কিন্তু

কিন্তু

সেদিনের আলোচনাটা ছিল ভৌতিক।

আকাশে অন্ধকার, বাইরে বৃষ্টির টাপুর-টুপুর হু-হু করে বয় ভিজে বাতাস— এরই মধ্যে বসেছে আমাদের সান্ধ্য-আসর। এমন সময়ে ভূতঘটিত আলোচনাই জমে ভালো।

পেয়ালার শেষ চাটুকু পেটে চালান দিয়ে চরণদাস বললে, ‘আদিমকাল থেকেই মানুষ ভূত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আসছে, কিন্তু আসলে ভূতকে যে কীরকম দেখতে, আজ পর্যন্ত সেইটেই স্থির হল না। এক একজন লোক ভূতের এক-এক রকম বর্ণনা দেয়। কেউ বলে ভূত হচ্ছে অমানুষ, কেউ বলে কিম্ভূতকিমাকার বলে তাকে অবিকল মানুষেরই মতন দেখতে, কেউ বলে আরও কত কী! এক-শো রকম মতো। এর মানে কী?’

ভজহরি বললে, ‘এর মানে হচ্ছে স্বচক্ষে কেউ ভূত দেখেনি, সবাই পরের মুখে ঝাল খায়।’

ভূপতি বললে, ‘সেইজন্যেই তো আমি ভূত মানি না।’

ভজহরি বললে, ‘তুমি ভূত মানো না, কিন্তু তোমার ভূতের ভয় আছে!’

‘তা থাকতে পারে? সেটা অহেতুক ভয়।’

আমি বললুম, ‘বন্ধুগণ বৃথা তর্কে দরকার নেই। তার চেয়ে আমি আরও কিছু গরম চা আর মুড়ি-ফুলুরি আনাই, তারপর একটা গল্প বলি।’

‘ভূতের গল্প?’

‘যা বলব তা ভূতের গল্প কি আমার গল্প সেটা আমি আগে থাকতে বলে রসভঙ্গ করতে চাই না।’

‘কিন্তু সত্যি গল্প তো?’

‘তোমরা বিশ্বাস করো আর না করো, কিন্তু ঘটনাটা আমার জীবনেই ঘটেছে।’

‘আচ্ছা, অন্তত আরও কিছু গরম চা আর মুড়ি-ফুলুরির খাতিরে তোমার গল্পটা মিথ্যা হলেও আমরা শুনতে রাজি আছি। আর কী জানো, এমন বাদলার সন্ধ্যায় ভূতের গল্প মিথ্যা হলেও শুনতে মন্দ লাগে না।’

আকাশে আরও ঘনিয়ে উঠল মেঘের ঘটা এবং আরও উচ্চগ্রামে উঠল বৃষ্টির সংগীত। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে গায়ে উড়ে আসতে লাগল জলের ছাট।

এল চা, এল মুড়ি-ফুলুরি, বেগুনি, শশা, নারিকেল ও কাঁচালঙ্কা প্রভৃতি। বাদলার গল্প জমাবার জন্য অনুষ্ঠানের ত্রুটি হল না।

চায়ে চুমক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে শুরু করলুম আমার কাহিনি—

তখন আমি বিহারের একটি পাহাড়ে জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। ‘বেড়াতে’ মানে, ডাক্তারের নির্দেশে লুপ্ত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে।

জায়গাটি সত্যসত্যই মনোরম। কলকাতায় যা পাওয়া যায় না, সেই পাহাড়, প্রান্তর, অরণ্য, ঝরনা, নদী কিছুরই অভাব নেই। বাতাসেও নেই ধুলোর ছিটে, ধোঁয়ার গন্ধ। মোটর-বাস-ট্রামের হুল্লোড়ের বদলে শোনা যায় বিহঙ্গদের সংগীত। যা দেখি, যা শুনি সবই ভালো লাগে।

সকালে-বিকালে করি পদচালনা। কোনোদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াই, কোনোদিন পাহাড়ের টঙে উঠে পৃথিবীর ছবি দেখি, কোনোদিন বাড়ির শিশুদের সঙ্গে নদীর ধারে বসে পুঁটিমাছ ধরি।

দিন কাটে নিশ্চিন্ত আরামে। মনের ও দেহের উন্নতি হয় একসঙ্গে। জায়গাটি এমন পছন্দ হল যে স্থির করলুম, এখানে মাঝে মাঝে এসে অবকাশযাপন করবার জন্যে খানিকটা জায়গা নিয়ে বাসা বাঁধব।

জনৈক স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, ‘নদীর পথে যেতে শেষ বাড়িখানা দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ। দেখলে পোড়ো বাড়ি বলে মনে হয়।’

‘ঠিক তাই। মানবেন্দ্র রায়চৌধুরি নামে কলকাতার এক জমিদারের শখের বাড়ি। ওই বাড়িতেই এক দুর্ঘটনায় মানবেন্দ্রবাবু সপরিবারে মারা পড়েন। তারপর থেকে বাড়িখানা খালি পড়ে আছে। সাধারণ লোকের কুসংস্কার জানেন তো, বেশিদিন কোনো বাড়ি খালি পড়ে থাকলেই লোকে বলে, হানাবাড়ি। আমি ওসব বাজে গুজবে বিশ্বাস করি না। ইচ্ছা করলে আপনি ওই বাড়িখানা খুব সস্তায় কিনতে পারেন।’

জনসাধারণের কুসংস্কার আমিও কোনোদিন আমলে আনিনি। ভূতপ্রেতের গল্পকেও কথার কথা বলে মনে করি। পঞ্চভূতে গড়া যে নশ্বর দেহ শ্মশানে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, আত্মা আবার তা ফিরে পেতে পারে না। নদীর পথের পোড়োবাড়ির কথা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে লাগলুম।

দিন তিনেক পরে একদিন নদীর পথ দিয়ে বেড়িয়ে ফিরছি, সন্ধ্যা তখন আসন্ন। হঠাৎ আকাশ ছেয়ে গেল কালবোশেখীর কালো মেঘে। প্রান্তরের ওপারের বড়ো বড়ো গাছগুলো প্রায় লুটোপুটি খেতে লাগল, বুঝলুম এখনি হুড়মুড় করে আঁধি এসে পড়বে এখানেও।

অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই পোড়ো বাড়িখানা। দোতালা বাড়ি। সামনের দিকে গাড়ি-বারান্দা। ছুটে তারাই তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলুম।

তারপরেই হু হু রবে এসে পড়ল দারুণ আঁধি। চারিদিক হয়ে গেল ধুলোয় ধুলোয় সমাচ্ছন্ন— দিগন্তব্যাপী মেঘের কালিমা ফুঁড়ে অগ্নিবাণ ছুড়তে ছুড়তে বজ্র দিতে লাগল ধমকের পর ধমক! গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়েও আত্মরক্ষা করা মুশকিল হয়ে উঠল।

অসহায়ের মতো এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখছি, এমন সময়ে পিছন থেকে গম্ভীর স্বরে কে বললে, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, ভিতরে আসুন!’

চমকে ফিরে দেখলুম, পিছনেই একটি দরজা খোলা ঘর এবং তারই ভিতরে ঝাপসা আলোয় দেখা যাচ্ছে দণ্ডায়মান এক অস্পষ্ট মনুষ্য মূর্তি। ঝড় আর ধুলোর ধাক্কা সামলাবার জন্যে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লুম।

দৃষ্টির আচ্ছন্ন ভাবটা একটু পরেই কেটে গেল বটে, কিন্তু ঘরের ভিতর তখনও আলোর চেয়ে অন্ধকারের ভাগই বেশি। তারই মধ্যে চেষ্টা করে চোখ চালিয়ে দেখলুম, যিনি ওখানে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি বয়সে প্রৌঢ়, তাঁর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে কালো চশমা, বর্ণ গৌর, চেহারা দীর্ঘ ও দোহারা।

আশ্রয়ের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’

খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর পেলুম, ‘হুঁ।’

বললুম, ‘কিন্তু আমি তো শুনেছি বাড়ির মালিক মানবেন্দ্রবাবুর মৃত্যুর পর এখানে আর কেউ বাস করেন না।’

‘কেন বাস করে না তা জানেন?’

‘কী এক দুর্ঘটনায় মানবেন্দ্রবাবু নাকি সপরিবারে মারা পড়েছিলেন।’

‘দুর্ঘটনার বিবরণ শোনেননি?’

‘না।’

‘তবে শুনুন।’ মূর্তি আমার দিকে তিন-চার পা এগিয়ে এল।

এমন সময়ে বাইরে নামল ঝমাঝম বৃষ্টি। মাথার উপরে আচ্ছাদন পেয়েছি বলে অদৃষ্টকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলুম।

অপরিচিত মূর্তি বললে, ‘এমনি বৃষ্টি নেমেছিল সেদিনও গভীর রাতে। ঝড় বয়েছিল বেগে, বজ্র উঠেছিল জেগে, আকাশ ঢেকেছিল মেঘে মেঘে মেঘে। তারপর? কী হল জানেন?’

‘হইহই করে ডাকাত পড়ল বাড়িতে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন ডাকাত। কী পাষণ্ড ডাকাত, রায়চৌধুরি বংশে বাতি দিতে কারুকে রাখলে না— কচি শিশুদের মুখ দেখেও তাদের মনে দয়া হল না! উঃ, এখনও চোখের সামনে দেখি সেই রক্তাক্ত দৃশ্য!’

বিপুল বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনিও কি ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন?’

‘নিশ্চয়!’

‘কে আপনি?’

‘মানবেন্দ্র রায়চৌধুরি। ডাকাতরা সবশেষে আমাকে হত্যা করে।’

আমি স্তম্ভিত। মূর্তি হন হন করে অন্য একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে চলে গেল।

তারপর আমি যা করলুম সেটা আর বলতে ইচ্ছা নেই, কারণ সে হচ্ছে কাপুরুষের আচরণ। জীবনে আর কখনো তেমন ভয় পাইনি।

‘বন্ধুগণ, এইখানেই আমার কথা ফুরুলো।’

এতক্ষণে যেটুকু রস জমে উঠেছিল তা একেবারে পানসে হয়ে গেল চরণদাসের হো হো হাস্যরবে। সে বললে, ‘তোমাকে বোকা বানাবার জন্যে কেউ একটা বিরাট ঠাট্টা করেছে।’

আমি বললুম, ‘মাঝে মাঝে আমারও সেই সন্দেহ হয়। কিন্তু—’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *