা : বিয়ার্ড

১২/৩/৯৬ ৭০ পয়সা ইন্ডিয়া ৫০০০

১৩/৩/৯৬ ৩০ পয়সা সাউথ আফ্রিকা ৭০০০

১৩/৩/৯৬ ৪৫ পয়সা ইন্ডিয়া ১০০০০

পরের পাতায় লেখা : লায়ন৷ তার নীচে তারিখ, পয়সার দর, দলের নাম ও সংখ্যা৷ (৩৯) এক-এক পাতায় এক-একটা অদ্ভুত নাম৷ ফাইলের পাতাগুলো কম্পিউটার থেকে ছেঁড়া৷ দেখলেই বোঝা যায়৷

মাথা সাফ হতে শুরু করল৷ এগুলো সব ‘কোড’, যাঁরা বেটিং করেন অর্থাৎ পান্টারদের৷ কারও আসল নাম নেই৷ বিয়ার্ড মানে এমন একজন লোক, যার দাড়ি আছে৷ লায়ন মানে সম্ভবত, লোকটার পদবি সিংহ৷ এঁদের নাম ‘বুকমেকার’ ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না৷ ফাইল উলটে দেখলাম, শ’পাঁচেক পাতা আছে৷

লালবাজারে সুদীশ নাগ একবার গল্প করেছিল, বড়ো-বড়ো বুকমেকাররা দিনের দিন পেমেন্ট দেন না৷ পান্টাররা এমন পয়সাওয়ালা লোক, হিসেব-নিকেশ হয় সপ্তাহের শেষে৷ পান্টাররা টেলিফোনে বাজি ধরেই খালাস৷ সারা সপ্তাহেই বিশ্বের কোথাও-না-কোথাও ক্রিকেট সিরিজ বা একদিনের ম্যাচ হচ্ছে৷ সিডনি, জোহানেসবার্গ, বার্বাডোজ, অকল্যান্ড, যেখানেই ম্যাচ হোক না কেন, পান্টাররা কলকাতায় বসেই বাজি ধরেন৷ এটা একটা অদ্ভুত নেশা৷ সপ্তাহের শেষে হার-জিতের হিসেব-নিকেশ করে তারা টাকা-পয়সা বুঝে নেয়৷ সবকিছুই চলে মুখে-মুখে৷ কেউ কাউকে ঠকায় না৷

ফাইলটা যথাস্থানে রেখে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গেলাম৷ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার৷ আলোটা নিভিয়ে হ্যান্ডেলটা ঘোরাতেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি, বিরাট একটা হলঘর৷ চমৎকার সাজানো-গোছানো৷ কোনো মার্কেন্টাইল অফিসের মতো৷ এক কোণে একটা এগজিকিউটিভ টেবিলের সামনে বসে আছেন রাজু কেডিয়া৷ টেবিলের ওপর গোটা দশেক ফোন৷ সাদা, লাল, সবুজ রঙের৷ পাশেই কম্পিউটার৷ কেডিয়ার উলটো দিকে বসে অন্য একজন৷ পাশ থেকে দেখে চেনা চেনা মানে হল৷ পেটানো চেহারা, গায়ে লাল রঙের টি-শার্ট৷ বসার ঋজু ভঙ্গি দেখে বোঝাই যায় ভদ্রলোক একসময় খেলাধুলো করতেন৷ তিনি কেডিয়াকে কী যেন বোঝাবার চেষ্টা করছেন৷ কেডিয়া ঘাড় নেড়ে একবার অ্যান্টি চেম্বারের দিকে ইঙ্গিত করলেন৷ আর তখনই ভদ্রলোক পেছন দিকে তাকালেন৷

আরে, এ তো সুনীত রেড্ডি! দেখেই চিনতে পারলাম৷ প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার৷ উনি এখানে? রেড্ডিও কি বেটিং সিন্ডিকেটে জড়িয়ে? বছর দশেক হল, খেলা ছেড়ে দিয়েছেন৷ কিন্তু হায়দরাবাদের ক্রিকেট মহলে এখনও ওঁর বেশ দাপট৷ প্রতি বছর রেড্ডি, কোনো-না-কোনো জায়গায়, কোনো- না-কোনো একটা কারণে বেনিফিট ম্যাচ বা মশালা ম্যাচের ব্যবস্থা করেন স্টার ক্রিকেটারদের নিয়ে৷ বোর্ড-কর্তারা মশালা ম্যাচের নিয়ম-কানুন বেঁধে দেওয়ার পরও রেড্ডিকে দমাতে পারেননি৷ মাসআটেক আগেও, প্লেয়ারদের নিয়ে তিনটে ম্যাচ উনি খেলে এসেছেন টরেন্টোতে৷ প্রচুর টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে দেন বলে, ক্রিকেটারদের মধ্যে রেড্ডি খুব জনপ্রিয়৷ বিশ্বকাপের সময় উনি সব জায়গায় ভারতীয় দলের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছেন৷ নিজের খরচে থাকছেন বড়ো-বড়ো হোটেলে৷ চাকরি তো করেন হায়দরাবাদের স্টেট ব্যাঙ্কে৷ তবু এত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন কী করে, তা নিয়ে আমারও মাঝেমধ্যে কৌতূহল হয়৷ ওঁকে কেডিয়ার সঙ্গে দেখে, এখন মনে হচ্ছে, টাকাটা উনি পান কোত্থেকে৷

দুজনের কথাবার্তা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না৷ ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, রেড্ডি কোনো একটা ব্যাপারে কেডিয়াকে কিছু বোঝাতে চাইছেন৷ অথচ কেডিয়া সেটা মানছেন না৷ রেড্ডি হঠাৎ ফোন করলেন কাউকে৷ খানিকক্ষণ কথা বলে কর্ডলেস ফোনটা এগিয়ে দিলেন কেডিয়ার দিকে৷ মিনিটখানেক পর দেখি, রেড্ডি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর টেবিলের ওপর রাখা ব্রিফকেসটা নিয়ে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷

দরজার ফাঁক থেকে চোখটা সরিয়ে নিলাম৷ আফজল বলেছিল, ড্রেসিং টেবিলের পাশের সুইচটা টিপলেই, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা পাব৷ কী পরামর্শ দিল ও? বেরোতে হলে কেডিয়ার সামনে দিয়েই বেরোতে হবে৷ যেটা সম্ভবই না৷ আর লোকটাও যেন জেঁকে বসে আছে৷ ফের চোখ লাগিয়ে দেখলাম, ঘনঘন টেলিফোন আসছে৷ কেডিয়া রিসিভার তুলছেন৷ হেসে কথা বলছেন৷ তার পর খসখস করে কী যেন লিখে নিচ্ছেন৷ খেলা শুরু হওয়ার সময় যত এগিয়ে আসে, বুকমেকারদের ব্যস্ততা নাকি ততই বেড়ে যায়৷ সুদীশ বলেছিল, পান্টাররাও নানা জায়গা থেকে ম্যাচ সম্পর্কে নানা খবর জোগাড় করেন৷ আন্দাজ করেন, তারপর বাজি ধরেন৷ তাই এই সময়টায় কেডিয়া সিট ছেড়ে উঠবেন বলে মনে হল না৷

দরজা সামান্য ফাঁক করে সব দেখছি৷ এদিকটায় কেডিয়ার নজর পড়লেই সর্বনাশ৷ আস্তে আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম৷ অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হবে, যাতে পাশের ঘরে নজর রাখা যায়৷ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঠের দেওয়াল আর সিলিংয়ের মাঝে এক ফুট করে কাচের শো-কেস৷ তাতে ফাইলপত্র ঠাসা৷ পাশের ঘরে কী হচ্ছে, দেখা সম্ভব নয়৷ অগত্যা ‘কি-হোল’-এর মাঝে চোখ দিলাম৷

উলটো দিকের দরজা দিয়ে একটা লোক ঢুকল৷ হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হল, চার্লস৷ কেডিয়া কম্পিউটারের ‘কি-বোর্ড’-এ কী যেন করছেন৷ এত ব্যস্ত যে, ইঙ্গিত করে বসতে বললেন চার্লসকে৷ লোকটাকে দেখামাত্রই চিনচিনে রাগ হতে শুরু করল৷ এত বড়ো একটা ম্যাচের আগে, এই ঝামেলায় পড়ার জন্য দায়ী, এই লোকটাই৷ বড়ো ম্যাচের দিন রোজ সকাল থেকেই আমি মনঃসংযোগ করি৷ কম কথা বলি৷ তাতে ম্যাচ রিপোর্টটা ভালো করা যায়৷ আজ তা তো কিছুই হল না৷ উলটে বন্দি হয়ে আছি এইরকম একটা জায়গায়৷

মিনিটপাঁচেক ধরে কেডিয়া আর চার্লসকে লক্ষ করতে লাগলাম৷ হঠাৎ দেখি, দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে, কথা বলতে-বলতে অ্যান্টি চেম্বারের দিকে আসছেন৷ বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ ওপরের দরজাটা খোলা৷ তবে ওই জায়গাটায় ঘন অন্ধকার৷ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম৷ তা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না৷ সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতেই নীচের দরজায় খুট করে শব্দ৷ একবার ভাবলাম, সুইচ টিপে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিই৷ কিন্তু সুইচ টিপলেই দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বন্ধ হবে৷ কেডিয়া আর চার্লস তা শুনতে পাবেন৷ তাই দরজাটা খোলা রেখেই বাথরুমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলাম৷

নীচে কেডিয়ার গলা, ‘‘সকালে টিভি নিউজে বলেছে, সনৎ জয়সুরিয়া খেলবে না৷ ইজ ইট ট্রু?’’

চার্লসকে বলতে শুনলাম, ‘‘এই খবরটা আপনাকে কে দিল?’’

‘‘একজন পান্টার ফোন করে জানাল৷’’

‘‘ভুল খবর মিঃ কেডিয়া৷ আমি একটু আগেই চেক করেছি৷ আপনার রিপোর্টার ন্যান্ডি এই খবরটা তখন ইন্ডিয়ান টিম-ম্যানেজারকে ফোনে দিচ্ছিল৷ তারপরেই কথা বলে জানলাম, জয়সুরিয়ার না খেলার খবরটা শ্রীলঙ্কান ক্যাম্প থেকে ইচ্ছে করে রটানো হচ্ছে৷’’

‘‘তুমি কী করে এত নিশ্চিত হলে?’’

‘‘বললাম তো, শ্রীলঙ্কান টিমের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি৷’’

‘‘শুধু শুধু ফালতু কথা রটবে কেন?’’

‘‘গেমসম্যানশিপ৷ আপনি এসব বুঝবেন না৷’’

‘‘মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে কথা বলেছ?’’

‘‘বলেছি৷’’

‘‘ও কাজটা করতে পারবে তো ঠিকঠাক?’’

‘‘পারবে৷’’

‘‘কাজটা তো ব্রেকফাস্টের সময়ই করতে পারত৷’’

‘‘সেটা রিস্ক নেওয়া হয়ে যেত৷’’

‘‘কেন?’’

‘‘যে ওষুধটা আমরা দিচ্ছি, সেই ‘লারজেকটিল’ খুব দ্রুত কাজ দেয়৷ ইন্ডিয়ান টিম ব্রেকফাস্ট করেছে সকাল আটটায়৷ খেলা দুটোয়৷ সকালে ওই কাজটা করলে, ঘণ্টাছয়েক মাত্র ওষুধের অ্যাকশন থাকত৷ তার মানে বেলা দুটো নাগাদ ওই তিনটে প্লেয়ার কিছুটা ফিট হয়ে যেত৷ আমাদের এত সব প্ল্যান কোনো কাজেই লাগত না৷ তার চেয়ে লাঞ্চ টেবিলে…চেষ্টা করাই ভালো৷ আর ঘণ্টাদেড়েক পর টিম লাঞ্চ করবে৷’’

‘‘কোন তিনটে প্লেয়ারকে টার্গেট করেছ?’’

‘‘জাদেজা, শচীন আর কুম্বলে৷’’

‘‘এই তিনটে প্লেয়ারই আসল৷ ঠিক আছে৷ লারজেকটিল মোহনের কাছে পৌঁছে দিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ৷ কাল রাতে পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁয় ও এসেওছিল৷ ডিসকো নাচার ফাঁকে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছি৷ পুরো একটা ফাইল৷’’

‘‘পরে ধরা পড়বে না তো?’’

‘‘কোনোমতেই না৷ যার সঙ্গে ট্যাবলেটটা ও মেশাবে, সেটা পরীক্ষা করলেও লারজেকটিলের কোনো চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবে না৷ তোমাদের চার্লস শোভরাজের কথা মনে আছে? ব্যাংককে ওর সঙ্গে আমার একবার আলাপ হয়েছিল৷ একই নামের শুরুটা, তাই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ শোভরাজ ওই লারজেকটিল খুব ব্যবহার করত, ওর শিকারকে কাবু করার জন্য৷’’

‘‘দ্যাখো পরে যেন কোনো গণ্ডগোল না হয়৷ আমি জড়িয়ে আছি, জানাজানি হলে কলকাতায় টিকে থাকতে পারব না৷ তোমার আর মোহনের কী৷ তোমরা তো কালই হংকং পালাবে৷’’

‘‘মিঃ কেডিয়া, ন্যান্ডির কী হবে?’’

‘‘ওকে ঠিক খেলার আগে ছেড়ে দেব৷’’

‘‘ঠিক আছে৷ আমাকেও মাঠে যেতে হবে৷ মোহনের সঙ্গে দেখাও হবে, মাঠে ওরা যখন খেলতে নামবে৷ আমি ফোটোগ্রাফার হয়ে মাঠের ভেতর থাকব৷ ওখান থেকে সেলুলার ফোনে তোমাকে শেষ খবরটা দিয়ে দেব৷ আমি একটু বেরোচ্ছি৷ আধঘণ্টা পর ফিরব৷’’

‘‘ঠিক আছে৷ মাঠ থেকে ফিরে আসার পর না হয়, তোমার আর মোহন চন্দ্রকুমারের হিসেবপত্র ‘সেটল’ করে নেব৷’’

‘‘ও কে৷’’

কয়েক সেকেন্ড পর দরজায় খুট করে একটা শব্দ হল৷

বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে আমার প্রায় হার্টফেল হওয়ার অবস্থা৷ এ তো পরিষ্কার ষড়যন্ত্র৷ সিঁড়ির সুইচ টিপে, দরজা বন্ধ করে, বেসিনের কাছে গিয়ে আমি প্রথমে চোখে-মুখে জল ছেটালাম৷ উত্তেজনায় সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ মোহন চন্দ্রকুমারকে দিয়ে এরা ইন্ডিয়া টিমের চরম ক্ষতি করতে যাচ্ছে৷ দেশের ক্ষতি করবে৷ বেটিংয়ে লাভ করার জন্য!!

প্রায় টলতে-টলতে সোফায় এসে বসে পড়লাম৷ লারজেকটিল… লারজেকটিল… কোথায় যেন শুনেছি এই ওষুধটার কথা? মনে করার চেষ্টায় চোখ বুজলাম৷ কে যেন বলেছিল আমাকে এই ওষুধটার কথা? সাংবাদিক কিশোর ভিমানি, না নোভি কাপাডিয়া? ভিমানিই৷ হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷ একবার শারজা থেকে ফিরে এসে উনি আমার কাছে গল্প করেছিলেন৷ চেতন চৌহান একবার পাকিস্তান ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে ভিমানির কাছে এসে কথায় কথায় বলেন, ‘‘মাথা ঝিম ঝিম করছে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ কী হল বলুন তো?’’ হঠাৎই সেই ঘুম ঘুম ভাব৷

ব্যাট করতে নেমে ক্রিজে সর্ষেফুল দেখেছিলেন চৌহান৷ ফিল্ডিং করার সময় মাঠে দাঁড়াতেও পারছিলেন না৷ ম্যাচে ভারত হেরে যায়৷ তারপর সেই ঝিমুনিও চলে যায়৷ পরে ভিমানি খোঁজ করে জানতে পারেন, ক্রিকেটে নানারকম ষড়যন্ত্র হয়৷ লারজেকটিল ট্যাবলেট জলের সঙ্গে বা অন্য কিছুতে মিশিয়ে কোনো প্লেয়ারকে খাইয়ে দিলেই হল৷ কয়েক ঘণ্টার জন্য সেই প্লেয়ার ক্লান্তিতে টলে পড়বে৷

সেই লারজেকটিল চার্লস দিয়ে এসেছে মোহন চন্দ্রকুমারকে৷ জাদেজা, শচীন আর কুম্বলকে যদি লাঞ্চ টেবিলে কোনোরকমে খাইয়ে দিতে পারে মোহন, তাহলে ভারতীয় টিম শেষ৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারবে শ্রীলঙ্কার কাছে৷ বোধ হয় ফ্লাড লাইট জ্বালাবারও দরকার হবে না৷ ম্যাচ তার আগেই শেষ হয়ে যাবে৷

অজিত ওয়াড়েকরের কাছে এখনই খবরটা পৌঁছে দেওয়া দরকার৷ কিন্তু কীভাবে? বসে বসে ভাবতে লাগলাম৷ আর একটা মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা যাবে না৷ মোহন চন্দ্রকুমার যাতে কোনোমতেই লাঞ্চ টেবিলে ওই তিন ক্রিকেটারের ধারে-কাছে না যেতে পারে, অথবা উলটোটা৷ হোটেলে ফোন করে অজিতভাইকে বলে দেওয়া সম্ভব৷ কিন্তু কেডিয়ার ফোন তো ব্যবহার করা যাবে না৷ অপারেটর সব শুনে ফেলবে৷

দ্রুত কী করা যায় ভাবছি৷ আফজলকে ডেকে এনে একটা চিঠি লিখে পাঠালে, সেটা পৌঁছোবে না অজিতভাইয়ের কাছে৷ আফজলের মতো লোক কাছেই ঘেঁষতে পারবে না৷ আফজলকে আমাদের অফিসে পাঠানো যায়, ইন্দ্রনীলের কাছে৷ ইন্দ্রনীল এখন অফিসে পৌঁছে গেছে৷ ও অজিতভাইকে ফোন করে দিতে পারে৷ কথাটা মনে হতেই ভাবলাম, আফজলকে অফিসে পাঠাব কেন? ইন্দ্রনীলের কাছে ফ্যাক্স মারফত এই মেসেজটা তো অনেক আগেই পৌঁছে যাবে৷ মেসেজটা অবশ্য লিখব আমাদের সাঙ্কেতিক ভাষায়৷ যাতে এখানে বা অফিসে কেউ না বুঝতে পারেন৷

কেডিয়ার টেবিলের পাশে আমি একটা ফ্যাক্স মেশিন দেখেছি৷ ও কি আমাকে মেসেজ পাঠাতে দেবে? চেষ্টা করে দেখিই না৷ এই ভেবে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললাম৷ একটু পরেই অন্য প্রান্ত থেকে অপারেটর বলল, ‘‘বোলিয়ে সাব৷’’

‘‘কেডিয়ার সঙ্গে কথা বলা যাবে?’’

‘‘জরুর৷’’

একটু পরেই কেডিয়ার গলা, ‘‘বলুন মিঃ নোনদি৷ কী করতে পারি আপনার জন্য৷’’

‘‘একটা ফ্যাক্স মেসেজ পাঠাব৷ আমার কলিগের কাছে৷’’

‘‘আমাকে বিপদ ফেলবেন না তো?’’

‘‘না৷ ক্রিকেট নয়, ফুটবল ম্যাচ নিয়ে ‘ইনস্ট্রাকশন’ পাঠাব৷’’

‘‘ঠিক আছে৷ লিখে ফেলুন৷ হামার লোগ গিয়ে নিয়ে আসবে৷’’

‘‘না৷ আমি সামনে দাঁড়িয়ে পাঠাতে চাই৷’’

‘‘ঠিক হ্যায়৷ যেমুন আপনার মরজি৷ দশ-পন্দরা মিনিট পর হামার লোগ যাবে আপনার কাছে৷’’

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে, টেবিলে রাখা রাইটিং প্যাড থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে লিখতে বসলাম৷ এই মেসেজটা যদি ইন্দ্রনীলের কাছে পৌঁছোয় তাহলে বিরাট একটা কেলেঙ্কারির হাত থেকে আমাদের টিম বেঁচে যাবে৷

ইন্দ্রনীল,

ডি সি এম ফুটবলে আজ মোহন

বাগানের ম্যাচ আছে৷ অমিতাভ চন্দ্র

টিমের সঙ্গে যায়নি৷ রবি কুমার

—কে বলবি, ম্যাচটা ও যেন

আমাদের জন্য লিখে পাঠায়৷ ইন্ডিয়া

টিমের সিলেকশন দিল্লিতেই৷ টিমের

জন্য কে চান্স পাবে, নামী প্লেয়ারদের

মধ্যে কে বাদ যাবে, তার সঙ্গে

কোচ আক্রামভকেও আজ লাঞ্চ

টেবিলে ধরে বড়ো একটা রিপোর্ট করতে

বলবি৷ আক্রামভ দু-একবার না না

করতে পারে৷ এড়িয়েও যেতে পারে৷

ও যা-ই বলুক, রবিকে বলবি, জরুরি

এই ইন্টারভিউটা৷ ইন্ডিয়া ক্যাম্পের খবরটা

রোজ রোজ দরকার৷ আমি ফোনে অজিত

ঘোষকেও ধরছি৷ না পেলে ওর ভাইকে

পাওয়া যাবেই৷ মাঠে খবরটা দিবি৷

 —কালকেতুদা৷

লেখাটা শেষ হতেই দরজায় খুট করে একটা শব্দ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আফজল৷ বলল, ‘‘কেডিয়া সাব আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে৷’’

দুজনে মিলে নীচের তলায় নেমে এলাম৷ কেডিয়ার ঘরটা উলটো দিক থেকে একটু আগে দেখেছি৷ যত বড় মনে হয়েছিল, তত বড়ো নয়৷ ঘর থেকে বেরোলেই সিঁড়ি৷ নীচে নেমে যেতে অসুবিধা হবে না৷ এই তলায় কয়েকটা অফিসও রয়েছে৷ লোক ওঠা-নামা করছে সিঁড়ি দিয়ে৷

দেখা হতেই কেডিয়া বললেন, ‘‘আমার অপারেটর বসে আছেন৷ ওঁকে মেসেজটা দিন৷’’ দেখি, ফ্যাক্স মেশিনের সামনে এক ভদ্রমহিলা বসে৷ হাত বাড়িয়ে তিনি কাগজটা নিলেন৷ পুরোটা পড়ে একবার রাজু কেডিয়ার দিকে তাকিয়ে তিনি ঘাড় নাড়লেন৷ তারপর নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন আমাদের অফিসের৷ আমার বুকটা ঢিপঢিপ করছিল৷ এবার যে মেসেজটা পাঠাচ্ছি, তা একটু অন্য ধরনের৷ প্রতি লাইনের শেষ অক্ষর নয়, শেষ শব্দটা পর পর সাজিয়ে নিলেই ইন্দ্রনীল বুঝতে পারবে, কী বলতে চাইছি৷

‘‘ইন্দ্রনীল, মোহন চন্দ্রকুমার যেন ইন্ডিয়া টিমের প্লেয়ারদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে না পারে৷ জরুরি খবরটা অজিতভাইকে দিবি৷—কালকেতু৷’’

দমবন্ধ করে আছি৷ ভদ্রমহিলা ফ্যাক্স মেশিনের মধ্যে কাগজটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন৷ নম্বর লেগে গেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা অফিসে পৌঁছে যাবে৷ এই একটা সময়, যখন আমরা সত্যিই টেনশনে ভুগি৷ ফ্যাক্স মেশিনটা তখন আমাদের কাছে দেবতা৷ তিনি তুষ্ট না হলে, সারাদিনের পরিশ্রমটাই বরবাদ৷ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ হঠাৎ পাতাটা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল৷ অর্থাৎ লাইন পাওয়া গেল৷ মেসেজটা অফিসে যাচ্ছে৷ উফ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷

রাজু কেডিয়া কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন৷ আমাকে বললেন, ‘‘মিঃ, নোনদি, আপনি ইকটু বসুন৷ আপনার সনে বাতচিত আছে৷’’

অগত্যা উলটোদিকের চেয়ারে বসলাম৷ আমার অন্তত কোনো দরকার নেই এই পাজি লোকটার সঙ্গে৷ এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচি৷

‘‘হামার একটা পোরপোজাল আছে মিঃ নোনদি৷ গুসসা করবেন না৷ আপনি জেন্টলম্যান আছেন৷ আপনার সনে একটা ডিল করতে চাই৷ আপনি হামাদের অ্যাডভাইসার হয়ে কাজ করুন৷’’

‘‘মাফ করুন, আমার পক্ষে সম্ভব না৷’’

‘‘কেনো মিঃ নোনদি?’’

‘‘আপনারা যা করছেন, বেআইনি৷’’

‘‘আপনি ঠিক বলছেন না৷ আপনি উইলিয়াম হিল আর ল্যাডব্রোকের নাম তো নিশ্চিত জানেন৷ আমরা ওদের মতো কাজই করছি৷ তাহলে ইললিগ্যাল বলছেন কেনো?’’

উইলিয়াম হিল আর ল্যাডব্রোক ইংল্যান্ডের নামী দুটি বেটিং সংস্থা৷ ওই দুটি সংস্থাই সরকারের অনুমোদিত৷ কেডিয়া ওদের নাম করায় আমি বিরক্তি সহকারেই বললাম, ‘‘ওদের সঙ্গে আপনার এই সিন্ডিকেটের তুলনা করবেন না৷’’

‘‘কেনো, ওদের মতো ‘কেরডিবিলিটি’ হামারও আছে মোশাই৷ হামার ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞাসা করুন, কেউ কখনও এক রুপিয়া ভি চিট হয়নি৷ পেমেন্ট সোব বাড়িতে পৌঁছে গেছে৷’’

‘‘মিঃ কেডিয়া, আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না৷ দয়া করে এবার আমাকে মাঠে যেতে দিন৷ গ্যারান্টি দিচ্ছি, গত রাতের কথা আমি ভুলে যাব৷’’

কেডিয়া যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একটা মেয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকল৷ বছর তেরো-চোদ্দ বয়স৷ সুন্দর একটা স্কার্ট পরা৷ মেয়েটার এক হাতে একটা জাতীয় পতাকা৷ অন্য হাতে গোল করে গোটানো বড়ো একটা আর্ট পেপার৷ আদুরে গলায় মেয়েটা বলল, ‘‘ড্যাডি, বিহারী আমাকে একটা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ এনে দিয়েছে৷’’

কেডিয়া বললেন, ‘‘বাঃ, কখন দিল?’’

‘‘এই একটু আগে৷ ইডেনে যাচ্ছি, ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ না নিয়ে গেলে হয়? দেখো ইন্ডিয়া টিম আজ জিতবেই৷’’

‘‘হ্যাঁ বেটা, তোর সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে?’’

‘‘সুরযভাই আর আশা ভাবী৷ তোমাকে বললাম, ক্লাব হাউসের আরও টিকিট এনে দাও৷ তাহলে সহেলিকে নিয়ে যেতে পারতাম৷ তুমি তো দিতেই পারলে না৷’’

কেডিয়া হাসলেন মেয়ের আবদার শুনে৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘হামার মেয়ে কিরকেট ছাড়া আউর কোনো গেম ভালোবাসে না৷ শচীনের বহুত ফ্যান৷’’ শচীনের কথা ওঠায় মেয়েটা গোটানো আর্ট পেপার খুলে দেখাল, ‘‘এই ব্যানারটা মাঠে নিয়ে যাচ্ছি ড্যাডি৷ তুমি কিন্তু টিভি-র সামনে বসে থাকবে৷ যদি আমাকে দেখায়৷’’

আর্ট পেপারে নীল রঙে লেখা, ‘‘শচীন, কনগ্রাটস ফর ইয়োর সুপার্ব ব্যাটিং৷’’

কেডিয়া বললেন, ‘‘কে লিখে দিল রে?’’

‘‘কাল আমি লিখেছি৷’’

‘‘খুব ভালো হয়েছে৷ আভি তু যা৷ মুঝে ইয়ে আঙ্কল সে বাত করনা হ্যায়৷’’

বাপ-মেয়ের কথাবার্তা শুনে মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল৷ মেয়েটা বোধ হয় কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে৷ হিন্দিতে কথা বললেও দু-একবার ইংরেজি শব্দের উচ্চারণেই তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম৷ মনে কত উৎসাহ নিয়েই না মেয়েটা আজ ইডেনে যাচ্ছে৷ ও জানেও না, ওর বাবা আজ শচীন-আজহারদের হারাবার জন্য গোপনে চক্রান্ত করেছেন৷

মেয়েটা আপন মনেই জাতীয় পতাকা নাড়াচ্ছে৷ পতাকাটা আলতোভাবে ছুঁয়ে গেল আমাকে৷ সঙ্গে-সঙ্গে শিউরে উঠলাম৷ সবকিছু জানার পরও কী করে বসে আছি, এই কেডিয়া লোকটার সামনে? যে করেই হোক, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার৷

কেডিয়াও খুব ব্যস্ত৷ চোখে চোখ পড়তে এবার বললেন, ‘‘মিঃ, নোনদি, রুমে গিয়ে জ্যারাসা রেস্ট নিন৷ ঠিক সাড়ে বারোটার সময় হামরা আপনাকে ইডেনে পাঠিয়ে দেব৷’’

সেই একই রাস্তা আর সিঁড়ি দিয়ে আফজলের সঙ্গে ফের ওপরের তলায় উঠে এলাম৷ ঘরে ঢোকার আগে, হঠাৎ কী মনে হতে ওকে বললাম, ‘‘এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কী রাস্তা তুমি বাতলালে আফজল?’’

‘‘কেন সাব?’’

‘‘আরে, বোরোতে হলে তো কেডিয়ার ওই ঘরটা দিয়েই যেতে হবে৷’’

আফজল বিস্মিত, ‘‘কেন সাব, অ্যান্টি চেম্বারের ভেতরেই তো আর একটা দরজা আছে৷ দুটো আলমারির ফাঁকে৷ লক্ষ করেননি?’’

‘‘না তো?’’

‘‘ভালো করে দেখবেন৷ সেই দরজাটা দিয়ে বেরোলেই দেখবেন, সামনে একটা লিফট আছে৷ সোজা একতলায় নেমে যাবেন৷ ওটা কেডিয়া সাহাবের পার্সোনাল লিফট৷’’

আফজলের কথা শুনে খুব আপশোশ হল৷ অ্যান্টি চেম্বারে নামার পর আমার ভালো করে দেখা উচিত ছিল, বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় আছে কি না৷ উত্তেজনায় সেটা দেখা হয়নি৷ পার্স বের করে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দিলাম আফজলের হাতে৷

আর এক মুহূর্তও দেরি করার সময় নেই আমার হাতে৷ ঘরে ঢুকে নিজেই ভেতর থেকে লক করে দিলাম দরজাটা৷ তারপর চারপাশটায় একবার নজর বুলিয়ে নিলাম৷ নাঃ, কোনো কিছু ফেলে যাচ্ছি না৷ বেলা এগারোটার মধ্যে যে করেই হোক, আমাকে হয় তাজ বেঙ্গলে পৌঁছোতে হবে, নয়তো ফোনে একবার কথা বলতে হবে অজিত ওয়াড়েকরের সঙ্গে৷ মোহন চন্দ্রকুমার যেন কিছুতেই লারজেকটিল খাইয়ে না দিতে পারে শচীন-অনিল-জাদেজাকে৷

দেশের প্রতি টান আমরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে টের পাই খুব সামান্যই৷ খেলার মাঠে যখন আমাদের জাতীয় দল খেলে, তখন সেই শেকড়ের টান হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে৷ একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল৷ সোল এশিয়ান গেমসের প্রথম দশ দিন আমরা কোনো সোনার পদক পাইনি৷ রোজ প্রেস সেন্টারে গিয়ে, দিনের শেষে খবর পাঠাবার সময়, ওখানকার টেলেক্স ঘরের কর্মীরা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘আজ তোমরা কোনো সোনা পেয়েছ?’’

হতাশভাবে ঘাড় নাড়তাম, ‘‘না৷’’

কর্মীরা সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘‘কাল নিশ্চয়ই পাবে, দেখো৷’’

সত্যিই, যেদিন পি টি ঊষা প্রথম সোনাটা পেলেন, সেদিন আনন্দে নিয়মকানুন ভুলে প্রেস বক্স থেকে লাফিয়ে ভি আই পি ব্লকে চলে গিয়েছিলাম ক্রীড়ামন্ত্রী মার্গারেট আলভার কাছে৷ বিজয় মঞ্চে ঊষা যখন সেই সোনাটা গলায় ঝোলাচ্ছেন, স্টেডিয়ামে আমাদের জাতীয় সংগীত বাজছে, সেই সময় আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম৷ সেদিন প্রবলভাবে অনুভব করেছিলাম, দেশটাকে কত ভালোবাসি৷

সোলের সেই দিনটার কথা মনে হতেই চঞ্চল হয়ে উঠলাম৷ দ্রুত পায়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে সুইচ টিপে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে৷ আবার সেই কাঠের সিঁড়ি৷ এবার স্বচ্ছন্দে নেমে এলাম নীচে, অ্যান্টি চেম্বারে৷ ঘরে অন্ধকার৷ লাইটার জ্বালিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ঠিক বের করে ফেললাম, দুই আলমারির মাঝে প্রায় গোপন একটা দরজাকে৷

দরজাটা খোলার আগে বুকটা একবার ধড়াস করে উঠল৷ ওপাশে কী আছে জানি না৷ এই সময়ে কারও মুখোমুখি হয়ে গেলে মুশকিল৷ আফজল বলেছিল, কেডিয়ার পার্সোনাল লিফট দিয়ে সোজা নীচে নেমে যাবেন৷ এপাশের ঘরগুলোতে নিশ্চয়ই ওঁর ফ্যামিলি থাকে৷ কারও চোখে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়৷

হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে খুব আস্তে দরজাটাকে সামান্য ফাঁক করে বাইরে একবার উঁকি মারলাম৷ উলটোদিকেই একটা লিফট৷ অপরিসর করিডর৷ ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ ডান দিকে পাশাপাশি তিনটি ঘর৷ কোনো একটা ঘরে টিভি চলছে৷ হিন্দি গান শোনা যাচ্ছে৷ লিফটের সুইচে আমি আঙুল ছোঁয়াবার আগেই হঠাৎ দেখি, মাঝের ঘরটা থেকে কেডিয়ার মেয়ে বেরিয়ে আসছে৷ তার হাতে তখনও সেই ফ্ল্যাগ৷ আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা হাসল৷

খুব অস্বস্তিকর সেই মুহূর্ত৷ ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম, মেয়েটার মুখে বিস্ময়ের কোনো চিহ্ন নেই৷ হঠাৎ ও বলল, ‘‘আঙ্কল, আপনি চলে যাচ্ছেন?’’

ঘাড় নাড়লাম৷ আর ঠিক সেই সময়ই, নীচ থেকে খটাস করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম৷ তারপর গুঁইইই ধরনের টানা আওয়াজ৷ সুইচবোর্ডের দিকে চোখ পড়তে দেখি, লিফট নীচ থেকে উঠে আসছে৷ সর্বনাশ! যদি কেউ ঠিক এই ফ্লোরেই উঠে আসে? মেয়েটা হাতকয়েক দূরে দাঁড়িয়ে৷ অ্যান্টি চেম্বারে ঢুকে গেলে ও সন্দেহ করবেই৷ এদিকে, লুকোবার আর কোনো জায়গাও নেই৷ পলকের মধ্যে মন ঠিক করে নিলাম৷ কেউ যদি এই ফ্লোরে উঠে আসে, দরকার হলে বলপ্রয়োগ করতে হবে৷ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ আমি নষ্ট করব না৷

লিফটটা এসে থেমে গেল৷ কিন্তু তার আগেই ভেতরের লোকটাকে আমি দেখে ফেললাম৷ এইসব সময় আমার রিফ্লেক্স দারুণ কাজ করে৷ দরজা খোলার আগে, ঝট করে সরে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ যাতে উঠে আসা লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে দেখতে না পায়৷ সারা শরীরের শক্তি তখন আমার হাতের মুঠোয়৷ ঠিকই করে ফেলেছি, লোকটাকে আমার শক্তির আন্দাজ দিতে হবে৷

লোকটা লিফটের বাইরে পা রাখতেই, ডানদিকে ঘাড়ের পিছনে মারাত্মক একটা আঘাত করলাম৷ ক্যারাটে শেখার ফলে, আমি জানি শরীরের কোথায় আঘাত করলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাবু করা যায়৷ ‘উক’ শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা৷ অন্য কেউ হলে, উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত থাকত না৷ কিন্তু লোকটা পারল৷ দু’হাতে দেওয়ালে ভর দিয়ে, চোখ-মুখ কুঁচকে, ব্যথা সহ্য করতে-করতে একবার ঘুরে তাকাল৷ আমি জানি, লোকটা ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট৷ ঘণ্টা দেড়-দুয়েক আগে বেশ গর্ব করে কথাটা ও শুনিয়েছে৷ পালটা মারার সুযোগ দিলে আমি দাঁড়াতে পারব না৷ ভেতর থেকে কে যেন সাবধান করে দিল৷ ওকে ছন্দে আসতে দিও না৷ মনে হতেই, ডান পায়ে পুরো শরীরটা ঘুরিয়ে বাঁ পায়ে সপাটে লাথি মারলাম ওর পাঁজরে৷ সেটা সামলাবার আগে, ফের একটা লাথি৷ প্রচণ্ড একটা আক্রোশ, তখন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷

ডান দিকে সেই মেয়েটা তখনও দাঁড়িয়ে৷ বিস্ফারিত ওর চোখ৷ হাত থেকে ফ্ল্যাগটা মেঝেতে পড়ে গেছে৷ যে কোনো মুহূর্তে মেয়েটা চিৎকার করে উঠতে পারে৷ ওর মুখটা দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, পালাতে হবে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, লোকটার পিঠ মেঝেতে৷ বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে৷ কিন্তু তারই ফাঁকে গড়িয়ে সরে আসছে লিফটের দিকে৷ যাতে আমি লিফটে ঢুকে পড়ার আগে ও বাধা দিতে পারে৷

ইচ্ছেটা বুঝতে পেরে, তলপেটে ফের লাথি মারলাম৷ ফের উক করে আর একটা আওয়াজ৷ মুখের সাদা চামড়া লাল হয়ে গেল৷ আঘাতে আপনা থেকেই পুরো শরীরটা গুটিয়ে একটু সরে গেল দেওয়ালের দিকে৷ সেই সুযোগে আমি দ্রুত লিফটে ঢুকে পড়লাম৷ ঘণ্টা বারো আগে এই লোকটা বিনা কারণে গাড়ির মধ্যে আমার মাথায় আঘাত করেছিল৷ এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে, ওকে পালটা না মেরে গেলে খুব আপশোশ হত৷

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লিফটটা নেমে এল একতলায়৷ গেটের সামনে ছোট্ট টুলে একটা লোক বসে ছিল৷ উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল৷ লোকটার দিকে তাকাবার সময় আমার নেই৷ গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম৷ উফ, এখন আমি মুক্ত৷ কেডিয়ার সাধ্য নেই, আমাকে ফের ধরে৷

বড়বাজার অঞ্চলে আমি খুব বেশি যাওয়া-আসা করিনি৷ সরু গলিটা দিয়ে হাঁটবার সময়, দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা, পগেয়াপট্টি৷ লোক গিজগিজ করছে রাস্তায়৷ ভালোভাবে হাঁটার পর্যন্ত উপায় নেই৷ খুপরির মতো ঘর, দোকান৷ কোটি-কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই অঞ্চলে৷ অথচ জায়গাটার কোনো উন্নতি হল না৷

হাতঘড়িতে দেখলাম, প্রায় সাড়ে দশটা৷ যা কিছু করার, আর আধঘণ্টার মধ্যে আমাকে করতে হবে৷ জোরে পা চালিয়ে মহাত্মা গান্ধি রোডে পৌঁছে গেলাম৷ উলটোদিকের ফুটপাথে বড়ো একটা শো-রুম, কাপড়ের৷ নিশ্চয়ই ওখানে ফোন আছে৷ এই ভেবে শো-রুমে ঢুকলাম৷ দোকানে বেশ ভিড়৷ একজন সেলসম্যানকে ফোনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কোণে ক্যাশিয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল৷

উত্তেজনায় হাত কাঁপছে৷ হোটেলের নম্বর ডায়াল করতেই ও প্রান্তে, ‘‘গুড মর্নিং, তাজ বেঙ্গল৷’’

‘‘দেখুন, আমি একজন রিপোর্টার৷ অজিত ওয়াড়েকরের সঙ্গে কথা বলতে চাই৷’’

‘‘কী নাম বলব?’’

‘‘কালকেতু নন্দী৷’’

‘‘একটু ধরুন৷’’

যাক নিশ্চিন্ত৷ অজিতভাইকে ষড়যন্ত্রের কথা সব জানিয়ে দিলে মোহন চন্দ্রকুমার ইন্ডিয়া টিমের কোনো ক্ষতি আর করতে পারবে না৷ ও-প্রান্তে রিং হচ্ছে৷ বেজেই চলেছে৷ কেউ ফোন তুলছে না৷ তবে কি অজিতভাই ঘরে নেই? না থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়৷ টিমের ম্যানেজারকে অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপার দেখতে হয়৷ হয়তো কোনো প্লেয়ারের ঘরে ঢুকেছেন৷

বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়েই ফোনটা ছেড়ে দিলাম৷ নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই৷ একটা ট্যাক্সি করে তাজ বেঙ্গলে পৌঁছোতে মিনিট পঁচিশ লাগবে৷ হোটেলে এখন প্রচণ্ড কড়াকড়ি৷ কিন্তু মাঝেমধ্যে যেতে হয় বলে, কর্মীদের অনেকেই চেনা৷ ঢুকতে আমার অসুবিধে হবে না৷ তাড়াহুড়ো করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম৷ একটা ট্যাক্সি ধরা দরকার৷ যেভাবেই হোক না কেন৷

বেলা দশটা-সাড়ে দশটার সময় বড়োবাজারে ট্যাক্সি পাওয়া এত কঠিন, তা ধারণায় ছিল না৷ সব ট্যাক্সিই হাওড়া স্টেশনের দিকে ছুটছে৷ ট্যাক্সি ছাড়া আলিপুরের দিকে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই৷ কী করি ভেবে, একটু ‘টেনশন’ বোধ করতে লাগলাম৷ সময় চলে যাচ্ছে হু-হু করে৷ ঘড়ির কাঁটা যেন দৌড়চ্ছে কার্ল লুইসের মতো৷ জনবহুল ওই রাস্তায় অসহায় হয়ে আমি শেষ পর্যন্ত হাঁটতে শুরু করলাম৷

সরু একটা গলি দিয়ে যখন ব্র্যাবোর্ন রোডের ফ্লাইওভারের নীচে আর্মিনিয়ান গির্জার কাছে পৌঁছোলাম, তখন এগারোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি৷ না, ইন্ডিয়া টিমকে আর ধরা যাবে না৷ ঠিক এগারোটায় সবাই লাঞ্চ করতে নামবে৷ মোহন চন্দ্রকুমার দুষ্কর্মটি করে ফেলবে৷ সব জানা সত্ত্বেও, আমি আটকাতে পারলাম না৷ ব্যাড লাক, সত্যিই ব্যাড লাক৷ চার্লসকে মেরে লিফটের পাশে ফেলে দিতে যতটা উৎসাহ নিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম, ক্রমশই তা কমতে শুরু করেছে৷ এই শহরেই, মাইল তিনেকের মধ্যে একটা লোককে যোগাযোগের চেষ্টা করছি৷ আশ্চর্য, পারছি না৷ ক্রমেই মনটা দমে আসছে৷

‘‘আরে ভাই, তুমি এহানে?’’

তাকিয়ে দেখি, রুমি৷ আমার সেই বাংলাদেশি বন্ধু৷

‘‘তুমি!’’

‘‘হাওড়া স্টিশনে গেছিলাম৷ আজমিরের টিকিট কাটতে৷ ভাবলাম, ইন্ডিয়াতে আইলামই যখন, আজমির শরীফে একবার ঘুইর‍্যা যাই৷’’

‘‘টিকিট পেয়েছ?’’

‘‘হ, কিন্তু কনফার্ম না৷’’

‘‘এখন যাচ্ছ কোথায়?’’

‘‘আমি তো তোমাগো অফিসেই যাইতেছিলাম৷ তারপর ইডেনে যামু৷ তোমারে দেইখ্যা ট্যাক্সি থেইকা নাইমা আইলাম৷’’

‘‘কোথায় ট্যাক্সি?’’

‘‘ওই তো৷’’

‘‘চলো, চলো৷ কথা বলার সময় নেই৷ আমাকে এখনই একবার তাজ বেঙ্গলে যেতে হবে৷ তুমিও আমার সঙ্গে চলো৷’’

‘‘কিছু খবর আছে নাকি?’’

‘‘বড়ো খবর৷’’

কে বলে ব্যাড লাক? তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে এসে বসলাম৷ ডালহৌসি দিয়ে আসার সময় মনে পড়ল, কাল রাতে এখানেই চার্লস আমার মাথায় আঘাতটা করেছিল৷ কোনো দরকার ছিল না৷ কী করছে এখন চার্লস? মার খাওয়ার পর নিশ্চয়ই কেডিয়ার কাছে গেছে৷ কীভাবে পালিয়ে এলাম, তা নিয়ে গবেষণা করছে৷ মাঠে খেলা দেখতে আসার সাহস ওর হবে না৷ তবে কেডিয়া অবশ্যই আমার হাবভাব লক্ষ করার জন্য লোক পাঠাবে৷

যাক, ওসব নিয়ে ভাবার সময় এখন আমার নেই৷ কার্জন পার্কের কাছে ট্যাক্সিটা পৌঁছোতেই পুলিশ আটকাল৷ সোজা রেড রোড ধরে যেতে দেবে না৷ বাঁ দিকে ঘুরে এসপ্লানেড ইস্ট হয়ে মেট্রো সিনেমার পাশ দিয়ে সোজা যেতে হবে৷ পুলিশ এবার খুব তৎপর৷ ইডেনমুখী দর্শকদের জন্য নতুন ব্যবস্থা করেছে৷ কার্জন পার্কের কাছ থেকেই দর্শকদের গাড়িতে তুলে পৌঁছে দিচ্ছে ইডেনে৷

এই জন্যই তাজ বেঙ্গলে পৌঁছোলাম বেলা সোয়া এগারোটা নাগাদ৷ রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ করে শুনতে পেলাম, ইন্ডিয়া টিমের সবাই এখন লাঞ্চ টেবিলে৷ শুনেই মনটা দমে গেল৷ এত কষ্ট করে আসা সবই বৃথা৷ অজিতভাইয়ের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে পারব না? এত কাছে এসেও?

তাজ বেঙ্গলে তিন-চারটে রেস্তোরাঁ৷ কোনটাতে ইন্ডিয়া টিম লাঞ্চ খেতে গেছে, জানি না৷ লবিতে এ নিয়ে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সিকিউরিটি এক অফিসার এসে ধরলেন৷ একটু উদ্ধত সুরেই বললেন, ‘‘রিপোর্টার হোন অথবা যাই হন, প্লিজ প্লেয়ারদের এখন ডিসটার্ব করবেন না৷’’

আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ‘‘শুনুন ভাই, খুব জরুরি দরকার৷ একটা খবর পৌঁছে দিতে হবে৷’’

‘‘কী মেসেজ দিতে চান বলুন, আমরা পৌঁছে দিয়ে আসছি৷’’

কী করে সব কথা বলব? চুপ করে তাকিয়ে রইলাম৷ তর্ক করে লাভ নেই৷ এটা এদের ডিউটি৷ অগত্যা লাউঞ্জের সোফায় গিয়ে বসলাম৷ যে রেস্তোরাঁতেই অজিতভাইয়েরা লাঞ্চ করুন না কেন, লিফট দিয়ে তো ওপরে যেতেই হবে৷ তখন ধরব৷

পাঁচ মিনিট…দশ মিনিট…আধঘণ্টা সময় কেটে গেল৷ কারও পাত্তা নেই৷ সোফায় বসে ছটফট করছি৷ একবার উঠে গিয়ে ইন হাউস ফোন থেকে ওয়াড়েকরের ঘরে যোগাযোগ করলাম৷ না, তিনি ঘরে নেই৷

হঠাৎ দেখি সুনীত রেড্ডি লিফটের কাছ দিয়ে হেঁটে আসছেন৷ যখন খেলতেন, তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়৷ ঘণ্টা দুয়েক আগে কেডিয়ার ওখানে ওঁকে যে পোশাকে দেখেছিলাম, পালটে ফেলেছেন৷ এখন কোট-টাই-সুট৷ একেবারে ফিল্মের নায়ক বলে মনে হচ্ছে৷ একটা তেলুগু ছবিতে নাকি একবার অভিনয়ও করেছিলেন রেড্ডি৷ বেশিদিন চলেনি৷

‘‘হাই নন্দী৷ কেমন আছ?’’

ষড়যন্ত্রে কি এই লোকটাও আছেন? থাকাটা অস্বাভাবিক নয়৷ একটু রাগ হল৷ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দেশকে বিকিয়ে দিতে হবে? এই ধরনের মানুষকে গুলি করে মারা উচিত৷ মনে-মনে এসব কথা ভাবলেও মুখে কিন্তু বললাম, ‘‘রেড্ডি, অজিতভাইকে কোথাও দেখেছ?’’

‘‘তিনি তো নেই৷’’

‘‘কোথায় গেছেন?’’

‘‘শুনলাম আধঘণ্টা আগে নার্সিংহোমে গেছেন৷’’

‘‘কেন?’’

‘‘আমার নাম করে লিখো না৷ জাদেজা, শচীন আর কুম্বলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷’’

শোনামাত্রই আমার শরীরের সব রক্ত কে যেন শুষে নিল৷ যা ঘটবার, তা হলে তাই ঘটল? কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কোন নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে, জানো?’’

‘‘না৷ আমরা বাইরের লোক, জানব কী করে?’’ বলেই লাউঞ্জে বোধ হয় কাউকে দেখতে পেলেন রেড্ডি৷ হাত নেড়ে হাসতে-হাসতে সেদিকে চলে গেলেন৷

একটু দূরে সোফায় বসে ছিল রুমি৷ ওকে বললাম, ‘‘তুমি ইডেনের দিকে চলে যাও৷ আমি পরে যাচ্ছি৷’’

আমার মধ্যে অস্থির ভাব দেখে অবাক হচ্ছিল রুমি৷ বলল, ‘‘কী হইল কও তো৷’’

‘‘পরে বলব৷ প্রেস বক্সে৷’’

দ্রুত বেরিয়ে এলাম রাস্তায়৷ সব শেষ৷ কেডিয়ার অফিস থেকে পাঠানো আমার মেসেজটা বোধ হয় ইন্দ্রনীলের হাতে পড়েনি৷ ও তাই অজিতভাইকে কিছু জানাতে পারেনি৷ জাদেজা, শচীন আর কুম্বলে যদি না খেলতে পারে, তাহলে ম্যাচ জেতার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই ভারতের৷ এত লোকের এত উৎসাহ, আশা সব মিলিয়ে যাবে আর কয়েক ঘণ্টা পর৷

চিড়িয়াখানার উলটো দিকে রোজ প্রচুর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে৷ একটাতে উঠে পড়লাম৷ তারপর ঘণ্টাদুয়েক ধরে চষে ফেললাম মধ্য কলকাতার কয়েকটা নার্সিংহোম৷ নাহ, কোত্থাও অজিতভাই যাননি৷ রিসেপশনে অনেকেই অবাক হচ্ছিল, আমার প্রশ্ন শুনে৷ প্রায় দু’দিন একই পোশাক পরে আছি৷ স্নান করিনি৷ চেহারায় এমনিতেই পাগল-পাগল অবস্থা৷ একটা নার্সিংহোমে একজন তো বলেই ফেললেন, ‘‘পাগল নাকি! এখানে শচীনকে খুঁজতে এসেছেন৷ জগতে কতরকম লোকই না আছে৷’’ বেলা আড়াইটা নাগাদ হাল ছেড়ে দিলাম৷ নাহ, ইডেনেই যাওয়া যাক৷

আরও আধঘণ্টা পর যখন ইডেনে পৌঁছোলাম, খেলা তখন শুরু হয়ে গেছে৷ বটতলার কাছে একজন পুলিশ অফিসার রেডিয়োতে কমেন্ট্রি শুনছিলেন৷ জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘‘ইন্ডিয়া টিম ব্যাট করছে৷ টসে হেরেছে৷’’ শরীর অবসন্ন৷ সকালের দিকে কেডিয়ার বাড়িতে সেই যে পুরি- হালুয়া খেয়েছিলাম, তারপর থেকে পেটে আর কিছু পড়েনি৷ ট্যাক্সি থেকে পুলিশ নামিয়ে দিয়েছে ফোর্ট উইলিয়ামের আইল্যান্ডের কাছে৷ মাঠ দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে প্রায় টলতে-টলতেই ইডেনে পৌঁছেছি৷

‘‘কী ব্যাপার মিঃ নন্দী? এত দেরিতে?’’

গেটের সামনে মেটাল ডিটেক্টরে প্রত্যেককে পরীক্ষা করে ঢোকাচ্ছিলেন এক পুলিশ অফিসার৷ প্রশ্ন তাঁরই৷

গলা শুকিয়ে কাঠ৷ গেটের পাশে ঠান্ডা পানীয়ের প্যাকেট দিচ্ছিলেন একজন৷ একটা চেয়ে নিলাম হাত বাড়িয়ে৷ তারপর বললাম, ‘‘একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম৷’’

চারতলায় প্রেস বক্সে ওঠার জন্য প্রায় নব্বইটা সিঁড়ি ভাঙতে হয় রিপোর্টারদের৷ অন্য দিন অসুবিধে হয় না৷ শরীর ক্লান্ত বলে দেড় তলা পর্যন্ত উঠেই হাঁফিয়ে গেলাম৷ ল্যান্ডিংয়ের পাশে একটা দরজা আছে, ভি আই পি বক্সে যাওয়ার৷ হঠাৎ দেখি, সেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসছেন অজিত ওয়াড়েকার৷ দেখা হওয়াটা এত আকস্মিক যে, প্রথমে মুখ ফুটে কথা বেরোল না৷

আমাকে দেখেই অজিতভাই বলে উঠলেন, ‘‘কী ব্যাপার দাদা? ইন্দ্রনীল ফোন করেছিল৷ ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই যে বুঝতে পারলাম না৷’’

উফ, আমার মন থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল৷ বললাম, ‘‘কখন ফোন করেছিল ইন্দ্রনীল?’’

‘‘এই দশটা, সোয়া দশটা নাগাদ৷’’

‘‘আমাদের টিমের সবাই ফিজিক্যালি ঠিক আছে?’’

‘‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট৷ আজ সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ ওয়াতন কা লিয়ে৷’’

অজিতভাইয়ের মুখে হাসি দেখে, আমার সব উদ্বেগ দূর হয়ে গেল৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনি কি নার্সিংহোমে গেছিলেন?’’

‘‘কী বাজে বকছ! হোটেল থেকে সোজা এখানে এসেছি৷ আচ্ছা, মোহন চন্দ্রকুমারের ব্যাপারে ইন্দ্রনীল কেন বলল, লাঞ্চ টেবিলে ও যেন শচীনদের পাশে না বসে?’’

খেলা শুরু হয়ে গেছে৷ এখন কি ষড়যন্ত্রের কথা অজিতভাইকে বলা উচিত? মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, না৷ সব জানলে উনি মনঃসংযোগ হারাতে পারেন৷ উনি ভারতীয় দলের মস্তিষ্ক৷ এখন কোনোভাবেই ওঁকে বিরক্ত করা উচিত নয়৷ অজিতভাইকে দেখার জন্য ল্যান্ডিংয়ে কিছু লোক জমে গিয়েছিল৷ সেটা দেখে বললাম, ‘‘এখন নয় অজিতভাই৷ খেলা শেষ হোক, বলব৷’’

শরীরে এখন অসুরের শক্তি৷ দুটো করে সিঁড়ি টপকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনতলায় উঠে গেলাম৷ ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল৷ ঝকমকে রোদ্দুর৷ সবুজ মখমলের মতো মাঠ৷ গ্যালারি জুড়ে অসংখ্য লোক৷

হঠাৎ চোখ গেল স্কোরবোর্ডের দিকে৷ ব্যাট করছেন শচীন তেন্ডুলকর আর অজয় জাদেজা৷ ওঁদের মাঝে একটা নাম, মোহন চন্দ্রকুমার কট রণতুঙ্গা বোল্ড ব্যাস ০৷ সাত ওভার চলছে৷ ভারতের স্কোর এক উইকেটে ৫৬৷ শচীন ৪৬, জাদেজা ৬৷

স্কোর বোর্ড থেকে চোখ সরাবার আগেই ইডেন একবার গর্জে উঠল৷ মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি, কভার দিয়ে বল ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির দিকে৷ শচীনের অসাধারণ একটা কভার ড্রাইভ৷ সারা ইডেন উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম জানাচ্ছে খুদে মাস্টারকে৷ হাফ সেঞ্চুরি হল৷ শচীন ব্যাট তুলে অভিনন্দনের প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন৷

দৃশ্যটা দেখে চোখে জল এসে গেল৷ না, মোহন চন্দ্রকুমার পারেনি৷ ক্ষতি করতে পারেনি সুনীত রেড্ডিও৷ শচীনদের নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার একটা মিথ্যে খবর দিয়ে রেড্ডি শুধু একটা বিচ্ছিরি রসিকতা করেছে আমার সঙ্গে৷ মোহন আজকের ম্যাচটা খেলে নিক৷ আর যাতে ভবিষ্যতে খেলতে না পারে, পরে তার ব্যবস্থা করা যাবে৷ পকেট থেকে রুমাল বের করার ফাঁকে, ওই আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে একবার মনে হল, ইডেনে জড়ো হওয়া লাখখানেক মানুষ কোনো দিন জানতেও পারবেন না, কত বড়ো দুঃখ পাওয়ার হাত থেকে আজ ওঁরা বেঁচে গেলেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *