৬
রান্কো চলে যাবার কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় বাঘরায় মুখ কালো করে কিতাগড়ে এসে দাঁড়ায়। ত্রিভন তখন সবে শিকার থেকে ফিরেছে—হাতে তার দুটো সেরালী।
এমন অসময়ে বাঘরায় সাধারণতঃ আসে না কিতাগড়ে। তার মুখের দিকে সপ্রশ্নদৃষ্টিতে চেয়ে ত্রিভন চমকে ওঠে। সে মুখে রক্তের কিছু মাত্র চিহ্ন নেই।
—কি হয়েছে বাঘরায়?
জবাব নেই? নির্বাক দৃষ্টিতে রাজার দিকে শুধু চেয়ে থাকে সর্দার।
রাজা সজোরে ঝাঁকি দেয়।
তবু বাঘরায় নীরব।
ত্রিভন অনুমান করে বড় রকমের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেরালী দুটোকে মাটির ওপর আছড়ে ফেলে দেয় সে। বাঘরায়ের হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নেয়।
—চুপ করে থাকলে চলবে না সর্দার। কি হয়েছে বল। যদি কিছু ঘটে থাকে তার প্রতিকার তো করতে হবে। তুমি হলে সতেরখানির সর্দার। যাই হোক না কেন, সকলের মতো ভেঙে পড়া তোমার সাজে না।
দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাজার সামনে মাটিতেই বসে পড়ে বাঘরায় সোরেণ। রুদ্ধ কান্নার আবেগকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলে—ছুট্কী নেই।
—নেই? তার মানে?
—খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
—তবু ভালো। ত্রিভন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে—কি হয়েছে খুলে বল।
প্রতিদিনের মতো আজও বাঘরায় ভোরবেলা উঠে তার ক্ষেতের দিকে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ছুীকে আর দেখতে পায় না। বাঘরায় ভাবল হয়তো কোনো কারণে বাপের বাড়ী গিয়েছে। তাই কিতাগড় চলে আসে সে। বাপের বাড়ী ছুট্কী মাঝে মাঝে যায়। শরীরটা তার ভালো যাচ্ছিল না কিছুদিন থেকে। সব সময়েই বিমর্ষ বলে মনে হত। কথাবার্তা কম বলত শাশুড়ী বলেছিল, ছেলে হবার আগে অমন হয়। প্রথম ছেলে হবার সময় কিন্তু হাসিখুসীই ছিল ছুট্কী। বাঘরায় ভেবেছিল, প্রতিবার হয়তো একরকম থাকে না মন মেজাজ।
দুপুরে কিতাগড় থেকে বাড়ী ফিরতে পারেনি বাঘরায়। কতকগুলো কাজে আটকে পড়েছিল সে। রান্কো বরাহভূমে যাবার পর থেকে তার ওপর কাজের চাপ পড়েছে অনেক বেশী। তাই গড়েই খাওয়া দাওয়া করেছিল। শিকারে যাবার আগে ত্রিভনই তাকে খেয়ে নিতে বলেছিল এখানে।
বাড়ী পৌঁছে বাঘরায়ের বুক কেঁপে উঠল। ছুট্কী ফেরেনি। সকালের যে যে জিনিস, যেখানে পড়েছিল সেখানেই রয়েছে। তাড়াতাড়ি সারিমুর্মুর বাড়ী ছুটে যায় সে। গিয়ে শোনে, ছুট্কী তিনদিন যায়নি ওখানে।
চারদিকে খুঁজতে শুরু করে বাঘরায়। প্রতিটি বাড়ীতে গিয়ে খোঁজে। কিন্তু নেই। কোথাও নেই। নিরাশ হয়ে কিতাগড়ে এসেছে শেষে
ত্রিভন ভেবে পায়না, কী হতে পারে ছুট্কীর। বাঘরায় যখন খুঁজে এসেছে তখন আশেপাশে কোথাও নেই। কিন্তু যাবেই বা কোথায়?
—কোনো ঝগড়া হয়েছিল তোমার সঙ্গে?
—না। ওর সঙ্গে আমার কখনো ঝগড়া হয়নি।
—আমি এখনি লোক পাঠাচ্ছি চারদিকে। তুমি যাবে?
—না। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। সাঙ্ঘাতিক কিছু দেখব হয়তো। বাঘরায় দুহাতে আবার মুখ ঢাকে।
—ছিঃ বাঘরায়, ধারতির বেলায় তো আমি অমন করিনি।
—আপনি রাজা।
—আমি মানুষ—তুমিও মানুষ।
কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে বাঘরায় বল্লে—আমি যাব রাজা।
—আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
—এই অন্ধকারে?
—ধারতির বেলায় তুমি খুঁজে বেড়াওনি সারারাত?
—রাজা! বাঘরায়ের চোখে জল আসে এতক্ষণে। শুকনো চোখ নিয়ে বড় কষ্ট পাচ্ছিল সে।
একটু চুপ করে থেকে বাঘরায় বলে ওঠে—কিন্তু রাজা, এখন তো মঙ্গল হেম্বরম্ নেই।
—চপ্। ও নাম মুখেও এনো না। লোকের যা বিশ্বাস তাকে যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহের ছায়া না পড়ে।
অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়। ছুটকী নেই। ঘুরতে ঘুরতে মারাংবুরুর গুহার সামনে আসে ত্রিভন আর বাঘরায়। এখানেও একবার খুঁজতে হয়—নইলে মনের খুঁতখুঁতি যায় না।
এখন আর এখানে এলে কুকুরের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। সেই কুকুর বন্দী অবস্থায় না খেতে পেয়ে মরে পড়েছিল। নতুন পূজারী এসে ফেলে দিয়েছে তাকে।
ঘুমিয়ে ছিল পূজারী। ত্রিভনের ডাকাডাকিতে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে আসে। রাজাকে দেখে বিস্মিত হয়।
সমস্ত ঘটনা শুনে সে বলে,—তাকে তো দেখেছি রাজা!
—দেখেছ? ছুট্কীকে?
হ্যাঁ। সারিমুর্মু সর্দারের মেয়ে তো?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, কখন দেখেছো? কোথায়? বাঘরায়ের হৃপিণ্ড যেন ফেটে বার হয়ে আসতে চায়।
—সকালে। ওই নীচের পথ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল।
—ছুটে যাচ্ছিল?
—হ্যাঁ। খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ছেলেপিলে হবে দেখলাম।
বাঘরায় নিজেকে সংযত করে বলে—কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি?
—করেছিলাম। বলল, মানত আছে কোন্ বন-দেবতার কাছে। ছেলে যাতে বাঁচে।
ত্রিভন আর বাঘরায় পরস্পরের মুখের দিকে চায়। এ এক গভীর রহস্য। মানতই যদি থাকে, সেকথা স্বামীকে গোপন করবে কেন?
—সত্যিই তুমি জানতে না বাঘরায়?
—না রাজা।
আরও এগিয়ে যায় দুজনা কিন্তু কোথায় সেই বন-দেবতার ঠাঁই? নিরাশ হুয়ে শেষরাতে ফিরে আসে তারা কিতাগড়ে।
দুপুরে অনুসন্ধানকারীদের একজন ফিরে আসে।
বাঘরায় বার হয়নি। দেহ-মনে সে অবসন্ন। ফাঁকা দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে সে চুপ করে বসেছিল রাজার পাশে।
লোকটি রাজার সামনে এসে দাঁড়ায় মাথা নীচু করে।
—খবর পেলে?
—হ্যাঁ, রাজা।
পেয়েছো? কোথায়? চিৎকার করে ওঠে বাঘরায়। মুহূর্তে তার সমস্ত অবসন্নতা ঘুচে যায়। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সে।
—আমদাপাহাড়িতে।
বাঘরায় মূক। আর উত্তেজনা স্তব্ধ। দৃষ্টিতে তার চূড়ান্ত অসহায়তা। সে টলতে থাকে।
ত্রিভন তাড়াতাড়ি উঠে তাকে ধরে ফেলে বলে—এ কী বাঘরায়?
—আমি বুঝতে পেরেছি রাজা।
—কী বুঝেছ?
—ওর মানত। একটি সুদীর্ঘ শ্বাস নির্গত হয় তার অতবড় বুকখানাকে কাঁপিয়ে দিয়ে। শেষে অস্ফুট স্বরে লোকটিকে প্রশ্ন করে,—সে কি বেঁচে আছে?
—না।
ত্রিভনও এতটা আশঙ্কা করেনি। কিন্তু বাঘরায়ের দিকে চেয়ে সে বিস্মিত হয়। দুঃসংবাদটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন নিজের শক্তি নিজের দৃঢ়তা ফিরে পায়। একটুও টলে না, পা কাঁপে না। চোখের পাতাও নড়ে না তার। লোকটির দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বলে—কোথায় সে? নাগাদের সেই টিলার ওপর?
—হাঁ। বাচ্চাটাও বাঁচেনি।
বাঘরায়ের মুখ যন্ত্রণায় নীল হয়ে ওঠে।
—তুমি স্থির হয়ে বসো বাঘরায়। ত্রিভন বলে
—ভাববেন না রাজা। আমি ঠিক আছি। কিন্তু বাচ্চাটা হল কখন? আপন মনে বিড়বিড় করে বাঘরায়।
লোকটি শুনতে পায় বাঘরায়ের স্বগতোক্তি। সে বলে—ওখানেই হ’য়েছে সর্দার। তিনি যেখানে পড়ে আছেন—তার পাশেই; মারা যাবার ঠিক আগে হয়েছে মনে হয়।
—কাকে পাহারায় রেখে এসেছ? ত্রিভন প্রশ্ন করে।
—গ্রামের সবাই। সোরেণ সর্দারের বউ শুনে একপাও নড়েনি, কেউ-নড়বেও না।
আমদাপাহাড়ীতে যাবার পথে বাঘরায় কোনো কথা বলে না। কলের মতো চলেছে ত্রিভনের পাশে পাশে। বিজলীর পিঠে চড়ে আসতে পারেনি ত্রিভন—বাঘরায় সঙ্গে ছিল বলে। সে চেষ্টা করেছিল বাঘরায়কে রেখে আসতে। পারেনি।
শেষে সেই প্রসিদ্ধ পরিচিত টিলাটির কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায় বাঘরায়। ছুট্কীর শেষ অবস্থা নিজের চোখে দেখতে বোধ হয় ভীতি বোধ করে সে—সইতে পারবে না বলে। কিংবা এ-ও হ’তে পারে—শক্তি সঞ্চয় করছে একটু থেমে নিয়ে
—তুমি না হয় এখানে দাঁড়াও। আমি দেখে আসি।
—না না, রাজা। আমি যাব। দেখতেই হবে আমাকে।
ইতিমধ্যেই খবর রটেছিল, রাজা আসছেন। একদল লোক দেখতে পেয়ে টিলার ওপর থেকে ছুটে এসে অভ্যর্থনা জানায়। বাঘরায় প্রতিটি মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। আশার কথা এতগুলো লোকের মধ্যে কেউ-ই শোনাতে পারে না? কেউ বললেও বলতে পারে, একটু নড়ে উঠল যেন, বোধ হয় বেঁচে আছে।
—না, ভুল। আশা করা পাগলামী। সর্দারের পক্ষে এ-পাগলামী শোভা পায় না।
—চলুন রাজা। বাঘরায় বলে।
—আগে আমিই যাই।
—না। আমি যাব।
ভীড়ের মধ্যে একজন বলে—মনে হচ্ছে যেন ঘুমিয়ে আছে বাচ্চাটাকে পাশে নিয়ে। প্রথমে যে দেখেছিল, সে তো তাই ভেবেছিল।
তারা গিয়ে দেখে, সত্যিই ঘুমিয়ে রয়েছে ছুট্কী। বাচ্চাটাও পড়ে রয়েছে মায়ের ঠিক পাশেই। কিন্তু মায়ের সঙ্গে নাড়ীর সংযোগ ছিন্ন হয়নি। অবসর মেলেনি। এ এক ভয়ংকর নাড়ীর টান—যার ফলে মা-ছেলে কেউ-ই বাঁচল না।
ত্রিভনের চোখের পলক পড়ে না।
বাঘরায় নির্বাক।
হঠাৎ সে ছুটে যায় ছুট্কীর দিকে। বসে পড়ে তার পাশে। ছুট্কীর ডান হাতের মুঠো বন্ধ। যেন চেপে ধরে রেখেছে সে। বাঘরায় মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নেয় সেটা। জিনিসটির দিকে চেয়ে শিশুর মতো কেঁদে ওঠে সে।
কেউ কিছু বুঝতে পারে না। ত্রিভনও নয়। দুঃখের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল সবার চোখে মুখে।
বাঘরায় ধীরে ধীরে উঠে রাজার কাছে এগিয়ে আসে। পাতায় জড়ানো একটি মোড়ক দেখিয়ে বলে—এই দেখুন রাজা।
—এটা কী বাঘরায়?
—ডুইঃ-এর অস্থি। এতদিন খুঁজে খুঁজে পাইনি। ছুটকী লুকিয়ে রেখেছিল যখের ধনের মতো।
—তোমার কথা তো বুঝছি না বাঘরায়।
রাজাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চোখের জলে ভেসে সর্দার বাঘরায় সোরেণ বলে—ছুট্কী ছেলেমানুষ ছিল, তাই বুঝতে পারেনি আগে। নিজে মরল—আমাকেও মেরে রেখে গেল।
আমদাপাহাড়িতে কতবার ছুটকী আসতে চেয়েছে। সাধারণ কৌতূহল ভেবে প্রথমে উড়িয়ে দিত বাঘরায়। শেষে এড়িয়ে গিয়েছে। রাগও করেছে ছুট্কীর বাড়াবাড়ি দেখে। কিন্তু কখনো কোনো সন্দেহ জাগেনি মনে। ডুইঃ-এর সঙ্গে ছুট্কীর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তাই ডুইঃ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে কোথায়, সে জায়গা দেখার আগ্রহ খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু দিনে দিনে ভেতরে ভেতরে মিথ্যার ভিত্ ধ্বসে গিয়েছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে—যা আসল সত্যি। তখন আর ছুটকী কোনো বাধাই মানেনি। ছুটে এসেছে আপনজনের কাছে। নিজেও সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে নিশ্চিন্ত হ’য়েছে। এখন বাঘরায় বুঝেছে, কেন ছুট্কী হাসি ভুলেছিল, কেন সে সব সময় একা একা বসে ভাবত—কেন গুণগুণ করে গাইত ডুইঃ-এরই বাঁধা গান।
নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে ডুইঃ-এর অস্থি নিয়ে বাঘরায় যখন ফিরে এল বাটালুকায়, তারপর থেকেই আসল সত্যি আবছাভাবে ছুট্কীর মনে ধরা পড়েছিল। কিন্তু গভীরভাবে জিনিসটি সে তলিয়ে দেখেনি। তবু অস্থির মোড়কটি লুকিয়ে রেখেছিল মহা সম্পদ হিসাবে। সেই সম্পদের মূল্য দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে শেষে কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
ভাঙা গলায় বাঘরায় বলে—রাজা, তীর্থস্থানে এসেছে ছুট্কী। মারাংবুরুর পূজারীকে সে ঠিক কথাই বলেছিল—বন-দেবতার পূজো দিতে এসেছে। সে-পূজোর বলি ছুী নিজে আর তারই রক্তমাংসে বড় হয়ে ওঠা ওইটি। বাঘরায় আঙুল দিয়ে দেখায়।
ত্রিভন স্তব্ধ। এ অভিজ্ঞতা তার কখনো হয় নি। মানুষের মনের এই জটিলতার শিক্ষা আজ তার প্রথম। অপরাধ কারও নয়—অথচ এই নিষ্করুণ অভিশাপ ব্যর্থ করে দিল তিনটি জীবনী-শক্তিতে ভরপুর মানুষকে।
বাঘরায়, ডুইঃ, রান্কো—সব সর্দারই যে শুধু বিষটুকুই পান করছে। সারিমুর্মুও। মেয়ের জন্যে তারও বুক ভাঙবে। সর্দাররা বোধ হয় শুধু দুঃখই পায়। পারাউমুর্মুও তাই পেয়েছিল। তবে কি অমৃতটুকু রাজাদের একচেটিয়া?
নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয় ত্রিভনের। বাঘরায়ের দিকে চাইতে পারে না। সতেরখানির সব রূপ, সব রস, সবটুকু গন্ধ যেন নিজেই শুষে নিয়েছে সে। কারও জন্যে ছিটেফোঁটাও ফেলে রাখে নি। হতভাগ্যেরা ছোটাছুটি করেছে, সামান্য একটু আনন্দ, সামান্য সান্ত্বনার জন্যে কিন্তু পাচ্ছে না। পেতে হলে রাজার স্বার্থপর বুকখানাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হয়।
চোখে জল আসে ত্রিভনের। সামনের ভীড় করা বুকগুলো যেন বিরাট শূন্যতা নিয়ে হাহাকার করছে।
ত্রিভনের দুহাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে। একটা প্রতিহিংসার চরিতার্থতা প্রয়োজন। কিন্তু কার ওপর সেই প্রতিহিংসা? সে জানে না। তবু বুঝতে পারে, কে যেন অন্যায় করছে—ঘোরতর অন্যায়। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এতে দিন যাক্ মাস যাক্, বছর যাক—ক্ষতি নেই, সে থামবে না। মুখোমুখি দাঁড়াবে সেই অন্যায়ের জঘন্য প্রতিমূর্তির সামনে—মঙ্গল হেম্বরমের সামনে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল। সে দিনের পরই আসবে সুদিন। ভরে উঠবে এতগুলো বুক—রূপ রস গন্ধে। মাতাল হবে তারা মহুয়া খেয়ে—নাচবে তারা, গাইবে তারা। কিতাডুংরিতে আনন্দের ঢেউ বইবে। টামাক, তিরিওর শব্দে শালবনের পাতা নাচবে।
রান্কো কিস্কু ফিরে আসে বরাহভূম থেকে। দুঃসংবাদ নিয়ে আসে সে। মহারাজ তার কোনো কথাই শোনেননি। এ-বছরের জন্যে কর না দেবার প্রশ্ন দূরে থাকুক, দরবারে তাকে ভৃত্যদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ সে শুধু দূত নয়, সে গিয়েছিল রাজার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসাবে।
রান্কোর প্রতিটি কথা ত্রিভন গম্ভীর হয়ে শোনে। বুধকিস্কুর কপালের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন কি বাঘরায়ের এ-কয়দিনের ভাবলেশহীন মুখেও রক্তের আভাস দেখা যায়
সারিমুর্মুও এসেছিল কিতাগড়ে। বাড়ীতে তার মন টেকে না—সব সময় তার আতঙ্ক, সে পাগল হয়ে যাবে। তাই অবসর চেয়েও পুরোপুরি অবসর নিতে পারেনি। রান্কোর কথায় সে ধীরে ধীরে বলে—এবারে প্রস্তুত হন রাজা।
কিছুক্ষণ আলোচনা চলার পর রান্কো হঠাৎ বলে ওঠে—এবারে আসল কথা বলি রাজা?
তার কথা শুনে সবাই অবাক হয়। এত কথার পরও আসল কথা বলেনি রান্কো?
—আসল কথা? সবাই নড়েচড়ে বসে। ভাবতে চেষ্টা করে, এর পরও আসল কথা তার কি থাকতে পারে।
ত্রিভনের সপ্রশ্ন মুখের দিকে চেয়ে রান্কো বলে—সমস্ত কিছুর জন্যে শুধু একজনও দায়ী।
—একজন? কে সে?
—নরহরি।
বিস্মৃতির দিকে দুহাতে ঠেলে দেওয়া একটা নাম যেন ঘুরে এসে সবার মনকে নাড়া দিল।
—নরহরি? সে কোথায়?
—দরবারে ঢোকার সময়ে দেখি, মর্যাদার আসনগুলির একটি দখল করে বসে আছে। আমাকে দেখেই কোনো ছুতো করে তাড়াতাড়ি চলে গেল। মনে হল ভালুকের তাড়া খেয়ে যেন পালাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রাজা বলে—বুঝেছি, নরহরি প্রতিশোধ নিতে চায়। বৈষ্ণব ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে তাই রাজার মন্ত্রী হয়ে বসেছে।
—তাহলে আমাদের প্রস্তুতই হতে হবে? বুধ বলে।
—হাঁ, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। বাঁচতে আমাদের হবেই। তবে মহারাজের আক্রমণের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। আমরাই আক্রমণ চালাব।
—সে কি সম্ভব? বুধ বলে।
—অসম্ভব হবে কেন? খাঁড়েপাথরের কথা কি শোনেনি কেউ।
বুধ যেন লজ্জা পায়। বয়স হয়েছে তার। ভীরু না হলেও, নতুন কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে নানান্ চিন্তা আচ্ছন্ন করে তাকে।
ত্রিভন বুঝতে পারে তার মনোভাব। সে বলে—তুমি আর সারিমুর্মু দেশেই থাকবে সর্দার। বাইরে থেকে কোনো হামলা এলে, তাদের শান্তি দেবার ভার তোমাদের দুজনার ওপর রইল।
—তাই হবে রাজা।
—বাঘরায়, তুমি সুপুর রাজ্যের ভার নাও। পাঁচদিনের মধ্যেই চোয়াড়দল নিয়ে রওনা হতে হবে তোমাকে। এর সব বন্দোবস্ত তোমাকেই করতে হবে।
—আমি প্রস্তুত রাজা। বাঘরায়ের চোখ দুটো চক্চক্ করে ওঠে। সে এইরকম একটা কিছু চাইছিল। বাটালুকায় এখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে চায় উত্তেজনা—সব কিছুকে ভুলিয়ে দেবার মতো নেশা-ধরা উত্তেজনা। যুদ্ধের চেয়ে সেরা জিনিস আর কি থাকতে পারে? নাম শুনলেই রক্ত নেচে ওঠে।
—রান্কো।
—আমাকে বরাহভূমের ভার দিন রাজা। ভৃত্যদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার অপমান ভুলতে পারছি না।
—বরাহভূমের আগে একবার ধলভূম ঘুরে এসো। অনেক দূরের পথ বটে, কিন্তু জিততে পারলে কিছু রসদ সংগ্রহ করে আনতে পারবে। আমাদের রসদের প্রয়োজন।
—আমি ধলভূমেই যাব রাজা। মনে মনে ত্রিভনের বুদ্ধির তারিফ করে রান্কো।
—বুধকিস্কু, আজই ঢাউরার ব্যবস্থা কর। শুধু হাটে-মেলার নয়। প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়ীর লোক যাতে শুনতে পায় সেইভাবে ঢাউরা দিতে হবে। লোক চাই—যুদ্ধের জন্যে প্রচুর লোক চাই। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় যেন, এ-যুদ্ধ এক-আধ দিনের নয়। কতদিন চলবে কেউ বলতে পারে না। যারা আসতে চায় তারা খুব তাড়াতাড়ি যেন কিতাগড়ে এসে জমা হয়।
—আমি আজই ব্যবস্থা করছি রাজা।
—সর্দার সারিমুর্মুকেও একটা ভার দিচ্ছি। কে কোন্ দলে গেল, গোবিন্দকে দিয়ে তা যেন লিখে রাখা হয়।
সম্মতি জানায় সারিমুর্মু।
ত্রিভন এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,—সবশেষে একটা কথা জানিয়ে দিই। তা না জানালেও চলত অবশ্য কারণ-নতুন কিছু নয়। তবু নিয়মতো জানানই উচিত। চোয়াড়বাহিনীর চিরকালের যা যুদ্ধপ্রথা তাই আমরা অনুসরণ করব। আমাদের উদ্দেশ্য হবে ওদের রাজ্যের শান্তি নষ্ট করা আর রসদ সংগ্রহ। আসল যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে হবে। লোকসংখ্যা আমাদের বড় কম। তবে দৈবাৎ যদি কখনো শত্রুসৈন্যের মুখোমুখি পড়ে যাও, তখন আমাদের শক্তিটা দেখিয়ে দিতে ভুলো না।
চার সর্দারের সপ্রশংস দৃষ্টির সামনে দিয়ে ত্রিভন কিতাগড়ের অন্দরমহলে প্রবেশ করে।
.
সে রাতে বিমর্ষ ত্রিভনের পাশে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় ধারতি। কিতাগড়ের প্রহরী ছাড়া সমস্ত প্রাণী ঘুমে অচেতন। ত্রিভন শয্যার ওপর কিছুক্ষণ ছট্ফট্ করে ধারতিকে নিদ্রিত ভেবে উঠে এসেছিল অন্দরের আঙিনায়। গ্রহরীরও প্রবেশের অধিকার নেই এখানে।
বসে বসে ভাবছিল সে, এভাবে এগিয়ে যাওয়াটা উচিত হল কিনা। নিজের তরফের অবস্থা তার অজানা নেই। যুদ্ধের জন্যে চাষবাষ হবে না ভালো করে। অনেক পুরুষ নিহত হবে—কিংবা ফিরে আসবে বিকলাঙ্গ হয়ে। সে সময়ে দুর্দিন দেখা দিতে বাধ্য
ধারতির স্পর্শে চমকে ওঠে রাজা।
—ঘুমোওনি তুমি?
—তোমার মনে অশান্তি। কোন্ শান্তিতে ঘুমোবো?
—ভাবছি ঝোঁকের মাথায় এ সব করে বসলাম না তো?
—এ ছাড়া আর কি করতে পারতে?
—একটা মীমাংসায় আসা কি সম্ভব হতো না চেষ্টা করলে?
—হ্যাঁ। তবে মাথা বিকিয়ে। বুড়ো দাদুর মুখে শুনেছি, সম্মানটাই হল আসল, তারপরে জীবন।
ত্রিভন ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে—পারাউ সর্দার সত্যি কথাই বলত। ভুল আমি করিনি। কিন্তু এতগুলো লোককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি বলে দুশ্চিন্তা
—তারা তোমাকে ভুল বুঝবে না রাজা।
—তাদের স্ত্রী—তাদের ছেলেমেয়ে? পথের পানে দিনের পর দিন চেয়ে থেকে যখন তারা হতাশ হবে? তাদের প্রিয় পুরুষটি যখন আর ফিরবে না—তখন?
—তখনো। আমি যে তাদেরই একজন রাজা। আমার মন আর তাদের মন একই। আমাকে দিয়েই আমি বুঝতে পারছি। সতেরখানির মেয়েরা যোদ্ধারি মেয়ে, তারা যোদ্ধার স্ত্রী। বিয়ের পরের দিন বুড়োদাদু কি বলেছিলেন ভুলে গেলে।
ধারতিকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে ত্রিভবন উত্তেজিত হয়—বলে, ঠিক বলছ ধারতি?
—হ্যাঁ রাজা। সাঁওতাল আর মুণ্ডাদের কাছে সম্মানই জীবন
কৃষ্ণপক্ষের রাতের কোটি তারার অস্পষ্ট আলোয় ত্রিভন চেয়ে থাকে তার ধারতির মুখের দিকে। সে মুখ কাঁটারাঞ্জার শালবনের মতই সজীব, সতেজ আর সত্যি।
ধারতি মৃদু হেসে বলে, কি দেখছ অত?
—সতেরখানি।
—এখেনে? ধারতি আঙুলের ডগা দিয়ে নিজের মুখ স্পর্শ করে।
—হুঁ।
—দেখোনি?
—এমনভাবে বোধ হয় দেখিনি।
—আর দেখতে হবে না। ত্রিভনের কোলে মুখ লুকোয় ধারতি।
পরম পরিতৃপ্তি ত্রিভনের মনে। সেই মুহূতে সে ভুলে যায় যে বাঘরায় শূন্য মনে শূন্য শয্যার ওপর ছট্ফট্ করছে। সবই হত, কিন্তু কিছুই হলো না তার। স্ত্রীকে পেল, ভালোবাসল, প্রতিদানও পেল ভালোবাসার অথচ টিকল না। মাঝখান থেকে শুধু পেয়ে হারানোর তীব্র ব্যথা, পিতৃস্নেহের ব্যথা, তার বুকখানাকে ধসিয়ে দিয়ে গেল।
তবু আজ রাতে অন্তত বাঘরায়ের এক মস্ত সান্ত্বনা রয়েছে—সে যুদ্ধে যাবে। যুদ্ধ থেকে না-ফেরার সৌভাগ্য তারও হতে পারে ডুইঃ-এর মতো। ডুইঃ-এর মৃত্যু দুর্ভাগ্যের। সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে কত আনন্দই না অনুভব করেছিল পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারল ভেবে। বেচারা জানতে পারল না, মরে যাওয়ায় কত বড় হতভাগ্য সে।
পারাউ মুর্মুর ঘরে রান্কো তখন তার নিজের জন্যে একটা ধনুক তৈরী করছিল—প্রদীপের আলোর নীচে। রাতের নিদ্রা বহুদিন থেকেই তার নেই। শেষ রাতে অবসন্ন হয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়।
রান্কোর চোখে ভাসে ঝাঁপনীর সেই মূর্তি—শালবনের মধ্যে বরাহভূমে যাবার দিন দেখেছিল যাকে। সে যেন ঝাঁপনীর প্রেতাত্মা। দেখার পর থেকে পৃথিবীর অনেক কিছু তার কাছে মূল্যহীন বলে বোধ হয়েছিল। কিন্তু ছুট্কীর মৃত্যুর বিবরণ শুনে সে যেন আবার বল পেয়েছে। ব্যর্থতার বল–বেদনার বল। কোমরে কাঠ নেওয়া ঝাঁপনীর সাংসারিক কথাবার্তার মধ্যে তাকে খোঁজা বৃথা। আসল ঝাঁপনী রয়েছে তার অন্তরের গভীরতম প্রদেশে। সে নিজেই হয়তো তা জানে না—জানতে চায় না। কারণ জেনে লাভ নেই কোনো। সেদিন ঝাঁপনী নিজের ওপরটাই শুধু দেখিয়েছিল হয়তো, যেমন ছুট্কী দেখাত নিজেকে না জানতে পেরে। তবু যদি একবার ঝাঁপনী আচমকা আভাসে প্রকাশ করে ফেলত তার আগেকার মনকে, বড় ভালো হত। ব্যর্থতার বেদনা উপভোগের মধ্যে একটা দ্বিধাভাব আসত না।
ধনুক তৈরী করতে করতে রান্কো প্রতিজ্ঞা করে আর কোনোদিন সে ঝাঁপনীর সামনে যাবে না। দৈবাৎ দেখা হলেও কথা বলবে না। সেদিনের ঘটনা ভুলে যাবার চেষ্টা করবে। ঘর ছেড়ে চলে আসার দিনের ঝাঁপনীকেই সে মনে রাখবে চিরকাল।
বিদায়ের দিন এসে গেল। বাঘরায় আর রান্কো প্রস্তুত হল। তাদের সঙ্গে যাবে সতেরখানি তরফের সিকি ভাগ পুরুষ। চাষবাসকে তো বন্ধ করা যায় না। নইলে অধ্যেক যেত। ঢাউরার জবাবে প্রায় সবাই জমা হয়েছিল কিতাগড়ে। সবাই যেতে যায়। বেছে নিতে হল তাদের ভেতর থেকে। শুধু একজন পুরুষই যে পরিবারের সম্বল। তাদের ঠেলে দেওয়া যায় না মরণের মুখে। আর যেতে দেওয়া যায় না তাদের, যারা ফসল ফলায়। অনেক আবেদন নিবেদনকে উপেক্ষা করতে হল তাই।
যাত্রার আগে কিতাডুংরির উৎসবের স্মৃতি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে যাবে তারা।
রাজা রাণীর সঙ্গে তরফের সবাই ভেঙে পড়ে সেখানে। রাণী বসলো রাজার পাশেই সেই পাথরের ওপর। চোখ জুড়োলো সকলের সজল চোখে ভাবল সবাই, রাণী যে তাদেরই ঘরের মেয়ে।
সারিমুর্মু কেঁদে বলে ওঠে—রাজা, আজ যদি আমার ছেলে থাকত।—আছে। রাণী বলে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে।
ত্রিভন অবাক হল। অবাক হয় সর্দারেরা—আর যারা শুনেছিল রাণীর কথা।
—বাঘরায় সোরেণ আপনার ছেলে সর্দার।
—বাঘরায়? তাই তো। হ্যাঁ হ্যাঁ—বাঘরায়, তুই-ই আমার ছেলে।
ছুটে এসে বৃদ্ধ সর্দারের হাঁটু জড়িয়ে ধরে ছিল বাঘরায়। বলেছিল-আমি তোমারই ছেলে সর্দার। কিন্তু আশীর্বাদ করে যেন আর ফিরে না আসতে হয়। আমারও যে ছেলে নেই। ছুট্কী একজনকেও রেখে গেল না।
রাণীর মুখ বেদনায় ক্লিষ্ট। রাজা বিচলিত
রান্কো এগিয়ে আসে। বাঘরায়ের হাত ধরে টেনে তোলে। তার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসে! শেষে বলে—খালি বুকেই আগুন জ্বলে বাঘরায়। সেই আগুণই না ঘরের বাইরে ছুটিয়ে নিয়ে যায়! এত বীরত্ব আর যুদ্ধ—সব ওই খালি বুকের কাণ্ড। ভরা বুক একটুকুতেই ভয়ে কাঁপে। হারাবার ভয়। যার সব হারিয়েছে তার ভয় কি?
শেলের মতো ত্রিভনের বুকে কথাগুলো এসে বেঁধে। থাকতে না পেরে সে বলে- একি সত্যি রান্কো?
—হ্যাঁ রাজা।
—এত লোক এখানে জমা হয়েছে,—হাণ্ডি খেয়ে নাচছে, গাইছে। অনেকেই শেষবারের মতো এসব করছে। সবারই বুক কি খালি?
—না রাজা। সতেরখানিকে তারা ভালোবাসে, তাই যাচ্ছে। তারা লড়বে, বীরত্বও দেখাবে। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়া যাকে বলে—তারা তা পারবে না। ভানুমতীর খেল দেখাবার সাধ্য তাদের নেই। খেল দেখায় ডুইঃ টুডু। বাঘরায় সোরেণ আর রান্কো কিস্কুর দল।
রাণীর কথা রান্কো ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ সেদিকে নজর পড়তে রাজ্যের সংকোচ এসে তারা মাথাটাকে হেঁট করে দেয়।
রাজা চিন্তান্বিত হয়। মনে পড়ে তার সেদিনের কথা, সেদিন অদৃশ্য হল ধারতি। প্রচণ্ড মশার কামড় সহ্য করে প্রহরের পর প্রহর বসেছিল মারাংবুরুর ঠাঁইয়ের পাশে ঝোপের মধ্যে। ভালুকের কথা মনে হয়নি—সাপের কথাও নয়। স্বাভাবিক অবস্থায় সে কি তা পারত? বোধ হয় না। তখন যে বুক ছিল শূন্য।
—তোমার কথা সত্যি রান্কো। ধীরে ধীরে বলে ত্রিভন।
ত্রিভন আবার ভাবে। বুক ছিল তার শূন্য সেদিন, কিন্তু তবু আশা ছিল। ধারতিকে ফিরে পাবার আশা। তাই নির্ভীক হলেও, সতর্কতা ছিল বাঘরায়ের সে বালাই নেই। সে সব চাইতে হতভাগা। রান্কোর আশা এখনো সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়েছে বলা যায় না—কিন্তু বাঘরায়ের আশার ভাণ্ডার পুরোপুরি খালি। সে জেনেছে, এতদিন যাকে নিয়ে ঘর করেছে, সে ছিল একান্তই অন্যের। ছুট্কী বেঁচে থাকলে তবু প্রতীক্ষার অগ্নি-পরীক্ষা দিতে পারত সে-যেমন দিচ্ছে রান্কো–সে পথও বন্ধ বাঘরায়ের
মেয়েরা দল বেঁধে নেচে চলেছে পুরুষদের ঘিরে ঘিরে। হাণ্ডি খাওয়া নাচে সংযমের বালাই থাকে না। আজ একেবারেই নেই। সবাই জানে যে-সমস্ত পুরুষ আজ জমা হয়েছে এখানে তাদের অনেকেই সতেরখানির মাটিতে আর পা দেবে না কোনোদিনও। উদ্দামতা তাই সীমা ছাড়িয়েছে। পুরুষেরা চায় চরম স্ফূর্তি, মেয়েরা চায় শেষবারের মতো তুষ্ট করতে তাদের—নিজেরাও তুষ্ট হতে।
কাণ্ড দেখে ত্রিভন নীচুগলায় ধারতিকে বলে—এবার তোমার ফিরে যাওয়াই ভালো।
—কেন?
—দেখছ না?
—কি?
—বলে দিতে হবে?
—এমন তো হবেই। আমার তুমি আছো–তোমার আমি আছি। কিতাপাট দুজনকে কাছে এনে দিয়েছেন। অনেকের তো সে সুযোগ হয় নি। কাঁটারাঞ্জায় যখন ছুটে যেতাম আমরা—সে সময়ে যদি তুমি যুদ্ধে যেতে কি করতাম আমি? এমন সুযোগ হয়তো তোমার আসেনি রাজা বলে। এলে কি ব্যর্থ হতে দিতে?
ত্রিভন যেন ধারতির নতুন পরিচয় পায়। তারও ইচ্ছে হয় ধারতির হাত ধরে ওদের দলে মিশে গিয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
ঝাঁপনী বসেছিল এক শালগাছের গোড়ায় তিনটে ছেলে নিয়ে। সবচেয়ে ছোটটি ঘুমিয়েছিল তার কোলে। তার ওপরেরটি সামনে কাঁদছিল মায়ের দুধ খাবার জেদ ধরে। অন্যদিন হলে তার পিঠে দু’চার ঘা বসিয়ে দিত ঝাঁপনী। কিংবা রাগ করে স্তনের ডগা মুখে ভরে দিয়ে নিশ্চিন্ত হত। কিন্তু আজ একটু অন্যমনস্ক সে।
সাল্হাই হাঁসদা আসেনি এখানে। তার নাকি অনেক কাজ রয়েছে ক্ষেতে। ঢাউরা শুনে সে কিতাগড়েও যায়নি। ঝাঁপনী ছি ছি করেছিল লজ্জায়। সাল্হাই হেসেছিল। সর্দার হবার শখ ছিল তার। তা যখন সম্ভব হয়নি, তখন এসব অশান্তির মধ্যে গিয়ে লাভ কি?
ঝাঁপনীকেও আজ সে আসতে মানা করেছিল কিতাডুংরিতে। শোনেনি ঝাঁপনী। এতগুলো লোক যুদ্ধে যাচ্ছে—দেখেও কত আনন্দ। তাছাড়া আর একটা আশাও ছিল।
হঠাৎ সে চমকে দেখে পাশে রান্কো দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে তার ছোট বাচ্চাটার দিকে চেয়ে রয়েছে।
—আবার হবে নাকি? প্রশ্ন করে রান্কো। ঝাঁপনীকে একা বসে থাকতে দেখে সে পূর্ব প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়েছিল।
—যাঃ, কি যে বল।
—সাল্হাই কোথায়?
—আসেনি!
—আজও এলো না?
—তার নাকি ক্ষেতে অনেক কাজ।
—ও। রান্কো একটু থেমে বলে,—তুমি এমন চুপ করে বসে আছো যে?
—কি করব?
—নাচবে, হাণ্ডি খাবে—সবাই যা করছে।
—এরা? নিজের ছেলেদের দেখায় ঝাঁপনী
রান্কো অবাক হয়, ঝাঁপনী একেবারে বদলায় নি তাহলে। সাল্হাই তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারেনি এখনো। সে বলে—এরা আর কারও কাছে থাকবে। বুড়ীর অভাব আছে নাকি?
—কার সঙ্গে নাচবো?
—যার সঙ্গে ইচ্ছে।
—ঝাঁপনী সঙ্কোচে বলে—তুমি? রান্কোর কাছে থাকার সময়ে তারা প্রায়ই নাচত। সেই স্মৃতি বোধহয় মনে পড়ে।
—হুঁ।
ঝরঝর করে ঝাঁপনীর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। সে কোনোরকমে বলে—তুমি যদি আর না ফের।
অবাক হয় রান্কো। সেদিন তবে ভুলই দেখেছিল। আগের ঝাঁপনীই রয়েছে এখনো। আনন্দে মন নেচে ওঠে তার।
বহুদিন পরে রান্কোকে পেয়েই আবার হারানোর ভয় তার।
অপ্রস্তুত হয় রান্কো। কি করবে ভেবে পায় না। কিছুই করার নেই অথচ—। সে আস্তে আস্তে ঝাঁপনীর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়।
হাণ্ডি না খেয়েও মাতালের মতো নাচে তারা দুজনে। পায়ে পাথরের খোঁচা লাগে—পা ফেটে রক্ত বার হয়। হুঁস থাকে না। টামাকের তাল তাদের পায়ে। তাদের সর্বাঙ্গে, তাদের হৃদপিণ্ডে, তাদের মনে।
—আমাকে নেবে তোমার সঙ্গে? আস্তে আস্তে বলে ঝাঁপনী।
—কোথায়?
—যুদ্ধে।
—পাগল।
—কেন?
—ছেলেপিলে?
—ওদের বাপ্ দেখবে। আমার দোষে হয়েছে ওরা?
—কারও দোষেই নয়।
—নেবে?
—তা হয় না ঝাঁপনী।
—তবে কথা দাও।
—কি কথা?
—ফিরে আসবে।
রান্কোর মাথা ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে বাঘরায়কে যা বলেছিল সব মনে পড়ে তার। ভাবতে অদ্ভুত লাগে—এর মধ্যেই কত বড় এক পরিবর্তন ঘটে গেল। ডুইঃ টুডু আর বাঘরায়ের দলে নিজেকে আর নির্বিচারে ফেলতে পারছে না সে এখন। কারণ শালবনের ঝাঁপনী আর কিতাডুংরির ঝাঁপনী এক নয়।
রাজাকে সে গর্ব করে বলেছিল, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সবাই পারে না, সেও কি পারবে এখন?
ঝাঁপনী জানে, রান্কোর সঙ্গে সে জীবনে মিলতে পারবে না। নিজে হাতে তার কাজ সে কখনই করে দিতে পারবে না। পারাউ সর্দারের নির্জন কুটিরে রান্কোর পিপাসা মেটাবার জন্যে এক লসী জল পৌঁছে দেবারও সৌভাগ্য তার হয়তো হবে না কোনোদিন। তবু সে তার নিরাপত্তা চায়। সে বেঁচে আছে এইটুকুতেই তার শান্তি।
আকুলভাবে রান্কোর মুখের দিকে চেয়ে থাকে ঝাঁপনী। জবাব চায় সে। স্পষ্ট জবাব। অমন হেঁয়ালী-ভরা হাসিমুখ দেখে সে কখনই কিতাডুংরি ছেড়ে যাবে না।
—বল।
—কি বলব।
—ফিরে আসতেই হবে।
—লাভ?
—জানিনে। শুধু বল ফিরে আসবে।
—পালিয়ে?
—না না—যুদ্ধ করে! রান্কো সর্দার পালাতে জানে না তা আমি জানি।
—যুদ্ধ করে ফিরে আসা কিতাপাটের হাত
—জানি। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে পাগলামী করো না।
রান্কো বুঝতে পারে ঝাঁপনী কি বলতে চায়। এবারের পুরো সম্মান বাঘরায়ের ভাগ্যে।
—তুমি কি চাও বাঘরায়ের চেয়ে আমি ছোট হয়ে যাই?
—না।
—তবে?
—অত জানি না—বলতে পারি না। ফিরে এসো—শুধু তুমি ফিরে এসো। কান্নায় ভেঙে পড়ে ঝাঁপনী।
বহুদিন পরে বুক-ভরা দুর্বলতা রান্কোকে চুরমার করে দিতে চায়। শালগাছের আড়ালে ঝাঁপনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে—যদি ফিরি, তোমার জন্যেই ফিরব ঝাঁপনী। এককালে তুমি ছিলে সবার ওপরে। এখন সতেরখানির পরেই তুমি এইটুকু পার্থক্য।
এক সময় নাচ থামায় তারা। ফিরে আসে রান্কো রাজারাণীর পাশে। শরীর আর মনে তার অসীম শক্তির অবসাদ।
বাঘরায় ম্লান হেসে তার দিকে চেয়ে থাকে। সে আগাগোড়া দেখেছিল সব। রান্কোর মুখ নীচু হয়। তাকাতে পারে না বাঘরায়ের চোখের দিকে। ছোট—অনেক ছোট সে বাঘরায়ের চেয়ে। বুকের আগুন আর আগের মতো জ্বলছে না।
—বড় আনন্দ হল রান্কো। বাঘরায়ের কথায় অকৃত্রিমতার ছাপ।
—কি বললে? থতমত খায় রান্কো।
—তুমি ডুইঃ-এর দলে। জিতে গেলে। ভুল করো না সেই হতভাগার মতো।
রান্কো মর্মে মর্মে অনুভব করে—এত যে ভীড়, এর মধ্যেও বাঘরায় একা। নিঃসঙ্গ। তার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। যেন অ-নে-ক উঁচু এক পাহাড়ের চূড়ায় সে রয়েছে—সবাই দেখতে পাচ্ছে অথচ নাগাল পচ্ছে না।
ত্রিভন সিং একসময়ে সর্দারদের কাছে ডাকে। দিন শেষ হয়ে আসে। আনন্দ উৎসব বন্ধ করতে হবে।
কিতাপাটের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেয় সবাই। শেষবারের মতো মাদল বেজে ওঠে।
রাজারাণী বিদায় নেয়।
কিতাগড়ে ত্রিভনের সামনে এখন এসে বসে শুধু বৃদ্ধ সারিমুর্মু আর প্রৌঢ় বুধকিস্কু। সবারই মুখ থমথমে। তীর ছোঁড়া হয়ে গিয়েছে—ফিরিয়ে আনার উপায় নেই। লক্ষ্যস্থলে গিয়ে বিঁধবেই। তাতে উঠবে বিরাট আলোড়ন–সে আলোড়নের ঢেউ দ্রুত ধাবিত হবে বাটালুকার দিকেই। হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাটালুকা—নিশ্চিহ্ন হবে গোটা সতেরখানি তরফই।
তবু উপায় নেই।
সারিমুর্মু আপন মনে ঘাড় নাড়ে—উপায় নেই। সম্মানই যদি জীবনের মুখ্য জিনিস হয়, তবে অন্য পথ ছিল না। সে ধীরে ধীরে বলে—রাজার কি আফশোস হচ্ছে?
চমকে ওঠে ত্রিভন সারিমুর্মুর কথায়। বুধকিস্কু ঘাড় ফেরায়।
—কিসের আফশোস সর্দার?
—পরিণাম ভেবে?
—না, দুঃখ হচ্ছে। সমস্ত ঘটনার জন্যে নিজেকে দায়ী বলে মনে হচ্ছে। আজ বার বার একই কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে। আমি রাজা না হলে হয়তো সতেরখানির এ-বিপদ কোনোদিনই আসত না। দূরের পোতামকে তীর দিয়ে মেরে ফেললাম দেখে তোমরা অবাক হয়েছিলে সর্দার। নির্বিচারে আমাকে রাজা করলে। কিন্তু ঠিক কাজ করেছিলে কি সেদিন?
—হ্যাঁ। ঠিক কাজই করেছিলাম। জীবনে বোধহয় ওই একটাই ঠিক কাজ করেছি। বুধকিস্কুর গলার পেশী ফুলে ওঠে।
—নরহরিকে সহ্য করলে এ বিপদ আসত না। ত্রিভন বলে।
—তা আসত না। তবে সমস্ত বীর্য হারিয়ে গলায় মারা পরে বেঁচে মরে থাকতাম রাজা তার চেয়ে এ অনেক ভালো। বীরের মতো মরা। আমরা, সাঁওতাল মুণ্ডারা এর চেয়ে বড় কিছু চাই না।
ত্রিভন চেয়ে থাকে বুধকিস্কুর দিকে। এমনিতে লোকটা বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখাতে পারে না। অথচ মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে, যা ভাবিয়ে তোলে। হৃদয় দিয়ে অনুভব করা জিনিস কথায় রূপ পেলে সবার মুখেই সমান শুনতে লাগে।
—বুধ ঠিকই বলেছে রাজা। সারিমুর্মু বলে।
—আমি নিজেও জানি ঠিক। কিন্তু সতেরখানির শত শত কুঁড়েঘরের কথা মনে পড়ে গেলে বড় দুর্বল হয়ে পড়ি।
—সে দুর্বলতাকে আর মনে স্থান দেবেন না রাজা। যে কুঁড়েঘরের কথা ভেবে আপনি কষ্ট পান, একবার গিয়ে দেখবেন চলুন, সে কুঁড়েঘরের প্রাণীগুলোর বুকে কতখানি গর্ব আজ। রাজা খাঁড়েপাথরের পরে এ-গর্ব অনুভব করার সুযোগ আর কখনো আসেনি। সারিমুর্মু বলে।
—যদি তাদের আপন মানুষরা ঘরে না ফেরে?
—তারা কাঁদবে—আকুল হয়েই কাঁদবে। তবু তাদের গর্ব বাতাসে মিলিয়ে যাবে না। আমার মতো যখন বয়স হবে তাদের নাতি নাতনিদের শোনাবে বংশের গৌরবের কথা। আর নাম করবে আপনার। বৃদ্ধ সর্দারের গলা আবেগে কেঁপে ওঠে।
মুৎনী এসে ত্রিভনের সামনে দাঁড়ায়। মেয়েটি রাণীর পরিচারিকা—বছর তেরো বয়েস। সারিমুর্মু বহুদিন রেখেছিল একে। সেখান থেকে বাঘরায় নিয়ে আসে কিতাগড়ে।
রাজার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মুৎনী। কি যেন বলতে চায়—অথচ বলে না। কিছু বলার জন্যেই এসেছে সে। নইলে দরবারে অন্তঃপুরের পরিচারিকার দাঁড়াবার কোনো কারণ নেই।
ত্রিভন অস্বস্তি অনুভব করে। সে জানে, ধারতির কাছ থেকে তলব এসেছে। মুৎনী না বললেও, তার চোখে মুখে সেই কথাই লেখা রয়েছে। তবু একটা গুরুতর আলোচনার মধ্যে তার আবির্ভাব বেমানান। উঠে অন্দর মহলে যেতে ইতস্তত করে ত্রিভন।
মুৎনী ফিরে যায় তার চোখের ইসারায়। আলোচনার জের টেনে ত্রিভন বলে—সতেরখানির ভবিষ্যৎ বাসিন্দারা যদি আমার নামই শুধু মনে করে—সেটা হবে মস্ত ফাঁকি। তাদের মনে রাখা উচিত বাঘরায় আর রান্কোর নাম। স্মরণ করা উচিত তাদের ডুইঃ টুডু, সারিমুর্মু আর বুধকিস্কুকে। আমি কে?
—মনে তারা সবাইকে রাখবে রাজা। একজনকে আশ্রয় করেই তো অন্য সবাই অমর হয়। বুধকিস্কু আরও জেঁকে বসে।
সারিমুর্মু ভাবে বুধটার বুদ্ধি আর পাকল না। চিরকাল সাদাসিদেই থেকে গেল সে। রাজার চোখ-মুখের চাঞ্চল্য লক্ষ্য করার মত চোখও নেই তার। সে তাড়াতাড়ি বলে—আমরা আজ চলি রাজা। কাল সকালে আবার আসব।
—এখনই। বুধ অবাক হয়।
—হ্যাঁ, তোমার ওই দোষ। একবার বসলে আর উঠতে চাও না। এখনি কেমন যেন বুড়ো হয়ে পড়েছ।
—কে বলল? লাফ দিয়ে উঠে বড়ে বুধ।
ত্রিভন হেসে ফেলে বলে—সর্দারকে এ-বদনাম দিও না সারিমুর্মু।
বুধের পিঠে হাত রেখে হাসতে হাসতে কিতাগড় ছাড়ে সারিমুর্মু।
অন্দরে যেতেই ধারতি ফুলের মালা হাতে এগিয়ে আসে। বিস্মিত হয় ত্রিভন। কিতাডুংরির উৎসবের পর যেদিন রান্কো আর বাঘরায় চোয়াড়ে বাহিনী নিয়ে দেশ ছাড়ল সেদিন বিকেলে মালা না নিয়ে এগিয়ে এসে তাকে চমকে দিয়েছিল ধারতি। প্রথম নিয়মভঙ্গ সেদিন। আঘাত পেয়েছিল ত্রিভন মনে মনে।
ধারতি হেসে বলেছিল—কত মেয়ের স্বামী গেল যুদ্ধে। দিনে তারা আনমনা হয়ে ঘরের কাজ করছে আর রাতে একলা বিছানায় শুয়ে ছট্ফট্ করছে। আমাদের এ আনন্দও বন্ধ থাক না রাজা। ওরা যে তোমারই প্রজা। ওদের দুঃখের অংশীদার তো আমরাই।
আনন্দে ভরে উঠেছিল ত্রিভনের মন।
এতদিন পরে আবার ধারতির হাতে ফুলের মালা দেখে সে ভাবল, কষ্টকে দীর্ঘতর করা সামর্থ্যে কুলালো না তার। মনে মনে দুঃখ পায় তাই।
—আবার এ সব কেন ধারতি? বেশ তো সয়ে গিয়েছিল।
—শুধু আজকের জন্যে।
—কিন্তু কেন?
—কারণ রয়েছে। মিষ্টি হাসে ধারতি।
—বিয়ের দিন তো আজকে নয়? জন্মদিনও নয়।
—এছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে না। আজকের দিনের?
—পারে, তবে আমার অনুমানের বাইরে।
—তাই-ই। হেসে ফেলে ধারতি।
—বল তবে।
—বলব বলেই তো মুৎনীকে পাঠিয়েছিলাম। এখন যে পারছি না। বলা এত কঠিন আগে বুঝিনি।
ত্রিভবন চেয়ে দেখে রাজ্যের লজ্জা এসে জড়ো হয়েছে ধারতির মুখে। সে বলে—মালা যখন হাতে নিয়েছ বলতেই হবে। নইলে গলায় পরিয়ে দেবে কি বলে?
—বলব। ধারতি মালা হাতে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। কি যেন ভাবে। শেষে ছুটে এসে ত্রিভনের গলায় পরিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—তোমার ছেলে।
—আমার ছেলে? বিস্মিত হয় ত্রিভন।
ধারতি ছেলেমানুষের মত মাথা ঝাঁকায়।
—কই।
—এসেছে।
—আলো দেখতে পায় ত্রিভন। ধারতিকে ছেড়ে দূরে সরে গিয়ে বলে—সত্যি?
—হুঁ।
আনন্দে বুক ভরে উঠলেও সে সংযত হয়ে বলে—ভালোই হ’ল। এই দুর্দিনে আসছে সে—দুঃখের মধ্যেই মানুষ হ’তে হবে। শক্ত হয়ে উঠবে। সতেরখানির সার্থক রাজা হবে। রাজাই তো ধারতি?
—হ্যাঁ—রাজাই তো। এমনভাবে বলে ধারতি যেন যে সব জেনে ফেলেছে।
—কি করে বুঝলে?
—আমার মন বলছে।
—একটা নাম দিতে হয়।
—এখনি?
—নিশ্চয়।
—তুমি আস্ত পাগল।
—আর তুমি পাগলি।
—ধারতি হাসে। ত্রিভনও হাসে। পাশাপাশি বসে দুজনা।
—কি নাম দেবে ধারতি।
—তোমার ছেলে, তুমি জান।
—তোমার কেউ না?
—তবু।
—তুমিই নাম দাও ধারতি।
—বেশ, দিলাম লাল সিং।
—সুন্দর। এত তাড়াতাড়ি এমন সুন্দর নাম কি করে দিলে?
—অনেক দিন দিয়েছি।
—সে কি!
—হ্যাঁ। যেদিন আমাদের বিয়ে হল—সেদিন বাঁশী বাজিয়ে তুমি শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লে। আমার চোখে ঘুম ছিল না। তোমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ তোমার ছেলের নাম মনে এসে গেল।
ত্রিভন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সতেরখানি তরফের রাণীর দিকে।
.