কিডনি আকারের পাথর যেটি রোজই চলাফেরা করে
জুনপেইর বয়স যখন মাত্র ১৬ তার বাবা এক চমকপ্রদ ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাপ বেটার শরীরে একই রক্ত প্রবাহিত হলেও তারা দুজন একে অপরের কাছে তাদের মনের দুয়ার মেলে ধরে না।
“সারা জীবনে একজন মানুষের সান্নিধ্যে যে নারীরা আসে তার মধ্যে মাত্র তিনজনের জন্য সত্যিকার অর্থ সে খুঁজে পায়, কমও না বেশিও না।” বলেছিল জুনপেইর বাবা। বরং বলা ভাল ঘোষণা করেছিল। খুব শীতলভাবে কথাটা বললেও প্রচন্ড দৃঢ়তা ছিল তার মধ্যে।
“সম্ভবত তুমি অনেক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে, তবে ভুল নারী পছন্দ করলে বিস্তর সময় নষ্ট হবে তোমার। কথাটা মনে রেখ।” বলেছিল তার বাবা।
পরে জুনপেইর তরুণ হৃদয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল, ওই তিন রমণীর সঙ্গে কী এর মধ্যেই বাবার দেখা হয়েছে? আমার মা কী তার একজন? তা-ই যদি হয়ে থাকে, তবে বাকি দু’জনের কী হয়েছে? কিন্তু বাবাকে সে এসব কথা জিজ্ঞেস করতে পারেনি।
.
১৮ বছর বয়সের সময় জুনপেই টোকিওর একটা কলেজে ভর্তি হয়। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে বেশ ক’জন মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে, যার মধ্যে একজনের জন্য সত্যিকার অর্থ খুঁজে পেয়েছিল। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার (ওটা প্রকাশ করতে অন্য লোকের চেয়ে তার সময় বেশি লাগে) আগেই মেয়েটি তার এক পরম বন্ধুকে বিয়ে করে আর অচিরেই মা হয়। ফলে আপাতত মেয়েটিকে তালিকা থেকে বাদ রাখতে হয়। মনটাকে শক্ত করে সেখান থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয় তার নাম। ফলে তার বাবার তত্ত্ব অনুসারে তার তিন নারীর মধ্যে বাকি থাকে আর দু’জন।
যখনই নতুন কোনো মেয়ের সঙ্গে জুনপেইর দেখা হয়, সে ভাবে সত্যিই কি এই নারী তার জীবনের সত্যিকার কোনো অর্থ রাখে? আর এই প্রশ্ন তার মনে উভয় সংকটের জন্ম দেয়।…
নতুন কোনো মেয়ের সঙ্গে কয়েক মাস থাকার পর তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সে অবহিত হয়, তোক তা তুচ্ছ কিংবা অকিঞ্চিতকর। এসব বেদনা তাকে অসম্ভষ্ট করে বা স্নায়ুকে স্পর্শ করে, হৃদয়ের নিভৃত কোণে সে বেদনা থেকে পরিত্রাণ অনুভব করে। এর ফলে একটার পর একটা মেয়ের সঙ্গে সিদ্ধান্তহীন সম্পর্ক বজায় রাখার একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যায় তার ভেতর।
জুনপেই ঠিক নিশ্চিত নয় তার ওই শক্তি কি তার সহজাত চরিত্র থেকে উৎসারিত না পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে জন্ম নিয়েছে। পরেরটা যদি হয় তাহলে বলতে হয় এটা তার বাবার অভিশাপেরই ফল। কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন নেয়ার সময় বাবার সঙ্গে তার প্রচণ্ড বচসা হয়, আর তার সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অদ্যাবধি ‘তিন নারী তত্ত্বটির পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা সে পায়নি। একটা পর্যায়ে এসে সে হাস্যোচ্ছলেই সমকামীতে পরিণত হওয়ার কথা ভাবে। যাতে সে ওই হাস্যকর উল্টো-গণনার হাত থেকে পরিত্রাণ পায়। ভাল হোক খারাপ হোক মেয়েরাই জুনপেইর একমাত্র যৌনাগ্রহের বিষয়।
.
পরবর্তী যে-মেয়েটার সঙ্গে জুনপেইর মোলাকাত হয় তার বয়স ছিল ওর চেয়ে বেশি। মহিলার বয়স ৩৬, আর ওর ৩১। জুনপেইর এক পরিচিত লোক মধ্য টোকিওর বাইরের দিকের একটা জায়গায় ফরাসি রেস্তোরাঁ খুলেছিল। সে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দাওয়াত হয়েছিল তার। সামার স্পোর্টস জ্যাকেটের সঙ্গে ম্যাচ করে গাঢ় নীল রঙের পেরি এলিস শার্ট গায়ে দিয়েছিল সে। ওই পার্টিতে এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল তার; কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে সাক্ষাৎকার বাতিল করে। ফলে কথা বলার কোনো লোকই সে পাচ্ছিল না। বারে বসে একা সে বড় এক গ্লাস মদ পান করছিল। সে ওখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমন্ত্রণকারী পরিচিত ভদ্রলোককে খুঁজতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। তখনই দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলা সেখানে এসে হাজির হয়। তাকে দেখে জুনপেইর প্রথম ভাবনা ছিল, গর্বিত অঙ্গভঙ্গির এক মেয়ের প্রবেশ ঘটেছে এখানে।
বারের কাউন্টারে কনুই রেখে সে বলল, “এখানকার একজনের কাছে শুনলাম আপনি লেখক। সত্যি নাকি?”
“তা-ই তো মনে হয়।”
“কয়টা বই বেরিয়েছে আপনার?”
“দু’টি গল্প সংকলন আর একটা অনুবাদের। খুব একটা বিক্রি হয়নি অবশ্য।”
জুনপেইকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মৃদু হাসল সে। আপাতদৃষ্টিতে সন্তুষ্ট বলেই মনে হলো তাকে।
“চমৎকার। সত্যিকার কোনো লেখকের সাথে এটাই আমার প্রথম মোলাকাত।” সে বলল।
“আমি হয়ত খানিকটা হতাশ করব আপনাকে,” বলল জুনপেই, “একজন পিয়ানোবাদক আপনাকে সুর বাজিয়ে শোনাতে পারবে, একজন চিত্রকর এঁকে দেখাতে পারবে, কিংবা ধরুন একজন জাদুকর, সে জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করতে পারবে আপনাকে। কিন্তু একজন লেখকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এসব কিছুই করা সম্ভব নয়।”
“সে আমি জানিনে, তবে আমি আপনার মধ্যেকার অলৌকিক আভা কিংবা ওই জাতীয় কিছু একটা উপভোগ করতে পারছি।”
“অলৌকিক আভা?”
“বিশেষ ধরনের আলোর দীপ্তি সাধারণ লোকের ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় না।”
“রোজ শেভ করার সময় আয়নার দিকে তাকাতে হয়; কিন্তু এ ধরনের কিছু তো চোখে পড়েনি আমার।”
সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে, “কী ধরনের গল্প লেখেন আপনি?”
“লোকেরা প্রায়ই এ কথাটা জিজ্ঞেস করে; কিন্তু আমার গল্প নির্দিষ্ট কোনো গোত্রে পড়ে না।” ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে সে বলে, “আমার মনে হচ্ছে আপনি বলতে চাচ্ছেন সাহিত্য পদবাচ্যের গল্প কাহিনী রচনা করেন আপনি।”
“হয়ত তা-ই। এক ধরনের ঘটনার বিবরণমূলক পত্র বলতে পারেন আর কি।”
সে আবার হাসে। জিজ্ঞেস করে, “আপনার নামটা জানতে পারি কি?”
“সাহিত্য পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে আপনার?” সে একটুখানি মাথাটা ঝাঁকায়।
“তাহলে তো আমার নাম জানাটা কষ্টকর। আমি তেমন একটা পরিচিত লেখক নই।”
তার অনুমতি না নিয়েই জুনপেইর পাশের টুলে বসে পড়ে সে। গ্লাসের শেষ পানীয়টুকু গলাধঃকরণ করে বলে, “আমার নাম কিরি।”
জুনপেই অনুমান করে সে ওর চেয়ে ইঞ্চিখানেক কিংবা তার চেয়ে বেশি লম্বা। গায়ের রঙ তামাটে, চুল ছোট, মাথার আকৃতি চমৎকার। বিবর্ণ সবুজ লিনেন জ্যাকেট তার গায়ে, হাত কনুই অবধি গোটানো। হাঁটু সমান স্কার্ট। জ্যাকেটের নিচে পড়েছে সূতির ব্লাউজ। তার স্তন খুব ছোট নয় আবার বড়ও নয়। পোশাকে স্টাইলের প্রবল প্রভাব। সব মিলিয়ে ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে সেখানে। ঠোঁট পুরুষ্টু। কোনো কিছু ভাবার জন্য থামলে তার চওড়া কপালে তিনটি সমান্তরাল ভাঁজ পড়ে। ভাবনা শেষ হলে ভাঁজগুলো থাকে না।
জুনপেই এ ব্যাপারে সচেতন যে, সে তার প্রতি আকৃষ্ট। ব্যাখ্যা করা যায় না তবে খুব অনড় একটা ব্যাপার তাকে উত্তেজিত করে তোলে। হঠাৎই সে খেয়াল করে তার গলা শুকিয়ে গেছে। তখন সে একজন ওয়েটারকে ডেকে খানিকটা মদের অর্ডার দেয়। আর আগের মতো ভাবতে বসে এই মেয়েটি কি তার জীবনে বিশেষ অর্থ বয়ে আনবে। সে কি বাকি দু’জনের একজন? এই মেয়ে কি তার জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ? তাকে কি চলে যেতে দেবে, না ঝুলে পড়বে?”
“আপনি কি সব সময় লেখক হতে চেয়েছেন?” বলল কিরি।
“হু। যা হতে চাই তার বাইরে আর কিছুই ভাবিনি।”
“তাহলে তো বলতেই হয় আপনার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।”
জুনপেই তার হাত প্রসারিত করে বলল, “অবাক কাণ্ড। আমি সব সময়ই। একজন মহৎ লেখক হতে চেয়েছি।”
“তা বয়স কত আপনার?”
জুনপেই যে তার চেয়ে বয়সে ছোট তাতে ওর কিছুই যায় আসে না। জুনপেইও কিছু মনে করে না তাতে। তরুণীদের চেয়ে সে বরং একটু বয়সী মেয়েদের পছন্দ করে। বয়স্কদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করা সহজ।
জুনপেই বলল, “তা কী কাজ করেন আপনি?” এ কথায় তার ঠোঁট সোজা হয়ে এল আর এই প্রথমবারের মতো তার অভিব্যক্তিতে আন্তরিকতা ফুটে উঠল।
“আমি কোন ধরনের কাজ করি বলে আপনার ধারণা?”
জুনপেই তার মদের গ্লাসটি একটুখানি কঁকিয়ে নিয়ে বলল, “সামান্য ইঙ্গিত কি পেতে পারি?”
“না কোনো আভাস দেয়া যাবে না। এটা বলা কি এতো কঠিন? সব কিছু পর্যবেক্ষণ আর বিচার করাই তো আপনার কাজ।”
“ঠিক তা নয়। একজনকে বার বার পর্যবেক্ষণ করতে হয় আর শেষ সম্ভাব্য মুহূর্ত পর্যন্ত বিচার করে যেতে হয়।”
“নিশ্চয়ই। তাহলে পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন তারপর প্রয়োগ করুন আপনার কল্পনাশক্তি। তাহলে তা আপনার পেশার নৈতিকতার সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করবে না।”
জুনপেই তার চোখ তুলে কিরির দিকে তাকাল আর নতুন অভিনিবেশ দিয়ে তার মুখমণ্ডল পরীক্ষা করতে লাগল এই আশায় যে, ওখানে সে কোনো গোপন চিহ্ন পেয়ে যাবে। জুনপেই সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাল। সে-ও তাই করল।
একটুখানি থেমে জুনপেই বলল, “আমার মনে হয় আপনি কোনো ধরনের একজন পেশাজীবী। আপনি যে কাজটি করেন সবার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ওটা করার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতার দরকার পড়ে।”
“ষাঁড়ের চোখ দেখছি! আর একটু বিশদ বলা যায় না?”
“সঙ্গীত বিষয়ক কিছু একটা?”
“না।”
“ফ্যাশন ডিজাইন।”
“হলো না।”
“তাহলে টেনিস?”
“এবারও হলো না।” কিরি বলল।
জুনপেই মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “বেশ। আপনার গায়ের রঙ তামাটে। শক্তপোক্ত শরীরের গড়ন, হাতের মাসলগুলোও খুব দৃঢ়। মনে হয় আউটডোর স্পোর্টস করেন। তবে মনে হয় না আপনি কোনো শ্রমিক।”
কিরি তার হাত দুটো কাউন্টারের ওপর স্থাপন করে বলল, “কাছাকাছি চলে এসেছেন আপনি।”
“কিন্তু ঠিক উত্তরতো দিতে পারিনি এখনো।”
“ছোট কিছু জিনিস গোপন রাখা জরুরি, বলল কিরি, “পেশাগত ফুর্তি থেকে বঞ্চিত রাখতে চাইনে আপনাকে… একটা ইঙ্গিত অবশ্য দেব। আপনার বেলায় এটা আমার জন্যও একই ব্যাপার।”
“একই ব্যাপার কেমন করে?”
“মনে হচ্ছে আমার পেশাটা এমন যা আমি খুব ছোটবেলা থেকেই হতে চেয়েছি। আপনার মতো। তবে ওখানে পৌঁছা খুব সহজ ছিল না আমার জন্য।”
“ভাল। ভাল। সেটা গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। কাজটি হতে হবে ভালবাসার, সুবিধার বিয়ের মতো নয়।”
“ভালবাসার কাজ,” কিরি বলল, “ওটা একটা চমৎকার রূপক বলতে পারেন।”
“আপনার কি মনে হয় আমি আপনার নাম শুনেছি?”
“সম্ভবত না, আমি এতোটা জনপ্রিয় নই।”
“বেশ। সবাইকেই কোথাও-না-কোথাও থেকে শুরু করতে হয়।”
“তবে আমার ব্যাপারটা আপনার থেকে একটু ভিন্ন। শুরু থেকেই আমি পূর্ণ শুদ্ধতা প্রত্যাশা করেছিলাম। কোনো ভুল করার অবকাশ ছিল না। শুদ্ধতা- নাহলে কিছুই না। দ্বিতীয় কোনো চয়েস ছিল না।”
“ওটা তো তাহলে আর একটা ইঙ্গিত।”
কিরি বলল, “হতেও পারে।”
একজন ওয়েটার শ্যাম্পেনের ট্রে হাতে করে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। কিরি দুটো গ্লাস তুলে নিয়ে নিজে একটা নিল আর একটা দিল জুনপেইকে। তারা গ্লাস ঠোকাঠুকি করল। কিরি বলল,”সে যাকগে, আপনি কি বিবাহিত?” জুনপেই মাথা নাড়ল। কিরি তখন বলল, “আমিও বিবাহিত নই।”
.
কিরি জুনপেইর রুমে রাত কাটাল। তারা বিস্তর মদ পান করল। রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হল, তারপর ঘুমাতে গেল। পরের দিন সকাল ১০টায় জুনপেই ঘুম থেকে উঠে দেখল কিরি চলে গেছে। যাবার আগে একটা সংক্ষিপ্ত নোট রেখে গেছে। কাজে যেতে হচ্ছে আমাকে। ইচ্ছে করলে যোগাযোগ করতে পার আমার সঙ্গে। নিচে ওর সেল ফোন নম্বর দিয়েছে।
জুনপেই ওকে ফোন করল আর পরের শনিবার একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার করল দু’জনে মিলে। তারা একটুখানি মদ খেল। জুনপেইর রুমে গিয়ে সঙ্গম করল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে আবার সে চলে গেল। রোববার সত্ত্বেও সে নোটে লিখল, কাজে যেতে হচ্ছে আমাকে।
জুনপেই এখনও জানে না কিরি কী কাজ করে। তবে ওই কাজটি শুরু হয় খুব সকালে। আর মাঝে মধ্যে সে রোববারেও কাজ করে। অনেক বিষয়ে কিরির জ্ঞান। পড়তে সে ভালবাসে। গল্প উপন্যাসের চেয়ে জীবনী, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান আর বিজ্ঞান বিষয়ক বই তার বেশি পছন্দ। বিস্তর তথ্য তার জানা। গৃহনির্মাণ বিষয়ে তার জ্ঞান দেখে তো জুনপেই অবাক। সে বলল, “তুমি কি নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত?” “আরে না না। বাস্তব সম্মত যে কোনো বিষয়ই আমাকে আকর্ষণ করে, এই যা।” সে জুনপেইর দু’খণ্ড গল্পগ্রন্থ পড়ে মন্তব্য করেছে, “চমকর তোমার গল্প। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি আনন্দ আমি পেয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম, যদি তোমার গল্প ভাল না লাগে তাহলে কী বলতাম তোমাকে? কিন্তু ভাবনার কোনো কারণই ঘটল না। ওগুলো পড়ে দারুণ মজা পেয়েছি।”
জুনপেই বলল, “যাক বাঁচালে। খুব ভাল লাগছে তোমার কথা শুনে।”
“শুধু তোমার ভাললাগবার জন্য বলছিনা এ কথা, তোমার ভেতর বিশেষ এক ধরনের উপাদান আছে যা তোমাকে বিশিষ্ট লেখকে পরিণত করেছে। তোমার গল্পগুলো জীবন্ত, শৈলি চমৎকার আর সবচেয়ে বড় কথা ওগুলো খুবই সুষম। এ সব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীত, উপন্যাস কিংবা চিত্রশিল্পের বেলাতেও তা প্রত্যাশা করি আমি। কোনো কিছুর মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে তা আমাকে রীতিমতো অসুস্থ করে তোলে।
“যে কারণে আমি কনসার্টে যাই না আর কোনো উপন্যাসও সচরাচর ছুঁয়ে দেখি না। আমার তো ধারণা তুমি ভবিষ্যতে উপন্যাস লিখবে। তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখকে পরিণত হবে। তবে খানিকটা সময় লাগতে পারে আর কি।”
“না, আমি জন্মগত গল্প লেখক। উপন্যাস আমার মাথায় আসে না।” শুকনো কণ্ঠে বলল জুনপেই।…
বিছানায় শুয়ে আলাপ করছিল তারা। এখন শরৎকাল। দীর্ঘ আর উষ্ণ যৌন : মিলনের পর পোশাক-আশাক খুলে ফেলেছিল তারা। সামনের টেবিলে দু’ গ্লাস মদ রাখা।
“জুনপেই।”
“বলো।”
“তুমি অন্য কারও প্রেমে এখন মত্ত, তাই না? এমন কেউ যাকে ভুলতে পারছ না?”
“হ্যাঁ। তা বলতে পার…”
“বলতে পার কেন? কথাটা তো ষোল আনা সত্যি। মেয়েরা কিন্তু এসব ব্যাপারে খুব সেনসেটিভ। ওর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পার না?”
“না, সমস্যা আছে।”
“এসব সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় কি নেই?”
মাথাটা দ্রুত নাড়িয়ে জুনপেই বলল, “না।”
খানিকটা মদ গলায় ঢেলে কিরি বলল, “ও রকম কেউ কিন্তু আমার নেই। তোমাকে দারুণ পছন্দ করি জুনপেই। তুমি সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছ। তোমার সঙ্গে মিলতে পেরে আমি খুবই সুখী। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, আমি তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। এতে কেমন বোধ করছ? একেবারে দুশ্চিন্তামুক্ত?”
জুনপেই ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে ওই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “সেটা কেন?”
“কেন আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাইতে পারি না?”
“উ হুঁ।”
“তোমার অসুবিধা হবে?”
“একটুখানি।”
“কারও সঙ্গে সিরিয়াস নৈমিত্তিক সম্পর্ক থাকবে না আমার। শুধু তুমি না, কারও সঙ্গেই না। এখন যা করছি তার ওপর মনোনিবেশ করতে চাই। কারও সঙ্গে যদি থাকতাম বা কারও সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকত তাহলে হয়ত এটা করা যেত না।”
একটুখানি ভেবে জুনপেই বলল, “তার মানে তুমি বলতে চাইছ, বিচ্ছিন্ন হতে চাইছ না।”
“হ্যাঁ।”
“বিচ্ছিন্ন হলে তুমি তোমার ব্যালান্স হারাবে, যা তোমার ক্যারিয়ারের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে।”
“তোমার কথা ঠিক।”
“কিন্তু এখনও তুমি বলনি কী কাজ তুমি কর।”
“অনুমান করে নাও।”
“তুমি একটা সিঁধেল চোর।”
“না।” বেশ ফুর্তি নিয়ে জবাব দিল কিরি। বলল, “খুবই সেক্সি তোমার অনুমান। তবে কিনা সিঁধেল চোর এত সকালে কাজে বেরয় না।”
“তাহলে তুমি হিট ম্যান।”
“হিট পারসন বলো। কিন্তু তা-ও না। তোমার অনুমান এমন বিদঘুঁটে কেন?”
“তুমি যা কর তা খুবই বৈধ কাজ।”
“খাঁটি। একেবারে খাঁটি কথা।”
“আন্ডারকভার এজেন্ট?”
“না। আজ থাক তবে এই প্রসঙ্গ। তোমার কাজ নিয়ে আলাপ করি বরং। কী লিখছ আজকাল?”
“কী আর। ছোটগল্প একখানা।”
“কী ধরনের গল্প?”
“এখনও শেষ হয়নি।”
“এখন পর্যন্ত কী ঘটেছে?”
জুনপেই চুপ করে রইল। যে কাজটি চলছে তা নিয়ে নীতিগতভাবে সে কোনো কথা বলে না। গল্পটা যদি সে মুখে বলে আর যদি কোনো কথা বাকি থাকে, তার ধারণা, গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু সকালের শিশিরের মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বিছানায়, আর কিরির চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে। তার মনে হলো, ঠিক আছে কিরিকে বলা যায় গল্পটা। তাছাড়া সে একটুখানি অবকাশও নিচ্ছে গল্প লেখা ফেলে।
“শোন তাহলে। গল্পটা প্রথম পুরুষে বলা। প্রটাগোনিস্ট একটা মেয়ে। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। ইন্টার্নি হিসেবে বড় একটা হাসপাতালে কর্মরত। বিয়ে করেনি, তবে একই হাসপাতালের একজন সার্জনের সঙ্গে প্রেম চলছে। ওই সার্জন ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের কোঠায়, বউ বাচ্চা আছে।”
নায়িকার চেহারা সুরত ভাবার জন্য খানিকটা সময় নিয়ে কিরি বলল, “সে কি সুন্দরী?”
“খুবই আকর্ষণীয়া। তবে তোমার মতো এতো সুন্দরী না।” কিরি জুনপেইর কাঁধে একটা চুমু দিয়ে বলল, “যথার্থ উত্তর দিয়েছ।”
“একদিন সে ছুটি নিল আর একা একা বেড়াতে চলে গেল। তখন ছিল শরৎকাল। একটা চমৎকার অবকাশ যাপন কেন্দ্রে গিয়ে উঠল সে। তারপর ঝরনার পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। পাখি পর্যবেক্ষণের নেশা আছে তার, বিশেষ করে মাছরাঙা তার খুব ভাল লাগে। হাঁটার সময় একটা বিচ্ছিরি পাথর তার চোখে পড়ল। পাথরটি কালো হলেও লালের ছোপ আছে খানিকটা। বেশ মসৃণ আর আকারটাও চমৎকার। তার মনে হলো পাথরটা দেখতে কিডনির মতো। শত হলেও সে তো একজন ডাক্তার। পাথরটা আকার আকৃতি ও পুরুত্বের বিবেচনায় সত্যিকার কিডনির মতো।”
“অতএব পাথরটা তুলে সে তার ঘরে নিয়ে গেল।” জুনপেই বলল, “ঠিক তাই। সে ওটা তার অফিসের কামরায় নিয়ে গেল আর পেপার ওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতে লাগল। জিনিসটা আকার আকৃতি আর ওজনে পেপারওয়েটের মতোই ছিল।”
“হাসপাতালের জন্যও তা উপযুক্ত ছিল, তাই না?” কিরি জিজ্ঞেস করল।
“ঠিক বলেছ। তবে দিন কয়েক পরে অদ্ভুত একটা ব্যাপার তার চোখে পড়ল।” কিরি গল্পের বাকি অংশ শোনার জন্য নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলো। জুনপেই একটু থামল, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে তার শ্রোতাকে উত্যক্ত করার জন্য; কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও ইচ্ছাকৃত ছিল না। গল্পের বাকি অংশ এখনও সে লেখেনি। কাজেই এই স্থানে এসে তাকে থামতে হলো। অচিহ্নিত এই মোড়ে দাঁড়িয়ে সে আশেপাশের এলাকাটা পর্যবেক্ষণ করল আর মস্তিষ্কের ভেতর তা খেলাল। তারপর সে ভাবল কেমন করে গল্পটা এগিয়ে নেয়া যায়।
“প্রতিদিন সকালেই সে পাথরটাকে অন্য একটা জায়গাতে আবিষ্কার করে। সে খুব সুশৃঙ্খল বলে পাথরটা সব সময় একই জায়গায় রাখে; কিন্তু পাথরটা সে কখনো চেয়ারের পাশে, ফুলদানির কিনারায় কিংবা মেঝের ওপর দেখতে পায়। প্রথমে তার মনে হয় স্মৃতি বিভ্রম ঘটেছে তার। কিন্তু তার রুম সব সময় তালা দেয়া থাকে, সেখানে বাইরের কেউ ঢোকে না। নৈশ প্রহরীর কাছে অবশ্য চাবি থাকে একটা; কিন্তু এই হাসপাতালে সে কাজ করছে দীর্ঘ দিন, সে কখনো কারও রুমে ঢোকে না। তাছাড়া একটা পাথর সরিয়ে রাখার জন্য প্রতিরাতে সে কেনই বা রুমে ঢুকবে। যেখানে ঘরের অন্য সব জিনিস যথাস্থানে আছে, কোনো জিনিস এদিক-ওদিক হয়নি বা খোয়া যায়নি। সে দারুণ রকম বিমূঢ় হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? কেন তোমার মনে হয় পাথরটা রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায়?”
কিরি বলল, “কোনো কিছু করা না করার ব্যাপারে কিডনি আকারের পাথরটির নিজস্ব যুক্তি আছে।”
“কী ধরনের যুক্তি থাকতে পারে তার?”
“ওটা নিজেকে নাড়াতে চায়। ধীরে ধীরে, দীর্ঘ সময় ধরে।”
“ভালকথা। সে কেন নিজেকে নাড়াতে চায়?”
কিরি বলল, “তা তো আমি জানি না। তারপর খিলখিল করে হেসে বলল, “হতে পারে সে তার জগতটাকে নাড়াতে চায়।”
“এ রকম বাজে শব্দ-কৌতুক জীবনেও শুনিনি। প্রায় গোঙানির মতো বলল জুনপেই।
“ শোন, তুমি হচ্ছে লেখক। সিদ্ধান্ত কিন্তু তোমাকেই নিতে হবে।”
“লেখার টেবিলে গিয়ে না বসলে আমার এই কাহিনী এগিয়ে নেয়া যাবে না…”
কিরি বলল, “অসুবিধা নেই। অপেক্ষা করব আমি।” সে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটি নিল আর একটুখানি মদ গলায় ঢালল। তারপর বলল, “তবে গল্পটি বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠছে ক্রমে-ক্রমে। কিডনি আকারের পাথরটার কী হয় শেষ পর্যন্ত জানতে চাই আমি।”
সে জুনপেইর দিকে ঘুরলে ওর স্তন যুগল তার শরীরে লেপ্টে যায়। তখন সে খুব নীরবে, গোপন কিছু শেয়ার করার ভঙ্গিমায় ফিস ফিস করে বলে, “একটা কথা কি জান জুনপেই, পৃথিবীতে কোনো কিছু করার জন্য অবশ্যই কোনো কারণ থাকে।”
ঘুমে ঢলে পড়ছিল জুনপেই, ফলে ওই কথার উত্তর দিতে পারল না।
.
পরবর্তী পাঁচদিন জুনপেই বলতে গেলে ঘর থেকেই বেরুল না। নিজের টেবিলে বসে কিডনি আকারের পাথরের গল্পটির বাকি অংশ লিখতে লাগল। কিরি ইতোমধ্যেই আভাস দিয়েছিল যে, পাথরটি ডাক্তারকে ধীরে ধীরে নাড়াতে শুরু করেছে তবে তা করছে খুব স্পষ্টভাবে। সে তার প্রেমিকের সঙ্গে অজ্ঞাত একটি হোটেল কক্ষে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে, যখন সে তার প্রেমিকের পৃষ্ঠদেশের কাছে পৌঁছেছে এবং কিডনির আকার অনুভব করেছে। কিডনি হচ্ছে গোপন সংবাদদাতা যেটাকে সে নিজে তার প্রেমিকের শরীরে লুকিয়ে ফেলেছে। তার হাতের নিচে ওটি পতঙ্গের মতো মোচড়ামুচড়ি করেছে, আর তার কাছে বার্তা পাঠিয়েছে। সে কিডনির সঙ্গে কথা বলেছে আর বার্তা আদান-প্রদান করেছে।
কিডনির মতো দেখতে পাথরটির অস্তিত্ব ডাক্তরের কাছে এখন গা সওয়া হয়ে উঠেছে। সে এটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। হাসপাতালে নিজের রুমে ঢুকেই সে পাথরটা দেখে, হাতে তুলে নেয় আবার যথাস্থানে রেখে দেয়। এটা তার কাছে একটা রুটিনে পরিণত হয়েছে। যতক্ষণ সে রুমে থাকে পাথরটি একটুও নড়াচড়া করে না, সূর্যের নিচে ঘুমন্ত বিড়ালের মতো চুপ হয়ে থাকে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে তালা লাগালেই ওটি নড়াচড়া শুরু করে।
কর্মস্থলে সে যখন অবসরে থাকে পাথরটাকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটার দিকে চোখ রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে, যেন তাকে সম্মোহন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সে অন্যসব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বইপত্র পড়তে পারে না, জিমনেশিয়ামে যাওয়া ছেড়ে দেয়। অন্য সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করে। এক অন্য রকম মানুষে পরিণত হয় সে। খিদে মরে যায়। এমন কি প্রেমিকের উষ্ণ আলিঙ্গন তার ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। আশে পাশে কেউ না থাকলে নিচুস্বরে পাথরের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কিডনির মতো দেখতে পাথরটি এখন তার জীবনের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।….
গল্প লেখার সময় জুনপেই কিরির কথা ভাবে। সে অনুভব করে কিরি (অথবা তার ভেতরকার কিছু) গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; তা নাহলে সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন এমন কিছু লেখার ইচ্ছে তার আদৌ ছিল না। জুনপেই আগে যে স্টোরি লাইনটা মনে-মনে ভেবেছিল তা ছিল আরও বেশি প্রশান্ত, মনস্তাত্ত্বিক। ওখানে পাথরের ঘোরাফেরার কোনো বিষয় ছিল না।
জুনপেই ভাবে ডাক্তার তার বিবাহিত সার্জন প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে। এমন কী সে তাকে ঘৃণা পর্যন্ত করবে। সম্ভবত অবচেতনভাবে সে-ও তাই চাচ্ছে।
পরের দিন সে যখন হাসপাতালে তার রুমে ঢুকল পাথরটি তার টেবিলের ওপর ছিল আর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। যেখানে থাকবার কথা ওখানেই ছিল, আগের মতোই কালো, আগের মতোই দেখতে ঠিক কিডনির মতো।
গল্পটা লেখা শেষ হতেই জুনপেই কিরিকে ফোন করে। সম্ভবত গোটা লেখাই পড়তে চাইবে সে। এক অর্থে গল্পটা রচনার ব্যাপারে ওর অনুপ্রেরণা আছে। কিন্তু ফোনে সে কিরিকে পাচ্ছিল না। রেকর্ডকরা কণ্ঠস্বর বলছে- নম্বরটা চেক করুন তারপর আবার চেষ্টা করুন। জুনপেই বার বার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই তার লাইনে ঢুকতে পারল না। সম্ভবত ওর ফোনে কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে।
জুনপেই বাড়িতেই অবস্থান করল আর কিরির প্রতীক্ষা করতে লাগল। এক মাস গেল, দু মাস গেল, তিন মাস গেল, কিরির সাড়া পাওয়া গেল না। ঋতু পরিবর্তিত হলো, এল নতুন বছর। তার গল্পটি একটা সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো। জুনপেই নিজের নাম আর গল্পটির নাম ‘কিডনি আকারের পাথর যা রোজই চলাফেরা করে’ দিয়ে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপাল যাতে কিরির নজরে আসে আর সে ওর সাথে প্রতিক্রিয়াটা শেয়ার করতে পারে। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না…
ওর জীবনে কিরির অন্তর্ধানের বেদনা ওর কল্পনার চেয়েও অনেক গুণ বেশি ছিল। প্রতিদিনই সে ভাবে আহা এখন যদি কিরি এসে হাজির হয়। জুনপেই ওর হাসি, ওর বচন, ওর স্পর্শ মিস করে। ভাললাগা সঙ্গীত বা সদ্য আসা বই পেয়ে। আগের মতো আনন্দ হয় না তার। সব কিছুই দূরের আর বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়। জুনপেই ভাবে কিরি হয়ত তার জীবনে ২ নম্বর নারী।
.
এরপরে জুনপেইর সঙ্গে কিরির সাক্ষাৎ বসন্তের এক সকালে, যদিও তাকে প্রকৃত সাক্ষাৎ বলে গণ্য করা যাবে না।
সে ছিল ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া একটা ট্যাক্সির ভেতর। ড্রাইভার এফ.এম. ব্যান্ডে রেডিও শুনছিল। রেডিও থেকে কিরির কণ্ঠস্বর ভেসে এল। জুনপেই প্রথমে বুঝতে পারল না ওটা কিরির গলা। তার মনে হচ্ছিল ওটা কিরির মতো কণ্ঠস্বর। পরে যখন আরও শুনল তখন ওর বলার ভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, শিথিল ভঙ্গিমা আর চিন্তার ফাঁকে থেমে যাওয়ার বিশেষ ধরন দেখে বুঝতে পারে এটা কিরি। জুনপেই ড্রাইভারকে ভলিউম বাড়াতে বলল।
এক মহিলা ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল- তার মানে আপনি ছোটবেলা থেকেই উঁচু জায়গা পছন্দ করেন?
“হ্যাঁ। যতদূর মনে পড়ে ওপরে অবস্থানের ব্যাপারটি ভাল লাগে আমার। যত বেশি ওপরে তত বেশি শান্তি। আমাকে কোনো ভবন শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় বাবা-মার সঙ্গে খাচ এ্যাচ করতাম। আমি ছিলাম এক অদ্ভুত ক্ষুদ্র প্রাণী।” অতঃপর দম ফাটানো হাসি।
“আমার ধারণা ওগুলোই আপনার বর্তমান কাজের অনুপ্রেরণা।”
“প্রথমে অবশ্য আমি একটা সিকিউরিটি কোম্পানির অ্যানালিস্ট ছিলাম। তবে আমি জানতাম, ওটা আমার যথার্থ কর্ম নয়। বছর তিনেক পর ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে উঁচু উঁচু ভবনের জানালা সাফ করার কাজ শুরু করি। আমি আসলে সুউচ্চ ভবনের চূড়ায় আরোহণ করে তা সাফাই আর মেরামতির কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো ধরুন পুরুষদের কাজ বলে বিবেচিত। ওরা সহজে কোনো মেয়েকে ওই কাজের অনুমতি দেয় না।”
“সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট থেকে জানালা সাফ- দু’য়ের মধ্যে তো বিস্তর ফারাক?”
“সত্যি কথা যদি বলি, জানালা সাফের কাজ আমার কাছে কম কষ্টের ব্যাপার। পড়ে যাওয়ার কথা যদি ওঠান তাহলে বলতে হয় শেয়ারের দাম পড়ে, আমি পড়ি না।” আবার উচ্চ হাস্য।
“আমার মনে হয় পর্বত আরোহণেও আপনার আগ্রহ আছে।”
“ও ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই বললেই চলে। কয়েকবার সে চেষ্টাও করেছিলাম; কিন্তু আমার জন্য কিছুই ছিল না ওটা। আমার আগ্রহ শুধুমাত্র মনুষ্য নির্মিত দালান কোঠায় যা মাটি থেকে সোজা ওপরের দিকে উঠে যায়। কেন তা আবার জিজ্ঞেস করবেন না যেন…।”
“এখন আপনি জানালা সাফ করার কোম্পানি পরিচালনা করছেন যেটি মেট্রোপলিটান টোকিওর হাইরাইজ ভবনের শীর্ষে কাজ করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।”
“ঠিক তাই।”
একটু পরেই ঘোষিত হলো- এখন শুরু হচ্ছে সঙ্গীতানুষ্ঠান। গান শুরু হলে জুনপেই ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে বলল, “এই মহিলা আসলে করেটা কী?”
“হাইরাইজ ভবনের ওপর থেকে কাছি নামায় তারপর ওটা বেয়ে ওপরে ওঠে। ভারসাম্য রক্ষার জন্য হাতে একটা দণ্ড রাখে। এক ধরনের পারফরমার বলতে পারেন তাকে। ও সব করেই সে আনন্দ পায়। আমি তো ধরুন গ্লাসের এলিভেটরে উঠতে গিয়েই ভয়ে মরি।”
“ওটা কি তার পেশা?” জুনপেই জিজ্ঞেস করে। তখন সে খেয়াল করে তার। গলা শুকিয়ে গেছে, স্বর গেছে বদলে, মনে হচ্ছে অন্য কেউ কথা বলছে।
“হ্যাঁ। আমার অনুমান সে ম্যালা স্পন্সর পায় আর পারফরমেন্স দেখায়। সে। নাকি জার্মানির এক নামকরা গির্জায় ওই পারফরমেন্স দেখিয়েছিল। সে বলে, বড় বড় সব দালানে সে ওটা করতে চায়, কিন্তু অনুমতি পায় না।”
.
“এটার সব চেয়ে মজার দিক হচ্ছে ওপরে উঠলে আপনি মানুষ হিসেবে। পরিবর্তিত হবেন,” কিরি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কাছে বলেছিল, “নিজেকে বদলাতে না পারলে আপনি টিকতে পারবেন না। যখন আমি কোনো উচ্চ স্থানে যাই তখন বাতাস আর আমি ছাড়া ওখানে আর কেউ থাকে না। বাতাস ঢেকে ফেলে আমাকে, ঝকায়। ওরা বুঝতে পারে আমি কে। একই সঙ্গে বাতাসকেও আমি বুঝতে পারি। আমরা একে অপরকে মেনে নেই, গ্রহণ করি আর একসাথে বাঁচার সিদ্ধান্ত নেই। ওই মুহূর্তটাকে আমি যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি পছন্দ করি। না, ভয় করে না আমার। উচ্চ স্থানে একবার পা দিলেই একটা মনোযোগের ভেতর চলে যাই, সকল ভয় কেটে যায়।”
এখন জুনপেই প্রায়ই উঁচু উঁচু ভবনের দিকে তাকায় আর মেয়েদের উড়ে যেতে দেখে। বাতাস আর ওর মাঝখানে কেউ আসতে পারে না। সে প্রচণ্ড ঈর্ষা অনুভব করে। কার প্রতি? বাতাসের প্রতি ঈর্ষা? এই দুনিয়ায় কে আছে যে বাতাসের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়?
জুনপেই আরও কয়েক মাস কিরির প্রতীক্ষায় থাকে। সে দেখতে চায় ওকে। কিডনি আকৃতির পাথর ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায় ওর সাথে। কিন্তু কিরির ফোন আসে না। সে বার বার ডায়াল করেও টেলিফোনে কিরিকে পায় না। গ্রীষ্ম এলে হাল ছেড়ে দেয় জুনপেই। ওর সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছেই হয়ত ওর নেই। কাজেই ওদের সম্পর্কটা নীরবেই ভেঙ্গে যায়, কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়া, অন্য মেয়েদের সাথে যেমন করে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে।
সে কি তিন নারীর একজন ছিল যে তার জীবনে সত্যিকার অর্থ বহন করেছে। প্রশ্নটা নিয়ে ভাবিত হলো সে; কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছুতে পারল না। আমি আরও ছ’ মাস অপেক্ষা করব তার জন্য তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। সে ভাবল।
ছ’টি মাস সে খুব মনোযোগ দিয়ে লেখালেখি করল। বেশ কিছু গল্প লিখে ফেলল সে। নিজের টেবিলে বসে লেখাগুলো ঘষামাজা করার সময় সে ভাবে কিরি সম্ভবত এখন কোনো উঁচু দালানে অবস্থান করছে, তার সঙ্গে আছে বাতাস। আমি এখানে একা একা বসে লিখছি, আর ও আছে ওইখানে, অনেক ওপরে, সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী দড়ি নেই। অভিনিবেশের জগতে পা রাখলেই তার সব ভয়-ডর উবে যায়। তখন সেখানে থাকে সে আর বাতাস। জুনপেই সব সময়ই তার কথাগুলো স্মরণ করে। অনুভব করে কিরির জন্য তার বিশেষ অনুভূতি আছে। অন্য কোনো রমণীর জন্য এ রকম অনুভব করেনি সে। ওটা একটা গভীর আবেগ, স্বচ্ছ রূপরেখা আছে তার, আছে সত্যিকার ওজন। এই আবেগের কী নাম দেবে সে? কোনো কিছু দিয়েই যা বদলাবদলি করা যায় না। কিরিকে জীবনে আর কোনো দিন না দেখলেও এই অনুভব থেকে যাবে আজীবন। তার শরীরের কোনোখানে- হয়ত হাড়ের মজ্জার ভেতরে- তার অনুপস্থিতির অনুভব কোন দিন শেষ হবে না।
বছর শেষ হয়ে গেলে জুনপেই মনস্থির করে। গণনায় তাকে ২ নম্বরে ফেলে। কিরি সেই নারীদের একজন তার জীবনে সত্যিকার অর্থ বহন করেছিল। দু’জনকে ঝেড়ে ফেললে একজনই থাকে।
কিন্তু এখন সে আর ভয় পায় না। সংখ্যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নিজেকে নিজে বলে জুনপেই। উল্টো গণনার আর কোনো মানে নেই। এখন সে জেনেছে, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে অন্য আর একজনকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারা। কখন সেটা করবে তুমি, সব সময়ই এটা প্রথমবার এবং শেষবার।
.
এক সকালে ডাক্তার খেয়াল করল কিডনি আকারের পাথর আর তার টেবিলের ওপর নেই। এবং সে জানে, ওটা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।