কিছু অবাঞ্ছিত শব্দযুগল
কয়েক শতাব্দী আগে যেমন ছিল, আজো একশ’ বছর পরেও, তেমনি অনায়াসে অবলীলাম কিছু কিছু ভুল, নিষ্ঠুর এবং অবিবেচনাপ্রসূত শব্দ, যেগুলো নিঃসন্দেহে নারীবান্ধব নয়, আমরা ক্রমাগত ব্যবহার করে যাচ্ছি। বিশেষ করে সংবাদ পরিবেশনায়। আজ কেবল তেমন তিন জোড়া শব্দ নিয়েই কথা বলব যা সমাজে নারীর অবমূল্যায়নের শুধু পরিচায়ক নয়, আমাদের—বিশেষ করে পুরুষকুলের-সংকীর্ণ ও বিকৃত মূল্যবোধ এবং অসহিষ্ণু ও অসচেতন দৃষ্টিভঙ্গিরও উদাহরণ। এ সম্পর্কে সচেতনশীলতার এবং এই অবাঞ্ছিত শব্দ প্রয়োগের আশু সমাপ্তি দরকার।
কুমারী মাতা :
কুমারী মাতৃত্ব ঘটেছিল যিশুর মাতা মেরীর ক্ষেত্রে-অন্তত ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে তাই লেখা রয়েছে। এছাড়া ‘কুমারী মাতৃত্বের’ নজির খুব একটা দেখা যায় না। আধুনিক কালে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতিতে যদিও কৌমার্য বজায় রেখে সন্তানধারন অন্তত প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব। কিন্তু ফাঁসিতলার ময়নার কুমারী মাতৃত্ব নিয়ে যখন খবরের কাগজে সংবাদ বেরোয়, স্বভাবতই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই সংবাদের গুরুত্ব কতখানি? সৃষ্টির গোড়া থেকে যে প্রক্রিয়া চলে আসছে, সংবাদ হিসেবে খবরের কাগজে স্থান পাবার যোগ্যতা সে কী করে অর্জন করল যদি না “হলুদ সাংবাদিকতা”র মোহ একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে সেখানে? এই সংবাদের নেপথ্য কাহিনী নিরবধি স্থির, এক ও অদ্বিতীয়। একই ঘটনার যুগে যুগে পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ নরনারীর স্বাভাবিক আকর্ষণের পরিণতি হিসেবে এক যুগলের শারীরিক মিলন ঘটেছিল কন্যাটির বিবাহপূর্ব কালে। কিন্তু পুরুষটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অক্ষম হয় অথবা অস্বীকার করে যখন তার প্রেয়সী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ফলে সমাজে “কলঙ্ক” নামক গভীর বোঝা ও ঘৃণা নিয়ে মেয়েটি আখ্যায়িত হয় “কুমারী মাতা” হিসেবে। কিন্তু মেয়েটি তো আসলে কুমারী নয়! সে অবিবাহিত। তার কৌমার্য হরণ করেই যে লাপাত্তা হয়েছে তার প্রেমিক অথবা সাধুবেশে এখন প্রাক্তন অভিজ্ঞতা বেমালুম অস্বীকার করছে সে। ফলে সংবাদ যদি করতেই হয়, সে পুরুষটি প্রেমের নামে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আশ্বাস দিয়ে, বিয়ের লোভ দেখিয়ে কন্যাটির সঙ্গে শরীর শরীর খেলেছিল, তাকে নিয়েই সংবাদ করা উচিত, মেয়েটিকে নিয়ে নয়। কিন্তু তাতো কাগজের কাটতি বাড়াবে না। ফলে লিখতে হয় মেয়েটিকে নিয়েই। আর তা যদি লিখতেই হয়, অন্তত সঠিকভাবে কেন লিখি না আমরা? কেন বলি না তাকে “অবিবাহিতা মা”! “কুমারী মাতা” ব্যবহার খুবই দৃষ্টিকটু যদিও পুনঃ পুন ব্যবহারে কুমারী আর অবিবাহিতার পার্থক্য যেন দ্রুত ঘুচে যাচ্ছে। এমনকি অনেক অভিধানেও এ দুটি শব্দকে অভিন্ন ও সমার্থক হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যদি চিন্তায় চেতনায় ব্যবহারেও এ পার্থক্য যদি ঘুচে যেত তবে কতই না ভালো হত। কিন্তু তাতো ঘটছে না। আমার কথা এই যে আগামী পঞ্চাশ বছরে আমরা অবশ্যই দেখতে পাব অবিবাহিতা মায়েরা আর এদেশে চাঞ্চল্যকর সংবাদ সৃষ্টি করতে পারছে না যেমন করছে না পাশ্চাত্যে। কেননা সেরকম কিছু সাহসী ও স্বাবলম্বী অবিবাহিতা মেয়ে শীঘ্রই এগিয়ে আসবে যারা গর্ব সহকারে তাদের একক পরিচয়েই সন্তানকে পরিচিত করাবে, পিতৃ পরিচয়হীনতা জরায়ুতে বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্ম যেমন রোধ করতে পারে না, শিশুটির বড় হয়ে ওঠা, মানুষ হবার পথেও তা অন্তরায় হতে পারে না। নিজের রক্ত মাংস পুষ্টি দিয়ে দীর্ঘ নটি মাস ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সন্তান মায়েরই সম্পদ। আর পিতা? তার অস্তিত্ব মা স্বীকার করলে আছে— নয়ত নেই।
নারী কেলেঙ্কারি :
সংবাদপত্র খুললেই “নারী কেলেঙ্কারি”তে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা অহরহ চোখে পড়ে। চোখে পড়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও। “নারী কেলেঙ্কারি” বলতে প্রায় সব সময়েই বুঝানো হয় বিবাহ বহির্ভূত কোন যৌন সম্পর্ককে। কিন্তু ঘটনাটিকে “নারী কেলেঙ্কারি” নাম দিয়ে নারী সে সমাজের একটি দুষ্ট গ্রহের মতো অবস্থানে রয়েছে, এবং তার প্রভাব ও সাহচর্য সে কতটা মারাত্মক ও ক্ষতিকর সেটাই প্রকারান্তরে বলা ও বুঝানো হয়। ব্যাপারটিকে “নারী কেলেঙ্কারি” না বলে “যৌন কেলেঙ্কারি” বলতে বাধাটা কোথায়? এখন “নারী কেলেঙ্কারি”র কথা কটি শুনেছেন আপনারা (যদিও তা শোনা অবশ্যই সম্ভব) যেখানে কেলেঙ্কারি (যদি এ ধরনের ঘটনাকে আদৌ কেলেঙ্কারি বলা চলে। আমার মতে অবশ্য দুটি পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্মতিতে যা ঘটে, তা শুধু তাদের দু জনের ব্যাপার। কেলেঙ্কারির কোনো স্থান নেই সেখানে। সমাজের চোখে তা গ্রহণযোগ্য না হলে চোখ বুজে থাকুক সমাজ। ভালোবাসার জয় হোক পৃথিবীতে। কিন্তু এটা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত মত। এর সাথে একমত হতে কাউকে বলছি না আমি) ঘটেছে কেবল নারীতে নারীতে? সেটা যে সম্ভব নয়, একথা বলছি না কিন্তু সংখ্যায় তা খুবই নগণ্য হবে সন্দেহ কি? অবধারিতভাবেই সেখানে সমান অথবা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে একজন পুরুষই। অথচ ঘটনাটি সনাক্ত হবে “নারী কেলেঙ্কারি” হিসেবে। আর সমস্ত নারীকুল মুখ বুজে সহ্য করে যাবে এ অপমান। সেই প্রাচীনকালের মুনি ঋষিদের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে ধারাবাহিক বিশ্বাস সমাজের শিকড়ে গভীরভাবে প্রোথিত যে নারী মানেই উটকো ঝামেলা, নারী মানেই কামনার আগুন, নারী মানেই পরিত্যাজ্য, “প্রলোভন”, “নারী কেলেঙ্কারি” সেই ধারণাকেই নতুন করে উস্কে দেয়। ফলে সংবাদ মাধ্যমের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আজ থেকে সংবাদের পাতায় “নারী কেলেঙ্কারি”তে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আর প্রকাশিত হবে না। যদি কেলেঙ্কারি বলে আখ্যা দিতেই হয় “তথাকথিত অবৈধ সম্পর্ককে, আমরা “যৌন কেলেঙ্কারি” বলেই তাকে আখ্যা দেব।
মেয়েলি ব্যাপার :
“মেয়েলি” শব্দটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে খুব ছোটবেলায়। আমার মার অতি প্রিয় ও পুরনো একখানা গ্রন্থ ছিল। খবরের কাগজ দিয়ে যত্ন করে মলাট দেয়া ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো বাদামি ও ঝুরঝুর ভঙ্গুর হয়ে পড়া জীর্ণ বইখানি অতি যত্নে মা প্রায়শই বহন করে বেড়াত। শুধু ঘরে নয়, পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতেও ঐ বইখানি মাকে ব্যবহার করতে দেখেছি। আশেপাশের আর কারো বাড়িতে ওরকম দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ ছিল না বলে আমার মায়ের এ বইখানির কদর ছিল খুবই বেশি। বইটির নাম, “মেয়েলি ব্রতকথা”। কতরকম ব্রতের যে কাহিনী বর্ণিত ছিল সেখানে সব আজ আর মনে পড়ে না। যমপুকুরের ব্রত, তারা ব্রত, জন্মত্রয়োতীর ব্রত, নাটাই মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত, আরো কত কী! এইসব কাহিনীতে থাকত, কেমন করে গৃহবধূর গভীর ত্যাগ তিতিক্ষা, বিশেষত ঐ বিশেষ ব্রতটির নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মিত পালন গৃহের কল্যাণ ও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। মাকে তখন মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, অন্য মায়েরা তো এত ব্রত করে না! তারাও তো সকলে ভালো আছে! আমার মাকে কেন এত ব্ৰত করতে হয়? কেন থাকতে হয় উপোস সপ্তাহে দু-তিন দিন। মা হেসে সরলভাবে যা বলতো তার অর্থ হল, কোন ব্রতটা করতেই হবে, কোনটা না করলেও চলে সেটা নির্ণয় করা বড়ই কঠিন। ফলে যতটা সম্ভব সব কিছুই করতে চায় মা পরিবারের কল্যাণের জন্যে। বলা তো যায় না। বাড়তি কল্যাণ যদি তাতে নাও আসে, ক্ষতি তো কিছু হবে না! এ যেন এ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ওপর হোমিওপ্যাথি খাওয়ালো। উপকার যদি না হয়, অপকার তো কিছু হবে না! অথবা চাঁদাবাজদের দৌরাত্মের কাছে পুরোপুরি আত্ম সমর্পণ। কাকে দিতেই হবে চাঁদা, কে না দিলে প্রাণে মেরে ফেলবে, কাকে অগ্রাহ্য করা যাবে, কে মোটামুটি নিরাপদ তা যেহেতু নানা সেই, চাঁদা চাইলেই দিয়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আজ বুঝি, আমার মা তেমনি চাঁদাবাজদের ধোঁকাতেই পড়েছিল। সেটা কমবেশি তখনো বুঝতাম। বাবার সঙ্গে এ ব্যাপারে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসেছিও আমরা। কিন্তু যে জিনিসটি তখন বুঝি নি অথবা মনে আসে নি, তাহলো, পরিবারের মঙ্গলের জন্যে ব্রতকথা কেন কেবলই “মেয়েলি” হতে হবে? “পুরুষালি” ব্রতকথার অস্তিত্ব কেন নেই? তাহলে কি পরিবারের কল্যাণ ও মঙ্গলের সকল দায়িত্ব শুধু মেয়েদেরই তা না হলে পুরুষদের ব্রত করতে হয় না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি অনেক পরে, যখন গভীরভাবে ভেবে দেখেছি “মেয়েলি” শব্দটির প্রয়োগ হয় কোথায় এবং কীভাবে। এই শব্দটিকে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ১. প্রথমত পরিবার, প্রতিবেশী অথবা বন্ধুর সঙ্গে কলহে নারীর ভূমিকা বা অবস্থান বুঝাতে—নিন্দার্থে। কিংবা নারীতে নারীতে একান্তে কথোপকথ বা ভাব বিনিময়কে ব্যঙ্গ করে। ২. দ্বিতীয়ত কিছু লোকাচার বিশেষ করে অনুষ্ঠানদিতে কোন কোন গৌণ কর্মকাণ্ড বোঝাতে। ৩. তৃতীয়ত ও মূলতঃ “মেয়েলী” শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকে মেয়েদের শারীরিক ব্যাপার বা সমস্যা বোঝাতে। যেমন, মাসিক, গর্ভধারণ, গর্ভপাত, প্রসব, স্তন্যদান, স্তন বা জরায়ুর অসুখবিসুখ, গর্ভরোধের প্রক্রিয়া। মানব জীবনের তথা সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোকে “মেয়েলি” বলে আখ্যায়িত করে পুরুষ এইসব জরুরি ও মৌলিক বিষয়গুলো থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তার নিজস্ব দায় দায়িত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে বরাবর। গর্ভধারণ ও স্তন্যদান কেবল নারীদেহে সম্ভব এ সত্য এই ব্যাপারগুলোকে একান্ত “মেয়েলি” করে দিতে পারে না। কেননা যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী দেহে এ ঘটনাগুলো সঞ্চারিত হয়, তাতে পুরুষের ভূমিকা থাকে প্রধান—প্রধান না হলেও অন্তত সক্ষম সমান। ফলে “মেয়েলি ব্যাপার” বলে সৃষ্টির এই মৌলিক সোপানগুলো উত্তরণের ভার একা মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সুবিধাবাদ ও দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়। উন্নত দেশগুলোতে একটি গর্ভবতী মেয়ে যখন প্রাকৃতিক প্রসবের ব্যাপারে নিজেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত করার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে ক্লাশে যায়, তার সাথে এক হাতে একটি বালিশ আরেকহাতে গর্ভবর্তী সঙ্গিনীর হাত ধরে পাশাপাশি যায় তার স্বামী বা প্রেমিক। সন্তান জন্মের সময়েও সে থাকে লেবার রুমে, এমন কি প্রসব কক্ষে। ফলে সন্তান জন্মের মতো একটি আনন্দকর ও উত্তেজনাকর মুহূর্ত যৌথ অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে আজ। সন্তানের জন্ম দিতে মেয়েদের যে ভয়ঙ্কর শারীরিক কষ্ট হয়, এটা সবটা সময় সামনে থেকে দেখার পর মেয়েদের প্রতি সম্মান ও দরদও বাড়ে পুরুষের। এছাড়া গর্ভপাতে (ইচ্ছাকৃত বা প্রাকৃতিক), স্তন্যদানে পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি নির্বাচনেও পুরুষ সঙ্গিটি নারীকে সহযোগিতা করে। তাই পাশ্চাত্যে এগুলো আর “মেয়েলি” ব্যাপার নেই। মানবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে এ উত্তরণটা ঘটে নি। এর সরাসরি কুফল আমরা দেখতে পাই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমাদের দেশ কিছু কিছু দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও মাতৃত্বজনিত মৃত্যুতে আমরা এখনো ভয়ানক ভাবে পিছিয়ে রয়েছি। নবজাতক ও শিশু মৃত্যুর হার গত বিশ বছরে অনেক কমে গিয়েছে আমাদের দেশে। পরিবার পরিকল্পনার সাফল্য তো সর্বজনবিদিতই। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে বেশ খানিকটা। কিন্তু এখনো প্রসব করতে গিয়ে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে তিনটি মেয়ে মারা যাচ্ছে আমাদের দেশে। বছরে মারা যাচ্ছে আঠাশ হাজার। আমাদের মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার ইউরোপের দেশগুলো থেকে একশ’ গুণ বেশি। এমনকি প্রতিবেশি দেশ শ্রীলঙ্কা অথবা দক্ষিণ ভারত থেকেও পাঁচ ছয়গুণ বেশি। আশেপাশের দেশগুলোর মধ্যে আরেকটি যে দেশে মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হার আমাদের মতোই অথবা আমাদের চাইতেও কোনো কোনো অঞ্চলে বেশি, সে দেশটির নাম পাকিস্তান। আর্থিক অবস্থা তাদের অপেক্ষাকৃত ভালো হওয়া সত্ত্বেও সে সমাজে নারীর অবস্থানের কথা আমরা সকলেই জানি। আর তাই অবাক হই না যখন মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর হারকে আজ একটি জাতির উন্নয়ন তথা নারীর অবস্থানের মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের দেশে এত বেশি হবার অন্যতম বড় কারণ “মেয়েলি ব্যাপার” বলে শাশুড়ি ও দাই জটিলতা টের পাবার পরও প্রসূতি নারীটিকে ঠিক সময় হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা ভাবে না বা নেবার গুরুত্বটা বুঝতে পারে না। স্বামী বা শ্বশুরও “মেয়েলি ব্যাপার” বলে বিবেচনার ভারটা হয় ছেড়ে দেয় গৃহের উপস্থিত নারীদের হাতে, অথবা নিজেদের হাতে তুলে নিলেও শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পুরুষ ডাক্তারের কাছে কুলবধূর প্রসবের চিন্তাটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে না। এই “মেয়েলি ব্যাপার” এর কারণেই বহু মেয়ের মৃত্যু হয় গোপনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে, জরায়ু ও স্তন ও ডিম্বাশয়ের অসুখ চেপে রেখে। “মেয়েলি ব্যাপার” বলে যত হেলাফেলাই করা যাক না কেন, মনে রাখতে হবে একটি মায়ের মৃত্যু কিন্তু শুধু একটি “মেয়েলি” মৃত্যু নয়। মতলবের একটি বৃহৎ গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে যে প্রসবের সময় যেসব মা মারা যায় তাদের সন্তানরা যদি জীবিত অবস্থায় জন্ম গ্রহণও করে চারভাগের তিনভাগ বাচ্চাই জন্মের প্রথম বছরের মধ্যেই মারা যায়। এছাড়া অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে পরিবারে বাবা মারা গেলে দশ বছরের অনুর্ধ শিশুদের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ছয়টি করে বেড়ে যায়। কিন্তু পরিবারে মা মারা গেলে দশ বছরের নীচে ছেলেদের মৃত্যুর হার বাড়ে এক হাজারে ৫০টি ও আর দশ বছরের নীচের মেয়েদের মৃত্যুর হার বাড়ে এক হাজারে ১৪৪টি। এছাড়া বাচ্চাদের স্বাস্থ্য পুষ্টি, পড়াশুনা, স্বামীর কাজে উপস্থিতির হার, কাজের উন্নতি সবকিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সংসারে হঠাৎ করে মায়ের মৃত্যু ঘটলে। “মেয়েলি” ব্যাপার বলে আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রসব এবং অসুখ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে ক্রমাগত অবহেলা করার কারণেই উন্নতদেশগুলোতে মেয়েদের গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে আজো তা পুরুষদের চেয়ে নীচে।
সবশেষে তাই বলব, কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া “কুমারী মাতৃত্বের” মতো আজব ঘটনা সোনার পাথর বাটির মতই অবাস্তব ব্যাপার। তেমনি “নারী কেলেঙ্কারি” ও “মেয়েলি ব্যাপার” এর অস্তিত্বও শুধুমাত্র টিকে রয়েছে পৌরুষবাদের অমানবিক দাপটে, নারীর অসচেতনতায় ও সমাজের নারীর প্রতি সামগ্রিক অবমূল্যায়নে। ভবিষ্যতে এই তিনটি শব্দ যুগলের ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে এই আশা। তবে নারীর প্রতি অসংবেদনশীল ও অপমানকর শব্দ প্রয়োগ, মন্তব্য বা কটাক্ষ কেবল এই তিন শব্দযুগলেই সীমাবদ্ধ নয়। এরকম রয়েছে আরো বহু শব্দ ও বাক্যবন্ধন যা সর্বাংশে পরিত্যাজ্য ও অবাঞ্ছিত বলে বিবেচিত হবে পুরুষ-নারী উভয়ের কাছেই, এটাই প্রত্যাশা।