কিন্তু এদিকে যেন আমি

কিন্তু এদিকে যেন আমি, যাকে বলে, গেটিং দ্য স্মেল অব এ ডেঞ্জার লাইক অ্যান ওয়ার হর্স। যত সন্ধে ঘনিয়ে আসছে, মিস্টার জে. বিশওয়াস যেন কেমন হয়ে উঠছেন, সিল্কের লুঙ্গি খসখসিয়ে বারে বারে নড়েচড়ে বসছেন, চোখে যেন রাগ জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে, মুখ ফুলে শক্ত হয়ে উঠছে, আর চোখ তুলতে গেলেই সেই চোখের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে, আর আমার ভিতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি তো মালভা গল্পটা আর পড়ছি না, আর সুদীপ্তা চ্যাটার্জি তো আমার প্রশংসাই করে গিয়েছেন, তবু উনি এ রকম করছেন কেন।

এই ভাবতে ভাবতেই, মিস্টার জে, বিশওয়াস হঠাৎ বইটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, সুইচ অন করে বাতি জ্বাললেন, তারপরে দরজা খুলে, দরজাটা খোলা রেখেই বেরিয়ে গেলেন। সেই ভোলা। দরজা দিয়ে আলোকিত করিডরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আমার কেমন যেন দু-দু-দুর্গম আর হি-হিংস্র জঙ্গলে একলা মনে হতে লাগল, অথচ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বসবার উপায় নেই, মিস্টার জে. বিশওয়াস হয়তো আরও রেগে যাবেন। আগাগোড়া ব্যাপারটা আমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না। মিস্টার জে. বিশওয়াস চেয়েছিলেন, এই সিঙল কুপেটা তিনি এবং তার মিসেসের নামে নেবেন, এবং মিসেসের আসার কোনও ব্যাপার নেই, সুদীপ্তা চ্যাটার্জিকে তিনি তা হলে একটু একলা পেতেন, আর সেই জন্যই নাকি তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। এর মানে কী? আমি কিছু দিয়েই, স্ত্রীকে কারোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন না, কারোর সঙ্গে মিশতে দেন না, বিনা অনুমতিতে বাড়ি থেকে বেরোতেও দেন না, অথচ তাঁকে যেন সুদীপ্তা চ্যাটার্জির জন্য কেমন ইয়ে মানে কাতর দেখাচ্ছিল। আমার ভাবনা শেষ হবার আগেই মিস্টার জে. বিশওয়াস ফিরে এলেন, তার সঙ্গে সাদা পোশাকের ট্রেনের বেয়ারা, হাতে ট্রে, ট্রেতে দুটো গেলাস, একটা পাত্রে বরফ আর চারটে সোডার বোতল, জানালার ধারে টেবিলে রাখল, জিজ্ঞেস করল, সোডাকা বোতল খুল দেগা সাব?’ মিস্টার জে. বিশওয়াস বললেন, কোই জরুরত নহি হ্যায়, তুম আধা ঘণ্টা বাদ বাদ খবর লেও।

বেয়ারা বলল, জি বহোত আচ্ছা’ বলে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। মিস্টার জে. বিশওয়াস লুঙ্গি খসখসিয়ে, মেঝেতে উটকো হয়ে বসে তার সুটকেস খুলে জনি ওয়াকারের একটা বোতল, আর স্টেনলেস স্টিলের অদ্ভুত দেখতে ওপনার বের করে সুটকেসটা আবার সিটের নীচে ঠেলে দিলেন। কিন্তু দুটো গেলাস কেন? আমার কী রকম ভয় করছে, উনি কি আমাকে ড্রিঙ্ক করতে বলবেন। নাকি? কিন্তু আমি তো পারি না। জীবনের সবথেকে বড় মারটা (আপাতত, পরে কী হবে জানি না।) যার কাছ থেকে খেয়েছি, দু-একবার তার কাছেই আমাকে হার মানতে হয়েছে। তা–তা সেই খোয়ারি যাকে বলে, সে তো ভাল করেই ভেঙেছে, মিস্টার জে. বিশওয়াস কি আবার সে চেষ্টা করবেন নাকি? তা হলে আমাকে কুপে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেখলাম, উনি একটা গেলাসেই হুইস্কি। ঢাললেন, বরফ ফেললেন, তারপরে ওপর দিয়ে সোডার বোতল খুললেন, আর তখনই দেখতে পেলাম, ওপনারটার ভিতরের ফাঁকটা আসলে একটি মেয়ের মূর্তি উঁচ কাটা, এবং সেই কাটা জায়গায়, যেখানে মেয়েটির কটি, সেই কটির সরু জায়গায় সোডার বোতলের মুখ ঢুকিয়ে, চাড় দিয়ে খুললেন। এখন আমি বুঝতে পারছি, ওপনারটার কাটা মূর্তির তিন-চার জায়গা দিয়ে সোডার বোতল খোলা যায়। আহ, মানুষের চিন্তা কত ভাবেই না খেলে, আমার মাথায় কোনও দিন আসত না। মিস্টার জে. বিশওয়াস হুইস্কিতে সোডা ঢেলে, চোখ বুজে একটি চুমুক দিলেন। আর আমার মধ্যে একটা নতুন ভয় জাগতে লাগল। এমনিতেই উনি কেমন যেন বাঘের মতো হয়ে আছেন, তারপরে যদি ড্রিঙ্ক করে মাতাল হয়ে যান–অসম্ভব! আমাকে কুপের বাইরেই রাতটা কাটাতে হবে বোধ হয়, এবং আর সে চেষ্টাটা এখন থেকে করাই বোধ হয় ভাল। এই ভেবে বইটা মুড়ে নিয়ে, পকেটে এক বার দেখে নিলাম, সিগারেটের প্যাকেটটা আছে কি না। ইতিমধ্যেই বাইরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, ডিনার সার্ভ করবে রাত্রি। আটটায়। এখন মাত্র পৌনে সাতটা। জানি না, কুপের বাইরেই, করিডরে আমাকে ডিনার দেবে কি না, তা হলে আমি সেখানেই খেয়ে নিতে পারব। বাইরে গিয়ে বেয়ারাদের জিজ্ঞেস করলেই হবে, না হয় আটটার সময় ঢুকে কোনও রকমে খাওয়াটা সেরে গেলেই হবে। কিন্তু এতটা সময় করিডরে থাকলে যদি লায়লী সিং বা চন্দন সিং-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? সে তো ভয়ংকর বিপদ। সুদীপ্তা চ্যাটার্জির কথা থেকে তো মনে হল, পাঁচটা থেকেই তাদের ড্রিঙ্কস শুরু হয়ে গিয়েছে। তার মানে, যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। উপায়? আছে, একটা আছে, আমি চেয়ার কারের বগির করিডরে চলে যেতে পারি, সেখানে এরা কেউ নিশ্চয়ই যাবে না। আহ, তবু একটা রাস্তা পাওয়া গিয়েছে, ভেবে খুবই স্বস্তিবোধ করছি তারপরে মিস্টার জে. বিশওয়াস ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে আস্তে এসে ওপরে শুয়ে পড়া যাবে, কারণ উনি নিশ্চয়ই নীচে শশাবেন। হঠাৎ আমি গুনগুনিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, আর তৎক্ষণাৎ স্থান কাল পাত্রের কথা মনে করেই সামলে গেলাম, এবং ওঠবার উদ্যোগ করলাম।

‘ইউ নো বয়…’। মিস্টার জে. বিশওয়াস বলে উঠলেন। আমি উঠতে পারলাম না, ওর দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। ওঁর গেলাস প্রায় অর্ধেক শেষ, উনি আমার দিকে তাকিয়ে নেই, গেলাসের দিকেই যেন তাকিয়ে আছেন, এবং বললেন, লাইফ ইজ এ ভেরিহোয়াট শ্যড আই স্যে, এ পিকুলার থিঙ।’ বলে গেলাস তুলে চুমুক দিলেন, আর আমি কিছু না বুঝে, ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আবার সে ভাবেই বললেন, আই মিন, আওয়ার একজিসটেনেন্স অব লাইফ, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তোমারও তা মনে হয় নাকি?’ বলে তিনি মুখ ফিরিয়ে, আমার দিকে তাকালেন, এবং আমি দেখে আশ্বস্ত হলাম, ওঁর চোখ এখন মোটেই বাঘের মতো দেখাচ্ছে না, সেই জ্বলন্ত রাগ আর নেই। কিন্তু আমি কী বলব, আমি তো ওঁর কথা বুঝতে পারছি না। কী জবাব দেওয়া উচিত, ভেবে না পেয়ে বলে ফেললাম, হ্যাঁ, তা ঠিক।

মিস্টার জে. বিশওয়াস ঘাড় দুলিয়ে বললেন, ঠিক হতেই হবে। তোমার নিজের কথাই ধরো না। কনট সার্কাসে লায়লী সিং-এর ব্যাপারটা।’

আমার মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে যাওয়া কুণ্ডলীর পাক যেন খুলতে লাগল, আমার শিরদাঁড়ার কাছে কাঁপছে। উনি গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, যদি তপন সেনের কথা সত্যি হয়, লায়লী ড্রাঙ্কেন অবস্থায় তোমাকে জড়িয়ে ধরে ওই কাণ্ড করে থাকে–অবিশ্যি শুধু তপন সেন না, অনেকেই তোমাকে নির্দোষ বলে জানে, যেমন বিমি (সুদীপ্তা চ্যাটার্জি), বিমিও মনে করে, তোমার কোনও দোষ নেই, তুমি ইনোসেন্ট–আরও কী সব বলে গেল–সত্যি, হ্যাঁ, তুমি দাড়ি কামাওনি কেন বলো তো?

মিস্টার জে. বিশওয়াসের কাছ থেকে, এ রকম জিজ্ঞাসার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, তাই প্রথমটা থতিয়ে গেলেও, বললাম, এমনি, আসলে আমি কখনও রোজ দাড়ি কামাতাম না। তা ছাড়া, আজ আবার যাবার তাড়া ছিল, সেজন্য দাড়ি কামাবার কথা মনেই হয়নি।’

উনি গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, কিন্তু মহিলারা হার্ট হন, বিমির কথা শুনেই তুমি বুঝতে পারলে?

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি যে আহত হয়েছেন, তা আমি বুঝতে পারিনি, তাই অবাক স্বরে শব্দ করলাম, ও!

হ্যাঁ, জীবনের এটা একটা বিশেষ অঙ্গ, পুরুষদের রোজ দাড়ি কামানো। দাড়ি কামাবে, রোজ। সকালবেলা দাড়ি কামাবে, যে কোনও দায়িত্বশীল ভদ্রলোকদের রোজ সকালবেলা দাড়ি কামানো উচিত।

আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাফ মুখ, চকচক করছে উনি বললেন, হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, এই জীবনের অস্তিত্বটা, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ভৌতিকও বলা চলে। তোমার নিজের জীবন দিয়েই বুঝতে পারছ, অপরাধ করল লায়লী, জেল খেটে এলে তুমি। আমি অবিশ্যি তোমার বিরুদ্ধে ছিলাম, কারণ কারণ অবিশ্যি অনেক। তুমি নিশ্চয় বোঝো, দিল্লিতে চন্দন সিং-এর ইনফ্লুয়েন্স অনেক বেশি। লায়লী সিং-এর ইজ্জত বাঁচাবার জন্য অনেক ওপর মহল থেকে তোমার পানিশমেন্ট দাবি করা হয়েছিল। আমি তোমার ফরে গেলেও, কিছুই হত না, কিন্তু আমার অনেক এনিমি হয়ে যেত। তাতে কী লাভ? তোমার ফরে যারা ছিল, তারাও কেউ তোমার জন্য কিছু করতে পারেনি। তপন কি কিছু করতে পারল? পারল না। অবিশ্যি ওর কাজকে সবাই প্রশংসা করেছে, অ্যান্ড দ্যাট ইজ ইনএভিটেবল। তোমাকে নিয়ে এ দু দিনের ঝগড়া ওদের মিটে যাবে, দে উইল সিট টুগেদার, ইট, ড্রিঙ্ক টুগেদার, অ্যান্ড দে উইল ফরগেট ইউ, অ্যান্ড দিস ইজ লাইফ।

এতগুলো কথা বলে, মিঃ জে. বিশওয়াস গেলাস হাতে নিয়ে এক চুমুকে সমস্ত হুইস্কিটুকু পান করে নিলেন, বোতল খুলে আবার ঢাললেন, বরফ নিলেন, তারপরে সেই ওপনার নিয়ে, এবার নারী মূর্তির মাথা দিয়ে সোডার বোতল খুললেন, এবং এ বার আমি আরও ভালভাবে দেখতে পেলাম, ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের পাতের ওপরে, এক সাইড থেকে দাঁড়ানো মূর্তিটা বেশ স্পষ্ট। যেহেতু সবটাই কাটা, মূর্তিটা নগ্ন কি নগ্ন না, কিছুই বোঝার উপায় নেই, কেবল আমার কেন যেন মনে হল, আমি এক পাশ থেকে সুদীপ্তা চ্যাটার্জিকে দেখতে পাচ্ছি, উনি যেন অন্ধকারে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ, চুল, গলা, বুক, পেট, কটি, কোমর, উরু, জঙঘা, পা। মিস্টার জে. বিশওয়াস সোডা ঢাললেন, ফেনা উঠল গেলাসে, গেলাস তুলে চুমুক দিলেন, এবং তখনও তার ডান হাতে সেই প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা ওপনারটি। রয়েছে, এবং তিনি ওপনারটি তুলে ধরে দেখলেন, তারপরে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, এটা প্যারিস থেকে এনেছিলাম। বলেই সেটা রেখে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?

আমার একটা কথাও মনে নেই, কেবল শেষের একটা কথা ছাড়া, অ্যান্ড দে উইল ফরগেট ইউ, দিস ইজ লাইফ।’ আমি বলতে গেলে, হতভম্বের মতো ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি গেলাসে আবার চুমুক দিলেন, বললেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমার আর লায়লী সিং-এর কথা বলছিলাম। আসলে ব্যাপারটা কী, তোমরা যদি ওই কাণ্ডটা ঘরের মধ্যে করতে।

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, আ-আমি কিছু করিনি।

 দ্যাট আই নো, কনট সার্কাসে তুমি কিছু করোনি, লায়লীই এমব্রেসড অ্যান্ড কিসড ইউ, কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যে একটা অ্যাফেয়ার তো ছিলই, তা না হলে আর লায়লী তোমাকে রাস্তায় জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে যাবে কেন?

অ্যাফেয়ার?

হ্যাঁ, অ্যাফেয়ার। অ্যাফেয়ার মানে জানো না?

আমার ঠোঁট খুলে, মুখ হা হয়ে গিয়েছে, কারণ অ্যাফেয়ার বলতে উনি কী বোঝাতে চাইছেন, আমি তা বুঝতে পারছি না। আমি যাকে বলে অসহায়, সেভাবে ঘাড় নাড়লাম, আর সঙ্গে সঙ্গে, ওঁর চোখের পাতা কুঁচকে উঠল, মুখটা আবার শক্ত হয়ে উঠল, আমার চোখের দিকে ওঁর লাল চোখ যেন বিধিয়ে দিলেন, এবং নিচু গরগর স্বরে বললেন, লায়লীর সঙ্গে তোমার আর কখনও কিছু হয়নি? তোমাদের

আমি প্রায় আঁতকে উঠে বললাম, মেক লালাভ টুগেদার? না না, বিশ্বাস করুন।

শাট আপ।‘ মিস্টার জে. বিশওয়াস ধমক দিয়ে উঠলেন, ডোন্ট লাই টু মি। তুমি বলতে চাও, লায়লী তোমাকে কনট সার্কাসেই প্রথম কিস করেছিল?

মিস্টার জে. বিশওয়াস ঠোঁট দুটো ধনুকের মতো বাঁকিয়ে ফেললেন, তাঁর নাকের পাটা দুটো ফুলে উঠল, যেন এত রেগে গিয়েছেন, কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না। তারপরে হঠাৎ গেলাস তুলে একটা লম্বা চুমুক দিলেন এবং আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মাই নেম ইজ জগট বিশওয়াস, ডু ইউ নো দ্যাট?’ বলে আমার দিকে তাকালেন। আমি জানি, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বোঝাতে পারলাম, কারণ কথা বেরোচ্ছে না, ওঁর চোখমুখের ভাব আবার বদলে গিয়েছে। উনি হঠাৎ আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে, মুখের অদ্ভুত মানে সত্যি অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে, যেন চুপিচুপি কিছু বলছেন, এভাবে বললেন, লুকিয়ে মজা মারতে খুব ভাল লাগে, না? আমি নিজের চোখেই এক বার দেখেছি, লায়লী তোমাকে জড়িয়ে ধরে, নাচবার নাম করে, কী সব করছিল, করেনি?

আমি এমনিতেই এক এক সময় তোতলা হয়ে যাই, এ রকম অবস্থায় পড়লে তো একেবারেই তোতলা হয়ে যাই। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম, হ্যাঁ, মানে আ-আমাকে উনি না–নাচাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আর তো কিছু করেননি?

না, কিছু করেনি, তোমাকে সমস্ত শরীর দিয়ে চেপে ধরে। কথা শেষ না করে, এক হ্যাঁচকায়। যেন নিজেকে ঝোকা অবস্থা থেকে টেনে নিয়ে গেলেন, বললেন, দ্যাটস অলরাইট, ইফ ইউ ডোন্ট লাইক টু এক্সপোজ ইওরসেল্ফ, ডোন্ট এক্সপোজ, বাট ডোন্ট টেল লাইজ।

বলে তিনি গেলাস তুলে চুমুক দিলেন, এবং গেলাসের দিকে চোখ রেখেই বললেন, দিস ইজ লাইফ। এনি হাউ, আমি যা বলতে যাচ্ছিলাম, আসলে যা-ই কর, চেপে।

চেপে?

 হ্যাঁ, চেপে, লুকিয়ে। আরে, চন্দনের সামনেই তুমি লায়লীকে যা খুশি করোনা, বড়জোর তোমাদের মধ্যে এক চোট হাতাহাতি হয়ে যাবে, কিন্তু ঘরের মধ্যে সে সব তো আর বাইরের লোকে দেখতে আসছে না। তোক দেখিয়ে কিছু করলেই, তোমাকে ইমমরাল ট্র্যাফিকে পড়তে হবে। আইনকানুন বলে ব্যাপারগুলো আছে তো, তুমি তার সম্মান দেবে না? আফটার অল, তুমি হচ্ছ সভ্য জগতের মানুষ। হ্যাঁ কি না?

আমার মুখে যেন জবাবটা এসেইছিল, কেবল ওঁর ধমকের অপেক্ষায় ছিল, আমি উচ্চারণ করলাম, হ্যাঁ।

দ্যাটস অলরাইট।’ বলে তিনি গেলাসে চুমুক দিলেন, এবং আবার কিছু বলবার জন্য মুখ খোলবার উদ্যোগ করতেই, দরজায় নকিং-এর শব্দ হল, উনি দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়েস, কাম ইন।

দরজা খুলে বেয়ারা ঢুকল, বলল, হ সাব, কুছ অর্ডার হ্যায়?

মিস্টার জে. বিশওয়াস বললেন, হোড়া বাদ থোড়া বরফ, অওর দো সোডা লাও।

বেয়ারা জিজ্ঞেস করল, ডিনার আভি লায়েগা??

মিস্টার জে. বিশওয়াস কবজির ঘড়িতে সময় দেখে বলে উঠলেন, মাই গড, কোয়ার্টার টু এইট? হোয়েন শি উইল বি–।’ বলতে বলতে থেমে গেলেন, এবং চোখের কোণ দিয়ে এক বার আমাকে দেখে নিয়ে বললন, মেরা খানা আভি নহি চাহিয়ে। তুম আগারি এ সাহাবকো ডিনার দে দো।আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুমি এখন খেয়ে নাও, তাই না?

আমি ঘাড় কাত করে বললাম, হ্যাঁ, খেয়ে নিই।’

বেয়ারা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে চলে গেল। উনি এক চুমুকে গেলাস শুন্য করে, আবার হুইস্কি ঢাললেন, বরফের শেষ টুকরোগুলো তুলে নিলেন, আর ওপনারটা তুলে, এ বার সুদীপ্তা চ্যাটার্জির (বুকটা ধক করে উঠল, আমি ওপরের ঘঁচের মূর্তিটাকে সত্যি সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ভাবছি নাকি? উনি শুনলে কী ভাববেন, ছি ছি!) এ বার সেই মূর্তির পয়েন্টেডা, তা ছাড়া আর কী বলতে হয়, আমি জানি না, পয়েন্টেড বুক দিয়ে সোডার বোতল খুলে, সোডা ঢাললেন, কিন্তু তুলনায় পরিমাণে খুবই কম। লায়লী সিং যেমন বলে, কুইক কিক’ উনি কি তা-ই চাইছেন? কুইক কিকের জন্য সে তো যাকে বলে নিট গলায় ঢালত। উনি গেলাস তুলে চুমুক দেবার মুহূর্তেই, দরজায় খট খট শব্দ করে, বেয়ারা দরজা খুলে, খাবার নিয়ে ঢুকল। এ বেয়ারা অন্য একজন, ক্যাটারিং-এর বোধ হয়, হাতে ডিনারের থালা, সঙ্গে আগের বেয়ারাও ঢুকল, বরফ আর সোডার বোতল নিয়ে। খাবারের বেয়ারা আমার ডান দিকে, দেওয়ালের গায়ে, ছোট টেবিলের ওপর খাবারের থালা রাখল, এবং ঢাকনাটা খুলতেই, খাবারের গন্ধ পাওয়া গেল, যা আমার একবারেই ভাল লাগল না। একটা ছোট স্টিলের বাটিতে, মিষ্টি হিসাবে পুডিং দিয়েছে। দুজন বেয়ারাই, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে চলে গেল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে, মিস্টার জে. বিশওয়াসের দিকে তাকালাম, উনিও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্যারি অন, আরম্ভ করে দাও।’

আমি ফর্ক আর চামচ তুলে নিলাম। খাবারের মধ্যে প্রধান যেটা, সেটা বোধ হয় বিরিয়ানি বা পোলাও-টোলাও জাতীয় একটা কিছু হবে, যার গন্ধে আমার খিদে নষ্ট হয়ে যেতে চাইছে, এবং মাংস, আর যেন কী রয়েছে। ভাল করে না দেখেই, আমি খেতে আরম্ভ করে দিলাম। গরম আছে, কিন্তু কী বিশ্রী স্বাদ, জানি না, এত জবজবে করে, কী দিয়ে ভাতগুলোকে মেখেছে। মিস্টার জে, বিশওয়াসের গলা শোনা গেল, হা, যে কথা বলছিলাম, (উনি ভোলেননি দেখছি, রেসপনসিবিলিটি বোধ যাঁদের বেশি, তাদের বোধ হয় এ রকমই হয়, ড্রিঙ্ক করুন আর যা-ই করুন, দায়িত্ব ভোলেন না।) তা হলেই বুঝতে পারছ, সভ্য হলেই, আমাদের একটা রেসপনসিবিলিটি এসে যায়, বাট দিস ইজ লাইফ, কেন না, বাই ইনস্টিংক্ট আমার অনেক কিছু চাই, মানে আমার করতে ইচ্ছা করে, ইজন্ট ইট?

আমার ফর্কে তখন হাড়সুদ্ধ এক টুকরো মাংস মুখের কাছে, মুখে দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আর মুখে পুরতে পারলাম না। উনি বলে চললেন, অ্যান্ড দেয়ার ইজ দ্য ক্রাইসিস, ইনস্টিংক্ট অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি–খাও খাও, তুমি খাও, আমি বলে যাচ্ছি, (গেলাসে চুমুক দিলেন, আমি মাংসের টুকরো মুখে দিলাম, বিশ্রী স্বাদ!) তখনই দরকার হয়ে পড়ে প্রাইভেসির। প্রাইভেসি ইজ প্রাইভেসি, তাকে তুমি প্রকাশ্যে আনতে পারো না, ইভন নট ইন লিটারেচার, দ্যু য়ু ফলো মি? প্রথমেই তোমাকে আমি যে প্রসঙ্গে বলতে যাচ্ছিলাম, ইয়েস–আমরা অনেক কিছুই করি, তার মানে এই নয় যে, সে সব তুমি প্রকাশ্যে বলবে বা লিখবে বা করবে, দ্যাট ইজ ভালগারিটি, অবসিন। আমরা কী না করি? আমরা (ওহ্, কী জঘন্য খাবার, ঠিক যেন চটচটে কিটকিটে, আমি আর খেতে পারছি না।) নেকেড হই, আমরা–আমরা–মানে আমি বলছি, তুমি একটা মেয়েকে সেডিউস করতে পারো, (আ-আ-আমি?) ইয়েস, আমি মানি, বাবা আর ছেলে একটি মেয়ের জন্য মারামারিও করতে পারে, বাট দ্যাট ইজ ইনডিসেন্ট, য়ু কান্ট ব্রিং ইট টু পাবলিক, লাইফ ইজ এ ভেরি–।

ওঁর কথা শেষ হল না, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি দরজা খুলে ঢুকলেন, আর উনি, কী বলে ওটাকে, হ্যাঁ, উল্লাসে কেমন একরকম গলায় বলে উঠলেন, আহ্ বিমি! দেন য়ু হ্যাভ কাম?’

আমি পুডিং মুখে তুলতে যাচ্ছিলাম, থপ করে নীচে পড়ে গেল, দেখলাম, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি নাইটি পরে আছেন, তার ঠোঁটে বা মুখে রং নেই, ঘাড় অবধি চুল এখন উশকোখুশকো, চোখ টকটকে লাল, তিনি যেন ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না, এবং ঠিক যেন হাসছেন না, অথচ হাসছেন, মিস্টার জে. বিশওয়াসের দিকে তাকাচ্ছেন না, ওঁর দৃষ্টি যেন জানালার দিকে, জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, য়ু মেন আর স্যো কুইয়ার’

মিস্টার জে. বিশওয়াস লুঙ্গি খসখসিয়ে উঠে, সুদীপ্তা চ্যাটার্জির কাছে গিয়ে, তার কাঁধে হাত রাখলেন, জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ য়োর হাজব্যান্ড ডুয়িং?

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি যেন হাসলেন, আর ওঁর প্রায় ট্রান্সপারেন্ট নাইটির ভিতরে শরীরটা কেঁপে উঠল বা দুলে উঠল, বললেন, ওহ্, হি ইজ স্নোরিং লাইক এ টাইগার।

বাঘের মতো নাক ডাকাচ্ছেন? মিস্টার জে. বিশওয়াস সুদীপ্তা চ্যাটার্জির কাধ ধরে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে এলেন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আবার বললেন, আমি কুপে অন্ধকার করে দিয়ে, দরজা টেনে দিয়ে চলে এসেছি।’

ফাইন!’ বলেই তিনি সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে মুখ নামিয়ে নিতে গিয়ে, আমার দিকে ফিরে তাকালেন। পাবলিক! আমার মনে পড়ে গেল, প্রাইভেসি ইজ প্রাইভেসি, তার মাঝখানে আমি একজন পাবলিক। আমি তাড়াতাড়ি পেপার ন্যাপকিন আর বইটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, আর সে সময়েই সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন, বলে উঠলেন, ওহ, ডার্লিং মদন, য়ু আর হিয়ার! বলেই তিনি মিস্টার জে. বিশওয়াসের হাত থেকে কাঁধ ছাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, এবং আমার কাঁধে দু হাত রাখলেন, আর মুখটা তুলে বললেন, দাড়ি কামাওনি কেন?

আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ, ওঁর মুখ থেকে মদের গন্ধ লাগছে, আর–আর ওঁর শরীর–সেই ওপনারের মতো, আমাকে ভারী কষ্ট দিচ্ছে, অথচ ওঁর সেই–সেই চোখে উনি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছেন, আমার শিরদাঁড়া বেয়ে সাপটা নামছে না উঠছে, বুঝতে পারছি না, আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের দিকে তাকালাম। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি তার মুখটা আরও উঁচু করে তুলে ধরতেই, মিস্টার জে. বিশওয়াস তাকে হাত ধরে নিজের কাছে ছিনিয়ে নিলেন, বললেন, বিমি, বিহেভ য়োরসেলফ। ও ওখানে যাবে কি না, সেটা বলে দাও।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, ওহ শু্যর।আমার দিকে ফিরে বললেন, মদন, তুমি (উনি আমাকে তুমি’ করে কখনও বলেননি।) ই বার্থে চলে যাও। নীচে চ্যাটার্জি ঘুমোচ্ছে, তুমি ওপরে শুয়ে পড়োগে, বালিশ আর চাদর রাখা আছে, অ্যান্ড আফটার অ্যান আওয়ার অর টু, আই শ্যাল মিট য়ু উ? ওহ, হাউ লাভলি য়ু আর…।’

ওঁর কথা শেষ হবার আগেই, মিস্টার জে. বিশওয়াস্ ওঁকে আরও গায়ের কাছে টেনে নিলেন, আমি তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে বেরিয়ে, আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম। আফটার অল, প্রাইভেসি ইজ প্রাইভেসি। ভিতর থেকে লক করে দেবার শব্দ শুনতে পেলাম, আর দেখলাম, সেই সোডা বরফের বেয়ারাটি আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে, কেমন একরকম করে যেন হেসে চলে গেল। করিডরে এখন বেয়ারাদের ডিনার সার্ভ করার ব্যস্ততা। আমি বাথরুমের স্পেসের দিকে এগিয়ে গেলাম।

.

আহ, অনেকটা স্বস্তিবোধ করছি। বাথরুমের স্পেসের কাছে বেয়ারারা এক পাশে ডিনার নিয়ে ব্যস্ত, দু-একজন সেখানে দাঁড়িয়েও গেলাস হাতে নিয়ে ড্রিঙ্ক করছে, আর কথা বলছে, আমি পকেট থেকে, মমতা কাকিমার দেওয়া কিং সাইজ ফরেন সিগারেট বের করে ধরালাম। তারপরেই ভাবনাটা মাথায় এল, যার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না যে, সুদীপ্তা চ্যাটার্জির সঙ্গে মিস্টার জে. বিশওয়াসের ব্যাপারটা কী। চাকরির পজিশনের দিক থেকে মিঃ চ্যাটার্জি, মিস্টার জে, বিশওয়াসের থেকে ছোট, বিভাগও ভিন্ন, কিন্তু ওঁর বয়স অনেক কম। মিস্টার জে. বিশওয়াসের বয়স অনেক বেশি, পঞ্চাশের ওপরে, সেই তুলনায় মিঃ চ্যাটার্জির বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ, সুদীপ্তা চ্যাটার্জিও অনেক ছোট, অথচ তিনি মিস্টার জে. বিশওয়াসের সঙ্গে–সেই বেয়ারাটার সঙ্গে আমার আবার চোখাচোখি হল, এবং সে যেন কেমন একরকম করে হাসল, নাকি কোনও ইঙ্গিতই করল, বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ মহিলা গলায় খিলখিল হাসি শুনে, আমি চমকে ফিরে তাকালাম। না, লায়লী সিং না, অন্য একজন মহিলা, আর একজন মহিলার সঙ্গে এসে, বাথরুমে ঢুকে গেলেন, কিন্তু আমার মাথায় লায়লী সিং ঢুকে যেতেই, মস্তিষ্কের মধ্যে সাপের চেরা জিভের স্পর্শ পেলাম যেন। আবার আমার মনে হল, আমি যেন সেই দু-দুর্গম হি-হিংস্র, গ–গভীর অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছি। আমি ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে করিডরের এদিকে ওদিকে দেখতে লাগলাম। কোনও একটা কুপের মধ্যে চন্দন সিং আর লায়লী সিং নিশ্চয়ই আছে, এবং যে কোনও মুহূর্তেই বেরিয়ে আসতে পারে। আমি তাড়াতাড়ি সিগারেটটা দেওয়ালের গায়ে অ্যাশট্রেতে চেপে দিয়ে, কুপের অক্ষর দেখে দেখে, ই কুপের সামনে দাঁড়ালাম। আমি এখন নিরুপায়, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস পাচ্ছি না।

খুব আস্তে আস্তে, হ্যাঁন্ডেলটা বাঁকিয়ে, দরজা ফাঁক করলাম, আর কানে এল, সত্যি বাঘের গর্জন। একটি মাত্র বেগুনি রঙের জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে, সেই আলোতে দেখতে পেলাম, মিঃ চ্যাটার্জি পায়জামা পরে, গেঞ্জি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে আছেন। একটা হাত পেটের ওপর, আর একটা হাত ওপর দিকে পড়ে আছে, মুখ অল্প একটা হাঁ করা। আমার কানে এল, মহিলা গলার খিলখিল হাসি, আমি তাড়াতাড়ি কুপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম, দরজাটা শব্দ না করে টেনে বন্ধ করে দিলাম, এবং আবার মিঃ চ্যাটার্জির দিকে তাকালাম। তিনি আমার মতোই লম্বা, কিন্তু আমার থেকে চার গুণচার ডবল যাকে বলে, চওড়া আর মোটা। ওপরের বার্থের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ঠিকই বলেছেন, বালিশ আর চাদর রয়েছে। কিন্তু মিঃ চ্যাটার্জি যদি জেগে ওঠেন, আর উঠে আমাকে দেখতে পান? ভাবতে পারি না। হয়তো ভয় পেয়েই আমাকে মারতে আরম্ভ করে দেবেন, চিৎকার করে তোক ডাকাডাকি করবেন। অসম্ভব! চিন্তা করতে পারছি না, আমার গায়ের মধ্যে যেন কেমন করছে। আমি নিঃশব্দে দরজা খুলে, আবার বেরিয়ে এলাম। দরজাটা টেনে দিয়ে, বাথরুম পেরিয়ে, দরজা ঠেলে, চেয়ার কার বগিতে ঢুকে পড়লাম। চমৎকার, যেন অন্য একটা জগৎ,কত মহিলা পুরুষ, বাচ্চাদের ভিড়, অধিকাংশই এখন খেতে ব্যস্ত। একসঙ্গে অনেকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, দু-তিনটি বাচ্চা ছুটোছুটি করছে, বিউটিফুল! কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকবার উপায় নেই, মাঝখানের সরু স্পেস দিয়ে আমি এগিয়ে গিয়ে, দরজা ঠেলে, বাথরুমের সামনে গেলাম। ওহ, এখানেও দেখছি, অনেকে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে, গেলাস হাতে ড্রিঙ্ক করছে, সিগারেটের ধোঁয়ায়, সেই খবরের কাগজের ভাষায় ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি সকলের মধ্যে একটু ফাঁক দেখে দাঁড়ালাম, এবং বাধ্য হয়ে পকেট থেকে প্যাকেট বের করে, একটা সিগারেট ধরালাম, কেন না অকারণে এদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। হঠাৎ একজন যুবক পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, দেখি দাদা, একটা আপনার সিগারেট ছাড়ুন তো।

আমি বলতে গেলে, খুব খুশিই হয়ে উঠলাম, প্যাকেটটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিশ্চয়। দেখলাম, তার চোখ দুটি টকটকে লাল, হাতে গেলাস, খয়েরি রঙের ড্রিঙ্কস, বোধ হয় রাম। সে বোধ হয় গাড়ির দোলানিতেই দুলছে, সকলকেই একটু দুলতে হচ্ছে গাড়ির ঝাঁকুনিতে। অন্য দিক থেকে কে একজন বলে উঠল, কমল, প্যাকেটটা এদিকেও এক বার চালান করে দিস।

যে বলল, সে বাথরুমের অন্য পাশে, আর একটা কমপার্টমেন্টের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। কমল যার নাম, সে ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের স্টিলের ফ্ল্যাট বেসিনে গেলাস রেখে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরল, এবং প্যাকেটটা অনয দিকে ছুড়ে দিল। আমার দিকে কয়েকজন তাকিয়ে দেখল, তাতে একটু অস্বস্তি হলেও, আমার কিছু খারাপ লাগল না। সারা রাত্রের মধ্যে আমার আর একটা সিগারেটেরও দরকার নেই। কমল যার নাম, সে সিগারেট ধরিয়ে, হাতে গেলাস তুলে নিয়ে বলল, ডু য়ু নো, হু অ্যাম আই?

কী করে জানব, শুধু নামটাই জানতে পেরেছি। একটু হেসে বললাম, আপনি কমলবাবু। কে যেন আমার পাশ থেকে হেসে উঠল, এবং কমল যার নাম, সে কাত হয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, ইয়েস, কিন্তু আমি কোন কমল, তা আপনি জানেন না?’

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম, ও লাল টকটকে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কেমন যেন একটা অফেন্ডেড ভাব, কিন্তু আমি কী করে জানব, ও কোন কমল। আমি এ রকম চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না, তাই চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, না তো।

কমল নামে যুবক যুবকই বলা যায়, কেমন যেন ধমকের সুরে বলল, কমল বসুর নাম আপনি শোনেননি? আপনি কি একটা বাঙালি না কি, অ্যাঁ? গ্রেট সিঙার কমল বসুর নাম আপনি শোনেননি, তার ছবি দেখেননি, তাকে চেনেন না?

আমি–আমি কী বলব, যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। কমল বসু, বিরাট গায়ক? কিছুতেই মনে। করতে পারছি না, আমি তার গান শুনেছি বা নাম শুনেছি বা ছবি দেখেছি কখনও। অবিশ্যি এ সব। ব্যাপারে আমি একটু ইয়ে আছি–মানে ক্যালাস–মানে লেস ইনফর্মড। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অনেকেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে আর কেমন যেন ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। এ বার আমি সত্যি অস্বস্তি বোধ করলাম। কমল বসু, গ্রেট সিঙার আবার বলল, আমি আপনার কাছে। এমনি এমনি সিগারেট চাইলাম? আমি কারোর কাছে সিগারেট চাইলে, সে নিজেকে গ্লোরিয়াস মনে করে, আপনাকে গ্লোরিয়াস্ করার জন্যই আপনার কাছে সিগারেট চেয়েছি, আর আপনি আমাকে রিকগনাইজ না করে, গবাকান্তর মতো তাকিয়ে আছেন?

কান্ত না হলেও, গবা আমার ডাকনাম ঠিকই, কিন্তু আমি যে সত্যিই কমল বসু নামে কোনও বিরাট গায়ককে চিনি না, কখনও তার গান শুনে থাকলেও, আমি মনে করতে পারছি না বা তার ছবি আমি কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না, যে কারণে আমি একটু লজ্জিতই হয়ে পড়লাম, বললাম, খুবই দুঃখিত, সত্যি।

এ সব দুঃখ-টুঃখে কিছু যায় আসে না, আপনি কমল বসুকে চেনেন না, আপনার গলায় দড়ি দেওয়া উচিত। টপ হিরো আমার ভয়েসে লিপ দেয়, মাই রেকর্ডস আর বেস্ট সেলার, আপনি আমার নাম জানেন না?

গ্রেট সিঙার কমল বসু কেমন যেন ক্ষেপে ক্ষেপে উঠছে, এবং এক চুমুকে গেলাস শুন্য করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, এই প্যানা, মাল দে।’

কাছেই একজন দাঁড়িয়েছিল, নিশ্চয়ই প্যানা, রামের বোতল খুলে, গেলাসে ঢেলে দিল। কমল বসু আরও জোরে চিৎকার করে উঠল, এ্যাই বেয়ারা, রাসকেল, কঁহা গেয়া, হমকো কোকস ডালো।

একটি বেয়ারা অনেককেই সোভা আর কোকাকোলার ছিপি খুলে দিচ্ছিল। সে হঠাৎ ভুরু কুঁচকে, কেমন একটু রোখা গলায় বলল, জবান সামালকে বাত কিজিয়ে সাব, আপ রাসকেল কেঁও কহতে?

কমল বসুকে আমার মনে হল, সে যেন একটা ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপা কী? ওটাকে বলে হস্তী, হস্তীর মতো বেয়ারার দিকে ফিরে বলল, কেয়া বাতায়া সসালা, হম তুমকো সাথ জবান সামালকে বাত করেগা, শুয়ার, ছোটা মুখ মে বড়ি বাত?

আমি একেবারে আঁতকে উঠে দেখলাম, বেয়ারাটা যেন বাঘের মতো প্রায় কমল বসুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর চিৎকার করে উঠল, কেয়া? হম সালা, শুয়ার? তেরি–একটা খুব খারাপ গালাগাল দিল, যা আমি উচ্চারণ করতে পারব না।) তেরা মাফিক সিঙার ম্যায় বহোত দেখা।

বলে সে কমল বসুর শার্টের কলার চেপে ধরল। কমল বসু বেয়ারার কলার চেপে ধরা হাত চেপে ধরে, চিৎকার করল, ওরে শুয়ার কা বাচ্ছা, কমল বসু কো তুম নহি জানতা?’

কে যেন বলে উঠল, এই কমলদা, ছেড়ে দাও।’

আমি দেখলাম, আশেপাশের লোকজন সবাই যেন কেমন সরে যাচ্ছে, এবং একটা মারামারির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, কারণ বেয়ারাটা বসুকে কলার ধারে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ফিন গালি বকতা, সালা তুমকো ম্যায় গাড়িসে ফেক দেগা।

বলে সে তাকে হ্যাঁচকা টান দিল, আমি প্রায় কেঁপে উঠলাম, এবং অবাক হয়ে দেখলাম সেই সব প্যানা না কারা ছিল, বা যাকে কমল বসু আমার সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়েছিল, তারা কেউ এগিয়ে আসছে না, এবং ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন বেয়ারা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে, এবং তাদের মুখে একটি মাত্র কথা, মারো সালেকো।

আমি থামাতে যেতে সাহস পাচ্ছি না, এবং সেই বেয়ারাটা কমল বসুকে কলার ধরে টানছে, আর বলছে, আও, তুমি কেতনা বড়া আদমি, ম্যায় দেখ লেংগে।

কমল বসুকে এখন যেন কেমন কাকা কাতর মতো দেখাচ্ছে, তার লাল চোখে সেই ক্ষ্যাপা ভাব আর নেই, এবং সে কলারটা ছাড়াবার চেষ্টা করে খালি বলছে, ছোড়ো, ছোড়ো হমকো, নহি তো বহোত খারাপ হো যায়েগা।

কেয়া খারাপ হো যায়েগা, শরম নাই লাগতা হ্যায়, এ্যায়সা গালি বকতা? আদমি লোক ঘরকা নোকরকো ভি এ্যায়সা নহি গালি দেতা৷’ বলে বেয়ারাটা তাকে আবার হ্যাঁচকা টান মারল। অন্য বেয়ারারা বলে উঠল, উসকো মাফি মানে পড়েগা, নহি তো ছোড়না নহি।

এ সময়েই কয়েকজন যাত্রী দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তাঁরা বেয়ারাদের বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন, এবং বোঝাতে লাগলেন, মাতাল লোকের কথায় কান দিতে নেই, ওদের কথার কোনও দাম নেই, যদিও অন্যায় করে ফেলেছে, ওরা মাফ করে দিক। তবু বেয়ারারা ছেড়ে দিতে চাইল না, কমল বসুকে মাফ চাইবার জন্য জেদাজেদি করতে লাগল, আর ভালমানুষ যাত্রীরা ওদের বোঝাতে লাগলেন, এবং শেষপর্যন্ত ওরা কমল বসুকে ছেড়ে দিল, আর ভালমানুষ যাত্রীরা কমল বসুকে নিয়ে কমপার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকে গেলেন। এখন দু-তিনজন মাত্র এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে, কারোর হাতেই গেলাস দেখতে পাচ্ছি না, সবাই চুপচাপ, কেবল বেয়ারারা নিজেদের মধ্যে, কমল বসুর নামে গালাগাল দিয়ে, ঘটনাটা বলাবলি করছে। তারপরেই এক ভদ্রলোক এলেন, ঢলঢলে মতো স্যুট পরা, সরু টাই পরা, তার হাতে একটি ছোট নোটবুক আর পেনসিল। তিনি হিন্দিতে বেয়ারাদের বললেন, ঘটনা তিনি সবই শুনেছেন; খুবই অন্যায় করেছে লোকটা, কিন্তু এখন আর গাড়িতে এ নিয়ে গোলমাল করে লাভ নেই। যার ইজ্জত বোধ নেই, তাকে বোঝাবার কিছু নেই, এ বার সবাই যে যার কাজে চলে যাক। দেখা গেল, ওঁর কথা সবাই মেনে নিল। যারা অন্য দিক থেকে এসেছিল, তারা চলে গেল, এখানকার বেয়ারাটি গেলাস আর সোডার আর কোকাকোলার খালি বোতলগুলো, এখান থেকে ওখান থেকে এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল। ভদ্রলোকটিও চলে গেলেন, এবং আমি তাকিয়ে দেখলাম, করিডরে আগের কেউ নেই, ওপাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন, একজন মহিলা বাথরুমে ঢুকলেন। আমি যেমন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তেমনি দাঁড়িয়ে রইলাম, হাতের বইটা হাতেই রয়েছে, এটা এখন খোলবার কথা ভাবতেই পারছি না, মনে হচ্ছে, আমি যেন একটা সাড়া শব্দ নেই, এরকম–এরকম একটা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আর আমার চারদিকে মৃতরা পড়ে রয়েছে, আর গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছুটে চলেছে।

তারপরেই কমল বসুর কথা আমার আবার মনে পড়ল, আর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি মানুষকে দেখে, সবসময়ে চেনাই যায় না বা বোঝা যায় না, সে কত বেচারির মতো হেলপলেস্। মনে মনে ঠিক করলাম, কলকাতায় ফিরে গিয়ে, আমাকে জানতেই হবে, কমল বসু কে, কী রকম গায়ক, এবং তার গান আমি শুনব, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাকে যে কী বলা যায়, বলা উচিত, আমি তো বুঝতে পারছি না। কমল বসু এত ইয়ে কেন, মানে নিজের সম্পর্কে এতটা বড় ধারণা করা বোধ হয় ঠিক না। তার বন্ধুরাই বা কী, তারাই তো সমস্ত ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারত, বন্ধুকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারত, কিন্তু তারা কে কোথায় চলে গেল, বোঝাই গেল না।

কেয়া সাব, আপকো কুছ দেগা? বেয়ারাটি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

আমি এক সেকেন্ড ভেবে বললাম, কোকাকোলা হ্যায়?

 হ্যায়।

একঠো দো।

সে আমাকে একটি কোকাকোলার ছিপি খুলে, ঔ ডুবিয়ে এগিয়ে দিল। আমি ঐ ঠোঁটে নিয়ে চুমুক দিলাম। আহ, সত্যি, আমার গলাটা শুকিয়ে যেন একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বেয়ারা না বললে, এ কথাও আমার মনে থাকত না বোধ হয়। খানিকটা চুমুক দিয়ে, দাম কত জিজ্ঞেস করে, পয়সা দিয়ে দিলাম, আর ওকেও কিছু দিলাম, ও আমাকে কপালে হাত ঠেকিয়ে সেজন্য সম্মান জানাল। আর তখনই আমার খোতেমানে আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। খোতে নিশ্চয় কারোর সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করে না, মানে আমি কমল বসুর কথা ভাবছি, ও আবার একটু অন্য রকমের ছেলে তো। মেরিয়ানের একটি ছেলে হয়েছে, এ কথাও মনে পড়ে গেল, ওরা এখন নাকি ক্যালিফোর্নিয়ায় আছে, আচ্ছা, খোতেটা আমেরিকায় কী করে?

যে সব কথার কোনও জবাবই আমার জানা নেই, সে সব কথা আমার মনে চারদিক থেকে ভিড় করতে লাগল, এবং এক সময়ে হঠাৎ আমার মনে হল, আমি একেবারে একা দাঁড়িয়ে আছি, কেউ নেই, কোথাও কোনও শব্দ নেই, কেবল গাড়ি ছোটার শব্দ। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি কি এখনও সেই কুপেতে আছেন, নাকি নিজের কুপেতে ফিরে এসেছেন? রাত কত হল? আমার হাতে কোনও ঘড়ি নেই। বেয়ারাটাও চলে গিয়েছে, কোকাকোলার শূন্য বোতলটা কোথায় রাখব? দেখলাম এক পাশে, কাঠের বাক্সে খালি বোতল অনেক রয়েছে। তার মধ্যেই বোতলটা ঢুকিয়ে দিলাম। চেয়ার কারের কমপার্টমেন্টের দরজা একটু ফাঁক করে দেখলাম, অন্ধকার, বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, সবাই বোধ হয় ঘুমোচ্ছ। মনে হল, এখন আমি আমার কমপার্টমেন্টের করিডরে ফিরে যেতে পারি, লায়লী সিং এখন নিশ্চয় জেগে নেই।

আমি আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে, অন্ধকারে সাবধানে, মাঝখানের সরু স্পেস দিয়ে এগিয়ে গেলাম, এখানেও নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে, এবং কেউ কেউ শীতের রাত্রের মতো, চাদর দিয়ে গা, মাথা মুড়ি দিয়ে, আধশোয়া হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে কমল বসু কোথায়, তা এখন বোঝবার উপায় নেই। আমি আর একটা এন্ডের দরজা খুলে, বাথরুম স্পেসে পা দিলাম। করিডরে আলো জ্বলছে। অ্যাটেনডেন্ট তার নিজের আসনে বসেছিল, আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। হয়তো সে ভেবেছে, আমি এই কমপার্টমেন্টের যাত্রী না, অথবা অবাক হয়েছে আমাকে এখন চেয়ার কার কমপার্টমেন্ট থেকে ফিরতে দেখে। আমি বাঁ দিক ফিরে করিডরের দিকে যেতে যাব, বাথরুমের দরজা খুলে গেল, দরজার সামনে লায়লী সিং দাঁড়িয়ে। সে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, মাদান।

মাদান! উহ, মস্তিষ্কের মধ্যে সাপটা কেবল কুণ্ডলী পাক দিচ্ছে আর ঝুলছে, তার চেয়ে দ–দ– দংশন করলে আমি বাঁচতাম, এটা একটা অসহ্য অবস্থা, কেন না, আমার সারা গা কেঁপে, মাথা ঘুরে যাচ্ছে, অথচ আমার ভিতরটা যেন বরফের মতো জমে গিয়েছে, আমার একটুও মুভ করার ক্ষমতা নেই। ঠিক যেন সেই শোনা কথার মতো, কারণ কখনও দেখিনি, অজগরের সামনে কী বলে ওটাকেস সম্মোহিত নিশ্চল ছাগলছানার মতো আমার অবস্থা, কঁপছি অথচ নড়তে পারছি না, আর দেখছি, গাঢ় বেগুনি রঙের সিল্কের ঢোলা পায়জামার ওপরে, একই রঙের লুজ পাঞ্জাবি পরা অজগরের চোখ দুটি টকটকে লাল, মাথার চুল গালে, কপালে ছড়ানো, রঙের কোনও প্রলেপ নেই, এবং অজগর যদিও ফণা তুলতে পারে না, তবু এ অজগর যেন, দু হাতে দরজা ধরে দুলছে। সেটা কেবল গাড়ির ঝাঁকুনিতে না, বোধ হয় কেন না, অজগরের লাল চোখ কেমন যেন ঢুলুঢুলু করছে। মাদান!’ সেই নাম, কনট সার্কাসের জুনের দুপুরে শুনেছিলাম, অথচ পিছন ফিরে দৌড়তে পারছি না, লায়লী সিং আবার ডেকে উঠল, য়ু মাদান! রিয়্যালি য়ু মাদান?’

আমি প্রায় স–সভয়ে ঘাড় নাড়তে গেলাম, কিন্তু আমার ঘাড় নড়ল না, যেন পেরেক ঠুকে অনড় করে দিয়েছে। লায়লী সিং-এর মুখ দরজার বাইরে খানিকটা এগিয়ে এল, বলল,’হোয়্যার ফ্রম, য়ু মাদান, হাউ য়ু আর হিয়ার, ইন দিস ভেরি মোমেন্ট?

আমারও সেটাই ভাবতে ইচ্ছা করছে, ঠিক এই মুহূর্তেই, এই অ–হ্যাঁ, অলৌকিক সাক্ষাৎ ঘটল কী করে? বাস্তবের সংজ্ঞা কী? লায়লী সিং-এর কথা ঠিক জড়ানো না, অনেকটা ভাঙা ভাঙা আর মোটা, যেন কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে, আর আমি গাড়ির ঝাঁকুনিতে যেন প্রায় লগবগ লগবগ করছি। লায়লী সিং আবার ইংরেজিতে যা বলল, তার মানে এই, আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না, বলা উচিত না, কেন বলবে, এত ঘটনার পর? সব দোষ আমার। সব। যদিও তার পরদিনই আমাকে সিমলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা হোক, সব দোষ আমার, আমাকে তুমি বলতে পারো, কী করে এটাকে কমপেসেট করা যায়?

কমপেনসেট? আর ঠিক এই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে গেল, অ্যাটেনডেন্ট গার্ড আমার ডান দিকের পিছনেই বসে আছে, এবং মনে হতেই, আপনা থেকেই আমার ঘাড় ফিরে গেল। আশ্চর্য, সে অদ্ভুতভাবে মাথা নিচু করে বসে আছে, যেন কিছুই দেখছে না, শুনছে না। কিন্তু কমপেনসেট? তার মানে কী, পরিশোধ? আমি আবার লায়লী সিং-এর দিকে তাকালাম, দেখলাম, ও এক পা এগিয়ে এসেছে। অ্যাটেনডেন্ট গার্ডের দিকে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বলল, ওর জন্য ভেবো না, ওর ব্যবস্থা আমি করে দেব, (কমপেনসেট?) তুমি বলল মাদান, কীভাবে আমি এটা কমপেনসেট করতে পারি?

বলতে বলতে ও একটা হাত বাড়িয়ে দিল, আর তৎক্ষণাৎ গ্রাসে ঢোকবার আগে, একটা শেষ চেষ্টার মতো, আমি নড়ে উঠলাম, এক পেছিয়ে গেলাম, আর এ সময়েই ভারী পায়ের খসখস শব্দ এগিয়ে এল, আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মিঃ চ্যাটার্জি। টকটকে লাল চোখ ঘুমে জড়ানো, শরীরও দুলছে, এবং আমার দিকে কেমন একটা ভুরু কোঁচকানো অচেনা দৃষ্টিতে তাকালেন–তার মানে, আমাকে চিনতে পারছেন না, এবং বোধ হয়, কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোধ হয় লায়লী সিংকেও চিনতে পারলেন না। তারপরে চিনতে পেরেই, জড়ানো প্রায়, মোটা স্বরে বলে উঠলেন, হ্যালো মিসেস সিং!’ বলে তিনি আবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, এবার তাঁর লাল চোখের পাতা আর একটু খুলল, আমার আতঙ্ক উত্তরোত্তর বাড়ছে, কিন্তু, আহ, সত্যি উনি আমাকে চিনতে পারলেন না, এবং লায়লী সিং-এর দিকে ফিরে তেমনি স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস সিং, হ্যাভ য়ু সিন বিমি এনিহোয়্যার? আই ডোন্ট সি হার ইন দ্য কুপো 

বলে তিনি অন্য আর একটি লেভেটরির বন্ধ দরজার দিকে তাকালেন। লায়লী সিং পলকে এক বার আমার দিকে দেখে নিল, কারণ আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, কী বলে সেটা শোনবার জন্য। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ওহ, মিসেস চ্যাটার্জি? উনি তো আমাদের কুপেতে আছেন, আমি ওঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে একটু এসেছিলাম, এখুনি আবার ফিরে যাচ্ছি। মিসেস চ্যাটার্জিকে কি পাঠিয়ে দেব?

মিঃ চ্যাটার্জি তার কবজির ঘড়ি দেখে বললেন, আমার মনে হয়, ওর এখন এসে শুয়ে পড়া উচিত, তা না হলে হ্যাঙোভার হয়ে যাবে, সকালে কষ্ট পাবে।

আমি এখুনি গিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ বলতে বলতে লায়লী সিং বাথরুমের বাইরে এল।

থ্যাংকু। মিঃ চ্যাটার্জি ফিরে চলে যাবার আগে, আবার আমার দিকে তাকালেন, এবং এ বার ওঁর চোখে বিশেষভাবে একটি কী বলে–অনুসন্ধিৎসা আর জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছে। উনি ভারী পায়ে স্লিপার খসখসিয়ে চলে যাবার পরেই, লায়লী সিং যেন ভয় পাওয়া স্বরে বলে উঠল, এখন আমি কোথায় খুঁজতে যাব মিসেস চ্যাটার্জিকে? আমি তো জানি না, সে কোন কুপেতে আছে। আর একটা সিঙল কুপেতে সে যাবে, আমাকে বলেছিল।এ সব ঘটনা সত্যি আমার সামনে ঘটছে বলে, আমি যেন। বিশ্বাস করতে পারছি না, এবং লায়লী সিংকে আমার কিছু বলা উচিত কি না, বুঝতে পারছি না। লায়লী সিং আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এ কমপার্টমেন্টে ট্রাভেল করছ?

মম– মমি?’ বলেই আমি চুপ করে গেলাম, সত্যি কথা বলতে পারছি না, মিথ্যাটাও চট করে মুখে এল না, আর লায়লী সিং কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, বুঝেছি, আমার সঙ্গে কথা বলতে তোমার ঘৃণা হচ্ছে।বলেই সে অ্যাটেনডেন্ট গার্ডের দিকে ফিরে বলল, গার্ড, আপকা ক্যায়া মালুম হ্যায়, সিঙল কুপে কয়ঠো হ্যায়, উসকি পাতা ক্যায়া?

অ্যাটেনডেন্ট গার্ড উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দো হ্যায়, এক সি, দুসরা ই।

হঠাৎ আমার শার্টের বুকে লায়লী সিং-এর হাত। আমি সরে যাবার আগেই ও বলে উঠল, জাস্ট এ মিনিট মাদান, ডোন্ট গো, আয়াম কামিং ব্যাক।

বলেই ও পায়জামায় একটা শব্দ তুলে, তাড়াতাড়ি করিডরের দিকে এগিয়ে গেল। আমি তৎক্ষণাৎ চেয়ার কার কমপার্টমেন্টের দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। কিন্তু সেখানে এখন অন্ধকার, আমাকে আবার ওপাশের করিডরে যেতে হবে। আমি অ্যাটেনডেন্ট গার্ডের দিকে ফিরে তাকালাম, আর সাধ্যমতো হিন্দিতে বললাম, ভাই, মুঝে এক কৃপা কিজিয়ে, ম্যায় এ লেভেটরিকে অন্দরমে যারাহে। মেমসাব আনেসে মেরা বাত কুছ পুছেগি তো কহনা কি ম্যায় চেয়ার কার কমপার্টমেন্ট মে চলা গয়া।

আমার মুখ দেখে, লোকটির কী মনে হল জানি না, কেবল দেখতে পেলাম, সে খুব অবাক হয়েছে, এবং জিজ্ঞেস করল, আপ তো সি বার্থ মে হ্যায় না?

জি। আপ মুঝে কৃপা কিজিয়ে, ম্যায় ঘুস যাতা।

যাইয়ে।

আমি আর কোনও কথা না, তাড়াতাড়ি পাশের লেভেটরিতে ঢুকে, ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। আয়নায় আমার নিজের মুখ দেখতে পেলাম, সত্যি, আমার নিজেকেই পিটি করতে ইচ্ছা হচ্ছে, এত দুদু-দুর্গতিও কারোর হয়? অবিশ্যি আমার উচিত, সোজাসুজি কথা বলা। আমার এত ভয়। কীসের? ভয়? এটা ঠিক ভয়-ই কি না, আমি জানি না, কিন্তু সোজাসুজি কথা বলা বা ফ্লেয়ার করা, এ সব যেন আমার ঠিক আসে না। তা ছাড়া, একটা কথা তো আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আমি জেলে বসে প্রায় মাথার চুল ছিঁড়েছি আর নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছি, কেন আমার জীবনে এমন ঘটল, এই। শাস্তি ভোগ করছি, তবু লায়লী সিং-এর ওপরে, যাকে বলে প্রচণ্ড একটা রাগ বা ঘৃণা, সে সব আমার হয়নি, এবং কেন হয়নি, তাও আমি ঠিক বুঝি না, কিন্তু আমি আবার লায়লী সিং-এর সামনে, এটা ভাবলেই আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। না না, অসম্ভব; আর কমপেনসেট? তার মানে কী? এর আবার কমপেনসেট হয় নাকি? আমি তো ভাবতেই পারি না। আমি আয়নার দিকে, আমার মুখ দেখলাম আবার, আর আমার হলুদ রঙের গুরুপাঞ্জাবির কলারটা ঘাড়ের নীচে গোঁজা দেখে, অবাক হলাম। বোধ হয় সেই কমল বসুর গোলমালের সময়, নিজেই গুঁজে দিয়ে থাকব। কোনও কারণে উত্তেজিত হলে, আমি এ রকম করি। কলারটা টেনে তুলতে যাব, সে সময়েই অস্পষ্ট হলেও লায়লী সিং-এর গলা আমি। শুনতে পেলাম, চলা গয়া? চেয়ার কার মে? তারপরে আর কিছু না, কেবল গাড়ির শব্দ আর ঝাঁকুনি, আমি দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। প্রায় মিনিটখানেক পরে, দরজায় আস্তে খুটখুট শব্দ হল। কে? অ্যাটেনডেন্ট গার্ড নিশ্চয়? আমি তবু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপরে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলোম। অ্যাটেনডেন্ট গার্ড। আমি বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিলাম। এখন লোকটির চোখে যাকে বলে কৌতূহল, তা-ই। বলল, মেমসাব আপনা বার্থমে চলি গয়ি। অওর–।’ লোকটি একটু চুপ করে থেকে, আবার বলল, আপকা বার্থমে যো মেমসাব থি, উয়ো মেমসাব ভি আপনা বার্থমে ঘুস গয়ি।

কথাটা শোনা মাত্র, লোকটির চোখের দিকে তাকিয়েই, আমার হাত আপনা থেকেই পকেটে চলে গেল। কিছু খুচরো টাকা আমার কাছে ছিল। আমি তাকে দুটো টাকা দিলাম, সে টাকা নিয়ে, কপালে হাত ঠেকাল, চোখে এখনও সেই কৌতূহলটা রয়েছে, কিন্তু তার দ্বিতীয় সংবাদে আমি খুবই স্বস্তিবোধ করছি যে, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ওঁর কুপেতে ফিরে গিয়েছেন, এবং কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, যা ঘটতে পারত, সবই ভালয় ভালয় মিটে গিয়েছে। মিঃ চ্যাটার্জি যদি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন, তা হলে কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটতে পারত, ভাবতেই আমার ভয় করছে। আমার হয়তো কিছুই হত না, কিন্তু উত্তেজনা? আমি তো উত্তেজনা সহ্য করতে পারি না।

আমি করিডর দিয়ে, প্রায় পা টিপে টিপে আমার কুপের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বন্ধ দরজাটা টেনে খুলে দেখলাম, সেই বেগনি রঙের জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মিস্টার জে. বিশওয়াস কাত হয়ে শুয়ে আছেন, তার লুঙ্গিটানা তাকানো যায় না, যদিও অস্পষ্ট, তিনি ঘুমোচ্ছেন, নিশ্বাসের শব্দে বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যেই কী করে ঘুমোলেন, জানি না। দেখছি, তার খাবার ঢাকা দেওয়া পড়ে আছে, গেলাসে হুইস্কি এখনও কিছু অবশিষ্ট, বোতলের তিন ভাগ শেষ। ওপরের বার্থে বালিশ আর চাদর দেওয়া রয়েছে। বইটা সেখানে রেখে, দরজাটা বন্ধ করলাম, তারপরে ঠিক জায়গায় পা দিয়ে, বার্থে উঠে বসলাম। এবং নিচু হয়ে উঁকি দিয়ে, আর এক বার মিস্টার জে. বিশওয়াকে দেখলাম, মনে পড়ে গেল, দিস ইজ লাইফ।সারা কুপের মধ্যে সেই ফরাসি সেন্টের গন্ধ ছড়ানো, এবং হুইস্কি, এবং আরও অনেক কিছুই যেন তার সঙ্গে মিলেমিশে, একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়ানো, ওহ, সত্যি আমি জানি না, জীবনটা কী। আমি হাত বাড়িয়ে রিডিং সুইচটা অন করতেই মনে হল, আলোটা যেন বড় উজ্জ্বল, আবার সঙ্গে সঙ্গে অফ করে দিলাম। না। এখন আর পড়া হবে না, কিন্তু ঘুম যে আসবে না, তাও ভালই বুঝতে পারছি, তবু আমাকে চুপ করে শুয়েই থাকতে হবে, আর জীবন কী, তার সংজ্ঞাই বা কী, এ জিজ্ঞাসা আমাকে হন্ট করতে থাকবে। আমি শুয়ে পড়লাম।

.

আশ্চর্য, হন্ট করা সত্ত্বেও দেখছি, খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, যে জানালার পরদাটা গোটানো, তার গায়ে আমি ভোরের আলো দেখেছি। এখন পাশ ফিরতেই দেখতে পেলাম, মিস্টার জে. বিশওয়াস আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছেন। দাড়ি কামাবে, দাড়ি কামাবে, যে কোনও রেসপনসিব লোকেরাই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শেভ করে। তা ছাড়া মহিলারা হার্ট হন।‘ আমি আমার গালে এক বার হাত বোলালাম, বেশ খড়খড় করছে, কিন্তু প্রথমেই আমার দাঁত মাজার কথা মনে হল, এবং বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন, অথচ অথচ, যদি লায়লী সিং-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? এ সব কোচে অ্যাটাচড বাথ দেয় না কেন। আমাকে উঠতেই হল, কেন না, আমাকে বার্থরুমে। যেতেই হবে, নামবার সময় শুনতে পেলাম, গুডমর্নিং বয়।

উনি মরনিং উচ্চারণ করেননি, আমি জবাব দিলাম, গুডমর্নিং।

নীচে নেমে, আয়নাতে ওঁর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল। ওঁর চোখের কোল দুটো ফোলা ফোলা, চোখ দুটো চকচক করছে, দেখে মনে হয়, ঘুমটা ভালই হয়েছে। আমি শুয়ে পড়ার পর ওঁর বেশ নাক ডাকছিল, অনেকটা মিঃ চ্যাটার্জির মতোই। একটু অস্বস্তিবোধ করছি, কারণ গতকাল আমি জানালার কাছে যখন বসেছিলাম, তখন আমার সুটকেস আর কিটব্যাগটা কুলি ওখানে সিটের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। উনি যেভাবে দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছেন, না সরলে নিচু হয়ে ব্যাগটা বের করতে পারব না। বললাম, সিটের নীচে আমার ব্যাগটা আছে, মানে আপনি যদি–

আমাকে বের করে দিতে হবে? এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন, যেন নিছক একটু মজা করছেন, কেন না, কথা বলেই উনি গাল দুটো এমনভাবে ফোলালেন, মুখটা প্রায় ফুটবলের মতো দেখাচ্ছে, অবিশ্যি দাড়ি কামাবার জন্যই।

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, না না, মানে, সে কী কথা! আমিই বের করব, আপনি একটু না সরলে।

তাই বলো। তুমি যেভাবে বললে, আপনি যদি-ভাবলাম ঠিক আছে, নিয়ে নাও।বলে উনি আয়না থেকে সরে গেলেন। আমি নিচু হয়ে, কেবল ব্যাগটা টেনে নিয়ে, দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। সত্যি, এখন মনে হচ্ছে, আমি ভগবানকে ডাকতে শিখলে পারতাম, অনেক লোকে যেমন কোথাও বেরোবার সময় দুর্গা দুর্গা বা ওই জাতীয় কিছু বলে, দুর্গতিনাশিনী, তা হলে ভাল হত। জানি না, তাতে সুফল কিছু হয় কি না, এখন আমার তা-ই মনে হচ্ছে, দরজাটা খোলবার আগে। কিন্তু নতুন করে এখন আর বলতে পারছি না। দরজাটা অর্ধেক খুলে, কোন দিকের বাথরুমটা কাছে, দেখে নিলাম। ডাইনেরটা। গতকাল রাত্রে লায়লী সিং গিয়েছিল বাঁয়েরটায়–তার মানে সে ও দিকেই কোনও কুপেতে আছে, এবং গেলে, সে দিকেই যাবে। করিডরটা ফাঁকাই দেখছি। আমি বেরিয়েই, দরজাটা। টেনে দিয়ে, প্রায় ছুটেই বাথরুমের দিকে গেলাম, এবং যেটাতে হাত দিলাম, ভাগ্য ভাল, সেটা এনগেজড নেই। ঢুকে পড়লাম।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই মনে হল, বেয়ারারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, ব্রেকফাস্ট সার্ভ করতে আরম্ভ করেছে। আমি করিডরে আসতেই, একজন মহিলাকে দেখে, বি’ কুপের হ্যাঁন্ডেলেই হাত দিয়ে ফেললাম, কিন্তু মহিলাটি লায়লী সিং না, এবং কয়েক পা এগিয়ে সি’-তে ঢুকে গেলাম। মিস্টার জে. বিশওয়াস ইতিমধ্যে ট্রাউজার, শার্ট পরে নিয়েছেন, টাইটা মাথার ওপর দিয়ে গলিয়ে, কলারের মধ্যে ঢুকিয়ে, ফাঁসটা এঁটে দিলেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই, ওঁর ভুরু কুঁচকে উঠল, জিজ্ঞেস করলেন, দাড়ি কামালে না?

আমার এক বার দাড়ি কামাবার কথা মনে হয়েছিল, কিন্তু ভাবলাম, এগারোটা ত্রিশের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাব, বাড়ি গিয়েই দাড়ি কামাব, যদিও সেফটি রেজার, ব্রাশ, ক্রিম সবই আমার এ ব্যাগে রয়েছে। বললাম, বাড়ি গিয়েই কামাব। ব্যাড, ভেরি ব্যাড, এটাকে তোমার একটা হ্যাবিট করে তুলতে হবে, সকালবেলা দাড়ি কামানো’ বলতে বলতে তিনি বসে পড়ে, স্লিপার খুলে মোজা পরতে লাগলেন। বেয়ারা কখন ওঁর গতকালের খাবারের বাসন তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এখন সে আমাদের ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঢুকল, এবং দুদিকে দুজনের খাবার রেখে, মিস্টার জে. বিশওয়াসের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কফি অওর টি সাব?’

‘কফি।’ বললেন তিনি, এবং বেয়ারা হোত আচ্ছা’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপকা?

‘চা।’ বলে আমি ব্যাগটা হুকে ঝুলিয়ে রাখলাম। একটা বেশ সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি, সেই সেন্টের গন্ধ না, সেটা এখনও আছে, অন্য একটা গন্ধ, বোধ হয় আফটার শেভিং লোশনের গন্ধ, তপনকাকা যেটা ইউজ করেন, অনেকটা সেই রকম। মিস্টার জে. বিশওয়াস জুতো, মোজা পরে নিলেন। বালিশ, চাদর নিয়ে গিয়েছে, বইটা ওপরে পড়ে আছে। আমি বসলাম, এবং খাবারের ঢাকনা খুলোম, আর আমাদের বাড়ির সেই মজার ঘটনাটার কথা আমার আবার মনে পড়ে গেল, গতকাল যে ঘটনা আমার মনে পড়েছিল। তা প্রায় দশ বছর আগের কথা, সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িতে এক ভদ্রলোক এলেন, ওরিজিনালি তিনি হিন্দি সাহিত্যিক, তেমন নামকরা নন, কিন্তু মানুষটিকে আমার ভাল লাগত, তিনি সব সময়ই বেশ হাসিখুশি থাকতেন, বাবার আসরে প্রায়ই আসেন। বাবার আসরে কত রকমের লোক–মানে ভদ্রলোক যে আসেন। আমাদেরও সে আসরে যাওয়া বারণ ছিল না, এমনকী ড্রিঙ্ক করাও বারণ ছিল না, সে কথা আগেই বলেছি। বছর দশেক আগে, একদিন মিঃ ঝা এলেন, আর খুব হাসতে হাসতে বাবাকে একটি মজার গল্প শোনালেন, আমার ঘটনাও সেটাই, এবং গল্পটাও ম্যাকসিম গর্কির ব্যাপার নিয়েই। মিঃ ঝা প্রগতিশীল হিন্দি সাহিত্যিকদের আসরে একটি হিন্দি গল্প শুনিয়ে এসেছিলেন, এবং সে গল্প শুনে, সবাই ওঁকে অশ্লীল বলে যা-তা সমালোচনা করেন। ওঁর ভাষায়, (উনি ভাল বাংলা বলতে পারেন।) বুঝলেন মহাদেবদা, আমি এক-একজনের গালাগাল শুনছি আর মিটিমিটি হাসছি।’ বাবা বলেছিলেন, তার মানে, তুমি তোমার কোঁচার মধ্যে একটি বেড়াল রেখে দিয়েছিলে। মিঃ ঝা। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, একজাক্টলি মহাদেবদা, আর সেই বেড়ালের নাম, মাফ করবেন, ম্যাকসিম গর্কি, কেন না, গল্পটা আমার না, তাঁর। গল্পটা অনুবাদ করার সময়, আমি নামধামগুলো এদেশি করে। দিয়েছিলাম, আর জায়গাটাও আমাদের বিহারের একটা অঞ্চলের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। শেষপর্যন্ত যখন দেখলাম, তাদের আক্রমণ অনেক দূর পর্যন্ত এসে গেছে, তখন আমি বেড়ালটাকে ছেড়ে দিলাম। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। তারপরে গল্পের নামটা যখন বললাম, তখন সবাইকেই চুপ করতে। হল, কিন্তু একজন ছাড়লেন না, তিনি বললেন, রাশিয়ার লুমপেন প্রলেটারিয়েটদের জীবনের সঙ্গে ইন্ডিয়ান লুমপেন প্রলেটারিয়েটদের কোনও মিল নেই, তাদের বাস্তবতা আমাদের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন, এ ধরনের অনুবাদ করে ঠকানোও অশ্লীল।‘ আমি তা মানি না কিন্তু তর্কে গিয়েও কোনও ফল হত না, তখন সবাই আমার ওপরে খুব খাপ্পা। বাবা বলেছিলেন, তা তুমিই বা ওদের ইঁদুর ভেবেছিলে কেন? তুমি নিয়ে গেছ মাসিকে, ওরা যে সব মাসির বোনঝি বাঘ। মিঃ ঝা খুব হেসে উঠেছিলেন, বাবা মিটিমিটি করে হাসছিলেন। বাবা যে ঠিক কেমন মানুষ, আমি কোনও দিন বুঝতে পারিনি, কেন না বাবার কথা আর হাসির মধ্যে যেন কেমন একটা কী বলে-রহস্য ছিল। মিঃ ঝায়ের সমালোচকদের বাঘ বলে উনি যে ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন, আমি বুঝতে পারি নি, তবে কেমন একটা টিজিং যেন ছিল মনে হয়।

বেয়ারা চা আর কফি নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল। দিয়ে আবার চলে গেল। আমার খাবার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কাপে চা ঢেলে দুধ চিনি দিয়ে নেড়ে চুমুক দিয়ে, আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের দিকে তাকালাম, আমার ভিতরে একটা উত্তেজনা জাগছে, এবং মুখ খুলতে গিয়েও হঠাৎ খুলতে পারলাম না, উনি এখন কাপে কফি ঢালছেন। কফি ঢালা শেষ হল, দুধ ঢাললেন, চিনি নিলেন না, আস্তে করে চুমুক দিয়ে, কাপ রাখলেন। আমি বললাম, আচ্ছা, ইয়ে মানে, আপনি লেখেন না কেন?

‘কেন’ শব্দটা যেন কেমন ঢেউ খেয়ে গেল, একটু বেশি রকম বি–বিনীত আর অমায়িক হতে গিয়ে। উনি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে, যাকে বলে, খানিকটা ফ্রাউনিং করে বললেন, লিখি না। কেন? হোয়াট দ্যু য়ু মিন?

আমার যা ব্যাপার, আমি আবার তোতলা হয়ে গেলাম, বললাম,  তা–তা–তা না, আ-আপনি তো লেখেনই, আমি–আমি বলছিলাম, লে-লেনিন যে বব ব্লান্ডার করেছেন না, মানে গর্কির মা–মালভার কথা বলছি, এ বিষয়ে লে–লেখেন না কেন?’ কে’ শব্দটা যেন ককিয়ে ওঠার মতো শোনাল, কারণ মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখ-চোখ, সেই–সেই রকম ভীষণ হয়ে উঠেছে। শক্ত মুখে আর শক্ত স্বরে বললেন, হোয়াট ডু য়ু মিন, কলকাতা এগিয়ে আসছে, তা-ই?’

আমি একেবারে ফ্যাফ্ল্যাবারগাসটেড। আমার কথার সঙ্গে, কলকাতা এগিয়ে আসার সম্পর্ক কী, বুঝতে পারছি না। কোনও রকমে উচ্চারণ করতে পারলাম, মা-মানে?’ তার মানে, ইট সিমস, তুমি আমাকে লেঙ্গি মারতে চাইছ। আমি বুঝি, তা না হলে এ সব কথার মানে কী? লেনিন ব্লান্ডার করেছেন বা মালভা অবসিন, এ সব কথা আমি লিখব? এমনকী, মালভা গর্কির রিপ্রেজেন্টিটিভ স্টোরি না, এ কথাও আমি লিখব না, বুঝেছ?

ওহ্!

হ্যাঁ, যা বিশ্বাস করা যায়, তা-ই লেখা যায় না। তুমি আমাকে কেন এ কথা বলছ, তা আমি ভালই জানি, বাট ডোন্ট গো ফারদার। আমি নকশালদের সমর্থন করেও আর্টিকেল লিখেছি, তুমি আমাকে কলকাতার ভয় দেখিয়ো না।

বলে তিনি উত্তেজিত ভাবে কফির কাপ তুলে চুমুক দিলেন। কিন্তু আমি চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিতে পারলাম না, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের কথার কোনও ইয়ে মানে খেই পাচ্ছি না। আমি কী বলেছি যে উনি এ সব বলছেন। আমি ওঁকে লেঙ্গি মারতে চাই? অর্থমন্ত্রকের এত বড় একজন কর্মচারী, এবং উনি নাকি প্রাইম মিনিস্টারেরও অ্যাডভাইসার, যদিও বিশেষ বিশেষ সাবজেক্টে ওঁকে আমি? ভাবতেই পারছি না।

মিস্টার জে. বিশওয়াস কফি শেষ করে ফেললেন, আবার বললেন, অবকোর্স, আমি তোমাদের বাড়িতেও যাব, মহাদেবদার (বাবা) সঙ্গে দেখা করব, তুমি মনে কোরো না, উনি আমাকে কোনও রকম ভুল বুঝবেন। তোমার কেসের সময়ই ওঁর সঙ্গে আমার ট্রাঙ্কে কথা হয়েছিল। তোমাকে নিয়ে কী হচ্ছে,

আমি একেবারে স-সকাতরে বললাম, বিশ্বাস করুন, আমি খারাপ কিছু ভেবে আপনাকে কিছু বলিনি। আমি জীবনে কখনও কারোকে লেগপুল করিনি।

তিনি বললেন, তা যদি হয়, ওয়েল অ্যান্ড গুড।

বলে তিনি জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি কয়েক সেকেন্ড ওঁর দিকে তাকিয়ে, আমার চায়ের কাপের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। আর আমার কিছু মুখে দিতে ইচ্ছা করছে না। আহ্, কেন যে ভগবানকে ডাকতে শিখিনি। আমি ওঁর সমস্ত কথাগুলোর কোনও মানেই করতে পারছি না। যা বিশ্বাস করা যায়, তা লেখা যায় না; নকশাল সমর্থন করে আর্টিকেল; লেঙ্গি মারা; লেগপুলিং; কলকাতা এগিয়ে আসা; কোনও কথারই মানে বুঝলাম না, কেবল এইটুকু ছাড়া, দিল্লিতে আমার ব্যাপারে, বাবার সঙ্গে ওঁর আগেই সব বলাবলি হয়ে গিয়েছে, যদিও সেটা আমাকে বলার কী উদ্দেশ্য, তা বুঝতে পারছি না, কারণ ও বিষয়ে আমার কিছু যায় আসে না। ওটা বাবার আর ওঁর ব্যাপার।

দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল, দেখা গেল স্যুটেড বুটেড টাই বাঁধা মিঃ চ্যাটার্জিকে, ওঁর সেই কেমন যেন ভীষণ মোটা গলায় বলে উঠলেন, গুডমর্নিং স্যার।

হ্যালো হ্যালো হ্যালো মিঃ চ্যাটার্জি, কাম ই প্লিজ। মিস্টার জে. বিশওয়াস খুশি গলায় ডাকলেন।

মিঃ চ্যাটার্জি ঢুকতে ঢুকতে বললেন, আমি আজ সকালে বিমির মুখে শুনলাম, আপনি এ গাড়িতে কলকাতায় যাচ্ছেন। আপনার সঙ্গে যে ওর কাল সন্ধেয় করিডরে দেখা হয়েছিল, বলতেই ভুলে গেছে।

মিস্টার জে. বিশওয়াস হেসে বললেন, তাই নাকি? তাতে কী হয়েছে, প্লিজ সিট ডাউন।

মিঃ চ্যাটার্জি, ওঁর পাশে বসলেন। বললেন, হঠাৎ একটা জরুরি দরকারে-আই মিন নট অফিসিয়াল, একটু কলকাতায় যেতে হচ্ছে। আপনি হঠাৎ?

আমারো তা-ই বলতে পারেন, পারিবারিক আই মিন পারিবারিক, তা ছাড়া দু-একটা কালচারাল গ্যাদারিং আছে, আই মিন, টু টক।

ও আচ্ছা।’বলে মিঃ চ্যাটার্জি এতক্ষণে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে নিতে গেলাম, উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, স্ট্রেঞ্জ, ইফ য়ু ডোন্ট মাইন্ড, ডিড আই সি য়ু আর টকিং উইথ মিসেস সিং, লাস্ট নাইট?

উনি কথাটা আমাকেই জিজ্ঞেস করেছেন, অতএব জবাবটা আমাকেই দিতে হয়, তাই মুখ ফিরিয়ে, ঘাড় কাত করে, হ্যাঁ বলে, মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল। মনে হলো, উনি বোধ হয় জীবনে এত অবাক কখনও হননি, যে কারণে ওঁর মুখটা পর্যন্ত লাল হয়ে উঠেছে। মিঃ চ্যাটার্জি এ বার বলে উঠলেন, আরে, আপনি তো সেই, আমাদের তপন সেনের ইয়ে মানে–

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি মদনমোহন।

মদনমোহন, ইয়েস। মাই গড, আপনি কাল রাত্রে মিসেস সিং-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন, বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে?

বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে?’ মিস্টার জে. বিশওয়াসের গলায় কয়েক টন বিস্ময় ঝরে পড়ল।

মিঃ চ্যাটার্জি তার মোটা দরাজ গলায় হেসে উঠলেন, ওঁর শরীর দুলে উঠল, গোটা সিটের দোলায় মনে হল আমি যেন নাচছি। হাসি থামলে বললেন, হ্যাঁ, কাল তো তাই দেখলাম। বাহু, গুড, ভেরি গুড ইয়ংম্যান, ইট ইজ রিয়্যালি এ স্ন্যাপ টু আস অল। আয়াম রিয়্যালি হ্যাপি।

উনি কী ভেবে এ সব বলছেন, বুঝে ওঠার আগেই, মিস্টার জে, বিশওয়াস আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসার স্বরে বললেন, তার মানে, য়োর দিস জার্নি ওয়াজ প্রিঅ্যারেঞ্জড উইথ লায়লী সিং?’

না আমার কথা শেষ হবার আগেই, খোলা দরজায় মিসেস চ্যাটার্জি দেখা দিলেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

মিসেস চ্যাটার্জি এখন শাড়ি পরে এসেছেন, অনেকটা গতকাল বিকালের মতোই পোশাকে। মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, তোমাকে আজ সকালে বলছিলাম না, একটি অদ্ভুত ছেলের সঙ্গে মিসেস সিংকে কাল রাত্রে আমি বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। দ্যাট ইজ হি, দিস মদনমোহন।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, ওহ, সে কথা লায়লীর কাছ থেকে এইমাত্র আমি শুনে এলাম। ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট। মদনবাবু আসছিলেন, লায়লী তখন বাথরুম থেকে বেরোচ্ছিল, ও খুব অবাক হয়ে গেছল। ব্যাপারটা আর কিছুই না।

বলেই তিনি আমার আর মিঃ চ্যাটার্জির মাঝখানের ফাঁকে বসে পড়লেন। আমি প্রায় কাত হয়ে সরে বসতে গেলাম, সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, ঠিক আছে মদনবাবু, বসুন আপনি, আপনাকে পুলিশে ধরবে না। এখন বলুন তো, লায়লী আপনাকে কাল রাত্রে কী বলল?

আমি খোলা দরজাটার দিকে এক বার অসহায়ের মতো দেখলাম, তারপরে বললাম, না-হা মানে উনি খুবই অবাক হয়েছিলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, যা ঘটে গেছে, সেটা কী ভাবে কনপেনসেট করা যায়।

কমপেনসেট? মিস্টার জে. বিশওয়াস অবাক স্বরে বলে উঠলেন।

কমপেনসেট?’ বলেই সুদীপ্তা চ্যাটার্জি খিলখিল করে হেসে উঠলেন, সেই সঙ্গে মিঃ চ্যাটার্জিও। এক জন বেয়ারা প্রায় দাঁড়িয়েই পড়েছিল দরজার কাছে, মিস্টার জে. বিশওয়াস বলে উঠলেন, বেয়ারা, দরবাজা বন্ধ কর দো।

বেয়ারা দরজাটা টেনে দিয়ে গেল, আমি ককথঞ্চিৎ স্বস্তি বোধ করলাম, এবং ওঁদের দুজনের হাসি থামার পর, প্রথম সুদীপ্তা চ্যাটার্জির গলা শোনা গেল, মিস্টার বিশওয়াস আপনি বলুন, কী করে লায়লী মদনবাবুকে কনপেনসেট করতে পারে?

মিঃ চ্যাটার্জি বলে উঠলেন, আমি বলতে পারি, বিশেষ করে লায়লী সিং যখন কলকাতাতেই যাচ্ছে, দেয়ারইজ এ গ্রেট চান্স টু কমপেনসেট। কী বলেন মদনবাবু?

আমি এ সব কথাবার্তার মানে কিছুই বুঝতে পারছি না, যাকে বলে ইয়ে, মানেফ্যালফ্যাল করে। ওঁদের মুখের দিকে দেখতে লাগলাম, যদিও মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখ যেন কেমন থমথম করছে। বললাম, না, মানে আমি ঠিক–আই মিন, কুডন্ট ফলো য়ু।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আবার খিলখিল করে হেসে উঠলেন, এবং মিঃ চ্যাটার্জিকে এক কঁধ দিয়ে একটা ধাক্কা দিলেন, বললেন, কেন ওঁকে এ সব বলছ। হি ইজ রিয়্যালি ইনোসেন্ট অ্যান্ড এ লাভলি ইয়ংম্যান।

বলেই আর এক কঁধ দিয়ে আমাকেও একটা ধাক্কা দিলেন, বললেন, আমি আপনাকে জানি মদনবাবু, হোয়াট য়ু আর। য়ু আর নট এ লেডি কিলার, বাট দে কিল য়ু।

বলে ঘাড় কাত করে, চোখের তারা দুটো ঘুরিয়ে, কেমন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু মেয়েরা আমাকে আবার কি করবে কী করে? বুঝতে না পেরে, সুদীপ্তা চ্যাটার্জির সেই সেই চোখের কেমন যেন তারা ঘোরানো দেখতে লাগলাম। কয়েক সেকেন্ড দেখতেই, আমার মাথাটা যেন ঘুরে গেল, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম, এবং মিস্টার জে. বিশওয়াসের গলা শুনতে পেলাম, কিন্তু মিসেস চ্যাটার্জি (আশ্চর্য, উনি তো ওঁকে বিমি’, তুমি’ বলে ডাকেন!) আপনি ওকে যতটা ইনোসেন্ট ভাবছেন, ততটা বোধ হয় না, একটু আগেই তার একটা প্রমাণ আমি পেয়েছি। এনি হাউ, তা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু লাস্ট নাইটে লায়লী সিং-এর সঙ্গে যে ওর দেখা হওয়াটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, এটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না।’

আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখের দিকে তাকালাম। ওঁর শক্ত মুখে কেমন একটা চ্যালেঞ্জের। এক্সপ্রেশন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জির অবাক চোখ বড় হয়ে উঠল, বললেন, বাট লায়লী টোন্ড মি! সে মিথ্যা কথাও বলতে পারে। বলে মিস্টার জে. বিশওয়াস এক বার আমার দিকেও তার শার্প দৃষ্টি দিয়ে যেন। বিধিয়ে দিলেন।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জির ঠোঁট দুটো কেমন যেন একটু বেঁকে উঠল, আর গলার স্বরে বেশ একটু জোর দিয়ে, এবং আরও কিছু–বোধ হয় বিদ্রূপ মিশিয়ে বললেন, মিস্টার বিশওয়াস, কোনও কোনও বিষয়ে আপনি আমার কথাকে সত্যি বলে মনে করতে পারেন। মেয়েরা কখন মিথ্যা বলে আর কখন সত্যি বলে, সেটা আপনাদের থেকে আমরা একটু ভাল বুঝি।

মিস্টার জে. বিশওয়াস সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে তাকিয়েছিলেন। ওঁর কথা শুনে, মিস্টার জে, বিশওয়াসের মুখের ভাব একেবারে বদলে গেল, বলে উঠলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, আর বলতে হবে না মিসেস চ্যাটার্জি, এরপরে আর আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।

মনে হল, মিস্টার জে. বিশওয়াস যেন একটু ঘাবড়েই গিয়েছেন, এবং কেমন এক রকম করে যেন সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে তাকালেন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আমার দিকে ফিরে, একটু হাসলেন, যে হাসিটাকে বলা যায়, একটা বাবাতুলের কথা শুনে হাসছেন, কিন্তু ওঁর শরীরটা–মানে ইয়ে, হ্যাঁ শরীরটাই এমন, আর জামা আর শাড়ি আর ভোলা নাভি আর সেই, সেই গন্ধ, সব যেন আমাকে ধাক্কা মারতে চাইছে, তাই ভয়ে ভয়ে আমি সরে যেতে চাইছি।

মিঃ চ্যাটার্জি বলে উঠলেন, কিন্তু মিস্টার বিশওয়াস, যদি লায়লীর সঙ্গে মদনবাবুর মিটিংটা প্রিঅ্যারেঞ্জডই হয়, তাতেই বা কী যায় আসে। আমি তো মনে করি, সেটা আরও মজার ব্যাপার।’

মিস্টার জে. বিশওয়াস বললেন, মজার হতে পারে। কিন্তু একজন মিথ্যা কথা বলবে সেটা মেনে নেব কেন?

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, সোহোয়াট, আপনি যদি মেনে না নেন? মদনবাবুর কী আসবে যাবে তাতে, লায়লীরই বা কী যাবে আসবে?

আমি কখনও সুদীপ্তা চ্যাটার্জির মতো কথা বলতে পারব না, বিশেষ করে, মিস্টার জে. বিশওয়াসকে। অনেকে যেমন বলে, অদ্ভুতভাবে, ছুরি চালিয়ে দিয়েছে, উনি যেন সেই রকম ছুরি চালিয়ে দিলেন, যদিও আমার কানে এখনও খটখট করে বাজছে, ওঁদের দুজনে দুজনকে আপনি’ করে বলতে শুনে। গতকাল এক বারও বলেননি। কী যে ব্যাপার জানি না, একমাত্র মনে পড়ে, দিস ইজ লাইফ। মিস্টার জে. বিশওয়াস যেন কেমন-কেমন নিভে গেলেন, যদি মানুষ নিভে যেতে পারে, এবং বললেন, অবকোর্স তা ঠিক। কিন্তু এভাবে বলবেন না মিসেস চ্যাটার্জি। অনেকেরই অনেক কিছুতে কিছুই যায় আসে না, কিন্তু সেটাই সব না।’

কোনও গরম জিনিস জুড়িয়ে গেলে যেমন হয়, মিস্টার জে. বিশওয়াসের গলাও যেন সেই রকম জুড়িয়ে গিয়েছে। আবার বললেন, ভেবে দেখুন, ব্যাপারটা যদি চন্দন সিং-এর চোখে পড়ে যেত, তা হলে কাল রাত্রে গাড়িতেই একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, যেত যেত। মদনবাবু আর লায়লী যদি আগে থেকে কথাবার্তা বলেই দেখা করত, তা হলে রিস্ক তারাই নিত, যদিও ব্যাপারটা মোটেই তা না। আর সর্দার যদি মনে করে, তার সর্দারনিকে মদনবাবু কেবলি ফুসলে নেবার তাল করছে, তা হলে সে তো একটা হোস। যার ওয়াইফ নিজেই এগ্রেসিভ, তার স্বামীর কী করবার আছে? আসল ব্যাপারটা কী, তা তো আমরা সবাই জানি মিস্টার বিশওয়াস। তারপরে আর প্রেস্টিজ কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা আমার ভাবতে ইচ্ছা করে না।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জির চোখের দিকে যেন মিস্টার জে. বিশওয়াস তাকাতে পারছেন না, কেবল বলতে পারলেন, তা ঠিক।

মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, মদনবাবু, আমি আপনাদের কলকাতার বাড়ি যাব, মহাদেবদার সঙ্গে এক বার দেখা তো করতেই হবে। তখন আপনার মুখ থেকে আমি শুনতে চাইব, আপনি লায়লী সিং-এর ব্যাপারটা কী ভাবে নিয়েছিলেন।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বলে উঠলেন, তার কী দরকার। হাতের ঘড়ি দেখে বললেন, হাওড়া পৌঁছুতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। মদনবাবুর মনের কথাটা আমরা এখনই শুনি না। আয়াম রিয়্যালি সো। কিউরিয়াস টু নো’ বলতে বলতে তিনি আমার দিকে তাকালেন, কথা শেষ করলেন, হোয়াট ইজ য়োর রিঅ্যাকশন। প্লিজ মদনবাবু বলুন।

রিঅ্যাকশন? মুশকিল সত্যি, আমি কী করে বোঝাব, আমার কী মনে হয়েছিল। কী বললে সেটা বোঝানো যায়, আমি জানি না। জিজ্ঞেস করলাম, মানে, কী বলব বলুন তো?

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি এখন প্রায় আমার দিকে ঘুরেই বসেছেন, এবং বলতে গেলে, প্রায় আমার গায়ের সঙ্গে ছুঁয়ে আছেন, কেন না, চার জনের বসবার মতো সাফিসিয়েন্ট জায়গা নেই। তিনি বললেন, আপনার রিঅ্যাকশন, অব দ্য অ্যাফেয়ার।’

আমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না, মনে হল, যাকে বলে, অগাধ জলে পড়ে গিয়েছি। সত্যি, আমার কী রিঅ্যাকশন? অবাক, হ্যাঁ, ভীষণ অবাক হয়েছিলাম, আর জেলে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তা-ই বললাম, খুব অবাক হয়েছিলাম, আর জেলে–মানে জেলের যা ব্যবস্থা, আর অনেক কয়েদির যা চরিত্র, তাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।’

বাট দ্যাট’জ ভেরি কমন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, লায়লী যখন কনট সার্কাসে ও রকম একটা কাণ্ড করল, আপনি কী ভাবলেন?

অবাক হলাম।

স্রেফ? তারপরে যখন আপনাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল, মামলা উঠল আপনার নামে, রিগরাস পানিশমেন্ট দিয়ে দিল, তখন?

তখন? তখন–ভয় পেলাম, কষ্ট পেলাম, খুব একটা দুদু-দুঃখ যাকে বলে।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর লায়লীর সম্পর্কে কী মনে হল?

 মিসেস সিং সম্পর্কে? ওঁর কথা আমার মনেই আসেনি।

মনেই আসেনি? ওর ওপর অ্যাঙার বা হেট্রেড কিছু হয়নি?

না তো।

 সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ওঁর সেই–সেই চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যদিও দৃষ্টিটা কেমন এক রকম যেন, এই আলো এই অন্ধকার, এ রকম দেখাচ্ছে, এবং দেখলাম, মিঃ চ্যাটার্জি আর মিস্টার জে, বিশওয়াসও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ সুদীপ্তা চ্যাটার্জি ওঁর দুহাত দিয়ে আমার দু গাল চেপে ধরে বলে উঠলেন, ওহ, হাউ পিওর য়ু আর!’ বলেই এক সেকেন্ড থেমে আবার বলে উঠলেন, দাড়ি কামাননি কেন?

আস্ক হিম, হোয়েদার আই টোন্ড হিম অর নট? মিস্টার জে. বিশওয়াস বলে উঠলেন।

হাউ পিওর য়ু আর থেকে যে দাড়ি কামাবার কথাটা উঠতে পারে, আমি ভাবতেই পারিনি, এবং সত্যি কথা বলতে কী, এঁদের সকলের, তার সঙ্গে মমতা কাকিমা, তপনকাকাও আছেন, এমনকী আমার বাবা, দাদা, ভাই, দিদি, কারোরই কথাবার্তা কোনখান থেকে কোথায় যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারি না।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি আমার গাল থেকে হাত নামিয়ে নিলেন। সত্যি, ভারী লজ্জা করছে, আমার খরখরে। গালে ওঁর এই সুন্দর হাত-মমতা কাকিমা হলে, আমার গালে একটা চাটিই মেরে দিতেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে বলতে গেলাম, বাড়িতে গিয়েই শেভ করব’ ঠিক সেই মুহূর্তেই মাইকে পুরুষের নিচু স্বর শোনা গেল, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, উইদিন এ ফিউ মিনিট উইল বি রিচিং হাওড়া স্টেশন, অ্যান্ড…।

সুদীপ্তা চ্যাটার্জি প্রথমে উঠে দাঁড়ালেন, এবং মিঃ চ্যাটার্জিও, এবং বললেন, তা হলে মিস্টার বিশওয়াস, কলকাতায় দেখা হচ্ছে। আপনার কদিনের প্রোগ্রাম?

মিস্টার জে. বিশওয়াস বললেন, ওহ, ওনলি টু ডেজ, আই উইল ফ্লাই অন দ্য থার্ড ডে বাই মর্নিং ফ্লাইট। আপনারা কদিন?

মিঃ চ্যাটার্জি সুদীপ্তা চ্যাটার্জির দিকে তাকালেন। সুদীপ্তা চ্যাটার্জি বললেন, এক সপ্তাহ। অবিশ্যি আপনার সঙ্গে দুদিনই দেখা হবে। চলি।

বলে আমার দিকে ফিরে বললেন, চলি মদনবাবু, আপনাদের বাড়িতে দেখা হবে।

আমি দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করলাম। মিঃ চ্যাটার্জি এক বার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ঘাড় আঁকালেন, তারপরে দুজনেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, মিস্টার জে. বিশওয়াস জানালার দিকে মুখ করে বসে আছেন, এবং হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে বা নেমে, আমার সঙ্গে একটি কথাও বললেন না, আমার দিকে তাকালেন না, যেন আমাকে চেনেনইনা। কী করব, আমার কিছু করার নেই, কেবল চুপচাপ তাকিয়ে দেখলাম, আর ওঁর কথাটাই ভাবলাম, বোধ হয় দিস ইজ লাইফ।কুলি ওঁর সুটকেস নিয়ে, ওঁর সঙ্গে নেমে গেল। আর এক জন কুলি জিজ্ঞেস করল, আমার কোনও লাগেজ আছে কিনা; আমি না বলে দিলাম, কারণ ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সুটকেসটা নিয়ে, আমি নিজেই ট্যাকসি স্ট্যান্ডে যেতে পারব। আমি ইচ্ছা করেই একটু দেরি করছি, লায়লী সিং নেমে চলে যাক। সবাই নেমে গেলে নামব। ভাবতে ভাবতেই, দরজার কাছে ডাক শুনতে পেলাম। মেজদা।

অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, বদ্রী, বাবার দুই ড্রাইভারের এক জন, এবং পুরনো। বদ্রী বিহারি হলেও ভাল বাংলা বলতে পারে, আমাদের বাড়িতে প্রায় বছর পনেরো আছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি!

বদ্রী হেসে বলল, হ্যাঁ, নামবেন না? আমি তো ভাবছি, আপনি এলেন কি না। বিলকুল প্যাসেঞ্জার নেমে গেছে।

বলতে বলতে সে ভিতরে ঢুকল। বললাম, এই একটু ধীরে সুস্থে নামছিলাম।

 বদ্রী জিজ্ঞেস করল, আপনার মালপত্র কোথায়?

একটা সুটকেস আছে, ওটা আমিই নিতে পারব।বলে আমি সুটকেসটা সিটের নীচে থেকে টেনে বের করলাম। বদ্রী তাড়াতাড়ি সুটকেসটা নিয়ে বলল, আপনি ছেড়ে দিন।

জানি বদ্রী ওটা আমাকে নিতে দেবে না। বদ্রী বেশ ফরসা, আর বাবা তার ড্রাইভারদের সবসময় সাদা ট্রাউজার আর গলাবন্ধ কোটে ফিটফাট রাখেন। আমি হুক থেকে কিটব্যাগটা নিলাম। এখনও সেই–সেই সেন্টের গন্ধ ছড়ানো, আমি বদ্রীর পিছনে পিছনে নেমে গেলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম চন্দন সিং আর লায়লী সিং দাঁড়িয়ে আছে, এবং আমার দিকে দু জনে দু রকম চোখে তাকিয়ে আছে। আমি প্রায় পঁড়িয়েই পড়েছিলাম, বদ্রী পিছন ফিরে ডেকে উঠল, আসুন, তা না হলে জ্যামে পড়ে যাব।

আমি তাড়াতাড়ি বদ্রীর পিছনে পিছনে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি এনেছ নাকি?

 বদ্রী হেসে উঠে বলল, তবে কি এমনি এমনি আসব নাকি?

তোমরা আমার আসার খবর জানতে?

সাহেব জরুর জানতেন, তিনিই তো আমাকে বললেন, আপনি আসছেন, আপনাকে যেন আমি বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য আসি।’

তপনকাকা তা হলে বাবাকে আগেই ইনফর্ম করে দিয়েছেন। বাবার মুখটা আমার মনে পড়ল। তিনি আমাকে কী ভাবে রিসিভ করেন, কে জানে। দিল্লির ঘটনায়, তার রিঅ্যাকশন আমি কিছুই জানি না। শুধু এইটুকু জানি, হায়ার কোর্টে মুভ না করে, লোয়ার কোর্টের ভারডিক্টই যেন মেনে নেওয়া হয়, এবং পানিশমেন্ট মেনে নেওয়া হয়। এর থেকে বাবার মনোভাব কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি হয়তো। আমাকে সত্যি অপরাধী ভেবে নিয়েছেন। বদ্রী আগে সুটকেসটা পিছনের কেরিয়ারে ঢুকিয়ে দিল, তারপরে আমাকে ঢোকবার জন্য পিছনের দরজা খুলে দিল। আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম। সে আমার। দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল, এবং এক পলকের জন্য যেন আমি মিস্টার জে. বিশওয়াসের মুখ দেখতে পেলাম, তিনি আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা বাড়ি আছেন তো?

বদ্রী বলল, না, সাহেব আজ সকাল সকালে বেরিয়েছেন, সাড়ে চারটের সময় ফিরবেন।

এত সকাল সকাল? বাবা তো বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ বেরোন?

আজ কী একটা কাজ পড়ে গেছে বলছিলেন।

আমি হাওড়া ব্রিজের দিকে তাকালাম। প্রায় তিন বছর বাদে কলকাতায় ফিরছি। কলকাতাকে আমি ভালবাসি, দিল্লিকেও আমার ভাল লেগেছিল, কিন্তু কী একটা পাগলামি যে ঘটে গেল কলকাতা যেন সেই কলকাতাই আছে। বদ্রী স্ট্রান্ড রোড ধরে, ময়দানের দিকে এগিয়ে চলল।

আমাদের বাড়িটাকে কলকাতার কোন এরিয়াতে বলা যায়? সাউথ? না। সেন্ট্রাল? তাও যেন ঠিক না। এ রকম কোনও শব্দ কি বলা যায়, সাউসেন্ট। কেন না, এরিয়াটা সাউথ সেন্ট্রালের মাঝামাঝি। পোস্টাল অ্যাড্রেস কলকাতা-১৯। আমাদের বাড়ির সামনে খানিকটা খোলা জায়গা আছে, যার এক পাশে তিনটি গ্যারেজ, এবং একটু বাগানের মতো। প্রথমে নাথুর সঙ্গেই দেখা হল, বাইরে অংশটা দেখাশোনা করা, (আসলে পাহারা দেওয়া) ওর কাজ। ও কপালে হাত ঠেকিয়ে হাসল, কিন্তু ওর চোখে কেমন একটা অবাক জিজ্ঞাসা। আমাদের বাড়িটা বড়, আড়াইতলা। নীচের তলাতে কোনও শোবার ঘর নেই, কেবল বসবার, গল্প করবার আর রান্না আর ডাইনিং রুম নীচে। আমার শোবার ঘর অবিশ্যি দোতলাতেই, এবং অধিকাংশ শোবার ঘর (দশটা–সব মিলিয়ে) খালিই পড়ে থাকে। বদ্রী আমাকে বলল, আপনি ওপরে চলে যান, কেউ এসে সুটকেস নিয়ে যাবে।

এ বাড়িতে লোকের অভাব নেই, বলতে গেলে, অনেক বেশি। বাবার তা-ই মরজি। যেন মুখ না খুলতেই কেউ হাজির হয়। অবিশ্যি সারা দিন এক রকম কাটে, সন্ধে থেকে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন অনেক লোকের দরকার হয়। রোজ সন্ধেতেই বাবার এত গেস্ট আসেন, আর এত রকম, এবং আগেই বলেছি বাবা দেবাদিদেব মহাদেবের মতো বসে থাকেন, সবাই এসে বাবার সঙ্গে কথা বলেন, তারপরে যে যার ড্রিঙ্ক নিয়ে নিজেদের জায়গা মতো ঘরে গিয়ে বসে পড়েন। বাবা তার কয়েকজন বিশিষ্টকে নিয়ে আসর জমান। তারপরে মোটামুটি সকলেই কিছু খেয়ে, রাত্রি দশটা নাগাদ বিদায় নেন। কলকাতায় এমনটি আমি আর কোনও বাড়িতে দেখিনি, আর বাবার ব্যাপার-স্যাপারও আমি বুঝি না।