কিপটে
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই একটু ফিক করে হেসে ফেললেন প্রিয়নাথ সান্যাল।
সকালটা ভারী চমৎকার আজকে। ঝিরিঝিরি প্রসন্ন বাতাস বইছে চারিপাশে। পোষা নেড়ি মিষ্টি দরজার কাছে ভারি মনোরম ভাবে শুয়ে। নরম মিঠে রোদ চারিপাশে মিহি গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে আছে।
ভারী অলস ভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙলেন প্রিয়নাথ, সংগে একটা খুব তৃপ্তির হাই।
কাল খুব জোর বাঁচা গেছেন উনি। প্রায় সারাদিন ধরে ছোটবোন সুবর্ণা এসে হাতে পায়ে ধরে সে কি কান্নাকাটি। কি না, ওর একমাত্তর ছেলে, শিবরাত্তিরের সলতে, তার কিডনি পাল্টানো হবে, আর তার জন্যে লাখ চারেক টাকা চাই।
শুনেই তো প্রিয়নাথের আত্মারাম খাঁচাছাড়া। একটা দুটো টাকা নয়, চার চার লাখ? বলি চারের পর কতগুলো শূন্য হয় কোন আন্দাজ আছে তোর?
এই যে তুই কারুক্কে না বলে বেজাতের ওই ছোকরা মাস্টার কে বিয়ে করে ভাগলবা হলি, এতো বড় কেলেঙ্কারি বাপ মায়ের মাথায় চাপিয়ে, বলি আমার ভরসায় করেছিলি? আর সে বাবুও যে স্কুলে টুকলি আটকাতে গিয়ে পটলোত্তলন করলো বিয়ের বছর তিনেকের মধ্যেই সেটা কি আমার সংগে কন্সাল্ট করে করেছিল নাকি র্যা? এখন যদি দুদিনের মধ্যে অপারেশন না করলে ছোকরা ফুড়ুৎ হয়, তবে সেটা কোন আইনে আমার দায়িত্ব হিসেবে বর্তায় শুনি?
ভাবতেই গা টা রি রি করে ওঠে প্রিয়নাথের। চাআআআর লাআআআখ টাকা! মামদোবাজি, নাকি? নাকি উনি কি দানছত্তর খুলে বসেছেন ? বলি সবাই ভেবেছেটা কি অ্যাঁ? হুঁঃ, কার কোথায় কে ছেলে মরছে, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কার পড়াশুনা হচ্ছে না, কোন ভিখিরির ছেলের ক্যান্সার, সবার জন্যেই শালা ওনার পেছন খুলে দিতে হবে নাকি,যত্তসব।
শেষে সুবর্ণা মাথা নিচু করে জলভরা চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন প্রিয়নাথ। উফফ, কি কষ্টেই টাকাগুলো বাঁচাতে পেরেছেন উনি। আজ বড় সুখের সকাল!
আনন্দে একটু ফিক করে হেসেই ফেললেন এলাকার ডাকসাইটে কিপটে প্রিয়নাথ সান্যাল। অবশ্য উনি নিজেকে কিপটে বলেন না, বলেন হিসেবী। বছর পাঁচেক বাদে বাদে হাওড়ার মঙ্গলা হাট থেকে জামাকাপড় হিসেব করেই কেনেন,সুবিধা এই যে প্যান্ট, বিছানার চাদর আর দরজার পর্দা একইসঙ্গে হয়ে যায়। তবে খাওয়ার শখটা পুরোমাত্রায় বজায় রেখেছেন উনি, সে স্বীকার করতে ওনার সমালোচকরা বাধ্য, মাছ তো দুহপ্তায় একদিন খাওয়া হয়ই। উনিশ ”বছর আগে কেনা সেকেন্ড হ্যান্ডে কেনা টিভিটার অবস্থা যদিও কহতব্য নয়, ক্যাটরিনা ক্যাইফ কে গোবিন্দার মতন দেখায়, হাশিম আমলাকে উসেইন বোল্ট। তবে ঘোরাঘুরি কিন্তু লেগেই আছে। এই তো বছর পাঁচেক আগে মন উচাটন হওয়াতে ডানলপ থেকে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গেছিলেন,পুরো তিরিশ টাকা খরচা করে! সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে? আরো যদি ওঁর বাড়িতে অন্ধকার থাকা নিয়ে কথা ওঠেই, তবে জেনে রাখা ভালো যে ইলেক্ট্রিক আলোতে ওনার মাথা ধরে, খুব দরকার ছাড়া আলো জ্বালান না, মোদ্দা কথা অকারণে কাউকে হতচ্ছেদ্দা করাটা ঠিক না। রাতের দিকটা আলো বলতে মোমবাতিই ভরসা বটে, তবে তাতে আরেকটা সুবিধা যে রাত্তিরে আলো আঁধারিতে শুধু গামছা পড়ে থাকলেই চলে। আর দাড়ি কামানোর পর বুরুশের সাবান ফেনা দিয়ে যদি উনি স্নান করেনই, তাতে কার কি হে? হপ্তায় একদিন সাবান আর শ্যাম্পু না করলে কি মান থাকে রে ভাই? এক খরচায় তিনটে কাজই হয়ে যায়, দাড়ি, শ্যাম্পু আর সাবান, হপ্তায় একদিন।
এই এতো এতো খরচাপাতির পর যদি কেউ বেমক্কা চাআআআর লাখ টাকা চেয়ে বসে, কার মাথা ঠিক থাকে দাদা, আপনিই বলুন?
উফফ, পরশুই ব্যাংকে গিয়ে দেখে এসেছেন মাত্তর সাতানব্বই লাখের মতন জমেছে,গরীবের বুকের রক্ত জল করে জমানো খুদকুঁড়ো বললেই চলে, তার থেকে বুকের পাঁজর খসানো চার চারটে লাখ টাকা, মা গো, স্রেফ দান করে দেওয়া?
মা ত্তারা ব্রহ্মময়ী, মা গো, তুমিই বাঁচিয়েছ মা!
চোখ বুজে হাত জোড় করে একটা প্রণামই ঠুকে দিলেন প্রিয়নাথ। তারপর চোখ খুলেই হাঁ।
ঠিক ওনার সামনে চেয়ারে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। ফর্সা গায়ের রঙ, কেঁকড়ানো চুল, রোগা দোহারা শরীর। ভারি মিষ্টি দেখতে। চোখে একটু দুষ্টুদুষ্টু ভাব, নিখুঁত করে কামানো গোঁফদাড়ি। চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে হাত তুলে নমস্কার করলেন ভদ্রলোক, ‘গুড মর্নিং প্রিয়নাথ বাবু। কেমন আছেন?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মিনিট তিনেক হাঁ করে ছিলেন প্রিয়নাথ, পরে খেয়াল হতে সন্তর্পণে মুখটা বুজিয়ে নেন, স্খলিত ন্ট্রে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কে মশাই? ঘরে ঢুকলেন কি করে?’
একটু অপ্রস্তুত হলেন বোধহয় ভদ্রলোক। গলা খাঁকড়ে বলেন ‘ইয়ে হঠাৎ এইভাবে এসে পরেছি বলে সরি স্যার। কিন্তু না এসে উপায়ান্তর ছিলো না বলেই, মানে খুব বাধ্য হয়েই আর কি, হেঁ হেঁ’।
‘হেঁ হেঁ মানে? বলি এটা কি মশাই ধর্মশালা না আপনার তালুইমশাইএর বৈঠকখানা? কোন আক্কেলে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়লেন মসাই? চুরি ডাকাতির মতলব নাকি?’
‘অ্যাঁ? আরে ছিছিছি….রামো রামো, কি বলছেন মশাই? একটু না বাড়িতে ঢুকেই পড়েছি, তাবলে একেবারে চোর জোচ্চর ভেবে বসলেন? বলি ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই একটা আমার?’
‘ইঃ, ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির এয়েচেন রে। এই সাতসকালে চুপিসাড়ে টুকটুক করে আমার বেডরুমে ঢুকে পড়ার মানেটা কি অ্যাঁ? পুলিশ ডাকবো নাকি দাদা?’
ভদ্রলোক পুরো কেতরে উঠলেন ‘ প্লিজ পুলিশ ডাকবেন না, কিছুতেই না, ন্না ন্না ন্না’।
খুবই সতর্ক হলেন প্রিয়নাথ। রোগাভোগা শরীর, ঝাঁপিয়ে পড়লে মনে হয় কবজা করতে বেশি অসুবিধা হবে না। বন্দুক ফন্দুক নিয়ে আসে নি তো আবার? মাওবাদী কি সন্ত্রাসবাদী নয় তো? ওদের নাকি অসাধ্য কিছু নেই, যেখানে পারছে ঢুকে বন্দুকফন্দুক চালিয়ে, খুনখারাপি করে, সে একাকার কাণ্ড…
গলা খাঁকড়ে নেন উনি, সন্দেহজনক কারও সামনে যে বসে আছেন সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই, মাওবাদীও হতে পারে, বা পাকিস্তানের এজেন্ট। ছদ্মবেশী বারাক ওবামা হলেই বা আটকাচ্ছে কে? খুবই সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করেন,’ ঝেড়ে কাসুন তো মশাই। বলি মতলবটা কি? আমার বাড়িতে কিন্তু একটা ফুটো কড়িও পাবেন না, আগে ভাগে বলে রাখলুম। বরং একটা ছেঁড়া গামছা আছে, সতের বছরের আগে কিনেছিলুম, অ্যান্টিক হিসেবে ভ্যালু কম নয়, সেইটে দিতে পারি, নিয়ে মানে মানে বিদায় হন দিকিন’।
ভদ্রলোক একবারে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, ‘আরে ন্না ন্না, ছি ছি, আমাকে ইয়ে ভেবেছেন নাকি? ছ্যা ছ্যা’ তারপর ঘাড়নাড়া থামিয়ে খুবই লজ্জিত ভাবে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে থাকেন ও ভারি মৃদুস্বরে বলেন ‘ দেখুন ব্যাপারটা বলতে আমার খারাপই লাগছে, কিন্তু কি করি বলুন তো, এদিকে না বললেই নয়। আপনি কিন্তু স্যর কথা দিন কিছু মাইন্ড করবেন না প্লিজ’।
‘দেকুন ন্যাকা মেনিমুখো ম্যাদামারা লোকজন আমার মোটে পচ্ছন্দ নয়। বাঙালি কবিদের এইরকম অম্বলে ভোগা পেটরোগা ম্যাদামারা ন্যাকাপনা থাকে। তা মশাই কি কবি নাকি?’
‘আরে ধুর। লজ্জা দেবেন না। সে বলতে গেলে একবার দুবার ছোটবেলায় লিখেছিলাম বটে, শুনবেন নাকি দুটো লাইন?’
এই বলেই ভদ্রলোক উদাস ভঙ্গিমায় খুবই দরদ দিয়ে আবৃত্তি করতে থাকেন, বেশ হাত পা খেলিয়ে, পয়ার ছন্দে,
‘পাতায় পাতায় ঝড়ে নিশার শিশির/ তাতে কি বা যায় আসে আমার পিসির।
স্কুলে যেতে ভয় করে শীত ও সামার/ সুযোগ পেলেই যাই বাড়িতে মামার।
(সেথা) আচার পাহারা দেয় রামন মিশির/
নিশীথে বানানো আচার আমার পিসির।’
কি ভাব! কি ভাষা!! খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন প্রিয়নাথ, চোখে জল। তারপর লুঙ্গির খুঁট তুলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন ‘ আহা, আহা, বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। মশাই যে বেশ নামজাদা কেউকেটা একজন তা পষ্ট বুজতে পারচি। সেই মাইকেল কি নবীন সেন, তারপর এই আপনি। বলি পরের বছরকার নোবেলের দিকে তাগ করচেন নাকি? জমিয়ে করুন দিকিন, দেখবেন যেন ফস্কে না যায়, হেঁ হেঁ। তা এমন গণ্যমান্য ব্যাক্তিটি সক্কাল সক্কাল আমার কাচে যে? আর তাছাড়া মহাশয়ের নামখানি যে বলতে হচ্চে যে এবার। কি করা হয় মহাশয়ের? থাকেন কোথায়? জোড়াসাঁকোর দিকে নয় তো? হ্যা হ্যা হ্যা’।
‘ইয়ে, আমি একজন লোকপাল স্যার। সাউথ থেকে আসছি’
‘লোকপাল?মানে লোকপাল বিল? সে কি পার্লানেন্টে পাস হয়েচে নাকি? যাঃ জানতে পারলুন না যে? টিভিটাও মাইরি…. খবর শোনাচ্ছে না অর্শের বিজ্ঞাপন, বোঝাই যায় না। আর সাউথ থেকে মানে? গড়িয়া না ব্যায়লা?’
‘আরে না না সাউথ, মানে একদম সাউথ’
‘সে কি? এমন চমৎকার ঝরঝরে মিঠে শান্তিপুরী বাঙলা বলছেন যে?’
‘আরে লজ্জা দেবেন না স্যার, আমি এমনিতেও খুবই লাজুক মানুষ, হেঁ হেঁ।’
‘বাঃ বাঃ। আই অ্যাম ভেরি ইম্প্রেসড ইয়াং ম্যান। এই বয়েসেই অত ওপরে উঠেচ, পার্লামেন্টারি ব্যাপারে আচো, অন্য ভাষাও এত চমৎকার বলচ, অথচ এত বিনয়। গুড গুড, এই দ্যাকো, আবার তুমি বলে ফেল্লুম। কিচু মনে কোর না বাপু, বয়সে ছোটই হবে আমার থেকে, কি বল?’
‘আরে সে তো বটেই, সে তো বটেই, হেঁ হেঁ।’
‘তা বাপু নাম গোত্তর কিচু বল। আমরাও ভারি সাউথ ইন্ডিয়ানদের ইয়ে করি, বুজলে। কি কালচারাল ইয়ে, আর কি ফটাফট ইংরেজি, আদ্দেক তো বুজতেই পারি না, হেঁ হেঁ। এই তো পাশের ফ্ল্যাটে রঙ্গনাথনদা থাকেন। ভারি মাই ডিয়ার লোক। এই তো ইচ্ছে আছে এই ডিসেম্বরেই একবার ওদিকে..’
‘আজ্ঞে আমার নাম কৃতান্তকুমার আদিত্য’, ভারি বিনয় সহকারে বলেন ভদ্রলোকটি।
‘বাহ বাহ। একটু সেকেলে বটে, তবে কিনা চমৎকার। বুঝলে বাবা, আমরা তো পুরোন যুগের লোক, আমাদের এই রকম নামই পচুন্দ। বাহ বাহ। তা আমাদের ইস্কুলে পড়াতেন অরূপ আদিত্য, হাওড়ার প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়, তা তেনার কেউ হও নাকি? না বলচ? তা বেস। তা বাবাজীবন এয়েচ কি করতে সেটা তো খোলসা করে বলতে হচ্চে এবার।’
একটু গলাটা খাঁকড়ে নেন কৃতান্তবাবু, তারপর খুবই মিষ্টি হাসিমুখে বলেন ‘এবার একটু উঠতে হচ্ছে যে স্যার। আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
মুহূর্তে চনমনে হয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। নেমন্তন্ন নাকি? অথবা কাঙালিভোজন? নাকি হরিসংকীর্তন? নাকি কোন সভাসমিতি? ও হো, এ সেই ‘নিখিল বংগ কৃপণচূড়ামণি সমিতি’র সংবর্ধনা নয় তো?
যাক, একবেলার খাবার খরচটা বেঁচে যাচ্ছে তাহলে!! যদিও মুখে একটু বিব্রতভাব বজায় রাখেন,
‘সে কি? কোতায়? এই সক্কাল সক্কাল? ধুর বাপু হুট করলেই যাওয়া যায় নাকি? বলি একটা সময় বলে তো বস্তু আচে না কি? আমার যে আরও দশটা কাজ আচে বলি সে কথাটাও তো ভাবতে লাগে?’
‘ইয়ে, বলছিলাম কি স্যর, এইটাই আপনার সময় ঠিক হয়েছে। একটু কষ্ট করে গা তুলতে হচ্ছে যে স্যর।’
‘মানে, এসব কি ভাই? না গেলে কি করবে?’ একটু ঘাবড়েই যান প্রিয়নাথ।
‘না গিয়ে আপনার একদম উপায় নেই স্যর। সত্যি বলছি।’ কথাগুলো কাতর অনুনয়ের মতই শোনায়।
‘দ্যাখো বাপু, ইয়ে জ্বালিও না বেশি। আমি তোমাকে ইনভাইট করে আনিনি একটুও। তুমি এখন যেতে পারো। দুগগা দুগগা।’ বিরক্তিসহকারেই বলেন প্রিয়নাথবাবু।
একটু ম্লান হাসেন আগন্তুক, ‘আমাকে কেউ ইনভাইট করে না স্যর। আমি বিনা ইনভিটেশনেই আসি। এসে বরং আমিই ইনভাইট করি’।
প্রিয়নাথ এতক্ষণ যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছিলেন। শেষ কথাটা শুনে ধন্দে পড়ে গেলেন। ছোকরা চায় কি?
‘তোমার কতা কিচুই বুঝছি না হে?’
‘কেন? এই সহজ জলবত্তরং কথাটা পাকা মাথায় খেলছে কেন বলুন তো? ‘
খানিকক্ষণ ভ্রুকুটিকুটিল চোখে চেয়ে রইলেন প্রিয়নাথ। সকাল সকাল মশকরা ওনার মোটে পছন্দ না। কিন্তু কি একটা কথা মনের ওপর ঘাই মেরে উঠতে চাইছে, উনি ধরি ধরি করেও ধরতে পারছেন না।
তরিৎগতিতে সোজা হয়ে উঠে বসলেন উনি, ‘নামটা কি বললে আরেকবার বলতো বাপু’।
বিনয়ে প্রায় ঘাড় বেঁকে গেলো ভদ্রলোকের, ‘আজ্ঞে, কৃতান্তকুমার আদিত্য। ডাকনাম একটা আছে অবশ্য, তবে কিনা এই নামটাই ভেবেচিন্তে…… ‘
থরহরি কেঁপে উঠলেন প্রিয়নাথ,
‘আ আ আ আপনি মানে.. আ আ আপনি ‘
‘এই দ্যাখো, আবার আপনি আজ্ঞে কেন? তুমিটাই তো দিব্যি মিষ্টি শোনাচ্ছিল’।
‘প্রভু, প্রভু, ক্কি সৌভাগ্য। আপনি…
‘সে কি স্যর, সৌভাগ্য কি বলছেন? আমাকে দেখলেই তো বেশিরভাগ লোক কেঁ কেঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আপনার কিন্তু স্যর, সাহস হ্যাজ, মানতেই হবে। এখনো টসকান নি, এ বড় সহজ কথা নয় কিন্তু। মাইরি বলছি’।
প্রিয়নাথ সোজা বুটপদ্মে উপুড় হয়ে পড়েন, ‘দয়া প্রভু, দয়া করুন।’
‘এই দ্যাখো। দয়া করার আমি কে? আর দয়া করার আছে টাই বা কি?’ প্রিয়নাথ কে ধরে সস্নেহে বিছানায় বসিয়ে দেন উনি ‘ইউ হ্যাড আ লং ফুলফিলিং লাইফ। এখন দিব্যি হাসতে হাসতে আপনার তো টা টা বাই বাই করার কথা। নিন, ঝটপট রেডি হয়ে পড়ুন তো’।
ককিয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ, ‘ফুলফিলিং লাইফ? কি বলছেন প্রভু? সারা জীবন ভালো খাইনি, পড়িনি। কোত্থাও ঘুরতে যাইনি, আনন্দ করিনি। কিসের ফুলফিলিং লাইফ প্রভু ?’
ফেঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালেন আগন্তুক,শিকনিটা জামার হাতায় মুছে ফেলেন, ‘তা সেগুলো করতে কি কেউ বারণ করেছিল স্যার? কি বলি বলুন তো? ইচ্ছে কি আমারই করে স্যর এইসব করতে। কিন্তু ডায়রি তে যে লেখা আজই আপনার দিন। অর্ডার এসে গেছে স্যর। নিন উঠে পড়ুন। মন দুর্বল করে ফেলাটা কোন কাজের কথা নয়। ওতে শ্লেষ্মা, পিত্তবিকার, উদুরি, অম্লশূল, এসবের ঝামেলা থাকে। রেডি হয়ে নিন স্যর। চুলটা আঁচড়ে নেবেন নাকি? নাকি থাক? বেশ একটা ক্যাজুয়াল বিউটি হাবভাব নিয়েই যাবেন? তাহলে তাই চলুন স্যর,এগোন যাক? ‘
‘কোন চান্স নেই প্রভু? কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না?’
‘কি যে বলেন। এ কি রাজধানী এক্সপ্রেসের রিজার্ভেশন নাকি, যে মিনিস্টার কোটায় একটা ব্যবস্থা করে দেবো?’
‘কিছু একটা করুন স্যর। এতদিন ধরে এত্ত কষ্ট করলাম, কিচ্ছু ভোগ করতে পারবো না?’
‘উমম, না ই তো মনে হচ্ছে’।
‘ইয়ে, প্রভু, শুনুন না। বলি সাতানব্বইয়ের হাফ কত হয়।’
‘এইটে কি অংক কষার সময় স্যার? ক্যালকুলেটরটাও হারামজাদা চিতু ঝেঁপে দিয়েছে লাস্ট উইক, কিন্তু জেনে হবেটাই বা কি?’
‘আমি বলছি প্রভু, উনপঞ্চাশের একটু কম। ওই পুরোপুরি উনপঞ্চাশই ধরুননা।’
‘ধরলুম। তো? ‘
‘বলছি কি, পুরো উনপঞ্চাশই, না পাকাপাকি পঞ্চাশই আপনার প্রভু। কড়কড়ে হার্ড ক্যাশ, আধঘণ্টার মধ্যে গরমাগরম… খিড়কি দরজা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ুন, কেউ জানবেও না যে আপনি এসেছিলেন। প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখবেন একটু’।
যমরাজ পাক্কা এক মিনিটের জন্যে বিঘতখানেক হাঁ করে চেয়ে রইলেন, তারপর কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছে হাঁ টা বুজিয়ে স্খলিতস্বরে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে ঘুষ দিচ্ছেন নাকি স্যর?’
‘আ হা হা, ঘুষ কেন হবে? প্রণামী বলুন স্যর। এই যে ঠাকুর দেবতা দেখলেই আট আনা এক টাকা করে দানবক্সে ফেলতুম, সে কি ঘুষ প্রভু? এইটে বরং আপনাকে সরাসরি দিচ্ছি। আপনিও হ্যাপি, আমিও হ্যাপি।’
উদাস হয়ে পড়েন যমরাজ ‘কি আর বলবো স্যর। আপনি বোধহয় এখনো আমাদের অপারেটিং মডেলটা বুঝে উঠতে পারেন নি। আমাদের ওদিকে ভিজিলেন্সও যেমন হারামি, অডিটও তেমনই ত্যাঁদড়। আমারই কি ইচ্ছে করে না একটু ভালোমন্দ খেয়ে পড়ে থাকতে?’ ধরে আসা গলাটা খাঁকড়ে পরিষ্কার করে নেন যমরাজ, ‘ আপনি বরং উঠুন স্যর, আমার আরো দুটো কাজ আছে আজ, ইশশ, বড্ড লেট হয়ে গেলাম।’
‘প্রভু প্রভু, জাস্ট একটি বছর’
‘উঁহু’
‘একটা মাস অন্তত দিন’।
‘নাঃ’
‘ এক সপ্তাহ?’
‘স্যর, এ কি কোলাঘাটের ইলিশ?’
‘লাস্ট প্রভু, একটা দিন, জাস্ট একটা দিন, তারপর হাসি মুখে’
‘বেকার সময় নষ্ট করছেন স্যর। চটি পরেই যাবেন বলছেন? চলুন তাহলে, দুগগা দুগগা।’
‘একটা মিনিট প্রভু, প্লিজ প্লিজ’।
‘উফফ, বড্ড জ্বালান মশাই। নিন উঠুন’, এই বলে যমরাজ একটা হাত দিয়ে ওনার ঘাড়ে ধরতেই জ্ঞান হারালেন প্রিয়নাথ বাবু।
***************
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন প্রিয়নাথ। সকালে তীব্র আলোয় চোখটা কুঁচকে গেলো। সারা গা ঘামে ভিজে জবজব করছে।
স্থির হয়ে বসে রইলেন খানিকক্ষণ।
স্বপ্নটা যদি সত্যিই হত? সত্যিকারের সত্যি হত? সত্যিই যদি কোনমুহুর্তে ডাক এসে যায় বিনা নোটিশে একদিন, তখন কি করবেন প্রিয়নাথ এই ঐশ্বর্য নিয়ে?
আর যার নোটিশ এসে গেছে আগে থেকে? ঢাক ঢোল বাজিয়ে? এবং যে নোটিশ ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা প্রিয়নাথ রাখেন, তার বেলা?
মনে হল কেউ যেন জীবনের দাবাখেলায় একটা কিস্তিমাতের চাল চেলে দিয়ে কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করছে প্রিয়নাথের হাবভাব, ঠেঁটের কোণে একটা বিদ্রূপের হাসি ঝুলিয়ে, যেন জিজ্ঞাসা করছে, ”এবার কি করবে প্রিয়নাথ, এবার?”
উঠে দ্রুত নিজের আলমারি হাঁটকাতে থাকেন উনি,আহ চেকবইটা কোথায় গেলো?
কোথায় যেন ভর্তি আছে সুবর্নার ছেলে? আহ,নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। এখানেই কাগজের টুকরোটা রেখেছিলেন না?
পাগলের মতন সবকিছু ওলটপালট করে খুঁজতে থাকেন প্রিয়নাথ। দাবার চালটাকে পালটা ফিরিয়ে দেওয়া খুব জরুরি।
এক্ষুণি।।