৪
চারিদিকে রক্তাক্ত মৃতদেহের মধ্যে ডুইঃকে পড়ে থাকতে দেখে বাঘরায়। সে বসে পড়ে তার পাশে।
তবু মরলাম না বন্ধু। ডুইঃএর মুখে ম্লান হাসি ফোটে।
—কি করে মরবি? নিজের চোখে আগে দেখবি তো খালি হাতে যুদ্ধ করে ফি করে মরতে হয়।
—বাঘরায়! ডুইঃ চিৎকার করে আপ্রাণ চেষ্টায়। অমন কাজ কখনো করবি না। নিজের সর্বনাশ করে আর একজনকে পথে বসাবি না।
—আর তুই? তুই ক’জনার সর্বনাশ করলি হিসেব রাখিস?
আমি তো মরিনি ভাই।
বাঘরায় কোনো কথা বলে না।
—যা, যুদ্ধ কর। ওদের এখনো অনেক বাকি।
—একটা কথা দে তবে।
—বল?
—চল, ছুট্কীকে নিয়ে আমি যেখানে থাকব—তুই-ও সেখানেই থাকবি। তিনজনে আনন্দে দিন কাটাব।
বুকের মধ্যে একটা দলা পাকানো ব্যথা ডানহাতের চেয়েও অসহ্য হয়ে ওঠে। ডুইঃ বুঝতে পারে তার মুখ বিকৃত হয়ে উঠছে। জোর করে হাসি ফোটায় সে। বলে—তা হয় না রে পাগল। আমার মতো পঙ্গুকে নিয়ে তোরা হাঁপিয়ে উঠবি। আমাকে ভালোবাসলেও, এমন দিন আসবে যখন তোরা বিরক্ত হয়ে উঠবি। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারবি না। তোদের মুখ দেখে আমিও সব বুঝব, অথচ চুপ করে থাকতে হবে। সে অসহ্য। তোদের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দকে মাটি হতে দিতে পারি না। ভাঙা জিনিস কি জোড়া লাগে? ওই তো পড়ে রয়েছে আমার হাত। ও হাতে কত অস্ত্র ধরেছি, গান লিখেছি—এনে জোড়া লাগা দেখি। তা হয় না। অবুঝ হোসনে।
—যুদ্ধ করব না।
জ্বলে ওঠে ডুইঃ—তা করবে কেন? দুই সর্দার আসেনি, আমি আহত। তোমার ওপর রাজার জীবনের দায়িত্ব কিনা—তাই যুদ্ধ করবে না। এই না হলে সর্দার! ছিঃ ছিঃ—তোর সম্বন্ধে এত নীচু ধারণা আমার কখনো ছিল না। রাজা কোথায় আছেন, খবর রাখিস? একা ছেড়ে দিয়ে কোন সাহসে নিশ্চিন্ত আছিস? যদি ভালোমন্দ কিছু হয়—কে নেবে দায়িত্ব? নাগাদের অনেকেই আছে। মরণ-কামড় দিতে ছাড়বে না তারা।
ব্যস্ত হয়ে ওঠে বাঘরায়। ছুটে যায় রাজার স্থানে। সেদিকে চেয়ে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যেও ডুইঃ-এর মুখে হাসি খেলে যায়।
টিলার অদূরে জলাশয়—সেখানে পদ্ম ফুটে রয়েছে। ছুট্কী ফুল ভালোবাসে খুব। ডুইঃ একবার তাকে পদ্ম দিয়েছিল—আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ছুট্কীর মুখ। জলাশয়ে বুনো হাঁসের ভীড়। একটু পরেই তারা উড়ে যাবে। আকাশে অনেক উঁচুতে শকুন উড়ছে। মরা জন্তুর সন্ধান পেয়েছে বোধ হয়? কিংবা এই মৃতদেহগুলির ওপরই তাদের সুতীক্ষ্ণ নজর। আজ না হলেও কালকে তারা এক বিরাট ভোজ পাবে এখানে।
হঠাৎ ডুইঃ দেখতে পেল একজন নাগা সন্ন্যাসী তারই কিছুদূরে উঠে দাঁড়ায়। মড়ার গাদার মধ্যে এতক্ষণ চুপ করে শুয়েছিল সে। এদের মধ্যেও তাহলে ভীতু মানুষ আছে। ধারণা ছিল না ডুইঃ-এর। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ছে তবু চেঁচিয়ে ওঠে—এই পালাচ্ছিস কোথায়?
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নাগা। আহত সৈন্যের মুখে এ-জাতীয় চিৎকার সে আশা করেনি। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। ডুইঃ বাঁহাত দিয়ে তরবারি টেনে নিয়ে প্রাণপণে উঁচিয়ে ধরে বলে—দেখছ কি? আহত দেখেও ভরসা হচ্ছে না? ছি ছি, থুঃ।
নাগা সন্ন্যাসী অবাক হয়। এক হাতে লোকটি কোন্ সাহসে তাকে ধমকায় ভেবে পায় না। তার মুখে ধীরে ধীরে কুটিল হাসি ফুটে ওঠে। লুটিয়ে পড়া এক নিহতের তরবারি তুলে নেয় নিজের হাতে। এক-পা এক-পা করে ডুইঃ-এর পাশে এসে দাঁড়ায়।
বাধা দেবার শক্তি ডুইঃ-এর ছিল না। যথেষ্ট রক্ত তার শরীর থেকে বার হয়ে মাটিতে গিয়ে মিশেছিল। বাঁ হাতে তরবারি তুলে ধরতেও হাত কাঁপছিল। নাগাটি তীক্ষ্ণ অস্ত্র বিনা বাধায় তার হৃপিণ্ড ভেদ করে মাটি স্পর্শ করে। সেই মুহূর্তে তার সামনে কার মুখ ভেসে উঠেছিল কেউ জানে না।
.
নাগা সন্ন্যাসীদের বধ করার পর দেড় বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে সতেরখানি তরফের শান্তি আর ব্যাহত হয়নি। চিরকালের দারিদ্র্য নিয়ে স্বাভাবিক আনন্দে দিন কাটিয়ে চলে রাজ্যের অধিবাসী। তরফের চার সর্দারের এক সর্দারের জায়গা এখনো খালিই পড়ে রয়েছে। ছুট্কী এখন বাঘরায় সোরেণের গৃহিণী। ডুইঃ-এর মৃত্যু তাঁর মনে যত বড় ঝড়ই তুলুক না কেন সে ঝড় শান্ত হয়েছে কালের গতিতে। বাঘরায় বুঝেছিল বন্ধু হলেও তার মন পাথরে গড়া নয়—তাই কোনো আঘাতের দাগ যদি পড়ে তাতে সে দাগ চিরস্থায়ী হতে পারে না। পাথরই যদি হততার মন তাহলে ডুইঃ-এর প্রতি বন্ধুত্বের বড় রকম আদর্শ স্থাপিত হলেও সর্দার হিসাবে সে পঙ্গু হয়ে যেত। কিতাপাটের আশীর্বাদেই মানুষ অনেক কিছুকেই চেপে রাখতে পারে—অনেক কিছু ভুলে যায়। নইলে উপায় থাকত না। ছুটকী তাকে যে প্রথম সন্তান উপহার দিয়েছিল সে আজ বেঁচে নেই। কিন্তু ওই দুই মাসের একরত্তি শিশু সেদিন যখন মারা গেল, তখন সেই মুহূর্তে, সে ভেবেছিল হয়তো তারও বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অথচ এর মধ্যে তো বেশ সামলে উঠেছে। ছুট্কীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে পথে-ঘাটে। হাণ্ডি খেয়ে তার কোমর জড়িয়ে নেচেছেও এক উৎসবে। ছেলের মৃত্যুতে বরং একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হয় বাঘরায়ের আগের চেয়ে সে যেন ছুটকীর অনেক কাছে চলে এসেছে। আগের তীব্র আকর্ষণের সঙ্গে এখন মমতা এসে যোগ হয়েছে।
ডুইঃ-এর জন্যে রাজা ত্রিভনেরও দুঃখ কম হয়েছিল না। কিন্তু প্রথম যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা সেই দুঃখকে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধতে দেয়নি তার মনে। তাছাড়া যুদ্ধ জয়ের পরে যেদিন প্রথম গিয়ে দাঁড়াল কাঁটারাঞ্জার পাথরের পাশে, সেদিন ধারতির চোখের ভাষা সব কিছুই ভুলিয়ে দিয়েছিল।
ঘটনা আবর্তিত হয়ে এগিয়ে চলছিল এক সুনির্দিষ্ট পথে। কেউ না জানলেও ত্রিভন জানত সে কথা। তাই ধাদকা আর পঞ্চ সর্দারী যখন দূত পাঠানো বন্ধ করল তখন রাণী, নরহরি দাস, এমনকি সর্দাররাও চঞ্চল হল। রাজা কি তবে অবিবাহিতা থাকবেন?
পঞ্চসর্দারী শত্রুতা করল। দুর্নাম ছড়িয়ে দেয় রাজা ত্রিভনের নামে।
নরহরির বাবাজী একদিন ব্যস্ত হয়ে ত্রিভনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
—কিছু বলবেন ঠাকুর?
—হ্যাঁ।
—বলুন।
—গোবিন্দ ফিরল আজ বরাহভূমি থেকে।
—নতুন কোনো খবর আছে?
—না, বিশেষ কিছু নয়। তবে রাজা ডেকেছিল তাকে।
—কেন?
—সতেরখানির লোক বলে। নরহরি গম্ভীর হয়।
চকিতে নরহরির আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নিয়ে ত্রিভন বলে–আপনার কথার অর্থ?
—রাজা বিদ্রূপ করছিলেন আপনাকে নিয়ে। শুধু আপনাকে নিয়ে বিদ্রূপ করলে হয়তো আজ কিছু বলতে আসতাম না। কারণ রাজা হেমৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর আমার সব কর্তব্য শ্রীশ্রীকালাচাঁদ জিউর মন্দিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
—আপনি পূজারী, শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু মন্দিরের বাহিরে আপনি কোন্ কর্তব্য করতে চান?
—আপনার পিতা পূজারী বলে শুধু ভাবতেন না আমাকে। আমার অনেক উপদেশ তিনি বিবেচনা করতেন। তাই সতেরখানির বহু লোকই বৈষ্ণব ধর্ম নিয়েছে।
—সতেরখানির সবাই বৈষ্ণব হোক—এ আমি চাই না।
—চান না? নরহরির মাথায় বজ্রাঘাত হয়।
—না। কারণ তাতে সতেরখানির অকালমৃত্যু অবধারিত।
বৈষ্ণবদের রাগতে নেই। রাগের সমস্তটুকু জ্বালা বিস্ফারিত দৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ পায় নরহরি বাবাজীর। শেষে কাঁপা গলায় বলে- হেমৎ সিং ভুঁইয়ার ছেলে হয়ে একথা বলতে পারলেন রাজা?
—বলতে বাধ্য হচ্ছি ঠাকুর। বৈষ্ণব ধর্মের যত গুণই থাক না কেন, আমাদের, এই সতেরখানির লোকদের, সে ধর্মের মধ্যে বেশী না-এগনোই ভালো। বাবাকেই দেখতাম—কত পরিবর্তন হয়েছিল তাঁর ধীরে ধীরে। সে পরিবর্তনে তাঁর আত্মার মঙ্গল হয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু অমঙ্গল ডেকে আনছিল এই রাজ্যের। তাই আমার ইচ্ছে, আমার ধর্ম শ্রীকালাচাঁদ জিউ-এর পুজোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক। বড় কঠিন কাজ আমাদের ঠাকুর। অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যেখানে রক্তপাত ঘটাতে হয় পদে পদে সেখানে বৈষ্ণব হয়ে বিবেকের দংশন সহ্য করে, ক্লীব হয়ে গিয়ে লাভ নেই। আপনি অবুঝ নন, সকলকে খেয়ে পরে বাঁচতে দিন। মহল জোনারের সঙ্গে একটু মাংসও তাদের পেটে পড়া দরকার।
বহুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে নরহরি। বলে—বেশ, তাই হবে। তবে আমাকে বিদায় দিন।
—সে তো সম্ভব নয়। জিউ আছেন।
—গোবিন্দ থাকল সেজন্যে। সে শুধু পূজারীই হয়ে থাকবে। আমি তা পারি না। পঁচিশ বছর আগে যেদিন নবদ্বীপ ছেড়েছিলাম, সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম গুরুদেবের সামনে, বৈষ্ণব ধর্মের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টাই হবে আমার ব্রত। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। এখন কাজ ফুরিয়েছে এখানকার।
—আপনাকে জোর করব না। তবে আপনি থাকলে মায়ের মনে নতুন করে আঘাত লাগত না।
—রাণী-মাকে আমি বুঝিয়ে বলব।
—ফল হবে না।
নরহরি জানে, ফল হবে না। সে বয়স নেই রাণীমার। তার ওপর অসুখে ভুগে ভুগে তাঁর আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এই সময়ে যা কিছুতে স্বামীর সামান্য স্মৃতি বিজড়িত, সে জিনিস ত্যাগ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বরং বেশী করে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করবেন। হেমৎ সিং-এর আমলে শেষ দিন পর্যন্ত নরহরির প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট—সর্দাররাও সমীহ করত তাঁকে। কারণ নরহরি ছাড়া চলত না রাজার। সব সময়ে তাঁর পাশে পাশে থেকে সুর করে পদাবলী শোনাত, আর তত্ত্ব কথা বুঝিয়ে যেত। কিন্তু সেবার নরহরি বরাহভূম থেকে ফিরে এসে হতবাক হয়ে দেখল যে হেমৎ সিং-এর নশ্বর দেহ যেমন পঞ্চভূতে গিয়ে মিশেছে, তেমনি তার অখণ্ড প্রতাপ ও মন্দিরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছে। তারপর থেকে সে অনেক চেষ্টাই করেছে ত্রিভনের মন ভোলাতে—কিন্তু পারেনি।
রাণীমা এত খোঁজ রাখেন না। কিতাগড়ের এক প্রকোষ্ঠে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে কেউই যায় না। তবে নরহরির অবাধ গতি সেখানে। তাই তিনি জানেন রাজপরিবারে নরহরি বাবাজীর স্থান আগের মতোই অটুট। এখন যদি হঠাৎ বলা হয় যে তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন, রাণীমা প্রথমে বিশ্বাসই করবেন না। পরে সব কিছু শুনে পাবেন দারুণ আঘাত।
নরহরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—ফল হয়ত হবে না। কিন্তু আমিও থাকতে পারি না এখানে। তার জন্য দরকার হলে সত্যি কথাই আগাগোড়া বলতে হবে রাণীমাকে।
—বলবেন। ঠিক আমি যা বলেছি আর করেছি, তাই বলবেন। তার সঙ্গে তত্ত্বকথা মেশাবেন না।
ত্রিভনের মেজাজ উষ্ণ হয়ে ওঠে। লোকটিকে সে কোনোদিনই ভালো চোখে দেখে না। কেমন যেন মেয়েলী ভাব। কথাবার্তার ঢংও তেমনি। অনেক সময়ে বড় বেশী অশ্লীল। এ লোক যত তাড়াতাড়ি রাজ্য থেকে বিদায় নেয় ততই ভালো। তার জন্য মায়ের মন ভাঙলেও রাজ্যের মঙ্গলের দিকে চেয়ে সেটুকুকে মেনে নিতে হবে। গোবিন্দ বয়সে তরুণ হলেও তার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য রয়েছে। ত্রিভন পছন্দ করে তাকে। তাই বাৎসরিক খাজনা এই দুবছর সে তাকে দিয়েই পাঠাচ্ছে বরাহভূমের রাজদরবারে। সঙ্গে অবশ্য দশজন চোয়াড় যায়।
নরহরির সঙ্গে যদি গোবিন্দও না চলে যায়, তাহলে সব দিকই বজায় থাকবে। কালাচাঁদ জিউ-এর পুজোর জন্যে অন্য লোকের সন্ধান করতে হবে না।
—তাহলে চলি রাজা।
—না। যে-কথাটা বলতে এসেছিলেন, বলে যান।
—আর কিছু বলতে আসিনি। এতদিন পরে প্রথম নিজেকে অবসন্ন মনে হল নরহরি বাবাজীর।
—বারহভূমরাজ আমাকে নিয়ে কী বিদ্রূপ করেছিলেন?
এখন আর কোনো ব্যাপারেই নরহরি দাসের আগ্রহ নেই। সে আশা করেছিল, অন্তত রাণীমার দোহাই দিয়ে ত্রিভন তাকে চলে যেতে নিষেধ করবে। ত্রিভনের সাফ জবাবে সে-আশা তিরোহিত। তবু রাজার কথার জবাব দিতেই হবে।
—আপনাকে নিয়ে বিদ্রূপ, তত বড় কথা নয়। কিন্তু সে বিদ্রূপ শ্রীশ্রীজিউকেও বিদ্ধ করেছে।
—শুনতে চাই সেটা।
—কালাচাঁদ জিউ-এর মন্দিরে নাকি আপনি রাজ্যের সুন্দরী নিয়ে বিলাস শুরু করেছেন—গোপীবিলাস তাই বিয়ে করতে চান না। তাই ধাক্কা আর পঞ্চ সর্দারী থেকে দূত এসে বারবার ফিরে গিয়েছে।
—এ কথা বিবেকনারায়ণ নিজে বলেছেন?
—হ্যাঁ। কারণ তিনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন গোবিন্দকে।
—উত্তরে গোবিন্দ কি বলেছে?
—সে বলেছে এ সব মিথ্যে গুজব।
—বিশ্বাস করেছেন রাজা!
—সেটা গোবিন্দ যাচাই করেনি। নরহরি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে।
—আচ্ছা, আপনি যান। ত্রিভনের ভ্রূ কুঁচকে ওঠে;
.
ত্রিভন জানত মায়ের কাছ থেকে ডাক আসবে।
সে ডাক এলো সেদিনই সন্ধ্যায়। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে সে মায়ের ঘরে প্রবেশ করে। ছেলেকে দেখে রাণী-মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
—কেঁদো না মা। অন্যায় কিছু করিনি।
—কাকে অন্যায় বলব তবে? এ তো নিজের বাবাকেই অপমান করা।
—না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলায় মা। বাবার সময়ে যা ঠিক ছিল এখন তা নাও ঠিক থাকতে পারে।
—তাই বলে দেবতাকে অপমান?
—অপমান আমি করিনি।
—বাকী থাকল কি? বাবাজীকে চলে যেতে বলা, দেবতাকে তাড়িয়ে দেবার সামিল। যে মুহূর্তে বাবাজী এখান থেকে বিদায় নেবেন, সেই মুহূর্তেই শ্রীশ্রীজিউ কিতাগড় ছাড়বেন। ওই পাথরের মূর্তিই শুধু নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকবে।
—গোবিন্দ থাকবে।
—গোবিন্দ? সে আবার পূজারী! বাবাজী নিজেও তো বলে গেলেন, তাঁর শিষ্য হলেও গোবিন্দকে বৈষ্ণব বলতে বাধে।
ত্রিভন বুঝল, নরহরি ইতিমধ্যেই সবক’টি কলকাঠি নেড়ে রেখে গিয়েছে। সে বলে—তবু তারই হাত দিয়ে পুজো করিয়ে এসেছেন বিগ্রহকে, নিজে তো কিছুই করতেন না। জেনেশুনে তিনিই তবে অন্যায় করেছেন প্রতিদিন।
রাণীমা চিৎকার করে ওঠে—ত্রিভু। অতবড় সাধক সম্বন্ধে এমন অশ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলো না। এই তো শুরু। এখনো অনেকদিন বাকী তোমার জীবনের। অনুতাপে পুড়ে মরতে হবে
ত্রিভন মৃদু হাসে—মহাপুরুষের হয়ে অভিশাপটা তুমিই দিয়ে দিলে মা।
চমকে ওঠেন রাণীমা—না না, যাট্। তা দেব কেন? কিন্তু সত্যি কখনো মিথ্যে হয় না।
—আমিও সেই কথাই বলছি মা। নরহরি ঠাকুরের কোনো প্রয়োজন আর সতেরখানি তরফে নেই—এটাই সত্যি।
রাণীমা বিহ্বল। বড় বড় চোখে চেয়ে থাকেন পুত্রের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ান-আয় আমার সঙ্গে।
—কোথায়? ত্রিভন অবাক হয়।
রাণীমা হাতের ইশারা করে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে যান। বাধ্য হয়ে ত্রিভন অনুসরণ করে তাঁকে। প্রকোষ্ঠের পর প্রকোষ্ঠ পার হয়ে তাঁরা রাজপরিবারের অস্থিশালায় এসে উপস্থিত হন। খাঁড়েপাথর—যুঝার সিং,—হেমৎ সিং–তিন রাজার অস্থি রয়েছে সুদৃশ্য তিনটি পাথরের নিচে।
রাণীমা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন—এই খাঁড়েপাথরের অস্থি ছুঁলাম, এই ছুঁলাম বুঝার সিং-এর অস্থি—আর এই তোর বাবার—
—দাঁড়াও মা। মনে হচ্ছে, তুমি কোনো কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে যাচ্ছ। কিন্তু তার আগে আমি তোমাকে শুধু একটি কথা জিজ্ঞাসা করছি।
একটু থেমে ত্রিভন বলে—শেষ সময়ে বাবা কেন আমাকেই রাজ্যভার দিতে বলে গেলেন?
—চিনতে পারেননি তোমাকে।
—ঠিকই চিনেছিলেন। চিনতে না শুধু তুমি। কখনো চেষ্টাও করনি চিনতে। ধর্মের জন্য নিজের ছেলেকে অবধি দূরে সরিয়ে রেখেছ। কিন্তু বাবা ছিলেন আমার বন্ধু। তিনি আমার শক্তি, আমার বুদ্ধি, আমার বিশ্বাস—সব কিছুইর খবর রাখতেন। আজ তোমাকে যে কথা বলায় বিচলিত হয়েছ তুমি, সে কথা, অল্প বয়স হলেও তখন বাবাকে কতবার বলেছি। এমন কথা বলেছি যা তুমি সহ্য করতে পারতে না। অথচ তিনি কখনো রাগেননি। বরং চিন্তান্বিত হয়েছেন। তুমি বিশ্বাস করতে পার। শেষ সময়ে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর ভুল বুঝেছিলেন। অথচ বয়স হয়েছিল বলে কিছু এড়িয়ে যেতে পারেননি। আমি শুধু ভাবি, ছেলে হয়েই যখন জন্মালাম, তখন তাঁর প্রথম বয়সে কেন হলাম না। এত সব সমস্যায় তো পড়তে হতো না তাহলে।
হেমৎ সিং-এর পাথরের ওপর রাণীমার হাত নিশ্চল হয়ে থেমে যায়। তিনি ত্রিভনের মুখের দিকে বহুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। শেষে বলেন—আমাকে একটু ধরে নিয়ে চল ঘরে।
ঘরে এসে বসে সুস্থির হতে রাণীমার অনেকটা সময় লাগে। সামান্য সময়ের মধ্যে তাঁর মনের ওপর এলোমেলো ঝড়ের ঝাপটা লাগায় তিনি কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
—রাজাকে একথা তুই বলেছিলি?
—হ্যাঁ মা, বাবা জানতেন মিথ্যে কথা আমি বলি না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার। রাণী, কাঁটার খোঁচা খেয়ে যেন ব্যথায় মুখ বিকৃত করেন। আরও কিছু শোনার জন্য ত্রিভনের দিকে চেয়ে থাকেন তিনি।
—আজ তোমাকে কত সংযতভাবে কথাগুলো বললাম। বাবাকে সেভাবে বলিনি। এত গুছিয়ে বলতে শিখিনি তখনো। তখন বলেছিলাম—ঠিক আমার মন যেভাবে চলতে চেয়েছিল। বাবাকে তো কখনো পর ভাবিনি। তোমার সামনে কত সাবধান হয়ে কথা বলতে হচ্ছে। বাবার সঙ্গে সে বালাই ছিল না। সেদিনের কথাগুলো হুবহু তোমাকে বললে, অস্থিশালায় আমার এক অনুরোধে তুমি প্রতিজ্ঞা থেকে বিরত হত না।
রাণীমা কেঁদে ফেলেন। ত্রিভেনকে কাছে ডেকে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলেন—তুই রাজা, রাজ্যের মঙ্গলই তুই বুঝিস ত্রিভু। আমি আর বাধা দেব না।
জীবনে প্রথম মায়ের এত কাছে এল ত্রিভু। ধর্মের যে আবরণ তাকে পৃথক ক’রে রেখেছিল এতদিনে সেটা অপসারিত হল সহসা। নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে ভাবে সে। কারণ পিতার মৃত্যুর পর সংসারে আপন বলতে তার কেউই ছিল না ধারতি ছাড়া। মায়ের সংস্পর্শে এসে তার বিক্ষিপ্ত মন যেন একটা স্থায়িত্ব পেল। তাই, কারণে অকারণে মায়ের কাছে আসতে শুরু করে সে।
নরহরি বাবাজীর সঙ্গে স্পষ্ট কথা হয়ে গেলেও সে এখনো বাটালুকা ছেড়ে যায়নি। বরং এতদিন যে পুজো গোবিন্দ করত তা নিজের হাতে নিয়েছে। গোবিন্দর ভার পড়েছে শুধু পুজোর যোগাড় আর ঘণ্টা বাজাবার। ত্রিভন আপন মনে হাসে। নরহরি বোধহয় নিজেকে চিনেছে এতদিনে। এতদিনের আশ্রয়ের মায়া ত্যাগ করতে মহাপুরুষের হৃদয় ভাঙছে। তার তো ঘর বলতে ওই মন্দিরটুকু আর আত্মীয় বলতে কেউ নেই।
রাণীমা একদিন ত্রিভনকে বলেন—এবারে বিয়ের ব্যবস্থা কর ত্রিভু। রাণী ছাড়া কি রাজা মানায়?
—আমিও তাই ভাবছি।
—লোক পাঠা পঞ্চসর্দারীতে। শুনেছি মেয়েটি খুবই সুন্দরী।
—পঞ্চসর্দারীতে কেন মা। খুঁজলে কি নিজের দেশে মেয়ে পাওয়া যায় না?
—নিজের দেশে মানে?
—এই সতেরখানিতে।
—সেকি? এদেশে আর রাজা কোথায়?
—রাজার মেয়েই যে বিয়ে করতে হবে এমন কি নিয়ম আছে কোনো!
—তোমার উদ্দেশ্য কি ত্রিভন! রাণীমা গম্ভীর হন।
সম্পর্ক ঘনীভূত না হতেই বিচ্ছেদের ইঙ্গিত। এ আশঙ্কা সে আগেও করেছিল। কারণ কথাটা মা নিজে না ওঠালেও তাকে একদিন বলতে হত। তবু মন ভেজাবার চেষ্টা করে সে। হাজার হলেও গর্ভে ধরেছেন তো। স্নেহের দুর্বলতা একবিন্দু কি না থেকে পারে?
আবার এক সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে মায়ের পাশে বসে তার পিঠে হাত রেখে বলে-খাঁড়েপাথর কি রাজা হয়ে জন্মেছিল মা?
—না।
—তাঁর রাণী কি সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিলেন না?
—তা ছিলেন। কিন্তু ত্রিভন সিং রাজা হয়েই জন্মেছিল।
—না। রাজার শেষ অনুরোধেই সর্দাররা আমাকে রাজা করেছে। সতেরখানি তরফের সিংহাসনে নইলে আজ অন্য কেউ বসত। এ-দেশ বরাহভূম নয়—মুর্শিদাবাদও নয় মা। রাজার ছেলে হলেই এখানে রাজা হওয়া যায় না। এখানে রাজা হতে হলে নিজের কৃতিত্বের সঙ্গে সর্দারদের অনুমতি প্রয়োজন। তুমি তো সবই জান মা।
—হ্যাঁ জানি। আমিই যে তোকে গর্ভে ধরেছিলাম।
—তবে? রাজার ছেলে হলে যেমন রাজা হওয়া যায় না—রাজার মেয়ে হলেও তেমনি রাণী হওয়া যায় না।
—তুই কি বলতে চাস।
—বলতে চাই সতেরখানি যে রাণী হবে; তাকেও উপযুক্ত হতে হবে। প্রয়োজন হলে যুদ্ধক্ষেত্রেও যেতে হবে।
—তেমন মেয়ে তুই পৃথিবীতে পাবি?
—পৃথিবী খুবই বড় মা।
—তুই না বললি সতেরখানির মেয়েই বিয়ে করবি?
—হ্যাঁ।
—পাগল হয়েছিস। নইলে এতবড় কথা বলতে পারতিস না।
—কেন মা।
সতেরখানিতে যেমন মেয়ের সন্ধান করার চেয়ে পরশ পাথর খুঁজে বেড়ানো অনেক সহজ।
—আছে, তেমন মেয়ে। এই বাটালুকাতেই।
—আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস?
—দেখবে?
—পাগলামী রাখ ত্রিভু। পঞ্চসর্দারীতে লোক পাঠা।
রাণীমা শুয়ে পড়েন।
—পারাউ সর্দারকে চেন মা?
—না চেনার কারণ নেই।
—তারই ছেলের নাতনী আছে। নাম দিয়েছি আমি ধারতি।
—তুই নাম দিয়েছিস?
—হ্যাঁ। তাকে দেখবে?
—থাক। রাণীমা ছটফট করে বলেন—আর সহ্য করতে পারছি না ত্রিভু। আমার শ্রীক্ষেত্র যাবার ব্যবস্থা করে দে।
—সর্দারের কাছে লোক পাঠাই?
—যা খুশী তাই কর। তুই রাজা, তোর আদেশে সব হবে। আমি কে?
—তুমিই সব। তোমার আশীর্বাদ পেতে চাই।
—অত সহজে আশীর্বাদ করতে পারব না। তার আগে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।
—একটু উদার মন নিয়ে চিন্তা করো মা, শক্তি আপনিই পাবে।
রাণীমা চোখের পাতা বন্ধ করেন। ত্রিভন সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে চলে যায়।
মত শেষ পর্যন্ত দিলেন রাণীমা। কিন্তু বাটালুকায় আর থাকলেন না। একদিন ভোরবেলা তাঁর শিবিকা লোকলস্কর নিয়ে এগিয়ে চলল সতেরখানি সীমান্তের দিকে। নরহরি বাবাজীও রাণীর সঙ্গ নিল। সে ভালোভাবেই জানত আজও যেটুকু সুবিধে সে ভোগ করত, সে শুধু রাণীর জন্যে। রাণীর অনুপস্থিতিতে তার কপালে কিছুই জুটবে না।
ত্রিভন অনেক বুঝিয়েছিল মাকে। এমনকি তাঁর পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল। শোনেননি তিনি। দুদিনের জন্যে যেটুকু স্নেহ বা বিশ্বাস তাঁর দেখা গিয়েছিল নারীসুলভ ভাবপ্রবণ তাই তার মূল কারণ। তবু হয়তো ত্রিভন সক্ষম হত যদি নরহরি মায়ের মন অমনভাবে বিষিয়ে না দিত।
সীমান্তে এসে ত্রিভন ঘোড়া থেকে নেমে শিবিকার পাশে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো বলেছিল—ধারতিও সর্দারও বংশের মেয়ে—যে সর্দার তার সতেরখানির জন্যে একখানা হাত দিয়েছে—যে সর্দার নিজের একমাত্র ছেলেকে দিয়েছে বিসর্জন। পারাউ সর্দার যদি খাঁড়েপাথরের সময়ে না থাকত, তাহলে যুঝার সিং আর হেমৎ সিং-এর নাম বোধহয় কেউ শুনতে পেত না।
—ফিরে যাও ত্রিভন। শ্রীক্ষেত্র আমাকে টানছে। ও-সব ঘরের কথা বলে কি লাভ? কোনো আকর্ষণ নেই আমার। তবে আশীর্বাদ চেয়েছ—করেছি। জানি না অমন আশীর্বাদের মূল্য কতটুকু।
—বেশ। শ্রীক্ষেত্র গিয়ে যদি সত্যিই কোনো বৈষ্ণবের দেখা পাও মা তাহলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করো, তোমার ওই শ্রীচৈতন্য কাদের জন্যে ভেবেছেন—কাদের আলিঙ্গন করেছেন।
নরহরির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার সে বলে-তোমার অনুচরটিকে কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যেও সে সময়। কারণ ধর্ম সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা নেই। এমনকি নবদ্বীপ থেকে আসার সময়ে যে-সমস্ত পুঁথি সঙ্গে করে নিয়ে এসে বাবাকে দিয়েছিল তাও কখনো উলটে দেখেনি। –কে বলল আমি দেখিনি। নরহরি রেগে ওঠে। সে ভালোরকম জানে সতেরখানিতে আর ফিরে আসার পথ নেই তার।
—পুঁথিগুলোর নাম কি বাবাজী?
—নাম কি মনে থাকে?
—রামায়ণ মহাভারতের নাম শুনেছ?
—তা শুনব না কেন?
—নিজেকে বৈষ্ণব বলে জাহির করে বৈষ্ণবদের পুঁথির নাম জান না? আমি তো শুনি অধার্মিক। কিন্তু আমিও বাবার কাছে শিখে লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল আগাগোড়া পড়েছি।
নরহরি ঢোক গেলে। কি যেন বলবার চেষ্টা করে সে। ত্রিভন তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলে ওঠে—পঁচিশ বছর আগের গুরুদেবের উপদেশ, আর তখনকার মুখস্থ করা পদাবলী না আউড়ে কিছু জ্ঞান অর্জনও তো করতে পারতে। কোনো কাজই ছিল না তোমার বাবাজী।
—চলে যা ত্রিভু। শেষ সময়ে ঝগড়া করে যাত্রাকে অশুভ করতে দিস না।
ত্রিভন ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় বাটালুকার দিকে। কদমে চলে তার প্রিয় বিজলী। ঝগড়া করে সত্যিই কোনো লাভ নেই। মা পুণ্য সঞ্চয় করুন শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে। সে বাধা দিতে পারে না। যেমন তার মা পারেন না তার পথে বাধার সৃষ্টি করতে—যে-পথ তাকে তার প্রজাদের সঙ্গে এক করে তুলতে সাহায্য করে।
তবু একটা ব্যথা অনুভব করে সে। কিসের ব্যথা জানে না। বাবার কথা মনে হয় তার। বাবার সে স্নেহ আর পাবে না সে। মায়ের কাছে বৃথাই সে আশা করেছিল। মনটা নেচে উঠেছিল সাময়িক ভাবে।
সর্দাররা রাজার মুখে শুনে চমকে উঠেছিল। জীবনে যে কথা শোনেনি—বাপ-ঠাকুর্দা যা কল্পনাও করতে পারত না। তাকি সত্যি হয়। কিন্তু রাজা তো মিথ্যে কথা বলেন না।
ত্রিভন বলেছিল—জানতাম অবাক হবে। কিন্তু এই আমার সঙ্কল্প। বাধা দেবার চেষ্টা করো না। শুধু জেনে নাও লোকদের মনোভাব।
সর্দারদের মুখ থেকে বাটলুকা গাঁ শোনে—শেষে শোনে তরফের সবাই। আনন্দে নেচে ওঠে তারা। দল বেঁধে ভীড় করে পারাউ সর্দারের আঙিনায়—দুই পুরুষ যেখানে কেউ আসেনি। নতুন নতুন লোক দেখে নতুন করে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ে পারাউ-এর দুচোখ বেয়ে।
ধারতি ঘরের কোণে গিয়ে লুকোয়। লজ্জায় ঘেমে ওঠে সে। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। ভীড় ঘরের মধ্যে এসে জড়ো হয়। তাদেরই মতো কুঁড়েঘরের এক মেয়ে হবে রাণী। প্রতিবেশী শুকোলরা রাজ্যের লোকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়। সবাই জিজ্ঞাসা করে রাণী কি চিরকাল ঘরেই বসে থাকতেন?
—আরে না না। ওই কুঙ্কী বুড়ী বাঁধা রয়েছে খুঁটিতে। ওর যত কাজ তো ওই মেয়েই করে। ওই যে জ্বালানি কাঠ জড়ো করা রয়েছে, লিপুরই তো কুড়িয়ে এনেছে শালবন থেকে। বুড়ো সর্দার একহাত নিয়ে কিছুই করতে পারে না। রান্নাবান্না লিপুরই করে।
—শুকোল এক নিঃশ্বাসে গর্বের সঙ্গে কথাগুলো বলে ফেলে।
—লিপুর কে? দূর-গ্রামের একজন প্রশ্ন করে।
—তোমাদের রাণী গো। আমাদের কাছে ও লিপুরই। স্নেহের হাসি হাসে শুকোল। তার কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে একরাশ মাথার।
শুকোল আবার সুরু করে-আল বাঁধতে লিপুর-সাঁজাল দিতে লিপুর—খুটি পুঁততে লিপুর। ওর কি গুণের শেষ আছে?
সবাই আবার ধারতির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। সত্যিই তো—তাদের মতোই একেবারে। রাজাও তবে তাদেরই মতো। ভালোই হবে। দুঃখ ঘুচবে এতদিনে।
একজন প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে বলে—রাজা কি শুধু একটা বিয়েই করবেন?
একসঙ্গে তেড়ে ওঠে সবাই। যারা চেনে তারা মুখ ভেংচে বলে—তবে কি তোমার সোয়ামী মতো?
অপ্রস্তুত হয় প্রৌঢ়া—না, না, তাই বলছি। বড় জ্বালা সতীন থাকায়। হিরোম এরা শুই শাগা। শুয়োপোকার হুলের মতো সবসময় কুটকুট করে।
শুকোল বলে ওঠে—রাজাকে দেখেছ? দেখলে আর ওকথা বলতে না দেবতা—এক্কেবারে দেবতা।
—আমারই ভুল গো। কারও বিয়ে হতে দেখলেই ওকথাটা আগে ভাগে মনে আসে। পাপ-পাপ।
একজন যুবতী আস্তে আস্তে বলে—রাণী নাকি ঘোড়ায় চড়া জানে, তীর ছুঁড়তে পারে। শুকোল এবারে বলে—ওইটাই জানিনে। আমিও তাই শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তীর ছোঁড়া শিখতে পারে-পারাউ সর্দার শেখাতে পারে। কত বড় সর্দার ছিল। কিন্তু ঘোড়ায় চড়া? ঘোড়া কোথায় পাবে। একটাই তো ঘোড়া কিতাগড়ের।
পারাউ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারে হেসে ওঠে দাওয়ার ওপর থেকে। সবার দৃষ্টি সেদিকে গিয়ে পড়ে।
শুকোল বলে—কি গো সর্দার, অমন হাসলে কেন? কথাটা কি সত্যি?
ঘাড় ঝাঁকিয়ে পারাউ বলে—হ্যাঁ।
—কে. শেখাল?
—কে আবার? যার রাণী হবে—সেই।
সবাই বিস্মিত হয়। শুকোলও বাদ যায় না। এত কাণ্ড হয়েছে, অথচ পাশে থেকেও জানতে পারেনি? নিজের ওপর রাগ হয় তার। মেয়েরা গালে হাত দেয়। ধারতি তার মুখখানাকে সামনের দিকে আরও গুঁজে দেয়।
.
কিন্তু এত যে জল্পনা কল্পনা, এত উৎসাহ উদ্দীপনা সব কিছু এক প্রচণ্ড আঘাতে নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
ধারতি নিখোঁজ হল একদিন।
—সত্যি। কঠিন সত্যি। কোথায় কিছুমাত্র ভুল নেই।
রাতে পারাউ সর্দার একবার ক’রে ওঠে রোজ। সে-রাতেও উঠেছিল। ঘুম ভাঙলে পারাউ রোজই একবার অভ্যাসমতো ডাকে ধারতিকে। সেদিনও ডাকল, কিন্তু সাড়া পেল না। মস্ত একটা নিয়মভঙ্গ সাড়া না পাওয়া। তাই আবার ডাকল। জবাব পেল না। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ধারতির শয্যার ওপর হাত রাখে—শয্যা শূন্য। বুকের ভেতরে ঠাণ্ডা হয়ে যায় বহুযুদ্ধের বিজয়ী সর্দারের। চিৎকার করে আবার ডেকে ওঠে।
হঠাৎ নজরে পড়ে, ঘরের দরজা খোলা। চমকে ওঠে সে। তাড়াতাড়ি বাইরে বার হয়ে আসে। ক্ষীণ আশা তখনো, হয়তো গোয়ালে গিয়েছে লিপুর। বুড়ো গাইটাকে বড় ভালোবাসে সে। হয়তো খেয়ালে হয়েছে যে সন্ধ্যেবেলায় বাঁধা হয়নি তাকে। উঠেছে তাই বেঁধে আসতে। কিন্তু পারাউকে না ডেকে কখনো তো সে বাইরে আসে না রাতে।
ফেউ-এর ডাক শোনা যায় খুব কাছে। পাগলের মতো পারাউ গোয়ালঘরে গিয়ে ঢোকে। নেই। সেখানেও নেই। কুঙ্কী অবাক হয়ে চেয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে। পথে বার হয়ে আসে বৃদ্ধ। অন্ধকারে ছোটে সে শুকোলের বাড়ীর দিকে। লাঠি আনতে ভুলে যায়। খালি হাতেই নোয়ানো দেহখানা টেনে টেনে ছোটে।
কিন্তু কোথায় লিপুর? সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে
সেই রাতেই খবর পৌঁছে যায় কিতাগড়ে। ঘোড়ার ওপর ত্রিভন ছোটে উন্মাদের মতো। প্রতিটি সর্দার ছোটে—ছোটে স্থায়ী চোয়াড় বাহিনীর লোকেরা। জঙ্গল আলোড়িত হয়—বন্যজন্তু ভয়ে পালায়। কাঁটারাঞ্জা পাহাড়ের প্রতিটি স্তরে স্তরে অনুসন্ধান চলে। সুবর্ণরেখার গতিপথের বহুদূর পর্যন্ত অনুসন্ধান চলে।
সব বৃথা।
ভোরের আলো ফোটার অনেক পরে ক্লান্ত ঘোড়াটিকে নিয়ে অবসন্ন ত্রিভন ফিরে আসে কিতাগড়ে। সর্দাররাও একে একে ফেরে। ফিরে আসে চোয়াড় বাহিনীর প্রতিটি লোক। ত্রিভনের ব্যাকুল দৃষ্টি সবার মুখে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। ব্যর্থতার স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠেছে সে-সব মুখে।
—রাজা। বাঘরায় সোরেণ এগিয়ে আসে।
ত্রিভন তাকায় তার দিকে। অসহায় সে দৃষ্টি।
—আমরা তো থামব না। খাঁড়েপাহাড়ি আর কাঁটারাঞ্জার সব কয়টি পাথর এখনো উল্টে দেখা হয়নি।
—এ তো কথার কথা সর্দার।
—না। সেই ভাবেই খুঁজব। পাথর ওল্টানো সম্ভব না হলেও, প্রতিটি গুহা, গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। রাতের অন্ধকারে যা সম্ভব হয়নি দিনের আলোয় তা হবে। হতেই হবে। আমি ফিরতাম না রাজা। ভাবলাম হয়তো খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ইতিমধ্যে।
—আমিও তাই ভেবেছি।
—কিতাপাট না করুন, যদি তিনি বেঁচে না থাকেন, দেহ যাবে কোথায়? সর্দাররা বেঁচে থাকতে তিনি শূন্যে মিলিয়ে যাবেন?
তখনি বার হয়ে যায় বাঘরায়। চোয়াড় বাহিনী ছোটে তার পেছনে।
ত্রিভন চিন্তাক্লিষ্ট হয়। কিছুদিন আগে এ ঘটনা ঘটলে সে নরহরিকে সন্দেহ করত। নিজের মা-ও সন্দেহের আওতার বাইরে পড়তেন না। কারণ নরহরির চেয়ে মায়ের স্বার্থ এখানে অনেক বেশী।
কিন্তু এখন সে কাকে সন্দেহ করবে? পারাউ সর্দারকে ডিঙিয়ে কোনো বন্য জন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে টেনে নিয়ে যায়নি ধারতিকে। নিয়ে গেলেও ধস্তাধস্তি বা চিৎকার হতই। অমন নিঃশব্দে সম্ভব হত না।
স্বেচ্ছায় যদি ঘর ছাড়ে ধারতি তাহলে অবশ্য নিঃশব্দেই যেতে পারে। কিন্তু কেন ছাড়বে? নিজেকে কি সে ত্রিভনের পথের কাঁটা বলে ভেবেছিল? সাধারণ মেয়ে হ’য়ে রাজাকে নীচে টেনে আনছে বলে ধারণা হয়েছিল তার?
ত্রিভন ভাবতে বসে। এতদিন ধরে ধারতির সঙ্গে যত কথা হয়েছে সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাচাই করতে থাকে। কিন্তু তেমন কোনো সিদ্ধান্তে জোর করেও আসতে পারে না। বরং ধারতি সমস্ত প্রাণ মন দেহ নিয়ে তাকে চেয়েছে। আত্মহত্যার প্রবৃত্তি তার হ’তে পারে না কখনই।
ছট্ফট্ করে ত্রিভন।
শেষে ঘোড়ার পিঠে গিয়ে লাফিয়ে ওঠে। সে ছোটে পারাউ সর্দারের কুটিরের দিকে।
.
শোকাকুল পারাউ সর্দার ঘোলাটে চোখ তুলে দেখে, দ্বিতীয়বার তার আঙিনায় রাজা এসে দাঁড়িয়েছেন। বহুদিন আগে একবার এসেছিলেন খাঁড়েপাথর আর বরাহভূমরাজ-এর পরে আর রাজ সমাগমের সৌভাগ্য হয়নি তার অবহেলিত কুঁড়েঘরে।
রাজাকে অভ্যর্থনা করতেই হবে। যত দুঃখই হোক না কেন তার, রাজার সম্মান দিতেই হবে। সে যে সর্দার। পাশে নিজের লাঠিটা খোঁজে সে। লাঠি ছাড়া তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব আজ। রাতে অনেকটা পথ খালি হাতে ঘুরেছে। শেষে আর পারেনি। পথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। কয়েকজন ধরে তুলে রেখে গিয়েছে তাকে দাওয়ার ওপর। সেই থেকে সেখানেই বসে রয়েছে সে। গোয়ালঘরে তখনো কুঙ্কী বাঁধা—বাইরে আনেনি কেউ। ধারতি ছাড়া আর কে-ই বা আনবে।
ত্রিভন এসে বৃদ্ধের পাশে বসে পড়ে।
—জানতাম, সহজে পাওয়া যাবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারাউ।
ত্রিভন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায়। বৃদ্ধ কি সন্দেহ করেছে কাউকে?
—এ কথা কেন বললে সর্দার।
—বললাম এই জন্যে যে, লিপুর আত্মহত্যা করতে পারে না।
—মানুষখেকো বাঘ অনেক সময়ে ব্যাটাছেলেদের ডিঙিয়ে মেয়েদের নিয়ে যায় এ আমি জানি। কিন্তু এখন সেরকম বাঘ একটাও নেই। তাছাড়া দরজা খুলে তো আমরা ঘুমোই না।
—ভুলে খুলে রাখতে পারে।
—না। ভুলেও না। কালও দরজা বন্ধ হয়েছে।
—তবে কি তুমি অন্য সন্দেহ করছ সর্দার?
—হ্যাঁ, চুরি করা হয়েছে আমার লিপুরকে।
—চুরি? কিন্তু কেন?
—রাণী হতে চলেছে বলে।
হিংসে অনেকেরই হতে পারে। সাধারণ এক তরুণীকে কুঁড়েঘর থেকে তুলে নিয়ে কিতাগড়ে প্রতিষ্ঠা করায় কোনো কোনো যুবতী আর বাপ-মায়ের মনের ভেতরে খচ্ খচ্ করতে পারে। কিন্তু এতখানি দুঃসাহস সতেরখানির কোনো লোকের হবে বলে ধারণাও করা যায় না। এ তো রাজার বিরুদ্ধে সোজাসুজি মাথা তুলে দাঁড়ানো। ত্রিভন ভেবে কূলকিনারা পায় না।
তার চিন্তারই যেন প্রতিধ্বনি তোলে পারাউ সর্দার—এমন দুঃসাহসও হতে পারে শুধু একজনের।
—কে-কে সে। ত্রিভন সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
পারাউ-এর ঘোলাটে চোখ তীব্র হয়ে ওঠে। সে সোজা রাজার দিকে দৃষ্টি ফেলে। শেষে চেপে চেপে বলে—মারাংবুরু।
—মারাংবুরু! ত্রিভন চিৎকার করে ওঠে।
—হাঁ রাজা। আপনার বাবার মৃত্যু রহস্যজনক হলেও, আমার কাছে তা জলের মতোই পরিষ্কার। আর একজনও সন্দেহ করেছিলেন—নরহরি বাবাজী। তিনি সে কথা বলতেই, আমি আপনাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। বোধ হয় আর কেউ জানে না।
—এ সন্দেহ কেন তোমার?
—বলব। আজ নিশ্চয়ই বলব। আমার লিপুরকে যখন চুরি করেছে সে, তখন কিছুতেই ছাড়ব না। বয়সটা যদি কিতাপাট বিশ বছরও কমিয়ে দিতেন। আজ দেখে নিতাম তাকে।
—কে সে? চঞ্চল হয় ত্ৰিভন।
—মঙ্গল হেম্বরম।
—পূজারী! ত্রিভন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। শেষে ধীরে ধীরে বলে—সে বাবাকে মেরেছিল?
—হ্যাঁ। কোনো ভুল নেই। দেশের লোক একে একে বৈষ্ণব হয়ে যাচ্ছে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল সে। ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল। রাজা যখন বলি বন্ধের আদেশ দিলেন, ক্ষেপে গেল সে। রাজা খাঁড়েপাহাড়ীতে ওঠার আগেই অন্য পথ দিয়ে গিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর মাথায়।
—সত্যি?
—নিজে চোখে কেউ দেখেনি। তবু কিতাপাট যেমন সত্যি—এও তেমন সত্যি।
—কিন্তু ধারতি?
—তাকেও সে-ই নিয়েছে। আমার প্রাণ ডেকে বলছে।
—মঙ্গল কি জানে না। আমি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার চাই না, সে কি জানে না যে নরহরি বিদায় নিয়েছে?
—জানে হয়তো। কিন্তু এ-ও জানে মারাংবুরুর প্রতিপত্তি দিনের পর দিন কমে আসছে। লোকে ভীড় করছে গিয়ে কিতাড়ুংরিতে। এজন্যেও আপনি দায়ী। আগের রাজা শুধু রাজাই ছিলেন। আপনি হয়েছেন সাধারণের একজন। এরপর লিপুর রাণী হলে সতেরখানি সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভুঁইয়া আর দিকুরা কি ভুলেও ওদিকে যাবে? মারাংবুরুর ঠাঁই হয়ে যাবে শ্মশান। তাই মঙ্গল চায় না এ বিয়ে। সে চায় রাণী আসুক অন্য রাজার ঘর থেকে। ব্যবধান গড়ে উঠুক কিতাগড় আর কুঁড়েঘরের মধ্যে।
ত্রিভন পারাউ সর্দারকে জড়িয়ে ধরে—সর্দার এভাবে তো আমি কখনো ভাবিনি। তুমি আজ বৃদ্ধ বলে আমার দুঃখ হচ্ছে। আফশোস হচ্ছে যুঝার সিং আর বাবার জন্যে। পঙ্গু সর্দারকে বাতিল করার প্রথা তোমার ওপরও খাটিয়েছেন তাঁরা। বুঝতে ভুল হয়েছিল তাঁদের যে পারাউ সর্দারের মাথা তার হাত-পায়ের চেয়েও বেশী শক্তি রাখে।
দুঃখের মধ্যেও তৃপ্তিতে ভরে ওঠে বৃদ্ধের মুখমণ্ডল। রাজা সত্যিই মহৎ।
—চলি সর্দার।
পারাউ জানে কোথায় যাবার কথা বলছে ত্রিভন। ব্যস্ত হয়ে বলে—একা যাবেন?
—হ্যাঁ, মঙ্গল হেম্বরমের সঙ্গে দেখা করতে দুজনের প্রয়োজন হয় না।
—কিতাপাট আপনার সহায় হোন। কথাটা বলেই বুকের ভেতরে ছ্যাঁৎ করে ওঠে বৃদ্ধের। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তার একমাত্র ছেলের যৌবনদীপ্ত মুখ। যুদ্ধবেশে এসে বিদায় চাইলে এই একই কথা বলেছিল পারাউ। কিতাপাট তো সেদিন শোনেননি। পারাউ ছট্ফট্ করে। বৃদ্ধ বয়সে কি শেষে ঠাকুর সম্বন্ধে সংশয় জাগল মনে!
আপন মনে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে পারাউ—না ঠাকুর, সন্দেহ নয়। অনেক আঘাত পেয়েছি। বড় দুর্বল হয়ে পড়েছি তাই। এই দুর্বলতাও তো তোমারই দান।
চোখ তুলে চেয়ে দেখে আঙিনা শূন্য। বিদায় নিয়েছে রাজা। দূরে পাহাড়ি পাথর থেকে অশ্বপদশব্দ ভেসে আসে।
.
সোজা গিয়ে মারাংবুরুর গুহার সামনে ঘোড়া থেকে নামে ত্রিভন। মন্দিরের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত হয় সে। চিৎকার করে ডাকে মংগল হেম্বরমের নাম ধরে। কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয় গভীর কন্দরে। কোনো সাড়া নেই।
আবার ডাকে ত্রিভন।
নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু ভেতর থেকে একটা কুকুর বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। যেন পাতাল থেকে ডাকছে। এ কুকুরকে কেউ কখনো দেখেনি—শুধু ডাকই শুনেছে।
অধৈর্য হয় ত্রিভন। ভালো করে চারিদিকে চেয়ে দেখে। হাতের বল্লমটা একবার নেড়েচেড়ে নেয়। শেষে বলে—আমিই ঢুকছি ভেতরে। সাবধান মঙ্গল।
এবারে মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। পদশব্দ শোনা যায় যেন।
মুহূর্তে ত্রিভন ঠিক করে, একা ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না। আক্রান্ত হয়ে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না
পদশব্দ এগিয়ে আসে। ত্রিভন অপেক্ষা করে।
মঙ্গল হেম্বরম সামনে এসে দাঁড়ায়।
—রাজা।
—হ্যাঁ।
—এ রাজ্যে কি নির্জনে সাধনা করবারও অধিকার নেই কারও?
—তোমার কাছে একটা কথা জানতে এসেছি মঙ্গল। সত্যি বলবে।
—’তুমি’ বলছ আমাকে?
—হেম্বরম!
—মারাংবুরুর পূজারী কি নরহরি বোষ্টম যে সে অপমান সহ্য করবে?
—চুপ কর। যা প্রশ্ন করছি তার ঠিকঠিক জবাব দাও।
—তুমিও সাবধান রাজা। মারাংবুরু এ-অপমান সইবেন না, তোমার প্রবাণবা দিয়ে তা দেখিয়েছেন।
—বাবার চেয়ে খাঁড়েপাহাড়ি প্রতিটি পথ আমার ভালোভাবে জানা আছে মঙ্গল। মাথায় পড়ার ভয় আমাকে দেখিও না।
—ত্ৰিভন।
—চুপ। আর একটিও কথা না। এই বল্লম দেখছ—
মঙ্গল থতমত খায়।
দাঁতে দাঁত চেপে ত্রিভন প্রশ্ন করে—ধারতি কোথায়?
—ধারতি? কে সে?
—সবই জানো তুমি। তবু বলছি, যাকে কাল রাতে তুমি চুরি করেছ—সে-ই ধারতি।
—চুরি! মঙ্গল লাফিয়ে ওঠে, সইবে না রাজা, সইবে না। তোমার দুর্দিন ঘনিয়ে এসেছে। মারাংবুরুর নামে আমি অভিশাপ দিচ্ছি।
সজোরে মঙ্গলের গালে চপেটাঘাত করে ত্রিভন-ভালো চাও তো ধারতিকে দাও। অভিশাপ পরে দিও।
রাগে ফুলতে থাকে পূজারী! কোনো জবাব দেয় না।
—মঙ্গল। এই শেষ বার বলছি। জবাব না দিলে, মারাংবুরুর পূজারী কাল থেকে নতুন লোক হবে।
—আমি জানি না রাজা।
জবাব শুনে নিজেকে অসহায় বলে বোধ হয় ত্রিভনের। এর পরে কী করণীয় কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। মঙ্গলের মুখের প্রতিটি কুটিল রেখার দিকে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। দৃষ্টি ফেলে খাঁড়েপাহাড়ির চুড়ায় দিকে, যেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠার আয়োজন করতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন হেমৎ সিং, সম্মুখে দণ্ডায়মান এই পাষণ্ডের হাতে।
শেষে কর্তব্য স্থির করে ফেলে ত্রিভন। তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে মঙ্গলের ওপর। ছায়ার মতো ঘুরতে হবে তার সাথে সাথে। ঘুরতে হবে এই মুহূর্ত থেকে। প্রতিটি কার্যকলাপ দেখতে হবে আড়ালে বসে।
বিদায় নেবার ভান করে ত্রিভন বলে—আজ আমি যাচ্ছি। কিন্তু কাল আবার আসব এই সময়ে। ভেবে রেখো কি জবাব দেবে তখন।
একটা পঙ্কিল হাসি ফুটে ওঠে পূজারীর মুখে। ত্রিভন লক্ষ্য করে সে হাসি।
ঘোড়ায় উঠে সে আস্তে আস্তে শাল বনের আড়ালে চলে যায়। সেখানে ঘোড়া থেকে নেমে তার পিঠ চাপড়ে বলে—অনেক খেটেছিস আজ বিজলী। এখন বিশ্রাম নে। এক পাও নড়িস না। খাওয়ার জন্যেও নয়। ধারতিকে উদ্ধার করতেই হবে। তোর পিঠে কত উঠেছে ও, মনে নেই!
বিজলী মুখ বাড়িয়ে দেয় ত্রিভনের মুখের সামনে।
—মনে আছে তো? হ্যাঁ, লক্ষ্মী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি।
দৃঢ়পদে ত্রিভন আবার এগিয়ে যায় গুহার দিকে। হাতে বল্লম। গুহার পাশে ঝোপ। সেই ঝোপে লুকিয়ে থেকে নজর রাখতে হবে।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। একা একা বসে থাকে ত্রিভন ঝোপের মধ্যে। সহস্র মশা এসে হেঁকে ধরে তাকে, তবু বিন্দুমাত্র নড়ে না সে। নড়লে ধরা পড়ার সম্ভাবনা।
চারদিক নির্জন। এতক্ষণে বাঘরায়ের দল নিশ্চয়ই ফিরেছে কিতাগড়ে।
হাতের বল্লমটার দিকে চায় ত্রিভন। ওইটিই একমাত্র ভরসা। বাঘ ভালুক এগিয়ে এলে রক্ষা নেই। সাপেও ছোবল মারতে পারে। তবু থাকতে হবে। থাকতে হবে ধারতির জন্যে।
ত্রিভন জানে, মঙ্গলের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তাতে সে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। ধারতি বেঁচে আছে কিনা কে জানে। এতক্ষণ বেঁচে থাকলেও আজকের রাতের পরে যে থাকবে না, এবিষয়ে নিঃসন্দেহ ত্ৰিভন।
খাঁড়েপাহাড়ির এক অংশে দাবানল জ্বলে ওঠে। বন্য জন্তুর চিৎকার শোনা যায়। অগ্নিশিখা মারাংবুরুর গুহাকে রাঙিয়ে তোলে। ত্রিভন জড়োসড়ো হয়ে বসে। শেষে দাবানল এক সময় ধীরে ধীরে নিভে যায়। রাত আরও গভীর হয়।
মশার কামড়ে সারা গা ফুলে ওঠে। বসে থাকতে থাকতে পা অবশ। ধীরে ধীরে পা নাড়ায় ত্ৰিভন।
তবে কি ধারতি নেই এখানে? পারাউ সর্দারের সন্দেহ কি অমূলক? বদমেজাজী বলে সবকিছুতেই হয়তো মঙ্গলের দোষ দেওয়া হয়। আসলে সে অত খারাপ কিনা কে জানে। মারাংবুরুকে ভালোবাসে সে। সে ভালোবাসায় কোনো পাপ থাকতে পারে না। মারাংবুরুর সম্মানের জন্য যদি সে খারাপ কথা বলে ক্ষতি কি? অবশ্য রাজাকে কড়া কথা বলা অন্যায় বলে ভাবে অনেকে। কিন্তু দেবতার পূজারী রাজার বাধ্য কোনোকালেই হয় না। বরং রাজাই এসে তার সামনে নতজানু হয়। বাবাকে দেখেছে ত্রিভন। প্রতি পদে তিনি নরহরির পদধুলি নিতেন। নরহরি অবশ্য কড়া কথা বলত না-সে বৈষ্ণব।
হঠাৎ গুহার ভেতরে ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ে। সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তোলে ত্রিভন। বুকের ভেতর তার ঢিপ ঢিপ করে। মঙ্গল হেম্বরম নিশ্চয়ই। এত রাতে তার আলো জ্বালবার প্রয়োজন হল কেন?
আলো সামনের দিকে এগিয়ে আসে। এবারে ত্রিভন স্পষ্ট দেখতে পায় মঙ্গলকে। তার মুখে আলো পড়ে বীভৎস দেখায়। ভেতর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসে—তেমনি বিকট
গুহার বাইরে চারিদিকে ঘুরে দেখে নেয় মঙ্গল। ত্রিভনের একেবারে কাছে চলে আসে একবার। ভয় হয় ত্রিভনের। সমস্ত কিছু বুঝি পণ্ড হলো। ধরা পড়ে গেলে মঙ্গলকে নিহত করা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। মাটির ওপর আস্তে আস্তে হাতটা নিয়ে গিয়ে সে পাশের বল্লম চেপে ধরে।
কিন্তু মঙ্গল দেখতে পেল না তাকে। সে কল্পনা করতে পারেনি, ওইটুকু ঝোপের মধ্যে স্বয়ং রাজা বসে রয়েছে ওৎ পেতে। সে জানে রাজা কালকের আগে আসবে না। তবু ঘুরে দেখে গেল একবার। সাবধানের মার নেই।
ত্রিভন উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ে তার উত্তেজনায়। মঙ্গল ধীরে ধীরে গুহায় ফিরে যায়। তার পরবর্তী কার্যকলাপ কি হবে আন্দাজ করা যায় না।
কুকুরটা ডেকে ওঠে ভেতর থেকে। ওটাকে সঙ্গে নিয়ে যদি বাইরে আসত মঙ্গল তবে লুকিয়ে থাকা সম্ভব হতো না কিছুতেই। জন্তুটা বোধ হয় কখনো বাইরে আসেনি—সূর্যের আলো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বন্দী হয়ে থেকে হিংস্র হয়ে উঠেছে নিশ্চয়। তাই মঙ্গল তাকে সঙ্গে রাখতে ভয় পায়।
সে সবাইকে বলে ওই কুকুরের মধ্যে দিয়ে মারাংবুরুর ইচ্ছা প্রকাশ পায়। তাই কুকুরকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে সতেরখানি তরফে—এমনকি তরফের বাইরেও। এই রহস্যের উদ্ঘাটন করতে চায় না মঙ্গল—তাই বাইরে আনে না।
ত্রিভনের ভয় হয়। গুহার শক্ত কাঠের দরজা হয়তো বন্ধ করে দেবে মঙ্গল। ধারতি যদি ভেতরে থাকে? এখনই হয়তো তাকে ঠেলে কুকুরের সামনে ফেলে দেওয়া হবে। মুহূর্তে দেহটি হবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। বল্লম হাতে নিয়ে দুই পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়ায় ত্রিভন
কিন্তু না। দরজা বন্ধ হয় না। আলোর রেখা কিছুক্ষণের জন্যে ভেতরে মিলিয়ে গিয়ে আবার এগিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে সে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে মঙ্গল একটা বোঝা টেনে নিয়ে আসছে। তবে কি ধারতি নেই? সব শেষ হয়ে গেল? মাথা ঝিম্ঝিম্ করে ওঠে তার।
না না। ওই তো দাঁড় করিয়ে দিল। হ্যাঁ, ধারতি—নিশ্চয় ধারতি। চিনতে ভুল হয় না ত্রিভনের হাত-পা বাঁধা ধারতির—মুখ বাঁধা। শয়তান নির্দয়ভাবে ফেলে রেখেছিল ওই অবস্থায়।
ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় ত্রিভনের। কিন্তু তাতে সুফল নাও ফলতে পারে। মঙ্গলের হাতে দাএম—খড়্গ। মানুষের অস্তিত্ব জানতে পারলে সে আর দেরী করবে না। সোজা দাএম চালাবে ধারতির ওপর।
কিন্তু কি করতে চায় শয়তান?
ধারতিকে ধরে টেনে নিয়ে আসে সে গুহার একেবারে সামনে, সেখানে কুকুর বলি দেওয়া
হয়। মাত্র দশ হাত দূর থেকে ত্রিভন চেয়ে থাকে।
হাত-পা-মুখের বাঁধন খুলে মঙ্গল বলে—কেন এখানে আনা হয়েছে জানিস?
ধারতি স্তব্ধ। অনুভব শক্তি নেই যেন তার।
—এই হাত আর এই খঙ্গ অনেক মানুষের মাথা নামিয়েছে।
ধারতি কাঁপে না একটুও।
—ত্রিভন? ফুঃ। তার বাপের ও-দশা কে করেছিল? এই আমি। পাথর দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম তার মাথা। তোর ত্রিভনেরও সেই দশা হবে—হবেই। তোকে পাশে নিয়ে কাঁটারাঞ্জায় আর বাঁশী বাজানো চলবে না।
ত্রিভন চমকে ওঠে। ধারতির চোখেও যেন বিস্ময়।
—ভাবছিস, দেখেনি কেউ, তাই না? মারাংবুরুর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। হুঁ।
খড়্গটা মটিতে নামিয়ে রাখে মঙ্গল। ধারতির একেবারে কছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তার কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলে—বাঁচাতে পারিস এখনো। সব পথ বন্ধ হয়নি এখনো। রাজী আছিস্?
কোন্ পথের কথা বলছে পাষণ্ড? ত্রিভন ভাবতে চেষ্টা করে?
—হ্যাঁ। ভেবে উত্তর দিবি। যাবি আমার সঙ্গে সতেরখানি ছেড়ে? আমার কাছে থাকবি? ত্রিভনের ইচ্ছে হয় কুকুরটার ওপর লাফিয়ে পড়ে। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে সে। শেষ অবধি দেখতে হবে।
ধারতি রাগে দুঃখে মাটিতে পদাঘাত করে। প্রথম কথা বলে সে—তোর মুখে পোকা পড়বে।
—তবে প্রস্তুত হ। আগুন জ্বলে মঙ্গলের সাপ-চোখে।
—আমি প্রস্তুত। কিন্তু রাজা তোমাকে ছাড়বে না—একথা বলে দিচ্ছি।
আর অপেক্ষা করা সঙ্গত হবে না। ত্রিভন ভাবে। এখনো খড়্গটা মাটিতে পড়ে রয়েছে। এরপর নিশ্চয়ই হাতে তুলে নেবে। তখন সময় পাওয়া যাবে না।
বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে খাটা পা দিয়ে চেপে ধরে বল্লম উঁচিয়ে দাঁড়ায় ত্রিভন।
—এক চুলও নড়িস না কুকুর!
ছাই-এর মতো সাদা দেখায় মঙ্গল হেম্বরমের মুখ। এই অপ্রত্যাশিত পরিণামের কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে। সে জানে এর পরে কি হতে পারে। ভয়ে শিউরে ওঠে—গা কাঁপতে থাকে।
হাত-জোড় করে বলে—জাঙ্গালা তারে, আশ্রয় এমালেম্।
—থির কোঃপে। ত্রিভন চেঁচিয়ে ওঠে। সে জানে এই সব হীন চরিত্রের লোকেরা সব কিছুই করতে পারে।
—আম্ রাজা। ইঞ আমরেণ হোপন কানালে।
এতক্ষণ ধারতি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যা ঘটেছে সব যেন স্বপ্ন—বাস্তবের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। ত্রিভনও তার দিকে চাইবার অবসর পায়নি। সম্মুখে জঘন্য শত্রুকে রেখে কোনোদিকে দৃষ্টি ফেলা যায় না। তাতে ঘোর বিপদ।
অনুভব শক্তি ধীরে ধীরে ফিরে আসে ধারতির। বুঝতে পারে স্বপ্ন নয়—যা ঘটছে অবিশ্বাস্য হলেও তা-ই সত্য।
মঙ্গলের কাকুতি শুনে ধারতি বলে—কখনো নয়, কোনো ক্ষমা নেই। ও হীন, ও নরক।
ত্রিভনের বল্লম ক্ষীণ আলোয় ঝলসে ওঠে। পরমুহূর্তে মঙ্গল লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ত্রিভন মৃত পূজারীর দিকে। লোকটির বলিষ্ঠতা ছিল। সেই বলিষ্ঠতা সতেরখানির প্রতিটি লোকেরই কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু মঙ্গলের বলিষ্ঠতাকে আচ্ছন্ন করেছিল তার মনের নোংরামি আর কুটিলতা। নইলে সে ত্রিভনের রাজত্বে শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারত।
গুহার কুকুরটি আবার ডেকে ওঠে।
ধারতি নিশ্চিন্ত হয়ে ভেঙে পড়ে ত্রিভনের বুকের ওপর।
বিজলী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ধারতি।
—চল। অবিশ্রান্ত জল ঝরে তার চোখ দিয়ে।
—একটু দাঁড়াও। একে এভাবে ফেলে গেলে তো চলবে না। কোনো গুহরা মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হবে। যদি কেউ জানতে পারে একে আমিই মেরেছি, তাহলে খারাপ ফল ফলতে পারে।
.