কিছুক্ষণ
-তুমি কি রাজনীতি কর?
-কেন?
-না তোমার দাড়ি দেখে মনে হচ্ছে।
-দাড়ি রাখা কি খারাপ?
– তা না, তবে প্রথমদিন কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে এলে দাড়ি কেটেই আসা উচিত।
-তাই নাকি? তা কটা ছেলের সাথে দেখা করেছ শুনি?
-তুমি তিন নম্বর। কি হল মুখটা ঝুলে গেল কেন?
– ইয়ে না মনে সেটা তো বলনি?
-বলার কি আছে? তুমি যে আঁতেলদের মত দাড়ি নিয়ে এসছ সেটা নিয়ে বলি তবে? ফেসবুকে ফটো দেখে তো মনে হচ্ছিল দুর্গাপুত্র কার্ত্তিক পুরো। তা না কোত্থেকে এক গাল দাড়ি নিয়ে চলে এসছে।
-তা তুমি যে আগের দুবার এসছিলে কার কার সাথে দেখা করেছিলে?
– দুটোই ঢ্যাঁড়শ। একটা ঋদ্ধি ব্যানার্জি যে শখের কবিতা লেখে আরেকজন তমাল শূর। একটাকে দাদা আরেকটাকে ভাই পাতিয়ে নিয়েছি। কবিতা টবিতায় বাপু আমার অ্যালার্জি আছে।
-ও।
-অ্যাই তুমি কবিতা লেখ না তো?
– না। একেবারেই না। ছোটবেলায় লিখতাম।
-লিখতে? যাঃ।
-যাঃ কেন?
-তারমানে ভবিষ্যতে লেখার চান্স আছে!
-না না, তোমার মত মেয়ে দেখলে কেউ কবিতা লেখে?
-মানে? মানেটা কি? আমার মত মেয়ে মানে কি?
-না মানে তোমাকে দেখেও তো বোঝা যায় একদম কঠিন কঠোর গদ্য পুরো, কবিতার কোন চান্সই নেই।
-হুম। তা কি ভেবেছিলে শুনি আমার ব্যাপারে?
– তোমায় তো সেরকম লাগেনি। মিষ্টি মিষ্টি ছবি শেয়ার করতে, রোম্যান্টিক গান কোট করতে, ভাবতেই পারিনি যে তুমি এত কাঠখোট্টা টাইপ বেরবে।
– ও আচ্ছা। ঠিক আছে। তা এখানে দাঁড় করিয়ে রাখবে না কোথাও বসবে?
-না চল ওই ওখানটা গিয়ে বসি?
-এমা না।
-কেন?
-ওদিকটা দেখছ না সব চুমু টুমু খাচ্ছে? ওদিকে যাব না।
-উফ, এত মহা বিপদে পড়া গেল। চল তাহলে ওই চায়ের দোকানটা গিয়ে বসি।
-হ্যা চল।
-হ্যা এবার বল।
-আমি কিন্তু চা খাই না। কফি খাই।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তুমি তো চাকরি কর না?
-হ্যা। ক্লারিকাল পোষ্ট।
-ও তারমানে মাইনে কড়ি সেরকম পাও না?
-ওই চলে যায় ছোট সংসার।
-কে কে আছে তোমার ছোট সংসারে?
-মা, দিদি আর আমি।
-দিদির বিয়ে হয়নি?
-হ্যা, সামনের এপ্রিলে, সব ঠিক হয়েই আছে।
-সেকি, সেটা তো বলনি?
-সব কথা ফেসবুকে বলা যায় নাকি? আচ্ছা তুমি আমায় এত প্রশ্ন করছ কেন? আমার প্রেমে পড়লে নাকি?
-তোমার প্রেমে। ফুঃ। পাগল নাকি?
-অ। তা ভাই বেরাদার বানানোর ধান্দা করছ নাকি? আমি কিন্তু নেই তাহলে। ভাই বানিয়ে গিফট বাগানোর চেষ্টা করলে আমি ওয়াক আউট করব।
-বাঃ। তুমি তো বেশ মজার কথা বল। গুড সেন্স অফ হিউমার।
-হুম। তোমার জীবনে প্রেম ছিল এর আগে?
-আমার বয়স প্রায় তেইশ হতে চলল। এম এ সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা দেব। তার ওপরে দেখতে সুন্দরী। আমার প্রেমিক থাকবে না তো কার থাকবে?
-ক’জন?
-ওই খান তিনেক ছিল। প্রথমটা ক্লাস সেভেনে ছিল। পাড়ার ম্যাথসের টিচারের কাছে পড়তে আসত। আমি বাড়ি থেকে বেরোলে দাঁড়িয়ে থাকত। পাশাপাশি বসতাম। মাধ্যমিক অবধি চলল। তারপর ছেলেটা যখন ব্যাক পেল ওই অঙ্কেই আমি ছেড়ে দিলাম। ফেল করা ছেলে আমার দুচোখের বিষ।
-বাহ বেশ তো। ছেলেটার তোমার জন্য পড়াশুনা নষ্ট হল, আর তুমিই ওকে ছেড়ে দিলে?
-কে বলল আমার জন্য নষ্ট হল। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া টাইপ ছেলে ছিল। স্কুলের সেক্রেটারি ছিল ওর বাবা। প্রতি ক্লাসে ফেল করলেও টিচাররা তুলে দিত। মাধ্যমিকে আর কে তুলবে? ব্যাক পেয়ে গেল।
-অ। আর বাকি দুজন?
-ক্লাস টুয়েলভ থেকে বি এ সেকেন্ড ইয়ার একজন। আমার ফিলসফি টিচার। ওর বাড়িতে গিয়ে পড়তাম। একদিন দোলের দিন বিকেলে গেছি। আমার মুখে রঙ দিয়ে দিল। সেই আমার শরীরে প্রথম কোন পুরুষ হাত দিল।
-তারপর?
-এত উত্তেজিত হবার কিছু নেই। গল্পের নায়িকা ভার্জিন হতে হবে এটা তোমার মিড এইট্টিজের বাংলা আর হিন্দি সিনেমায় হত। হ্যা। উই ডিড হ্যাভ সেক্স। ওর বাড়িতে কেউ ছিল না। হয়ে গেল। তারপর ও চাকরি পেয়ে স্টেটসে চলে গেল। তারপর কোন যোগাযোগ নেই।
-হুম। তারমানে ওই সেক্সটা করার জন্যই প্রেম করেছিল।
-জানিনা। আমি ওরকম টাইপ মেয়ে নই যে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে আমার সকল নিয়ে চলে গেল। এক মাস মন খারাপ ছিল। মনটা এই জন্যই খারাপ ছিল যে সে ব্যাটা আমাকে এত ইমোশনালি ঠকিয়ে গেল। যদি সেক্স করতেই হত, সোনাগাছি যা। কেন প্রেমের নামে এই ফ্রডগুলি করলি? যাকগে, তার ছ’মাস বাদে এক চ্যাংড়া প্রোফেসর প্রেম নিবেদন করল। প্রথম প্রথম ন্যাকা ন্যাকা কথা বলত। তারপর একদিন সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে বুকে হাত দিতে গেল।
-তারপর?
-তারপর আমি ভদ্রভাবে বললাম, এসব করতে গেলে চাঁদ, বিয়ের পর কোর। জিজ্ঞেস করল কেন। আমি সব বললাম জীবনে দ্বিতীয়বার চার অক্ষরের বোকা হতে রাজি নই।
-হা হা।
-হ্যাঁ। পরে আমারও হাসি পেয়েছে। কিন্তু তখন সিরিয়াস ছিলাম। আমার এইসব কথা দেখে ব্যাটা ঘাবড়ে গেল। এড়িয়ে এড়িয়ে চলল।আমিও বুঝে গেলাম ব্যাটা ভেড়ার বাচ্চা।
-উফ। তোমার মত মেয়ে আমি জীবনে একটাও দেখিনি। তোমার প্রেমে পরে গেলাম।
-ওই ডিশিসানটা আমি দেব। সেরকমই কথা হয়েছিল।
– হ্যাঁ। তারপর দুই ফেসবুক পুঙ্গবের গল্পটা বল।
-গল্প আর কি। ফেসবুকটা হল যত মেয়েবাজ ছেলেদের আড্ডা। কয়েকটা তো আবার দেখলাম রীতিমত বিবাহিত লোক কুমার সেজে গল্প করে বেরোচ্ছে। তা ওই ঋদ্ধি আমায় কবিতা মেসেজ করত। কয়েকটা রবি ঠাকুরের কবিতা কয়েকটা জীবনানন্দের কবিতাও পোষ্টও করত। ভাবত আমি বুঝি কিছুই বুঝি না। আমিও ন্যাকা ন্যাকা ভাবে উত্তর দিতাম, মেনি থ্যাঙ্কস ইত্যাদি।
-সে সেটা তুমি ভালই পারো।
-শাট ডাউন। আগে আমায় বলতে দাও। যখন দেখা করতে এল সামনে বসে খালি সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে আর কি সব নাম আউড়ে যাচ্ছে। কবে রবীন্দ্রনাথ বউদির সাথে শুয়েছিল কি করেছিল এসব।
-উফ… যাতা।
-হ্যাঁ। ওসব শুনে আমার আক্কেল গুরুম। বললাম, ভাই আমার না কোন দাদা নেই। আপনাকে দেখে আমার দাদা বলতে ইচ্ছে করছে। সে তো বিষম টিসম খেয়ে একাকার। আমিও বললাম বাড়িতে মা পাটিসাপটা বানাবে, সাহায্য করতে হবে, বলে কেটে পড়লাম। ফেসবুকে অন হলে এখন আর বেশি ভাটায়না মালটা।
-আর সেকেন্ড জন। কি নাম যেন বলেছিলে?
-তমাল। তমাল শূর। ইঞ্জিনিয়ার। ব্যাটা ভালই ছিল। চাকরিও পেয়েছিল বাইরে। আমি যখন বললাম আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাব না তখন দেখলাম মিইয়ে গেল।
-ও তার মানে ওকে পছন্দ ছিল?
-হিংসা হচ্ছে? না পছন্দ সেরকম ছিল না। আমার থেকে বড় বেশি হাই ফাই হয়ে যাচ্ছিল। একটু কম্প্যাটিবল না হলে হয়? বড়লোক বাড়ির ছেলে। এদিক সেদিক দেখে চাপ নিলাম না। ভাই বানিয়ে ফেললাম। আমি কিন্তু চিনি কম বেশি খাই। আড়াই চামচ দাও।
-বাব্বা। এত চিনি খাও কেন? সুগার হবে তো?
-লোকজন বলছে আমার মধ্যে মিষ্টত্ব কমে যাচ্ছে। তাই একটু ট্রাই করছি আর কি।
-তা তোমায় ফটো দেখে আর কথা বলার আগে কিন্তু বুঝি নি যে তুমি রামগোপাল বর্মা কি আগ।
-হিহি। আমি কিন্তু একটু পাগলিও আছি জানো? বৃষ্টিতে ভিজি পাগলের মত।
-সেকি? শীতকালেও?
-অতটা স্ক্রুও ঢিলা নেই। খুব গরম টরম পড়ার পর যখন ঝুম বৃষ্টি নামে তখন ভিজি।
-এটা কিন্তু কমন কেস। মেয়েরা তো আসলে ছেলেদের থেকে একটু আঁতেল বেশি হয়। ওই বৃষ্টি ট্রিস্টি পড়লে অনেক সিনেমাতেও দেখা যায় হাত ফাত ছড়িয়ে ভিজছে।
-সে হতে পারে। ওটা সিনেমাতেই দেখবে। ম্যাক্সিমাম বৃষ্টি হলে জানলা দিয়ে হাত বের করে। ঝুম হয়ে ভেজে বেশি না। যারা ভেজে তারাই পাগলী।
-সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রহ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম্ ইভ কাটাব জীবন
-বাব্বা। চমকে দিলে একেবারে। একেবারে জয় গোঁসাই আউড়ে দিলে যে! তোমায় দেখলে তো মনে হয় না পেটে পেটে এত।
-হ্যাঁ ওই আর কি। একটু আধটু চর্চা করতাম। তোমার তো আবার এ সব পছন্দ না।
-ব্যাপারটা হল আমি নিজে কবিতা পড়ি কিন্তু ওই দাড়ি রেখে, ব্রণ রেখে, ঝুল পাঞ্জাবী পরা কবি আমি এক্কেবারে দেখতে পারি না। কিন্তু তোমার মত এই যে সাধারন সাজপোশাকের লোকজন দুম দাম এত সুন্দর আবৃত্তি করে দিলে আমার বেশ লাগে। তবে ওই দাড়িটা কেটে আসবে নেক্সট দিন।
-তারমানে আবার দেখা হচ্ছে নেক্সট দিন?
-চিন্তা করে দেখলাম দেখা করাই যায়। তবে এখনও চিন্তা ভাবনা কোর না। আমি কিন্তু ভার্জিন না সেটাও মনে রেখ। বুঝলে মিস্টার সায়ন্তন দত্ত?
-সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিলাম।
-আচ্ছা, সেদিনও “রাষ্ট্রে” একটা কবিতা পড়লাম যেন সায়ন্তন দত্তের, বেশ দারুণ অন্যরকম কবিতা। আমার এতক্ষণ মনে হচ্ছিল না। তুমি ব্যাটা সেই সায়ন্তন নও তো?
-ওই একটা লিখে পাঠিয়েছিলাম বেরিয়ে গেছে দেখলাম।
-ওহ গুরু। যা তা তো। আমি তবে একজন উঠতি নামকরা কবির সাথে এতক্ষণ ভাটালাম। কিন্তু ফেসবুকে এসবের উল্লেখ করনি কেন? একটা কবিতা “রাষ্ট্রে” বেরোলে তো পাবলিক যত লোক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে সবাইকে ট্যাগ করা শুরু করে, পারলে রিক্সা করে মাইক নিয়ে বেরোয়। সেটা করলে না কেন? আমার না কেমন একটা লাগছে। ঈশ তোমাকে অনেক কিছু বলে দিয়েছি। সরি সরি।আর তখন যে বললে কবিতা লেখ না?
-হা হা। ঠিক আছে। তোমার জন্য সব কিছুই করা যায়।তুমি যেরকম কবিদের উপর ক্ষেপে ছিলে তাতে আর বেশি রিস্ক নিইনি। আমি দাড়িটা রেখেছিলাম ওই কবি লুকসটা আনার জন্যই কিন্তু যা বুঝলাম ওটায় আমায় মানায় না। আর ফেসবুকে প্রচারটা আমার ঠিক ভাল লাগে না। ওটা থাক।
-একটা ফ্যান পেজও তো আছে তোমার। প্রায় এক দেড় হাজার মেম্বার। দিনে দিনে সংখ্যাটা বাড়ছে।
-আমি ওই মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে আসি কে কি বলছে। মন টন খারাপ থাকলে ওটা দেখে ভাল হয়ে যায়।
-আচ্ছা, তাহলে আজ আমি আসি?
-কোথায় যাবে?
-বাড়ি যাই।
-কেন? মা পুলিপিঠে বানাবে? সাহায্য করতে হবে?
-ঈশ, তোমায় সরি আপনাকে কত কিছু বলেছি। খুব খারাপ লাগছে।
-বাঃ, লজ্জা পেলে তোমাকে তো চমৎকার লাগে।
-দূর।আমি যাই…
-আরে, আরে, পালাচ্ছ কোথায়? শুনেই যাও না,এই মেয়ে, এই পাগলী..