কাশ্মীর সমস্যা, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল”
১৯৪৭ সালের দেশভাগের শর্ত অনুসারে এটি হচ্ছে মালিকানার প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব। ভারতের দাবি, কাশ্মীর তার অবিচ্ছেদ্য অংশ- পাকিস্তান এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত দখলদার; কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতা বা পাকিস্তানে যাওয়ার দাবি ভারতের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে কাশ্মীর সমস্যা হচ্ছে ‘অমীমাংসিত দেশভাগ। এই বিরোধের সূত্র থেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। যুদ্ধ চলাকালেই ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি কাশ্মীর সমস্যাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলে ভারত। জাতিসংঘ তারপর বিভিন্ন রেজুলেশন পাস করে। প্রথম রেজুলেশন (১৯৪৮) অনুসারে জাতিসংঘ একটি কমিশন (ইউএনসিআইপি) তৈরি করে।
দ্বিতীয় রেজুলেশন (১৯৪৮) অনুসারে ইউএন কমিশনের কর্মপরিধি ও সদস্য বাড়ানো হয়। মিলিটারি পর্যবেক্ষক ও মিলিটারি উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। এর আওতায় প্রথম ইউএন মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান (ইউএনএমওজিআইপি) জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরে আসে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মিলিটারি অবজারভার গ্রুপের দুটি দপ্তর সক্রিয় আছে কাশ্মীরে। একটি ভারত শাসিত অংশে, অন্যটি পাকিস্তান শাসিত অংশে। স্বাধীন কাশ্মীরের দাবিদার এক বুদ্ধিজীবী এই লেখককে বলেছিলেন, ‘মিলিটারি অবজারভার গ্রুপের উপস্থিতি এখনও প্রমাণ করছে যে কাশ্মীর একটি আন্তর্জাতিক বিরোধ। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল দুই দেশের। ১৯৪৯ সালেই জাতিসংঘ একটি মিডিয়েটর গ্রুপ নিয়োগ দেয় জেনারেল নাগটনের নেতৃত্বে। নাগটন কমিটির প্রস্তাবগুলো ছিল
১. রাজ্যের মধ্যবর্তী সিজফায়ার (যুদ্ধবিরতি) লাইনের উভয় পাশ থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে হবে, যাতে কোনো ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ না করে।
২. কাশ্মীর ভ্যালি, পুঞ্চ ও জম্মু এলাকার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের গিলগিত ও বালতিস্তানকেও বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরতে হবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে জম্মুর মুজাফফারাবাদ এলাকাসহ গিলগিত ও বালতিস্তানকে তাদের অধিকারে নেয়। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে মূলত ১৯৪৭-এর আগে মহারাজার অধীনে থাকা ওইসব এলাকাসহ গোটা রাজ্যকেই বিরোধপূর্ণ হিসেবে মত দেয় ওই কমিটি।
৩. কমিটি প্রস্তাব করে, ওই এলাকাগুলো সেখনকার (existing) স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা শাসিত হবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে।
৪. জাতিসংঘের ৫ জানুয়ারি ১৯৪৯ তারিখের রেজুলেশন অনুসারে জাতিসংঘের কমিশনের তত্ত্বাবধানে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পাকিস্তান রাজি ছিল। কিন্তু ভারত হয়নি। ভারতের অভিযোগ ছিল, পাকিস্তান উপজাতীয় দখলদারদের সহায়তা করার মাধ্যমে মহারাজার ভারতে যোগদানের চুক্তিকে লঙ্গন করেছে। অর্থাৎ, ভারতের দাবি ছিল মহারাজা যে ভারতে যুক্ত হয়েছিলেন সেটাই ফাইনাল। সুতরাং যে কোনো উদ্যোগের আগে শর্তহীনভাবে জম্মু-কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য এবং উপজাতীয়/পাঠান লোকদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানায় ভারত। ১৯৫০ সালের ১২ এপ্রিল ওয়েন ডিক্সনকে মিডিয়েটর করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ডিক্সন রিজিওনাল পিলবিসাইট’ এর প্রস্তাব দেন।
তাতে বলা হয়, পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে আছে যেসব এলাকা তাদের পাকিস্তানের অধীনে আর যেসব এলাকা স্পষ্টতই ভারতে যোগদানের পক্ষে তাদের ভারতের অধীনে যুক্ত করে দেওয়া হোক। আর কেবল, যেখানে জনমত সুস্পষ্ট নয় সেখানেই গণভোট আয়োজন করা হোক। তিনি মূলত গিলগিত-বালতিস্তানকে পাকিস্তানের অধীনে এবং জম্মুকে ভারতের অধীনে দেওয়ার কথা বলেছেন। আর কাশ্মীর ভ্যালিসহ আশপাশের এলাকায় গণভোটের কথা বলেছেন। তবে ভারত ও পাকিস্তানের কেউই এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। উভয়ই ‘আস্ত মুলোর দাবিদার ছিল।
১৯৫০ সালের ২৩ আগস্ট ওই অস্ট্রেলিয়ান কূটনীতিক ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। একদিকে জাতিসংঘের এসব উদ্যোগ চলছিল। অন্যদিকে, ভারত শাসিত অংশে ভারতীয় ব্যবস্থার অধীনে একটি গণপরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। অর্থাৎ, মহারাজার পক্ষ থেকে কাশ্মীরের যোগদানকে যৌক্তিক ধরে ভারত এগিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা অনেকটা বিরোধপূর্ণ জমিতে সালিশ চলাকালীন জমির দখল চালিয়ে যাওয়ার মতো। এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়া আসে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দুই শক্তিশালী নিরাপত্তা পরিষদ সদস্য যৌথভাবে একটা রেজুলেশন দেয় জাতিসংঘে।
ফলে, ফের কাশ্মীর ইস্যুর আলোচনা নিরাপত্তা পরিষদে ওঠে ১৯৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। অ্যাংলো-আমেরিকান এই রেজুলেশনের পর ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধির বক্তব্য শোনা হয়। পাকিস্তান এটি মেনে নেয়। কিন্তু, নেহরু ‘অবজেকশন দেন। ১৯৫১ সালের ৩০ মার্চ ফ্রাঙ্ক পি গ্রাহাম মধ্যস্থতার জন্য নিযুক্ত হন। তিনি তিন বছর চেষ্টা করেন। কিন্তু, দুই দেশের কাউকে তিনি খুশি করতে পারেননি। ভারতের দাবি ছিল, মহারাজার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর ভারতে যোগ দিয়েছে। তাই পাকিস্তানকে সব ধরনের সৈন্য সরিয়ে না নিলে কোনো ধরনের গণভোটের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল, প্রস্তাবে পাকিস্তানকে
সব সৈন্য সরিয়ে নিতে বলা হলেও ভারতকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে কিছু সৈন্য রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যা সুষম নয়। এছাড়া, নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের সক্রিয় তত্ত্বাবধান ছাড়া গণভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না এমন আশঙ্কাও করেছে পাকিস্তান। এরই মধ্যে ভারত শাসিত অংশে ভারতের তত্ত্বাবধানে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। ভারতীয় সংবিধানে একটি বিশেষ রাজ্য হিসেবে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরকে ব্যাখ্যা করা হয়। ফের ১৯৫৪ সালে সিকিউরিটি কাউন্সিলে আলোচনা হয় কাশ্মীর সমস্যা। ততদিনে নেহরুর কাছে শেখ আবদুল্লাহর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সে তখন জেলবন্দি। ১৯৫৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বকশি গোলাম মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন জেঅ্যান্ডকে বিধানসভা মহারাজার স্বাক্ষরিত ভারতে যোগদানপত্র অনুমোদন দেয়।
এর জবাবে পাকিস্তান বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে নেয়। সেখানে একটি রেজুলেশন পাস হয়। তাতে আবারও বলা হয়, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের কথা। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, ইউকে এবং ইউএসএ একটি প্রস্তাব তোলে। তাতে ভেটো দেয় রাশিয়া। পরে এপ্রিল মাসে একটি সংশোধিত প্রস্তাব আনা হয়। সেটি গৃহীত হয়। ১০টি দেশ সমর্থন করে। রাশিয়া ভেটো না দিয়ে নীরব থাকে। সেই আলোকে সুইডিশ নাগরিক গানার জারিং দুই দেশের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাদের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেন।
তিনি তার রিপোর্টে বলেন, গণভোট হলে নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ নতুন মাত্রা পাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এই রিপোর্টটি ভারত সানন্দে গ্রহণ করে। অর্থাৎ, জারিং কমিশন কোনো সমাধান দেয়নি। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিল আরেক ইউএন প্রতিনিধিকে কাশ্মীর পাঠান। ১৯৫৮ (মার্চ) সালে ওই প্রতিনিধি তার রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে একটি কনফারেন্স প্রস্তাব করেন। যা পাকিস্তান গ্রহণ করলেও ভারত অস্বীকার করে। অর্থাৎ, তিনি ভারত-পাকিস্তানের সরাসরি সমঝোতার পরামর্শ দেন। কিন্তু, দিন শেষে ক্ষমতার রাজনীতিই প্রভাব বিস্তার করে।
স্পষ্টতই, ১৯৫৮ সালের পর থেকে কাশ্মীর সংকটের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা রিপোর্টিং, বিবৃতি ও উদ্বেগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে আবারও কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ বাধে দুই দেশে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি সই হয়। সে অনুসারে উভয় পক্ষ একে অপরের এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে আলোচনা চালানোর ঘোষণা দেয়। মূলত, এই চুক্তি কাশ্মীর সমস্যাকে ফ্রিজাবদ্ধ করে দেয়। এই ঘোষণা কাশ্মীরের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তাছাড়া, আমেরিকা তখন ভিয়েতনামে ব্যস্ত। এ ছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও
নানা সংঘাতে ও জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে, পাকিস্তানের উদ্যোম ও আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়া ভারতের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। ওই সময় জাতিসংঘ কাশ্মীরি জনগণের রাইট টু সেলফ ডিটারমিনেশনের কথা উল্লেখ করে রেজুলেশন পাস করলেও রিয়ালিস্ট (বাস্তববাদী) রাজনীতিতে তা সামান্যই গুরুত্ব পায়। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ চার্টারের চতুর্থ অধ্যায় অনুসারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শুধু সুপারিশ করতে পারে। বিরোধে জড়িত পার্টিগুলো তা মানা বা না মানার এখতিয়ার রাখে। সেই এখতিয়ারের বলে দেশ দুটির স্বার্থের দ্বন্দ্বই (কনফ্লিক্ট ওভার ইন্টারেস্ট) টিকে থাকল। জাতিসংঘের পরামর্শমাফিক জনগণের মতামতের প্রাধান্য পেল না। তবে, এখনও জাতিসংঘের দৃষ্টিতে কাশ্মীর একটি অমীমাংসিত ‘বিরোধ’।
এখানে উল্লেখ করা জরুরি, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকা ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে গেলেও প্রভাবশালী দেশগুলোর অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল কাশ্মীর সফর করেছিল। কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ভূমিকার গুরুত্ব সম্পর্কে সেই দলের মন্তব্যটি এখানে উল্লেখযোগ্য। কাশ্মীরি জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর আস্থা ধরে রাখা কঠিন। কারণ, আন্তর্জাতিক মহল প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘমেয়াদে কাশ্মীর সমস্যার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেনি।
এমনকি তারা কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃত দিকগুলোর বিষয়ে মনোযোগও দেয়নি।” ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে রাশিয়ার মধ্যস্থতার কথা আগেই বলা হয়েছে। চীন যদিও সরাসরি কাশ্মীরের সীমানার সঙ্গে যুক্ত একটি পক্ষ। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অমীমাংসিত রাজ্যটির বিরাট এলাকা। কিন্তু, দেশটি এই ইস্যুতে বরাবরই নীরব কূটনীতির অনুসারি। পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির রয়েছে গভীর ও সুমিষ্ট সম্পর্ক। তবে, সে সম্পর্ক মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিনিয়োগমুখী। যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে গেলে শুরু করতে হয় রবার্ট হাথাওয়ের বক্তব্য দিয়েই।
তিনি মার্কিন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক স্ক্যাফারের বরাতে লিখেছেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান বা অন্তত ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কখনও সম্পৃক্তি (এনগেজমেন্ট) আর কখনও নিশ্চলতার (কুয়েসেন্স) মধ্যে উঠানামা করেছে। কাশ্মীর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন স্টিফেন কোহেন। তিনি তার ১৯৯৩ – ৯৫ সালের মধ্যে লেখা এক নিবন্ধে কাশ্মীর সমস্যার জটিলতা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটি হচ্ছে একটি সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, ধ্বংস এবং ভীতির সমন্বয়, যা ইতিহাসের কয়েকটি ধাপে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ও আইজেন হাওয়ারের সময় তাদের অবস্থান ছিল ব্যাপক
কঠোর। নেহরু একবার এক আমেরিকান অফিসারকে বলেছিলেন, “আমি ওয়াশিংটনের যতসব নীতিবাক্য শুনতে শুনতে ক্লান্ত। দীর্ঘকাল ধরেই ওয়াশিংটনের বিশ্বাস ছিল, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে অ্যাংলো-আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্ক নির্ভর করবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের ওপর। কিন্তু, নেহরু রাশিয়ার সঙ্গে সখ্যের সুযোগে জাতিসংঘে তোলা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রস্তাবে ভেটোর ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে বিল ক্লিন্টন ২০০০ সালে কাশ্মীরে সফরের সময় মন্তব্য করেছিলেন, কাশ্মীর হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা। কিন্তু, মার্কিন কর্তৃপক্ষের সেই মনোভাব বদলে গেছে ক্রমান্বয়ে। স্টিফেন কোহেন তার মুভিং ফরওয়ার্ড ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক নিবন্ধে (মে ২০০১) লিখেছিলেন,
‘পৃথিবীর তিনটি বৃহত্তম উপজাতীয়-স্থানীয় (ethnic-domestic) সংঘাতের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। যথা: আফগানিস্তান, কাশ্মীর এবং শ্রীলঙ্কা। সংঘাতের প্রকৃতিগত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিবেচনায় তিনটি সংঘাত আলাদা। সুতরাং, এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাদা আলাদা নীতি হওয়া দরকার। এবং, দক্ষিণ এশিয়ায় কাশ্মীর হচ্ছে সবচেয়ে সংকটাপন্ন সমস্যা। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের ট্রিগার পয়েন্ট। পাকিস্তান সেখানে র্যাডিক্যাল জিহাদিদের সহায়তা করছে। যতক্ষণ পাকিস্তান এই সহায়তা অব্যাহত রাখছে ততক্ষণ সেখানে সংঘাত বিস্তারের আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। ইসলামাবাদের এই ভূমিকার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
কাশ্মীর সংকটের দাবিতে ভারত-পাকিস্তান কয়েকটি যুদ্ধ করেছে। ১৯৯৯ সালে কারগিলে সীমিত পরিসরে এক যুদ্ধ হয়েছে। কাশ্মীরকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো শক্তি পাকিস্তানের নেই। কিন্তু, উপত্যকায় সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার শক্তি তার আছে। ভারত কাশ্মীরকে দখলে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু, ঠিকঠাকভাবে শাসন করতে অক্ষম। বর্তমান এই বৃহদাকার সংঘাতের মধ্যে কাশ্মীরি জনগণের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি হুমকির মুখে। আর কাশ্মীরের স্থানীয় নেতৃত্ব দুর্বল এবং দ্বিধাগ্রস্ত। এ সমস্যায় জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই কোনো সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। অধিকন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু উদ্যোগ নিতে পারে। ১. কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে ভারতকে একটি অর্থবহ সংলাপে উৎসাহিত করতে পারে। ২. সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান বৃদ্ধিতে ভারতকে সহায়তার প্রস্তাব দিতে পারে। ৩. ইসলামাবাদকে বার্তা দিতে পারে যে, নন-কাশ্মীরি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তা অব্যাহত রাখলে তাদের দেশকে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”(৬)
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে পাকিস্তান ঘেঁষা অবস্থান থেকে মাঝামাঝি একটি অবস্থানে এসেছে। এবং এটা ঘটেছে ৯/১১-এর আন্তর্জাতিক পটপরিবর্তনের পর। তারই ধারাবাহিকতায় এখন খবরের কাগজে প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের
বিবৃতি দেখা যায়। তাতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্পেকসপার্সন বলে থাকেন, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদেরই আলোচনা করা উচিত।(৭)। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিকের সঙ্গে ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাক্ষাৎ হয়েছিল এই লেখকের। তিনি কাশ্মীরে গিয়েছিলেন মূলত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এবং পর্যটনের সম্ভবনা ও নিরাপত্তার অবস্থা যাচাই করতে। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাগানে বসে তার সঙ্গে প্রায় দেড় ঘন্টা আলাপের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও গবেষক ছিল। ওই কূটনীতিকের নাম জর্জ এন. শিবলি। তাকে কাশ্মীরি এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেছিল, আপনারা চাইলে যেকোন কিছুই করতে পারেন। তোমার দেশ সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু তোমরা কেন কাশ্মীর ইস্যুতে কিছু করছো না? তার জবাব ছিল,
‘আপনি আপনার মতামত নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আপনি ধরে নিতে পারেন আমার গায়ে অনেক মোটা চামড়া আছে। তবে আসলে সিরিয়া নয়। ইরাকের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকার কথা আমরা বলতে পারি। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে আমাদের দেশের এমন একটা অবস্থান ছিল যে, আমরা পৃথিবীর যেকোন স্থানে যা কিছু করতে পারি। সেই প্রেক্ষিতে, জর্জ বুশ ও ডোনাল্ড রামসফেন্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইরাকে। এটা সত্য, আমি জর্জিয়ায় তিন বছর কাজ করেছিলাম। আমি ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেন এবং তার ছেলেদের নিষ্ঠুরতার কথা জানি। সে ছিল ভয়ানক। সুতরাং, আমরা মনে করেছিলাম ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দামকে সরিয়ে দিলেই মানুষ আমাদের বন্দুকের নলে ফুল বসিয়ে অভিবাদন জানাবে। কিন্তু তা হয়নি। যুদ্ধে ৪০০০ মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে। তার চেয়ে অনেক বেশি নিহত হয়েছে ইরাকি। এটা ছিল আমাদের ভুল।’
কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি বললেন, “আমরা যদি ভারতকে শক্তভাবে কিছু বলি তারা বলবে, আপনারা আমাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কিছু করতে পারেন না। আমরা কাশ্মীরের মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা বুঝি। কিন্তু কিছু করতে হলে সেটা হতে হবে শান্তভাবে (ইন অ্যা সফট ওয়ে)।
নোট/সূত্র
১. ফয়সাল মাহমুদ সম্পাদিত ঢাকা থেকে প্রকাশিত (সেপ্টেম্বর, ২০১৬) “বিবেকের বার্তা” ম্যাগাজিনে কাশ্মীর সমস্যা ও জাতিসংঘ’ শীর্ষক লেখকের একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়। এই অধ্যায়টি ওই লেখার বর্ধিতাংশ।
২. উপরের তথ্যগুলো দুটি সূত্র থেকে নেওয়া। Ahmed, Samir; Contextualizing Mosharraf’s Four Point Formula; Journal of Kashmir Studies, 2012; Pp: 87-105. এবং Sajad Padder; India-Pakistan: Composite Dialogue Process (2015); New Delhi; Pp: 22-30.
৩. J-k.com; Kashmir, World’s Most Beautiful Prison;
http://www.jammukashmir.com/archives/archives 2004/kashmir20040721a. html (accessed: 14, Oct; 2015)
৪. Srinath Raghavan (2013); 1971: Global History of the Bangladesh War; P 1.
৫. Robert M Hatahway; Review; https://www.foreignaffairs.com/reviews/capsule-review/ 2010-0301/limits-influence-americas-role-kashmir
৬. Stephen P. Cohen; 2001, Moving Forward in South Asia; Brookings: Web; Kashmir: The Roads Ahead; 1995.
৭. Greater Kashmir; 26 December, 2015; P. 1.