কিয়ারোসকিউরো
“ইজ়ি ম্যান, ইজ়ি। হাত তুলে দাঁড়াও। না, নড়বে না। নইলে গুলি চালাতে হাত কাঁপবে না আমার।” বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কথাটা ধারালো বরফের মতো এসে আঘাত করল আমায়। পিস্তলের হ্যামার টানার ধাতব শব্দটা ক্ষীণভাবে এল আমার কানে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্রিজের পাশের পোস্টে একটা দুর্বল বাল্ব আছে। তার পক্ষে এই বৃষ্টির চাদর ভেদ করা সম্ভব নয়। তবুও পিছনের মানুষটাকে দেখার জন্য হাত তোলা অবস্থাতেও ঘুরলাম আমি। প্রথমে মনে হল, শূন্যের ভিতর একটা বন্দুক ধরা হাত তাক করে রয়েছে আমার দিকে। তারপর ক্রমশ গোটা মানুষটার অবয়ব নজরে এল আমার। কালো রেনকোট পরে রয়েছে মানুষটা, মাথাটা রেনকোটের হুড দিয়ে ঢাকা থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। গলার স্বর শুনে বুঝলাম মানুষটা আওয়াজ বদলে কথা বলছে…
॥ আমস্টারডম, দু’মাস আগে: ১৩ মে ॥
When you walk through a storm,
Hold your head up high.
And don’t be afraid of the dark
At the end of a storm
There’s a golden sky.
And the sweet silver song of a lark.
Walk on through the wind.
Walk on through the rain
Though your dreams be tossed and blown…
Walk on, walk on, with hope in your heart.
And you’ll never walk alone
You’ll never walk alone…
আমার আশেপাশের সকলে এখনও একসঙ্গে গেয়ে চলেছে এই গান। ইউরোপের যে-কোনও ফুটবল মাঠে এই গান খুব পরিচিত। নিজেদের টিমকে সাহস জোগাতে গ্যালারি থেকে সমর্থকরা একসঙ্গে এই গান গায়। বলে, “তুমি একা নও, আমরাও আছি তোমার সঙ্গে।”
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বাবাও এমন বলেছিলেন আমায়। বলেছিলেন, “তুই একা হবি না কোনওদিন। জানবি, আমি আছি তোর সঙ্গে।” এখন ফাদার ফ্রান্সিসও এমন বলেন।
আমার মা মারা গিয়েছিলেন জন্মের সময়। আর বারো বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর আমায় আশ্রয় দিয়েছিলেন ফাদার ফ্রান্সিস। তারপর বড় হয়ে যখন আমি জীবনে পা রাখলাম, পাহাড় ছেড়ে সমতলে নামলাম, তার আগে তিনি ছোট্ট একটা ছবি দিয়েছিলেন আমায়। বলেছিলেন, “এটা রাখ। তোর বাবার তোলা তোর পাঁচ বছর বয়সের ছবি। এটা সব সময় সঙ্গে রাখবি। জানবি তুই একা নোস। তোর বাবা আছেন তোর সঙ্গে।”
আজ এই গোধূলি আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আমার আবার বাবার কথা মনে পড়ল। আমার ওয়ালেটে রাখা সেই ছবির কথা মনে পড়ল। চারদিকে খেলা দেখে বের হওয়া মানুষের ভিড়ে আর একা লাগল না আমার। মনে হল বাবা বলছে, You’ll never walk alone.
আমস্টারডাম এরিনার মতো দুর্দান্ত মাঠ ইউরোপে কমই আছে। এখানে খেলা দেখা হল একটা অভিজ্ঞতা। তাও যদি আবার লিভারপুল আর আয়াখ্স আমস্টারডামের হয়। কিন্তু আমি এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে আসিনি আমস্টারডামে। শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্য আমি ঢুকে পড়েছিলাম মাঠে। সামনে খেলা হলেও আমার মন ছিল না খেলায়। বরং মনের ভিতরে অস্বস্তি হচ্ছিল। টেনশন হচ্ছিল। রাইকার আসবে তো ঠিক সময়ে? আমি ঘড়ি দেখলাম।
পাশের বুলেভার্ডে ছোট্ট কফিশপটা রুবেনের। ওর কাছেই সাইকেল রেখেছি আমি। এই শহরে টুকটাক যাতায়াতের জন্য সাইকেলই বেশি চলে। দোকানের সামনে যেতেই রুবেন আমায় দেখে বলল, “কে জিতল?”
“ড্র হয়েছে। ১-১,” বলেই সাইকেলে উঠে পড়লাম আমি।
“কে-কে গোল দিল?”
আমার আর নষ্ট করার সময় নেই। প্যাডেলে চাপ দিয়ে বললাম, “ডি স্টাস্ট্ক্রান্ট-এ দেখে নিয়ো।”
এরিনা বুলেভার্ড থেকে যওডেনব্রিস্ট্রাট যেতে সাইকেলে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট মতো লাগে। তবে আঠেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমি। রাইকারের সঙ্গে খোলা জায়গায় বেশিক্ষণ থাকব না। কেউ আমাদের একসঙ্গে দেখে ফেলুক আমি চাই না।
রাইকার একজন ফর্জার। পুরনো মাস্টার পেন্টারদের ছবি নকল করতে তার জুড়ি মেলা ভার। তবে মাস্টার পেন্টারদের মধ্যে ওর স্পেশ্যালিটি হল, মোনে আর রেমব্রান্ট। ওর নকল করা রেমব্রান্টের ছবি দেখে কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয় সেটা নকল না আসল। রাইকার বলে যে, জাল ছবি আঁকা হল উন্নতমানের শিল্প। এ কাজ সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এই যে কাজটা ওকে দেওয়া হয়েছে সেটার কথাই ধরা যাক। সম্প্রতি গোয়ায় খুঁজে পাওয়া রেমব্রান্টের আঁকা তাঁর পুত্র টাইটাসের ৭৭.৬৩ সেন্টিমিটার ছবিটা নকল করতে রাইকারের প্রায় একমাস সময় লেগেছে শুধু ছবির সরঞ্জাম জোগাড় করতে। ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়েই জানতে পারলাম যে, ১৬৫০ সাল বা তার আশেপাশের সময়ের একটা ক্যানভাস জোগাড় করার জন্য ওকে খুব ঘুরতে হয়েছে। তারপর এগমন্ড আন ডেন হোফ নামক ছোট্ট এক শহরের এক ততধিক ছোট সরাইখানায় নাম না জানা এক শিল্পীর আঁকা সেই সময়ের ছবি ও খুঁজে পেয়েছে। এরকম পুরনো বহু অজানা শিল্পীর অনেক ছবি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। দশ ইউরো দিয়ে ছবিটা কিনতে হয়েছে রাইকারকে। তারপর ক্যানভাসের রং যথাসম্ভব তুলে, ট্রিটমেন্ট করে সেটাকে উপযুক্ত বানাতে হয়েছে ছবির জন্য। রেমব্রান্টের সময়ের ব্যবহৃত রংও জোগাড় করেছে ও। জোগাড় করতে হয়েছে সেই সময়ের ব্রাশ, আর ভার্নিসও। তারপরেও অশান্তি যায়নি। প্রকৃত ছবিটাকে রেমব্রান্ট যে পদ্ধতিতে এঁকেছিলেন, সেভাবে আঁকতে হয়েছে। ছবির রং শুকোনোর জন্য অল্প আঁচে রুটি সেঁকার মতো সেঁকতে হয়েছে আর সময়ে সময়ে ছবিটাকে নানাভাবে মুড়ে ছবি জুড়ে অসংখ্য হেয়ার ক্র্যাক তৈরি করতে হয়েছে। এগুলো পুরনো ছবির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারপর সেই সময় রেমব্রান্ট কী ধরনের সই করতেন, তাও ছবিতে রাখতে হয়েছে। এত করেও কিন্তু আমি জানি, ল্যাব অ্যানালিসিস ও এক্স-রে করলে ছবিটা যে নকল তা ধরা পড়বে। অবশ্য নকলটা যাতে ধরা পড়ে, সেভাবে ছবি তৈরি করতেই বলা হয়েছে আমাকে।
দূর থেকে রাইকারের ডিমের মতো মাথাটা দেখলাম আমি। রাস্তার উপর চেয়ার পাতা একটা রেস্তরাঁয় বসে রয়েছে। আমি পিঠের ব্যাগটাকে হাতে নিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। হাতের চিজ় স্যান্ডউইচটা নামিয়ে হলুদ দাঁত দেখিয়ে হাসল রাইকার, “এনেছ?”
আমি ব্যাগটা টেবিলে রেখে বললাম, “ঠিক করে গুনে নাও।”
“ধুর বোকা, তুমি বললেই হবে!” রাইকার ব্যাগটার উপর হাত বোলাল। তারপর পাশের লম্বা ঝোলা থেকে একটা গোল প্লাস্টিকের কেস বের করে বলল, “এই নাও, মাস্টার পিস অব রেমব্রান্ট।”
“রেমব্রান্ট? না তোমার?”
“আমি তো কপিয়ার মাত্র। নাও, দেখো ঠিক হয়েছে কিনা!”
“ঠিক না হলে তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে?” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি।
রাইকার থমকে এক মুহূর্ত। ও জানে ‘রেহাই’ দেওয়ার ব্যাপারে আমার সুনাম নেই খুব। ও জোর করে হাসল, “এবার সত্যিই তোমায় অ্যাডাম মনে হচ্ছে। এমন ছদ্মবেশ নিয়েছ যে, কারও বোঝার সাধ্যি নেই যে, তুমি আসলে কে!”
আমি কেসটা আড়াআড়ি করে পিঠে ঝুলিয়ে বললাম, “আর একটা ছোট্ট কাজ আছে, পারবে?”
রাইকার ওর স্যান্ডউইচ শেষ করে পেপার টাওয়েলে হাত মুছল। বলল, “তুমি বলো না, আই উইল ট্রাই।”
আমি ভণিতা না করে বললাম, “এই যে নকলটা আঁকলে, ঠিক এমনই আর-একটা নকল আঁকতে হবে তোমায়। তবে উইথ মর্ডান কালার্স। ছবিটা দেখতে একরকম হলেই হবে। আর বিশেষ কিছু ডিটেল দরকার নেই।”
“কেন? ওই হেয়ার লাইন ক্র্যাকগুলো বা পুরনো রং বা ক্যানভাস মেটিরিয়াল, দরকার নেই?”
“না, দরকার নেই। আর শোনো রাইকার, এই দ্বিতীয় জাল ছবিটার কথা যদি কেউ জানতে পারে, তা হলে অতলান্তিকের তলাতে লুকিয়েও পার পাবে না তুমি, বুঝেছ?”
রাইকার মাথা নাড়ল। বুঝেছে। ও বলল, “ওটা সাত দিনে পেয়ে যাবে তুমি। গিভ মি আ রিং অ্যারাউন্ড দ্যাট টাইম। ঠিক আছে, আমি আসি। ডোন্ট ওরি অ্যাডাম।” রাইকার টেবিলে স্যান্ডউইচের দাম রেখে ওর স্কুটারে চেপে বেরিয়ে গেল।
আমি আবার সাইকেলে উঠলাম। রাতের আমস্টারডাম আলোর গয়নায় সেজে উঠছে। যওডেনব্রিস্ট্রাটে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে একটা। দূরে রেমব্রান্ট মিউজ়িয়াম হাউজ় দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার পাশের রেমব্রান্ট কর্নার। বাড়ির এক পাশে বিশাল বড় সাইনবোর্ডে রেমব্রান্টের ছবি লাগানো। ছবির তলায় লেখা, তাঁর জন্মের ৪০০ বছর পূর্তি হবে এই ২০০৬ সালে। পৃথিবী বিখ্যাত এই ডাচ আর্টিস্ট এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের কিছু সেরা সময়। সেই বাড়ির সামনে তাঁরই আঁকা ছবির নকল হাতবদল হল আজ। আমি চোয়াল শক্ত করলাম। সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। আমার পিঠে ঝোলানো ছবিটা বদলে দেবে অনেকের ভাগ্য। আমারও কি? আচ্ছা, ভাগ্য বলে আদৌ কিছু হয়? নাম না জানা ছায়ার মতো মানুষ আমি। অন্ধকার জগতে রোজ নতুন করে ভাগ্য তৈরি করতে হয় আমায়। রাইকার আমায় অ্যাডাম বলে জানে, কেউ আমায় জানে অদম্য সেন বলে, আবার কেউ জানে… আমি সেন্ট অ্যান্টনিব্রিস্ট্রাটের রাস্তায় এগোলাম। আমার এই নতুন কাজের ফলে যে আমার ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে, তা আমি জানি। তাই সতর্ক হতে হবে আমায়। কোনও ব্যুহ রচনার আগে তা কেটে বেরোবার পথও জানতে হবে আমায়। আর ওই দ্বিতীয় নকল ছবিটা হবে আমার ব্যুহ কেটে বেরোবার চাবিকাঠি।
আমি প্যাডেলে চাপ দিলাম। সামনের কঠিন দিনগুলোর আগে আমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় গোটা ছকটা কষে ফেলা। এই কাজে একটু ভুল হওয়া মানেই মৃত্যু। তবুও নিজের বাঁচার জন্য, আমার ফান্ডিং-এ চলা চারটে অনাথাশ্রমের বাচ্চাদের বাঁচার জন্য, এরকম মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে আমায়।
॥ ২৬ জুন: প্রস্তুতির আড়ালে ॥
“সব প্ল্যান মতো এগোচ্ছে তো? আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি এরর। রিমেমবার, এর জন্য কিন্তু অনেক টাকা দেওয়া হবে তোমায়। সুতরাং, কাজ হওয়া চাই-ই,” কথা শেষ করে সুধীর বেদী হাতের স্লাইড মোবাইলটা শব্দ করে বন্ধ করল। তারপর মুখ তুলে বলল, “এবার মনীশ উপাধ্যায় বুঝবে যে, প্রেসিডেন্টের চেয়ারটা গদির নয়। ওর ভিতর দিয়ে কুড়ি হাজার ভোল্টের কারেন্ট যায়!”
অনুপ আইয়ার আধ ঘণ্টায় এই প্রথম কথা বলল, “যদি না হয় কাজটা? যদি গন্ডগোল হয়? মানে মনীশ যদি জেনে যায়?”
“সব সময় বাজে কথা বলো কেন?” সুধীর হলুদ তরল ভর্তি গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে মুখটা বিকৃত করল একটু। বলল, “আমার প্ল্যান ফুলপ্রুফ। মনীশ হ্যাজ় টু পে দ্য প্রাইস। মনে নেই, গত ফেব্রুয়ারির ইলেকশনে কীভাবে হারাল আমায়? সকলের সামনে প্রমাণ করল আমি নাকি টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চেয়েছি। সোয়াইন একটা! কিন্তু ও জানে না, আমায় কেউ মেরে বেরোতে পারে না। আর একটা ড্রিঙ্ক বানাও। টুডে আই উইল সেলিব্রেট দ্য ডাউনফল অব মনীশ উপাধ্যায়।”
অনুপ সামনের টেবিলে রাখা বোতল থেকে ড্রিঙ্ক বানাতে বানাতে দেখল, সোফার ব্যাকরেস্টে চিত করে মাথা রেখে ডান হাত দিয়ে সোফার হাতলে তাল ঠুকছে সুধীর। মানে, ফোনটা করার পর মেজাজ ঠিক আছে। সুধীরের খোশমেজাজে থাকার এটাই লক্ষণ। বহুদিন পরে ওকে এই অবস্থায় দেখল অনুপ। ফেব্রুয়ারির পর এই প্রথম। ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে এই জুনের শেষ, প্রায় পাঁচ মাস হল মনীশ উপাধ্যায় এই কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে সুধীর বেদীকে হারিয়ে।
কৃষ্টি হল ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস আর্ট ও কালচারাল সোসাইটি। হিমাচল প্রদেশের কোলে ছবির মতো এক উপত্যকায় কৃষ্টির ক্যাম্পাস। দারুণ লাইব্রেরির সঙ্গে, থিয়েটার হল, ফিল্ম কমপ্লেক্স, আর্ট গ্যালারি, রিসার্চ ল্যাব থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি আর্টিস্টদের জন্য হস্টেল, ডরমিটরি, সুইমিং পুল, কী নেই সেখানে! সারা পৃথিবীর নানা কোম্পানির স্পনসরশিপ পায় কৃষ্টি। ফলে এর প্রেসিডেন্ট পদটি যে লোভনীয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বছরখানেক ধরে সুধীর সব আঁটঘাট বেঁধেছিল এই প্রেসিডেন্টশিপের জন্য। কিন্তু মনীশ উপাধ্যায় একদম ক্লিন সুইপ করে বেরিয়ে যায়। উপরন্তু বোর্ডের সকলের সামনে প্রমাণ করে দেয় যে, সুধীর টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চেয়েছিল। তখন থেকে তক্কে তক্কে আছে সুধীর। মনীশ উপাধ্যায়কে ছাড়বে না ও। তাই এমন একটা প্ল্যান সাজিয়ে রেখেছে, যা কিনা সামনের ১৫ জুলাই শুধু প্রতিশোধই তুলবে না তার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ ডলারও তুলবে সুধীরের ঘরে।
সুধীর বেদী তিনটে জিনিস পছন্দ করে, হুইস্কি, টাকা আর ক্ষমতা। টাকা সুধীর বেদীর প্রচুর। নানা ধরনের ব্যবসায় প্রচুর টাকা খাটে ওর। তবু পিপাসা মেটে না। এই পিপাসায় যোগ হয়েছে ক্ষমতার লোভ। অনুপ, সুধীরের মুখ চোখ দেখে বোঝে যে, এই কৃষ্টির প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যা খুশি তাই করতে পারে লোকটা।
অনুপের টাকাও কম নেই। তবুও সুধীরের সঙ্গে মানসিকতায় পেরে ওঠে না ও। অমন অ্যাটাকিং লোকের সামনে চুপ করে থাকে তাই। আর সুধীর ওর সঙ্গে ব্যবহারও করে তেমন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সবসময়। যেন বোঝাতে চায়, অনুপের মতো একজন স্পাইনলেসকে ও-ই দয়া করে এনেছে এখানে। অনুপের নিজস্ব কোনও যোগ্যতা নেই। তাই অনুপ ভিতরে ভিতরে গুমরালেও সুধীরকে এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারেনি এখনও। তবে সুধীর মোটামুটি অনেক কিছুই বলে অনুপকে। এমনকী, ওর প্ল্যানটাও বলেছে। তবে প্ল্যানমাফিক কে কাজ করছে তা বলেনি। সুধীর নিজেও লোকটাকে দেখেনি। সে নাকি কখনও সামনে আসে না! কে জানে সুধীর সত্যি বলছে কিনা!
গ্লাসটা সুধীরের দিকে এগিয়ে দিল অনুপ। ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে দশটা। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ও উঠল। যাওয়ার আগে বলল, “সুধীরভাই, যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তুমি যা প্ল্যান করেছ তা ভয়ংকর। ধরা পড়লে…”
“তুম চুপহি রহো তো আচ্ছা হ্যায়। ভয় পেলে হবে? সেইজন্যই কোনওদিন কিছু হবে না তোমার। বাপ-ঠাকুরদার পয়সায় বড়লোক হয়ে লেজ নাড়বে শুধু। নেগেটিভ কথা না বলে এখন যাও। লেট মি এনজয় মাই ড্রিঙ্ক। যাও।”
‘বাপ ঠাকুরদার পয়সায় বড়লোক,’ কথাটা গায়ে লাগল অনুপের। সুধীর বেদী সবসময় কেন এমন করে খোঁচা মারে ওকে? অনুপকে নিচু করে কি নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চায় ও? বাইরে পোর্টিকোর নীচে রাখা কালো গাড়িতে গিয়ে বসল অনুপ। সুধীরের শেষ কথায় মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ওকে বড্ড বেশি আন্ডার এস্টিমেট করে সুধীর। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। আসলে অনুপ আইয়ার কে, তা বোঝানোর সময় এসেছে সুধীর বেদীকে। ও চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। মোবাইল বের করে নম্বর ডায়াল করল একটা। কানে লাগিয়ে বলল, “সব প্ল্যানমতো এগোচ্ছে তো?”
॥ ২৮ জুন : অনিশ্চয়তা ॥
“মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্পের কথা উঠলে যে ক’জন শিল্পীর নাম আমাদের আলোচনা করতেই হবে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রেমব্রান্ট। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই হল্যান্ডের লেডেন শহরে রেমব্রান্টের জন্ম। ওঁর পুরো নাম রেমব্রান্ট হারমেনস্জুন ভন রাইন। ওঁর বাবা ছিলেন শস্য পেষাই কলের মালিক, যাকে সাধারণত মিলার বলা হয়। বাড়ির অবস্থাও ভাল ছিল রেমব্রান্টের। লেডেনের লাতিন স্কুলে গ্রিক, অঙ্ক, ক্লাসিক্যাল লিটারেচার, ভূগোল ও ইতিহাস নিয়ে পড়া শেষ করে তিনি লেডেন ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞান নিয়ে ভরতি হন। কিন্তু ছবি আঁকার দিকে প্রবল ঝোঁকের ফলে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন মাঝপথে। প্রথমে জেকব ভ্যান সোয়ানেনবার্গ ও পরে পিয়েতর লাস্টম্যানের কাছে কাজ শেখেন তিনি। এই পিয়েতর লাস্টম্যানের প্রভাব রেমব্রান্টের আঁকার জীবনে সুদূরপ্রসারী। এঁর কাছে কাজ শেখার সময়েই রেমব্রান্ট রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলা সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং প্রভাবিতও হন।”
অধ্যাপক গোকুল মিশ্র এবার থামলেন। টেবিল থেকে গেলাস তুলে জল খেলেন একটু। তারপর ঝুলে-পড়া কাঁচা-পাকা গোঁফের ফাঁক দিয়ে হাসলেন। বললেন, “এই ২০০৬ সালে বসে ১৬০৬ সালে জন্মানো একজনের কথা শুনে তোমরা বোর হচ্ছ না তো?”
নীল দেখল সারা ক্লাস সমস্বরে জানাল যে, তারা বোর হচ্ছে না। ভাল লাগল ওর। এই তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেমেয়েদের দেখলে ওর আবার এই বয়সে ফিরে যাওয়ার লোভ হয়। সিমলার একটা স্কুল থেকে এরা ‘কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটি’ দেখতে এসেছে। এ বছর, অর্থাৎ এই ২০০৬ হল রেমব্রান্টের জন্মের চারশো বছর। সেই উপলক্ষে ১৫ জুলাই রেমব্রান্টের জন্মদিনে আর্ট এগজ়িবিশন ও মেলা হবে এখানে। কৃষ্টির এই আর্ট ডিপার্টমেন্টে তারই প্রস্তুতি চলছে। অধ্যাপক গোকুল মিশ্র খুবই ব্যস্ত সেই নিয়ে। তবুও তারই ভিতর রেমব্রান্ট নিয়ে ছোটদের সামনে দু’-চার কথা বলার সময় বের করেছেন উনি।
গোকুল মিশ্র আবার শুরু করলেন, “তারপর ১৬২৫ সালে রেমব্রান্ট লেডেনে ফিরে নিজের স্টুডিয়ো খুলে কাজ শুরু করেন। ক্রমশ তাঁর নাম লোকে পোট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে জানতে শুরু করে। তাঁর নানা ছবির মধ্যে ‘দি অ্যানাটমিক্যাল লেকচারার’, ‘দ্য জিউস ব্রাইড,’ ‘দ্য নাইট ওয়াচ’, কিছু সেল্ফ পোট্রেট, ‘টাইটাস অ্যাট হিজ় ডেস্ক’ বিখ্যাত। সম্প্রতি গোয়া থেকেও রেমব্রান্টের আঁকা টাইটাসের আর-একটা ছবি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যা এই কৃষ্টিতে রেস্টোর করার কাজ চলছে। এই টাইটাস হল রেমব্রান্ট ও তাঁর স্ত্রী সাসকিয়ার পুত্র। টাইটাসের জন্মের পরের বছর সাসকিয়ার মৃত্যু হয়। আর সাতাশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় টাইটাসের। শেষ বয়সে কপর্দকশূন্য হয়ে অবহেলায় মৃত্যু হয় রেমব্রান্টেরও। তবে তিনি মারা গেলেও তাঁর ছবিগুলোর মৃত্যু ঘটেনি। পিকাসোকে পর্যন্ত তাঁর ছবি প্রভাবিত করেছিল। আলো-ছায়ার খেলায় তাঁর ছবিগুলো আজও শ্রেষ্ঠ শিল্পের মর্যাদা পায়। আমি খুব সংক্ষেপে রেমব্রান্ট সম্বন্ধে তোমাদের বললাম। এবার কিছু জানার থাকলে তোমরা আমায় প্রশ্ন করতে পারো,” গোকুল মিশ্র থামলেন।
নীল বসল না আর। অডিটোরিয়ামের শেষ বেঞ্চ থেকে উঠে বেরিয়ে এল চওড়া করিডরে। তবে সেটুকু সময়ের মধ্যেই শুনল একটা ছেলে জানতে চাইছে, “এই রেমব্রান্টের এক-একটা ছবির দাম কত হবে স্যার?”
হাসি পেল নীলের। এরাও এই বয়সে এখন টাকাপয়সার ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছে। ও ঘড়ি দেখল। বিকেল সাড়ে তিনটে বাজে। সন্ধে সাতটার আগে গোকুল মিশ্র সময় দিতে পারবেন না। তাই এই সুযোগে হস্টেলে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে।
নীল করিডর থেকে মাঠে নামার সিঁড়িতে পা দিতে গিয়েও থমকে গেল। সেই সুন্দরমতো মেয়েটা হাত তুলে ওকে দাঁড়াতে বলছে। নীল দাঁড়াল। এমন হাতছানি এড়ানো উচিত নয়। নীল এখানে এসেছে চারদিন হল। তার মধ্যে এই মেয়েটাই চোখে পড়েছে প্রথমে। এত সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে চোখে না পড়ে যে উপায় নেই! এমন টানাটানা চোখ-নাক কি মিকেল এঞ্জেলো নিজে তৈরি করেছেন? তবে আলাপ করার সুযোগ হয়নি এখনও। বোধহয় এবার হবে। মেয়েটা এদিকেই আসছে।
শুধু মেয়েটা নয়, এল আরও তিনজন। এদের মুখ চেনা। হস্টেলে আর এই ক্যাম্পাসেও এদের দেখেছি। কিন্তু পরিচয় হয়নি।
মেয়েটা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল নীলের দিকে, “হাই, আয়্যাম কুমুদ্বতী বিসারিয়া।”
“নীল, আই মিন নীলাম্বর দে।”
“বেঙ্গলি?” হাসল কুমু।
“হ্যাঁ,” নীল এবার প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকাল বাকিদের দিকে।
কুমুই পরিচয় করিয়ে দিল। প্যাট্রিক জফ, ইতালি থেকে এসেছে। পূরব ঝা এসেছে বিহার থেকে আর হিরণ্য কারলেকের এসেছে মহারাষ্ট্র থেকে। কুমুদ্বতী নিজে রাজস্থানের মেয়ে। এক মাসের জন্য ওরা সকলে এসেছে এই কৃষ্টিতে আর্টের ওপর একটা ওয়ার্কশপে।
কুমু প্রশ্ন করল, “তুমি তো প্রোফেসর গোকুল মিশ্রর জীবনী লেখার কাজ করছ, না?”
নীল মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ওঁর উপর অনেক আগেই এমন বই লেখা দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে বোধহয় গুণীদের কদর হয় না।”
“তা কেন? তুমি তো লিখছ,” এবার পূরব কথা বলল।
“এত অল্প বয়সে হঠাৎ এমন জীবনী লেখার মতো বোরিং কাজ করছ?” বলেই ছোট্ট করে জিভ কাটল কুমু। বলল, “আই অ্যাম জাস্ট জোকিং!”
নীল হাসল। ভারী হাসিখুশি মেয়ে তো! তবে এত অল্প বয়স কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। ছাব্বিশ বছরটা খুব একটা কচি বয়স নয়।
প্যাট্রিক বলল, “তোমায় তো হস্টেলে দেখেছি আমি। তা ক’দিনের জন্য এসেছ? মানে জীবনী লেখার জন্য ইনফো পেতে আর কতদিন লাগবে বলে মনে হয়?”
“প্রোফেসর মিশ্র তো তেমনভাবে সময়ই দিতে পারছেন না। ১৫ জুলাই না গেলে কিচ্ছু বলা যাবে না,” নীল বলল।
হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ শুনে নীল পিছনে ঘুরল। একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে নীল ফুলশার্ট আর সাদা প্যান্ট। পাট করে আঁচড়ানো চুল। আর এই ছায়াচ্ছন্ন করিডরেও চোখে সানগ্লাস পরে রয়েছে। লোকটা কোনও ভণিতা না করে নীলকে বলল, “এই যে মিস্টার, তুমি তোমার নাম আর হোয়্যার অ্যাবাউটস আমাদের সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে লিখিয়েছ?”
“মানে?” ঘাবড়ে গেল নীল।
“তুমি জানো না যে, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে কেউ যদি এখানে আসে, তার ডিটেল আমাদের রাখতে বলা হয়েছে? যাও, এখনই সাউথ গেটে আমাদের অফিসে গিয়ে নাম-ধাম লিখে এসো,” কথা শেষ করে লোকটা এবার কুমুর দিকে তাকাল। চোখ কালো কাচের আড়ালে থাকলেও ঠোঁটের ভঙ্গিটার মধ্যে একটা অসভ্যতা টের পেল নীল। আচ্ছা বদ লোক তো!
লোকটা এবার বলল, “আর তোমরা? পিকাসো রসেটিরা? নাম, গোত্র সব লিখেছ তো?”
প্যাট্রিক বলল, “লিখেছি, তবে এর দরকারটা বুঝতে পারছি না। আমরা তো আর্টিস্ট ওয়ার্কশপে এসেছি। তার জন্য এমন প্রসিডিয়োর কেন?”
“আর্টিস্ট?” লোকটা মুখ বাঁকাল, “গত চার মাসে সিডনি, আমস্টারডাম, প্যারিস আর নিউ ইয়র্ক থেকে রেনোয়া, মোনে, গগ্যাঁ আর ক্লিমট চুরি গিয়েছে। এখানেও রেমব্রান্টের অপ্রকাশিত ছবি রয়েছে। চোরেরা যে ছোঁক ছোঁক করছে! তাই সব নামধাম দরকার, বুঝেছ? আর তা ছাড়া এই করিডরটা তো কফিশপ নয়, যে আড্ডা দেবে। যাও তোমরা এখন, ডিসপারস,” লোকটা চলে যাওয়ার আগে আর একবার কুমুকে মাপল।
দূরে কালো কাচে ঢাকা নীলের ছোট্ট গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ও বলল, “এভাবে কথা বলছেন কেন ভদ্রলোক? কী নাম এঁর?”
“ভদ্রলোক? হুঁঃ, ছোটলোক,” কুমুর গলায় রাগ, “এর নাম তমোনাশ রয়। এখানকার সিকিয়োরিটি চিফ। অসভ্য, ইতর একটা। এমন করে কথা বলছে যেন আমরা সব চোর। মুডটাই অফ করে দিল।”
নীল গাড়ির সামনে পৌঁছে দরজা খুলে বলল, “তোমরা হস্টেলে গেলে আমি তোমাদের লিফট দিতে পারি।”
প্যাট্রিক বলল, “না, আমাদের একটা সেশন আছে। সেখানেই যাচ্ছিলাম। তুমি গোকুল মিশ্রর জীবনী লিখছ বলে আলাপ করতে এলাম। আচ্ছা, আসি। কেমন?”
নীল গাড়িতে বসে কালো কাচ তুলতে যাবে এমন সময় হিরণ্য এই প্রথম গাড়ির জানলায় ঝুঁকে বলল, “নামটা কিন্তু লিখিয়ে দেবে সিকিয়োরিটি রেজিস্টারে। রেমব্রান্টের ছবি ডিসপ্লে করা হবে ১৫ জুলাই। তার আগে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার দাম এই ছবিটার। তমোনাশ রয়ের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে কিন্তু এই হিমাচলের উপত্যকাতেও মধুর লোভে মৌমাছি এসে জুটবে। আগাম সতর্কতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। হয়তো ছবিচোর ইতিমধ্যেই এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে।”
॥ ১ জুলাই : অপেক্ষা ॥
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা বাটির মতো উপত্যকায় কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটির ক্যাম্পাসটা এখান থেকে থার্মোকলের তৈরি মনে হচ্ছে! এখন বর্ষাকাল, তবুও বিশেষ বৃষ্টি হচ্ছে না। পরিষ্কার নীল আকাশ জুড়ে সাদা মেঘ ছুঁয়ে রয়েছে পাহাড়ের মাথা। এমন সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার হঠাৎ ফাদার ফ্রান্সিসের কথা মনে পড়ল। বহুদিন দেখা হয়নি ফাদারের সঙ্গে। আমি সময়ে সময়ে শুধু ওঁর অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা জমা দিই। তবে উনি বারণ করেন। বলেন, “দরকার নেই আমার। এই ছোট্ট পাহাড়ে মানুষের সাহায্যে ঠিক চলে যায় আমাদের।” কিন্তু ওঁর আশ্রম ছাড়াও আরও অন্য অনাথাশ্রমকেও টাকা দিই আমি। তাই সেখানকার শিশুদের সুস্থভাবে বাঁচার জন্য চাই টাকা। অনেক টাকা।
আর এই টাকা, ওই দূরে থার্মোকলের মতো দেখতে বাড়িটার মধ্যে থাকা একটা ছবি আমায় দেবে! রাইকারের এঁকে দেওয়া দুটো ছবিই সযত্নে রেখে দিয়েছি আমি। আর সময় হলে…
মার্চ মাসের প্রথমে এস বি-র ফোনটা পাওয়ায় আমি অবাক হইনি। নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজের বিনিময়ে আমি মোটা টাকা নিই। তবে আমি কখনও ক্লায়েন্টদের সামনে যাই না। ফোনে কথা সেরে বলি যে, কাজ হয়ে গেলে আমার অ্যাকাউন্টে টাকাটা জমা দিয়ে দিতে অথবা অন্য কোনও জায়গা থেকে টাকাটা তুলে নিই আমি। অন্যান্যদের মতো এস বি-ও প্রথমে দেখা করতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে। আমি আমল না দিয়ে বলেছিলাম, আপনি ফোনেই বলুন।
উনি বলেছিলেন, “আমার জরুরি একটা কাজ করে দিতে হবে আপনাকে। কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটিতে ১৫ জুলাই রেমব্রান্টের একটা অপ্রকাশিত ছবি প্রকাশিত হবে। তার আগে সেটার রেস্টোরেশনের কাজ চলবে। রেস্টোরেশন শেষ হবে ৯ জুলাই আর প্রদর্শনী ১৫ জুলাই। ঠিক এর মাঝের দিনগুলোর মধ্যেই ওই ছবিটা আপনাকে লুকিয়ে বের করে আনতে হবে। আর তার পরিবর্তে প্ল্যান্ট করতে হবে একটা হুবহু নকল ছবি। ছবিটা এমনভাবে করাবেন, যাতে খুঁটিয়ে ল্যাব টেস্ট করলেই একমাত্র বোঝা যাবে যে, সেটা আসলে নকল। পারবেন?”
না পারার মতো কিছু নেই। ইমপসিবল ইজ় নাথিং।
এস বি বলেছিল, “আমি আপনাকে ছবিটার বড় দুটো ফোটোগ্রাফিক প্রিন্ট পাঠাব। সেটা দেখে আঁকা সম্ভব হবে নিশ্চয়ই? আচ্ছা, কীভাবে পাঠাব? আপনি তো দেখা করবেন না।” রাইকারের ঠিকানায় ছবিগুলো পাঠাতে বলেছিলাম আমি। তারপর বলেছিলাম, “এর জন্য আমি পঁচাত্তর হাজার ডলার নেব।”
“ডান। তবে পুরোটাই কাজের পরে দেব, আগে নয়। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি তো?”
বিশ্বাসভঙ্গের কাজ আমি মাত্র একবার করেছি। তাও নিরীহ মানুষদের বোমার হাত থেকে বাঁচিয়ে! কিন্তু এ তো নিরীহ চুরি। কোনও প্রাণনাশের আশঙ্কা নেই। আমি বলেছিলাম, “বিশ্বাস করতে পারেন, যদি আপনি নিজে অবিশ্বাসের কোনও কাজ না করেন।”
সেই ডিলের ফলশ্রুতি এই ছবি। রেমব্রান্টের আঁকা তাঁর ছেলে টাইটাসের ছবির নকল। রাইকার এঁকে দেওয়ার পর ইয়োরোপের চারজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চেক করিয়েছি নকল ছবিটাকে। তারা বলেছে, এত দুর্দান্ত নকল তারাও কোনওদিন দেখেনি! এখন শুধু অপেক্ষা। গোয়া থেকে খুঁজে পাওয়া রেমব্রান্টের ছবিটার সংস্কারের অপেক্ষা। কৃষ্টি ফাউন্ডেশনে সেই সংস্কারের কাজ শেষ হলেই আমি নেমে পড়ব কাজে। কাজ, আমার জন্য, ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য।
পাহাড়ি নদীর উপর পুরনো ইটের লাভার্স ব্রিজ পেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম আমি। কৃষ্টিতে ফিরতে হবে আমায়।
॥ ৫ জুলাই : প্রতিক্রিয়া ॥
মুখ, চোখ এখনও লাল হয়ে আছে সুধীর বেদীর। মনে হচ্ছে, কেউ যেন মাথার ভিতরে বসে আগুন জ্বালাচ্ছে। যে-কোনও মুহূর্তে মাথাটা ফেটে যেতে পারে। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘড়িটা দেখল ও। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে। ওর এক জায়গায় ডিনারের নেমন্তন্ন রয়েছে। কিন্তু মনটা এমন টক হয়ে আছে যে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। সকলের সামনে মনীশ উপাধ্যায় এমন করে বলতে পারল?
সুধীর জানতে চেয়েছিল, “এই যে রেমব্রান্টের চারশো বছর উপলক্ষে তাঁর অপ্রকাশিত ছবি উন্মোচন করার পরিকল্পনা করেছেন, তার জন্য উপযুক্ত সিকিয়োরিটির ব্যবস্থা করেছেন তো?”
“মানে?” ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল মনীশ, “আপনি এমন প্রশ্ন করছেন কেন?”
“জানেন না, গত বছরখানেকের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা মূল্যবান ছবি চুরি হয়েছে? তাই জানতে চাইছি, এখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেমন?”
“তমোনাশ রয়েছে। হি ইজ় ভেরি গুড ইন সিকিয়োরিটি ম্যাটার্স।”
“তমোনাশ রয়? ওই হামবাগ, খিটখিটে লোকটা? মিস্টার উপাধ্যায়, রেমব্রান্টের ছবিটা এখান থেকে চুরি হলে কিন্তু কৃষ্টির ভীষণ বদনাম হবে। আপনার তো দায়িত্ব আছে একটা।”
“প্লিজ়, আমাকে আমার দায়িত্ব শেখাবেন না। ‘দায়িত্ব’ কথাটা আপনার মুখে মানায় না। আমার সিকিয়োরিটি যথেষ্ট টাইট।”
এবার সুধীর রেগে উঠেছিল, “আপনি আমায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন কেন? আর শুধুমাত্র তমোনাশ রয়ের উপর ভরসা করছেন? আপনি বোঝেন রেমব্রান্টের আঁকা ছবির গুরুত্ব?”
“শাট আপ,” মনীশ উপাধ্যায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, “রেমব্রান্টের ছবিটা যেখানে রাখা হবে সেই গ্র্যান্ড গ্যালারি ছ’তলায়। বাইরে থেকে হেভিলি গার্ডেড। রাতে সব দরজা বন্ধ থাকে। ওর একদিকের কাচের দেওয়ালটা লেজার-রে দিয়ে স্ক্রিন করা। তা ছাড়া একজন ইন্টারপোল থেকে এখানে আছে। বাট অবভিয়াসলি ইন ডিসগাইস।”
“ইন্টারপোল? হঠাৎ?” মনে মনে সতর্ক হয়ে উঠেছিল সুধীর। ওর প্ল্যানে তো ইন্টারপোল নামক কাঁটাটা ছিল না।
“প্যাট্রিক জফ। ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করতে এসেছে। আসলে অপ্রকাশিত এই রেমব্রান্ট মানুষের কৌতূহল বাড়াচ্ছে। ইন্টারপোলের কাছে খবরও আছে যে, ছবিটা নাকি টার্গেট হতে পারে। হল্যান্ডে একজন আর্ট ফরজার ধরা পড়েছে। তার থেকে নাকি পুলিশ জানতে পেরেছে এই ছবিটাও চোরদের টার্গেটে আছে। তাই তারা জফকে পাঠিয়েছে। তবে ব্যাপারটা কেউ জানে না। আর মনে রাখবেন, কথাটা কৃষ্টির ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের মধ্যেই যেন থাকে। বুঝেছেন?”
সুধীর বলেছিল, “এমন করে বলছেন কেন? আমরা কাকে বলব? কৃষ্টির ভালটা আমাদেরও মাথায় আছে। তা ছাড়া আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কি সন্দেহ আছে আপনার।”
“বিশ্বাস? আপনাকে? মনে নেই, আগের ইলেকশনে কী করেছিলেন? তারপরও কোন মুখে এসব কথা বলছেন আপনি? এই ম্যানেজিং কমিটির রুলিং গ্রুপ আর অপোজ়িশনের মধ্যে যাতে স্বচ্ছতা থাকে, তাই এই খবরটা দিলাম আমি। না হলে দিতাম না। আমার শরীরে তো আর চোরের রক্ত নেই, যে লুকিয়ে সব করব।”
চোর! মানে? সকলের সামনে ওকে চোর বলা? মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছে সুধীর বেদীর। মাথায় আগুন জ্বলছে। বড্ড বাড় বেড়েছে মনীশের। এমন টাইট দেবে যে, জীবনে আর মাথা তুলতে হবে না।
গাড়িতে বসে পকেট থেকে একটা ওষুধ বের করে জিভের তলায় রাখল সুধীর। হার্ট বেশি চাপ সহ্য করতে পারে না আজকাল। এই ওষুধ আর পিস্তল সুধীরের নিত্যসঙ্গী। গাড়ির সামনের সিটে ওর একজন বডিগার্ড থাকলেও একটা ছোট অটোম্যাটিক পিস্তল সবসময় সঙ্গে রাখে ও। রোজগার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুও যে বাড়ে! তবে প্যাট্রিক জফ একটা অশনি সংকেত! ওর প্ল্যান ভন্ডুল হওয়ার একটা চান্স থেকে যাচ্ছে। অদম্য সেন নামে ছবি বদলের জন্য যাকে নিয়োগ করেছে সুধীর, ক্রাইম দুনিয়ায় তার প্রচুর নাম। কিন্তু তা হলেও পঁচাত্তর হাজার ডলার চেয়ে একটু বাড়াবাড়িই করেছে লোকটা। সুধীরের অন্য একটা ভাবনা রয়েছে। তাই সুধীর একটা ব্যাকআপও রেখেছে। সিজ়ার। ঠান্ডা মাথায় রক্তপাত ঘটাতে তার মতো পারদর্শী কেউ নেই। ছায়ার মতো কাজ করে দৈত্যর মতো চেহারার লোকটা। এর আগেও ব্যাবসার নানা ক্ষেত্রে তাকে কাজে লাগিয়েছে সুধীর। ইন্টারপোলের লোকজন খুবই দক্ষ হয়, তাই চান্স নেওয়া যাবে না। কিন্তু জফকে একেবারে প্রাণে মেরে দেওয়াও সম্ভব নয়। তা হলে সমস্যা বাড়বে আরও। তাই শুধু জখম করে সরিয়ে দিতে হবে। আর জখমটাও এমনভাবে করতে হবে, যাতে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট। তারপর দেখা যাবে মনীশের দৌড়।
চোর? আমি চোর? চোয়াল শক্ত করল সুধীর বেদী। মনীশ উপাধ্যায়, তুমি দেখো কীভাবে সকলের সামনে তোমায় চোর প্রতিপন্ন করব আমি। ১৫ জুলাই রেমব্রান্টের আঁকা ছবি দেখে পাবলিকলি আপত্তি তুলব আমি। বলব, আসল রেমব্রান্ট সরিয়ে তুমি হুবহু নকল পেন্টিং রেখেছ যাতে লোকে ধরতে না পারে। ছবির ল্যাব টেস্ট করলে ধরাও পড়বে সেই সত্য। সকলে থুতু দেবে মনীশের গায়ে। সকলের সামনে চোখের জল ফেলতে হবে। কিন্তু তার আগে প্যাট্রিক জফের বন্দোবস্ত করতে হবে। পকেট থেকে ফোনটা বের করল সুধীর।
॥ ৬ জুলাই : ডিনারের পরে ॥
“কিয়ারোসকিউরো,” কফির কাপটা দু’হাতে চেপে ধরে বলল কুমু।
নীল দেখল হিরণ্য ছাড়া বাকিরা সকলেই হাসছে। সেমিনার হলের পাশের এই জায়গাটায় কয়েকটা কংক্রিটের স্ল্যাব এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। নীলরা সকলে সেখানেই বসে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হিমাচলের এই পাহাড়ি অঞ্চল এমনিতেই ঠান্ডা। আজ আবার বৃষ্টি হয়েছে, তাই ঠান্ডাটা ভালই পড়েছে। ক্যান্টিন থেকে রাতের খাবার সেরে এই ঠান্ডাটাই উপভোগ করতে সেমিনার হলের পাশে এসে বসেছে ওরা। একটু আগে ক্যান্টিনের একজন এসে এখানেই কফি দিয়ে গিয়েছে ওদের। এই ক’দিনেই নীলের সঙ্গে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে কুমু, প্যাট্রিক আর পূরবের। তবে হিরণ্য একটু আলগোছে থাকে। আজ কথা হচ্ছে ১৫ জুলাই রেমব্রান্টের আঁকা ছবির উন্মোচন নিয়ে। সেই আলোচনার জের টেনেই কুমু বলল, “কিয়ারোসকিউরো।”
নীল হাসল। কুমু কী ভেবেছে, ও এই শব্দের মানে জানে না? ও বলল, “প্যাট্রিক হয়তো ভাল বলতে পারবে এর মানে। ওর দেশের কথা থেকেই তো শব্দটা এসেছে।”
প্যাট্রিক বলল, “ঠিক। ‘কিয়ারোসকিউরো’ শব্দটি ইতালীয়। মানে, ক্লিয়ার-ডার্ক। বা আলো-ছায়াও বলা যেতে পারে। রেমব্রান্টের ছবিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ‘আলো’-কে ছবির চরিত্র করে তোলাটা রেমব্রান্টেরই নৈপুণ্য। কী অসাধারণ তাঁর আলো-ছায়ার কেরামতি। যেন আমাদের জীবনের প্রতিফলন।”
পূরব বলল, “এই ছবিটাতেও সেই আলো-ছায়ার খেলা রয়েছে।”
“তোমরা দেখেছ?” নীল উত্সাহিত হল।
“হ্যাঁ, গোকুলস্যারের সঙ্গে আমাদের দরকার ছিল বলে ল্যাবে গিয়েছিলাম। জানোই তো, ওখানে ছবিটার উপর থেকে বহুকালের জমা ধুলো সরিয়ে তাকে রেস্টোর করা হচ্ছে। সেখানেই ছবিটাকে দেখলাম আমরা,” কুমুর গলায় তৃপ্তি। কফিটা শেষ করে একটু দূরে রাখা ট্র্যাশে ও টুপ করে ছুড়ে মারল কাপটা। নিখুঁত টিপ। ও বলল, “চার-পাঁচজন মিলে কাজ করছিল। তবে স্যার বেশিক্ষণ থাকতে দেননি।”
“লাকি পিপ্ল,” হাসল নীল, “আমি এখনও দেখতে পাইনি ছবিটা। আরে প্রোফেসর মিশ্রকে যখন ইন্টারভিউ করার সময় পাই, উনি হয় ওঁর চেম্বারে থাকেন, নয়তো লাইব্রেরিতে থাকেন। তবে রিকোয়েস্ট করেছিলাম ছবিটা দেখার। বললেন, সময়মতো দেখার সুযোগ পাবে। তোমরা সত্যিই লাকি।”
প্যাট্রিক বলল, “উনি যে সাবধান হবেন সেটা তো স্বাভাবিক। রেমব্রান্টের যে-কোনও ছবির দামই আকাশছোঁয়া। এটারও নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে।”
“তবে দাম দিয়েই কি আর সবকিছুর মূল্যায়ন হয়?” হিরণ্য আচমকা বলল কথাটা।
“ঠিক। কিন্তু সেটা ক’জন বোঝে। পৃথিবীতে কিছু ধনকুবের আছে, যারা পারলে সব ছবি কিনে নিজেদের বাড়ির বৈঠকখানায় টাঙিয়ে রাখে। এতে যে কী লাভ হয়! সেখানে তো নিজে আর বাড়ির কাজের লোকজন ছাড়া বিশেষ কেউ দেখতেও পায় না,” কুমু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সেমিনার হলের বাইরের অল্প আলোয় নীল দেখল ঠান্ডা হাওয়ায় একটা ধোঁয়া পাক খেল কুমুর সামনে। ছুরি দিয়ে কেটে বের করা পাতলা নাকটা একটু লাল হয়ে আছে কি?
প্যাট্রিক হাসল, “এসব হল ইনভেস্টমেন্ট। ভবিষ্যতে টাকায় টান পড়লে সেগুলো বিক্রি করে তারা। তবে এই ছবিটা কিন্তু দারুণ। ছেলে টাইটাসের একটা ছবি, ‘টাইটাস অ্যাট দ্য ডেস্ক’, রটারডাম মিউজ়িয়ামে আছে। ৭৭ সেন্টিমিটার লম্বা, ৬৩ সেন্টিমিটার চওড়া। ১৬৫৫ সালে আঁকা। এখানের এই ছবিটা কিন্তু তারও কয়েক বছর পরের। বোধহয় ১৬৫৮ সালের। তবে মাপটা এক। টাইটাস এখানে উদাস হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। জানলা দিয়ে নিসর্গও দেখা যাচ্ছে। এমন একটা ছবি যে কীভাবে গোয়ায় এল! তবে একটাই বাঁচোয়া, ছবির রং এতদিনের ধুলোয় চাপা পড়েছে শুধু। আর কোনও সমস্যা নেই। রেস্টোরেশনের পর ফাটাফাটি দেখতে লাগবে।”
পূরব বলল, “সত্যি, রেমব্রান্টের ছবি দেখলে আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”
“সে তুমি সজারু হতেই পারো! কিন্তু আর একদম এখানে বসে থাকা যাবে না। রেমব্রান্ট নিয়ে অনেক বাতেলা হয়েছে। এবার হস্টেলে যাও।” পিছন থেকে আচমকা তমোনাশের গলা পেয়ে চমকে গেল সকলে।
“কেন?” তমোনাশের রুক্ষ স্বরের পালটা জবাবে কুমুও রুক্ষ গলায় বলল।
“আমি বলছি তাই। ওঠো তোমরা!” তমোনাশ আরও এগিয়ে এল।
নীল বুঝল, কথায় কথা বাড়বে। ও বলল, “ঠিক আছে। আমরা যাচ্ছি।”
“শোনো, ফারদার এখানে কেউ ঘোরাঘুরি করবে না এই সময়ে,” তমোনাশ কড়া গলায় বলল।
কুমু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পূরব বাধা দিল। বলল, “চল, লেটস গো ব্যাক।”
নীলদের উঠতে দেখে তমোনাশ আর দাঁড়াল না। কুমুর দিকে অভদ্রভাবে তাকিয়ে সেমিনার হলের সামনে দিয়ে মেন বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে গেল।
কুমু বলল, “লোকটা ভীষণ রুড। সুযোগ পেলে এমন দেব না, বুঝবে! এই কৃষ্টির ক্যাম্পাস কি ওর বাপের? আমরা এখানে ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করতে এসেছি। আর একটা ন্যূনতম বয়সও হয়েছে আমাদের। ও কেন এমন ব্যবহার করবে? আই উইল কমপ্লেন এগেন্সট হিম।”
“ছাড় না,” পূরব বলল।
এখান থেকে হস্টেলটা হেঁটে পাঁচ মিনিট। রাস্তার পাশে পাশে গাছ আর ঝিমধরা সোডিয়াম ভেপার লাগানো এক অদ্ভুত আলো-ছায়া তৈরি হয়েছে চারদিকে। আর এর মধ্যে ওই মেন বিল্ডিং-এ একটু-একটু করে জেগে উঠছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এক ছবি। আলোর ছবি, অন্ধকারের ছবি। বাবার আঁকা তাঁর সন্তানের ছবি। চারদিক বড় নিস্তব্ধ মনে হল নীলের। তমোনাশ এসে সুর কেটে দিয়েছে আড্ডার। সকলে চুপচাপ হাঁটছে। নুড়ির উপর জুতোর শব্দ গড়িয়ে পড়ছে রাতের ঢাল বেয়ে। হঠাৎ প্যাট্রিক বলল, “এই রে, আমি মোবাইলটা ফেলে এসেছি ক্যান্টিনে।”
“ক্যান্টিনে?” হিরণ্য অবাক হল।
“তোমরা এগোও, আমি আসছি।” প্যাট্রিক ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল।
“মোবাইল ফেলে এসেছে?” পূরব অবাক হয়ে তাকাল।
“চল,” হস্টেলের দিকে এগোবার আগে নীল একবার পিছনে ফিরল। আর দেখল, হিরণ্য প্যাট্রিকের চলে যাওয়া পথের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে।
॥ ৬ জুলাই : মধ্যরাতের পাহাড়ে ॥
সুচটা কাগজে মুড়ে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটার সঙ্গে কার্গো প্যান্টের হাঁটুর পাশের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সিজ়ার। অন্ধকারে মাটিতে শোয়ানো শরীরটার দিকে দেখল একবার। নিথর। মেরুদণ্ডের ঠিক জায়গায় ইঞ্জেকশনটা দিয়েছে। মানুষ থেকে জড়পদার্থে পরিণত হয়েছে শরীরটা। ঘাড়ে আচমকা মেরে অজ্ঞান করে পাহাড়ের মাথায় শরীরটাকে বয়ে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে সিজ়ারকে। কিন্তু ওভাবে আর নীচে নামতে হবে না। পা দিয়ে শরীরটাকে ধাক্কা দিল সিজ়ার। পাথর খসিয়ে ছোট ছোট গাছপালা ভেঙে শরীরটা তলিয়ে গেল খাদের অন্ধকারে।
॥ ৭ জুলাই : কফিশপে ॥
আজ মেঘ করে আছে খুব। উপত্যকা থমথম করছে। বৃষ্টি নামবে যে-কোনও সময়ে। কফিশপের জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়গুলোকে অদ্ভুত মায়াময় লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই ওগুলো পাহাড় তো, নাকি মেঘ? এই থমথমে আকাশ যেন কৃষ্টির পরিবেশকেই রিফ্লেক্ট করছে। কী করে যে এমনটা হল, এখনও বুঝতে পারছে না নীল। গতকাল রাতে যখন মোবাইল আনতে প্যাট্রিক ক্যান্টিনের দিকে গিয়েছিল তখন কি বুঝতে পেরেছিল এমনটা ঘটবে? রাতে প্যাট্রিক ফিরেছিল কিনা, সেটা আর খোঁজ করেনি কেউ। সকালে কৃষ্টির ওয়ার্কশপে আসা কিছু ছেলেমেয়ে পাহাড়ের খাদে একটা বড় গাছের গোড়ায় প্যাট্রিকের শরীরটাকে আটকে থাকতে দেখেছিল! কৃষ্টির ক্যাম্পাসে খবরটা ছড়াতে সময় লাগেনি একদম। আধঘণ্টার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে প্যাট্রিককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সিমলায়। শুনছে, এরপর দিল্লিতে পাঠানো হবে ওকে। প্যাট্রিককে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময়ে দেখেছিল নীল। মাথার বাঁদিকটা থেঁতলে গিয়েছে। কলারবোন যেভাবে উঁচু হয়ে আছে, তাতে নিশ্চিত যে সেটা ভেঙেছে। এ ছাড়া পায়ের অবস্থাও শোচনীয়। কীভাবে এমন মারাত্মক জখম হল প্যাট্রিক? ও তো যাচ্ছিল ক্যান্টিনে! সেখান থেকে পাহাড়ে গেল কেন ও?
পুলিশ এসে ঘুরে গিয়েছে ক্যাম্পাস থেকে তবে তারা ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্ট বলেই প্রমাণ করতে চাইছে। কারণ, যদি কোনও ক্রিমিনাল কেস তৈরি হয়, তা হলে জল অনেকদূর গড়াবে। প্যাট্রিকের দেশের হাইকমিশন ব্যাপারটা ছাড়বে না সহজে। তাই পুলিশ সেফ গেম খেলে বলে দিয়েছে, অ্যাক্সিডেন্ট। তবে তমোনাশ রয় কিন্তু ছাড়েনি। এখন সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসে। তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, এর পিছনে অন্য গল্প আছে।
“তমোনাশ তোমায় ধরেছিল?”
কুমুর প্রশ্নে মুখ ফেরাল নীল। সকাল থেকে নানা ঝড়-ঝাপটায় মেয়েটার মুখটা একটু শুকনো লাগছে। তবু কী অসাধারণ!
“কী হল? কী দেখছ? তমোনাশ ধরেছিল তোমায়?”
নীল হাসল। কুমু কি বুঝতে পেরেছে ওর মুগ্ধতা?
ও বলল, “না, এখনও ধরেনি। তবে ধরবে নিশ্চয়ই। এমন অবস্থায় ও কি আর ছড়ি ঘোরাবার সুযোগ ছাড়বে?”
“আমি কিন্তু একটা কথা ভাবছি,” কুমু গম্ভীরমুখে বলল, “হিরণ্য কাল রাতে কোথায় ছিল?”
“কেন?”
“আমি আমার ঘরের জানলা দিয়ে একজনকে বেরোতে দেখেছি রাতে। হাঁটাচলা দেখে তো হিরণ্য বলেই মনে হল।”
নীল চিন্তিত মুখে বলল, “তুমি বললে বলে মনে পড়ল, হিরণ্য কাল অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিল প্যাট্রিকের যাওয়ার পথে। দৃষ্টিটায় এমন একটা কিছু ছিল যে…”
“ওই যে গোকুলস্যার,” কুমু হঠাৎ নীলের কথার মাঝখানে বলে উঠল।
গোকুল মিশ্র কফি শপে ঢুকে কোনার একটা টেবিলে বসলেন। ওদের দেখেছেন বলে মনে হল না। নীল দেখল, মোটা চশমা পরা মানুষটা একটা জার্নাল খুললেন। সাদা তুলোর মতো চুল এলোমেলো হয়ে আছে। এত দূর থেকেও নিকোটিনের দাগধরা আঙুলগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কুমু বলল, “একটা মজার কথা জানো?”
“কী?” নীল ভ্রূ তুলল।
“গোকুলস্যার নাকি ভীষণ কিপটে। ওঁর নাকি একটাই সুট, একজোড়া লেদার শু, আর একটাই চশমা আছে। দেখো না, রোজ কেমন ওই খয়েরি সুটটাই পরেন।”
“যাঃ,” নীল হাসল।
“সত্যি বলছি। এত বড় মানুষ, এত টাকা রোজগার করেন, কিন্তু কিপটে! মজার কথা না? শুনেছি উনি এক টাকাকে নাকি এক হাজার টাকা হিসেবে দেখেন।”
“কে বলে এসব তোমাদের?”
“এই ব্যাপারটা সকলেই জানে। তোমার লেখায় কথাটা কাজে লাগতে পারে বলে ইনফরমেশনটা দিলাম।”
নীল কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। তমোনাশ রয় ঢুকছে কফিশপে।
“তো এখানে বসে গপ্পো হচ্ছে?” এই মেঘলা দিনে, শপের ভিতরের মন্দ আলোতেও তমোনাশ সানগ্লাস পরে রয়েছে।
কুমু বলল, “মানে, কী বলতে চাইছেন?”
“ইউ পিপ্ল আর সো ইররেসপন্সিবল। কখন থেকে তোমাদের খুঁজছি জানো?” তমোনাশ প্রায় চিৎকার করে উঠল।
কুমু বলল, “কেন খুঁজছেন?”
“কাল রাতে তোমরা কোথায় ছিলে?”
“কেন?” নীল জিজ্ঞেস করল এবার।
“তোমরা কোথায় ছিলে বলো। প্যাট্রিক যখন তোমাদের ছেড়ে ক্যান্টিনের দিকে গেল তখন তোমরা কোথায় ছিলে?”
“কেন বলব?” কুমু উঠে দাঁড়াল, “এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“প্যাট্রিকের এই অবস্থার পর…”
“মারা গেছে প্যাট্রিক? যায়নি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে? তাও করেনি। পুলিশ বলছে অ্যাক্সিডেন্ট। সেখানে আপনি কে? কৃষ্টির সিকিয়োরিটি চিফ মানেই কিন্তু প্রশ্ন করার অথরিটি নেই আপনার। আমি কিচ্ছু বলব না। চল নীল,” কুমু পার্স থেকে কফির দাম টেবিলে রেখে নীলের হাত ধরে টানল।
“এভাবে পার পাবে না তোমরা!” তমোনাশ গর্জন করল।
“চল নীল।” কুমু হেঁটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। নীল হাঁটতে হাঁটতে দেখল সানগ্লাস খুলে হিংস্র চোখে তাকিয়ে রয়েছে তমোনাশ রয়।
॥ ১০ জুলাই : রেস্টোরেশনের পর ॥
মাথাটা সামান্য হেলিয়ে হাসল সুধীর। অনুপটা গাধাই রয়ে গিয়েছে। বলে কিনা, এখন যদি ১৫ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়! আরে প্যাট্রিক কি মারা গিয়েছে নাকি? ও এখন কোমায়। বেশি ইন্টারপোলগিরি ফলানোর ফল। সিজ়ার সত্যি শিল্পী। অপরাধ-শিল্পী। সকলের চোখ এড়িয়ে প্যাট্রিক যাচ্ছিল মনীশ উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সিজ়ারের হাজারটা চোখ, লক্ষ ইন্দ্রিয়! পাহাড়ের নীচের এক অন্ধকারে প্যাট্রিকের পিছনে অনেকটা মাটি ফুঁড়েই যেন উদয় হয়েছিল সিজ়ার। প্যাট্রিক বোঝার আগেই রবারের ব্যাটন নেমে এসেছিল প্যাট্রিকের মাথার পিছনে।
তারপর সংজ্ঞাহীন প্যাট্রিককে পাহাড়ের মাথায় বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। লম্বা-চওড়া সিজ়ারের কাছে সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। সেখানে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে মেরুদণ্ডের বিশেষ জায়গায় পুশ করেছিল ইঞ্জেকশন। কমপক্ষে দু’সপ্তাহের জন্য অসাড় হয়ে থাকবে প্যাট্রিক। তারপর ওকে গড়িয়ে দিয়েছিল পাহাড়ের ঢাল দিয়ে। কেউ তো আর পিঠে ইঞ্জেকশনের দাগ লক্ষ করবে না। সবটাই নিখুঁতভাবে অ্যাক্সিডেন্ট প্রমাণ করা যাবে। আর পুলিশও তেমন গুরুত্ব দিয়ে দ্যাখেনি ব্যাপারটাকে। শুধু ওই ব্যাটা তমোনাশ রয়টাই বাড়াবাড়ি করছে। মনীশের হাত আছে যে ওর মাথার উপর!
হাত! ওটা আর ক’দিন পরে লজ্জায় নিজের মুখ ঢাকতে ব্যবহার করতে হবে মনীশ উপাধ্যায়কে। ওকে অপমান করা! প্রেসিডেন্টের চেয়ার কেড়ে নেওয়া! কোটি কোটি টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ!
দাঁড়াও, বের করছি। সুধীরের হাতে দুটো তাস আছে। একজন সিজ়ার আর অন্যজন সেই অদম্য সেন। সিজ়ার তার প্রথম কাজটা করেছে। এবার অদম্য সেনের পালা।
গাড়ির সিটে ছড়িয়ে বসল সুধীর। কৃষ্টির মেন গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকছে। রেমব্রান্টের আঁকা ছবিটা থেকে কয়েক শতাব্দীর ধুলো সরে গিয়েছে। আজ কৃষ্টির বোর্ডের রুলিং ও অপোজ়িশন, দু’পক্ষকেই স্পেশ্যাল ইনভিটেশন পাঠিয়েছে মনীশ। ও দেখাতে চায় ওর কৃতিত্ব! রেমব্রান্টের এই ছবির উন্মোচনের জন্য পৃথিবীর অনেক মিউজ়িয়াম সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে এই সম্মান কেড়ে এনেছে মনীশ উপাধ্যায়। মনে মনে হাসল সুধীর। ১৫ তারিখ এই ছবিই হবে মনীশের নেমেসিস।
গাড়ি এসে থামল মেন বিল্ডিং-এর সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সুধীর এগোল লিফ্টের দিকে। পিছনে অনুপ আসছে। লিফ্টে উঠে অনুপ আবার একই কথা বলল, সুধীরভাই, যদি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়? ইতালিয়ান ছেলেটার যা হল!
“তুমি গাধা?” খেঁকিয়ে উঠল সুধীর। লিফ্টম্যানটা চমকে তাকাল। সুধীর বলল, “কিচ্ছু হবে না। অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে প্রোগ্রাম বাতিলের সম্পর্ক কী?”
“না, মানে ওটা অ্যাক্সিডেন্টই তো?”
“না তো কী? পুলিশ তো বলেইছে যে, প্যাট্রিক জফ পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে।”
“অত রাতে পাহাড়ে কী করছিল ছেলেটা?”
সুধীর উত্তর দিল না। লিফ্ট এসে থেমেছে ছ’তলায়। এটাই গ্র্যান্ড ডিসপ্লে গ্যালারি। কৃষ্টির সবচেয়ে ভাল ছবিগুলো এখানে রাখা হয়। এই ঘরটার একদিকের দেওয়াল সম্পূর্ণ কাচের। দুপুরের আলোয় অদ্ভুত লাগছে চারদিক। এই হলের প্রবেশপথের সামনে মেটাল ডিটেক্টর ব্রিজ রাখা। পাশে দু’জন সিকিয়োরিটির সঙ্গে দরজা আগলাচ্ছে তমোনাশ রয়।
সুধীর আলতো করে অনুপের পিঠে হাত দিল। বলল, “যা হয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা কোরো না। এত ভয় পাও কেন? একদম নার্ভাস হবে না। আমার প্ল্যান যেন গুবলেট না হয়।”
দরজার কাছে মোবাইল ফোন জমা নিচ্ছে তমোনাশ। সুধীর ফোনটা জমা দিয়ে সিকিয়োরিটি ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে গেল। দরজার উলটোদিকে সেই বিখ্যাত ছবি। মেহগনি ফ্রেমের উপর স্ক্রু দিয়ে আঁটা প্লেক্সিগ্লাসের তলায় জ্বলজ্বল করছে টাইটাস। সুধীর কাছ থেকে দেখবে বলে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। পিছনে অনুপের গলা শোনা যাচ্ছে।
তমোনাশের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে অনুপ, “না, মোবাইল দেব না আমি। কেন, মোবাইল নিয়ে ভিতরে গেলে কী হবে?”
“প্লিজ় মিস্টার আইয়ার। যা নিয়ম তা মানতেই হবে। না হলে…” তমোনাশ গম্ভীরভাবে বলল।
“না হলে মানে? না হলে মানে কী? আমি ক্রিমিনাল? আমার দরকারি ফোন আসবে।”
“দেখুন, উপাধ্যায়স্যার বলেছেন, টপমোস্ট সিকিয়োরিটির জন্য নো মোবাইলস আর অ্যালাউড। মোবাইল না জমা রাখলে আপনাকে ঢুকতে দেব না।”
“উপাধ্যায়স্যার!” চিত্কারে ফেটে পড়ল অনুপ, “মাই ফুট। আই ওয়াক আউট ইন প্রোটেস্ট। দরকার নেই ছবি দেখে। গো টু হেল।” অনুপ লিফ্টের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। হাসি পেল সুধীরের। ব্যাপারটা প্ল্যানের মধ্যে ছিল না, কিন্তু গাধা অনুপটা সামান্য মোবাইল নিয়ে ঝঞ্ঝাট করে মনীশের চেষ্টায় সামান্য হলেও কালি ঢেলে দিল। সকলের সামনে প্রমাণ করেছে যে, মনীশ বাড়াবাড়ি করছে। ও দেখল তমোনাশ মুখ লাল করে টয়লেটের দিকে চলে গেল।
কাচের দেওয়ালের কাছে সরে এল সুধীর। ওই মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গাড়ির দিকে এগোচ্ছে অনুপ। হাঁটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগ কমেনি। কানে মোবাইল ধরা রয়েছে অনুপের। দরকারি ফোনটা এল কি?
॥ ১০ জুলাই : একাকী ॥
পিঞ্চার যন্ত্রটা আমি সিয়েরা লিয়ঁর একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর থেকে কিনেছিলাম। কোনও ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফর্মারকে এক মিনিটের জন্য ট্রিপ বা অকেজো করিয়ে দিতে এটা ব্যবহৃত হয়। এতদিন পরে এটা কাজে লাগবে আবার। আমি যন্ত্রটাকে টেবিলের উপর রাখলাম। আজ একটু আগে এস বি-র ফোন এসেছিল। ছবি গ্যালারিতে চলে এসেছে, এবার সেটা হটিয়ে তার জায়গায় নকল ছবি টাঙাবার সময় এসেছে। মাঝে আর কয়েকটা মাত্র দিন রয়েছে। এস বি বলেছে যে, ছবিটা সরানোমাত্র যেন ওকে আমি খবর দিই। তা হলে লোক মারফত সেটা আমার থেকে নিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করবে। আমি ভেবে দেখেছি, এস বি-র পাঠানো লোকটার সামনে কিছুক্ষণের জন্য ছদ্মবেশে গেলেও সমস্যা হবে না।
কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে অন্য কথা। আমার মনে হচ্ছে, এস বি-র মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে। মনে হচ্ছে, আমার সাবধানে থাকা উচিত। ক্যাম্পাসে প্যাট্রিক জফ বলে যে ছেলেটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, তা মনে হচ্ছে দুর্ঘটনা নয়। ওই জায়গাটায় আমি গিয়েছিলাম একা। যে জুতোর ছাপ ওখানে ছিল, তা প্যাট্রিকের জুতোর ছাপ নয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর জুতোটা দেখেছিলাম। বরং পাহাড়ের মাথায় প্যাট্রিকের জুতোর কোনও ছাপই ছিল না। আমার মনে হয় অজ্ঞান করে ওকে পাহাড়ে তুলে নিয়ে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার ছ’নম্বর ইন্দ্রিয় ক্রমাগত সংকেত পাঠাচ্ছে আমায়। এস বি-র গলা সন্দেহজনক লাগছে আমার। কাজ শেষ না করলে টাকা দেবে না বলেছে, কিন্তু করলে দেবে তো?
আমি মন ঘোরাতে পিঞ্চারটাকে দেখলাম। এটাকে এক ফাঁকে গিয়ে এই ক্যাম্পাসের ট্রান্সফর্মার রুমে লাগিয়ে দিয়ে আসতে হবে। গ্র্যান্ড গ্যালারিতে ঢোকার জায়গাগুলোয় সব লেজ়ার লাগানো রয়েছে। এক মিনিটের জন্য কারেন্ট বন্ধ না করতে পারলে কিছুতেই ওই ঘরে ঢোকা যাবে না। কাজ শেষে বেরোবার সময়ও আরও একবার কারেন্ট বন্ধ করতে হবে। কতক্ষণ বন্ধ থাকবে, এক মিনিট? হ্যাঁ, তাই যথেষ্ট আমার পক্ষে। লেজ়ার অকেজো করতে পারলেই বাকিটা সহজ। এখন শুধু মনটাকে শান্ত করতে হবে। কাজের আগে মনসংযোগ জরুরি।
আজও ফাদার ফ্রান্সিসকে ফোন করেছিলাম। ফাদার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুই কেন এমন অন্ধকারে থাকিস? সত্পথে রোজগার করতে পারিস না?”
“সৎপথে টাকা রোজগার করলে চারটে অরফ্যানেজে কনট্রিবিউট করা যায় না, ফাদার।”
“কিন্তু বাজে কাজ করে কতদিন চলবে?”
“যতদিনই চলুক, কিছু বাচ্চা তো বাঁচছে এই টাকায়। তা ছাড়া অসৎ কাজ হলেও এই কাজে মনের জোর লাগে।”
“না, সৎ হওয়ার জন্য মনের জোরের দরকার হয় বেশি। তোর বাবা এসব দেখলে কষ্ট পেতেন।”
ওয়ালেট থেকে ছবিটা বের করে বাইরে থেকে আসা অল্প আলোয় ধরলাম। আমার পাঁচ বছর বয়সের ছবি। ছবিতে আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি আনমনে। আচ্ছা, বাবা কখন তুলেছিল এই ছবিটা? ছবিতে বাবা নেই, কিন্তু তবুও কী জীবন্ত তার উপস্থিতি। বাবা এসব দেখলে কষ্ট পেত?
আমি বাইরে তাকালাম। মনকে দুর্বল হতে দেওয়া চলবে না। কাল-পরশুর মধ্যেই কাজ সারতে হবে আমায়। ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে এই উপত্যকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। আমি টেবিল থেকে পিঞ্চার আর রিমোটটা ব্যাগে ভরতেই, করিডরে কার যেন পায়ের শব্দ পেলাম।
॥ ১১ জুলাই : ছোট্ট ঘটনা ॥
“স্যারের কথা চিন্তা করলেই আমার এত এমব্যারাসড লাগছে না! কী করে যে চশমাটা ভেঙে গেল। ভিড়ের মাঝে ধাক্কাধাক্কিতে চশমাটা হাত থেকে পড়ে…” কথাটা শেষ না করে মাথা ঝাঁকাল পূরব।
নীল পিঠে হাত দিল ওর, “ছাড়ো, কিচ্ছু হবে না। তুমি তো জেনেবুঝে কিছু করোনি।”
পূরব নীলের দিকে ফিরল, “তুমি তো আমার পিছনে ছিলে, দেখলে কে ধাক্কা মারল আমায়?”
“ধাক্কা? না, আমি আমার নোটবই আর ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।” নীল ঠোঁট উলটাল।
কুমু বলল, “বাদ দাও। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পরে রোজই অমন ধাক্কাধাক্কি হয়। ঘরের একজ়িটটা এমন ছোট আর স্যারের টেবিলটাও দরজার কাছে। আর তা ছাড়া সামান্য চশমা তো।”
“না, মোটেই সামান্য নয়। স্যারের একটাই চশমা!” পূরব বলল।
“ও-ও,” হাসল কুমু, “স্যারের মাইজ়ারলি নেচার তো। তা কে বলল একটা চশমা?”
“আরে গোকুলস্যারই বিড়বিড় করছিলেন, ‘একটা চশমা, তাও ভাঙল, আবার বানাতে হবে।’ ইস, স্যার কী ভাবলেন বলো তো?”
নীল পাহাড়ের দিকে তাকাল। আজ সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে। নীল ওড়নার মতো ঝাপসা আলোয় ঢেকে আছে উপত্যকা। এমন দিনে মনখারাপ হয়ে থাকে নীলের। ও বলল, “চলো আজ একসঙ্গে লাঞ্চ করি সকলে।”
“লাঞ্চ হবে না। আমায় একবার টাউনে যেতে হবে। তার আগে তমোনাশ রয়ও ডেকেছে। আমার ফিল-আপ করা ফর্মে নাকি বাড়ির ঠিকানা লিখতে ভুলে গিয়েছি। ইউ পিপ্ল এনজয় লাঞ্চ,” পূরব ছাতা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল।
কুমু ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “এই তমোনাশ লোকটাকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটা নুইসেন্স। আরে, আমরা অন্য জায়গা থেকে ইনভিটেশন পেয়ে এখানে এসেছি মাত্র। উই আর নট ক্রিমিনালস। কিন্তু ব্যাটা এমন করছে- রাতে কোথায় ছিলে? প্যাট্রিক তোমায় শেষ কী বলেছিল? এই ফর্ম ভরো, ওখানে যাবে না- অল বুল শিট।”
নীল বলল, “আরে শুধু তোমাদের সঙ্গেই নয়। আমায় বলে, ‘কী সাংবাদিকতা করো যে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াও?’ যেন ওর বাবার টাকায় তেল কিনি। সেদিন অনুপ আইয়ার বলে কৃষ্টির ম্যানেজমেন্টের একজনের সঙ্গে তো হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল ওর।”
“কবে?” কুমু গল্পের গন্ধ পেয়ে ওর দিকে তাকাল।
“ম্যানেজমেন্টের কয়েকজনের কাছে রেমব্রান্টের আঁকা ছবিটা দেখানোর অনুষ্ঠান ছিল! ম্যানেজমেন্টের বাইরের লোক বলতে ছিল গোকুলস্যার আর ওঁর বায়োগ্রাফার হিসেবে আমি। মোবাইল নিয়ে ঝঞ্ঝাট লেগেছিল অনুপ আর তমোনাশের। সে এক সিন!”
কুমু বলল, “এই লোকটাকে ইমিডিয়েটলি স্যাক করা উচিত।”
নীল হেসে কিছু বলতে গিয়েও পারল না। দেখল হিরণ্য এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। ওর মুখ-চোখ বরাবরের মতো এখনও সিরিয়াস।
“হাই হিরণ্য,” কুমু হাসল।
হিরণ্য বলল, “পূরব কোথায়?”
“কেন? টাউনে যাবে বলল তো!” নীল অবাক হল।
“টাউনে?” হিরণ্য থমকে গেল এক মুহূর্ত, “আচ্ছা, ছেলেটাকে কেমন মনে হয় তোমার?”
“কেন? কী মনে হবে?” এবার কুমুর অবাক হওয়ার পালা।
“তুমি কি জানো, প্যাট্রিক যে রাতে আহত হল, সেই রাতে ও অনেকক্ষণ ঘরে ছিল না?”
“তোমায় কে বলল?” প্রশ্নটা করে নীল আড়চোখে কুমুকে দেখল। কুমু হিরণ্যর সম্বন্ধে কী বলেছে সেটা আর বলল না।
“আমি জানি,” হিরণ্য বলল।
“ও আমার ঘরে এসেছিল, ওয়ার্কশপে আমার করা স্কেচগুলো দেখতে,” কুমু বলল।
“অত রাতে?” হিরণ্য ভুরু কোঁচকাল।
“সো হোয়াট?” কুমু রেগে গেল।
“না, তা নয়। আমার মনে হয় হি ইজ় আ ফিশি গাই। জেনো, শুধু প্যাট্রিকের অ্যাক্সিডেন্টই নয় আরও কিছু অঘটন ঘটবে। আর ঘটবে খুব শিগগিরই। বি অন ইয়োর গার্ড,” হিরণ্য আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
কুমু বলল, “কী সব ঘটছে বলো তো? আরও যে কীসব ঘটতে চলেছে? আমার ভয় করছে নীল।” নীল কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বুকের ভিতর ফড়িং উড়ছে। কুমু কখন যেন পেঁচিয়ে ধরেছে ওর হাত!
॥ ১২ জুলাই : অপারেশন ॥
কাজটা খুব সোজা। গ্যালারির কাচের দেওয়ালের প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফুট নীচ থেকে পাহাড়ের ঢালের মতো নেমে গিয়েছে একতলা অবধি। একতলায় এই ঢালের মাঝে চৌকো করে কেটেই দরজা বানানো হয়েছে। এই ঢালু অংশটা কংক্রিটের তৈরি। তবে তার উপর মাটি ফেলে ঘাস বোনা হয়েছে। পাতাবাহার গাছ লাগিয়ে লেখা হয়েছে, কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটি। পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকেও এই লেখা দেখা যায়। আমায় এই ঢাল বেয়ে উঠতে হবে তিনতলার কাছাকাছি উচ্চতায়। বাকিটা দেওয়ালের খাঁজে পা রেখে পৌঁছোতে হবে কাচের দেওয়ালে। স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে লাগানো আড়াই ফুট বাই তিন ফুটের এক-একটা কাচ। অটোম্যাটিক স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে একটা কাচ খুলতে বড়জোর চল্লিশ সেকেন্ড। তারপর শুধু রিমোট দিয়ে পিঞ্চার অ্যাকটিভেট করে মিনিটখানেকের জন্য ক্যাম্পাসের বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। লেজ়ারও অফ হয়ে যাবে। সেই সুযোগে ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে। রেমব্রান্টের ছবিটা স্ক্রু লাগানো প্লেক্সিগ্লাস থেকে বের করে পালটাতে লাগবে আরও পাঁচ মিনিট। তারপর কাচের দেওয়ালের কাছে এসে আবার পিঞ্চার, লোডশেডিং, লেজ়ার অফ। বাইরে বেরিয়ে কাচ লাগিয়ে দেওয়া। ক্লিন অ্যান্ড স্টার্চড। কেউ বুঝতে পারবে না।
আয়নায় একবার দেখে নিলাম নিজেকে। আপাদমস্তক ধূসর লাইক্রায় ঢেকে নিয়েছি শরীর। চোখে নাইট ভিশন গগল্স। লোডশেডিং-এ কাজে লাগবে। পিঠে ক্রস করে ঝুলিয়ে নিয়েছি রাইকারের এঁকে দেওয়া হুবহু নকল ছবিটা। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে। পাহাড়ের একদম কোল ঘেঁষে এখানকার ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল জ়োন। ক্যাম্পাসটা এত বড় যে, যেতে সময় লাগবে। এই সময়ে দুটো গার্ড থাকে ওখানে। কিন্তু দুটোই কুঁড়ের হদ্দ, ঘুমোয়। ট্রান্সফরমারের নীচে ছোট্ট পিঞ্চারটা লাগাতে সমস্যা হবে না।
অন্ধকারের সঙ্গে মিশে এগোতে থাকলাম আমি। মাথার উপর ছড়িয়ে থাকা মেঘের আকাশ। দু’-চারটে তারা উঁকি মারছে সেই ফাটল দিয়ে। দুর্বল চাঁদ মেঘের ভিতরে ডুবে-ভেসে টিকে আছে কোনওমতে। আর তার অনেক নীচে, অন্ধকারের সঙ্গে মিশে এগোচ্ছি আমি।
আট মিনিটের মাথায় পাহাড়ের একপাশে কন্ট্রোল রুমে এসে পৌঁছোলাম। কাচের ঘরে একজন গার্ড যথারীতি ঘুমোচ্ছে আর অন্যজন নেই। কোথায় লোকটা? আমি তারের গেট টপকে ভিতরে ঢুকলাম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম মিটার পঞ্চাশেক দূরের ট্রান্সফর্মার রুমের দিকে। দরজাটায় তালা। আমি মাস্টার কি বের করে তালা খুলতে যাব হঠাৎ পিছন থেকে আচমকা শুনলাম, “পুট ইয়োর হ্যান্ডস আপ…”
কে? শরীরে বিদ্যুত্ খেলে গেল আমার। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে নিচু হয়ে গড়িয়ে গেলাম পাশের ঝোপে। আর গড়াতে গড়াতে শুনলাম, “…অ্যান্ড সে ওম শান্তি ওম।”
দ্বিতীয় গার্ড প্যান্টের বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে জড়ানো গলায় থেমে থেমে গান গেয়ে ফিরছে। ক্লোজ় শেভ। লোকটা আদৌ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে বলে মনে হল না। নিশ্চয়ই আমায় খেয়াল করেনি। গালি দিলাম নিজেকে। আরও সাবধান হতে হবে আমায়।
ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল জ়োন থেকে যখন বেরোলাম তখন মেঘ আরও ঘনিয়ে এসেছে আকাশে। ক্যাম্পাসের ভিতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আলোয় মনে হচ্ছে, এই বৃহত্ দৃশ্যপট যেন সেই ওলন্দাজ শিল্পীরই আঁকা। আমি সেই কিয়ারোসকিউরো ভেদ করে এগোতে লাগলাম। রেমব্রান্টকে পালটাতে হবে রাইকার দিয়ে।
“হ্যান্ডস আপ।” না, আর গান নয়। গলাটা শুনে থমকে গেলাম আমি। ধীরে ধীরে পিছন ফিরলাম। আরে, একে তো আমি চিনি। তবে একটা বাঁচোয়া, মুখোশ থাকায় ও আমায় চিনতে পারছে না। ও এগিয়ে এল আমার দিকে। হাতে পিস্তল। ও প্রশ্ন করল, কে তুমি? কী করছ এত রাতে?
আমি উত্তর না দিয়ে নিমেষে প্যান্টের পকেট থেকে লম্বা নলের মতো যন্ত্রটা বের করে সুইচ টিপলাম। পিং…। এটা মেকানিক্যাল ডার্ট। ট্রিগারে চাপ পড়ামাত্র একটা ইঞ্চিচারেক ফোল্ডিং তির গিয়ে লাগল ওর শরীরে। ন্যানো সেকেন্ড। কাটা গাছের মতো পড়ে গেল। সংজ্ঞাহীন। আমি এগিয়ে গিয়ে তিরটা খুলে নিলাম শরীর থেকে। তুলে নিলাম পিস্তলটা। তারপর পড়ে থাকা পাথর তুললাম একটা। একে কয়েকদিনের জন্য অকেজো করে দেওয়া দরকার। পায়ের গোড়ালিটা কাঠ ফাটার মতো শব্দ করে ভাঙল। ও বুঝতেই পারল না। আমি এবার ওর মানিব্যাগ আর গলার সোনার চেনটা নিয়ে নিলাম। ডাকাতির কনফিউশন গুলে দিতে হবে ঘটনায়। তারপর ওকে গড়িয়ে দিলাম পাশে চওড়া ড্রেনের ভিতর। দেরি হল কিছুক্ষণ, কিন্তু তাও রাত বাকি আছে অনেকটা। কাজ পড়ে রয়েছে। একজন পুত্র জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। বাইরে নিসর্গ, বাইরে মুক্তি। আমি বুকের কাছে হাত দিলাম। বাবা আছে আমার সঙ্গে। বাকিটুকুও থাকবে। গ্যালারির দিকের অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিশে গেলাম আমি।
॥ ১৩ জুলাই : দীর্ঘতম রাত্রি—১ ॥
“আচ্ছা, পূরব এল না তো?” ঘোরলাগা গলায় জিজ্ঞেস করল হিরণ্য।
এই ঘরটায় আলো কমিয়ে রাখা হয়েছে। তার ভিতরেও নীল দেখল হিরণ্যের মুখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি।
কুমু বলল, “বললাম তো ওকে আসতে, কিন্তু এল না!”
“যাক গে, বাদ দাও। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ,” হিরণ্য হাসার চেষ্টা করল।
“কী করে হল এসব?” নীল চুলের ভিতর হাত চালাল।
মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত ভাবল হিরণ্য, তারপর বলল, “ইটস নো পয়েন্ট হাইডিং এনিমোর। আয়্যাম আ প্রাইভেট এজেন্ট।”
“এজেন্ট? মানে? তুমিও এজেন্ট? প্যাট্রিকও এজেন্ট? গোকুল মিশ্র এজেন্ট নন তো?” উত্তেজিত হয়ে বলল কুমু।
“তোমরা সকলেই আমাদের বন্ধু সেজে এসে আমাদের উপর নজরদারি করছিলে। আর আমরা বোকার মতো তোমাদের বিশ্বাস করে…”
নীল কুমুর পিঠে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করল। বলল, “কাম ডাউন। এটা ওর কাজ, ও কী করবে?”
হিরণ্য বলল, “প্রসপেক্ট ইনশিয়োরেন্স রেমব্রান্টের ছবিটাকে ইনশিয়োর করেছে। যদিও মনীশ উপাধ্যায় বলেছেন যে, সিকিয়োরিটি টাইট, তবুও ওরা সিক্রেটলি আমায় এখানে পাঠিয়েছে। এই সদ্য-পাওয়া ছবিটার উপর অনেকের লোভ রয়েছে। এটাকে গার্ড করা ইম্পর্ট্যান্ট। কিন্তু…”
হিরণ্যকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে নীল বলল, “কিন্তু তোমার এই হাল হল কীভাবে? পুলিশ যে বলল মাগিং, তা কি সত্যি?”
“আই ওয়াজ় নট মাগড। ইট ওয়াজ় আ কভার আপ অ্যাক্ট। চোরের লক্ষ্য ছিল ছবি। ইলেকট্রিক্যাল কন্ট্রোল রুম থেকে বেরোতে দেখেছিলাম ওকে। তারপর গ্যালারির দিকে এগোতে দেখে মাঝপথে ওকে ইন্টারসেপ্ট করি। প্রায় কবজাও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু, একটা ‘পিং’ শব্দ শুনলাম আর তারপর এভরিথিং ওয়েন্ট ব্ল্যাক। জ্ঞান হল এই নার্সিংহোমে। দেখো না, পা ভেঙে দিয়ে আমায় অচল করে দিয়ে গেছে।”
“কিন্তু, ছবি তো চুরি হয়নি। তা তুমি চিনতে পেরেছিলে লোকটাকে?” কুমু জিজ্ঞেস করল।
“না। আর চিনব কী করে? আগাগোড়া গাঢ় রঙের পোশাক পরেছিল লোকটা। কিন্তু কেন চুরি করল না, তাই তো ভাবছি।”
নীল দেখল হিরণ্য হাঁপাচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছে এমন একটা ড্রাগ ওর শরীরে ঢুকেছিল, যার ফলেই ঘোরলাগা ভাব। ওকে আর কথা বলানো ঠিক নয়। নীল উঠল। বলল, “আজ আমরা যাই, তুমি রেস্ট নাও।”
হিরণ্য মাথা নাড়ল, “আর রেস্ট। এবার চাকরিটা যাবে আমার। অসুস্থ মা-বাবার একমাত্র সম্বল আমি। কিন্তু…”
“আরে ছবি তো চুরি হয়নি। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?” কুমু সান্ত্বনা দিল।
“তা হলেও…”
“ধ্যাত, ছাড়ো ওসব। আমরা আসি,” কুমু হেসে নীলের সঙ্গে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীলের খারাপ লাগল। হিরণ্য চুপচাপ ছেলে, কিন্তু গোটা ঘটনায় এত বিব্রত হয়েছে যে, ব্যক্তিগত কথাবার্তাও বলে ফেলছে। ও বলল, “একটাই বাঁচোয়া, রেমব্রান্টের ছবিটা চুরি যায়নি, না? তবে পুলিশের উচিত সিকিয়োরিটি বাড়ানো। ক্যাম্পাসে ডাকাত ঢুকল কী করে?”
কুমু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
নার্সিংহোমের রিসেপশনে তমোনাশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দেখে এগিয়ে এল লোকটা, “তোমরা কাদের এজেন্ট?”
“মানে?” কুমুর নরম গলা নিমেষে কঠিন হয়ে উঠল।
“যে রেটে রোজ এজেন্ট বেরোচ্ছে। তা গতকাল রাতে তোমরা কোথায় ছিলে?” তমোনাশের স্বর রুক্ষ হয়ে উঠল।
নীল কিছু বলার আগে কুমু হাত ধরে টানল ওকে, “চলো, ফালতু প্রশ্নের জবাব দেব না।”
“বাট আই শুড নো,” তমোনাশ কুমুর হাত ধরতে গেল।
“হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি? স্কাউন্ড্রেল! আমি তোমার বিরুদ্ধে চার্জ আনব।”
নীল দেখল অবস্থা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও কুমুকে ধরে নিয়ে বেরিয়ে এল রিসেপশনের বাইরে। সত্যি তমোনাশ খুব বাড়াবাড়ি করছে।
“তোমরা কি হিরুর বন্ধু?” দরজার কাছে প্রশ্নটা শুনে থমকাল নীল। একজন বৃদ্ধ মানুষ তাকিয়ে রয়েছেন ওদের দিকে।
“হ্যাঁ, আপনি?”
“হিরু আমার ছেলে। ও ভাল হয়ে উঠবে তো?”
নীল হাসল, “আপনি চিন্তা করবেন না। ও ভাল হয়ে যাবে। বিশেষ কিছুই হয়নি।”
“বলছ?” ভদ্রলোক সামান্য স্বস্তি পেলেন যেন।
কুমু বলল, “আঙ্কল ডোন্ট ওয়ারি। হিরণ্য উইল বি অল রাইট। আর ওর চাকরি নিয়েও চিন্তা করবেন না।”
“করছি না। আমার ছেলে ভাল হয়ে উঠলেই হল,” ভদ্রলোক আবার ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ছাতা খুলে নীল ধরল কুমুর মাথায়। দূরে ওর গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। হিরণ্যর বাবার অসহায় মুখটা এখনও চোখে ভাসছে। নীল বলল, “তুমি ছাতাটা ধরো তো, আমি একবার আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছ?” কুমু অবাক হল।
‘হিরণ্যর বাবাকে একটা কথা বলা দরকার।”
নীল যখন ফিরে এল কুমু ততক্ষণে গাড়ির ভিতরে বসে পড়েছে। নীল ড্রাইভারের সিটে বসে বলল, “চলো, এবার তোমার জন্মদিনের কেক কাটি।”
কুমু হঠাৎ হাত রাখল নীলের হাতে। মৃদু গলায় বলল, “তুমি যে আজ আমার জন্মদিনের জন্য সিমলায় যাওয়া পিছিয়ে দিলে, তার জন্য থ্যাঙ্কস।”
নীলের গলার কাছে ছোট্ট একটা বেলুন ফুলল। গাড়ির নির্জনতায় সে নরম চোখে তাকাল কুমুর দিকে। কুমু আরও এগোল। আলতো করে হাত দিল নীলের মাথার পিছনে। টানল কাছে। নীলের গরম নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেল কুমুর নিশ্বাস। ঠোঁটে মিশল ঠোঁট। বৃষ্টি আরও জোরে এল। আর ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল উপত্যকা।
॥ ১৩ জুলাই : দীর্ঘতম রাত্রি-২ ॥
“তাই? কখন? না না ওখানে নয়, ওই যে লাভার্স ব্রিজটা রয়েছে, তার উপর দিয়ে ওই দিকে গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরবে। শোনো, গাড়ি নেবে না। গাড়িটা ব্রিজের এইদিকে, মানে ক্যাম্পাসের দিকে রাখবে। তারপর হেঁটে, যেখানে বললাম, সেখানে যাবে। আমার লোক থাকবে ওখানে। ওর হাতে জিনিস দিয়ে তোমার টাকা বুঝে নেবে। ঠিক আছে?” সুধীর চুপ করে ওপাশের উত্তরটা শুনল। তারপর আবার বলল, “মনে থাকে যেন, ছবিটা রোল করে ফায়ার অ্যান্ড এক্সপ্লোশন গ্রুপ কেসে নিয়ে আসবে। ছবির যেন কোনও ক্ষতি না হয়। নো রং মুভস। যদি এখান থেকে নিরাপদে বেরোতে চাও, তা হলে চালাকি করবে না। আমি এই জায়গাটাকে হাতের তালুর মতো চিনি। তোমায় না চিনলেও, আমার লোক মারফত ঠিক খুঁজে বের করব তোমায়। তারপর…” সুধীর হাসল শব্দ করে। তারপর কেটে দিল ফোনটা। কিন্তু রাখল না। আবার ডায়াল করল। কার সঙ্গে জানি কথা বলল লাভার্স ব্রিজের ওই পাড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার জন্য।
অনুপ বোতল থেকে হুইস্কি ঢেলে ড্রিঙ্ক বানাচ্ছিল। সুধীর সোফার ব্যাকরেস্টে মাথা রেখে কথা বলছিল এতক্ষণ। এবার কথা শেষ করে ফোনটা সোফায় ছুড়ে সোজা হয়ে বসল। মুখে হাসি উপচে পড়ছে।
অনুপ জিজ্ঞেস করল, “কী হল? এনি গুড নিউজ়?”
“এটাও বোঝো না? তুম গধে হো কেয়া? আরে কাজ হয়ে গিয়েছে। রেমব্রান্ট হাপিস। গ্যালারিতে যেটা ঝুলছে, সেটা ফেক। আমার লোক লাভার্স ব্রিজের ওই দিকে গিয়ে ছবিচোরের থেকে মাল তুলে আনবে।”
“তোমার লোক মানে?”
“সে আছে। সব জানতে হবে না তোমায়। তুমি শুধু দেখো কী হয়। পরশু বিকেলে যখন ‘টাইটাস বাই দ্য উইন্ডো’-এর উদ্বোধন হবে আই উইল চ্যালেঞ্জ দ্য অথেন্টিসিটি অব দ্য পিকচার। প্রথমে পরীক্ষা করে দেখা যাবে যে, ছবিটা ঠিক আছে, কিন্তু তারপর এক্স-রে করে ল্যাব টেস্ট করলে ধরা পড়বে যে ওটা খুব নিখুঁত একটা ফেক। আমি তখন দেখতে চাই মনীশ উপ্যাধ্যায়কে। আমি চোর? শালা, মনীশকে মাটিতে মিশিয়ে দেব আমি। বলব, ছবিটা হাপিস করেছে ও-ই। তারপর একটা ফেক ছবিকে অরিজিনাল বলে চালাতে চাইছে। আই উইল রুইন হিম! আমায় যেমন সকলের সামনে হিউমিলিয়েট করেছিল, আমিও তেমন সারা পৃথিবীর সামনে ওকে ছিঁড়ে খাব। দেখাব, কৃষ্টির প্রেসিডেন্ট পদ আসলে কার জন্য!”
অনুপ হুইস্কির গ্লাসটা এগিয়ে দিল সুধীরের দিকে। সুধীর তাতে লম্বা চুমুক দিল, “আঃ, আই লাইক দিস বিটারনেস। লেটস এনজয় মাই ভিকট্রি।”
অনুপ বলল, “ড্রিঙ্কটা কি একটু কড়া হয়েছে? সোডা দেব আর-একটু?”
“চুপ করো, কেন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছ!” সুধীর দ্বিতীয় চুমুকটা দিল। বাইরে কড়কড় শব্দে বজ্রপাত হল। সুধীর বেদীর বাড়িটা আজ খালি। কেউ নেই।
“ওঃ, এমন গরম লাগছে কেন?” সুধীর টাইয়ের নটটা আলগা করল। হুইস্কিতে তৃতীয় চুমুকটা দিয়ে বলল, “নেভার মাইন্ড, এ বোধহয় টাকার গরম। অরিজিনাল ছবিটার খদ্দের পেয়ে গিয়েছি আমি। মিলিয়নস অব ডলার কামাব। ডলার অ্যান্ড প্রেসিডেন্টস চেয়ার। তোমাকেও দেব টেন পার্সেন্ট। একেই বলে বুদ্ধি, বুঝেছ অনুপ? তোমার আছে?”
অনুপ এবার হাসল, “কনগ্র্যাচুলেশন ভাইয়া।”
“ইয়াঃ, আই ডিজার্ভ…” হঠাৎ যন্ত্রণায় বেঁকে গেল সুধীরের শরীর। হাতের থেকে হুইস্কির গ্লাস পড়ে গেল নীচের কার্পেটে। সুধীরের ঘাম হচ্ছে। যন্ত্রণায় মোচড়াচ্ছে শরীর। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে অল্প। টেবিলের উপর রাখা জলের বোতলের দিকে মরিয়াভাবে হাত বাড়াল ও। কিন্তু বোতলটা পেল না। অনুপ সরিয়ে নিল নিমেষে। বলল, “ইউ ডিজ়ার্ভ টু ডাই। এখন বুঝলে কে গাধা?”
“কেন?” কোনওমতে শব্দটা বেরল সুধীরের মুখ দিয়ে।
অনুপ নিজের মোবাইল বের করে বলল, “আমি গাধা, আমি কিছু পারি না। তোমার ভিকট্রি! টেন পার্সেন্ট! মিলিয়নস অব ডলার। টাকার গরম! না, ওটা বিষের প্রতিক্রিয়া। রেমব্রান্ট তোমার নয়, আমার। আর তিন মিনিটের মধ্যে তুমি শেষ হবে। কিন্তু ততক্ষণে দেখো, আমি কীভাবে তোমার ছবি ওড়াই!”
অনুপ একটা নম্বর ডায়াল করে মোবাইলটা কানে নিল, “হ্যালো, পাখি ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। ওকে ব্রিজের উপরেই থামিয়ে ওর পালক ছিঁড়ে নাও। তারপর কথা মতো জায়গায় পৌঁছোবে, বুঝলে? যেন ভুল না হয়। আর কাজটা সেরে ফোনে খবর দেবে আমায়, আমি অপেক্ষা করব,” অনুপ ফোনটা কেটে সুধীরের দিকে তাকাল। আর… দুম! বারুদের তেতো গন্ধ। কে যেন লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দিয়েছে অনুপের বুক ভেদ করে। সারা শরীর কাঁপছে। যন্ত্রণায় অবশ হয়ে আসছে মাথা। হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল ওর। বুকের বাঁ দিক থেকে রক্তের ধারা নামছে নীচে। চোখ ঝাপসা। তবুও তার মধ্যেই অনুপ দেখল সামনের সোফায় কাত হয়ে পড়া সুধীর বেদীর হাতের পিস্তল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
“গাধা, তুই…” কথা শেষ করতে পারল না সুধীর, স্থির হয়ে গেল। অনুপ শেষবারের মতো চেষ্টা করল পাশে পড়ে থাকা ফোনটা তোলার। কিন্তু হাত পৌঁছোল না। শরীরে শূন্যতা। বজ্রপাত হল কোথাও? বিদ্যুত্ চমকাল? অনুপ আইয়ার ঢলে পড়ল কার্পেটে। বাইরে বৃষ্টি আরও জোরে এল। আর ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল উপত্যকা।
॥ ১৩ জুলাই : দীর্ঘতম রাত্রি-৩ ॥
ব্রিজের মুখে গাড়িটা রেখে আমি নামলাম। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে উপত্যকায়। সময়ের চেয়ে কুড়ি মিনিট লেট হয়েছে। আসলে ছোট্ট কাজটা সেরে আসতে একটু সময় লেগেছে। বৃষ্টিতে সবকিছু আবছা হয়ে আছে। ব্রিজের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর বুকে বেজে চলেছে বৃষ্টির শব্দ। মনে হচ্ছে, ঘষা কাচের ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। দু’হাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট নয়। আমি পিঠে ঝোলানো লম্বাটে কেসটা ঠিক করলাম। এটা বেশ ভারী। আগুন ও বিস্ফোরণ নিরোধক। ঠিক যেমন এস বি বলেছে। আমি ভুরুর উপর থেকে নেমে আসা জল মুছলাম। এরই মধ্যে সারা শরীর ভিজে গিয়েছে। ব্রিজটা বেশ লম্বা। দু’পাশে ইট দিয়ে তৈরি রেলিং আছে। তবে বাঁদিকের রেলিং-এর মাঝখানটা ভাঙা। এখান থেকেই নাকি দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সেদিন থেকেই এই সেতুর নাম লাভার্স ব্রিজ।
আমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। আজ এস বি-র গলায় এমন কিছু একটা ছিল যে, আমার ভিতরের অ্যান্টেনা বলছে, সামনে বিস্তর গন্ডগোল আছে। আমি যথাসাধ্য সাবধান হয়ে আছি, তবু বিপদ তৈরি করছে আবহাওয়া। এই মধ্য জুলাইয়ের বৃষ্টি। আমি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। না, পিছনে রাখা আমার গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না একদম। ব্রিজটা যেন আজ বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ যেন রবারের মতো টেনে লম্বা করে দিয়েছে পথ। এই পথের শেষে অপেক্ষা করছে একটা বাঁক। তার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এস বি-র লোক। সে কি টাকা নিয়ে এসেছে? নাকি…
“ইজ়ি ম্যান, ইজ়ি। হাত তুলে দাঁড়াও। না, নড়বে না। নইলে গুলি চালাতে হাত কাঁপবে না আমার।” বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কথাটা ধারালো বরফের মতো এসে আঘাত করল আমায়। পিস্তলের হ্যামার টানার ধাতব শব্দটা ক্ষীণভাবে এল আমার কানে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্রিজের পাশের পোস্টে একটা দুর্বল বাল্ব জ্বলছে। তার পক্ষে এই বৃষ্টির চাদর ভেদ করা সম্ভব নয়। তবুও পিছনের মানুষটাকে দেখার জন্য হাত তোলা অবস্থাতেও ঘুরলাম আমি। প্রথমে মনে হল শূন্যের মধ্যেই একটা বন্দুক ধরা হাত তাক করে রয়েছে আমার দিকে। তারপর ক্রমশ গোটা মানুষটার অবয়ব নজরে এল আমার। কালো রেনকোট পরে রয়েছে মানুষটা। মাথাটা রেনকোটের হুড দিয়ে ঢাকা থাকায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। গলার স্বর শুনে বুঝলাম, মানুষটা আওয়াজ বদলে কথা বলছে।
“পিঠের ওইটা খুলে মাটিতে নামিয়ে রাখো,” আবার নির্দেশ এল।
আমি জানি আমার প্যান্টের ডানদিকে পকেটে মেকানিকাল ডার্টটা রয়েছে। এটা একবার বের করতে পারলে…
“না না, হাত সামনে রাখো। প্যান্টের পকেট থেকে কিছু বের করার চেষ্টা করলেই গুলি চালাব।”
আমি হাতটা সামনে তুলে হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলাম, “আমায় তুমি মারতেই পারবে না।”
“কেন?”
“তুমি আর যেই হও খুনি নও।” আড়চোখে দেখলাম লাভার্স ব্রিজের ভাঙা পাঁচিল আমার দশ পায়ের মধ্যে। আমি খুব ধীরে সাইড স্টেপ করে সেদিকে এগোতে লাগলাম।
“এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি ঠিক গুলি চালিয়ে দেব। কী ভেবেছ ছদ্মবেশে আছ বলে কি চিনতে পারব না তোমায়? কেসটা তাড়াতাড়ি খুলে মাটিতে নামিয়ে রাখো।”
আর পাঁচ পা। কিন্তু আমি নিরুপায়। পিঠ থেকে কেসটা খুলতে খুলতে আমি আরও তিন পা সরে গেলাম রেলিং-এর ভাঙা অংশের দিকে।
“নামাও। মাটিতে নামাও ওটা।” মানুষটা এবার এগিয়ে আসছে আমার দিকে। রেনকোটের হুডটা কপালের অনেকখানি নীচে অবধি নামানো। কে এই লোকটা? হাঁটা দেখে চেনা মনে হচ্ছে। আমি আরও সরে গেলাম রেলিং-এর ভাঙা অংশের দিকে। নীচে বৃষ্টি বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে নদী।
“দাও,” লোকটার গলা এবার হিংস্র। আমি আচমকা লাফিয়ে রেলিং-এর উপর উঠে হাতের লম্বা কেসটা বাড়িয়ে ধরলাম নদীর উপর। বললাম, “নাও চালাও গুলি, আমি নদীতে ফেলে দেব এটা।”
“না!” চিৎকার করে উঠল লোকটা, “কুকুর, তোকে কুকুরের মতো গুলি করে মারব। দে, হাতের ওটা দে।” লোকটা এগিয়ে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। টাল সামলাতে না পেরে আমি পড়ে গেলাম। আমার অর্ধেক শরীর ঝুলে রইল ভাঙা রেলিং-এর নীচে। লোকটা প্রায় ঝুঁকে পড়ে এক হাতে বিপজ্জনকভাবে বন্দুক দোলাচ্ছে আমার দিকে। আর অন্য হাতে লম্বা কেসটা টানছে। ধস্তাধস্তিতে খুলে পড়েছে আমার নকল চুল। মুখের নকল চামড়া। কিন্তু কে এই মানুষটা? বৃষ্টি, অল্প আলো আর ধস্তাধস্তিতে বুঝতে পারছি না ঠিক। তবে এভাবে চললে আমি পড়ে যাব এবার। মৃত্যু নিশ্চিত। আমি আচমকা পা গুটিয়ে লাথি চালালাম। ভোঁতা শব্দ করে লোকটা গড়িয়ে গেল পাশে। আমি সেই সুযোগে উঠতে যাব, কিন্তু তার আগেই লোকটা বন্দুক তাক করল আবার। হিসহিসে গলায় বলল, “এবার মর।”
আমি স্থির হয়ে গেলাম। লোকটার মাথার আবরণ খসে গিয়েছে। চা-রঙা আলোর আবছা দ্যুতি এসে পড়ছে ওর মুখে। আর সেই আলোয় আমি চিনতে পারলাম মানুষটাকে।
“তমোনাশ রয়!” আমি আপনা থেকেই বললাম।
“হ্যাঁ, আমি। এবার দে ওটা, নইলে…”
“না…” আর একটা শব্দ, সঙ্গে পায়ের আওয়াজ। বৃষ্টির ভিতর এসে উপস্থিত হয়েছে আর একজন। তমোনাশ থমকাল। আর আমার দমবন্ধ হয়ে এল। এই গলার স্বরটা আমার চেনা।
“প্লিজ়, ওকে মারবেন না,” বৃষ্টির চাদর ভেদ করে এগিয়ে এল কুমু।
তমোনাশ বিভ্রান্ত গলায় বলল, “দে, দে কেসটা, না হলে এবার…” আমি ওই বিভ্রান্তিটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আচমকা মোচড় মেরে উঠে আমি তমোনাশের হাত ধরে টান মারলাম। ও টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার উপর। হাতের বন্দুকটা কানফাটা শব্দে গুলি ওগরালেও, ওর হাত থেকে ছিটকে ভাঙা রেলিং দিয়ে পড়ে গেল নীচের নদীতে। আমি তমোনাশকে জাপটে ধরে হাতের কেসটা ছুড়ে দিয়ে বললাম, কুমু, এটা নিয়ে পালাও।
কুমুদ্বতী উড়ন্ত কেসটাকে মুঠো বন্দি করল। আমি আবার বললাম, “পালাও, তমোনাশকে আমি ধরে রেখেছি।”
কুমু কেসটাকে পিঠে ঝুলিয়ে বলল, “সরি নীল, তমোনাশকে ছেড়ে দাও।”
আমার হাত আলগা হয়ে খসে পড়ল তমোনাশের শরীর থেকে। দেখলাম কুমু পিস্তল তাক করে রয়েছে আমার দিকে।
তমোনাশ উঠে দাঁড়িয়ে লাথি মারল আমায়। ভোঁতা বুট এসে আছড়ে পড়ল পেটে। আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলাম। শুনলাম কুমু বলছে, “ওভার কনফিডেন্স খুব খারাপ। তোমায় প্রথমে আমি সন্দেহ করিনি। কিন্তু পূরবকে ধাক্কা মেরে যেই গোকুল মিশ্রর চশমা ভাঙলে, অমনই সন্দেহ হল আমার। আর সেটা গাঢ় হল, যখন তুমি পূরবকে বললে কে ধাক্কা মেরেছে সেটা তুমি দ্যাখোনি। ছবি পালটে দিলে সেটা যে, গোকুল মিশ্রর ধরে ফেলার এক পার্সেন্ট চান্স আছে সেটাও তুমি রাখতে চাওনি, না? গোকুল মিশ্রর কিপটেমির সুযোগ নিয়েছিলে তুমি। তারপর গতকাল রাতেও তুমি যে বেরিয়েছিলে তা আমি দেখেছি। আজ সন্ধেবেলা হিরণ্যকে দেখতে গিয়ে তুমি চাদরে ঢেকে রাখা বাঁ পায়ের দিকেই তাকিয়েছিলে। আজ সারাদিন তো তুমি হিরণ্যকে দ্যাখোইনি, তা হলে জানলে কী করে কোন পা-টা ওর ভেঙেছে। ওভার কনফিডেন্স তোমায় শেষ করল নীলাম্বর।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিন্তু তমোনাশের সঙ্গে তোমার…”
“ডিকয়,” কুমু হাসল, “ঝগড়া তো? দ্যাখো তো কেমন বোকা বনলে তোমরা। এখন এই রেমব্রান্ট আমাদের, বুঝেছ?”
আমি অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই আচমকা তমোনাশ ধাক্কা মারল আমায়। এবার আমি টাল সামলাতে পারলাম না। রেলিং-এ ঠোক্কর খেয়ে পড়ে গেলাম। এক হাত দিয়ে পাঁচিল ধরার চেষ্টা করলেও তমোনাশ লাথি মারল হাতে। ব্রিজের নীচে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় শুনলাম কুমু বলছে, “গুডবাই।”
ডিগবাজি খেয়ে পা-টা যখন পাথরে লাগল মনে হল বোমা ফাটল বোধহয়। তবে ধাক্কার ফলে পড়ার গতি কমল আর আমি ব্রিজের গায়ে গজিয়ে ওঠা একটা বুনো লতা কোনওমতে ধরে ঝুলে পড়লাম। আমার শরীরের ধাক্কায় দুটো বড় পাথর নীচের নদীতে ‘ঝুপ’ শব্দে পড়ল। ব্রিজের নীচে ঝুলে রইলাম আমি। পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। হাতের জোরই এখন আমার সম্বল। বৃষ্টির হিজিবিজি শব্দের মাঝে তমোনাশের গলা পেলাম, “আপদটা গেল তা হলে। কুমু ছাতাটা খুলে ফোনটা বের করো। খবরটা দিতে হবে।” আমি দেখতে না পেলেও বুঝলাম কুমু ছাতা খুলল। মোবাইল বের করে কানে লাগাল। এবার কুমুর গলা শোনা গেল, “মিস্টার আইয়ারের ফোনটায় রিং-ই হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।”
“ধরছে না? অনুপস্যার তো এমন করেন না। উনি তো বললেন, আমাদের কলের জন্য অপেক্ষা করবেন। এখন ফোন ধরছেন না কেন?”
কুমু বলল, “স্ট্রেঞ্জ! কিন্তু এখানে থাকাও তো ঠিক নয়। আর ক্যাম্পাসে ফিরতেও না করেছেন আইয়ার। চলো, টাউনের দিকে যাই। ওখান থেকে না হয় চেষ্টা করব আবার।”
তমোনাশ জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু যাবে কীসে?”
“কেন?” নীলের গাড়ি ব্রিজের মুখে রাখা আছে তো! গাড়িটাতে উঠে অনেক প্রেমের অভিনয় করেছি। এবার এটাকে অন্য কাজে লাগানো যাক।”
তমোনাশ বলল, “লেটস গো ডার্লিং।”
আমি ঝুলে রইলাম ব্রিজের নীচে। পা-টার যন্ত্রণা এবার ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। মাথাও অসাড় হয়ে আসছে। নীচে বয়ে চলেছে নদী। হাত ফসকালে মৃত্যু নিশ্চিত। আমি জোর করে মাথাটা পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করলাম। কুমু! শেষ পর্যন্ত কুমু। আমি কি অন্ধ? প্রেমে পড়েছিলাম কি? এটা বুঝতে পারিনি তো! আমি শুনলাম, গাড়ির শব্দ হল। আমার প্রিয় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে ওরা। নিয়ে গেল। সামান্য কেঁপে উঠল ব্রিজ। গাড়িটা বৃষ্টির শব্দ নস্যাত্ করে পাহাড় কাঁপিয়ে চলে গেল টাউনের দিকে। আমি সর্বশক্তি দিয়ে লতা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। একবার, দু’বার, তিনবার। নাঃ, হাত ফসকাচ্ছে, তবু চেষ্টা ছাড়লাম না। উঠতে আমায় হবেই।
এদিকে বৃষ্টি আরও জোরে এল। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল উপত্যকা।
॥ ১৩ জুলাই : দীর্ঘতম রাত্রি-৪ ॥
বাঁকের মুখে গাড়ির হেডলাইটটা দেখতে পেল সিজ়ার। এ সময় তো কৃষ্টির দিক থেকে কোনো গাড়ি আসার কথা নয়। তা হলে কি হেঁটে আসছে না লোকটা? গাড়ি করে পালানোর চেষ্টা করছে? কিন্তু ওকে যে ফোনে বলা হয়েছিল লোকটা হেঁটে আসবে। কিন্তু এ তো পালাচ্ছে! আর পালানোর চেষ্টা করলে কী করতে হবে সেটা তো ও জানে। লম্বা ছবি রাখার কেসটা তো আগুন ও বিস্ফোরণ নিরোধক।
ঝাপসা বৃষ্টির ভিতর এগিয়ে আসছে গাড়ি। উজ্জ্বল হেডলাইট চিরে দিচ্ছে অন্ধকার। সিজ়ার চোয়াল শক্ত করল। মানুষ মারতে ভাল লাগে না ওর। কিন্তু ও নিরুপায়। পাশে প্লাস্টিকের আবরণ সরিয়ে আরপিজি-৭ বের করল ও। এই রকেট প্রপেলড গ্রেনেড। বর্তমান বিশ্বে ভীষণ কার্যকরী এক ক্ষেপণাস্ত্র। টিপ করে ট্রিগার টিপলেই হল। লম্বাটে ছুঁচলো মুখের গ্রেনেড গিয়ে আঘাত করবে লক্ষ্যে।
গাড়িটা ভীষণ জোরে এগিয়ে আসছে। জায়গাটার একপাশে পাহাড় হলেও অন্য পাশে ঢালু বিস্তীর্ণ উপত্যকা। সিজ়ার পাহাড়ের খাঁজে দাঁড়িয়ে আরপিজি-৭ তুলে তার নাইট ভিশন ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখল। কালো কাচে ঢাকা গাড়ি। ছোট্ট, কিন্তু খরগোশের মতো ক্ষিপ্র। গতি দেখে নিশ্চিত হল, লোকটা পালাচ্ছে। সিজ়ার ট্রিগারে হাত দিল। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। তাই ঝাপসা দৃশ্যের ভেতর নিশানা ঠিক রাখার জন্য গাড়িটাকে আরও একটু কাছে আসতে দিল ও। ডানদিকে বাঁক নিল গাড়িটা। দূরত্ব এবার ১০০ মিটার। কালো কাচে ঢাকা গাড়িটা গতি কমাচ্ছে না। না, আর নয়, এবার সময় হয়েছে। ট্রিগারটা টিপে পাথরের আড়ালে বসে পড়ল সিজ়ার।
বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনিতে কেঁপে উঠল পাহাড়। গাড়িটা দোতলা বাড়ির সমান ছিটকে উঠে গড়িয়ে গেল ঢালু জমিতে। আগুনের বল পাকিয়ে উঠল আকাশে।
কিছুক্ষণ পরে সিজ়ার হাতে টর্চ নিয়ে বৃষ্টি ভেদ করে এগিয়ে গেল ঢালু জমির দিকে। হাতের টর্চ ঘুরিয়ে খুঁজল কিছু। তবে বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। পাথরের খাঁজে ওই তো পড়ে রয়েছে কালো হয়ে যাওয়া লম্বাটে কেসটা। সিজ়ার হাসল। কেসটা তুলে ও গুঁজে নিল পিঠের ব্যাগে।
তারপর এগিয়ে গেল দূরে অন্ধকারে দাঁড় করানো মোটরবাইকের দিকে। আজ সিজ়ার নিশ্চিন্ত। জব ওয়েল ডান। ও নিশ্চিত, সুধীর বেদী খুশি হবে খুব।
॥ ১৫ জুলাই : টাইটাস ॥
শেষ বিকেলের আলোয় গোলাপি হয়ে আছে উপত্যকা। তার ভিতরে কৃষ্টি আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটির ক্যাম্পাস আজ সেজে উঠেছে। কারণ, আজ ১৫ জুলাই। রেমব্রান্ট হারমেনসজুন ভন রাইনের চারশোতম জন্মদিন। কৃষ্টির ক্যাম্পাসে আজ ছোটখাটো মেলা বসেছে। দেশি-বিদেশি নানা মানুষের ভিড় সেখানে। রাস্তা দিয়ে আরও মানুষ আসছে। গতরাতের বৃষ্টির পর আজ আবহাওয়া শুকনো। সন্ধের দিকে ভিড় আরও বাড়বে, বলল কফিশপের মালিক। নীল ঘড়ি দেখল। ছবির উন্মোচন হবে সন্ধে সাতটায়। তার আগে আছে ছোটখাটো কিছু অনুষ্ঠান। সেন্ট্রাল থেকে মিনিস্টারও এসেছেন। সিকিয়োরিটির ভীষণ কড়াকড়ি। তার মধ্যে দুটো এমন ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
নীল কফির কাপে চুমুক দিল। তমোনাশ আর কুমুদ্বতী যদি ওকে ব্রিজ থেকে ফেলে না দিত, তা হলে এই মিষ্টি ঠান্ডার ভিতর বসে ওকে আর কফি খেতে হত না। ওর সেই গাড়ি করেই তো পালিয়েছিল দু’জন। বিস্ফোরণের পর কত দূরে পড়েছিল ওদের দেহ? পুলিশের কথা অনুযায়ী পোড়া মাংসের টুকরো পাওয়া গিয়েছে কিছু। আর গাড়িটাও প্লাস্টিকের বোতলের মতো তুবড়ে গিয়েছে। গাড়িটার জন্য একটু মনখারাপ হচ্ছে নীলের। কালো কাচ লাগানো গাড়িটা খুবই সুন্দর ছিল। তবে ওর জীবনটা তো বেঁচেছে! এস বি ছবি নেওয়ার নাম করে মৃত্যু ফাঁদ পেতেছিল ওর জন্য। তাই ছবিটা আগুন ও বিস্ফোরণরোধী কেসে ভরে আনতে বলেছিল। কিন্তু মৃত্যু এখনও দূরে। বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকলেও, বেঁচে আছে ও।
এর মধ্যে আবার কৃষ্টির ম্যানেজিং কমেটির দুই সদস্য মারা গিয়েছে। সুধীর বেদীর বাড়িতে তার নিজের লাশের সঙ্গে পাওয়া গেছে অনুপ আইয়ারের লাশও। অনুপ আইয়ারের সঙ্গে তমোনাশকে কথা বলতে শুনেছিল নীল। আর অনুপের সঙ্গেই তো পাওয়া গিয়েছে সুধীর বেদীকে। সুধীর বেদী। এস বি?
তবে এই পরপর দুটো ঘটনার পুলিশ ভীষণভাবে নড়েচড়ে বসেছে। সেন্ট্রাল থেকে ইনভেস্টিগেশন টিমও এসেছে। চারদিকে বিপুল নিরাপত্তা আর চেকিং চলছে। তবু কৃষ্টির অনুষ্ঠান বাতিল হয়নি। ছবি উদ্বোধন পিছোনো সম্ভব নয়। রেমব্রান্টের চারশো বছর উপলক্ষে তাঁর আঁকা পুত্র টাইটাসের অজানা ছবি মানুষের সামনে আনার এ এক অনন্য সুযোগ। নীল জানে, মনীশ উপাধ্যায় এই সুযোগ ছাড়বে না। এমন ছবি এক শতাব্দীতে বার বার খুঁজে পাওয়া যায় না। ছবি। হাসল নীল। কোন ছবি দেখবে মানুষ? চারশো বছর উপলক্ষে কার ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে? রেমব্রান্টের না রাইকারের? ফাদার ফ্রান্সিস বলেন, “মানুষকে বিশ্বাস করো। তার উপর আস্থা রাখো।” কিন্তু জীবন অন্যরকম শিখিয়েছে নীলকে। শিখিয়েছে, স্বার্থের জন্য মানুষ সবকিছু করতে পারে। তাই এস বি-কে বিশ্বাস করেনি ও। নীল জানত এস বি ওকে ঠকাবেই। তাই দ্বিতীয় একটা ছবি নিয়ে এসেছিল ও। না, কুমুকে সন্দেহ করেনি ও। কুমুর প্রতি তো দুর্বল হয়ে পড়েছিল নীল। ওই মুখের দিকে তাকালে তো সব হিসেব উলট-পালট হয়ে যেত। আর তাই অসাবধানও হয়েছিল। যার খেসারত দিতে গিয়ে প্রায় প্রাণটাই চলে যাচ্ছিল। তবে একটা ভুল করেছিল কুমু। ভুল করেছিল তমোনাশ। সুধীর বেদী। সকলে।
কফিশপের দরজার ঘণ্টিটা নড়ে উঠল। তার শব্দে মুখ তুলল নীল। বাঁ পায়ের প্লাস্টার নিয়েও উঠে দাঁড়াল ও।
“তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। ভাগ্যিস বলেছিলে বাঁ পায়ে প্লাস্টার আছে। এটা না দেখলে তো বুঝতেই পারতাম না। দারুণ ছদ্মবেশ নিয়েছ তো। তা, এই নাও তোমার জিনিস।”
ব্রাউন পেপারে মোড়া লম্বাটে জিনিসটা ধরল নীল। বলল, “ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা? টাকাটা ট্রান্সফার করতে হবে তো।”
“টাকা? দাও।” গলায় খুশি ঝরে পড়ল।
নীল ল্যাপটপটা খুলে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে ঢুকল। কয়েকটা ক্লিক করে ঘুরিয়ে দিল ল্যাপটপ। বলল, “প্লিজ়, টাইপ ইয়োর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার।”
“ইয়েস।” খটখট শব্দে নম্বর টাইপ হয়ে গেল। নীল এন্টার টিপে বলল, “টাকা চলে গেল। ইট ইজ় অল ইয়োর্স।”
“আমি আসি। বেস্ট অব লাক। তবে সাবধান, বাইরে পুলিশ থিকথিক করছে।”
আবার দরজা খোলায় টুংটাং শব্দে নড়ে উঠল ঘন্টিটা। কফিশপের চারদিকে চোখ বোলাল নীল। না, কেউ নেই। ও সাবধানে ব্রাউন পেপারের র্যাপারটা খুলল। তারপর মেলে ধরল সামনে। ৭৭ x ৬৩ সেন্টিমিটারে ধরে রাখা হয়েছে এক পিতার স্নেহ। নিজের সন্তানের ছবি তিনি এঁকে রেখেছেন পরম মমতায়। ছবির উপর আলতো করে আঙুল বোলাল নীল। ভাবল, একদিন এখানেও আঙুল ছুঁইয়েছিলেন সেই গম পেষাই কলের মালিকের ছেলেটিও।
নীল মুখ তুলল। কফিশপের কাচের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। ভিড়ের ভিতর ঈষত্ ঝুঁকে তিনি হাঁটছেন। তিনি না থাকলে, তিনি সঙ্গে করে না আনলে, এই ছবি পৌঁছোত না ওর কাছে। এ ছবি ওই পাহারার ভিতর থেকে বের করতে পারত না নীল যদি না তিনি সাহায্য করতেন। ওই চলে যাচ্ছেন তিনি। তিনি, গোকুল মিশ্র।
অ্যামস্টারডাম থেকে ছবি নিয়ে সোজা এই কৃষ্টিতে চলে এসেছিল নীল। প্রৌঢ়ের ছদ্মবেশে ঘুরে দেখেছিল কৃষ্টির ক্যাম্পাস। ঘুরে দেখেছিল আশেপাশের পাহাড়, কৃষ্টির ইলেকট্রিক্যাল জ়োন আর গ্র্যান্ড গ্যালারি। এইখানেই যে রেমব্রান্টকে টাঙানো হবে। সেই সময়েই গ্র্যান্ড গ্যালারি দেখে ও বুঝেছিল একে ভেদ করা সম্ভব নয়। তার উপর ওই লেজ়ার বিম দিয়ে ব্লক করা কাচের দেওয়াল। এ দুর্ভেদ্য। তখনই ওর মাথায় আইডিয়াটা আসে। গোকুল মিশ্রর জীবনী লিখবে বলে ও অ্যাপ্রোচ করে প্রোফেসরকে। বলে, এর জন্য পাবলিশার টাকাও দেবে। টাকা, গোকুল মিশ্রর একমাত্র দুর্বলতা। রাজি হয়ে যান প্রোফেসর। এক লাখ টাকা আগেভাগেই ধরিয়ে দেয় নীল।
এদিকে ছবি বদলের সময় এগিয়ে আসছিল। নীল বুঝতে পারছিল, গোকুল মিশ্রকে বলার সময় হয়েছে। কিন্তু সংশয়ও ছিল। প্রোফেসর যদি রাজি না হন?
প্রস্তাব শুনে একটুও অবাক হননি গোকুল মিশ্র। মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, “এক কোটি টাকা দিলে কাজ হয়ে যাবে।”
“দেব,” পালটা হেসেছিল নীল, “তবে ছবি পাওয়ার পর।”
“কিন্তু ছবিটা পালটাব কী করে? ছবির সঙ্গে আমি তো একা হতেই পারি না। চারদিকে গার্ড থাকে।”
“তার দায়িত্ব আমার।” নীল শান্ত গলায় বলেছিল, “সকলের সামনেই আপনি ছবিটা বদলে দেবেন। কিন্তু কেউ আপনাকে ধরতে পারবে না।”
ডিকয়। যা করব না, তা করার ভান। তাতেই ভুলেছিল হিরণ্য, কুমু, এমনকী এসবি-ও। একটা জিনিস নীল লাগিয়েছিল ট্রান্সফরমার রুমে, তবে তা পিঞ্চার নয় মোটেই। যদি কেউ পিছু নেয়, তাকে ভুল পথে চালিত করার জন্যই এটা করেছিল নীল। ও জানত, হিরণ্যের মুখ দিয়ে ছবি চুরির ঘটনাটা ছড়াবেই। কিন্তু ও তো ছবি চুরির চেষ্টাই করেনি। হিরণ্যকে আহত করে গ্র্যান্ড গ্যালারির ধারে পাশেও যায়নি সে রাতে। ওর লক্ষ্য ছিল ছবি চুরির ব্যাপারে হিরণ্যকে কনভিন্স করানো। ওর উপর হামলায় হিরণ্য কনভিন্সড হয়েছিল। তাই সহজ হয়েছিল কাজটা। নার্সিংহোমে দেখতে যাওয়ার সেই রাতে কাজটা আরও সহজ করে দিয়েছিল হিরণ্যর বাবা। কুমুকে গাড়িতে বসতে বলে ও ফিরে গিয়েছিল বৃদ্ধের কাছে। বলেছিল, “ছেলের চাকরির চিন্তা করবেন না। আপনাকে আর কিছু পরে একটা জিনিস দিয়ে যাব আমি। হিরণ্যকে দিয়ে দেবেন। ওর ভাল হবে।”
এস বি-র সঙ্গে কথা বলে বেরোনোর সময় নার্সিংহোমে গিয়েছিল নীল। রাইকারের আঁকা প্রথম হুবহু নকল ছবিটা যত্ন করে গুটিয়ে একটা চিঠির সঙ্গে দিয়েছিল বৃদ্ধকে। বলেছিল, “এটা সাবধানে পৌঁছে দেবেন হিরণ্যকে।” চিঠিতে ও লিখেছিল-
“হিরণ্য,
ছবিটা চুরি করলেও এখন বুঝেছি অন্যায় হয়েছে। তাই ফেরত দিলাম। তবে খুব সাবধানে এই জিনিসটা নিয়ে যাবে গোকুলস্যারের কাছে। জানাজানি হলে কৃষ্টির সঙ্গে তোমারও বদনাম হবে। গোকুলস্যারকে বোলো, মনীশ উপাধ্যায়কেও বোলো। ওরা আমার বদলে দেওয়া নকল ছবিটা খুলে তার জায়গায় লাগিয়ে দেবে এই আসল ছবিকে। তুমি বাঁচবে, কৃষ্টি বাঁচবে, দেশের সম্মানও বাঁচবে। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো।
ইতি-
তোমার বন্ধু।”
বন্ধু! কে কার বন্ধু? হিরণ্য হাতে স্বর্গ পেয়েছিল নিশ্চয়ই। চুপিচুপি ছবিটা নিয়ে গিয়েছিল গোকুল মিশ্র ও মনীশ উপাধ্যায়ের কাছে। সকলের সামনে আসল ছবিটা খুলে রাইকারের আঁকা হুবহু এক দেখতে নকল ছবিটা লাগিয়েছিলেন গোকুল মিশ্র। আর আসলটা বাতিল করে রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে। যেটা এখন নীলের হাতে। আর রাইকারের আঁকা দ্বিতীয় নকল ছবিটা এস বি-র লোককে পৌঁছে দিতে গিয়ে তাই নিয়ে মারামারি করে কতজনই না মারা গেল! ভাগ্যিস দ্বিতীয় ছবিটা বুদ্ধি করে আঁকিয়ে রেখেছিল ও। নীল হাতের লাঠিতে ভর করে উঠল। প্লাস্টার করা বাঁ পা-টা টেনে টেনে দাঁড়াল বাইরে এসে। ওই দূরে কৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় চকচক করছে ছ’তলার কাচের দেওয়াল। তার ভিতরে নানা মানুষ জড়ো হচ্ছে। একটু পরে মাননীয় মন্ত্রী উদ্বোধন করবেন ছবির। ছবির রেস্টোরেশনের জন্য বাহবা কুড়োবেন গোকুল মিশ্র, প্রদর্শনীর জন্য প্রশংসা পাবেন মনীশ উপাধ্যায়।
আর নীল? না অদম্য সেন? নাকি অ্যাডাম। আসলে কে ও? কী ওর নাম? পরিচয়ই বা কী? ও কেউ নয়। ও অদৃশ্য মানুষ। এই ছবি নিয়ে এবার ওকে উড়ে যেতে হবে ফিজি। সেখানে একজন অনেক অনেক টাকা নিয়ে অপেক্ষা করছে। টাকা। অর্থ। চারটে অনাথাশ্রমকে ফান্ডিং করতে হয় ওকে। ক্ষুধার্ত শিশুরা ছবি বোঝে না, শিল্প বোঝে না। কেবল বাঁচার লড়াই বোঝে। ছোটবেলায় বাবার কাছে শোনা রবিনহুড ছিল ওর প্রিয় চরিত্র। ফাদার ফ্রান্সিস বলেন, “রবিনহুড হওয়ার চেষ্টা করিস না।” ও চেষ্টা করেও না। শুধু বাবার কথা মনে রাখে। বুকের কাছে রেখে দেয় বাবার তোলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ওর ছবি। টাইটাসের ছবি।
ও হাতের দিকে তাকাল, কোথায় যেন রেমব্রান্ট আর ওর সামান্য বাবা, এক। না, বাবা যতদিন আছে ওর সঙ্গে, ও একা নয়। কৃষ্টির দিকে এগোনো মানুষের ভিড় ভেঙে উলটোদিকে হাঁটতে লাগল ও। মনে পড়ল বাবার শেষ কথা, “তুই, একা হবি না কোনওদিন, জানবি আমি আছি তোর সঙ্গে।”
ও গুনগুন করে গাইতে লাগল,
Walk on, walk on, with hope in your heart.
And you’ll never walk alone
You’ll never walk alone…