কিউকিলা ও দস্যু বনহুর
দৈত্যরাজ কিউকিলা তার বিরাট দেহ নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে শহরের দিকে। তেলের পিপের মত মাথাটির উপর ষ্টীমারের সার্চলাইটের মত চোখটা যেন আগুন ছড়াচ্ছে। যে। পথ দিয়ে কিউকিলা অগ্রসর হচ্ছিলো সেই পথের দু’পাশের বড় বড় দালান-কোঠাগুলো খেলুনা ঘরবাড়ির মত কিউকিলার পায়ের তলায় থেতলে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিলো। নিদ্রায় অচেতন নগরবাসিগণ কিউকিলার পায়ের চাপে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ছিলো। কেউ কেউ বা অর্ধমৃত অবস্থায় আর্তনাদ করে ছুটে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলো কিন্তু পালাতে সক্ষম হচ্ছিলো না তারা। কিউকিলা তাদের ধরে ফেলছিলো এবং রক্তপায়ী বাদুড়ের মত তাদের বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছিলো।
ভয়ঙ্কর কিউকিলার কবল থেকে কারো রক্ষা নেই।
গভীর রাতের নিস্তব্ধতার বুকে জেগে উঠছিলো এক মর্মভেদী আর্তচিৎকার।
ঘুম ভেঙে যায় বনহুরের, সে দ্রুত শয্যায় উঠে বসে।
এমন সময় রহমান শশব্যস্তে ছুটে আসে বনহুরের শয্যার পাশে–সর্দার, সর্দার, কিউকিলা শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে…..কিউকিলা শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে…..
বনহুর বলে উঠলো–আমিও ঐ রকম অনুমান করছি রহমান।
সর্দার, ঐ শুনুন জনগণের করুণ আর্তচিৎকার!
বনহুর ততক্ষণে শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঝাঁম সর্দার দলবল নিয়ে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর রহমানের পাশে। সকলেরই চোখেমুখে এক ভয়ঙ্কর উদ্বিগ্নতার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ব্যস্তকণ্ঠে বললো ঝাঁম সর্দার– হুজুর, হুজুর……কিউকিলা, কিউকিলা….আর বিলম্ব নেই….এসে পড়েছে, কিউকিলা এসে পড়েছে…..হুজুর, এখন উপায় কি?
বনহুর গম্ভীর হয়ে একটু চিন্তা করলো, পরক্ষণেই ঝাঁম সর্দারকে উদ্দেশ্য করে বললো, সর্দার, তুমি তোমার দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাও। বিষমাখা তীর নিয়ে সবাই প্রস্তুত হয়ে থেকো, কিউকিলাকে দেখামাত্র দূর থেকে অবিরত তীর নিক্ষেপ করবে ঠিক তার কপালে চক্ষুটা লক্ষ্য করে। যাও, বিলম্ব করো না।
রহমান বলে উঠলো–এইদিকেই কিউকিলা আসছে বলে মনে হচ্ছে। ঐ যে দালান-কোঠা ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, তার সঙ্গে মানুষের আর্তচিৎকারও ভেসে আসছে।
বনহুর দ্রুতহস্তে ড্রেস পরে নিলো।
বাইনোকুলার আর রিভলভার নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো–রহমান, আমাকে অনুসরণ করো।
ততক্ষণে ঝাঁম সর্দার দলবল নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেছে সেখান থেকে।
রহমান বনহুরের সঙ্গে এগিয়ে চললো।
ঘাঁটির বাইরে আসতেই নজরে পড়লো তাদের দৈত্যরাজের মত জমকালো একটা বিরাট দেহ সম্মুখে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তে বুঝে নিলো, কিউকিলা এবার একেবারে নিকটে এসে পড়েছে।
বনহুর রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–শীগ্গির মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো রহমান……নিজেও সে দ্রুত উবু হয়ে শুয়ে পড়লো মাটির মধ্যে।
রহমানও মুহূর্ত বিলম্ব না করে ভূতলে শুয়ে পড়লো।
অল্পক্ষণে দু’খানা পা এগিয়ে এলে তাদের দিকে। পা নয় যেন তালগাছের দুটো গুঁড়ি।
পাশেই কতকগুলো গাছপালা ভেঙে পড়ার মড় মডু শব্দ হলো, বনহুর তাকিয়ে দেখলো, একটি তালগাছের গুঁড়ি তার দক্ষিণ বাহুর পাশে এসে পড়েছে। রুদ্ধ নিশ্বাসে মাটি চেপে পড়ে রইলো বনহুর আর রহমান। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ছে, রহমানের দিকে তাকিয়ে একবার দেখলো বনহুর, বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল।
বনহুর আর রহমান মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো, তাদের কানে ভেসে আসছে নর-নারীর করুণ আর্তনাদ-বাঁচাও….বাঁচাও….বাঁচাও…..।
বনহুর আর রহমান যখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছে তখন কিউকিলার তালগাছের গুড়ির মত পা খানা সরে গেলো ঝড়ের বেগে।
নিশ্বাস ফেলে বাচলো রহমান।
বনহুর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো রহমান, শীগগির পিছন দিকে কোনো আড়ালে লুকিয়ে পড়ো। কিউকিলা সম্মুখে কোনো লোককে ধরার জন্য উন্মাদ হয়ে ছুটে যাচ্ছে।
বনহুর আর রহমান দু’জনা একসঙ্গেই একটা ভাঙা কক্ষের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। বনহুর বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখলো, অদূরে একটা লোককে দক্ষিণ হাতের মুঠায় চেপে ধরে বুকের কাছে দাঁত বসিয়ে দিয়ে রক্ত শুষে নিচ্ছে কিউকিলা।
কিউকিলার ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত।
রহমান শিউরে উঠে বললো–সরদার, কি ভয়ানক নৃশংস দৃশ্য!
ঠোঁটের উপর আংগুল চাপ দিলো বনহুর।
কিউকিলা মৃতদেহটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো উচ্ছিষ্ট দ্রব্যের মত।
ঠিক বনহুর আর রহমান যে স্থানে আত্নগোপন করে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই স্থানে এসে পড়লো লোকটার মৃতদেহটা। যদিও ঝাপসা অন্ধকারে লোকটির দেহ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না তবু বুঝা গেলো–দেহটা অসাড়–প্রাণহীন।
এবার দৈত্যরাজ দীর্ঘ পদক্ষেপে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
নিশ্বাস নিলো রহমান।
বনহুর তখন দক্ষিণ হস্তে রিভলভার চেপে ধরে কিউকিল:টিকে অনুসরণ করলো।
কিউকিলা অভিমুখে পা বাড়াতেই রহমান বনহুরকে চেপে ধরলোসর্দার যাবেন না, যাবেন না সর্দার…..
রহমান, এখন চুপ থাকার সময় নয়, যেমন করে হোক দৈত্যরাজ কিউকিলাকে শেষ করতে হবে।
সর্দার, যে জীবের দেহে কামানের গোলা বিদ্ধ হয়নি, কি করে আপনি সেই জীবকে হত্যা করবেন? সর্দার, আপনি ক্ষান্ত হন,
রহমান, আমার সঙ্গে এসো, আমি ঐ নরহত্যাকারী জীবটাকে হত্যা না করে ক্ষান্ত হবে না।
সর্দার!
বনহুর পুনরায় বললো–আমি বুঝতে পেরেছি, কিউকিলাকে কাবু করার একটিমাত্র উপায় আছে–সে হলো কিউকিলার ঐ চোখটা। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছে, তার দেহে কামান বা রাইফেল-বন্দুকের গুলী বিদ্ধ না হলেও তার চোখে সে কোনোরকম আলো সহ্য করতে পারে না। যখনই আলো পড়বে তখনই সে চোখটাকে পিছন দিকে ফিরিয়ে রেখেছে। এমন কি আলোকরশ্মি স্তম্ভের আলো সে সহ্য করতে গিয়ে মাথা বিপরীত দিকে করে রেখেছে। ভুলক্রমেও সে তাকায়নি আমাদের দিকে।
হাঁ সর্দার, কিউকিলা আলো সহ্য করতে পারে না, এটা আমরা বুঝতে পেরেছি।
সেই কারণেই এই ভয়ঙ্কর জীবটা শুধু রাতের অন্ধকারেই শহরের বুকে হানা দিয়ে থাকে এবং দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকে সাগরতলায়। রহমান, কোনোক্রমে ঐ জীবটার চোখে গুলী বিদ্ধ করতে পারলেই আমরা জয়ী হবো।
সর্দার, সত্যি বলছেন?
হ, রহমান, সত্যি এবং আমি সেই কারণেই কিউকিলাকে অনুসরণ করছি।
কিন্তু কিউকিলার চোখে গুলী বিদ্ধ করা….থেমে পড়লো রহমানকণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো; কারণ সে জানে–কিউকিলার চোখে গুলী বিদ্ধ করা সাংঘাতিক ব্যাপার।
বনহুর বললো–রহমান, তুমি কখনো ঘাবড়াবে না। বনহুর কথাটা বলে দ্রুত অগ্রসর হলো। যে দিকে কিউকিলা চলে গেছে সেই পথে এগুতে লাগলো তারা। অন্ধকারে যদিও নানারকম অসুবিধা হচ্ছিলো তবু বনহুর ও রহমান জীবটাকে অনুসরণ করলো।
সম্মুখে যমদূতের মত কিউকিলা এগিয়ে চলেছে–চারদিক থেকে ভেসে আসছে অগণিত জনগণের করুণ ভয়ার্ত চিৎকার। যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
একটা ভাঙা দালানের আড়ালে আত্নগোপন করে বনহুর গুলী চালালো, কিন্তু এতো দূরে তখন সরে পড়েছে কিউকিলা যার জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। একবার নয়, বার বার গুলী করেও সে কৃতকার্য হলো না।
কিউকিলা তখন বিরাট লম্বা লম্বা পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। হত্যার নেশা হয় তো তখনকার মত মিটে গেছে তার, ফিরে চলেছে নিজের আবাসে।
বনহুরের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো, জলদানব কিউকিলা অগণিত শহরবাসীকে নিহত এবং আহত করে ফিরে গেলো সমুদ্রের বক্ষে। বনহুর রহমানসহ চেষ্টা নিয়েছিলো কিউকিলার চোখে কোনোরকমে গুলী বিদ্ধ করা যায় কি না–কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, কিউকিলার মাথাটা ছিল অনেক উর্ধ্বে, কাজেই রাইফেল বা রিভলভারের গুলী সঠিকভাবে তার চোখে বিদ্ধ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়েছিলো।
কিউকিলা যখন সমুদ্রবক্ষে নামতে শুরু করলো তখন বনহুর তার শাহীর ক্যাপ্টেন বোরহানের নিকটে ওয়্যারলেসে সংবাদ পাঠিয়ে দিলো, কিউকিলা গত রাতে যে স্থানে তলিয়ে গিয়েছিলো আজও সেই স্থানে তলিয়ে যায় কিনা লক্ষ্য রাখতে।
শাহী জাহাজ তখন ঝম-সমুদ্রের তীর ছেড়ে প্রায় পাঁচ হাজার গজ দূরে অবস্থান করছিলো। ‘শাহীর’ মধ্যে ছিলো ক্যাপ্টেন বোরহান এবং বনহুরের বেশ কিছুসংখ্যক বিশ্বস্ত অনুচর। এরা সবসময় সমুদ্রের দিকে লক্ষ্য রেখে চলেছে। দিনে এরা ঘুমাতো আর রাতে এরা জেগে থাকতো।
সর্বক্ষণ তাদের মনে নানারকম আশঙ্কা উঁকি দিতো, না জানি কখন কোন মুহূর্তে কিউকিলা তাদের জাহাজে হানা দিয়ে বসে! সেই কারণেই বনহুরের আদেশে শাহী’কে মাঝসমুদ্রে রাখা হয়েছিলো।
ওয়্যারলেসে সংবাদ পেয়ে বোরহান বাইনোকুলার যন্ত্র চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগলো। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো বোরহান এবং তার সহকারিগণ। তারা দেখলোতাদের জাহাজ ছেড়ে বহু। দূরে বিরাট পর্বতের মত একটা দেহ এগিয়ে আসছে সমুদ্রের দিকে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ঝাপসা কালোমত নজরে পড়তে লাগলো। আরও দেখতে পেলোলা, পর্বত আকার দেহটার কপালে আগুনের গোলার মত একটা চোখ টর্চলাইটের মত জ্বলছে।
বোরহান ওয়্যারলেসে বনহুরকে জানিয়ে দিতে লাগলোসর্দার, আমাদের জাহাজ শাহী’ এখন সমুদ্র তীর থেকে প্রায় পাঁচ হাজার গজ দূরে রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন জমকালো পর্বতের মত একটা বিরাট দেহ মন্থর গতিতে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে আসছে…….
বোরহান শুনতে পায় তাদের সর্দার দস্যু বনহুরের কণ্ঠস্বর–সাবধানে লক্ষ্য করো, জীবটা পূর্বদিন যে স্থানে তলিয়ে গিয়েছিলো সেই স্থানে তলিয়ে যায় কিনা। জায়গাটা তোমাদের সঠিক স্মরণ না থাকলে আজ ভালভাবে স্মরণ রেখো।
সর্দার, পূর্বদিন যে স্থানে জীবটা তলিয়ে গিয়েছিলো আজও সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সেদিন কিউকিলাকে যে স্থানে ভেসে উঠতে দেখেছিলাম এটা কি সেই স্থান?
হা সর্দার, আশ্চর্য! কিউকিলাকে আমরা প্রথম দিন যে স্থানে ভেসে উঠতে দেখেছি এটা ঐ স্থান। আরও লক্ষ্য করেছি, কিউকিলা যতবারই ভেসে উঠেছে এবং তলিয়ে গেছে ঐ একই স্থানে।
ঘাঁটিতে ওয়্যারলেসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো বনহুর, বোরহানের কথায় তার চোখ দুটো যেন বিস্ময়ে জ্বলে উঠে।
রহমান লক্ষ্য করছিলো সর্দারের পাশে দাঁড়িয়ে। সে বুঝতে পারে, সর্দার বোরহানের কথায় কোনো কু খুঁজে পেয়েছেন।
রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–কিউকিলার বাস সমুদ্রগর্ভে হলেও তার বাসস্থান এমন এক স্থানে যে স্থান তার অতি পরিচিত। রহমান, আমি কিউকিলার বাসস্থান আবিষ্কার করতে চাই।
সর্দার, আপনি এ কি কথা বলছেন?
যা বলছি তা আমি করতে চাই এবং করবো……
মনে মনে শিউরে উঠলো রহমান।
*
বনহুর তার ঘাটি থেকে ফিরে এসেছে শাহী জাহাজে। আলোকরশ্মি স্তম্ভ আবার বসানো হয়েছে জাহাজের ডেকের উপর। সমস্ত অনুচর এবং ঝাঁম সর্দার বনহুরকে তার দলবল নিয়ে ‘শাহী জাহাজে কিউকিলা হত্যার জন্য বনহুরকে নানারকম সাহায্য করে চলছে।
বনহুর বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছে–এবার কিউকিলার আবাসস্থল সে দেখবে তারপর তাকে হত্যার ব্যবস্থা নেবে নতুনভাবে।
ঝাঁম শহরের সেরা কয়েকজন ডুবুরীকে বনহুর নিয়ে এসেছে কিন্তু বহু অর্থের বিনিময়েও তারা সমুদ্রগর্ভে নামতে রাজি হয়নি। মরতে তারা ভয় পায় না কিন্তু কিউকিলার হস্তে মরতে তারা রাজি নয়।
ডুবুরিগণ রাজি না হলেও বনহুর ক্ষান্ত হলো না। সে নিজে সমুদ্রগর্ভে নামবে বলে মন স্থির করে নিলো। সে দেখতে চায়, কিউকিলা কোথায় বাস করে এবং সমুদ্রগর্ভে কি করে সে।
বনহুরের মনোভাব প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুচরদের মধ্যে ভীষণ একটা দুশ্চিন্তার ছায়াপাত হলো, বিশেষ করে সর্দারকে হারাতে তারা চায় না। রহমান নিজে ডুবুরীর পোশাক পরে সমুদ্রগর্ভে নামবে বলে সর্দারকে জানালো। বনহুরের আরও কয়েকজন অনুচরও এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখলো। তারা বললো–সর্দার, হুকুম করুন, আমরা জীবন দিয়েও কিউকিলা হত্যার জন্য চেষ্টা করবো।
বনহুর কারো কথায় কান দিলো না, সে ডুবুরীর বেশে সজ্জিত হয়ে নিলো।
অবশ্য তার সঙ্গে দু’জন ডুবুরীও থাকবে।
বনহুর যখন ডুবুরীর ড্রেসে সজ্জিত হচ্ছিলো তখন ঝাম-রাজকন্যা মালা এসে হাজির। সে লোকমুখে জানতে পেরেছে, বনহুর সমুদ্রবক্ষে গভীর জলমধ্যে অবতরণ করবে। কথাটা শুনে শিউরে উঠেছিলো মালা–সর্বনাশ, ওকে তাহলে চিরদিনের জন্য হারাতে হবে। মালা পিতার কাছে অনুরোধ করেছিলো বাবা, ওকে তুমি ক্ষান্ত করো। কিউকিলা হত্যা করতে গিয়ে এমন সুন্দর একটা জীবন বিনষ্ট হয়ে যাবে, এ আমি সহ্য করতে পারবো না। বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি দেবরাজকে ফিরিয়ে আনন। চোখে রুমাল চাপা দিয়ে কেঁদেছিলো মালা তবু ঝমরাজ কন্যাকে আশ্বাস দিতে পারেননি কারণ কিউকিলাকে হত্যা না করলেই নয়। কিউকিলার অত্যাচারে সমস্ত ঝাঁম শহর একেবারে নিঃশেষ হতে চলেছে।
মালা অগত্যা নিজেই তার ঘোড়াগাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে সমুদ্রের ধারে। তারপর মোটরবোট যোগে পৌঁছে গেছে সে একেবারে শাহী জাহাজে।
মালাকে দেখে বনহুর বিস্মিত হলো, অবাক কণ্ঠে বললো–মালা তুমি!
মালা বনহুরের জামাটা এটে ধরলো–তুমি নাকি সমুদ্রে অবতরণ করছো?
হ মালা।
না, আমি তোমাকে সমুদ্রে অবতরণ করতে দেবো না দেবরাজ। মালা বনহুরকে ‘দেবরাজ’ বলে ডাকতো।
অবশ্য বনহুরের এ নামটা দিয়েছিলেন মহারাজ মোহন্ত সিন্ধু। বনহুরের সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেই কারণে ‘দেবরাজ’ বলে ডাকতেন। ঝাঁম শহরের লোকজন সবাই বনহুরকে অত্যন্ত ভক্তি করতো–তারাও তাকে দেবরাজ’ বলতো।
মালার কথায় বনহুর হাসলো, তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো পরপর দুটি মুখমনিরা আর নূরী। তারাও আজ পাশে থাকলে তাকে এমনি করেই বাধা দিতো। বললো বনহুর-মালা, কিউকিলাকে হত্যা না করলেই যে নয়। জানো তো, ঝাঁমবাসীর সম্মুখে আজ কি বিপদ?
জানি কিন্তু তোমাকে সমুদ্রগর্ভে নামতে দেবো না।
ভয় পেয়ো না মালা, আমি কিউকিলার বাসস্থান শুধু দেখে আসবো।
সর্বনাশ! কিউকিলা তোমাকে হত্যা করে ফেলবে।
মালা, এতো লোকের জীবনের বিনিময়ে গেলোই বা আমার একটি জীবন….
না না, আমি তোমাকে সমুদ্রে অবতরণ করতে দেবো না, খুলে ফেলো তুমি ডুবুরী ড্রেস। বনহুর বিপদে পড়লো যেন, ঝাঁম ভাষায় সে নানাভাবে মালাকে বুঝাতে চেষ্টা করলো। মালা শুধু নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো। নিজের অজান্তে বনহুরকে সে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিলো তাই সে কিছুতেই তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারলো না।
কিন্তু বনহুর অন্য ধরনের পুরুষ–তাকে কোনোদিন ভয়-ভীতি আতঙ্কগ্রস্ত করতে সক্ষম। হয়নি। আজ সে মালার কথায় বা তার চোখের পানিতে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারে না। সব বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে দস্যু বনহুর ডুবুরীর ড্রেসে সজ্জিত হয়ে ডেকে এসে দাঁড়ালো। বনহুরের অনুচরগণের মুখ ছাইয়ের মত বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঝাঁম সর্দার দলবল নিয়ে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কি মহারাজ মোহন্ত সিন্ধুও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বাধা দিতেও পারছেন না। বনহুরের উপর তার বিশ্বাস কিউকিলার বাসস্থানের সন্ধান সে আনতে পারবে; কিন্তু ভয়ও হচ্ছে–যদি আর ফিরে না আসে!
বনহুরের সঙ্গে দু’জন ডুবুরী নামতে স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু তারা জাহাজ ছেড়ে দু’শত গজের মধ্যে থাকবে, তার বেশি তারা যাবে না।
বনহুর প্রথম জাহাজ থেকে বোটে অবতরণ করলো। শুধু মুখটা খোলা রয়েছে আর সারা। দেহে তার ডুবুরীর ড্রেস। সঙ্গী ডুবুরীদ্বয়ও বনহুরের সঙ্গে জাহাজ থেকে বোটে নেমে এলো।
রহমান তার কয়েকজন অনুচর ও কয়েকজন ডুবুরীসহ বোটে নামলো কারণ অক্সিজেনের পাইপ এবং যন্ত্রপাতি বোটেই থাকবে।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে মোহন্ত সিন্ধু এবং মালা ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে লাগলো।
বনহুর বিলম্ব না করে সমুদ্রবক্ষে নেমে পড়লো। বনহুরের সঙ্গে দু’জন ডুবুরী তাকে অনুসরণ করলো। তিনজন মিলে ক্রমান্বয়ে নেমে চললো সমুদ্রগর্ভে!
বোটের উপরে আতঙ্কিত হৃদয় নিয়ে রহমান ও দলবল অপেক্ষা করতে লাগলো।
দু’জন ডুবুরী ও দস্যু বনহুর গভীর জলের তলায় সাঁতার কেটে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পাশ কেটে চলে যাচ্ছে কত নাম না জানা মাছ এবং জল-জীব। বনহুরের দক্ষিণ হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা আর বাম হস্তে তীব্র আলোক-বিচ্ছুরিত টর্চ।
বনহুরের সঙ্গীদ্বয়ের হস্তেও ছোরা আর ঐ ধরনের টর্চ রয়েছে।
প্রায় বিশগজ নিচে অবতরণ করার পর হঠাৎ একটা বিকটা শব্দ তাদের কানে এলো; চমকে উঠলো ডুবুরীদ্বয়। বনহুরও বিস্মিত হলো–কিসের এ শব্দ! ভীষণ কানফাটা আওয়াজ। কিন্তু পরক্ষণেই সব নিস্তব্ধ। বনহুর আর ডুবুরীদ্বয় সম্মুখে তাকিয়ে দেখলো, একটা হাঙ্গর আর অক্টোপাশে লড়াই চলেছে। বনহুর বুঝতে পারলো, অক্টোপাশের কবলে পড়ে হাঙ্গরটা মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং সে-ই ঐ রকম বিকটা শব্দ করছিলো।
ডুবুরীদ্বয় ও বনহুর দূর থেকে এই দৃশ্য দেখতে লাগলো কিন্তু বেশিক্ষণ সেইস্থানে বিলম্ব করতে সাহসী হলো না তারা। হাঙ্গর আর অক্টোপাশে তুমুল ধস্তাধস্তি ধাক্কায় সেখানের জলরাশি যেন তোলপাড় হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি সরে পড়লো বনহুর আর তার সঙ্গীদ্বয়।
গভীর তলদেশে আরও নেমে চলেছে বনহুর ও ডুবুরীদ্বয়। কিছুটা অগ্রসর হতেই অদূরে পাথরখন্ডের উপরে বিরাট বিরাট দেহ-পা ওয়ালা কতগুলো জীব হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বনহুর বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলো, জীবগুলো অন্য কিছু নয়– সামুদ্রিক কাঁকড়া। কি ভয়ঙ্কর আর বিকট চেহারা কাঁকড়াগুলোর। সম্মুখের পা উঠিয়ে মাঝে মাঝে বড় বড় মাছ ধরে মুখের কাছে টেনে নিচ্ছে। সম্মুখের পাগুলো যেন এক-একটা করাতের মত ধারালো আর সাঁড়াশির মত দেখতে। বিরাটদেহী কাঁকড়াগুলোর চোখ যেন ইলেকট্রিক বলের মত জ্বলছে।
মানুষের আভাস পেয়েছে হয়তো, কাঁকড়াগুলো হঠাৎ যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো; দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগলো এদিকে।
বনহুর সঙ্গীদ্বয়সহ সেখান থেকে সরে পড়লো ক্ষিপ্রগতিতে। একসঙ্গে প্রায় সাঁতার কেটে চলেছে ওরা।
বনহুর সর্বপ্রথমে–পিছনে চলেছে ডুবুরীদ্বয়।
বনহুরের চোখে বাইনোকুলার লাগানো রয়েছে, সে চারদিকে সর্তক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অগ্রসর হচ্ছে। বনহুরের ইচ্ছা–আরও দূরে গভীর সমুদ্রতলে নেমে যায় কিন্তু ডুবুরীদ্বয় আর দূরে যেতে রাজি নয়।
ফেরার জন্য অগ্রসর হতেই একটা বিরাট জল-জন্তু আকারে ঠিক কচ্ছপের মত তাড়া করে এলো ভীষণভাবে।
বনহুর ডুবুরীদ্বয়কে দ্রুত একপাশে সরে যাবার জন্য ইংগিত করলো।
ডুবুরীদ্বয় কিছুটা সরে যেতে না যেতেই কচ্ছপরাজ এসে আক্রমণ করলো বনহুরকে। বনহুরের দক্ষিণ হস্তে ছিলো সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরাকচ্ছপরাজ তাকে আক্রমণ করতেই বনহুর ছোরাখানা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলো। শুরু হলো ধস্তাধস্তি।
ডুবুরীদ্বয়ের হস্তেও ছোরা ছিলো কিন্তু তারা এগুতে সাহসী হলো না। বনহুর একাই লড়াই করে চললো। বনহুরের দেহে ডুবুরীর মজবুত ড্রেস থাকায় কচ্ছপরাজ সহজে তার দেহে আঁচড় কাটতে বা দাঁত বসাতে পারলো না।
বনহুর কৌশলে কচ্ছপটাকে কাবু করার চেষ্টা করতে লাগলো।
ডুবুরীদ্বয় বহুবার সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করেছে কিন্তু এমন বিপদে তারা পড়েনি কোনোদিন। তারা ভয়ানকভাবে ঘাবড়ে গেলো, বনহুরকে সহায়তা করার ইচ্ছা থাকলেও কিছুতেই সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না।
বেশ কিছুক্ষণ কচ্ছপটার সঙ্গে লড়াই চলার পর হঠাৎ বনহুর তার ছোরা দিয়ে কচ্ছপটার গলায় আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে ছোরাখানা কচ্ছপের গলার নালী ভেদ করে প্রবেশ করলো ভিতরে।
মুহূর্তে কচ্ছপটা কাৎ হয়ে উল্টে গেলো; পরক্ষণে পুনরায় সোজা হওয়ার জন্য চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো সমুদ্রের ঘোলাটে পানির কিছুটা অংশ।
কচ্ছপের কবল থেকে মুক্ত হলো বনহুর, হাঁপাচ্ছে সে। এবার বনহুর সঙ্গীদ্বয়সহ এগুতে লাগলো কিন্তু বেশিদূরে অগ্রসর হতে পারলো না, সমুদ্রতলে জলীয় উদ্ভিদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলো তাদের দেহ। জলীয় উদ্ভিদগুলো কতকটা লতা-গুল্মের মত অত্যন্ত শক্ত এবং শিকড় জাতীয়।
আবার ভীষণ এক বিপদের সম্মুখীন হলো তারা। সমস্ত শরীরে শিকড়ের মত জলীয় উদ্ভিদগুলো এঁটে বসে যাচ্ছে যেন। বনহুর সঙ্গীদ্বয়কে সূতীক্ষ্ণ ছোরা দ্বারা শিকড় জাতীয় উদ্ভিগুলো কেটে ফেলবার জন্য বললো।
কিন্তু আশ্চর্য! যতই লতা-গুল্মগুলোকে তারা দেহ থেকে ছিন্ন করে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগলো ততই যেন আরও জড়িয়ে পড়ছে তাদের দেহের সঙ্গে আঠালো বস্তুর মত।
. ডুবুরীদ্বয় প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলো।
বনহুর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মুক্ত হয়ে পড়লো। এবার সে তার সঙ্গীদ্বয়কে মুক্ত করে নেবার জন্য সংগ্রাম করে চললো। সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা দ্বারা ডুবুরীদ্বয়ের দেহের আবেষ্টন কেটে ছাড়িয়ে নিচ্ছে সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।
বহুক্ষণ সময় লেগে গেলো, বহুকষ্টে ডুবুরীদ্বয়কে উদ্ধার করে নিয়ে ফিরে চললো তাদের জাহাজ অভিমুখে। আজ কিউকিলার কোনো সন্ধানই তারা পেলো না।
এদিকে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অস্থির চিত্তে ঈশ্বরকে স্মরণ করছে সিন্ধু মহারাজ মোহন্ত আর তার কন্যা মালা।
রহমান এবং বনহুরের অনুচরগণও অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে বিপুল আগ্রহ নিয়ে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলো। সকলের মুখেই বিষাদের ছায়ানা জানি কেমন আছে তারা! না জানি কখন কি বিপদ ঘনিয়ে আসে তাদের সর্দারের ভাগ্যে!
সবাই যখন চিন্তামগ্ন তখন বনহুর ডুবুরীদ্বয়সহ ফিরে এলো জাহাজে ওরা ফিরে আসতেই আনন্দধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠলো শাহী জাহাজখানা! কিউকিলার আবাসস্থল হতে তারা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে–এটাই হলো তাদের খুশির কারণ।
মালা তো আনন্দে আত্নহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বনহুরের বুকে, সিন্ধু ভাষায় জানাতে লাগলো তাকে অভিনন্দন। কিন্তু পরক্ষণেই যখন শুনলো মালা, বনহুর কিউকিলার বাসস্থানের সন্ধান পায়নি এবং সে পুনরায় যাবে তখন তার মুখখানা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো।
মালা সচ্ছভাবে বনহুরের কণ্ঠ আলিঙ্গন করেছিলো। এটা তাদের দেশের নিয়ম, কাজেই লজ্জা বোধ করেনি সে।
বনহুর কিন্তু তার অনুচরদের সম্মুখে এ ব্যাপারে অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছিলো।
বনহুর ড্রেস পরিবর্তন করে যখন নিজের ক্যাবিনে এসে বসলো তখন সে আরও অবাক হলো। দেখলো মালা তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বনহুর তার শয্যায় বসে তোয়ালে দিয়ে মাথাটা মুছে শুকনো করছিলো। মালা এগিয়ে এলো–তোয়ালে আমাকে দাও, আমি তোমার মাথার জল শুকিয়ে দিচ্ছি।
বাধা দিয়ে বললো বনহুর–তুমি রাজকুমারী, কেন আমার জন্য এতো করতে যাবে মালা?
বনহুরের কণ্ঠ তার কোমল হাত দু’খানা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মালা ক’দিন পর তুমি আমার স্বামী হবে আর আমি তোমার জন্য এটুকু কষ্ট করতে পারবো না?
বনহুরের ভ্রু কুঁচকে উঠলো মুহূর্তের জন্য। কোনো উত্তর সহসা দিতে পারলো না সে।
মালার ওষ্ঠদ্বয় বনহুরের চিবুক স্পর্শ করলো, বললো সে কোনো উত্তর দিচ্ছো না কেন দেবরাজ?
বনহুর মালার নিকট হতে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য টেবিল থেকে বাইনোকুলারটা হাতে তুলে নিয়ে মালার চোখে ধরলো–মালা, এটা দিয়ে তাকিয়ে দেখো, ঐ যে প্রচন্ড ঢেউ-এর উচ্ছ্বাস দেখছে ওখানে আবার আমাকে যেতে হবে।
শিউরে উঠলো মালা!
প্রচন্ড ঢেউগুলো গর্জন করে ছুটে চলেছে, যেন বিরাট বিরাট এক একটি ভয়াল পর্বতমালা। সেকি ভয়ঙ্কর সমুদ্রব! মালা বাইনোকুলারসহ বনহুরের হাতখানা চেপে ধরলো।
বনহুর বললো–ওখান থেকে যদি ফিরে না আসি?
না না…মালা বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে–আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না দেবরাজ?
এমন সময় বাইরে রাজা মোহন্ত সিন্ধু আর বোরহানের কণ্ঠ শুনতে পায়। মালাকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসে দরজার দিকে।
মোহন্ত সিন্ধু বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড ও বোরহান ক্যাবিনে প্রবেশ করেন।
বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড ঝম-রাজ্যেরই একজন অধিবাসী। তিনিও কিউকিলা হত্যার জন্য নানারকমে চেষ্টা করে চলেছেন।
বনহুর তাদের বসবার জন্য অনুরোধ জানালো।
আসন গ্রহণ করলেন তারা।
মালা পিতার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।
বনহুর নিজেও একটা আসন গ্রহণ করে সিগারেট-কেসটা বাড়িয়ে ধরলো মোহন্ত সিন্ধু ও ক্যাপ্টেন বোরহানের দিকে।
সিগারেট পান করতে করতে আলাপ চললো।
মোহন্ত সিন্ধু বনহুরকে লক্ষ্য করে বললেন–আচ্ছা দেবরাজ, আপনি কিউকিলা হত্যা ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত এবং চিন্তিত রয়েছেন। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন এই জলদানবকে হত্যা করে ঝম বাসিগণকে উদ্ধার করেন, তাই না?
হাঁ, মহারাজ, আমার এটাই ইচ্ছা। বললো বনহুর।
পুনরায় বললেন মোহন্ত সিন্ধু–কিন্তু আপনার অদ্ভুত মেশিন আলোকরশ্মি স্তম্ভ কিউকিলার কিছু করতে পারলো না তো?
এবার বলে উঠে ক্যাপ্টেন বোরহান–আশ্চর্য এখানেই। আলোকরশ্মি স্তম্ভের বৈদ্যুতিক রশ্মিতে যে কোনো কঠিন বস্তু গলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় অথচ কিউকিলার রক্ত-মাংসের দেহ বিনষ্ট হলো না।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–আশ্চর্য কিছু নয়। আলোকরশ্মি স্তম্ভের মারাত্নক বৈদ্যুতিক রশ্মি। কিউকিলাকে ভস্মীভূত করতে সক্ষম হয়নি সত্য, কিন্তু এর কারণও আছে। কিউকিলার দেহের চামড়া এতো শক্ত এবং কঠিন যা শত শত গন্ডারের চামড়ার চেয়েও মজবুত। তা ছাড়াও আর একটি কারণ রয়েছে আমরা কিউকিলাকে কোনো সময় স্থিররূপে পাইনি। আলোকস্তম্ভের রশ্মি বিচ্ছুরিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সে সরে পড়েছে বা সমুদ্রবক্ষে ডুব মেরেছে। কাজেই হাজার হাজার গুণ ভোল্টের আলোকরশ্মিও তাকে নিহত করতে পারেনি। তবে আমার বিশ্বাস, আলোকরশ্মি স্তম্ভের রশ্মি তার দেহকে বিদগ্ধ করেছে নিশ্চয়ই।
থামলো বনহুর।
মোহন্ত সিন্ধু বললেন–সত্যি দেবরাজ, আপনার এই অদ্ভুত আলোকরশ্মি স্তম্ভের কার্যবলি লক্ষ্য করে আমি শুধু বিস্ময়াহতই হইনি বরং আমি অত্যন্ত বিমুগ্ধ হয়েছি, যদিও কিউকিলা হত্যার জন্য এই রশ্মি দ্বারা আমার রাজ্যের প্রচুর বৃক্ষলতা এবং শস্যাদি বিনষ্ট হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড বললেন–দেবরাজ, আমি একটি কথা জানতে চাই–এমন একটি মারাত্নক রশ্মি আপনার হাতে থাকা সত্ত্বেও আপনি সাগরতলে কিউকিলার আবাসস্থল কেন অন্বেষণ করে চলেছেন? আপনার আলোকরশ্মি স্তম্ভের আলো কি সমুদ্রগর্ভে প্রবেশে সক্ষম নয়?
একটু হেসে বললো বনহুর–কিউকিলার আবাসস্থল নিশ্চয়ই গভীর জলের তলদেশে……
বললেন বৈজ্ঞানিক–তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মোহন্ত সিন্ধুও বললেন–আমারও সেরকমই মনে হয়।
বনহুর বললো–সন্দেহ নয় মহারাজ–সত্য; কিউকিলা শুধু গভীর জলমধ্যেই থাকে না, সে এমন কোনো স্থানে বাস করে যেখানে পৃথিবীর কোনো রশ্মিই পৌঁছতে সক্ষম নয়। এমন কি মারাত্নক আলোকস্তম্ভের বৈদ্যুতিক রশ্মিও সেখানে প্রবেশে অক্ষম।
বনহুরের কথায় ক্যাবিনের প্রতিটি মানুষের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।
মালার চোখমুখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠেছে, মুখমন্ডল অত্যন্ত গম্ভীর। মালা নির্বাক স্তব্দ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে। বনহুরের কথাগুলো যেন তার কানে অদ্ভুত শোনাচ্ছিলো।
মোহন্ত সিন্ধু বললেন– এবার তাহলে কি কিউকিলাকে হত্যা করা কিছুতেই সম্ভব হবে না?
বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড বললেন–হতে পারে এবং তাকে ভস্মীভূত করতে হবে। আলোকরশ্মি স্তম্ভের যে তেজ আছে তার তেজশক্তি আরও বাড়িয়ে দিতে হবে।
বললো বনহুর–আমিও ঐ রকম চিন্তা করেছিলাম মিঃ ফিরার্ড, কিন্তু কিউকিলা আমাদের চেয়েও শতগুণ চালাক, তাকে আলোকরশ্মি স্তম্ভের সীমানার মধ্যেই পাওয়া যাবে না।
তাহলে কি আলোকরশ্মি দ্বারা তাকে হত্যা করা সম্ভব নয় আপনি মনে করেন?
হাঁ মহারাজ! মোহন্ত সিন্ধুর কথায় বললো বনহুর।
পুনরায় মহারাজ সিন্ধু প্রশ্ন করলেন–কিউকিলাকে হত্যা করা যদি সম্ভব নয় তবে কেন আপনি এতো কষ্ট করে সমুদ্রবক্ষে গভীর জলমধ্যে কিউকিলার বাসস্থানের সন্ধান করে চলেছেন? বনহুরের মুখে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো, শান্ত কণ্ঠে বললো বনহুর কিউকিলাকে হত্যা করতেই হবে এবং যে কোনো উপায়ে। থামলো বনহুর, আংগুলের ফাঁকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা ক্যাবিনের মেঝেতে নিক্ষেপ করে পা দিয়ে পিষে ফেললো, তারপর বললো– কিউকিলাকে হত্যা করতে হলে তার বাসস্থান খুঁজে বের করতে হবে। নিশ্চয়ই ঐ জীবটা সাগরতলে কোনো ডুবন্ত পর্বতের গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং সময়মত বেরিয়ে আসে।
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড–কিন্তু কি করে তাকে আপনি হত্যা করতে চান দেবরাজ?
ডিনামাইট ফিট করে তাকে হত্যা করতে হবে! বললো বনহুর।
ক্যাবিনের মধ্যে যে কয়েকজন লোক ছিলো সবাই একবার এ-ওর মুখে তাকিয়ে নিলো, মনের বিস্ময় ফুটে উঠেছে প্রত্যেকের চোখেমুখে!
অস্ফুট কণ্ঠে বললেন মহারাজ মোহন্ত সিন্ধু ডিনামাইট!
হাঁ, একটি নয় কয়েকটি ডিনামাইট প্রয়োজন আমাদের। প্রথমে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে কিউকিলা কোথায় বাস করে তারপর সেই জায়গায় ডিনামাইট বসিয়ে দিতে হবে……
মালা এবার আর্তকণ্ঠে বলে–দেবরাজ, এতোবড় দুঃসাহস তোমার হলো কি করে? সমুদ্রতলে তুমি ডিনামাইট বসাতে যাবে?
হাঁ, তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিউকিলাকে নিহত করতে হলে তাকে ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করতে হবে এবং আমি সেই কারণেই সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করে কিউকিলার আবাসস্থল অন্বেষণ করে চলেছি।
ক্যাবিনস্থ সকলের মুখেই আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠলো। সবাই বিস্মিত হতবাক হয়ে পড়লো। মোহন্ত সিন্ধু যদিও কিউকিলার অত্যচারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তবু দেবরাজের কথায় তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেলো! গভীর সমুদ্রতলে কিউকিলার বাসস্থানে ডিনামাইট বসানো যে সামান্য ব্যাপার নয়, এ কথা তিনি জানেন।
রহমানের দুঃসাহসী মনেও ভয়ের সঞ্চয় হলো, সে একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারলো না।
ক্যাবিনের প্রতিটি মানুষের মুখ শুকিয়ে চুন হয়ে গেছে, এ যে অসাধ্য ব্যাপার যা তারা কল্পনাও করতে পারেনা। ভয়ঙ্কর সমুদ্রবক্ষে গভীর জলের তলায় ডিনামাইট ফিট করা কম কথা নয়, তাও কিউকিলার মত দৈত্যরাজের বাসস্থানে!
মালা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো।
রহমান বেরিয়ে গেলো ক্যাবিন থেকে, সে সর্দারের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট নয়। জানে তার সর্দার অসাধ্য সাধনে কোনোদিন পিছু পা নয়, তবু কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো সে।
বনহুর বৈজ্ঞানিক ফিরার্ড ও মোহন্ত সিন্ধুর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ এ ব্যাপার নিয়ে আলাপ আলোচনা করলো।
*
নিস্তব্ধ গভীর রাত।
সমস্ত জাহাজখানা নীরব। শুধু অন্ধকার ডেকে একটা ভারী বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আপন মনে পায়চারী করছে বনহুর, তারই বুটের শব্দ গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতাকে যেন খান খান করে ফেলছিলো। অন্ধকারে যদিও তার মুখমন্ডল দেখা যাচ্ছিলো না তৰু বুঝা যাচ্ছিলো, সে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কিছু চিন্তা করছিলো। তার আংগুলের ফাঁকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা থেকে একটা ক্ষীণ ধূম্রশিখা বেরিয়ে মিশে যাচ্ছিলো অন্ধকারের বুকে, মাঝে মাঝে বনহুর সিগারেটটা চেপে ধরছিলো দু ঠোঁটের মধ্যে। কখনও বা রেলিং-এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলো সমুদ্রবক্ষের জমাট অন্ধকারের দিকে।
অদূরে অন্ধকারে ডেকের আড়ালে আর একটি লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো।
হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে যায়, গম্ভীর কণ্ঠে বলে–কে?
এগিয়ে আসে ছায়ামূর্তি–সর্দার!
রহমান তুমি!
সর্দার, সমস্ত রাত আপনি জেগে কাটাবেন?
তুমিও তো দেখছি জেগে আছে?
সর্দার!
তোমার চোখেও ঘুম আসছে না, এইতো?
সর্দার, আপনি এ দুরভিসন্ধি ত্যাগ করুন। কিউকিলা হত্যার জন্য আপনার জীবন আমরা বিনষ্ট হতে দেবো না।
এগিয়ে আসে বনহুর রহমানের পাশে, যদিও রহমানের মুখ সে দেখতে পাচ্ছিলো না তবু তার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো রহমান তার জন্য অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বনহুর জানে, তার অনুচরগণ তাকে কত ভালবাসে! সাগরবক্ষে অবতরণ ব্যাপার শুধু তাদের চিন্তিতই করে তোলেনি, তাদের মনে ভীষণ একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রহমানের কাঁধে হাত রাখে বনহুর, সান্ত্বনার স্বরে বলে–আমার কাজে বাধা দিও না রহমান। আমি জানি, তোমরা আমাকে যেমন ভালবাসো, সমীহ করো, তেমনি করো বিশ্বাস কাজেই আমার উপর তোমাদের যে আস্থা সে আস্থা তোমরা হারিও না।
সর্দার, হঠাৎ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে বসে তাহলে কান্দাই ফিরে কি জবাব দেব বৌরাণী আর বোন নূরীর কাছে।
হঠাৎ অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বনহুর।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রহমান, বনহুরের হাসির কারণ সে সহসা খুঁজে পায় না।
বনহুরের বলিষ্ঠ কণ্ঠের তীব্র হাস্যধ্বনিতে নিস্তব্দ রাত্রির জমাট অন্ধকার যেন থরথর করে কেঁপে উঠে। হাসি থামিয়ে বলে সে রহমান, দস্যু বনহুরের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হবে বা হতে পারে, এটা আশ্চর্য কিছু নয় এবং এজন্য তোমাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।
সর্দার!
রহমান, তোমাদের সর্দারের মৃত্যুর জন্য কোনোদিন তোমরা ঘাবড়াবে না বা বিচলিত হবে না। আমি জানি, আমার অবর্তমানেও তোমরা আমারি মত আমার আস্তানা পরিচালনা করবে।
রহমান আজ নিজকে স্থির রাখতে পারলো না, হঠাৎ বনহুরের পায়ের কাছে বসে পড়লো, দু’হাতে চেপে ধরলো বনহুরের পা দু’খানা–সর্দার!
বনহুর তাড়াতাড়ি রহমানকে তুলে নিলো, বুকে জড়িয়ে ধরে বললো
রহমান, তোমরাই আমার ভরসা, আমার বন্ধু। কিউকিলা হত্যায় তোমরা আমাকে যথাসাধ্য। সাহায্য করবে, এই আমার কাম্য।
সর্দার!
রহমান, ঝাঁমবাসীদের সম্মুখে আজ যে বিপদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা অতি ভয়ঙ্কর। কিউকিলা এই শহরটাকে নিঃশেষ করে ফেলবে এবং ঝাঁম দেশের কোন অস্তিত্বই রাখবে না। তাই যেমন করে থোক, ঝম দেশকে আর ঝামবাসীদের বাঁচাতে হবে।
সর্দার, যে জীবকে কোনো শক্তিই কাবু করতে সক্ষম হলো না এমন কি আলোকরশ্মি স্তম্ভের। বৈদ্যুতিক রশ্মিও যার কোনো ক্ষতি করতে পারলো না, তাকে আপনি……
হাঁ, আমি জানি তাকে হত্যা করতে হলে একমাত্র ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করতে হবে।
কিন্তু আপনি যেভাবে বলছেন তাকি সম্ভব হবে সর্দার?
অসম্ভব হলেও তাকে সম্ভব করে নিতে হবে।
সর্দার, কোনো ডুবুরীকে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে…….।
কেউ রাজি হবে না রহমান। লক্ষ টাকার বিনিময়েও কোনো ডুবুরী যাবে না কিউকিলার গহ্বরে, বুঝলে?
সর্দার!
আমাকেই তাই যেতে হবে।
সর্দার, আমিই যাবো, আদেশ করুন সর্দার?
রহমান, তুমি পারবে না, কারণ সমুদ্রগর্ভে অবতরণ অভ্যাস তোমার নেই।
সর্দার, আপনারও তো ছিল না, কিন্তু আপনিও সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করেছিলেন?
রহমানের কথায় বনহুরের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
বনহুর পা বাড়ালো নিজের ক্যাবিনের দিকে।
রহমান তাকে অনুসরণ করলো।
ক্যাবিনের নিকটে যেইমাত্র পৌঁছেছে বনহুর আর রহমান, ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজখানা দুলে উঠলো ভীষণভাবে। কাৎ হতে গিয়ে সোজা হলো তখনই তাই রক্ষা।
একসঙ্গে জাহাজের লোকজন জেগে উঠলো এবং ভয়ার্তভাবে চিৎকার করে উঠলো। সবাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে ডেকের উপর, সকলের চোখেমুখেই আতঙ্ক আর উদ্বিগ্নতার ছাপ।
বনহুর রহমানকে লক্ষ্য করে বললো-রহমান, কিউকিলা ঠিক আমাদের জাহাজের তলায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে।
মুহূর্ত বিলম্ব করো না, আমার সঙ্গে এসো। আলোকরশ্মি মেশিন চালু করতে হবে…..এসো, এসো রহমান….বনহুর দ্রুত ছুটে চললো জাহাজের সম্মুখ ডেকের দিকে।
রহমান এবং আরও কয়েকজন অনুচর বনহুরকে অনুসরণ করলো। বোরহান তখন জাহাজের বিপদ সংকেতধ্বনি ঘোষণা করে চলেছে।
বনহুর আলোকস্তম্ভ মেশিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রহমান চিৎকার করে উঠলো! সর্দার, সাবধানে কাজ করবেন! ভুল যেন না হয় সর্দার।
ততক্ষণে কিউকিলা জাহাজের পাশে দৈত্যরাজের মত মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার বিকট জমকালো মাথাটার উপরে আগুনের গোলার মত চোখটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
জাহাজের লোকজন কিউকিলাকে দেখবামাত্র ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলো, যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে লাগলো, কতকগুলো লোক ছুটলো ক্যাবিনের দিকে।
এক দন্ডে সেকি ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি হলো জাহাজখানা দুলছে ভীষণভাবে, যেন এইমাত্র ডুবে যাবে।
বনহুর তখন মারাত্নক আলোকরশ্মি স্তম্ভের মেশিনটা চালু করবার জন্য ক্ষিপ্রভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো ওদিক থেকে, বনহুর দেখলো, কিউকিলা তার দক্ষিণ হাতখানা বাড়িয়ে জাহাজের ডেক থেকে পলায়নরত একজন অনুচরকে সে হাতের মুঠায় তুলে নিলো। তীব্র একটা করুন আর্তনাদ ক্ষণিকের জন্য ভেসে এলো বনহুরের কানে।
কিউকিলা লোকটাকে মুখের কাছে তুলে ধরলো, অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝা গেলো লোকটাকে হত্যা করে রক্ত পান করছে দৈত্যরাজ।
বনহুর আলোকরশ্মি স্তম্ভের মেশিনটার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে মেশিনের মুখ কিউকিলার দিকে ফিরিয়ে নিলো।
রহমান তার অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সর্দারকে সতর্ক করে দিচ্ছিলো। হঠাৎ যেন কোনো ভুল না হয়। সে জানে, আলোকরশ্মি স্তম্ভের আলো কতখানি মারাত্মক। এত বিপদ মুহূর্তেও রহমান তার সর্দারকে ছেড়ে কিছুতেই চলে যেতে পারছিলো না। সেও সর্দারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো।
বনহুর তখন কৌশলে আলোকরশ্মির মুখ কিউকিলার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে মুখের আবরণ উন্মোচন যন্ত্রটি টিপে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একটি নীলাভ তীব্র আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়লো কিউকিলার দেহে।
বনহুর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভের মেশিনের সুইচ টিপে চললো। স্পীড যতই বাড়িয়ে দিতে লাগলো ততই আলোকরশ্মি সমুদ্র বক্ষে যেন আগুন ধরিয়ে দিলো। কিউকিলা হাতের মৃতদেহটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ডুব দিলো। আর এক মুহূর্ত সে আলোকরশ্মির সম্মুখে স্থির থাকতে পারলো না।
জাহাজখানা তখন ভয়ানকভাবে দুলছে।
বনহুর সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভের সুইচ অফ করে দিলো। তারপর মেশিন বন্ধ করে দ্রুত চলে গেলো ক্যাপ্টেন বোরহানের ক্যাবিনে। তখনই জাহাজ ছাড়বার জন্য আদেশ দিলো বনহুর।
বনহুরের নির্দেশমত জাহাজ এবার উত্তর-পশ্চিম দিকে এগুতে লাগলো। স্পীডে জাহাজ চালাবার জন্য আদেশ দিলো সে। কিউকিলা যে স্থানে তলিয়ে গেছে ঐ স্থান ত্যাগ করা তাদের এখন নিতান্ত প্রয়োজন।
বনহুরের দেহে এক উন্মাদনার ছাপ, ঘামে চুপসে গেছে তার সমস্ত জামা-কাপড়। সুন্দর মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে।
একজনকে হারানোর ব্যথা বনহুরের মনে আঘাত করছিলো। না জানি কোন্ ব্যক্তি আজ কিউকিলা হস্তে প্রাণ দিলো। এখনও কেউ জানেনা কে সে হতভাগ্য অনুচর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহী’ ঝাঁম সমুদ্রের অদূরে ঝম পর্বতের নিকটে পৌঁছে গেলো। এখানে জাহাজ নোঙর করার জন্য প্রস্তুতি নিলো কিন্তু এখনো তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়–কথাটা জানিয়ে দিলো বনহুর সবাইকে।
সেদিন সমস্ত রাত অনিদ্রায় কাটলো বনহুর এবং তার অনুচরগণের। সতর্কতার সঙ্গে সকলে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে চারদিকে লক্ষ্য রাখলো। বনহুর চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছে। হঠাৎ যদি কিউকিলা এখানে এসে পড়ে তাহলে আর রক্ষা নেই, কাজেই পূর্ব হতে প্রস্তুত রইলো সে।
রাত ভোর হয়ে এলো একসময়।
উপস্থিত বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন সকলে কিন্তু প্রত্যেকের মনেই ভয়ানক দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। গত রাতে তারা একজন সঙ্গীকে হারিয়ে একেবারে ভীত হয়ে পড়েছে। ভিতরে ভিতরে সকলে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও প্রকাশ্যে কেউ সাহস পেলো না কারণ জানে তারা, তাদের সর্দার দস্যু বনহুর সাধারণ ব্যক্তি নয়। যদি কোনোক্রমে বুঝতে পারে কেউ তার দলে বিদ্রোহী হয়েছে বা ঐ রকম মনোভাব পোষণ করছে, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। তাদের সর্দার যেমন মহৎ তেমনি কঠিন। প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
একবার এক ঘটনা ঘটে ছিলো, বনহুরের অনুচরদের মধ্য হতে একজন বেরিয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছিলো অন্য এক দস্যুদলে।
জানতে পেরেছিলো বনহুর, আদেশ দিয়েছিলো রহমানকে–এই মুহূর্তে তোমরা তাকে পাকড়াও করে এনে দাও।
সর্দারের আদেশে রহমান কয়েকজন সঙ্গীসহ বেরিয়ে পড়ছিলো সেই পলাতক অনুচরটির সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অনুচরটিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তারা। ধরে আনে বনহুরের নিকটে। বনহুর তাকে প্রকাশ্য দরবারকক্ষে তার অনুচরগণের সম্মুখে কুকুরের মত গুলীকরে হত্যা করেছিলো। এমনি আরও কত হত্যা বনহুর করেছে যা অনুচরদের মনে গভীর এক ভীতির সঞ্চার করেছে।
মনে মনে সবাই কিউকিলার জন্য ভয়াতুর হলেও প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস পেলো না। তবে রহমানকে জানালে তারা সমুদ্রবক্ষে এভাবে আর থাকতে পারবে না।
রহমান তাদের বুঝাতে লাগলো, সর্দার কিউকিলা হত্যা না করে কিছুতেই যাবে না, কাজেই তাদের অপেক্ষা করতেই হবে মৃত্যু হলেও বিমুখ হওয়া চলবে না।
বাধ্য হয়ে নীরব রইলো শাহীর লোকজন।
আবার কয়েকদিন কিউকিলার কোনো আবির্ভাব ঘটলো না। ঝাঁম শহরবাসী কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে এসেছে।
মোহন্ত সিন্ধু কন্যাসহ এলেন বনহুরের সঙ্গে দেখা করতে। সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছে মালার, কিউকিলা যদি আর না আসে তাহলে দেবরাজকে হারাতে হবে না। মালা পরপর কয়েকদিন শিবের পূজা করে চলেছে তার প্রার্থনা—দেবরাজকে যেন সে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পায়।
মোহন্ত সিন্ধু মালাকে নিয়ে মোটর-বোট যোগে শাহীতে এসে হাজির হলেন।
অভিনন্দন জানালো বনহুর মহারাজ এবং তার কন্যা মালাকে। মালার চোখেমুখে খুশির উচ্ছ্বাস সে বনহুরের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো–দেবরাজ আর কিউকিলা আসবে না। আমি শিবপূজা করে কিউকিলার ধ্বংস কামনা করেছি।
বনহুর অবাক হয়ে তাকালো মালার মুখের দিকে, মালা বলে কি!
বনহুরকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বললেন মোহন্ত সিন্ধু মালা প্রতিদিন শিবিরে পূজা করে প্রার্থনা জানিয়েছে, কিউকিলাকে তিনি যেন ধ্বংস করে ফেলেন।
হাসলো, বনহুর, মালার সরল মনের পরিচয় পেয়ে সে মুগ্ধ হলো।
ঐ দিন বনহুর সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করবে, কাজেই মোহন্ত সিন্ধু কন্যাসহ শাহী জাহাজে রয়ে গেলেন। ঝাঁম সর্দার তার দলবল নিয়ে আর একখানা মোটর-বোট নিয়ে হাজির হলো। ডুবুরিগণ আজ সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করবে না বটে কিন্তু বনহুরকে সাহায্য করার জন্য সবাই প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছে।
বনহুর ডিনামাইট সংগ্রহ করে ফেলেছে ক’দিনের মধ্যে। একটি নয়-তিনটি ডিনামাইট বসাবে বনহুর সমুদ্র তলে কিউকিলার বাসস্থলে কিন্তু তার পূর্বে তাকে আর একবার সমুদ্রতলে যেতে হবে। কারণ এখন্ও দৈত্যরাজ কিউকিলার বাসস্থান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।
বনহুর একসময় ডিনামাইটগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলো। এমন সময় মালা তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো বনহুর।
মালা বললো কি করছো দেবরাজ?
ডিনামাইটগুলো পরীক্ষা করে দেখছি।
ডিনামাইট! সে আবার কি দেবরাজ?
বনহুর মালাকে বললো–বস মালা, তোমাকে বুঝিয়ে বলছি।
মালা বসলো।
বনহুর নিজে মালার সম্মুখে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলতে লাগলো–মালা, তুমি শিবের পূজা করেছিলে না।
হাঁ, করেছিলাম।
তোমার শিব ঠাকুর এগুলো দিয়েছেন।
অবাক হয়ে বললো মালা–আমার শিব ঠাকুর এগুলো দিয়েছেন বলে কি?
কেন বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?
শিবঠাকুর যে পাথরের মূর্তি–কি করে এগুলো দেবেন তিনি তোমাকে?
বনহুর ভ্র জোড়া টান করে একটু হেসে বললো–কেন তোমার শিবঠাকুরের প্রাণ নেই?
মালা খিল খিল করে হেসে উঠলো–পাথরের মূর্তির আবার প্রাণ থাকে নাকি!
বলো কি মালা, শিবের প্রাণ নেই?
না না।
তবে তার পূজো করো কেন তোমরা?
দেবতা, সেজন্য?
যে দেবতার প্রাণ নেই, সে দেবতা কি করে তোমার কিউকিলাকে হত্যা করবে বলো?
দেবতার অদৃশ্য শক্তি আছে, সে শক্তি দ্বারা সে কিউকিলাকে হত্যা করবে।
হেসে উঠলো বনহুর হো হো করে–যে শিবের প্রাণ নেই তার আবার শক্তি আছে না কি? মালা শিবের পূজো করে কোনো ফল হবে না। আমি তোমাদের দৈত্য কিউকিলাকে হত্যা করবো।
না না, তুমি মানুষ হয়ে এমন কাজ পারবে না।
মালা–আমার খোদা আছেন, যার অসীম শক্তি–তিনি আমাকে সাহায্য করবেন।
খোদা! কে খোদা? তোমার কোনো বন্ধু বুঝি?
শুধু আমার নয় সমস্ত পৃথিবীতে যত জীব আছে সবার তিনি বন্ধু।
তোমার সঙ্গে আজ তিনি সমুদ্রবক্ষে নামবেন?
হাঁ নামবেন, তিনি সবসময় আমার সঙ্গে থাকবেন।
বনহুর লক্ষ্য করলো, তার কথায় মালার মুখ দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হয়তো সে ভাবলো, যাক, তার দেবরাজ একা সমুদ্রগর্ভে নামবে না। আশ্বস্ত হলো যেন মালা অনেকটা, বনহুরের কন্ঠ আবেষ্টন করে ধরলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের অনুচর ফরিদ সেই ক্যাবিনে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ফিরে এলো সে–এমনভাবে তার সর্দারের কণ্ঠ মালাকে বেষ্টন করে ধরতে দেখে লজ্জায়-ক্ষোভে গনগন করতে লাগলো। ফিরে গেলো সে রহমানের পাশে।
রহমান ফরিদকে এমনভাবে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে বললো–সর্দারকে বলেছো সব প্রস্তুত।
ফরিদ ঢোক গিলে বললো–রহমান ভাই একটা কথা!
রহমান ফরিদের মুখোভাব লক্ষ্য করে বিস্মিত হলো, বললো কি কথা বলবি ফরিদ?
এদিকে এসো বলছি।
রহমান হাতের কাজ রেখে উঠে দাঁড়ালো, তার আশেপাশে আরও লোকজন ছিলো কাজেই সে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।
ফরিদ চারদিক সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফিসফিস করে বললো–মালার সঙ্গে সর্দারের প্রেম হয়ে গেছে রহমান ভাই।
অস্ফুট কন্ঠে বললো রহমান–প্রেম!
হাঁ মালা আর সর্দারকে একসঙ্গে দেখলাম, শুধু তাই নয় যা দেখলাম বলা চলবেনা, জানো রহমান ভাই—
রহমান তার সর্দারকে জানে, তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করতে দেখে সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো দৃঢ়মুষ্টিতে চেপে ধরলো ফরিদের গলা।
ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর আর মালা এসে দাঁড়ালো সেখানে। বনহুর আর মালাকে দেখেই রহমান ফরিদকে মুক্ত করে দিলো।
ফরিদ রহমানের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রীতিমত হাঁপাতে লাগলো,
রহমান একবার তাকালো সর্দারের পাশে দন্ডায়মান মালার দিকে, তারপর সর্দারের মুখে।
বনহুর বললো–কি হয়েছিলো রহমান?
কিছু না সর্দার। বললো রহমান।
বনহুর ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো–ফরিদকে ওভাবে গলা টিপছিলে কেন?
রহমান মাথা চুলকাতে লাগলো।
এমন সময় মোহন্ত সিন্ধু ও ক্যাপ্টেন বোরহান এসে উপস্থিত হলেন।
ততক্ষণে ফরিদ অনেকটা সুস্থ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা আর এমন কি রহমানের কাছে মাঝে মাঝে তারা এমন সাজা পেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই ভুলে গেলো ফরিদ কিছুক্ষণের মধ্যে।
কিন্তু রহমানের মন থেকে মুছে গেলো না ব্যাপারটা, সর্দার সম্বন্ধে এমন উক্তি সে কোনোদিন শুনবে বলে আশা করেনি। মালার প্রতি একটা ক্রুদ্ধভাব জেগে উঠলো তার অন্তরে।
রহমান বনহুরের জন্য ডুবুরীর ড্রেস এবং সমুদ্র তলে নামার জন্য সাজ-সরঞ্জাম গুছাচ্ছিলো।
বনহুর আজ কিউকিলার আবাসস্থল দেখবার জন্য স্বয়ং সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করবে। এরপর যখন সে আবার সমুদ্রতলে নামবে তখন তার সঙ্গে থাকবে ডিনামাইট।
ডুবুরীদ্বয় বনহুরের জন্য ড্রেস এবং আসবাবপত্র পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলো।
মোহন্ত সিন্ধু ক্যাপ্টেন বোরহান আর বনহুর দাঁড়িয়ে দেখছে। বনহুরের কয়েকজন বিশিষ্ট অনুচরও আছে সেখানে মালা আজ বনহুরের পাশে অতি ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
রহমান কাজ করছিলো আর মাঝে মাঝে আড় নয়নে তাকিয়ে দেখছিলো মালার দিকে। যত রাগ হচ্ছিলো তার রাজা মোহন্ত সিন্ধু ও তাঁর কন্যা মালার উপর। আজ ঝাঁম রাজ্যকে বিপদমুক্ত করতে গিয়ে তাদের সর্দারকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে হচ্ছে। না জানি সর্দারের ভাগ্যে কি আছে, কিউকিলা হত্যা করতে গিয়ে নিজেই না নিহত হয়ে বসেন। তারপর মালা এসে সর্দারের গলায় মালার মতই জড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। রহমান নীরবে এসব দেখে গেলেও সহ্য করতে পারছিলো না যেন।
ডুবুরীদ্বয় সব কিছু করে দেখে নিলো। এবার বনহুর এগিয়ে এলো ড্রেস পরার জন্য। বনহুরের দেহ থেকে জামা খুলে ফেলা হলো।
বনহুরের দেহ থেকে বসন উন্মোচন করে ফেলার পর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলো। এমন কি রহমান বা অন্যান্য অনুচরও এর পূর্বে তারা তাদের সর্দারের দেহ সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় দেখেনি। এতো সুন্দর সুপুরুষ তাদের সর্দার–যেন কল্পনার বাইরে। পৌরুষদীপ্ত, বলিষ্ঠ বাহু, প্রশস্ত লোমশ বক্ষ, গভীর নীল দুটি চোখ, উন্নত নাসিকা–যেন অপূর্ব এক মূর্তি।
মালা নির্নিমেশ নয়নে তাকিয়েছিলো বনহুরের দিকে দৃষ্টি সে ফিরিয়ে নিতে পারছিলো না কিছুতেই। বনহুরের শরীরে তখন ডুবুরীর ড্রেস পরানো হচ্ছিলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই বনহুরের ডুবুরি ড্রেস পরা হয়ে গেলো। আজ বনহুর একাই সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করবে।
বনহুর মোটর-বোটে নেমে আসার পূর্বে নিজের ক্যাবিনে প্রবেশ করলো, বের করে নিলো ওয়্যারলেসটা। বনহুর ইচ্ছা করেই তার বাজুবন্ধের ক্ষুদে ওয়্যারলেসটা খুলে রাখে আজকাল। কারণ নূরীর লকেটে তার কণ্ঠস্বর ধরা পড়ে যে-কোনো মুহূর্তে–আর নূরী তাকে বিরক্ত করে সর্বক্ষণ।
ওয়্যারলেসে বনহুর নূরীর সঙ্গে আলাপ করে নেয় কিছুক্ষণ। তারপর বেরিয়ে আসে ক্যাবিন থেকে।
বনহুর এবার জাহাজ শাহী’ থেকে মোটর বোটে নেমে বসলো। আজও মোহন্ত সিন্ধু ও তাঁর কন্যা মালা বনহুরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো শাহীর ডেকে দাঁড়িয়ে।
বনহুরের মোটর বোটে দু’জন ডুবুরী দু’জন বনহুরের অনুচর আর রইলো রহমান। ওয়্যারলেস যন্ত্র, বাইনোকুলার, অক্সিজেন পাইপও রয়েছে। জাহাজের নিকট হতে যতই বনহুরের বোটখানা সমুদ্র বক্ষে সরে যাচ্ছে ততই মালার মুখ বিষণ্ণ মলিন হয়ে আসছে, হাত নাড়ছে মালা এবং মোহন্ত সিন্ধুর।
বোটে দাঁড়িয়ে বনহুরও হাত নাড়ছে।
কে জানে এই তার শেষ বিদায় কি না!
*
গভীর সমুদ্রতলে আজ বনহুর সম্পূর্ণ একা।
জীবননাশের ভয়ে আতঙ্কিত ডুবুরীদ্বয় লক্ষ টাকার বিনিময়েও কিউকিলার আবাসস্থলের সন্ধানে সমুদ্রগর্ভে নামতে রাজি হয়নি।
বনহুর অবশ্য ইচ্ছা করলে ডুবুরীদ্বয়কে সঙ্গী করে নিতে পারতো তার বজ্র কঠিন কণ্ঠস্বর বাধ্য করতো ওদেরকে কিন্তু বনহুর ইচ্ছা করেই ডুবুরীদ্বয়কে ক্ষমা করে দিয়েছে, কারণ সে জানে ওরা যা ভয় পেয়েছে সেটা সত্যও হতে পারে, মৃত্যু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই ডুবুরীদ্বয়কে আজ না নিয়ে, একাই সে অবতরণ করেছে সমুদ্রগর্ভে।
যতই গভীর জলের তলে নেমে চলেছে বনহুর ততই আরও বিস্মিত হচ্ছে। জীবনে সে বহু কিছু দেখেছে কিন্তু এমন আশ্চর্য বস্তু এবং জীব দেখেনি; কতরকম মাছ, কতরকম কাঁকড়া, শামুক, হাঙ্গর, কুমীর তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বনহুর চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছে, লক্ষ্য করছে। দূরে অনেক দূরে–উদ্দেশ্য-কিউকিলার আবাসস্থল খুঁজে বের করা।
সাঁতার কেটে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বনহুর, তার কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা, একটি নয় কয়েকটি। একটি ছোরা সবসময় তার হাতের মুঠায় রয়েছে।
ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে এতোক্ষণ একটি জীবও তাকে আক্রমণ করেনি বা তার সম্মুখে এসে পড়েনি। সমুদ্রতলে নানা জাতীয় জলীয় উদ্ভিদ, বড় বড় পাথরখন্ড আর নানারকম সেগুলো নজরে পড়ছে। কোথাও বা পাহাড়ের মত উঁচু-নীচু ঢিবি। এক একটা ঢিবি প্রায় তিন-চার তলা বাড়ির সমান উঁচু। বনহুর দূর থেকে এই সব ঢিবির উপর লক্ষ্য রেখে এগুতে লাগলো।
কত ফিট নিচে নেমেছে বনহুর মিটারে দেখে নিলো। চমকে উঠলো সে, এতো নিচে গভীর সমুদ্রতলে কোনো ডুবুরী নামতেও সাহসী হবে না। বনহুরের বুক এতোটুকু কাঁপলো না বা সে বিচলিত হলো না। বাইনোকুলার চোখে দিয়ে সমুদ্রতল নিরীক্ষণ করে চললো! ধীরে ধীরে সাঁতার। কেটে এগুচ্ছে বনহুর। একস্থানে নজরে পড়লো, কি সুন্দর ফুলের মত কতকগুলো জলীয় উদ্ভিদ গভীর জলের তলায় রূপালী গাছের মত ঝকমক করছে। কতকগুলো বরফের ফুলের মত সাদা ধপ ধপে। মুগ্ধ হয়ে গেলো সে, এতো মনোমুগ্ধকর জলীয় উদ্ভিদ বনহুর কোনোদিন দেখেনি। বৈচিত্রময় পৃথিবীর অভ্যন্তরেও রয়েছে কত বিচিত্র রূপধারা। ইচ্ছা হলো এই উদ্ভিদগুলো সে তুলে। নেয়, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো তার, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় এ নয়।
বনহুর ভেসে উঠলো কয়েক ফিট উপরে, দিকদর্শন যন্ত্রে লক্ষ্য করে দেখে নিলো এখন সে কোন্ দিকে এগুচ্ছে। বনহুরের ড্রেসের সঙ্গেই ছিলো সবরকম জলীয় যন্ত্রপাতি। যাতে তার কোনোরকম অসুবিধা না হয়।
কিছুটা অগ্রসর হতেই একটা বিরাট অজগর ভেসে এলো তার দিকে। সে কি ভয়ঙ্কর আর মস্ত বড় দেহ। এবার বনহুর ভয় পেলো, শিউরে উঠলো সে। মস্ত বড় হা করে এগিয়ে আসছে। অজগরের চোখ দুটো যেন টর্চলাইটের বালুবের মত জ্বলছে।
গভীর জলের তলায় না হলে বনহুর এতোখানি ঘাবড়ে যেতো না কিন্তু এখন তার ভাববার সময় নেই। বনহুর ছোরাখানা বাগিয়ে ধরে প্রস্তুত হয়ে নিলো, এক মুহূর্ত বিলম্ব হলে সর্পরাজ তাকে গ্রাস করে ফেলবে।
যদিও বনহুরের হাতে সূতীক্ষ ধার ছোরা ছিলো তবু অজগরটিকে লক্ষ্য করে বনহুর ভীত হলো। এবার অজগরের কবল থেকে তার রক্ষা নেই, বুঝতে পারলো সে। বনহুর সাঁতার কেটে অজগরের লক্ষ্যের বাইরে যাওয়ার জন্য দ্রুত সরে যেতে লাগলো, কিন্তু সর্পরাজ তার বিপুল বিরাট দেহ নিয়ে আঁকা বাঁকা হয়ে তীরবেগে ভেসে আসছে।
বনহুর মরিয়া হয়ে সাঁতার কাটছে, অসীম জলরাশি ঠেলে প্রাণ পণে অজগরের দৃষ্টির আড়ালে সরে যাবার চেষ্টা করছে সে। আর বুঝি বাঁচতে পারলো না, ক্রমান্বয়ে হাত পা কেমন অবশ হয়ে। আসছে তার। শিথিল হয়ে আসছে তার বাহু দুটি। এতোক্ষণ দক্ষ সাতারুর মত সাঁতার কেটে এগুচ্ছিলো, হঠাৎ তার শরীরের সঙ্গে কি যেন জড়িয়ে গেলো। বনহুর লক্ষ্য করতেই ভয়ে আড়ষ্ট হলো, জলীয় উদ্ভিদের শিকড়ের সঙ্গে আটকে পড়েছে তার দেহটা।
বনহুর এবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো, অজগর সাপটা ভেসে ভেসে আসছে। তার বিরাট হার মধ্যে খাড়ার মত তীক্ষ্ণ দুটি দাঁত আর তরবারির মত লক লকে জিহ্বা। বনহুর বিমর্ষ মুখে তাকালো সর্প রাজের দিকে। সমস্ত দেহ তখন তার জলীয় উদ্ভিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে মাকড়সার জালের মত।
ডুবুরীর ড্রেসের মধ্যেও বনহুরের শরীর ঘেমে উঠেছে, ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল। দক্ষিণ হস্তের ছোরাখানা এটে ধরে হাঁপাচ্ছে সে।
বনহুর এবার ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেললো। গভীর সমুদ্র বক্ষে আজ তার এইভাবে মৃত্যু ছিলো কে জানতো।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছে বনহুরের অনুচরগণ আর মহারাজা মোহন্ত সিন্ধু ও তার কন্যা মালা।
বোটের উপরে রহমান ও ডুবুরীদ্বয় আতঙ্কভরা হৃদয় নিয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারা জানে না, তাদের সর্দার এই মুহূর্তে সমুদ্রতলে কি অবস্থায় রয়েছে।
বনহুর নিজের শরীর থেকে জলীয় উদ্ভিদের শিকড়গুলো ছাড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করলো না; কারণ সে বুঝতে পেরেছে, চেষ্টা করে কোনো ফল হবে না। হাত পা অবশ হয়ে এলো বনহুরের নিজকে প্রস্তুত করলো সর্পরাজের উদরে প্রবেশের জন্য।
সত্যি এ দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর!
দস্যু বনহুর আজ ঝাঁম সমুদ্রের তলদেশে একটি সর্পরাজের উদর পূর্ণ হতে চলেছে। তার মাত্র কয়েক হাত দূরে এসে পড়েছে সর্পরাজ।
বনহুর একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নিলো। চোখের সম্মুখে ঝরে পড়লো সহস্র ফুলঝুরি। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো সে প্রাণপনে।
ঠিক ঐ মুহূর্তে বনহুরের দেহে জলতরঙ্গের প্রচন্ড আঘাত এসে লাগলো। ভয়ঙ্করভাবে দুলে উঠলো তার দেহটা। তবে কি সর্পরাজ তার দেহটাকে ভক্ষণ করে ফেললো। বনহুর অতি কষ্টে আবার চোখ মেলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো, বিরাট একটা তিমি মাছের সঙ্গে সর্পরাজের যুদ্ধ বেঁধে গেছে।
সর্পরাজ এগিয়ে আসছিলো, প্রায় বনহুরের কাছাকাছি এসে পড়েছে এমন সময় একটা তিমি আচমকা আক্রমণ করে বসেছে সর্পরাজকে।
মৎস্যরাজ সর্পরাজের লেজের দিকে প্রায় অর্ধেকটা গিলে ফেলেছে। বাকি অর্ধেকটা নিয়ে ভীষণ তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে সর্পরাজ।
অজগরের শিকার হলো দস্যু বনহুর।
আর তিমি মাছটার শিকার হলো অজগর। তিমির মুখ-গহ্বর থেকে অজগর প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মৎস্যরাজ অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, সে কিছুতেই সর্পরাজকে ছেড়ে দেবে না, ভীষণ যুদ্ধ চলেছে দু’জনার মধ্যে।
বনহুর খোদার কাছে প্রাণ ভরে শুকরিয়া করে নিলো। আর মুহূর্ত বিলম্ব করলো না সে, দ্রুতহস্তে কেটে ফেলতে লাগলো নিজের দেহের শিকড়গুলো। এতোক্ষণে আবার যেন সে ফিরে পেয়েছে পূর্ব শক্তি, সজীব হয়ে উঠেছে তার অসাড় দেহটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনহুর জলীয় উদ্ভিদের আঠালো শিকড় থেকে নিজকে মুক্ত করে নিতে সক্ষম হলো।
একবার বনহুর তাকিয়ে দেখলো, তিমি মৎসের উদরে অজগরের দেহের তিন ভাগ অংশ প্রবেশ করেছে। অজগরটা মরিয়া হয়ে বার বার হা করছে। নিজকে রক্ষা করার জন্য সে কি আকুলতা। একটু পূর্বে স্বয়ং দস্যু রাজের যে অবস্থা হয়েছিলো ঠিক সেই অবস্থায় পড়েছে সর্পরাজ।
বনহুর আর বিলম্ব না করে অতিদ্রুত সাঁতার দিয়ে ভেসে উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে এখন হাজার হাজার ফিট গভীর জলের তলায় রয়েছে।
তবু আপ্রাণ চেষ্টায় তিমিটার দৃষ্টির আড়ালে সরে যেতে প্রয়াস নিচ্ছিলো সে।
বনহুরের ডুবুরী ড্রেসের সঙ্গে ছিলো দ্রুত সাঁতার কাটার অদ্ভুত যন্ত্র। যার দ্বারা বনহুর গভীর জলের তলে অনায়াসে সাঁতার কাটতে সক্ষম হচ্ছিলো বনহুর সেই সাতারু যন্ত্রের দ্বারা কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক দূরে এসে পড়লো।
হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি পথ রোধ হয়ে গেলো যেন। বিরাট একটা পাহাড় তার সম্মুখে দেখতে পেলো সে। উঁচু-নীচু স্থানে স্থানে গর্তের মত গোল ছিদ্রপথ রয়েছে। নানা রকম মাছ ঝাক ঝাক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গর্তের মধ্যে এবং আশে পাশে। বড় বড় চাঁদা মাছও রয়েছে, প্রায় এক একটা বিশ পঁচিশ হাত প্রশস্ত, দেহটা রূপালী কানগুলো ঠিক সোনালী পর্দার মত।
বনহুরকে দেখে মাছগুলো ছুটে ছুটে পালাতে লাগলো। আর কত রকম মাছ, ছোট বড় নানা রকমের। পাহাড়টার গায়ে সেঁওলা জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে মাছগুলো সেইসব সেঁওলা খাচ্ছিলো।
বনহুর ডুবন্ত পাহাড়ের উঁচু নীচু গা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলো। সুন্দর মনোমুগ্ধকর রং বেরং এর মাছ তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো। কতরকম ঝিনুক-সোনালী-রূপালী-হলদে। কতকগুলো ঠিক ফুলের মত দেখতে। বনহুর কয়েকটা সুন্দর ঝিনুক তার পোশাকের পকেটে তুলে নিলো। ছোট ছোট ফুলের কুঁড়ির মত ঝিনুকগুলো থেকে একরকম নীলাভ আলো ঠিকরে বের। হচ্ছিলো। বনহুর বুঝতে পারলো, এসব ঝিনুক থেকেই ডুবুরিগণ উজ্জ্বল মুক্তা উদ্ধার করে থাকে।
আপন মনে এগুচ্ছে বনহুর। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেলো দূরে, একটা ফাটলের মত বড়। গর্তের মধ্যে জমকালো কিছু নজরে পড়লো। বনহুর সাঁতার কাটা বন্ধ করে চুপ হয়ে দাঁড়ালো, বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো, বনহুরের নিকট থেকে অন্ততঃ পক্ষে পঞ্চাশ গজ দূরে ডুবন্ত পাহাড়টার গায়ে সেই বিরাট ফাটল। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি ফেলতেই স্তম্ভিত বিস্মিত হলো বনহুর, বিরাট ফাটলটার ভিতরে একটা বিরাট দেহ গুটি গুটি মেরে শুয়ে আছে। তবে কি সেই জলদানব কিউকিলা। বনহুরের মন আশায়-আনন্দে নেচে উঠলো, মনের সন্দেহ দূর করবার জন্য আরও কিছুটা অগ্রসর হলো সে। এবার অতি ধীরে লঘুভাবে সাঁতার কাটছে বনহুর। তার চোখেমুখে বিপুল উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠেছে। কিছুটা অগ্রসর হতেই বনহুর আপন মনেই অস্ফুট শব্দ করলো, এটাই কিউকিলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বনহুর আর বিলম্ব না করে উপরের দিকে সাঁতার কেটে ভেসে উঠতে লাগলো। সাঁতারু মেশিনের স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছে বনহুর। ঘড়িতে দেখে নিলো, পুরো তেরো ঘন্টা সে সমুদ্রবক্ষে গভীর জলের তলায় ছিলো।
বনহুর যখন সমুদ্রতল হতে উপরে ভেসে উঠলো তখন মোটর বোটখানা তার নিকট হতে প্রায় মাইল দুয়েক দূরে ছিলো। রহমানের চোখে ছিলো দূরবীক্ষণ যন্ত্র, সে চারদিকে ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে অন্বেষণ করে ফিরছিলো। এতোক্ষণও সর্দারকে ফিরে আসতে না দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো রহমান ও তার দলবল।
জাহাজ শাহী’তেও মোহন্তসিন্ধু ও মালা ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছেনা জানি সমুদ্রগর্ভে দেবরাজ এখন কি করছে। ক্যাপ্টেন বোরহান এবং বনহুরের অন্যান্য অনুচর সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে, সমুদ্রগর্ভে এতে বিলম্ব হচ্ছে কেন? তবে কি কিউকিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে?
রহমান বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে, সে বোটের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা সর্বক্ষণ সমুদ্রবক্ষে নজর রেখেছে, কখন কোথায় ভেসে উঠবে। কোনো মুহূর্তে সে বিশ্রাম গ্রহণ করেনি। সর্দারকে বিদায় দেবার পর থেকে সবসময় উদ্বিগ্ন চিত্ত নিয়ে প্রতীক্ষা করছে–কখন তার আবির্ভাব ঘটবে।
বনহুর যখন সমুদ্রবক্ষে ভেসে উঠলো তখন জাহাজ এবং মোটর বোটখানা তার নিকট হতে বহুদূরে। জাহাজ ও মোটরবোট থেকে কেউ তাকে দেখতে পেলো না।
সাঁতার কেটে এগুচ্ছে বনহুর। যদিও তার ড্রেসের সঙ্গে সাঁতার কাটার জন্য সহজ স্পীড মেশিন ফিট করা ছিলো তবু সমুদ্রতলে অক্সিজেন নিয়ে বহুক্ষণ কাটানোর দরুণ বনহুর বেশ নার্ভাস বোধ করছিলো।
সমুদ্রবক্ষে ভেসে উঠার পর প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেলো তবু সন্ধান নেই কারো। শাহী’ জাহাজখানা তো এখন বহুদূরে। রহমান মোটরবোট নিয়ে চারদিকে খুঁজে ফিরছে, কিন্তু যেখানে বনহুর সাঁতার কেটে এগুচ্ছে সেখানে কেউ সন্ধান পায়নি এখনও।
মোহন্ত সিন্ধু ও মালা শাহী’ থেকে নেমে এসেছে দ্বিতীয় একটি মোটরবোটে। তারাও উদ্বিগ্ন হৃদয় নিয়ে খুঁজে ফিরছে দেবরাজকে। মালা তো প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে, তার মুখে একটা দুশ্চিন্তার চাপ পড়েছে না জানি সমুদ্রতলে তার কি হলো।
মালাও চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে চারদিকে দেখছে। মনের মধ্যে ঝড় বইছে যেন ওর, দেবরাজকে না পেলে ও যেন বাঁচবে না!
মালার আঁচলখানা বাতাসে পত্ পত্ করে উড়ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে কাঁধে, পিঠে, ঘাড়ে, চোখে, মুখে। করুণ বিষণ্ণ মুখমন্ডল, চোখে ব্যাকুল চাহনি। ঠোঁট দুটো সমুদ্রের উষ্ণ বাতাসে শুকিয়ে উঠেছে চটচটে হয়ে। বৃদ্ধ মোহন্ত সিন্ধুর চোখমুখেও আশঙ্কার ছাপ ফুটে উঠেছে।
রহমানের বোটের সঙ্গে মিলিত হলো মোহন্ত সিন্ধুর মোটর বোটখানা। উভয় বোটের আরোহীই যখন বনহুরের সন্ধান লাভে বিমুখ হয়ে পড়েছে তখন হঠাৎ মালার বাইনোকুলারে ধরা পড়লো, দূরে অনেক দূরে বনহুর সাঁতার কেটে আসছে।
মালা আনন্দধ্বনি করে উঠলো–বাবা ঐ দেখো দেবরাজকে দেখা যাচ্ছে।
বলো কি মালা?
হাঁ বাবা। মালা নিজ হস্তে পিতার চোখে বাইনোকুলার ধরলো।
রহমানও দেখলো মালা ঠিকই বলেছে, খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখমন্ডল। আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে সে বনহুরের দিকে মোটর বোটের মুখ ফিরিয়ে ষ্টার্ট দিলো।
মালাও তার বোটের চালককে রহমানের বোটখানাকে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিলো। দু’খানা বোট স্পীডে এগিয়ে চললো। উত্তাল তরঙ্গের ফেনিল জলরাশির বুকে বোট দু’খানা যেন পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
বনহুরও সাঁতার কেটে এগুচ্ছিলো, কিছুক্ষণেই রহমান এবং মোহন্ত সিন্ধুর বোট পৌঁছে গেলো তার পাশে! রহমানও তার সঙ্গী ডুবুরীদ্বয় বনহুরকে তুলে নিলো।
মোহন্ত সিন্ধু ও মালা দ্বিতীয় বোট থেকে নেমে এলো রহমানের বোটে। তারপর জাহাজে ফিরে এলো সবাই মিলে। আবার জাহাজে আনন্দ উৎসব বয়ে চললো।
বনহুরের অনুচরগণ সর্দারকে ফিরে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো। রাজা মোহন্ত সিন্ধুর আনন্দ যেন ধরছে না। মালাতো কি বলে বনহুরকে অভিনন্দন জানাবে তার ঠিক নেই। সে বনহুরকে কাছে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই যখন শুনলো পুনরায় বনহুরকে সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করতে হচ্ছে, তখন সে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লো। বনহুর আর বিলম্ব করতে রাজি নয়, সে কিউকিলার আবাসস্থল আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। তখনই প্রস্তুত হয়ে নেবার জন্য রহমানকে ডিনামাইটগুলো আনতে আদেশ করলো।
বনহুর কিভাবে ডিনামাইট বসাবে এ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক মিঃ ফিরার্ড এর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে নিলো কিছুক্ষণ। একটি নয় তিনটি ডিনামাইট বসাতে হবে। কারণ একটি দিয়ে কিউকিলার আবাসস্থল ডুবন্ত পাহাড়টা ধ্বংস নাও হতে পারে। কিউকিলা যদি আহত হয় তাহলে সে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সংক্ষেপে বনহুর সমস্ত কথাই প্রকাশ করলো তার প্রধান অনুচর রহমান, রাজা মোহন্ত সিন্ধু এবং অন্যান্য সকলের নিকটে। মালাতো শুনে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বনহুরের অনুচরগণ ভয় প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো, শিউরে উঠলো তাদের, দস্যুপ্রাণ।
মোহন্ত সিন্ধুর মুখমন্ডল বিবর্ণ-ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। তিনি যেন এসব কল্পনাই করতে পারেন না। সাগরতলে যে এমন সব ভয়ঙ্কর জীব বাস করে তাও যেন তার চিন্তার বাইরে।
মোহন্ত সিন্ধু সব শোনার পর ভয়াতুর কণ্ঠে বললেন–কিউকিলা আমার সব ধ্বংস করুক। তবু আমি তোমাকে আর যেতে দেবো না দেবরাজ। অমন ভয়ঙ্কর স্থানে গেলে আর তুমি ফিরে আসবে না।
বনহুর মৃদু হেসে বললো-মহারাজ, আপনি দেশের রাজা। আপনার মুখে সাজে না এমন কথা। আজ ঝাঁম রাজ্যের প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর সম্মুখীন। আপনার নিজ জীবনেরও বিশ্বাস নেই মহারাজ।
তবু–তবু তোমার মত একটি ছেলেকে হারাতে মন আমার চায় না দেবরাজ।
মোহন্ত সিন্ধু আর বনহুরের মধ্যে যখন এই কথাবার্তা চলছিলো তখন রহমান ডিনামাইট নিয়ে আসে। সে নিজেও সর্দারকে মৃত্যুগুহায় পাঠাতে রাজি নয় কিন্তু রহমান জানে, কোনো বাধাই সর্দারকে তার কার্য থেকে ক্ষান্ত করতে সক্ষম হবে না; কারণ সে জানে, কিউকিলা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকাকালে তার বাসস্থানের ভিতরে ডিনামাইট বসাতে হবে। হঠাৎ জেগে উঠলে ডিনামাইট বসানো তো দূরের কথা–মৃত্যু সুনিশ্চিত। কিউকিলাকে বনহুর ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে এসেছে, তার ঘুম ভাঙবার পূর্বেই তাকে কাজ সমাধা করতে হবে।
বনহুর তার ডুবুরী ড্রেসের ভিতরে ডিনামাইট নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলো। প্রত্যেকটা ডিনামাইটের সঙ্গে থাকবে ইলেকট্রিক তারের সংযোগ, সুইচ থাকবে জাহাজে। বনহুর ডিনামাইটটি ফিট করে ফিরে আসার পর সুইচ টিপে দিলেই ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটবে। সঙ্গে ধ্বংস হবে কিউকিলার বিরাট দেহটা।
সকলের বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে বনহুর সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করলো। শাহী জাহাজ এবং কয়েকখানা মোটারবোট বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়লো সমুদ্রবক্ষে। বনহুরের বিশ্বস্ত অনুচরগণের প্রত্যেকের চোখেমুখেই আজ এক বিপুল উন্মাদনার ছাপ। সর্দার গভীর জলের তলদেশে যমদূতকে হত্যা করতে চলছে। ঝাঁমবাসীদের রক্ষা করার জন্য তার এ অসীম প্রচেষ্টা। কে জানে তার এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে কি না।
ক্রমান্বয়ে বনহুর নেমে চলেছে নিচের দিকে। মিটারে দেখে নিচ্ছে কত ফিট জলের তলায় এখন সে আছে। বনহুরের কভারে ঢাকা মুখমন্ডলে কঠিন কর্তব্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। যেমন করে হোক তাকে কার্যোদ্ধার করতেই হবে।
যতই গভীর জলমধ্যে নেমে আসছে ততই বনহুর নিজকে কঠিন সংযত করে নিচ্ছে, মৃত্যুকে যেন জয় করতে পারে। তার চারপাশ কেটে চলে যাচ্ছে কতরকম মাছ, কতরকম জলজীব। তাকে দেখে জলজীবগুলো আশ্চর্য হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কাটছে হয়তো ভাবছে, সেও তাদেরই একজন! কতকগুলো ছোট মাছ ঝাঁক ধরে এগিয়ে আসছিলো, বনহুরকে দেখামাত্র ছুটে পালিয়ে গেলো। হয়তো তাকে ভয়ঙ্কর কোনো শত্রু মনে করে থাকবে ওরা।
বনহুর আপন মনে হাসলো।
আজ বনহুর সাবধানে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। তার পিঠে বাঁধা স্পীড মেশিনটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু দিয়ে এগুচ্ছে বনহুর। নানা জাতীয় জলীয় উদ্ভিদ এড়িয়ে ডুবন্ত ছোট ছোট পাহাড়গুলোর মাথার উপর দিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত জীব এসে তার পথরোধ করলো। বনহুর এরকম জীব দেখেনি কোনোদিন, নামও জানে না। জীবটা ঠিক গোল ফুটবলের মত কিন্তু আকারে অনেক বড় প্রায় ফুটবলের চেয়ে দু’শ গুণ বড় হবে। গোলাকার জীবটার দেহে কোনোরকম হাত-পা বা লেজ নেই, নেই কোনো মাথার চিহ্ন। দেহটার সম্মুখভাগে মার্বেলের মত ক্ষুদে ক্ষুদে দুটো চোখ, চিংড়ি মাছের চোখের মত খানিকটা উঁচু হয়ে বেরিয়ে এসেছে যেন। চোখ দুটোর নিচে বিরাট একটা কাটা রেখার মত কিছু। বনহুর আরও আশ্চর্য হলো–মাঝে মাঝে কাটা রেখাটা ফাঁক হয়ে করাতের মত দু’পাটী দাঁত বেরিয়ে আসছে। বুঝতে পারলো বনহুর ঐ ফাঁকটাই হলো অদ্ভুত জীবটার মুখগহ্বর।
থমকে স্থির হয়ে পড়লো বনহুর। অদ্ভুত জীবটা পানির মধ্যে ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে। যেন গ্যাসভরা একটা বেলুন আর কি।
বনহুর আরও গভীর অতলে তলিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগল। বেলুনটা যেন তার দিকেই গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে। সর্বনাশ নর খাদক জীব নাকি ওটা! ভাবলো বনহুর মনে মনে। দক্ষিণ হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরাখানার দিকে তাকিয়ে নিরাশ হলো, এটা দিয়ে কিছু হবে না ঐ বিরাট ফুটবলটার। হয়তো সামান্য ফুটোর সৃষ্টি হবে মাত্র তার শরীরে।
বনহুর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো ফুটবল আকারের জীবটার কবল থেকে কি করে বাঁচবে। সে যতই নিচে নেমে যাচ্ছে ফুটবলটাও তাকে অনুসরণ করছে।
একি বিপদ! এবার বুঝি এই অদ্ভুত জীবের মুখগহ্বরে নিজকে সমর্পণ করতে হয়। বনহুর যখন অত্যন্ত দ্রুত নিজকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে তখন ফুটবলটাও তার গতি বাড়িয়ে দিলো। হঠাৎ চমকে উঠলো বনহুর ফুটবলটির পেটের মধ্যে কেমন যেন শব্দ হচ্ছে শুনতে পেলো সে। ঠিক কোনো মেশিনের শব্দের মতই লাগলো তার কানে।
বনহুর বিস্মিত হয়ে পড়েছে, এ আবার কি ধরনের জীব কে জানে। বনহুর যতই পালাচ্ছে গোলকার জীবটা ততই তাকে অনুসরণ করছে।
মরিয়া হয়ে উঠলো বনহুর। সে আরও লক্ষ্য করলো, বড় বড় হাঙ্গর কুমীরগুলো পর্যন্ত গোলাকার জীবটাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এবার নিজের জীবনের আশা ত্যাগ করে ফেললো। বনহুর। অত্যন্ত হাঁপিয়ে পড়েছে অক্সিজেন পাইপ ঠিকমত কাজ করতে পারছে না আর। স্পীড মেশিনের গতি ও ফুটবল আকার জীবটার গতির কাছে হ্রাস হয়ে এসেছে। মৃত্যু, এবার সত্যিই মৃত্যু দস্যু বনহুরের।
তবু শেষ চেষ্টা করছে বনহুর। তার সাঁতারের মেশিনের গতি ডবল বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে তো মানুষ কতক্ষণ এভাবে একটানা সাঁতার কাটতে পারে। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে বনহুরের।
ফুটবলটা একেবারে অতি নিকটে এসে পড়েছে। হা করছে বার বার আর কেমন যেন একটা বিকট শব্দ করছে যন্ত্রের আওয়াজের মত।
হঠাৎ বনহুর ধাক্কা খেলো যেন কিসের সঙ্গে। তাকিয়ে দেখলো, একেবারে সেই পাহাড়টার গায়ে এসে আটকে পড়েছে। শিউরে উঠলো–এটা সেই ডুবন্ত পাহাড়, যে পাহাড়ের ফাটলে নিদ্রিত আছে ভয়ঙ্কর দৈত্যরাজ কিউকিলা।
বনহুর নিজের আশা ত্যাগ করলো, সম্মুখে এগিয়ে আসছে অদ্ভুত জীব ফুটবল পিছনে কিউকিলা। বনহুর আর এগুতে পারলো না, পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
গোলাকার জীবটা তখন পাশে এসে পড়েছে, একেবারে চোখের সম্মুখে। বনহুর তাকিয়ে দেখলো, ঠিক একটা বড় লৌহগোলক যেন। চোখ মুদলো বনহুর তার দৃষ্টির সম্মুখে নেমে এলো রং-এর ফুলঝুরি।
কিন্তু একি! বনহুরকে জীবটা তো গ্রাস করলো না। কেমন যেন আওয়াজ হচ্ছিলো, এবার ঘটং করে একটা শব্দ হলো সঙ্গে সঙ্গে বনহুর চোখ মেলে তাকালো। বিস্ময়ে হতবাক স্তম্ভিত হলো বনহুর দেখলো এতোক্ষণ যে গোলাকার ফুটবলটাকে সে ভয়ঙ্কর কোনো জীব বলে ধারণা করেছিলো আসলে সেটা কোনো জীব নয়–একটা ডুবন্ত জলযান। গোলকার ঢাকনা খুলে বেরিয়ে এলো দু’জন মানুষ। লোক দু’জনার দেহে অদ্ভুত ড্রেস। ঠিক ডুবুরী ড্রেসের মতই কতটা দেখতে। বনহুরকে দু’জন ধরে ফেললো দু’পাশ থেকে। বনহুর লোক দুটির মুখ দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলে তারা সভ্য মানুষ।
বাধা দিলো না বনহুর ওদের, তার মনে তখন বিপুল জানার বাসনা, কে এরা, কিই বা তাদের উদ্দেশ্য। বনহুর নিজকে সমর্পণ করলো লোক দুটির হাতে। ২৮৪ O
এবার বনহুরের আরও আশ্চর্য হবার পালা, লোক দুটি বনহুরকে নিয়ে গোলাকার জলযানটার পাশে এগিয়ে এলো। একজন জল্যানটার পাশের কোনো সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনা খুলে গেলো।
বনহুরকে নিয়ে ওরা প্রবেশ করলো ভিতরে। বনহুর হতবাক হয়ে দেখলো, অদ্ভুত ফুটবলের মত জলযানটার ভিতরটা সুন্দর একটা মোটর কারের মত দেখতে। পাশাপাশি বসবার দুটো আসন পিছনে, আর সম্মুখে একটি আসন এটি বোধ হয় চালকের ড্রাইভিং আসন হবে। মোটরগাড়ি হ্যান্ডেলের মতই একটা গোল হ্যান্ডেল। পাশেই মিটার মেশিন, মাডগার্ড ও আরও অনেকরকম যন্ত্রপাতি নজরে পড়লো বনহুরের।
বনহুরকে পিছন আসনে বসিয়ে দিয়ে একজন তার পাশে বসে পড়লো আর একজন সম্মুখে। ড্রাইভ আসনে বসে পড়েছে। ভিতরে প্রবেশ করার সময় এক বিন্দু জলও প্রবেশ করেনি জলযানটার মধ্যে। বনহুর নিশ্চুপ বসে ওদের কার্যকলাপ দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পূর্বে জলজীব ভ্রমে যার কবল থেকে রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো, এখানে তার উদরে এভাবে আয়েসে বসে থাকবে সে ভাবতে পারেনি।
বনহুরের দেহে ডুবুরী ড্রেস তখনও পরা রয়েছে।
লোক দুটো তাদের মুখের অদ্ভুত আবরণ উন্মোচন করে ফেললো। বিস্মিত হলো বনহুর– উভয়েই সভ্য জগতের সুষ্ঠু মানুষ–তবে এরা ঝামবাসী নয়–কোন্ দেশের লোক সহজে বুঝা গেলো না।
সঙ্গীকে লক্ষ্য করে সামনের লোকটা খাঁটি ইংরেজিতে বললো–ওর মুখের আবরণ উন্মোচন করতে বলো স্মিয়ং।
বনহুর অবাক হলো, এরা তবে সভ্য মানুষ–সুন্দর ইংরাজি বলছে। তার পাশে বসা। লোকটার নাম স্মিয়ং। লোকটা কি বলে শুনবার জন্য অপেক্ষা করলো বনহুর।
লোকটা এবার বনহুরকে তার মুখের অক্সিজেন পাইপসহ মুখোশ খুলে ফেলার জন্য বললো। সেও ভাল শুদ্ধ ইংরাজি বলছে।
বনহুর খুলে ফেললো নিজের মুখের মুখোশ। সঙ্গে সঙ্গে আরও অবাক হলো, জলযানটার মধ্যে অক্সিজেন তো রয়েছেই এয়ারকন্ডিশনিং এর সুন্দর ব্যবস্থা আছে। রক্তাভ একটা আলো জ্বলছে ভিতরে, সেই আলোতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ভিতরটা এবং সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বনহুর।
স্মিয়ং প্রথম ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললো–আর্লিং স্মিথ, একে নিয়ে এখন কোথায় যাবে?
আলিং স্মিথ জলযানটা চালনা করছিলো, ঘাড় ফিরিয়ে জবাব দিলো–আমাদের দলপতির কাছে নিয়ে যাবো একে।
বনহুর ওদের কথাবার্তায় বুঝতে পারলো, এরা কোনো গ্যাং বা দল নিয়ে কোথাও বাস করছে। কিন্তু কোথায় তাদের সেই ঘাটি, যেখানে রয়েছে এদের দলপতি। নিশুপ বসে রইলো বনহুর। কিউকিলা হত্যা করতে এসে একি বিভ্রাটে পড়লো।
এবার ফুটবলটা যেন দক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ে শট করা বলের মতই সা-সা করে ছুটতে লাগলো। বনহুর ভাবতেও পারেনি, এই গোলক পিন্ডটা জীব নয়-একটি জলযান এবং শত শত ফিট, গভীর জলের তলায় সেটা কোনো মানুষ্যনামী সভ্য জীব দ্বারা চালিত হচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য বনহুর হতবাক হয়ে পড়েছিলো।
হঠাৎ বনহুর চমকে উঠলো।
স্মিয়ং বলল–নামতে হবে এবার।
এতোক্ষণে বনহুর কথা বললো–বেশ চলো।
এসো। উঠে দাঁড়ালো স্মিয়ং।
আর্লিং স্মিথ তখন জলযানটা থামাতে ব্যস্ত।
জলযানটা থেমে পড়তেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। এবার অন্য একটা শব্দ হচ্ছে, এরকম শব্দ বনহুর শুনেছিলো জলযানে প্রবেশ মুহূর্তে।
আর্লিং স্মিথ জলযানের গায়ে একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো পাশের ঢাকনাটা।
আর্লিং স্মিথ আর স্মিয়ং অদ্ভুত মুখোশ পরে নিয়েছে। বনহুরকেও তারা তার অক্সিজেন পাইপসহ ডুবুরী আচ্ছাদন দ্বারা মাথাটা ঢেকে ফেলতে বললো।
বনহুর তার মুখোশে মুখসহ মাথাটা আবৃত করে নিলো। কোমরের বেল্টে সূতীক্ষ ধার ছোরা এবং অটোমেটিক পিস্তলটা ছিলো। বনহুর একবার ছোরা এবং অটোমেটিক ক্ষুদে পিস্তলটার উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। না জানি ভাগ্যে কি আছে, তবে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে নিজকে রক্ষার জন্য চেষ্টা করবে।
সঙ্গীদ্বয়সহ বনহুর নেমে পড়লো। চারদিকে থৈ থৈ জলরাশি। সমুদ্রতল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আশ্চর্য হলো সে, এখানেও বিরাট একটা ডুবন্ত পাহাড়। তবে এটা সে পূর্বের সে পাহাড় নয়, সেটা বেশ বুঝতে পারলো। তারা যেখানে নেমে দাঁড়ালো সেখানে একটা লম্বা সাবমেরিন ধরনের জলযান দেখতে পেলো। আর্লিং স্মিথ ও স্মিয়ং বনহুরকে নিয়ে সেই লম্বা জলযানটার মধ্যে প্রবেশ করলো।
এবার সাবমেরিন ধরনের জলযানটা সমুদ্রবক্ষে কোনো গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো বলে মনে। হলো বনহুরের। কারণ সে সাবমেরিনের সম্মুখে কাঁচের মত সচ্ছ অংশ দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলো। সাবমেরিনই বটে, কারণ এই জলযানটার ভিতরে মাত্র দু’জন লোক কোনোরকমে বসতে পারে এবং এর ভিতরে যে-সব যন্ত্রপাতি নজরে পড়লো এসব অতি মারাত্মক ধরনের। বনহুর সব লক্ষ্য করছে নিপুণ দৃষ্টিতে।
যে পথে সাবমেরিনটা অগ্রসর হচ্ছিলো, সে পথের দু’ধারে সুউচ্চ পাথরস্তর পর্বত সমান উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বনহুর স্পষ্ট অনুভব করলো, কোনো পর্বতের বা পাহাড়ের গুহার সুড়ঙ্গপথে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সাবমেরিনটা থেমে পড়লো এবং এক মিনিট পর আবার চলতে আরম্ভ করলো। এবার কেমন যেন চাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছে বনহুর। তবে কি শুকনো উঁচুনীচু পাথরের উপর দিয়ে সাবমেরিনটা চলেছে।
অল্পক্ষণ চলার পর থেমে পড়লো সাবমেরিন আকার জলযানটা। লোক দুটো সুইচ টিপতেই দরজা খুলে গেলো সাবমেরিনের। নেমে দাঁড়ালো তারা এবং বনহুরকে নামবার জন্য ইংগিত করলো।
বনহুর লোক দুটিকে অনুসরণ করলো। সে দেখলো, এখানে কোনো জলোচ্ছাস বা জলরাশির উন্মত্ত ঢেউ নেই শুকনো মাটিও নয়–শুধু পাথরের ঢিবি। বনহুরকে নিয়ে লোক দু’জন এগুতে লাগলো। জায়গাটায় জলরাশি না থাকলেও আলো-বাতাস কিছু নেই। একটা বড় গর্তের মত সুড়ঙ্গমুখে এসে ওরা দু’জন দাঁড়ালো–অমনি নড়ে উঠলো পাথরখানা, তারপর দেখলো, পাথরখানা সরে যাচ্ছে একপাশে। ভিতরে নজর পড়তেই বনহুর উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা দেখতে পেলো।
আর্লিং স্মিথ ও স্মিয়ং বনহুর সহ প্রবেশ করলো সেই সুড়ঙ্গ মধ্যে। বনহুর লক্ষ্য করলো সুন্দর বিরাট একটি গুহা–ঠিক শহুরে কোনো হলঘরের মত। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, গুহার মধ্যে নানারকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্র সাজানো রয়েছে। কক্ষমধ্যে কয়েকখানা চেয়ার, চেয়ারে উপবিষ্ট কয়েকজন লোক। বনহুর আরও বিস্মিত হলো, তাদের দেহে সাবমেরিন চালকদ্বয়ের মতই অদ্ভুত ড্রেস কিন্তু কারো মুখে কোনো মুখোশ বা আবরণ নেই। বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই তার সঙ্গীদ্বয় নিজ নিজ মুখের মুখোশ খুলে ফেললো, বনহুরকে খুলে ফেলার জন্য। বললো তারা।
বনহুর নিজ মুখ থেকে ডুবুরী ড্রেসের মুখোশ খুলে ফেলতেই আশ্চর্য হলো। গভীর সাগরতলায় গুহার মধ্যে সচ্ছ আবহাওয়ায় এয়ার কন্ডিশনিং এবং অক্সিজেনের দ্বারা গুহার মধ্যে সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা বা কষ্ট হচ্ছে না তার। এবার বনহুর ভালভাবে লক্ষ্য করলো, আরও অবাক হলো সেগুহামধ্যে যারা উপবিষ্ট ছিল তাদের মধ্যে দু’জন নারীও রয়েছে। নারী দুটিও ইংরেজ মহিলা তা তাদের চেহারা দেখেই বেশ বুঝা যাচ্ছে।
বনহুরকে দেখেই গুহার মধ্যে সবাই বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়ে পড়েছে। জিজ্ঞাসা করলো একজন–একে কোথায় পেলে আর্লিং স্মিথ?
আর্লিং স্মিথ জবাব দিলো–সাগরতলে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো।
স্মিয়ং বললো–কোনো গুপ্তচর হবে।
তরুণীদ্বয়ের একজন বনহুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তাকালো সে বনহুরের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে। আপাদমস্তক লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো, তারপর বললো–একে আটক করে রাখো, দেখো যেন না পালাতে পারে।
তরুণী যখন বনহুরের মুখে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছিলো তখন সে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো তরুণীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে। এমন সুন্দরী তরুণী সে খুব কমই দেখেছে। তরুণীর দেহে যদিও তখন অদ্ভুত ড্রেস ছিলো তবু বনহুরের দৃষ্টিতে তার রূপলাবণ্য ধরা পড়ে গেলো অনায়াসে।
বনহুর কেমন যেন মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে ছিলো, চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছিলো না।
তরুণী বললো–নিয়ে যাও ওকে।
বনহুর একটু হেসে বললো–আমি গুপ্তচর নই সুন্দরী।
তরুণী কণ্ঠস্বর কঠিন করে বললো–বিশ্বাস কি তোমাকে?
আমার পোশাক, আমার প্রমাণ–আমি একজন ডুবুরী।
তরুণী গম্ভীর হয়ে উঠলো, তারপর দাঁতে দাঁতে পিষে বললো–এ পোশাক ছাড়া আমার রাজ্যে আসার সাধ্য কি তোমার।
রাজ্য!
হাঁ জানোনা না ঝম সাগরের সমস্ত তলদেশ আমার রাজ্য। এখানকার রানী আমি। আর এদের দেখছো এরা সবাই আমার বিশ্বস্ত অনুচর। এবার দ্বিতীয় তরুণীর দিকে তাকালো প্রথম তরুণী –এ আমার সহচরী মিস্ এ্যালিন।
ধন্যবাদ। আস্তে করে উচ্চারণ করলো বনহুর। তারপর বললো–রাণী, তোমার নাম জানতে, পারি কি?
যদিও তুমি আমার বন্দী কিন্তু তোমার সাহস দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি? তবু বলছি তোমাকে আমার নাম–মিস জীমস মীরা।
বনহুর একবার নয়, বার বার দুই উচ্চারণ করলো মিস জীমস মীরা। মিস জীমস মীরা—
ততক্ষণে আর্লিং ও স্মিয়ং বনহুরকে টেনে নিয়ে চললো।
বনহুরকে যখন পাশের এক গুহা বা সুড়ঙ্গমধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তাকে পুনরায় মুখের আবরণ পরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
একটা লিফট এর মত চৌকানি বস্তুর উপরে দাঁড়ালো ওরা বনহুরকে নিয়ে। বনহুর এবং ওরা দু’জনসহ লিটখানা এবার অল্প কিছুক্ষণ নেমে চললো তারপর দাঁড়িয়ে পড়লো নিশ্চুপ হয়ে।
আর্লিং–বললো নেমে পড় বন্ধু।
বনহুর কিছু চিন্তা করছিলো, কাজেই সে আনমনা হয়ে পড়েছিলো একটু চমকে উঠে বললো–হ্যাঁ নামতে হবে আমাকে?
স্মিয়ং বললো-হাঁ, দেখছো না বন্দীশালা এসে গেছে।
বনহুর যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো, আর্লিং এবং স্মিয়ংকে লক্ষ্য করে বললো–তোমরা লিট। থেকে নামবে না বন্ধুগণ?
আর্লিং বললোনা! তোমাকে শুধু পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবো।
বনহুর গুহাটার মধ্যে ভালভাবে তাকালো, আধো অন্ধকার লাগছে চারদিক। আর্লিং বললো–এখানেও তুমি সচ্ছন্দে নিশ্বাস নিতে পারবে। কাজেই মুখের অক্সিজেন পাইপ খুলে ফেলো। আর শোন, বন্দীশালা তোমার একার; এখানে আর কোনো বন্দী এখন নেই।
স্মিয়ং বললো–হাঁ, এটা তোমার ভাগ্য বলতে হবে।
বনহুর লিফট থেকে নেমে দাঁড়ালো।
হিমশীতল গুহার মধ্যস্থল এয়ার কন্ডিশনিং রয়েছে তাই কোনো অসুবিধা হলো না তার। বনহুর বললো বন্ধু, আবার কখন আসবে তোমরা?
আর্লিং জবাব দিলো–মিস মীরার হুকুম হলেই আসবো আমরা।
বনহুর বললো–তোমরা যাচ্ছো যাও কিন্তু বড্ড ক্ষুধা বোধ করছি আমি কারণ বহুক্ষণ হলো সাগরতলে এসেছি।
আর্লিং বললো আবার মিস্ মীরাকে বলবো।
মিনতি ভরা স্বরে বললো বনহুর–দয়া করে বলো।
ওরা চলে গেলো।
বনহুর গুহার মধ্যে প্রবেশ করে তাকাচ্ছে, গভীর সাগরতলে এমন সুবন্দোবস্ত করা গুহা সত্যি আশ্চর্য বটে! দেয়ালে হাত দিয়েই স্পষ্ট দেখতে পেলো, সুইচ রয়েছে সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। হতবাক না হয়ে পারলো না বনহুর। ঠিক ফার্স্ট ক্লাশ ট্রেনের কামরার মত গুহার মধ্যভাগ। একপাশে গদি-আটা হেলনা চেয়ার, টেবিল আর সোফা। বনহুর নিজের দেহ থেকে ডুবুরী ড্রেস খুলে ফেললো। না কোনোরকম অসুবিধা বোধ করছে না তো, নিশ্বাস নিতে কোনো কষ্টও হচ্ছে না। শরীরটা বেশ শান্ত ঠান্ডা মনে হচ্ছে। বহুক্ষণ ডুবুরী ড্রেস পরে থাকায় ক্লান্ত বোধ হচ্ছিলো, এখন নিজকে অনেকখানি হাল্কা লাগছে বনহুরের। চেয়ারের উপর ডুবুরী ড্রেসগুলো রেখে সোফার। দিকে অগ্রসর হলো। এখন তার শরীরে কোনো জামা-কাপড় নেই শুধু পরনে একটি সিল্ক আন্ডারওয়্যার ছাড়া।
বনহুর সোফায় দেহটা এলিয়ে দিলো আবেশে। দেহ সুস্থ বোধ করলেও মন সুস্থ হলো না। কারণ সে এসেছে কিউকিলা হত্যার জন্য আর হলো সে বন্দী। শাহীতে তার অনুচরগণ ভীষণ আশঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রহমান, ক্যাপটেন বোরহান ও আরও অনেকে। মহারাজ মোহন্ত সিন্ধু ও তাঁর কন্যা মালাও অত্যন্ত ঘাবড়ে পড়েছে তার জন্য। মালার কথা মনে হতেই বনহুরের মনটা মায়ায় আর্দ্র হয়ে উঠলো, বেচারীর কত আশা তাকে স্বামীরূপে পাবে। হাসিও পেলো বনহুরের মালার আচরণ মনে করে। নিজকে বিলিয়ে দেবার সেকি প্রচেষ্টা তার। বনহুর চঞ্চল হয়ে উঠলো। এই মুহূর্তে মালাকে কাছে পেলে তবু হয়তো খানিকটা স্বস্তি পেতো সে। বড় একা নিঃসঙ্গ লাগছে। এই নির্জন পাতালপুরীতে।
এইতো সবে শুরু–আরও কতদিন যে তাকে এভাবে কাটতে হবে কে জানে! একটা সিগারেটের জন্য মনটা উসখুস্ করছে তার। সোফায় চীৎ হয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো কতকথা– কিউকিলা হত্যা করাটাই হলো তার প্রথম কাজ। এই জলদৈত্যটাকে হত্যা না করা পর্যন্ত বনহুর নিশ্চিন্ত নয়। কত লোককে সে হত্যা করেছে–আরও করবে। সাক্ষাৎ শয়তান যেন কিউকিলা। যদিও বনহুর বন্দী হয়েছে তবু নিজকে সে সম্পূর্ণ বন্দী ভাবতে পারছে না। কারণ যারা তাকে আটক করে আনলো তারা এখন পর্যন্ত তার দেহ সার্চ করে দেখেনি বা তার পোশাক-পরিচ্ছদ পরীক্ষা করে ডিনামাইটগুলো বের করে নেয়নি।
বনহুর বিলম্ব না করে উঠে পড়লো, হঠাৎ যদি ওরা তার ডুবুরী ড্রেস সার্চ করে ডিনামাইটগুলো আবিষ্কার করে ফেলে তাহলেই প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যাবে। উঠে পড়লো বনহুর, ডুবুরী ড্রেসের ভেতর থেকে বের করে নিলো ডিনামাইটগুলো, আর অটোমেটিক পিস্তলটা। কোথায় লুকিয়ে রাখবে ভাবতে লাগলো, চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
হঠাৎ বনহুরের খেয়াল হলো, যে সোফাটায় সে এতোক্ষণ নিশ্চিন্তে বসেছিলো তার তলায় লুকিয়ে রাখলে মন্দ হয় না। বনহুর দ্রুত হস্তে ডিনামাইটগুলো সোফার নিচে লুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালো। পিছনে হাত রেখে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। আবার বসলো, হাত দুটি দিয়ে চুলগুলো টানতে লাগলো, আপন মনে। অধরদংশন করতে লাগলো।
চিরচঞ্চল উচ্ছল দস্যু বনহুর নিশ্চুপ বসে থাকবে, এটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অল্পক্ষণের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠলো–এখান থেকে না বের হলে কিউকিলাকে হত্যা করা সম্ভব হবে না। এভাবে চুপচাপ বসে থাকার সময়ই বা কোথায়। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। এতোক্ষণ তার জাহাজে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে যা ভেবেছিলো তা হলো কই! বনহুর দেহটা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো।
এমন সময় একটু শব্দ হলো; বনহুর চোখ মেলে চাইতেই দেখলো, তার সম্মুখে একটি লোক দাঁড়িয়ে তার হাতে খাবারের ট্রে, তার পিছনে দাঁড়িয়ে যমদূতের মত দু’জন লোক; তাদের হাতে জমকালো চক্চকে রিভলভার। বনহুর যমদূত দু’জনের হস্তস্থিত রিভলভার দু’টির দিকে একনজর তাকিয়ে দেখে নিয়ে দৃষ্টি স্থির করলো খাবারের ট্রের উপর। পাউরুটি, মাখন, চিনি, দুধ, চা–সব সাজানো আছে ট্রেটার উপর। বনহুর সম্মুখস্থ টেবিলে খাবারের ট্রে রাখতে বললো।
লোকটা খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে চলে গেলো। তার সঙ্গেই বেরিয়ে গেলো যমদূতদ্বয়। বনহুর এবার নিশ্চিন্ত মনে খাবারের টেবিলে বসলো।
খাবার খেলো বনহুর তৃপ্তি সহকারে। বন্দীর প্রতি মিস মীরার অনুরাগ মন্দ নয় দেখে খুশি হলো সে মনে মনে। খাবারগুলো রুচিমতই হয়েছিলো।
খাওয়া শেষ করে বনহুর সোফায় দেহটা এলিয়ে দিলো। দেখা যাক্ এরপর তার ভাগ্যে কি অবস্থার সংযোগ হয়।
কতক্ষণ কেটে গেছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো বনহুর, হঠাৎ একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখ মেলে তাকিয়ে চমকে উঠলো, তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিস এ্যালিন ও মিস মীরা। তাদের পিছনে উদ্যত রিভলভার হস্তে আর্লিং এবং স্মিয়ং।
বনহুর আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে মিস মিরাকে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু সে অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলো কারণ তার দেহে একমাত্র সিল্ক আন্ডারওয়ার ছাড়া আর কিছু ছিলো না। বনহুর এগিয়ে গেলো তার ডুবুরী ড্রেসের দিকে, হাত বাড়াতেই মিস মীরা বললো-লজ্জার কোনো কারণ নেই যুবক। আমি এক্ষুণি তোমার জন্য ড্রেস আনতে বলছি।
বনহুর নিশ্চুপ সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
মিস মীরা বললো তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো, সঠিক জবাব দেবে?
বললো বনহুর–নিশ্চয়ই দেবো।
তোমার নাম কি বল?
আমার নাম দেবরাজ।
দেবরাজ! এ আবার কেমন নাম?
মিস এ্যালিন বললো–দেবরাজ বুঝ না মীরা?
না! বললো মীরা।
বনহুর তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টি মেলে মিস মীরার দিকে। মীরার সৌন্দর্য তাকে যেন অভিভূত করে ফেলছে। সুন্দরী নারী সে বহু দেখেছে কিন্তু মীরা যেন অপূর্ব!
বললো মিস্ এ্যালিন–দেবরাজের মানে স্বর্গের রাজা।
বলো কি?
হাঁ মীরা, আমি শাস্ত্রের মাধ্যমে এ কথা পড়েছিলাম।
মিস্ মীরা অবাক হয়ে তাকালো বনহুরের নগ্ন দেহটার দিকে। নিৰ্ণিমেশ দৃষ্টি নিয়ে দেখছে। সে ওকে।
বনহুর আরও বেশি বিব্রত বোধ করলো। সেও তাকালো মিস্ মীরার মুখের দিকে মীরার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।
মিস্ মীরা বললো বুঝলাম তুমি দেবরাজ কিন্তু আমার রাজ্যে কেন এসেছিলে বলো?
বনহুর সচ্ছকণ্ঠে জবাব দিলো–গভীর সমুদ্রতলে আপনার রাজ্য তা জানতাম না মিস মীরা।
কি উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এসেছো?
ভ্রমণ উদ্দেশ্যে।
এবার হেসে উঠলো মিস মীরা, তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বললো–মিথ্যা কথা! গভীর সাগরতলে কেউ কোনোদিন ভ্রমণ করতে আসেনা। জানো তোমাকে কিভাবে আমরা হত্যা করবো? মিথ্যা বলার শাস্তি কি টের পাবে এবার।
আমাকে আপনি হত্যা করবেন? কিন্তু আপনারা আমার সঙ্গে যেমন ব্যবহার দেখাচ্ছেন। তাতে মনে হচ্ছে, আমি আপনাদের অতিথি–আর আমি যে মিথ্যা বলছি তারই বা প্রমাণ কি?
আর্লিং বললো–তোমাকে যেভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি তাতে তুমি যে কোনো মতলব নিয়ে আসোনি তা তোমার হাবভাব দেখেই বুঝা গেছে।
বনহুর বললো-মতলব একটা ছিলো তা সবার সামনে বলা যাবে না। মিস মীরা, আপনি যদি একবার একা—
বেশ তাই আসবো, যদি এদের সম্মুখে বলতে তোমার আপত্তি থাকে। এখন তাহলে চলি, এসো এ্যালিন।
মিস মীরা ও এ্যালিন চলে গেলো, তাদের অনুসরণ করলো আর্লিং স্মিথ আর স্মিয়ং।
বনহুর হাসলো আপন মনে।
অল্পক্ষণ পর একটি লোক এক সেট ড্রেস নিয়ে হাজির হলো। বনহুর দেখলো যা সে কামনা করছিলো এ ড্রেসগুলো ঠিক সেই রকম। নাইট ড্রেসের মত দেখতে কতকটা। বনহুর ড্রেসটা পরে নিলো, নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো বেশ মানিয়েছে তাকে ড্রেসটা।
লোকটা চলে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়িয়েছে, বনহুর বললো–আমাকে যদি একপ্যাকেট সিগারেট দিতে পারো তাহলে অনেক খুশি হতাম।
লোকটা খাঁটি সাহেব লাল টকটকে চেহারা; বনহুরের কথায় হাসলো দাঁত বের করে, তারপর নিজের পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করে দিলো আর একটা ম্যাচ বাক্স।
বনহুর বললো–ধন্যবাদ।
লোকটা চলে গেলো।
*
ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে চললো। বনহুরের অনুচরদের মধ্যে ভীষণ একটা আতঙ্ক দেখা দিলো, আশঙ্কিত হয়ে পড়লো সবাই। চব্বিশ ঘন্টার জন্য ডুবুরী ড্রেসে অক্সিজেন পাইপে অক্সিজেন ভরা থাকে কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার স্থলে বিয়াল্লিশ ঘন্টা অতিবাহিত হতে চললো।
রহমান ক্ষিপ্তের ন্যায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সমস্ত দিন স্পীড বোট নিয়ে সমুদ্রব চষে ফিরেছে কিন্তু সর্দারের ফিরে আসার কোনো লক্ষণ সে পায়নি। ক্রমে হতাশ হয়ে পড়েছে। রহমান চোখে সে অন্ধকার দেখছে যেন।
বহু রাত ধরে সার্চলাইট নিয়ে রহমান অনুসন্ধান চালালো সর্দারের কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিমুখ হতে হলো তাকে। ফিরে এলো রহমান স্পীডবোট নিয়ে।
সমস্ত জাহাজে একটা অমঙ্গলের ছায়াপাত ঘটলো। এতবড় সর্বনাশ হবে তা ভাবতে পারেনি বনহুরের অনুচরগণ।
মহারাজ মোহন্ত সিন্ধু এবং তার কন্যা মালা তো রোদন করতে লাগলো। দেবরাজকে তারা এভাবে হারাবে এ যেন কল্পনার বাইরে ছিলো তাদের। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়লো রহমান। সর্দারকে হারিয়ে কোনমুখে ফিরে যাবে সে কান্দাই আস্তানায়।
সেদিন সে রাত সবার অনিদ্রায়-অশান্তিতে কাটলো। একদিকে কিউকিলার জন্য সদা আতঙ্ক অন্যদিকে সর্দারের জন্য ভয়ানক দুশ্চিন্তা।
পরদিনও বুকভরা আশা নিয়ে রহমান ঝম-সমুদ্রবক্ষে সর্দারের সন্ধান করে ফিরতে লাগলো। মহারাজ মোহন্ত সিন্ধুও দুদিন হলো ফিরে যাননি তাঁর ঝাঁম রাজ্যে। কন্যা মালাও রয়েছে তাঁর সঙ্গে।
ঝাঁম সর্দার দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছে–তাদের ঝম-ঘাটিতে-না জানি কি হলো! দেবরাজ নিশ্চয়ই কিউকিলাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে, এই তাদের ধারণা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাহাজ শাহী’ নিয়ে ফিরে এলো সবাই তৃতীয় রাতে ঝাঁম শহরে।
ঝাঁম সর্দার যখন জানতে পারলো, দেবরাজ সমুদ্রবক্ষ হতে ফিরে আসেনি তখন সে মাথায় হাত দিয়ে ভূতলে বসে পড়লো। রাজা মোহন্ত সিন্ধুর অবস্থাও তাই তিনিও একেবারে মুষড়ে পড়েছেন। যে একটু ভরসা ছিলো তাও সমূলে বিনষ্ট হলো। কেমন করে তিনি দেশবাসীকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করবেন, ভেবে অস্থির হলেন।
মালা তো দেবরাজের জন্য আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলো। সে সর্বক্ষণ সমুদ্রতীরে গিয়ে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকতো–যদি দেবরাজ ফিরে আসে! মৃত্যুভয় তাকে ঘরে আটকাতে পারলো না–কিউকিলার ভয়েও সে ভীত হলো না।
সখীগণ মালাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু কিছুতেই মালা প্রকৃতিস্থ হচ্ছে না যেন। মালা দেবরাজকে এতো গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিলো, সখীরা বুঝতে পেরে বিশ চিন্তিত হলো।
রহমান ওয়্যারলেসে নূরীকে ব্যাপারটা জানাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় নূরীর দিক থেকেই প্রশ্ন এলো–কেমন আছে বনহুর।
রহমান জবাব দিতে গিয়ে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো তার–কি জবাব দেবে সে! লাউড স্পীকারে মুখ রেখে থ হয়ে বসে রইলো বোবার মত। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা। অন্যান্য অনুচর ছিলো সেই স্থানে। বিস্মিত হলো তারা–রহমানের চোখে কোনোদিন পানি দেখেনি– আজ তার চোখে পানি!
বারবার নূরী প্রশ্ন করছে বলো রহমান, আমার হুর কোথায়? কেমন আছে সে? জবাব দিচ্ছো না কেন?
তবু রহমান নীরব, পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে পড়েছে রহমান। নিজের অধর দংশন করছে সে।
নূরীর আবেগভরা কণ্ঠ–রহমান, আমার হুরকে কথা বলতে বলল। কতদিন তার কণ্ঠ শুনিনি। রহমান, ওকে কথা বলতে দাও।
রহমান অতিকষ্টে নিজকে সংযত করে নিয়ে বলে–দূরী, সর্দার এখন জাহাজে নেই।
কেন, কোথায় গেছে সে? তুমি না বলেছিলে, হুর সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করেছে? সে ফিরে এসেছে তো?
রহমান কোনো জবাব দিতে পারে না।
পুনঃ পুনঃ প্রশ্ন করে নূরী–নিশ্চুপ কেন বলো? কথা বলো রহমান? হুরের বাজুবন্দ কেন সে খুলে রেখেছে। কেন আমি তার কথা শুনতে পাই না?
কে জবাব দেবে–? রহমান লাউডস্পীকার মেশিন অফ করে দিয়েছে। হঠাৎ বাহুর মধ্যে। মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, কোনরকমে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না সে।
নূরী রহমানের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে একেবারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বারবার ওয়্যারলেসের মেশিন চালু করে রহমানকে প্রশ্ন করে।
অগত্যা রহমান বলতে বাধ্য হলো–সর্দার সাগরতল থেকে ফিরে আসেনি!
আকাশ ভেঙে পড়লো নূরীর মাথায়–কি সর্বনাশ হলো! তবে কি তার বনহুরকে সেই নররক্তখাদক দৈত্যরাজ হত্যা করে রক্ত শুষে নিয়েছে? মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লো নূরী। গড়াগড়ি দিয়ে রোদন করতে লাগলো সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো যেন। বনহুরই যে তার জীবনের একমাত্র ভরসা। তার সব কিছু।
সমস্ত দিন নূরী কাঁদলো, তাকে কেউ ক্ষান্ত করতে পারলো না। কেঁদে কেঁদে এক সময় নূরী প্রকৃতিস্থ হলো বটে কিন্তু ঝাঁম রাজ্যে যাওয়ার জন্য সে প্রস্তুত হয়ে নিলো।
এ সময় আস্তানার দায়িত্বভার ছিলো কায়েস আর মাহবুবের উপর। এরা সংবাদ শুনে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হলো। শুধু কায়েস আর মাহবুবই নয়, কান্দাই আস্তানায় বনহুরের প্রত্যেকটা অনুচর চিন্তিত এবং শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লো।
কায়েস সর্দারের সঠিক খবর জানার জন্য ঝাঁম রাজ্যে যেতে মনস্থির করে নিলো। নূরীও যাবে তার সঙ্গে, এরকম কথাবার্তা হলো।
নূরীর প্রিয় সাথী ছিলো নাসরিন। বনহুর ঝাঁম রাজ্যে কিউকিলা হত্যা করার জন্য গমন করলে নূরী যখন সদা বিষণ্ণ মুখে বসে বসে ভাবতো তখন হাসিগানে নাসরিন তাকে মুখর করে তোলার চেষ্টা করতো। কখনও ঝাঁম জঙ্গলে যেতো দু’জন ঘোড়ায় চড়ে শিকার করতে, কখনও ছোট্ট নৌকা নিয়ে ঝরণার জলে ঘুরে বেড়াতো দাঁড় টেনে টেনে। নাসরিন আর নূরী একসঙ্গে গান গাইতো, একসঙ্গে বেড়াতো ঘুমাতোও একসঙ্গে। কারণ রহমানও নেই, বনহুরও নেই–নূরী আর নাসরিন উভয়েই সঙ্গীহারা। দু’জন মুখোমুখি শুয়ে গল্প করতে দু’জনার প্রিয়তমের।
আজ নূরীর মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেছে, সর্বক্ষণ তার চোখে পানি লেগেই রয়েছে। গন্ড বেয়ে ঝরে পড়ছে সদা অশ্রু ধারা। নাসরিন তাকে কিছুতেই যেন প্রবোধ দিতে পারছিলো না। অনেক করে বুঝানোর পরও সে শান্ত হলো না একটুও।
কায়েস এবং মাহবুব নূরীকে নিয়ে মহাবিপদে পড়লো জটিল এক সমস্যায় পড়লো তারা। এদিকে আস্তানা ছেড়ে কায়েস আর মাহবুবের একসঙ্গে যাওয়াও চলবে না। রহমান নেই, সে থাকলে তবু হতো।
কায়েস ওয়্যারলেসে সংবাদ পাঠালো রহমানের কাছে, নূরী সম্বন্ধে সব বললো সে তাকে। নূরী ঝাঁম রাজ্যে যাওয়ার জন্য একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠেছে–তাকে না নিয়ে গেলেই নয়।
রহমান সংবাদ শুনে বেশি ঘাবড়ে গেলো, কারণ নূরী এসে সর্দারকে না দেখে আরও উন্মত্ত হয়ে উঠবে। তাকে সংযত রাখাই মুস্কিল হয়ে পড়বে তখন।
রহমানের কোনো আপত্তিই শুনতে রাজি নয় নূরী–জানালো কায়েস। অগত্যা রহমান নূরীকে ঝাঁম রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলো।
বনহুরকে নিয়ে ঝাঁম রাজ্যে যখন তোলপাড় শুরু হয়েছে তখন কান্দাই আস্তানায় নূরী পাগলিনীপ্রায় হয়ে উঠেছে। তার বনহুরকে হারিয়ে সে কিছুতেই বাঁচতে রাজি নয়। আস্তানার সবাই তাকে সান্ত্বনা দিয়েও শান্ত করতে সক্ষম হচ্ছে না, এমনকি দাইমাও বুঝিয়ে শুঝিয়ে দেখলো তবু নূরী অবুঝের মত সদা রোদন করে চলেছে।
কায়েস একদিন মনিরার কাছে গেলো, বিশেষ করে মনিরা আর বাচ্চা নূর কেমন আছে জানবার জন্য। কান্দাই পৌঁছলে নিশ্চয়ই রহমান তাকে প্রশ্ন করতে পারে, বৌরাণী আর ছোট সাহেব কেমন আছে। কায়েস তাই কান্দাই শহরে একদিন গিয়ে হাজির হলো।
মনিরা আনন্দিত হয়ে এসে দাঁড়ালো কায়েসের সামনে। সে মনে করলো না জানি তার স্বামীর কোনোসংবাদ এনেছে কায়েস। নিশ্চয়ই সে ভাল আছে। কিন্তু মনিরা যখন কায়েসের গম্ভীর বিষণ্ণ মুখ লক্ষ্য করলো তখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো যেন। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো মনিরাকায়েস, কি সংবাদ বলো? অমন চুপ হয়ে আছো কেন?
কায়েস অনেক কষ্টে নিজকে সংযত রেখে বললোসংবাদ ভাল নয় বৌরাণী।
শিউরে উঠলো, মনিরা, আশঙ্কিতভাবে বললো–তোমাদের সর্দার ভাল আছে তো?
কোনো জবাব না দিয়ে মুখ ফেরালো কায়েস।
মনিরার বুকের মধ্যে তখন ঝড় উঠেছে না জানি কি দুঃসংবাদ তাকে শুনতে হবে। চোখমুখ রাঙা হয়ে উঠলো মুহূর্তে। কানটা গরম হয়ে উঠেছে গনগনে সীসার মত।
ঠিক সেই দন্ডে নূর মায়ের পিছনে একটা থামের আড়ালে এসে দাঁড়ায়। কায়েসকে সে আরও কয়েকবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছে। তাকে দেখলেই সে কোলে তুলে নিয়ে আদর করেছে, ঠিক রহমান চাচার মত। কিন্তু আজকের মত এমন চুপি চুপি আসেনি তো সে কোনো দিন। নিশ্চয়ই তার মাকে কোনো গোপন কথা বলতে এসেছে লোকটা। কি বলে শুনবার জন্য নূর কান পেতে চুপ করে দাঁড়ালো।
মনিরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো–বলো, বলো কয়েস সে কেমন আছে? কেমন আছে বলো?
সর্দারের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বৌরাণী।
কেন? কোথায় গিয়েছিলো সে?
ঝাঁম দেশের নাম শুনেছেন কিনা জানি না, সর্দার সেই দেশে গিয়েছিলেন কিন্তু আর ফিরে আসেননি।
কায়েস গোপন করে গেলো আসল কথাটা। সর্দার ঝম দেশ থেকে ফিরে আসেননি, এটাই শুধু বললো। সাগরবক্ষে গভীর জলের তলায় সে গিয়েছিলো কিউকিলা হত্যার জন্য সে কথা সম্পূর্ণ চেপে গেলো ভয়ে। বৌরাণী যদি আরও কেঁদে কেটে হুলস্থুল বাধিয়ে বসে! তার চেয়ে যা বলেছে তাই যথেষ্ট।
কায়েস চলে যাচ্ছিল তাড়াতাড়ি মনিরার মনে সন্দেহ জাগলো, ডাকলো সে–শোন কায়েস যেও না।
থমকে দাঁড়লো কায়েস, পালাতে পারলে সে যেন বেঁচে যেতো কোনোরকমে। হাতের মধ্যে হাত কচলাতে লাগলো সে ধীরে ধীরে।
মনিরা সরে এলো, গভীর ধরা গলায় বললো–সঠিক জবাব দাও কায়েস কি হয়েছে তোমাদের সর্দারের?
বৌরাণী যা বললাম তাই—
না, তুমি কিছু লুকোচ্ছো আমার কাছে। বলো, বলো কায়েস, সত্যি করে বলো? আমার কাছে কিছু লুকোবে না।
বৌরাণী।
বলো কায়েস সত্যি কি সে ঝাঁম দেশে গিয়েছিলো আর সেখানে থেকে ফিরে আসেনি? আমার মনে হচ্ছে, তুমি কিছু কঠিন কথা গোপন করছো?
না না বৌরাণী আমি সত্যি কথা বলতে পারবো না। আমাকে মাফ করবেন আপনি। পা বাড়ায় সে চলে যাবার জন্য।
এমন সময় আড়াল থেকে ছুটে এসে কায়েসের পথ রোধ করে দাঁড়ায় নূর দৃঢ় গলায় বলে তোমাকে যেতে দেবো না কায়েস চাচা যতক্ষণ তুমি আম্মির কাছে সব কথা সত্যি করে না বলেছ।
হঠাৎ নূরের এভাবে আবির্ভাব হতে দেখে মনিরা আর কায়েস হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। মনিরা ও কায়েস মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নেয়।
নূর কায়েসকে জড়িয়ে ধরে–বলো, আম্মি যা জিজ্ঞাসা করছিলো বলো?
মনিরা নূরকে টেনে নেয় কোলের কাছে।
কায়েস সেই ফাঁকে ছুটে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
নূর বলে উঠে–আম্মি, কায়েস চাচা কার কথা বলছিলো কে তাদের সর্দার যে ঝম দেশ থেকে ফিরে আসেনি? কে সে সর্দার?
না না, ও কিছু নয়; কিছু নয় বাবা।
আম্মি, তুমি সর্দারের কথাটাই বার বার কায়েস চাচাকে জিজ্ঞাসা করছিলে বলো কে সে?
সর্দার! সর্দার! তোমার কায়েস চাচাদের সর্দার।
তারজন্য তোমার এতো চিন্তা কেন আম্মি?
তোমার আব্বার বন্ধু কিনা তাই—
আব্বার বন্ধু?
হাঁ বাবা, তোমার আব্বার বন্ধু।
খুব ভাল মানুষ বুঝি কায়েস চাচাদের সর্দার?
খুব ভাল–গলা ধরে আসে মনিরার। সে নূরকে বুকে চেপে ধরে গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।
*
সমুদ্রতলে কয়েকদিন কেটে গেছে বনহুরের।
এখানে যদিও সে বন্দী তবু মিস জীমস মীরার অনুচরগণ তার প্রতি কোনো অসৎ ব্যবহার করেনি, তবে সর্বক্ষণ কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছে তারা তার উপরে যেন সে পালাতে না পারে।
বনহুর এ কদিন অনেক সন্ধান লাভ করেছে; কতকটা সে ইচ্ছে করেই পালাবার চেষ্টা করেনি। গভীর সাগরতলায় এমন একটা যে দল বা আস্তানা আছে সত্যি বিস্ময়কর। বনহুর জানতে চায় সাগরতলের এই গভীর রহস্য। কে এরা? কিই বা এদের উদ্দেশ্য? মিস জীমস মীরা। কে? আর গভীর সাগরতলায় তার রাজ্যই বা কেমন?
বনহুর চেষ্টা করছে এদের দলভুক্ত হতে এবং ভিতরের সব রহস্য উদঘাটন করতে।
এই কয়দিনের মধ্যে জিম মীরা একদিন শুধু এসেছিলো তার গুহায়, তবু তার সঙ্গে ছিলো দু’জন রিভলভারধারী দক্ষ পাহারাদার। বনহুর সুযোগ খুঁজছিলো মিস মীরাকে আয়ত্তে আনবার। মীরাকে কৌশলে বশীভূত করতে পারলে সে সব জানতে পারবে। এমনও হতে পারে, তখন দৈত্যরাজ কিউকিলাকে হত্যা করাও সহজ হবে।
কিন্তু বনহুর মিস জীমস মীরাকে তেমন করে নাগালের মধ্যে পায়নি এখনও। ওকে নিতান্তভাবে প্রয়োজন তার।
বনহুরকে যে গুহায় আটক করে রাখা হয়েছিলো সে গুহার দ্বিতীয় কোনো পথ ছিলো না। শুধু পাশের ছোট্ট একটা গুহা বাথরুম হিসাবে ব্যবহার করার জন্য নির্ধারিত ছিলো। এই গুহার মধ্যে ছিলো একটি ছোট্ট ছিদ্রপথ, এই ছিদ্রপথে সমুদ্রগর্ভের বহুদূর অবধি দৃষ্টিগোচর হতো। ছিদ্রপথের আবরণ ছিলো সচ্ছ পাথরের তৈরি তাই সব দেখা যেতো স্পষ্টভাবে।
বনহুর এই ছিদ্রপথে সাগরতলে সবকিছু লক্ষ্য করতো। অনেক বিস্ময়কর জিনিস তার দৃষ্টিগোচর হতো যা সে কল্পনা করেনি কোনোদিন। আর ভাবতো কিউকিলা হত্যার কথা।
সেদিন বনহুর গুহার মধ্যে একটা গদি-আঁটা সোফায় বসে গভীরভাবে চিন্তা করছিলো মনটা বড় অস্থির লাগছে এমনিভাবে আর কতদিন এটি নির্জনগুহায় কাটাবে। তার চঞ্চল মন আর বন্দী থাকতে চাইছিলো না। কখনও পায়চারী করছিলো কখনও বা আসন গ্রহণ করছিলো কখনও বা ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাচ্ছিলো অসীম জলরাশির দিকে। কতরকম মাছ, হাঙ্গর, কুমীর, কচ্ছপ–কতরকম জলজীব সাঁতার কেটে কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে বনহুর, বিস্ময়ভরা নয়নে দেখে সে প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৃষ্টি।
এমন সময় গুহামধ্যে কেউ যেন প্রবেশ করলো টের পেয়ে এগিয়ে আসে বনহুর, অবাক হয়–মিস জীমস মীরা দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুর এসে দাঁড়ালো জীমস মীরার সম্মুখে পা থেকে মাথা অবধি তাকিয়ে দেখে নিলো একবার।
বললো জীমস মীরা–কি দেখছো?
স্পষ্ট করে জবাব দিলো বনহুর–তোমাকে।
জীমস মীরার চোখেমুখে ক্রুদ্ধভাব ফুটে উঠলো, রাগত কণ্ঠে বললো–তোমার স্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি–ভুলে গেছো তুমি আমার বন্দী?
মৃদু হেসে বললো বনহুর-উঁহু ভুলিনি সে কথা।
তবে আমাকে এভাবে অপমান করলে কেন?
কে বললো তোমাকে আমি অপমান করলাম? মিস জিমস্ মীরা আমি তোমাকে ভালবাসি–বনহুর ওর হাত ধরলো।
সঙ্গে সঙ্গে মিস মীরা ঠাই করে বনহুরের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো বনহুর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে।
মিস মীরা অবাক হয়ে তাকালোর চড় খেয়ে হাসছে লোকটা পাগল নাকি।
বনহুর ওর মুখের কাছে ঝুঁকে বললো–তুমি আমাকে ভালবাসতে পারো না মীরা?
রাগে তখন গসগস করছে মিস জিমস্ মীরা। ওর নিশ্বাস দ্রুত বইছে চোখ দুটি দিয়ে আগুন ছিটকে বের হচ্ছে যেন। বনহুরকে হাসতে দেখে রাগটা আরও বেড়ে গেছে মিস মীরার।
বনহুর বললো–মিছামিছি রাগ করছো মিস মীরা। শান্ত হও। মনোযোগ সহকারে শোন আমার কথাগুলো।
রুক্ষ কণ্ঠে বললো মিস মীরা–আমি তোমার কোনো কথাই শুনবো না।
তাহলে কেন এসেছিলে তুমি?
অনুগ্রহ করে তোমার খোঁজ নিতে।
ধন্যবাদ। তবে অনুগ্রহ করে আমার কয়েকটা কথা যদি শুনতে মীরা।
তুমি আমাকে ভালবাসো–এই কথা জানতে চাও–এই তো?
হা মীরা,আমি তোমাকে—
আমি রাণী তা জানো?
জানি।
তুমি আমার বন্দী একথা নিশ্চয়ই স্বীকার কারো?
করি। কিন্তু তবু তোমাকে আমার বড় ভাল লেগেছে। মীরা! মীরা আমাকে বিমুখ করো না।
বনহুর কৌশলে মীরাকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করে। ওকে বশীভূত করতে না পারলে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিউকিলা হত্যা ছাড়াও সাগরতলের রহস্য তাকে উদঘাটন করতে হবে। তাই সে মিস জীমস মীরাকে নিজের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে পেতে চায়। সে জানে, নারীমন যতই কঠিন থাক তাকে নুয়ে আনতে বেশি বেগ পেতে হয় না, বিশেষ করে অবিবাহিতা তরুণী মিস জীমস মীরাকে।
বনহুরের কথায় মিস জীমস মীরা অধর দংশন করতে লাগলো। মুখোভাব অনেকটা কোমল হয়ে আসছে।
বনহুর বুঝতে পারলো ঔষধ ধরেছে, বললো–বসো মীরা।
রুক্ষ কণ্ঠেই বললো মীরা–যা বলবার থাকে বলো? আমি বন্দীর ঘরে বসতে রাজি নই।
বনহুর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, বললো–আমি তোমার শত্রু নই মিস মীরা।
আমি প্রথম দিন বলেছি, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না।
কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি, এ কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করো? তুমি আমার কাছে কি চাও, আমি তোমাকে তাই দেবো।
মিস জীমস মীরার ভ্রূ দুটি কুঁচকে উঠলো, নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুরের নীল সুন্দর দুটি চোখের দিকে। ধীরে ধীরে সচ্ছ হয়ে এলো মিস মীরার মুখোভাব। মীরা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে, তার চোখের সম্মুখে ভাসছে প্রথম দিনে বনহুরের নগ্ন সুন্দর বলিস্ট দীপ্ত দেহখানা। আস্তে আস্তে জীমস মীরা সরে আসছে বনহুরের দিকে, হাত দুখানা প্রসারিত হয়ে আসছে তার।
বনহুরও এগুচ্ছে ওর দিকে, জীমস মীরার দৃষ্টির সঙ্গে স্থির হয়ে আছে বনহুরের দৃষ্টি। সেও এগুচ্ছে নিজের অলক্ষ্যে, বিস্মৃতির পথে তালিয়ে যাচ্ছে যেন সে ক্রমান্বয়ে।
অস্ফুট কণ্ঠে ডাকলো বনহুর–জীমস মীরা, তোমাকে আমি ভালবাসি, যা চাও তাই দেবো আমি তোমাকে! তাই দেবো আমি তোমাকে…….জীমস মীরাকে বনহুর জড়িয়ে ধরলো গভীর আবেগে। মুখটা নেমে এলো ওর মুখের উপর নিবিড়ভাবে।
মিস মীরাও বনহুরের কণ্ঠে আলিঙ্গন করে ধরলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই সে বনহুরের গালে প্রচন্ড একটা চড় বসিয়ে দিলো তারপর নিজকে ওর বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে গেলো দ্রুতগতিতে।
বনহুর বাম হাতের তালু দিয়ে নিজের গলাটা একবার নেড়ে নিলো, তারপর হেসে উঠলো আপন মনে।
জীমস মীরা চলে গেলো বটে কিন্তু তার সমস্ত দেহ-মন এক বিপুল উন্মাদনায় চঞ্চল হয়ে উঠলো। নিজের গুহায় ফিরেও সে প্রকৃতিস্থ হতে পারছিলো না, বন্দী যুবকের নিবিড়তম আকর্ষণ তাকে যেন অভিভূত করে ফেলছিলো। কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো সে।
আর কেউ মিস জীমস মীরার এই মনোভাব লক্ষ্য না করলেও মিস এ্যালিন করলো, তার কাছে ধরা পড়ে গেলো সে। তবে কেন মিস জীমস মীরা এমন আনমনা হয়ে পড়েছে, এটা সে সঠিক বুঝতে পারলো না।
একসময় ওকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর পেলো না মিস এ্যালিন।
মিস জীমস মীরা সাগরতল রাজ্যের রাণী হলেও এক ইংরেজ বৈজ্ঞানিক ছিলো–সেই হলে সর্বেসর্বা। তার কথামতই রাণীকে উঠতে-বসতে ও কাজ করতে হলো। সে-ই জীমস মীরাকে রাণী করে হাতের মুঠোয় রেখেছিলো। রাণী হয়েও সে বৈজ্ঞানিকটিকে ভয় করতো ভীষণভাবে। যদিও বৈজ্ঞানিক জ্যামস্ কোথায় থাকতো জানতো না মিস মীরা, মিস এ্যালিন বা তাদের দলের কোনো লোক তবু তারা সবাই আতঙ্কিতভাবে সময় কাটাতো জ্যামসের জন্য।
মিস এ্যালিন মিস মীরার ভাব লক্ষ্য করে ভ্রুকুটি করে বললো–ব্যাপার কি জীম, হঠাৎ আজ যে বড় আনন্দমুখর লাগছে তোমাকে?
মিস জীমস মাথা নত করলো, একটু হেসে বললো–সাগরতলের রাণী আমি, আমার কত আনন্দ জানো না?
সব জানি। জ্যামস্ বাবা বলেছিলেন, তোমাকে না পেলে তার সব সাধনা নষ্ট হয়ে যেতো,তুমি নাকি খুব লাকী মেয়ে।
হাঁ, বাবা আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন। কিন্তু এ্যালিন, জানি না বাবাকে কেন যেন আমার বড্ড ভয় করে।
তুমি নিজের বাবাকে ভয় করো মীরা?
না না ভয় করি না, কিন্তু….থেমে যায় মিস মীরা।
সেদিন আর কোনো কথা চলে না এ্যালিন আর মিস মীরার মধ্যে। কারণ আর্লিং আর স্মিয়ং এসে পড়ে সেখানে।
*
রাত কি দিন এখানে বুঝবার জো নেই। বনহুরের যখন ঘুম পায় ঘুমায় আর যখন ঘুম না। পায় তখন জেগে থাকে। সময় যেন আর কাটতে চায় না। আজ প্রায় সপ্তাহ হলো সে এদের হাতে বন্দী হয়েছে। এর মধ্যে বনহুর জানতে পেরেছে অনেক কিছু। আরও জানার বাসনা আছে তার! সেদিন ঘুম থেকে উঠে বনহুর তার ডুবুরী ড্রেস পরীক্ষা করে দেখছিলো, এবার ছুটবে সে অজানার উদ্দেশ্যে।
ঐ সময়ে পিছনে লঘু পদশব্দ শুনতে পেয়ে দাঁড়ালো বনহুর, দেখলো ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে মিস জীমস মীরা। চোখেমুখে একটা ব্যাকুল চাহনি!
বনহুর বললো–মিস মীরা তুমি?
মিস মীরা নির্বাক, কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু।
বনহুর দেখলো, আজ জীমস মীরার দেহে হাল্কা নাইট ড্রেস। চুলগুলো এলোমেলো, বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে কাঁধের চারপাশে। চোখ দুটিতে তন্দ্রা-ঢুলুঢুলু ভাব। বনহুর বুঝতে পারলো, এখন নিশ্চয়ই রাত, শয্যা ত্যাগ করে উঠে এসেছে বোধ হয় মিস জীমস মীরা। পাতলা নীলাভ গাউনের মধ্য দিয়ে জীমস মীরার যৌবনদীপ্ত ফিকে গোলাপী দেহটা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
বনহুর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না, মোহগ্রস্তের মত সরে আসে জীমস মীরার দিকে। ডান হাতখানা রাখে বনহুর জীমস মীরার কাঁধে।
সেই মুহূর্তে ওদিকে আড়ালে লুকিয়ে পড়ে একটা ছায়ামূর্তি। ঠিক বনহুর আর জীমস মীরার নিকট হতে কয়েক হাত দূরে। সব লক্ষ্য করছে ছায়ামূর্তি আড়াল থেকে।
বনহুর ভুলে যায় নিজের অস্তিত্ব, গভীর আবেগে টেনে নেয় জীমস মীরাকে নিবিড়ভাবে। বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুর চাপে নিষ্পেষিত হয় ওর শুভ্র কোমল দেহটা। ওষ্ঠদ্বয় রাঙা হয়ে উঠে মুহূর্তে।
কিন্তু একি করছে! বনহুর নিজকে সংযত করে নেয় এবং মুক্ত করে দেয় জীমস মীরাকে! জীমস মীরা আর একদন্ড বিলম্ব না করে দ্রুত পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
রীতিমত হাঁপাচ্ছে জীমস মীরা। ভীত নজরে চারদিকে তাকাচ্ছে সে, কেউতো দেখে ফেলেনি বন্দীর গুহায় গিয়েছিলো এতো রাতে! ভয় কাউকে করে না জীমস মীরার ভয় শুধু জ্যামস্ বাবাকে। সে জানে, বৈজ্ঞানিক জ্যামস্ অতি ভয়ঙ্কর আর ভীষণ নিষ্ঠুর। কোনোক্রমে সে যদি জানতে পারে, বন্দীর গুহায় গিয়েছিলো তাহলে আর রক্ষা থাকবে না।
জীমস মীরা শয্যা গ্রহণ করলো, চাদরখানা টেনে দিলো নিজের শরীরে।
একটু পরে আড়াল থেকে বেরিয়ে মিস এ্যালিন তার নিজের শয্যায় শয়ন করলো।
মিস জীমস মীরা গুহা ত্যাগ করে চলে আসার পর বনহুর লক্ষ্য করেছিলো, আরও কেউ যেন তার গুহা থেকে বেরিয়ে গেলো অতি গোপনে।
বনহুর কিছুক্ষণ পায়চারী করতে করতে চিন্তা করে নিলো, কেউ কি তাহলে জীমস মীরাকে অনুসরণ করেছিলো? ওকে ফলো করে প্রবেশ করেছিলো তার গুহায়? গুহাটা ক্ষুদ্র নয়–বিরাট বড়। ট্রেনের কামরার মত লম্বা এবং আঁকাবাঁকা এবড়ো-থেবড়ো–এক নজরে সব দিকে নজর যায় না।
বনহুর তার ডুবুরী ড্রেস পরে নিলো দ্রুতহস্তে, তারপর অক্সিজেন পাইপসহ মুখোশটা পরে বেরিয়ে পড়লো! সে একদিন বের হবার পথ এবং কৌশল শিখে নিয়েছিলো। সন্তর্পণে বাইরে এসে দাঁড়ালো, দরজা খুলতেই ভেবেছিলো সাগরের জলরাশি তাকে অভিনন্দন জানাবে কিন্তু কোথায় জল? সুন্দর সুড়ঙ্গপথ চলে গেছে সম্মুখ দিকে। সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে এগুতে লাগলো বনহুর। কিছুদূর অগ্রসর হতেই সম্মুখে একটি গুহামুখ দেখে ভিতরে প্রবেশ করলো। আলগোছে। এগুতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, পিছু হটে একটা পাথরের আড়ালে আত্নগোপন করলো বনহুর। দেখলো গুহার মধ্যে শয্যায় শায়িত এক যুবতী, বনহুরের চিনতে বাকি রইলো না–মিস জীমস্ মীরা নিদ্রায় মগ্ন রয়েছে।
হঠাৎ খুট করে শব্দ হলো, বনহুরের দৃষ্টি পড়লো–আধা অন্ধকারে জীমস মীরার শয্যার দিকে এগিয়ে আসছে একটি ছায়ামূর্তি। শিউরে উঠলো বনহুর, ছায়ামূর্তির হস্তে সূতীক্ষ্ণ ধার একখানা ছোরা। ছোরাখানা সে ঘুমন্ত জীমস মীরার বুকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য যেমন উদ্যত হলো, অমনি বনহুর পিছন থেকে খপ করে ধরে ফেললো! সঙ্গে সঙ্গে ছোরাখানা কেড়ে নিলো ছায়ামূতির মুঠোর মধ্য থেকে।
গুহার স্বল্প আলোতে চমকে উঠলো বনহুর, দেখলো ছায়ামূর্তি মিস এ্যালিন।
বনহুরের দেহে তখন ডুবুরীর ড্রেস ছিলো, মুখে ছিলো অক্সিজেন পাইপসহ মুখোশ, তাই বনহুরকে মিস এ্যালিন চিনতে পারলো না।
ওদিকে মিস জীমস মীরা নিদ্রায় অচেতন।
মিস এ্যালিন ভয়ে পালিয়ে গেলো দ্রুত সেখান হতে।
বনহুর মিস জীমস মীরার গুহার মধ্যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মিস এ্যালিন যে পথে বেরিয়ে গেছে এ পথে বেরিয়ে যাবে কিনা ভাবছে এমন সময় বনহুরকে পিছন থেকে দু’জন লোক আক্রমণ করে বসলো।
আচমকা আক্রমণে বনহুর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো, ফিরে দাঁড়িয়েই দেখলো, আর্লিং ও স্মিয়ং উদ্যত ছোরা বাগিয়ে ধরেছে। দু’জনের হাতে দু’খানা সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা।
বনহুরকে লক্ষ্য করে আর্লিং আর স্মিয়ং ছোরা বাগিয়ে দিতে গেলো। বনহুর দু’হাতে দু’জনার দু’খানা হাত ধরে ফেললো খপ করে, সঙ্গে সঙ্গে মোচড় দিলো ভীষণভাবে।
বনহুরের বলিষ্ঠ হাতের মধ্যে আর্লিং আর স্মিয়ং-এর হাত মুচড়ে গেলো যেন, দু’জনই কুঁড়ে বসে পড়লো ভূতলে।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে জীমস মীরা, স্তম্ভিত হতবাক হয়ে গেছে সে একেবারে। বিস্ময়ভরা নয়নে দেখছে সে স্তব্ধ হয়ে।
বনহুর আর্লিং আর স্মিয়ং-এর হাত থেকে ছোরা দুখানা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো তারপর বুট দিয়ে সজোরে মারলো এক লাথি আর্লিং-এর চোয়ালে।
আর্লিং ছিটকে গিয়ে পড়লো কয়েক হাত দূরে।
পিছন থেকে স্মিয়ং বনহুরকে জাপটে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ওকে খেলনা পুতুলের মত ছুঁড়ে ফেলে দিলো। গুহার মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লো স্মিয়ং।
আর পুনঃ আক্রমণ করলো না ওরা, দু’জন উঠি-পড়ি করে পালিয়ে গেলো সেখান থেকে।
বনহুর তাকিয়ে দেখলো, মিস জীমস মীরা হতবাক হয়ে গেছে। হাসি পেলো বনহুরের, এই কি হলো সমুদ্র তলদেশের রাণী? নিজের মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেললো বনহুর।
মিস মীরার মুখ দীপ্ত হয়ে উঠলো, তাড়াতাড়ি ছুটে এলো বনহুরের পাশে–একি তুমি!
হাঁ, আমি মীরা। জানো, মিস এলিন তোমাকে এতোক্ষণে হত্যা করে ফেলতো।
মিস এ্যালিন!
হাঁ, তোমার সহচরী বা সঙ্গিনী।
আমাকে সে হত্যা করতে গিয়েছিলো, বলো কি?
এতোক্ষণে তোমার বুকের রক্তে সিক্ত হয়ে উঠতো এই পাতালপুরীর শুভ্র বিছানাটা। এই বুঝি তোমার রাজ্যের নিয়ম আর শৃঙখলা? তুমি এদের রাণী আর তোমাকে এরা হত্যা করার জন্য উনখ!
মিস জীমস মীরা অসহায় চোখে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। অতি করুণ ব্যথাভরা সে চাহনি। বললো সে–তুমি জানো না, এখানে আমি কত অসহায়।
তোমাকে দেখে আজ সেইরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি এখানে মোটেই নিরাপদ নও!
হাঁ, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ সত্য। তোমাকে একদিন সব বলবো, কিন্তু আজ নয়–তুমি যাও, শীঘ্র যাও আমার গুহা থেকে।
যদি না যাই?
ঐ যে আর্লিং আর স্মিয়ং পালিয়ে গেলো–ওরা জ্যামস্ বাবার কাছে গিয়ে সংবাদ দেবে। সে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক! যদিও আমাকে কন্যা বলে স্বীকার করে কিন্তু ক্ষমা সে করবে না। তোমাকে এবং আমাকে হত্যা করবে।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মিস মীরা, তোমার জ্যামস বাবা আমার কিছু করতে পারবে না।
তুমি জানো না বন্দী, সে কতবড় বৈজ্ঞানিক, কিউকিলার মত একটা রাক্ষসকে সে পুতুলের মত নাচায়! ..
বনহুর অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–কিউকিলা!
হাঁ, দৈত্য-জলদৈত্য সে! অভি ভয়ঙ্কর এক নর রক্তপিপাসু রাক্ষস।
কিউকিলা…কিউকিলা……ঐ জলদানবটা বৈজ্ঞানিক জ্যামস্ বাবার পোষা পুতুল? বলো কি মিস মীরা? বনহুরের মুখমন্ডল উজ্জ্বল দীপ্তময় হয়ে উঠলো।
বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময়ভরা নয়নে মিস জীমস মীরা। সে ভেবে পাচ্ছে না, বন্দী কেন এতো দীপ্তময় হয়ে উঠলো। এতোবড় ভয়ঙ্কর কথাটা শুনে সে ঘাবড়ে গেলো না কেন!
বনহুর মিস মীরার হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরলো–জ্যামস্ বাবা কোথায়? তার কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারো?
মিস মীরা বিবর্ণ হয়ে উঠলো, ভয়কম্পিত কণ্ঠে বললো–এ তুমি কি বলছো বন্দী? তুমি যাবে জ্যামস্ বাবার কাছে।
হা মীরা।
মরবে। সেখানে গেলে মরতে হবে আমাকে এবং তোমাকে।
তুমি না সমুদ্রতলের রাণী?
সে মাত্র ছলনা। আমাকে রাণী বানিয়ে আমার বাবা সবকিছু অধিকার করে নিয়েছে। ঐ জ্যামস্ বাবা……সে অনেক কাহিনী বলবো তোমাকে একদিন।
মিস জীমস মীরার কথায় বনহুর ভয়ানক অবাক হলো। সে নিজেও ভেবেছিলো, জীমস্ মীরার জীবনে কোনো রহস্যময় ঘটনা আছে, তাকে দেখলে কিছুটা অনুমান করা যায়। জীমস মীরার ভাষা যদিও ইংলিশ কিন্তু তার চেহারা সম্পূর্ণ ইরানী মেয়েদের মত ছিলো। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, ডাগর টানাটানা দুটি চোখ। সুন্দর মসৃণ রেশমের মত একরাশ চুল। উন্নত নাসিকা, রক্তাভ গন্ডদ্বয়। গায়ের রং ধপধপে সাদা নয়, ফিকে গোলাপী। জীমস মীরাকে দেখলে মায়া হয়, ভালবাসতে ইচ্ছা করে।
বনহুর বললো হয়তো এমন দিন নাও আসতে পারে জীমস মীরা, যেদিন আমি নিরিবিলি তোমার কাহিনী শুনবো। এসো তুমি আমার গুহায়, সেখানে সব বলবে।
একটা ভীতভাব ছড়িয়ে পড়লো জিমস্ মীরার মুখের উপরে। ভয়বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো চারদিকে, তারপর ফিসফিস করে বললো–এরা টের পেয়ে গেছে আমি বন্দীর সঙ্গে মিশেছি।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–এতো ভয় পাচ্ছো কেন?
তুমি জানো না, তুমি চেনো না জ্যামস্ বাবাকে।
কোনো বাবাই আমার কাছে এগুতে সাহসী হবে না মীরা। তুমি নির্ভয়ে চলো আমার গুহায়। বনহুর মীরার হাত ধরে নিয়ে চলে নিজের গুহায়।
মিস মীরা ফ্যাকাশে মুখে বনহুরের পাশে এসে বসে।
বনহুর বলে–এবার বলো, যে কাহিনী তুমি আমাকে শোনাবে বলেছিলে?
মিস জীমস মীরার চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠলো, হয়তো বা তার এমন কোনো কথা মনে পড়ছে যা তাকে অত্যন্ত বিচলিত, বেদনাক্লিষ্ট করে তুলছিলো।
বনহুর নিজের হাত দিয়ে জীমস মীরার অশ্রু মুছে দিয়ে বললো-আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার ব্যথা। বলো যদি কোনো উপকার করতে পারি?
বনহুরের সহানুভূতিপূর্ণ কথায় জীমস মীরার মনটা কানায় কানায় ভরে উঠলো, উচ্ছল কণ্ঠে বললো–পারবে তুমি আমাকে এদের কবল থেকে উদ্ধার করতে? পারবে……
পারবো মিস মীরা! পারবো…..গম্ভীর স্থির কণ্ঠে বললো বনহুর।
মীরা আত্নহারা হয়ে বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে বললো–আমার বাবার অনেক রত্ন আছে। আমি তোমাকে, দেব…….
নির্জন নিস্তব্ধ গুহায় জীমস মীরাকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে পেয়ে নিজকে সংযত রাখতে পারলো না বনহুর। একজন পুরুষের পক্ষে এমন একটা মুহূর্তে নিজকে শক্ত রাখা দূরূহ। বনহুরের বাহু দুটি জীমস মীরাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করলো। জীমস মীরার দেহটা বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুর মধ্যে শিথিল হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে। ওর মুখখানা তুলে ধরলো সে নিজের মুখের কাছে। কেমন যেন মোহগ্রস্তের মত অভিভূত হয়ে পড়েছে বনহুর ধীরে ধীরে। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে জীমস মীরার দৃষ্টির সঙ্গে। রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে বনহুর, ঠিক সেই ক্ষণে তার বিবেক প্রতিবাদ জানালো…..না না, এ তুমি কি করতে যাচ্ছে বনহুর…..নিজকে কলুষিত করতে চলছে….তুমি না সংযমী পুরুষ….বনহুর জীমস মীরাকে মুক্ত করে দিলো, বললো–আজ যাও জীমস মীরা। আজ যাও তুমি! •
শুনবে না আমার কাহিনী।
এখন নয় জীমস, তুমি যাও–যাও।
বিস্মিতা হতবাক জীমস মীরা বনহুরের নিকট হতে সরে দাঁড়ালো। তারপর বেরিয়ে গেলো গুহা থেকে!
বনহুর গুহার মেঝেতে পায়চারী করতে লাগলো, সত্যি সে কতোবড় অন্যায় পথে পা বাড়াতে যাচ্ছিলো। কতোবড় একটা চরম অভিশাপ থেকে সে যেন মুক্তি পেলো আজ।
বনহুর একসময় তার শয্যা গদি-আঁটা সোফায় বসে পড়লো।
এ গুহায় বন্দী হবার পর থেকে বনহুর লম্বামত সোফাটা শয্যার জন্য ব্যবহার করতো, কারণ এ গুহায় কোনো শয়নোপযোগী বস্তু ছিলো না। কোনো অসুবিধা হতো না বনহুরের, কারণ তার সবকিছু অভ্যাস আছে। সোফার একটি হাতলে মাথা রেখে পা দু’খানা আর এক হাতলে তুলে দিয়ে আরামে ঘুমাতো।
আজও বনহুর সোফায় গা এলিয়ে দিলো অন্যান্য দিনের মত। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না, নানারকম চিন্তার উদ্ভব হচ্ছিলো তার মাথার মধ্যে।
হঠাৎ একটা নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে এলো, অতি তীব্র অথচ ক্ষীণ আওয়াজ।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে সোফার শয্যা ত্যাগ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, মনটা যেন আচম্বিতে শিউরে উঠলো তার, তবে কি মিস জীমস মীরার কিছু ঘটলো? বনহুর ক্ষিপ্রহস্তে ডুবুরী ড্রেস পরে নিলো, তারপর বেরিয়ে এলো দ্রুত গুহা থেকে।
প্রথমে সে জীমস মীরার গুহায় প্রবেশ করলো, কিন্তু জীমস মীরার শয্যা শূন্য। বনহুর তাকালো গুহার মধ্যে চারদিকে, কোথাও কাউকে দেখতে পেলো না। কিন্তু নারীকণ্ঠের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে। বনহুর এবার অপর দিকে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ নজরে পড়লো, গুহাটার ওদিকে ফাটলের মতো একটা সুড়ঙ্গপথ আছে। বিলম্ব না করে কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা খুলে নিলো, এগুলো সন্তর্পণে।
কিছুটা অগ্রসর হতেই কানে এলো স্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দ।
বনহুর আরও দ্রুত পা চালালো।
গুহার ওপাশে ফাটলের মধ্য দিয়ে গোঙ্গানির শব্দটা আসছে। বনহুর ফাটলটার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো, সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো। ওপাশের গুহাটাই সেই গুহা, যে গুহার মধ্যে বনহুরকে বন্দী করে প্রথম দিন আনা হয়েছিলো। বনহুর দেখলো, মিস জীমস মীরাকে একটা লম্বা। পাথরখন্ডের সঙ্গে বেঁধে চাবুক মারা হচ্ছে। তার দেহের জামাটা চাবুকের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
দেহের কতক অংশ কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাজা লাল রক্তে মিস জীমস মীরার নীলাভো জামার অংশগুলো টকটকে লাল দেখাচ্ছে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে অসহায়া তরুণী জীমস মীরা। মাথাটা ঝুলছে সামনের দিকে, হাত দু’খানা দুপাশে রশি দিয়ে বাঁধা। দেহটাও নেতিয়ে পড়েছে, তবু চাবুকের পর চাবুক পড়ছে তার দেহে।
গোঙ্গানি থেমে গেছে, আর কোনো শব্দ বের হচ্ছে না জীমস মীরার কণ্ঠ থেকে।
আর্লিং ও স্মিয়ং দু’পাশে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলিষ্ঠ জমকালো লোক চাবুক চালাচ্ছে অবিরত। বনহুর চমকে উঠলো, ওপাশে আর একজনকে দেখে কি ভীষণ চেহারার লোক! মানুষ না গরিলা বুঝা যায় না। দেহের চামড়াটা ধবধবে সাদা কিন্তু আকারে ঠিক একটা বিরাট হাতির মত। লাল দুটি চোখ যেন আগুন ছড়াচ্ছে।
বনহুর নিশ্বাস বন্ধ করে লক্ষ্য করছে সব। হঠাৎ তার কানে গেলো, যে লোকটা চাবুক চালাচ্ছিলো সে বলে উঠলো–জীমস্ বাবা, বলুন শেষ করে দেই?
আর্লিং বললো মরে গেছে মনে হচ্ছে।
কর্কশ ধেড়ে গলায় গর্জে উঠলো–ওর দেহটা চাবুকের আঘাতে ছেঁড়া নেকড়ার মত কুটোকুটো করে দাও।
ওপাশ থেকে মিস এ্যালিন বললো–বন্দীর সঙ্গে যে ভালবাসা করতে পারে তাকে বিশ্বাস নেই জীমস্ বাবা। মীরাকে হত্যা করাই শ্রেয়।
জ্যামস বাবা মিস এ্যালিনের কথায় খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। হুড়রর হুড়রর বলে। কেমন যেন বিদঘুটে শব্দ করলো, তারপর বললো–ঠিক বলছো এ্যালিন, এবার আমি তোমাকে রাণী করবো। শেষ করে ফেলো জীমকে।
স্মিয়ং বললো–জীমকে হত্যা করে তার বাবার কাছে কি জবাব দেবেন জ্যামস্ বাবা?
জবাব দেবার পূর্বেই আমি তাকে হত্যা করবো কারণ এখন সে আমার বন্দী।
মিস এ্যালিন অবাক হয়ে আরও সরে এলো, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–ইরান শাহ আপনার বন্দী?
হাঁ, কিউকিলা দ্বারা তার সমস্ত কিছু ধ্বংস করে তাকে বন্দী করেছি। সে এখন ইরান সাগরের তলায় তারই রত্ন-ভান্ডারে রক্ষীর কাজ করছে। তাকে হত্যা করতে আমার কতক্ষণ! হাঃ হাঃ হাঃ, ইরান শাহ বন্দী–তার কন্যা আমার বন্দিনী–তার রত্ন-ভান্ডার আমার হাতের মুঠায়…….
মিস এ্যালিনের দু’চোখ কপালে উঠেছে যেন, বললো–ইরান শাহের রত্ন-ভান্ডার আপনি আত্নসাৎ করতে পেরেছেন জ্যামস্ বাবা?
হাঁ হাঁ, সব আমার দখলে এখন। বললো জ্যামস্ বাবা।
বনহুর স্তব্ধ হয়ে শুনলো সব কথা। উষ্ণ হয়ে উঠলো ওর ধমনীর রক্ত–মনে পড়লো, মিস জীমস মীরা বলেছিলো, জ্যামস বাবাকে তুমি চেনো না, কতো বড় সাংঘাতিক সে…..আরও বলেছিলো তোমাকে আমার সব কাহিনী বলবো একদিন……এখন সব স্পষ্ট হয়ে উঠে বনহুরের কাছে। মিস জীমস মীরা ইরান শাহের কন্যা। তাকে চুরি করে কিংবা জোর করে ধরে এনে এখানে মিথ্যা রাণী সাজিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে। শয়তান জ্যামস্ বাবার বাধ্য অনুগত জীব ঐ ভয়ঙ্কর জলদৈত্য কিউকিলা, ভাবতেই যেন বনহুর স্তম্ভিত হলো। কিন্তু এখন ভাববার সময় কই, মিস জীমস মীরাকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে।
পুনরায় আঘাত করবার জন্য চাবুক হস্তে লোকটা যেমন তার চাবুক উত্তোলন করলো, সঙ্গে সঙ্গেই বনহুরের হস্তের সূতীক্ষ্ণধার ছোরা এসে বিদ্ধ হয় তার পিঠে। আর্তনাদ করে উঠে পাক খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় লোকটা জ্যামস্ বাবা পায়ের কাছে।’
তৎক্ষণাৎ জ্যামস্ বাবার আদেশ করলো–আলিং, স্মিয়ং, দেখো তো, কে কোথা থেকে এভাবে ছোরা নিক্ষেপ করলো? তাকে পাকড়াও করে এনে এই ছোরা দিয়েই হত্যা করো।
মিস এ্যালিন বলে উঠলো–পাতাল রাজ্যে কে আসবে আবার, নিশ্চয়ই সেই বন্দী…….
মিস এ্যালিনের কথা শেষ হয় না, বনহুর আর একখানা ছোরা হস্তে আচমকা আক্রমণ করে জ্যামস্ বাবাকে।
জ্যামস্ বাবা ঘুরে দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে এক মুষ্টি বসিয়ে দেয় বনহুরের নাকের উপর। বনহুর ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়ে দূরে। সেকি ভীষণ শক্তি জ্যামস্ বাবার দেহে, যেন দৈত্যরাজ।
বনহুর পড়ে যায় মাটিতে।
জ্যামস্ বাবা ছুটে গিয়ে তার হাতির মত একখানা পা তুলে দেয় গলার উপর। চাপ দেয় দেহের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে। বনহুরের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। মরিয়া হয়ে বনহুর জ্যামস বাবার পা ধরে খুব জোরে প্যাঁচ দেয়, দেহের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সে।
জ্যামস বাবার দেহটা মোচড় খেয়ে ধপ করে পড়ে যায় ভূতলে। বনহুর ক্ষিপ্রগতিতে উঠে দাঁড়ায়, টিপে ধরে জ্যামস বাবার গলা।
জ্যামস্ বাবা তার ডান হাত দিয়ে খামচে ধরে বনহুরের চুলের মুঠি, পরক্ষণেই একটা মুষ্ট্যাঘাৎ বসিয়ে দেয় সে বনহুরের চোয়ালে।
বনহুর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। জ্যামস্ বাবা তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ে, বনহুরকে জাপটে ধরে ফেলে।
বনহুরও জড়িয়ে ধরে জ্যামস্ বাবাকে, পরপর কয়েকটা ঘুষি লাগায় তার নাকে-মুখে চোয়ালে। বনহুরের বজ্রমুঠির আঘাতে জ্যামস্ বাবার নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। চিৎ হয়ে পড়ে যায় গুহার মেঝেতে।
বনহুর দ্রুত হস্তে জ্যামস্ বাবার নিহত অনুচরের বুক থেকে তুলে নেয় সূতীক্ষ ধার ছোরাখানা তারপর জ্যামস্ বাবার বুকে ক্ষিপ্রহস্তে বসিয়ে দেয় সমূলে।
আঃ…..একটা অদ্ভুত আর্তনাদ করে উঠে জ্যামস্ বাবা–সঙ্গে সঙ্গে মিস এ্যালিন চিৎকার করে উঠলো–সর্বনাশ, জ্যামস বাবা নিহত হয়েছে! জ্যামস বাবা নিহত হয়েছে!
আর্লিং আর স্মিয়ং ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো, মিস এ্যালিনের চিৎকারে আরও কয়েকজনসহ ছুটে এলো তারা!
বনহুর এবার তার ডুবুরী ড্রেসের মধ্য হতে বের করে নিলো ক্ষুদে অটোমেটিক পিস্তলখানা। পরপর গুলী ছুঁড়লো সে এক-একজনকে লক্ষ্য করে।
অব্যর্থ লক্ষ্য বনহুরের, একটি গুলীও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। আর্লিং আক্রমণ করবার পূর্বেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। পরক্ষণেই রুখে এলো স্মিয়ং ছোরা হস্তে, কিন্তু সেও বনহুরের নিকট পৌঁছতে পারলো না। আরও কয়েকজন এলো কিন্তু তারা কেউ রক্ষা পেলো না, সবাই মৃত্যুবরণ করলো।
বনহুর তাকিয়ে দেখে আর একটি প্রাণীও জীবিত নেই। কিন্তু মিস এ্যালিন কোথায়? বনহুর একবার তাকালো পাথরখন্ডের সঙ্গে বাঁধা মিস জীমস মীরার সংজ্ঞাহীন দেহটার দিকে। এগিয়ে গেলো সে ঔষ পাশে–ঐ মুহূর্তে কেমন যেন একটা শব্দ শুনতে পেলো বনহুর, কোনো গ্যাস প্রয়োগের শব্দ বলেই মনে হলো তার।
বনহুরের দেহে ডুবুরী ড্রেস থাকলেও তার মুখের আবরণ উন্মোচিত ছিলো, সে অনুভব করলো–তার নিশ্বাস নিতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। বনহুর একদন্ড বিলম্ব না করে অক্সিজেন পাইপসহ মুখোশটা পুরে নিলো, তারপর অতি দ্রুতহস্তে খুলে ফেললো মিস মীরার দেহের বন্ধন, তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো সেই গুহা থেকে। যে গুহায় বনহুরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেই গুহায় মিস জীমস মীরাকে নিয়ে প্রবেশ করলো। ওকে একটি সোফায় শুইয়ে দিয়ে নিজের মুখের মুখোশ খুলে ফেললো। তাকালো বনহুর মিস জীমস মীরার সংজ্ঞাহীন অসহায় করুণ মুখখানার দিকে। দেহের বসন ছিন্নভিন্ন, রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে স্থানে স্থানে, দেহের প্রায় সমস্ত অংশই বনহুরের দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে!
বনহুর একটি তোয়ালে নিয়ে চাপা দিলো তার দেহটা। কিন্তু এখন বিলম্ব করার সময় কোথায়–এ গুহাটার মধ্যেও গ্যাস আসছে। বনহুর দ্রুত বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় মুখোশটা পরে নিলো সে ভালভাবে।
ফিরে এলো বনহুর সে গুহায় দেখলো, একটা ধূম্ররাশির মত গ্যাস সমস্ত গুহাটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে বনহুর বুঝতে পারলো, কেউ কোনো স্থান হতে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ছে। এগুলো বনহুর সামনের দিকে, অমনি হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলো। জ্যামস্ বাবার মৃতদেহের সঙ্গে হোঁচট খেয়েছিলো, একটু হলেই মুখ থুবড়ে পড়ে যেতো। বনহুর দেখলো, গুহামধ্যে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে তারই হস্তে নিহত লোকগুলো। একনজর তাকালো বনহুর মৃতদেহগুলোর দিকে, তারপর ফাটল ধরনের গুহামুখ দিয়ে প্রবেশ করলো।
প্রথম দিন বনহুর গুহার মধ্যে অনেকরকম বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম লক্ষ্য করেছিলো–তবে কি এই গুহা থেকেই কোনো বিষাক্ত গ্যাস ছাড়া হচ্ছে! কে জানে কে সে শয়তান, নিশ্চয়ই সে তাকে এবং জীমস মীরাকে হত্যা করার জন্যই এভাবে গুহায় বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে অক্সিজেন নষ্ট করে দিচ্ছে।
বনহুর গুহাটার মধ্যে প্রবেশ করে তাকালো চারদিকে কিন্তু এতো বেশি গ্যাস ধোঁয়ার মত ছড়িয়ে পড়ায় তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বনহুর ভালভাবে তাকালো চারদিকে। হঠাৎ চমকে উঠলো, দেখলো একটি টেবিলে নানারকম মেশিন বসানো আছে, একটা যন্ত্রের উপরে হাত রেখে উঁচু হয়ে পড়ে আছে মিস এ্যালিন।
বনহুর সব বুঝে নিলো, তৎক্ষণাৎ মিস এ্যালিনকে চিৎ করে ফেললো দেখলো তার দেহে আর জীবন নেই। মিস এ্যালিনের হাতের নিচে যে সুইচটা অন করা ছিলো বনহুর ক্ষিপ্রগতিতে অফ করে দিলো। একটা সাঁ সাঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিলো, সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। বনহুর ভালভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো, মিস এ্যালিন তাকেই হত্যা করার জন্য পালিয়ে এসে বিষাক্ত গ্যাসের সুইচ চালু করে দিয়েছে! কিন্তু সে নিজের মুখে কোনো মুখোশ বা অক্সিজেন পাইপ পরে নিতে ভুলে গেছে এবং সেই কারণেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে।
এবার বনহুর ফিরে এলো আবার তার সেই বন্দী গুহায়। মিস জীমস মীরার সংজ্ঞা তখনও ফিরে আসেনি। যেমনটি বনহুর রেখে গেছে তেমনি পড়ে আছে সোফার মধ্যে। হাত দু’খানা ছিন্ন লতার মত নিতিয়ে আছে দু’পাশে।
এ গুহায় বিষাক্ত গ্যাস এখনও তেমনভাবে প্রবেশ করেনি তাই রক্ষা, না হলে মিস জীমস মীরাকে কিছুতেই বাঁচানো সম্ভব হতো না।
বনহুর এবার নিশ্চিন্ত, সাগরতলের জ্যামস্ বাবার সবগুলো অনুচরকে নিঃশেষ করে ফেলেছে সে। এখন তাকে আর কেউ বাধা দিতে আসবে না কোন কাজে। মিস এ্যালিনও নিজের পথ নিজেই বেছে নিয়েছে। বনহুর নিজের দেহ থেকে ডুবুরী ড্রেস খুলে ফেললো। অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো বনহুর, একসঙ্গে এতোগুলোকে পরাজিত করে হত্যা করা কম কথা নয়। জ্যামস বাবার মত এক রাক্ষসের পাল্লায় পড়েও সে নিজকে রক্ষা করতে পেরেছে এবং তাকে নিহত করতে সক্ষম হয়েছে। বিষাক্ত গ্যাসের ক্রিয়া তাকে অনেকটা কাবু করে ফেলেছিলো। বনহুর দেহের বসন মুক্ত করে নিজকে অনেকটা শান্ত সুস্থ করে নিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ এখানে বিলম্ব করা যায় না। মিস জীমস মীরার সংজ্ঞা ফিরে না এলে কিছু করতে পারছে না। ফিরে তাকালো বনহুর জীমস মীরার দিকে।
এগিয়ে এলো ওপাশ থেকে, ডান হাতখানা দিয়ে জীমস মীরার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো আলগোছে। নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
নিজের মধ্যে একটা দুর্বলতা অনুভব করছে বনহুর। জীমস মীরার সৌন্দর্য তাকে অধীর করে তুলছে, কিছুতেই নিজকে সংযত রাখতে পারছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে তার কানের কাছে ভেসে এলো মনিরার কণ্ঠস্বর…..একি করছে মনির,–নিজকে সংযত করে নাও…..। বনহুর আবার শুনতে পেলো নূরীর কণ্ঠ…..না না, ভুল করো না, যদিও আমরা তোমার পাশে নেই কিন্তু আমাদের স্মৃতি তোমার চারপাশ ঘিরে আছে, ভুল করো না হুর……ভুল করো না হুর…….
বনহুর সরে এলো মিস জীমস মীরার পাশ থেকে।
পায়চারী করতে লাগলো, নিজের চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালাতে লাগলো দ্রুতগতিতে। মনকে সে কঠিনভাবে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করলো।
হঠাৎ মিস জীমস মীরা নড়ে উঠলো, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–পানি……
বনহুর তখনই পানির গেলাসটা নিয়ে এগিয়ে গেলো–এই নাও পানি জীমস মীরা।
জীমস মীরা উঠতে গেলো কিন্তু পারলো না–ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো উঃ মাগো মাগো……
বনহুর বামহস্তে ধরলো জীমস মীরাকে আর দক্ষিণ হস্তে পানির গেলাসটা চেপে ধরলো তার ঠোঁটের কাছে–খাও জীমস মীরা।
জীমস মীরা ব্যাকুল আগ্রহে পানি পান করলো। তার কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। পানি পান করে তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো, বললো–আমার কি হয়েছিলো বন্দী?
বনহুর তাকে ধীরে ধীরে সোফায় শুইয়ে দিয়ে বলল–বন্দী নয়, তুমি আমাকে বন্ধু বলে ডাকবে। কারণ আমি আর বন্দী নেই তোমাদের।
বন্ধু–বেশ, বন্ধু বলেই ডাকবো। কিন্তু আমার এ অবস্থা কেন?
সব ভুলে গেছো এরি মধ্যে?
জীমস মীরা ব্যথাভরা কণ্ঠে বললো–আমি ঘুমিয়েছিলাম, তখন কারা যেন আমাকে বেঁধে ফেললো। আমি ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি….
স্বপ্ন নয়–সত্য।
সব সত্য?
হাঁ, দেখছো না তোমার দেহের অবস্থা?
উঃ সমস্ত দেহে আমার রক্ত! আমার জামা ছিঁড়ে গেছে কেন?
তুমি রাণী, তাই তোমার প্রাপ্য ছিলো এসব। গভীরভাবে চিন্তা করলেই সব মনে পড়বে তোমার।
মিস জীমস মীরা একটু ভাবলো, তারপর হঠাৎ বলে উঠলো–সব মনে পড়েছে আমার। বন্ধু, জ্যামস্ বাবা….জ্যামস্ বাবা আমাকে হত্যা করবে, আমাকে হত্যা করবে! উঠতে গেলো মিস জীমস মীরা!
ধরে ফেললো বনহুর, সান্ত্বনার স্বরে বললো–জীম, আর ভয় নেই তোমার। জ্যাম বাবা এবং তার দলবলকে আমি হত্যা করেছি।
অবাক হয়ে তাকালো জীমস মীরা, বনহুরের কথা সে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না।
বনহুর বললো–তুমি নিশ্চিন্ত জীম। আর কেউ তোমাকে শাস্তি দিতে আসবে না। আমি নররাক্ষস জ্যামস্ বাবা ও অন্যান্য সবাইকে নিঃশেষ করেছি।
মিস এ্যালিন–সে কোথায়?
সে শয়তানীও নিজেই মৃত্যুবরণ করেছে। বললো বনহুর।
কিভাবে সে বিষ গ্যাস ছাড়তে গিয়ে নিজেই তার শিকার হয়েছে, সব খুলে বললো মিস জীমস মীরার কাছে বনহুর!
অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো মিস জীমস মীরা, নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পাচ্ছিলো সে। কারণ ছেঁড়া বসন ভেদ করে তার দেহের অংশগুলো বেরিয়ে পড়েছিলো।
বনহুর নিজের হাতে তোয়ালেটা মিস জীমস মীরার দেহে জড়িয়ে দিলো, একটু হাসলো বনহুর মুখ টিপে–হাজার হলেও জীমস মীরা নারী তো, আর সে পুরুষ, কাজেই লজ্জা পাবার কথাই বটে!
মিস জীমস মীরার পাশের সোফায় বসে বললো বনহুর–জীম এখন তুমি শোনাতে পারো তোমার সেই কাহিনী।
কিন্তু…….থেমে গেলো জীমস মীরা।
থামলে কেন, বলল কি বলতে চাও তুমি?
অনেক সময় লাগবে বলতে, তাই বলছিলাম পরে বলবো।
না, তুমি সংক্ষেপে বলো জীম কারণ আমি সেই ভেবে কাজ করবো।
জীমস মীরা বলতে শুরু করলো–আমার বাবা ইরানের বাদশাহ ছিলেন, তাঁর নাম শাহ নাশাদ। আমার বাবার একমাত্র কন্যা আমি। বাবার রাজ্য ছাড়াও তিনি এক দ্বীপের অধিকারী ছিলেন, সে দ্বীপ ছিলো ইরান সাগরের নিভৃত এক অংশ। কেউ সে দ্বীপের সন্ধান জানতো না আমার বাবা ছাড়া। বাবা মাঝে মাঝে ঐ দ্বীপে যেতেন, বহু রত্ন নিয়ে ফিরে আসতেন এবং সেইসব রত্ন বিক্রয় করে ইরানের দীন-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। বাবা কোনো গরির লোককে দেখলে প্রায় কেঁদে ফেলতেন, তিনি ভুলে যেতেন তিনি একজন বাদশাহ। সেই দীনহীন ব্যক্তিকে নিজের পাশে বসিয়ে শুনতেন কি তার অভাব বা কষ্ট। তারপর সাধ্যমত তার কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন……
বনহুর মুগ্ধ নয়নে শুনছিলো মিস জীমস মীরার কথাগুলো, বড় সুন্দর মিষ্টি লাগছে ওর কথার প্রতিটি শব্দ, বললো–বলো জীমস তারপর?
একদিন আমার বাবার কাছে এক ইংরেজ বণিক এসে হাজির হলো, কেঁদে-কেটে বললো–জাহাজডুবি হয়ে সর্বহারা পথের ভিখারী হয়েছে। এক মুষ্টি অন্নের জন্য আজ সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবার মহৎ হৃদয়ের কথা জানতে পেরে সে নাকি এসেছে বাবার কাছে। বাবা তার ছিন্ন মলিন পোশাক দেখে, তার কথা শুনে অনেক দুঃখ করলেন এবং তাকে সান্ত্বনা দিলেন– তিনি পুনরায় তার বাণিজ্য উপযোগী অর্থ দেবেন!
বাবা তাকে মহলে আশ্রয় দিলেন এবং তিনি তাকে খুব আদরযত্ন করলেন। এতো ছোটখাটো অর্থের প্রয়োজন নয়, বাবা একদিন জাহাজ নিয়ে ইরান সাগরে পাড়ি জমালেন, ফিরে। এসে বণিককে তার বাণিজ্য উপযোগী অর্থ দেবেন বলে গেলেন!
কিন্তু বাবা সেই যে ইরানসাগরে জাহাজ ভাসালেন আর ফিরে এলেন না। আমরা আশ্চর্য হলাম, বাবা যেদিন বিদায় নিলেন ঐদিন বণিকটাও নিরুদ্দেশ হয়েছে, তাকেও আর দেখা গেলো না।
বনহুর আগ্রহভরা কণ্ঠে বললো–তারপর?
তারপর সমস্ত ইরান যখন বাদশাহর অন্তর্ধানে মর্মাহত তখন এক ভয়ঙ্কর জীবের আবির্ভাব ঘটলো–ঐ জীব কিউকিলা। ইরানসাগর থেকে গভীর রাতে এই জীব উঠে আসতো এবং বাড়িঘর চুরমার করে লোকজনদের ধরে রক্ত পাম করতো।
ইরানবাসী যখন এই ভয়ঙ্কর জীব কিউকিলার অত্যাচারে অতিষ্ঠ তখন একদিন সেই বণিক এসে হাজির হলো রাজপ্রাসাদে। আমার বাবার মন্ত্রীবরকে বললো-তোমরা যদি শাহজাদী মীরাকে দাও তাহলে ঐ জীব আর তোমাদের উপর অত্যাচার করবে না।
রাজ্যরক্ষার জন্য মন্ত্রী গোপনে আমাকে সমর্পণ করলো সেই শয়তান ইংরেজ বণিকের হাতে। বণিক আমাকে নিয়ে কোথায় এলো আমি জানি না–জ্ঞান হলে দেখলাম, আমার বাবাকে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে তার দেহে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা বিদ্ধ করা হচ্ছে। বাবা যন্ত্রণায় করুণ আর্তনাদ করছেন আর বলছেন, আমি বলবো না কিছুতেই, আমার রত্ন ভান্ডারের সন্ধান তোমাকে দেবো না।
দেখলাম বাবার মুখেচোখে সেকি নিদারুণ বেদনাপূর্ণ ভাব। শুকিয়ে গেছে, মুখের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। দেহটা কঙ্কালের মত হয়ে পড়েছে। একটি বছর ধরে চলেছে তার উপরে এই। কঠিন নির্মম শাস্তি। বাবাকে দেখে আমি কেঁদে আকুল হলাম।
বাবা আমাকে দেখে কাঁদলেন না, তার নিজের অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি যেন ভুলে গেছেন সবকিছু, রীতিমত কাতরাচ্ছেন তিনি তখন!
শয়তান বণিক তার হাতির মত হাতখানা দিয়ে আমাকে ধরলো, তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ওদিকের অগ্নিকুন্ডটার দিকে, বললো–এবার এর পালা।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন আমাকে বেঁধে ফেললো।
আমি ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছি।
বাবা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না।
আমাকে ওরা শক্ত করে একটা লোহার থামের সঙ্গে বেঁধে ফেললো। তারপর যে লৌহশলাকা দিয়ে বাবার দেহে শেক দেওয়া হচ্ছিলো ওটা এবার নিয়ে এলো আমার দিকে।
আমি প্রাণফাটা চিৎকার করলাম–বাবা, বাবা…….।
এবার বাবা কথা না বলে পারলেন না, হঠাৎ বাবাও আমার মত চিৎকার করে উঠলেন– থামো, থামো আমার মেয়েকে তোমরা কষ্ট দিও না, আমি সব বলছি!
আশায় আনন্দে আমার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমি তাকালাম বাবার দিকে, বাবার মুখে মমতার ছাপ ফুটে উঠেছে, বাবা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
শয়তান বণিকের ইশারায় আমাকে মুক্ত করে দিলো তার ধূর্ত অনুচরগণ। বাবার বন্ধনও মুক্ত করে দিলো ওরা। বাবা ছাড়া পেয়ে আমাকে নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, মা মা বলে ডাকতে লাগলেন। বাবা যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে স্নেহ গদগদ হয়ে পড়লেন, তখন বাবার দেহে আমি এক ভীষণ উৎকট দুর্গদ অনুভব করলাম, বাবাকে কতদিন ওরা স্নান করতে দেয়না। তাছাড়াও বাবার গায়ে পোড়া অংশগুলি পঁচে তারই গন্ধ বের হচ্ছিলো।
বনহুরের মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, চোখ দুটি দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। অধর দংশন করতে লাগলো সে। বললো–ঐ শয়তান বণিক বুঝি তোমাদের জ্যামস্ বাবা?
হাঁ, ঠিক বলছো বন্ধু, ঐ শয়তান বণিকই জ্যামস্ বাবা যে আমার বাবার কাছে তার রত্ন ভান্ডারের সন্ধান জেনে নিয়ে আমাকে রত্ন ভান্ডারের রাণী করতে প্রতিশ্রুতি দিলো, আর আমার বাবাকে যে কি করেছে জানি না। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো জীমস মীরার।
বনহুর জীমস মীরার পিঠ চাপড়ে বললোতোমার বাবা জীবিত, আমি নিজ কানে শুনেছি এবং ঐ রত্নভান্ডারের মধ্যেই আছেন তিনি। জীমস আর বিলম্ব করা যায় না, কিউকিলা হত্যা না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নাই!
জীমস মীরা বনহুরের হাতে চেপে ধরলো–তুমি ওকে মারতে পারবে বন্ধু? পারবে মারতে?
পারবো জীমস।
সত্যি তুমি কতবড় সাহসী, কতোবড় বীর পুরুষ। এতোগুলো শয়তানকে তুমি একা হত্যা করেছে। জ্যামস্ বাবার মত এক নর রাক্ষসকে তুমি হত্যা করেছো…..আনন্দে জিমস্ মীরার চোখ উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো একটু থেমে বললো–কিউকিলা জ্যামস্ শয়তানের শুনেছিলাম পোষা রাক্ষস। ওকে দিয়ে ঐ শয়তান যা খুশি করাতো। আমি শুনেছি, কিউকিলাকে আরব সাগরের কোনো ডুবন্ত পর্বত থেকে জ্যামস্ বাবা কৌশলে হাতের মুঠোয় করেছিলো……
অস্ফুট ধ্বনি করে বনহুর–আরব সাগর থেকে কিউকিলাকে ঝম সাগরে আনা হয়েছিলো। ঝাঁম শহরকে ধ্বংস করাই ছিলো জ্যামসের উদ্দেশ্য এবং ঝাঁম রাজ্যের অধিপতি হবার সখ ছিলো তার।
অবাক হয়ে জীম তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখের দিকে।
বললো বনহুর–জীম, তুমি কি এখন সুস্থ বোধ করছো?
হাঁ অনেকটা।
আমাকে যেতে হবে।
বনহুরের কথায় শিউরে উঠলো জীমস্ মীরা–চলে যাবে?
একেবারে নয়, কয়েক ঘন্টার জন্য।
কোথায় যাবে তুমি?
কিউকিলা হত্যার চেষ্টা করতে..
আমিও যাবো তোমার সঙ্গে বন্ধু। আগ্রহভরা কণ্ঠে বললো জিমস্ মীরা।
বনহুর বললো সাবমেরিন নিয়ে আমাকে যেতে হবে। কাজেই তোমাকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয় জীম। বনহুর তার ডুবুরীর ড্রেস পরতে শুরু করলো।
জীমস মীরা তখন নিজের ছিন্ন ভিন্ন ড্রেসের দিকে তাকিয়ে বললো
আমার ড্রেস ও গুহায় আছে, যদি এনে দিতে তাহলে আমি খুশি হতাম।
বনহুর জীমস মীরার কথামত তার ড্রেস এনে দিলো।
জীমস ড্রেস পাল্টাবার সময় লজ্জিতভাবে বনহুরের দিকে তাকাচ্ছে দেখে বনহুর হেসে বললো–আমি ওদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি ড্রেস পরে নাও।
জীম বললো–আচ্ছা পরে নিচ্ছি, তুমি ওদিকে তাকাও।
বনহুর মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো।
জীমস মীরা জামা পাল্টে নিয়ে বললো–এবার তাকাও।
বনহুর দাঁড়ালো বাধ্য ছাত্রের মত।
জীমস মীরা হাসলো, সে তার ব্যথা ভুলে গেছে যেন অনেকটা।
বনহুর তার ডুবুরী ড্রেস পরা শেষ করে ডিনামাইটগুলো চোরা পকেটে তুলে নিলো।
জীমস মীরার মুখ ক্রমে বিষণ্ণ হয়ে আসছে।
বনহুর প্রস্তুত হয়ে বিদায় চাইলো–জীমস চলি?
জীমস তার স্বভাবমত বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরলো। তারপর পর পর কয়েকটা চুম্বন দিলো সে ওর গুন্ডদ্বয়ে।
বনহুর বাধা দিলো না বা দিতে পারলো না জীমস্ এর কাজে। সেও প্রতিদানে জীমস মীরার ওষ্ঠদ্বয়ে চুম্বনরেখা এঁকে দিলো গভীর আবেগে।
বনহুর সাবমেরিনে প্রবেশ করার পূর্বে ডুবুরী ড্রেস এবং অক্সিজেন পাইসপসহ মুখোশ পরে নিলো।
জীমস মীরা হঠাৎ কেঁদে ফেললো তোমাকে যেতে দেব না বন্ধু। তুমি খুলে ফেলো ও ড্রেস।
একি, তুমি কাঁদছো জীম।
আমাকে সঙ্গে নাও। মরতে হয় একসঙ্গে মরবো দু’জনা।
হেসে বলল, বনহুর–মরলে চলবে কি করে? তোমাকে তোমার পিতার কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমার বাঁচতেই হবে জীম। বনহুর মুখোশ খুলে ফেলেছিলো, আবার পরে নিলো।
বনহুর ততক্ষণে সাবমেরিনে উঠে বসেছে।
হাত নাড়লো জীমস।
বনহুর ঢাকনা বন্ধ করে দিলো সাবমেরিনের, তারপর বেরিয়ে এলো সমুদ্রতলে গভীর জলোচ্ছাসের মধ্যে। স্পীড বাড়িয়ে দিলো মিটারের সর্বশেষ কাটায় দ্রুত সাঁ সাঁ করে এগিয়ে চললো বনহুরের সাবমেরিনটা। সম্মুখের পাওয়ারফুল কাঁচের ক্ষুদ্র শাসী দিয়ে দেখছে বনহুর তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছে কত হাঙ্গর, কুমীর, কচ্ছপ, তিমি মাছ–আরও কত কি। নানারকমের। জলীয় উদ্ভিদ এবং লতাগুল্মের মাঝ দিয়ে স্পীডে চলেছে জলযানটা।
হঠাৎ কোনো ডুবন্ত পাহাড়ে বা ঐ ধরনের পাথরে সাবমেরিন ধাক্কা না খায় সেদিকে বনহুরের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। এতো দ্রুত সাবমেরিন চলছিলো যার জন্য বনহুর এক ঘন্টার মধ্যেই তার চিহ্নিত সেই ডুবন্ত পাহাড়ের নিকটে পৌঁছতে সক্ষম হলো। বনহুর চিনতে পারলো, এটাই সেই পাহাড় যার বিরাট গুহায় কিউকিলাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলো সে।
এতো সাবধানে এবং কৌশলে বনহুর সাবমেরিন চালনা করে এসেছে যার জন্য জলযানটা কোনো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে যায়নি। তাছাড়া বনহুর সেদিন আর্লিং-এর চালনা থেকেই নিজে শিখে নিয়েছিলো। স্পীডবোট চালনার মতই কতকটা, হাডেল ঘুরিয়ে গতি ঠিক রাখতে হয়। কয়েকটা সুইচ রয়েছে, এই সুইচগুলো কেমন ভাবে কোনটা কখন কাজে লাগাতে হয় সব সেদিন নিপুণভাবে লক্ষ্য করে দেখে নিয়েছিলো সে, কাজেই আজ কোনো অসুবিধা হলো না।
বনহুর তার পরিচিত ডুবন্ত পাহাড়টার বেশ কয়েক মাইল দূরে থাকতেই সাবমেরিনের স্পীড কমিয়ে দিলো। তারপর স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো গভীর জলের মধ্য দিয়ে!
দুঃসাহসী বনহুরের বুক এতোটুকু কাঁপলো না। অসীম সাহসে তার ক্ষুদ্র জলযান নিয়ে কিউকিলার আবাসস্থলের দিকে এগুচ্ছে বনহুর।
ভাগ্য তার প্রসন্ন বলতে হবে; বনহুর দেখলো ডুবন্ত, পাহাড়টার যে গুহায় একদিন কিউকিলাকে দেখেছিলো সে, আজ ঐ গুহা ফাঁকা। বনহুর বুঝতে পারলো, কিউকিলা ঝাঁম শহরে রক্তপান উদ্দেশ্যে গমন করেছে। আর বিলম্ব নয়, বনহুর সাবমেরিনসহ প্রবেশ করলো গুহার মধ্যে। অথৈ জলরাশিপূর্ণ গুহা সাবমেরিন নিয়ে অনায়াসে পৌঁছে গেলো ভিতরে।
বনহুর সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে পড়লো, ডুবুরী ড্রেস পরে সমুদ্রগর্ভে অবতরণে কোনো অসুবিধা হলো না। সাঁতার কেটে গুহার মধ্যে দেখে নিলো চারিদিক কোথায় ডিনামাইট বসালে কিউকিলাসহ পাহাড়টা ধ্বংস হয়ে যাবে। বনহুর অতি সতর্কতার সঙ্গে গুহার মধ্যে ডিনামাইট গুলো সাজিয়ে রাখলো সুন্দরভাবে। ডিনামাইটের সুইচ অন করে রাখলো। চাপ পড়লেই যাতে বিস্ফোরণ ঘটে।
বনহুর ডিনামাইট বসিয়ে সাবমেরিন নিয়ে যখন যমপুরী কিউকিলার আবাসস্থল থেকে বেরিয়ে আসছিলো তখন দৈত্যরাজ কিউকিলা তার বিরাট দেহ নিয়ে ফিরে আসছিলো নিজের গুহায়। ভাগ্যিস গুহার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলো বনহুর তাই রক্ষা, নাহলে গভীর জলের তলায় বনহুর নিঃশেষ হয়ে যেতো, আর সে কোনো দিন ফিরে যেতে না পৃথিবীর বুকে।
কিউকিলার পায়ের পাশ কেটে বনহুরের সাবমেরিন বেরিয়ে এলো সমুদ্রের অথৈ জলে। এবারে আর তাকে কে পায়, স্পীডে ছুটছে জলযানটা! সাঁ সাঁ করে তার বেগে চলেছে, বনহুর সুইচ অন করে হ্যান্ডেল চেপে ধরে আছে। না জানি কোন্ মুহূর্তে পিছনে শোনা যাবে ডিনামাইট বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দটা। একটি নয়–তিনটি ডিনামাইট বসিয়ে রেখে এসেছে বনহুর।
বনহুরের সাবমেরিন কয়েক মাইল আসতে না আসতে পিছনে সমুদ্রগর্ভে ভীষণ এক আওয়াজ হলো, সঙ্গে সঙ্গে ডুবন্ত পাহাড়টা যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়লো চারপাশে। তোলপাড় শুরু হলো যেন মনে হলো সমস্ত পৃথিবীটা যেন ধ্বংস হয়ে গেলো।
ডুবন্ত পাহাড়টার পাথরখন্ডের সঙ্গে বনহুরের সাবমেরিনখানা ধাক্কা খেলো প্রচণ্ডভাবে। বনহুর তবু সংজ্ঞা হারালো না বা সাবমেরিনের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিলো না। শক্ত হাতে ধরে রাখলো, যেমন করে তোক নিজে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে অসহায় জীমস মীরাকে।
[পরবর্তী বই ইরান সাগরে দস্যু বনহুর]