কিতাগড় – ২

সমস্ত দিন আনন্দ আর উত্তেজনার মধ্যে কাটলেও, সন্ধ্যাবেলা মন খারাপ হয় লিপুরের। কাঁটারাঞ্জার টান দুর্নিবার—সেই টানকে সংযত রাখতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে ওঠে। শেষে দাদুর কাছে গিয়ে বসে পড়ে বলে—গল্প বল।

—কিসের গল্প।

—রাজার।

—আর একদিন শুনিস। আজ ঘুমো গে।

—ঘুম যে পায় না।

আঙিনার সাঁজালের আলো এসে পড়েছে লিপুরের মুখে। সেই মুখের দিকে চেয়ে কষ্ট হয় পারাউ-এর।

—তোর বিয়ে দেবো রে লিপুর। আর দেরি করব না।

—না। বিয়ে করব না।

—কেন রে। সুন্দর একটা এঁড়ে আসবে। বৃদ্ধ হেসে ওঠে। দরকার নেই।

—চিরকাল এমনি থাকবি?

কথার জবাব দেয় না লিপুর। অন্যমনস্ক হয় সে।

সেই সময়ে নরহরি বাবাজী এসে আঙিনায় পা দেয়।

—কেমন আছো সর্দার?

—ঠাকুরবাবা না?

—হ্যাঁ। বরাহভূম থেকে ফিরেছি কাল। এসে দেখলাম সব ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। নরহরি চোখ মোছে।

—মারাংবুরুর অভিশাপ।

—তুমিও একথা বিশ্বাস করেছ?

—বিশ্বাস করাই ভালো। না হলে অনর্থ ঘটে।

—আমি জানি, কে এমন জঘন্য কাজ করেছে। নরহরির কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা।

—মঙ্গল হেম্বরম্ পারাউ উদাসভাবে বলে ওঠে।

চমকে ওঠে নরহরি।

—চমকালেন কেন?

—তুমি জান?

—একথা জানতে কোনো কষ্ট হয় না ঠাকুরবাবা। রাজা বৈষ্ণব। রাজ্যের লোকেরাও একে একে বৈষ্ণব হচ্ছে। মারাংবুরুর প্রতাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই—

—ঠিক। আমি যাব মঙ্গলের কাছে।

—না। যাবেন না। ধরে নিন রাজার ভাগ্যে ছিল অপঘাত মৃত্যু। শুধু শুধু ওখানে গিয়ে ওকে প্রাধান্য দিলে খারাপ হবে।

নরহরির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। বৃদ্ধের কথাটা সে উড়িয়ে দিতে পারে না। বরং যত ভাবে, ততই ঠিক বলে মনে হয়। কালাচাঁদ জিউ-এর প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে মারাংবুরুর কথা সতেরখানির অধিবাসীদের মন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে তাকে একপাশে সরিয়ে রাখাই ভালো। রাজাও সেই ভাবে ভালো করতেন। কুকুর বলির রক্ত দেখে বিচলিত না হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে, আজ এতদিন পরে মারাংবুরু আমার সতেরখানির লোকদের মনে ভীতির আসন প্রতিষ্ঠা করতে পারত না।

—তোমার কথা মেনে নিলাম সর্দার। মঙ্গল থাক তার নিজের অভিযান নিয়ে।

—আর একটা কথা ঠাকুরবাবা। আপনার সন্দেহের কথা রাজা ত্রিভনের কানে যেন না যায়। প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করতে পারেন তিনি। সে চেষ্টা করলে অনেক দিকুর মন ভাঙবে। রাজার বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারে তারা মঙ্গলের প্ররোচনায়।

—সত্যি কথা বলেছ সর্দার। আমরা থাকি পুজো-অৰ্চনা নিয়ে। এত বেশী ভাবতে পারি না।

—আপনাদের তো কোনো দরকার নেই এসবে। আপনারা হলেন মহাপুরুষ।

—কই আর হতে পারলাম। গোবিন্দকে জীউ-এর সেবার ভার দিয়ে ভাবলাম বৃন্দাবন যাব। কিন্তু হয়ে উঠছে না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরহরি দাস।

গুরুগম্ভীর আলোচনায় অধৈর্য হয়ে উঠেছিল লিপুর। নরহরির দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও সজোরে কৃত্রিম শ্বাস ফেলে।

—বৃন্দাবনের কথা শুনে তোর দীর্ঘশ্বাস পড়ল নাকি রাধা? নরহরি ঠাট্টা করে।

—আবার রাধা বলছ?

—তুই তো রাধাই।

—বেশ তাই। লিপুরের মুখ গম্ভীর হয়।

কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদ দেখা যায় আকাশে। লিপুর উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেদিকে। কিছুই ভালো লাগে না তার, কাঁটারাঞ্জায় ইচ্ছে করে যায়নি বলে। সে হয়তো ফিরে গিয়েছে অপেক্ষা করে করে।

—কি রাধা চাঁদ দেখে কি কালাচাঁদের কথা মনে পড়ল?

নরহরি বাবাজীকে আদপেও ভালো লাগে না লিপুরের। এর চেয়ে বরং মারাংবুরুর পূজারী ভালো। দেখে ভয় লাগলেও ভালো। নরহরি বাবাজীকে কেমন যেন অসভ্য বলে মনে হয়। কথার জবাব দেয় না সে।

সেই সময়ে করুণ বাঁশীর সুর ভেসে আসে দূর থেকে। চঞ্চল হয়ে ওঠে লিপুর। কিছুক্ষণ বসে থেকে ছট্‌ফট্ করে শেষে উঠে পড়ে। কোথা থেকে আসছে সে-সুর জানে সে। ছুটে গাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছে হয়, তখনি দৌড়ে যায় কাঁটারাঞ্জার সেই পাথরের কাছে। যে-পাথর মসৃণ হয়ে উঠেছে—মানুষের স্পর্শ পেয়ে পেয়ে। কিন্তু এই রাতে একা কি করে যাবে? রাগ হয় বাঁশীওলার ওপর। ওর কি একটুও বুদ্ধি নেই? ভয়ও নেই একবিন্দু। যদি ভালুক এসে কিছু করে? যদি বাঘ বার হয়? লিপুরের ছোট্ট বুকখানা ভয়ে কাঁপতে থাকে।

বাঁশীর সুর নরহরি আর পারাউ সর্দারও শুনতে পায়। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না—লিপুর সেই সুরের টানেই বাইরে গেল। অমন বাঁশী কত লোকই বাজায় এই তরফে।

নরহরি আরও কিছুক্ষণ বসে গল্প করে। কুঙ্‌কীর বাছুর দেখে। এত বয়সেও সে আবার বাচ্চা দিল দেখে অবাক হয়। শেষে একসময়ে বলে—আজ উঠি সর্দার।

—আসবেন মাঝে মাঝে। বেশীদিন আর আসতে হবে না।

নরহরি চলে গেলে বৃদ্ধ আবার ভাবতে বসে। লিপুরের ভার ঠাকুরবাবার ওপর দিয়ে গেলে হয়। সতেরখানিতে তাঁর প্রভাব আছে—ব্যবস্থা একটা করে দিতে পারবেন ভালো ঘর দেখে। কিন্তু বলতে কেমন বাধো বাধো লাগে। এ-বংশের মেয়ের আবার বিয়ের ভাবনা। কত সম্বন্ধই তো এলো—সবই কি খারাপ ছিল? আসলে মেয়েটিকে কাছে রাখার ছুতো। নিজের মন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে বৃদ্ধের কাছে।

পুবের আকাশ ফর্সা না হলেই বাটালুকা গ্রামের আশেপাশের সমস্ত অধিবাসী ঘরের বাইরে এসে কপাট বন্ধ করে। নারীরা বাচ্চাদের পিঠে বেঁধে নেয় ভালো করে। অনেক যুবতী আঁচলভরে বন্যফুল তুলে নেয়। আর পুরুষেরা হাতে নেয় বাদ্যি—তুমদাঃ, মাদান ভেড়, রাহাড়। মেয়েরা সুন্দর সাজে সেজেছে—পরনে তাদের রঙীন খাণ্ডি আর বান্দের কিচরি। পুরুষেরা গায়ে জড়িয়েছে বাহাধুতি। সারিবদ্ধভাবে বাজনা বাজিয়ে হৈ হৈ করতে করতে তারা রওনা হয় কিতাডুংরিতে কিতাপাটের মন্দিরে। অসময়ে কিতাডুংরির এই উৎসব। প্রতি শ্রাবণ মাসের উৎসব ছাড়াও এটা বাড়তি লাভ। তাই সবার মনে আনন্দ।

নতুন রাজা আজ কিতাপাটের পুজো দেবেন। রাজদর্শন মিলবে। সেই সঙ্গে বোঝা যাবে রাজার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা। দু’একটা বিচার করবেন তিনি। সতেরখানি তরফের এটাই হল প্রচলিত নিয়ম। প্রথম দিনেই রাজা সম্বন্ধে সমস্ত অধিবাসীর মনে স্পষ্ট ছাপ পড়ে যায়। সে ছাপ এত গভীর যে কিছুতেই আর ওঠে না। প্রথম দিনেই রাজার হয় চরম-পরীক্ষা।

কিতাডুংরি পাহাড় থেকে শালবনে ছাওয়া সদ্য-ঘুমভাঙা বাটালুকা গ্রামখানাকে দেখায় অপূর্ব আলের পথ ধরে পিঁপড়ের সারির মতো দলে দলে আসে মুণ্ডা, দিকু, ভূমিজ সাঁওতালেরা। পাথরের দুর্গম পথ বেয়ে তারা অবলীলাক্রমে উঠে আসে পাহাড় বেয়ে—এসে জড়ো হয়ে মন্দিরের সামনে।

লিপুরও এসেছে শুকোলদের বাড়ীর লোকজনের সঙ্গে। পারাউ সর্দারের পক্ষে এতদূর হেঁটে আসা সম্ভব নয়।

মজা দেখতে এসেছে লিপুর ভিড়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে সে। রাজার বিচার দেখে তার খুব হাসি পাবে। রাজা নিশ্চয়ই মুখখানাকে গম্ভীর করবে। তখনি তো সে হেসে ফেলবে। মনে মনে একটু ভয়ও হয় লিপুরের। তার মতো আর সবাই না হেসে ওঠে রাজার কাণ্ড দেখে। লজ্জার সীমা থাকবে না তাহলে।

হঠাৎ জনতার মধ্যে একটা আলোড়ন ওঠে। এতক্ষণের চিৎকার আর হাসি মুহূর্তে স্তব্ধ হয়। রাজা আসছেন।

ত্রিভন সিং ভুঁইয়া ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। তাকে অনুসরণ করে পায়ে হেঁটে আসে নরহরি বাবাজী, সারিমুর্মু, বুধকিস্‌কু, বাঘরায় সোরেণ আর ডুইঃ টুডু।

কী চমৎকার দেখাচ্ছে রাজাকে। লিপুরের চোখের পলক পড়ে না। যেন মেঘের রাজ্য থেকে দেবতা নেমে এলেন। এ দেবতাকে সে তো চেনে না—দেখেনি কোনদিনও। মনের মধ্যে কে যেন গুমরে কেঁদে ওঠে—সজল হয়ে ওঠে ওর চোখ দুটো। রাজা ক-ত উঁচুতে। আর সে? কারারাঞ্জার কোল ঘেঁষা এক কুটিরের সামান্য বালিকা। পরনে তার ছেঁড়া শাড়ী। হাতে একজোড়া বালাও জোটে না।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে লিপুর। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গোঁজে সে। আর কেউ দেখে ফেললে তিরস্কার করবে। আজকের দিনে হাসতে হয়—আনন্দ করতে হয়। এই আনন্দের মধ্যে তার চোখের জল দেখতে পেলে সর্বনাশ ঘটবে।

যে প্রত্যাশা আর বুক-ভরা আনন্দ নিয়ে সে এসেছিল, রাজার রূপ আর আড়ম্বর দেখে তা নিমেষে অন্তর্হিত হয়। একটা তীব্র বেদনা বাসা বাঁধে, তার মনে। এ-রাজাকে সে চেনে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে লিপুর কাঁটারাঞ্জা পাহাড়ে আর সে যাবে না। আর সে বসবে না সেই মসৃণ পাথরে। বাঁশীও শুনবে না। না—না, মরে গেলেও নয়। বাঁশীর সুর যদি ভেসে আসে দূর থেকে, সে কানে আঙুল দেবে। তবু যদি শুনতে পায়, গরুর জন্যে রাখা পোয়ালের গাদায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবে থাকবে তার মধ্যে।

বেশীক্ষণ বসে থাকা যায় না। সবার সঙ্গে তাকেও দাঁড়াতে হয়। রাজা একেবারে কাছে এসে পড়েছে। সম্মান দেখাতে হবে।

কিতাপাটের পূজারী এতক্ষণ মন্দিরের সামনে পায়চারী করছিল। এবারে একগাল হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় রাজার দিকে। তার আমন্ত্রণে রাজা মন্দিরে প্রবেশ করে। সর্দাররা দাঁড়িয়ে থাকে এক বিরাট পাথরের পাশে। পুজো দিয়ে রাজা তার ওপরই এসে বসবে।

লিপুর ভাবে, কাঁটারাঞ্জার পাথর এই পাথরের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক কালো। সে পাথরে কেমন যেন মায়া-মাখানো, এমন রুক্ষ নয়। এ পাথরটায় সত্যিই কোনো রস নেই। লিপুর দেখে, সবাই হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিতাপাটকে প্রণাম করছে তার রাজার সঙ্গে। ধরা পড়ার ভয়ে সেও মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে।

বাইরে আসে রাজা। সর্দাররা এগিয়ে যায়। আহ্বান করে তাকে আসন গ্রহণ করতে। ত্রিভন সিং গম্ভীর—হাসির চিহ্নমাত্র নেই মুখে। লিপুর চেনে না একে–কিছুতেই নয়। এ অন্য লোক। তাই তারও হাসি পাচ্ছে না। আগে ভুল ভেবেছিল—ভেবে নেচেছিল।

সারিমুর্মু জোর গলায় বলে ওঠে—নতুন রাজা কিতাপাটের আশীর্বাদ পেয়েছেন। তোমরা তাঁর দীর্ঘজীবন কামনা কর।

সমবেত জনতা একই সঙ্গে বিড়বিড় করে কি যেন বলে। লিপুরের মনে হয়, অনেক দূরে কোথাও যেন হাট বসেছে। তারই শব্দ ভেসে আসছে। সে-ও একান্ত মনে প্রার্থনা করে- কাঁটারাঞ্জার পাহাড়ের মতো চিরকাল বেঁচে থাকে যেন ঠাকুর।

বুধাকিসকু এবারে বলে—রাজা বিচার করবেন। তোমাদের কারও যদি কোনো অভিযোগ থাকে এগিয়ে এসো।

একটা অখণ্ড স্তব্ধতা বিরাজ করে কিছুক্ষণের জন্যে। সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না কোনো। শেষে একজন যুবক অসংকোচে এগিয়ে আসে। সুঠাম দেহ তার। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল।

—তোমার নাম? সারিমুর্মু প্রশ্ন করে।

—রান্‌কো কিস্‌কু।

—বিচার চাও?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—বল, তোমার অভিযোগ।

—আমাকে একঘরে করা হয়েছে আজ।

—আজ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। এখানে আসার জন্যে ভোরবেলা উঠে দরজা খুলে দেখি, বাড়ির সামনে বাঁশ পুঁতে তাতে এঁটো শালের পাতা, পোড়া কাঠ আর ঝাঁটা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ত্রিভন সিং কথা বলে এবারে,–কেন একঘরে করল?

—আজ্ঞে রাজা, আমার বউ নেই। খুব ছোটবেলায় মরে গিয়েছে। মাস-চারেক আগে একজন মেয়েলোককে এনে রেখেছিলাম সারিগ্রাম থেকে—বিয়ে করব বলে। এতদিন পরে পাড়ায় সবাই জানতে পেরেছে তার উপাধিও আমার মতো ‘কিস্‌কু’।

—তুমি জানতে না?

—রাজাকে সাক্ষী করে কিতাপাটের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি আমি জানতাম না।

—তবে বিয়ে করনি কেন এতদিন?

—হয়ে ওঠেনি। রান্‌কো এবারে সত্যি কথা বলল না। সে বলল না যে বিয়ে করলে হারিয়ে যাবার ভয় থাকে না। হারিয়ে যাবার ভয় না থাকলে আবার ভালোবাসা।

—তাকে ছেড়ে দাও। ত্রিভন কঠিন ভাবে বলে।

—পারব না। ঝাঁকড়া চুল নিয়ে রান্‌কো মাথা ঝাঁকায়।

সর্দাররা নড়েচড়ে ওঠে। ত্রিভন সিং মুহূর্তের জন্যে বিচলিত হয়। শেষে বলে—এ হচ্ছে রাজার বিচার, যাকে তোমরাই সিংহাসনে বসিয়েছ।

—কিন্তু আমি তো এমন বিচার আশা করিনি।

—তোমার আশা অনুযায়ী বিচার হবে না। তোমার মনের চাইতে সতেরখানির সমাজের মূল্য বেশি। ত্রিভন কথাটাকে উচ্চারণ করলেও, মন থেকে মেনে নিতে পারল না। তবু উপায় নেই, সতেরখানিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে প্রৌঢ় আর বৃদ্ধদের মন অনুযায়ীই বিচারের রায় দিতে হবে।

রান্‌কো বুঝতে পারে, উদ্ধত হয়ে এখানে লাভ নেই। সমস্ত দেশের লোকের বিপক্ষে দাঁড়ানো তার একার পক্ষে অসম্ভব। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

চার-সর্দার ধমকে ওঠে। ডুইঃ বলে—ব্যাটাছেলে হয়ে চোখের জল ফেলছ? লজ্জা করে না?

তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলে বলে রান্‌কো—ভুল হয়েছিল সর্দার। এমন আর হবে না। রান্‌কোর সমস্ত শরীর রক্ত হয়ে ওঠে। কিতাপাটের কাছে শক্তি কামনা করে সে।

ত্রিভনের কষ্ট হয়। লোকটি সত্যিই মেয়েটিকে ভালোবাসে। আজ যদি সে রাজা না হতো—যদি এই পাহাড়-সমান দায়িত্ব তার না থাকত, তাহলে বলত—বেশ করেছ।

কিন্তু উপায় নেই। সে রান্‌কো কিস্‌কুর পাড়ার আর সবাইকে সামনে আসতে বলে। পঁচিশজন লোক একসঙ্গে এসে রাজাকে প্রণাম করে।

—তোমাদের মধ্যে মোড়ল কে?

—আমি রাজা। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ায় এক বৃদ্ধ।

—রান্‌কো মেয়েটিকে আজই ছেড়ে দেবে। কিন্তু মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা তো করতে হবে।

—কালই বিয়ে দেবো তার রাজা। আমরা প্রস্তুত।

—বেশ। আর রান্‌কোরও তো বিয়ের দরকার। বাড়িতে কেউ নেই তার।

—পাড়ায় অনেক মেয়ে আছে রাজা। অমন সুন্দর ছেলের বউএর ভাবনা?

—ভালো। ওর বাড়ির সামনে থেকে আজই বাঁশ তুলে নেবে। পাড়ার সবাই ওকে নিয়ে আজ খাওয়াদাওয়া করবে।

জনতা জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। এমন সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করা তারা দেখেনি কখনো। নতুন রাজা মানুষ নয়—দেবতা। ভিড়ের মধ্যে লিপুরের ছোট্ট বুকখানা গর্বে ভরে ওঠে। কিছু না বুঝলেও এটুকু সে জেনেছে যে ত্রিভন সিং চমৎকার বিচার করেছে। কিন্তু সে তো রাজা—পারবেই বা না কেন? কিতাগড়ে যারা জন্মায় তারা আঁতুড় ঘরের বাইরে আসার আগেই বিচার করতে শেখে—ঘোড়ায় চড়া শেখে।

জনতার কলরব রান্‌কো কিস্‌কুর কানে যায় না। তার মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে। আজ থেকে ঝাঁপনী তার কেউ নয়। ঝাঁপনী কালই হবে অন্যলোকের ঘরণী। ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় রান্‌কো। পালাতে হবে বাটালুকা ছেড়ে অনেক দূরে। যেখানে ঝাঁপনীর কথা তার কানে পৌঁছবে না।

বুধ কিস্‌কু চিৎকার করে বলে—আর আকয় কোয়াঃ চেৎ লালীশ মেনাঃ আ?

সবাই ঘাড় ফিরিয়ে এদিকে ওদিকে দেখে। কেউ এগিয়ে আসে না আর। আর কোনো নালিশ নেই আজ।

নাচ শুরু হয়। পুরুষেরা বাদ্যি নিয়ে একদিকে—মেয়েরা অন্যদিকে। আজকের দিনে শুধু আনন্দ। নাচ গান হাণ্ডি আর মনের শ্রদ্ধা দিয়ে তারা রাজাকে অভিষেক করবে। কিতাডুংরি পাহাড়ের এই আনন্দোৎসব নিচের গ্রামগুলির শালবনের পাতায় কাঁপন লাগায়। মুষ্টিমেয় স্থবির আর অসুস্থ ব্যক্তি, যারা যোগ দিতে পারেনি এতে, ঘরে বসে কান পেতে শোনে এই আনন্দ কোলাহল। এক অকথিত ব্যথা পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে তাদের বুকের নীচে। এমন দিন জীবনে দুবার আসে না।

রাজার নামে জয়ধ্বনিতে ত্রিভন সংকুচিত হয়। ভাবে, এতগুলো লোকের এই যে বিশ্বাস আর নির্ভরতা—এর যোগ্যতা আছে কি তার? পারবে কি সে সতেরখানি তরফের সমস্ত অধিবাসীর সুখদুঃখের বোঝা ঘাড়ে নিতে?

একজন যুবতী নাচতে নাচতে রাজার সামনে এসে থেমে যায়। মুচকি হেসে নত হয়ে একপাত্র হাণ্ডি বাড়িয়ে দেয়।

নরহরি বাবাজী হাঁ হাঁ করে ওঠে—না না, ছি ছি, হাঁড়িয়া খাবে কেন?

ত্রিভন সিং চার সর্দারের মুখের দিকে চকিতে দৃষ্টি ফেলে। এখানকার নিয়মকানুন সে ঠিক জানে না। আগে থেকে তারা বলেও দেয়নি।

সর্দারদের মুখে কিছুই লেখা নেই। সে নিজের বুদ্ধিতে পাত্রটি মুখের সামনে তুলে সামান্য একটু খেয়ে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেয়।

নরহরি বাবাজী স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।

জনতা আনন্দে আকাশ ফাটানো চিৎকার করে। মেয়েটি সেই পাত্র থেকে একটু একটু করে অনেক পাত্রে ঢেলে দেয়। রাজার প্রসাদ।

একদল মেয়ে একসঙ্গে এগিয়ে আসে এবারে। প্রত্যেকের হাতে হাণ্ডির পাত্র। নিজেকে অসহায় মনে করেন ত্রিভন। এতগুলো পাত্র থেকে একটু করে খেলেও তাকে আজ পাথরের ওপর ঢলে পড়তে হবে। হাণ্ডি পানের অভ্যাস তার একটুও নেই। কিন্তু এরা শুনবে না—বিশ্বাস ও করবে না। পেট থেকে পড়েই যারা মুখে হাণ্ডির স্বাদ পায়, তাদের রাজা এ-পর্যন্ত জিনিসটি খায়নি, একথা কেন তারা মানবে? মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে ফেলে সে। হাসতে হাসতে প্রতিটি পাত্রে ওষ্ঠ স্পর্শ করে দেয়।

সর্দারদের মুখ হাসিতে ভরে ওঠে। ত্রিভন বুকে বল পায়। এটাও হয়তো একটা পরীক্ষা—সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

সারিমুর্মুকে কাছে ডেকে বলে—আর বেশীক্ষণ চলতে দেওয়া উচিত নয় সর্দার। অনেকেই মাতাল হয়েছে! পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে পারে।

—আধ্যেক লোকও যদি সেভাবে মরে আজ, তাতে তাদের বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। কিন্তু এমন নাচগান এখনি বন্ধ করলে বড় আঘাত পাবে।

ত্রিভন উপলব্ধি করে, কথাটা ঠিকই বলেছে সর্দার।

উন্মত্ত জনতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা পাহাড়ে—দাবানলের মতো। বেশবাসের খেয়াল থাকে না কারও। এক একজন যেন এক একটি আগুনের ফুলকি। সূর্যের তাপ শালগাছে বাধা পেলেও সারা গা তাদের ঘর্মাক্ত—চোখ রক্তবর্ণ। মাথার চুল ধূলিমলিন। তবু নেচে চলেছে তারা—যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা—যার যেমন শক্তি, যার যেমন পায়ের জোর, দেহের ওজন। এমন সব উৎসবের দিনে অনেকের অনেক কামনার চরিতার্থ হয়—অনেক বিরহের সাময়িক নিবৃত্তি—অনেক অকথিত কথায় প্রকাশ। পুষে রাখা আনন্দ আর ব্যথা, হাসি আর অশ্রুতে ঝরে পড়ে এমন দিনে।

শেষে সূর্য একসময় পশ্চিমে ঢলে পড়ে। হাণ্ডির ভাঁড় শূন্য হয়—শরীরের সমস্ত শক্তি হয় নিঃশেষিত। শিশুরা কাঁদতে শুরু করে—বৃদ্ধেরা ধুঁকতে থাকে—মাতালেরা আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে টলে পড়ে এদিকে ওদিকে। ভাঙা পাত্র বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকে উৎসব প্রাঙ্গণে। বন্যফুলের স্তূপ শুকিয়ে ওঠে রাজার পাথরের চারপাশে।

উৎসব শেষ হয়। সর্দার আর নরহরি বাবাজীর সঙ্গে রাজা বিদায় নেয় ঘোড়ায় চড়ে। যুবতীরা মাতাল স্বামীদের তুলে ধরে। মায়েরা শিশুদের পিঠে বেঁধে নেয়। বাদ্যযন্ত্রগুলো ঘাড়ে নিয়ে শ্লথ গতিতে সারিবদ্ধ হয়ে ঘর-পানে ফেরে সতেরখানি তরফের বহু গ্রামের অধিবাসী। ফেরার পথে মাদলে মাঝে মাঝে হাত চাপড়ায় তারা—উৎসবের সুরের রেশ তখনো তাদের কানে বাজে, মনে বাজে, মেয়েরা দু’এক কলি নতুন শেখা গান গেয়ে ওঠে। সবার চোখের সামনে ভাসে তাদের নবীন রাজার সুন্দর কালো চেহারা।

লিপুরের ছোখেও ভাসে ত্রিভনের মুখ। কিন্তু সে-মুখের কথা মনে করে তার চোখ ছাপিয়ে জল আসে। সামনের অসমতল পথ ঝাপসা হয়ে ওঠে বার বার। সে হোঁচট খায়—সবার পেছনে পড়ে যায়।

শুকোলের দিদি পেছন ফিরে চিৎকার করে বলে ওঠে—ইক লো ছুঁড়ি, হলো কি তোর!

—যাই দিদিমা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় লিপুর।

.

পরদিন দুপুরে পারাউ সর্দারের সামনে ভাত ধরে দিয়ে নিজে খেয়ে নেয় লিপুর। সকালে কেটে আনা একগাদা ঘাস কুকীর সামনে রাখে। ঘরের যেটুকু কাজ বাকি ছিল সেরে নিয়ে সর্দারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্দার তখনো ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে চলেছে।

—বাইরে যাব আমি।

—কোথায়? পারাউ প্রশ্ন করে।

—পাহাড়ে।

—এখন কেন?

—জ্বালানি কাঠ নেই। শুকোলদের বাড়িতেও যাব এক ফাঁকে। ওরা লোক দেবে বলেছিল আল বাঁধার জন্যে।

—তা যা, তাড়াতাড়ি ফিরিস।

লিপুর বাইরে আসে।

গরুটা ডেকে ওঠে। ফিরে দেখে তার দিকে চেয়ে রয়েছে এক দৃষ্টে। কাছে গিয়ে দাঁড়ায় লিপুর হাসিমুখে। পিঠ চাপড়ে বলে—অমন করে পেছু ডাকতে নেইরে কুঙ্‌কী। আমি আসছি। তুই বাচ্চাটাকে একটু আগলে রাখিস।

কুঙ্‌কী মুখ নিচু করে খেতে খেতে একটা শব্দ করে। বোধহয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খানিকটা ঘাস মুখের সামনে থেকে উড়ে যায় শ্বাস ফেলার সময়ে।

—রাগ করলি? লিপুর তার পিঠের ওপর মাথা রাখে। আঙুল দিয়ে পিঠের নীচের দিকে সুড়সুড়ি দেয়। কুঙ্‌কীর গায়ের চামড়া কেঁপে ওঠে সুড়সুড়িতে।

—যাইরে। লিপুর দৌড়ে রাস্তায় নামে। পারাউ সর্দারের আঁচানোর শব্দ কানে আসে তার। এখন বুড়ো বাইরের খাটিয়ার ওপর গা এলিয়ে দেবে। বিকেলের আগে আর উঠবে না।

শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়ে লিপুর তাড়াতাড়ি পা চালায়। এই সময়েই সাধারণত সে আসে। বুকের ভেতরে ক্ষীণ আশা, হয়ত আজকেও আসবে পুরোনো অভ্যাসের বশে। হাতে থাকবে বাঁশি।

যতই এগিয়ে যায় বুকের ধুকধুকুনি ততই বাড়ে লিপুরের। যদি না থাকে আজ? কালো পাথরটা শূন্য পড়ে থাকে যদি? ভাবতে পারে না লিপুর।

সোজা পথে যেতে ভরসা পায় না সে। ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে। আকাওনা, দুধিলোটা, কেদার, সাপীন আর দাতরার গাছের পাতা দু’হাতে দিয়ে সরিয়ে সে চলতে থাকে। সেলেসিং লেগে গা জ্বালা করে। তবু চলে সে। শেষে একসময়ে সেই পাথরের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ায়।

নেই সে। লিপুরের মন ভেঙে পড়ে। তার সব উদ্যম, সব পরিশ্রম হতাশায় পরিসমাপ্ত হয়।

রাজা হয়েছে সে। আর আসবে না। সিংহাসন পেয়েছে। এই কালো পাথরের কথা কি আর মনে থাকে?

লিপুরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, কোটি কোটি কীটের শোষণে সামনের পলাশ গাছ যেমন হয়েছে, ঠিক তেমনি। পাথরটার নীচে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সে। নিজে থেকে কখনো পাথরের ওপর বসেনি লিপুর, আজও বসবে না। ত্রিভু জোর করে তার হাত ধরে কখনো কখনো বসিয়েছে।

একটু দূরের এক গাছে ময়ূর পেখম মেলেছে। সেইদিকে আনমনে চেয়ে থাকে সে। কিছুদিন আগে কুঙ্‌কীকে খুঁজতে এসে প্রথম যখন ত্রিভুর সঙ্গে দেখা হয়, তখনো এক ময়ূর পেখম মেলে দাঁড়িয়েছিল। ত্রিভু সেদিকে দেখিয়ে বলেছিল—ওটা নিবি? আমি ধরে দিতে পারি।

লিপুরের প্রলোভন হয়েছিল খুব। তবু বলেছিল—বেঁধে রাখলে ওর কষ্ট হবে। গাছেই থাক। –বাঃ, তুই তো বেশ ভাবিস। তুই আমার দলে।

সেদিন ত্রিভু যখন তার পরিচয় জানতে চেয়েছিল, গর্বে ভরে উঠেছিল তার বুক। সে পারাউ সর্দারের মুখে শোনা নিজেদের বংশ-পরিচয় গম্ভীরভাবে বলেছিল ত্রিভুকে।

—বড় ঘরের মেয়ে তুই তাহলে!

—আমাদের চেয়ে বড় ঘর আছে নাকি!

—সত্যিই নেই।

ত্রিভু যেদিন রাজা হল, সেদিনই লিপুর প্রথম জানল বাঁশী হাতে ছেলেটিই রাজা। লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়েছিল সে। ভেবেছিল আর আসবে না এদিকে। কিন্তু দুপুর না গড়াতেই কে যেন প্রবলভাবে টানতে তাকে কাঁটারাঞ্জার এই পাথরের পাশে। তাই এসেছে। দেখাও হয়েছে রাজার সঙ্গে। কিন্তু পরিবর্তন দেখেনি কোনো। ঠিক আগের বাঁশীওলাই যেন। ভয় ভেঙে গিয়েছিল লিপুরের। আনন্দ হয়েছিল খুব। নাচতে নাচতে গিয়েছিল তাই কিতাডুংরিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভুল ভাঙল। ত্রিভন যেন বুঝতে পেরেছে এতদিনে,—রাজা হবার অর্থ। অত লোকের মধ্যে হাজির হয়ে, সবার সঙ্গে নিজের পার্থক্য যাচাই করার অবকাশ পেয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে তার মনেও। আগের বাঁশীওলা আর নেই।

তবু আজ লিপুর এসেছিল একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে। সে আশা দুরাশাই। ত্রিভন আসেনি—আর আসবেও না কখনো। কিতাগড়ে তার অনেক কাজ এখন।

ত্রিভু যেখানে পা রাখত, লিপুর সেখানে হাত বুলোয়। ত্রিভু যেখানে বাঁশী রাখত, সেখানে সে মাথা রাখে। শেষে কেঁদে ফেলে।

—এই কাঁদছিস কেন রে?

চমকে ওঠে লিপুর। চোখ দুটো মুছে ফেলে তাড়াতাড়ি। চেয়ে দেখে বাঁশীওলা দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে।

—সেঙেল সিং লেগেছে—এই দেখ। সে তাড়াতাড়ি তার বিছুটিলাগা ফুলে ওঠা হাত-পা বাড়ায়।

—ঝোপের মধ্যে দিয়ে এলি কেন?

—রাস্তা দিয়েই তো এসেছি।

—হুঁ, আমি দেখিনি বুঝি।

—কোথায় ছিলে?

—ছিলাম এক জায়গায়। এই ক’দিন আসিসনি কেন?

লিপুর একটু ভেবে নিয়ে বলে—কুঙ্‌কীর বাচ্চা হয়েছে যে।

—বাজে কথা বলিস না। ত্রিভন তার বাঁশীটা লিপুরের মাথায় ঠুকে দেয়।

লিপুরের খুব হাসি পায়। এই আবার রাজা। এ আবার বিচার করে।

—কাল কোথায় ছিলি? ত্রিভন প্রশ্ন করে।

—বাড়ীতে।

—যাসনি?

—কোথায়?

—কিতাডুংরি।

—সেখানে গিয়ে কি হবে?

—রাজা দেখতে?

—বয়ে গেছে। কুঙ্‌কীকে নিয়ে যা ঝামেলা।

—তোকে শূলে দেওয়া হবে।

—দিও। কত ক্ষমতা দেখব।

—সত্যি যাসনি?

—হুঁ। গিয়েছি।

—দেখিনি তো।

—পেছনে ছিলাম লুকিয়ে। নাচতেও জানিনে, হাণ্ডি খেতেও পারিনে। সামনে থেকে কি করব? লিপুর হাত নেড়ে কোমর দুলিয়ে বলে। ত্রিভন হেসে ওঠে।

ঝোপের আড়াল থেকে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ হয়। লিপুর ভয়ে জড়িয়ে ধরে ত্রিভনকে।

—ভালুক।

ত্রিভন আরও জোরে হেসে ওঠে।

—ভালুক। শুনলে না? লিপুরের চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে।

—ঘোড়া।

—কার?

—আমার। রাজা হয়েছি যে। হেঁটে এলে পেছনে ভীড় হবে। কালকে চিনে ফেলেছে সবাই। –কালকের সেই ঘোড়াটা!

—হ্যাঁ, ওই একটাই ঘোড়া রাজার। বিজলী ওর নাম।

—চল দেখব। খুব সুন্দর সাজানো হয়েছিল।

—আজকে আর সেজে নেই। আমারই মতো।

লিপুর দাঁত দিয়ে একটা বুনো লতা চিবোতে থাকে। মনের মধ্যে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে তার, কিন্তু বলতে দ্বিধাবোধ করে। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে সে। ধীরে ধীরে মুখ নীচু করে।

—শিখিয়ে দেবো। ত্রিভন তার মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে।

চমকে ওঠে লিপুর। সোজা তাকিয়ে বলে—কি?

—ঘোড়ায় চড়া

বিস্মিত হয় লিপুর। মনে মনে ভাবে, সে খুব বোকা। নিশ্চয়ই মুখের ভাবে মনের কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

আজও বাঁশী বাজায় ত্রিভন। একমনে শোনে লিপুর। কিতাডুংরি পাহাড়ে গতকাল বুদ্ধিদৃপ্ত যে মুখ দেখেছিল, ভুলে যায় সে মুখের কথা। সামনেই তো বসে রয়েছে সে। চোখও দেখা যাচ্ছে তার। এ চোখে ভাসছে বাটালুকার মাঠ ঘাট পাহাড় আর শালবানের গাঢ় ছায়া।

বাঁশী থামে এক সময়ে। লিপুরের দিকে তাকিয়ে ত্রিভন প্রশ্ন করে—ভালো লাগে না? ঘাড় কাত করে লিপুর।

—তোর কুঙ্‌কী ডাকছে।

খেয়াল হয় লিপুরের। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যে হবে একটু পরেই। ত্রিভন তার পিঠে ছোট্ট কিল মেরে বলে—যাঃ, বাড়ী যা।

লিপুর উঠে ছুটতে শুরু করে। শুকোলের বাড়ি হয়ে যেতে হবে। আল বাঁধার লোক ঠিক করেছে কিনা কে জানে। বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তো বুড়ো প্রশ্ন করে। জ্বালানি কাঠ সে আগেই কিছু জোগাড় করে রেখেছে। আজ না নিলেও চলবে।

পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দে থেমে যায় সে।

—উঠবি?

—না, ছিঃ।

—ওঠ না। কেউ দেখতে পাবে না। শালবনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব!

—কি করে উঠব?

ত্রিভন নেমে তাকে উঠিয়ে দেয়। কদমে ছোটে ঘোড়া। প্রথমটা ভয় করছিল লিপুরের। শেষে দু’পাশে ত্রিভনের লাগাম-ধরা দুই দৃঢ় হাত দেখে সাহস পায়। ত্রিভনের নিঃশ্বাস তার মাথায় এসে পড়ে। সে নিশ্চিন্ত মনে দু’পাশের শালগাছের দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সব যেন নতুন—এভাবে কখনো দেখেনি। ঘোড়ায় চড়লে চিরপরিচিত দৃশ্যগুলোও কেমন যেন অন্যরকম লাগে। গাছগুলো কেমন পেছনে সরে সরে যাচ্ছে—কত তাড়াতাড়ি।

সেদিন সন্ধ্যায় কাজকর্ম সেরে লিপুর পারাউ সর্দারকে চেপে ধরে গল্প বলার জন্যে। রাজার গল্প হওয়া চাই।

—অনেক তো শুনেছিস।

—না, বল। আবদার ধরে সে।

—শোন্ তবে। এই জঙ্গল মহলেরই এক রাজার গল্প বলি।

লিপুর আরও একটু কাছ ঘেঁষে বসে। বৃদ্ধ শুরু করে—

আমাদের ওই খাঁড়ি পাহাড়ি ছাড়িয়ে আরও হেঁটে চললে, সতেরখানি তরফ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে অল্প দূরে এক গ্রাম আছে। গ্রামের নাম হল রূপসান। অনেক—অনেক দিন আগে এক ক্ষত্রিয় রাজা যাচ্ছিলেন শ্রীক্ষেত্র দর্শনে। চলতে চলতে, পথের মধ্যে এই রূপসানে এসে এক রাতে তাঁবু ফেললেন। রাজার সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর রাণী। রাণীর পেটে ছিল ছেলে। রাজা কিন্তু জানতেন না একথা। রাণী বলেননি তাঁকে। বললে, শ্রীক্ষেত্র দর্শন জন্মে আর ঘটবে না ভাগ্যে। ওভাবে তীর্থে যাবার নিয়ম নেই কিনা। তাই সংবাদটা চেপে রেখেছিলেন রাণী। রূপাসনে এসেই রাণী কাতর হয়ে পড়লেন। ছেলে হবার সময় হয়েছে। যন্ত্রণায় অস্থির, অথচ মুখে টু শব্দ করার উপায় নেই। রাজা জানতে পারলেই সর্বনাশ। তাই অসহ্য যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করলেন তিনি বহুক্ষণ ধরে। শেষে গভীর রাত্রে, সবাই যখন ঘুমে অচেতন, সেই সময়ে রাণীর যমজ সন্তান হলো। দুটোই ছেলে। রাণী পড়লেন মহা সমস্যায়। ছেলেদের ফুটফুটে চেহারার দিকে চেয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। অথচ রাজা শুনলে বিপদ ঘটবে।

—কেন, রাজার তো আনন্দই হতো। লিপুর বলে ওঠে।

—না রে, ওসব ব্যাপারই আলাদা। সে কি আর সতেরখানির রাজা, যে ছেলে দেখে আনন্দ হবে? ওরা অন্যরকম। তাছাড়া তীর্থক্ষেত্রে যাবার সব পুণ্য তো ওখানেই নষ্ট। যাকগে, শোন শেষরাত্রে যখন তাঁবু তোলা হল, রাণী একটা বাঁশের হাড়কার মধ্যে ছেলে দুটোকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এলেন।—যাওয়ার সময় রাণীর কী কান্না। রাজা হাজার জিজ্ঞাসা করেও কোনো জবাব পেলেন না।

রাণীরা চলে যাবার অনেক পরে এক বরাহ ঘুরতে ঘুরতে এসে দেখল এদের। সে কিন্তু খেয়ে ফেলল না এদের—মেরেও ফেলল না। মানুষ না হলে কি হবে, ওদেরও মায়া আছে! ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বোধ হয় নিজের বাচ্চার কথা মনে পড়ল তার। বুঝলি লিপুর, সব শিশুই এক। ওই যে কুঙ্‌কীর বাচ্চা ওখানে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমী করছে, ছটফট করছে, ওর সঙ্গে কি মানুষের বাচ্চার কোন তফাৎ আছে? নেই। বরাহ ছেলে দুটোকে নিজের দুধ খাইয়ে দিনে দিনে দিব্যি বড় করে তুলল। শেষে একদিন এক দিকু শিখারে গিয়ে ওদের দেখতে পেয়ে ঘরে নিয়ে এল। মানুষ করতে লাগল। নাম রাখল, শ্বেত বরাহ আর নাথ বরাহ।

দুই ভাই বড় হল। বড় হয়ে জঙ্গল মহলেরই পাতকুম রাজ্যের রাজার অধীনে চাকরি নিল। ভালোভাবেই দিন কাটছিল। শেষে রাজ্যের ব্রাহ্মণরা দু’ভাই-এর ওপর ভীষণ চটে গেল। ব্রাহ্মণদের প্রণাম করত না এরা। মাথাও নোয়াতো না কারও সামনে। শেষে দল বেঁধে ব্রাহ্মণরা একদিন রাজার কাছে গিয়ে অভিযোগ করল। রাজা ডেকে পাঠালেন দুই ভাইকে।

—তোমরা প্রণাম কর না ব্রাহ্মণদের? রাজা প্রশ্ন করেন।

—মহারাজ, আমরা ক্ষত্রিয়। আমাদের মাথা এমনভাবে ঘাড়ের সঙ্গে লেগে রয়েছে যে কিছুতেই নত হয় না।

রাজা ভাবলেন, মিথ্যে কথা বলছে তারা। জব্দ করার ফন্দি আঁটলেন তিনি। বললেন—বেশ, আমি পরীক্ষা করব তোমাদের। রাজী আছো?

—হ্যাঁ, মহারাজ।

পরদিন দুই ভাইকে ঘোড়ায় চড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন প্রাসাদ থেকে কিছুদূরে। বলে দেওয়া হল, ঘোড়া ছুটিয়ে প্রাসাদের সিংহদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে।

প্রাসাদের সিংহদ্বার ছিল নীচু। একটা লোক ঘোড়ায় চড়ে কোনোরকমে ঘাড় সোজা করে ঢুকতে পারে ভেতরে। রাজা সেই দ্বারে একটা খঙ্গ ঝুলিয়ে রাখলেন। বরাহ ভাইরা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে মাথা নীচু করলে বাঁচবে—নইলে রক্ষা নেই।

বড় ভাই শ্বেত বরাহ প্রথমে ঘোড়া ছুটিয়ে এল। সিংহদ্বারের একেবারে কাছাকাছি এসে খাটার দিকে দৃষ্টি পড়ল তার। স্তব্ধ হয়ে দেখছে রাজধানীর সমস্ত লোক। ব্রাহ্মণরা উদগ্রীব। রাজার মুখে মৃদু হাসি। নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি—মাথা নোয়াবেই শ্বেতবরাহ। কিন্তু তাঁর ধারণা ভূল। আতঙ্কিত হয়ে সবাই দেখল খঙ্গের আঘাতে শ্বেতবরাহের মস্তক স্কন্ধচ্যুত হয়ে ভূমিতে গিয়ে পড়ল। ভীষণ অনুতপ্ত হলেন রাজা। ছোট ভাই নাথবরাহ ছুটে আসতেই, নিজে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাকে থামিয়ে দেন। ঘোড়া থেকে নেমে আসতে অনুরোধ করেন তাকে। শেষে তার হাত ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে আসেন শ্বেতবরাহের মৃতদেহের সামনে। বড় ভাইএর ছিন্নমুণ্ড দেখে নাথবরাহের চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। অনেক দুঃখ-কষ্ট ঝড়-ঝাপটার মধ্যে তারা পাশাপাশি মানুষ হয়ে উঠেছিল।

পাতকুম-রাজ নাথবরাহকে দিলেন এক প্রকাণ্ড রাজত্ব। সেই রাজ্যই বরাহভূম—আমাদের সতেরখানি যাকে কর দেয়। নাথবরাহের নামেই দেশের নাম হয়েছিল বরাহভূম। কিন্তু আসলে, বনের সেই হিংস্র পশু, বরাহ ভাইদের যে মানুষ করেছিল—সে-ই অমর হয়ে থাকলে এই নামের মধ্যে। তাই না রে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিপুর বলে —হুঁ!

—এবার শুতে যা।

লিপুর আঙিনায় নামে। সাঁজালটা উসকে দেয়। কিছু ঘুঁটে এনে রাখে তার ওপর।

সমস্ত প্রান্তর নিস্তব্ধ। কিছুদূরে বাটালুকা গ্রামও ঘুমিয়ে পড়েছে। কাঁটারাঞ্জার ফেউএর ডাক ভেসে আসে। গরু ছাগল খুঁজতে বার হয়েছে বাঘ। দূরে খাঁড়ে পাহাড়ির দাবাগ্নি জ্বলে উঠেছে। মারাংবুরুর ক্রোধ—প্রায়ই জ্বলে অমন। অনেক গাছপালা, হরিণ, ময়ূর, সাঁজারু ছুঁচো মারা যায় এতে।

লিপুর পারাউ সর্দারের পাশ দিয়ে ঘরে গিয়ে ঢোকে। একটু নিশ্চিন্ত মনে ভাবতে হবে ত্রিভুর কথা। ঘোড়ায় ওঠার শিহরন এতক্ষণ পরে আবার অনুভূতি হয়। মাথার চুলে আলগোছে হাত রাখে সে—যেখানে অনেকক্ষণ ধরে ত্রিভুর নিঃশ্বাস পড়েছে। তার কিশোরী মনে এক অনাস্বাদিত পুলক জাগে। সে জানে না এর কারণ—বয়স হয়নি জানবার।

ত্রিভনের সঙ্গে লিপুরের মেলামেশা যখন ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হচ্ছিল, সেই সময় সমান্তরালভাবে আর একটি ঘটনা দিনের পর দিন ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। বাঘরায় সোরেণ আর ডুইঃ টুডু—এই দুই নবীন সর্দারের মধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলছিল এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মর্যাদা নিয়ে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়—শক্তি পরীক্ষা নিয়ে নয়। এর উপলক্ষ্য হল ছুট্‌কী। সারিমুর্মুর একমাত্র মেয়ে ছুট্‌কী। হাসিতে যার ঝরণা ঝরে—চাহনিতে যার হরিণ মরে লাজে।

বাঘরায় আর ডুইঃ—দুজনেরই বিয়ে হয়েছিল এককালে—সেই ছেলেবেলায়। কারও স্ত্রীই বেঁচে নেই। বাঘরায়ের বউ মরেছিল সাপের কামড়ে। হাওড়া-ছকের মহামারী ডুইঃএর বউকেও টেনেছিল। তারপরে এদের যৌবন এসেছিল, কিন্তু বিয়ে করা আর ভাগ্যে ঘটেনি। যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা এককালে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল, এখন তারা মৃত

ছুট্‌কীকে দুজনরাই একসঙ্গে চোখে পড়েছিল, সর্দার হবার পরপরই। সর্দারের বউ এমনিই হওয়া উচিত—একই সঙ্গে দুজনার মনের মধ্যে এই একই কথা ধ্বনিত হয়েছিল। বিশ্বস্ত বন্ধু তারা। কারও মনের বাসনাই কারও অজানা নেই। সেই থেকে চলেছে নারী-মন জয়ের প্রচেষ্টা। বন্ধুত্বের খাতিরে একসঙ্গে কেউ এগোয় না। একের আড়ালে চলে অন্যের সাধনা। কিন্তু বন্ধুত্বের ছেদ পড়েনি বিন্দুমাত্র।

দুজনাই লোভনীয় পাত্র। কারও সঙ্গে বিয়ে দিতেই আপত্তি নেই সারিমুর্মুর। কিন্তু দ্বন্দ্বযুদ্ধের বহর দেখে বুধকিস্‌কুর পরামর্শে চুপ করে থাকে সে। সুযোগ যখন মিলেছে, মনের মানুষ বেছে নিক মেয়ে।

পছন্দ কিন্তু অত সহজে করতে পারে না ছুট্‌কী। একের অজ্ঞাতে আর একজন যখন তার সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সে বুঝতে পারে না সত্যিই কাকে ভালোবাসে। বাঘরায় সাক্ষাতের সুযোগ খোঁজে কালাচাঁদের মন্দিরে যাবার পথে। ডুইঃ এসে দাঁড়ায় শালবনের ধারে, যখন সে প্রতি দুপুরেই আসে ফুলের জন্যে। বিকেলে মালা না পরলে ভালো লাগে না ছুট্‌কীর। দুই বন্ধুই বোধ হয় জানে পরস্পরের সাক্ষাতের সময়, তাই সংঘর্ষ বাধতে দেখা যায় না কখনো।

এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন হয় ছুট্‌কী। প্রতিদিন যখন গোবর জল দিয়ে সারা উঠোন লেপতে থাকে, তখন মন তার চিন্তায় ভরে ওঠে। প্রশস্ত উঠোন মসৃণভাবে নিকোবার সময় কোনো ছন্দপতন ঘটে না, তাই সেই সময়ে তার যত ভাবনা। সে দুজনার চুল-চেরা বিশ্লেষণ করতে বসে। প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে উঠত। কিন্তু দিন যত এগিয়ে চলে ততই তার মনের মধ্যে কবির কবিতার মতো একটা স্পষ্ট ভাব দানা বেঁধে উঠতে থাকে।

বাঘরায়। হ্যাঁ, বাঘরাই তার মনকে বেশী করে টানছে যেন। এই টানার কারণ ডুইঃ টুডুর অক্ষমতা নয়। তার চরিত্রের এক সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ছুট্‌কী ঠিক খাপ খাওয়াতে পারে না। ডুইঃএর মনে কোথায় যেন একটা অবাস্তবতার কীট লুকিয়ে রয়েছে—যেটা পাহাড়-ভাঙা মেয়ে ছুট্‌কীর ঠিক পছন্দ নয়। সে এমন পুরুষ চায় যে মাটির ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলে। যার বুদ্ধির চেয়ে বীরত্বটাই প্রধান। নারীমনকে চেনার জন্যে ব্যস্ত না হয়ে, নিজেকে যে বেশী করে প্রকাশ করে। ডুইঃএর বুদ্ধি বড় বেশী তীক্ষ্ণ। সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রখর আলো মাঝে মাঝে ছুটকীর অন্তঃস্থল অবধি ধাওয়া করে। এটা সহ্য করা বড় কঠিন, যেমন কঠিন ডুইঃএর আবোলতাবোল কথা। তবে তার একটা জিনিস ছুটকীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। গান বাঁধে ডুইঃ। মিষ্টি গলায় গান গায় সে।

শালবনের ধারে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ সেদিন। কিতাগড় থেকে ফিরছিল ডুইঃ। ছুটকীর আঁচলে ছিল ফুল। সংকুচিত হয়েছিল ছুট্‌কী। মন তার বাঘরায়ের দিকে চলেছে। ডুইঃকে এড়িয়ে যেতে চায়। তাই হঠাৎ তার আবির্ভাবে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আঁচলে এক কোণা থেকে কিছু ফুল মাটিতে পড়ে যায়।

সেদিকে চেয়ে ডুইঃ বলে—বাঘরায় জিতে গেল।

—কি করে বুঝলে?

—তোমার দাঁড়ানো দেখে। ওই ফুলগুলো পড়ে যাওয়া দেখে।

ছুট্‌কী জানে, বাঘরায় শত চেষ্টাতেও এমন কথা বলতে পারত না—এতটা লক্ষ্যই করত না। সে নিজের আনন্দেই থাকত ভরপুর। ছুটকীর মনের অবস্থা দেখার সময় কই তার?

—তুমি এত বুঝতে পার?

—পারি। সেজন্যে আমার দুঃখ কম নয়।

ছুট্‌কী ম্লান হাসে।

—ছুট্‌কী! তবু তোমার নিজের মুখে একবার শুনতে চাই।

—বুঝতেই তো পার সব।

—তবু নিশ্চিন্ত হতে চাই। চল ছুট্‌কী, আমরা এই বাটালুকা ছেড়ে খাঁড়ি পাহাড়ি ছেড়ে চলে যাই অনেক দূরে—।

—সেকি? দেশ ছেড়ে যাবে? তোমার ওপর যে রাজা ত্রিভন সিং নির্ভর করেন

—তা বটে। ঠিক আছে, দেশেই থাকব। নির্জনে একটা ছোট্ট কুটির তৈরি করব। সাজম, কাদাম, রাইরুই আর মুরৎ গাছ ভীড় করে থাকবে সেই কুটিরের চারদিকে। আলাকজাড়ি বেড়া বেয়ে ওপরে উঠবে। বাগানে ফুল ফুটবে—গাছে গাছে ডাকবে কোল, কিনী, মিরু। মারা পেখম ধরবে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব।

অবাস্তবতার কীট মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ছুট্‌কী জানে এখন আর থামানো যাবে না। সে চেষ্টা করাও বৃথা

—আর কিছু বলবে? নিঃস্পৃহ গলায় বলে ছুট্‌কী।

ডুইঃ অসহায় বোধ করে নিজেকে। ছুট্‌কীর চোখের দিকে চেয়ে দেখে—সে চোখে চাপা হাসির আভাস।

—তুমি রাগ করলে ছুট্‌কী?

—না, রাগ করব কেন? তোমার যা ইচ্ছে তাই তুমি বলেছ। তবে আমি ওসব পছন্দ করিনে। সবাই যদি তাদের বউকে নিয়ে অমন নির্জনে বাসা বাঁধে, তাহলে ধাদকা, পঞ্চসর্দারী আর তিন সওয়া দু’দিনেই সতেরখানিকে ছাড়িয়ে যাবে।

—সতি কথা বলেছ। আমারই ভুল। তুমি আমার পাশে পাশে থেকে এসব ভুল শুধরে দেবে তখন—তাই না ছুট্‌কী?

—ধেৎ, বিধুয়া হেরেল। ওসব কথা আমার মোটেই ভালো লাগে না।

ছুটকী অনেক চেষ্টা করেই ‘বিধায়ু হেরেল’ সম্বোধনটা করল ডুইঃকে। এর পরিণতি সে জানে। ডুইঃএর মতো ভদ্র স্বভাবের পুরুষ হয়তো এর পর আর কথাই বলতে পারবে না। কারণ সম্বোধনটা নিম্নস্তরের। সর্দারের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে ঘৃণা জন্মাবে তার মনে। সে আর ফিরেও তাকাবে না ছুটকী বলে এক মেয়ের দিকে। কিন্তু উপায় নেই। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চলতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। একটি মীমাংসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এর পরে মীমাংসার জন্য আর ভাবতে হবে না তাকে।

ডুইঃএর মুখ ছাইএর মতো সাদা হয়ে যায়। তার পা টলতে থাকে। ছুট্‌কী তাকে ভালোবাসে—এ ধারণা প্রথমে থাকলেও দিনের পর দিন তাতে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তবু একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে উপস্থিত হত সে এই শালবনের ধারে। সে আশাও আজ তিরোহিত হল। এমন সুন্দর মেয়ের মুখে এ ধরনের উক্তি অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় তার কাছে। তবু তা সত্যি।

নিজেকে সামলে নেয় ডুইঃ। সতেরখানি তরখের চার সর্দারের এক সর্দার সে। সামান্য এক মেয়ের জন্যে এতখানি কাতর হয়ে পড়া তার পক্ষে সাজে না। আঘাত যা পেল—সে আঘাত মনেই চেপে রাখতে হবে। যে ঘা এখন থেকে দগদগ করবে মনের ভেতরে, তার নিদারুণ ব্যথা প্রকাশের জন্যে বাইরে আর্তনাদ করার সুযোগ হবে না কখনো। সান্ত্বনা যে এতে একেবারে নেই, তা নয়। সে হারলেও জিতে গেল তারই একমাত্র বন্ধু বাঘরায়—যার জন্যে জীবন দিতে পারে সে। নিজের জীবনকেই যদি দেওয়া যায় ছুীকে কেন পারবে না দিতে? কিন্তু সত্যিই কি তাই? সে উপলব্ধি করে নিজের জীবনের মূল্য নিজের প্রিয় বস্তুর চেয়ে অনেক কম।

—চলি ছুট্‌কী। ম্লান হেসে ডুইঃ বলে—আর কখনো ফুল তুলতে এসে বাড়ি ফিতে তোমার দেরি হবে না। জোর করে গানও শোনাব না।

ধীরে ধীরে শালবনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে ডুইঃ।

হুকীর চোখ জলে ভরে আসে। কিতাডুংরির দিকে চেয়ে সে ভাঙা গলায় বলে—তুমি তো সব জান কিতাপাট। আমাকে ক্ষমা কর। ডুইঃকে সান্ত্বনা দিও। ভুলিয়ে দাও তার আঘাত।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *