কাশ্মীর থেকে শেখা
দুটি বছর। নির্মল প্রকৃতির বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছি। দেখেছি কতগুলো মানুষের নির্মল চেহারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হতে হতে বীভৎস হয়ে গেছে। এখন তারা ভয়ঙ্কর। মৃত্যু এখন তাদের কাছে ভয় নয়, সাহসের সঞ্চয়। ভারতীয় সাংবাদিক হুমরা কোরায়শী কাশ্মীরের ওপর লিখেছেন একটি বই। তিনি একবার এক আলাপে বলেছিলেন, তোমরা কাশ্মীরে থাকছে, দেখছো। বিনিময়ে কাশ্মীরকে কী দেবে? কী করবে কাশ্মীরের মানুষের জন্য? এই প্রশ্নের কোনো জবাব সেদিন ছিল না আমার কাছে। আজও জানি না কী দেওয়ার আছে আমার কাশ্মীরকে? তবে, কাশ্মীর আমাকে দিয়েছে কিছু পরম প্রিয় বন্ধু।
কাশ্মীর আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ফের মনুষ্যত্ব। কাশ্মীর আমাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে, মৃত্যুর মধ্যে জীবনকে। কাশ্মীর আমাকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বাঙালির বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুলের বাণী- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাসরি, আর হাতে রণতূর্য’। এখনও কাশ্মীরের ঘরে ঘরে ওয়ানয়ুন সুর করে বেজে ওঠে আনন্দ-অনুষ্ঠানে, বিয়েতে। ওয়াজারা রাধেন ওয়াজওয়ান। আবার সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে কফিনে ঢোকে তাগড়া যুবক। যেখানে আমার মতো বিদেশিরা নিরাপদ অনেকটাই। কিন্তু, মাটির ছেলেরা কবরের আগ পর্যন্ত নিরাপত্তাহীন। সেই মাটির ছেলেদের নিরাপত্তার প্রত্যাশা করেই ফিরছি স্বদেশে, নিরাপদে। কাশ্মীরকে সে হিসেবে কিছুই দেওয়া হয়নি। তবে, কাশ্মীর থেকে নিয়েছি অনেক।
কাশ্মীরের কাছ থেকে আমি ঠিক তিনটি বিষয় শিক্ষালাভ করেছি। প্রথমত, কাশ্মীরি ভাষা। ভাষাটির এক অন্যরকম শক্তি আছে। আছে জযবা। এ ভাষার শব্দভাণ্ডার সীমিত কিন্তু আবেগ অসীম। ছোটোখাটো বাক্য কিন্তু তীব্র প্রভাব সৃষ্টিকারী। বাংলাভাষার চেয়ে অনেক কম শব্দ এর অভিধান। এতে সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি আর হিব্রুসহ অনেক ভাষার শব্দ আছে। কিন্তু ভাষাটির নিজের শব্দ খুবই কম। আমার ধারণা এটা এখনও একটা রিসিভার ল্যাঙ্গুয়েজ। গ্রাহক। বিতরণকারী নয়। ভাষা হলো একটা সমাজের প্রবেশদ্বার। আমি সে দুয়ার যখনই খুলেছি তখন দেখি সময় হয়েছে ফেরার। এখন কাশ্মীর আমাকে বারবার টানে।
দ্বিতীয়ত, কাশ্মীর আমাকে দিয়েছে একটি রাজনৈতিক উপলব্ধি। কাশ্মীর থেকেই আমি প্রথম উপলব্ধি করেছি জাতিরাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা। অভিজ্ঞতা পেয়েছি যে কিভাবে জাতিরাষ্ট্র অক্ষম হয়ে পড়ে অনেক সময়। সৈন্য, সামন্ত, গোলাবারুদসহ সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের উপস্থিতি সত্ত্বেও তার সুগভীর ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয় তখন যে কী অবস্থা হয় তা উপলব্ধি করেছি কাশ্মীর থেকে। কাশ্মীরি লোকদের আচরণের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা বা ভক্তি নেই। সেখানে সামাজিক কাঠামো কার্যকর রয়েছে রাষ্ট্রের চেয়ে বহুগুণ।
সত্যিই, সমাজ হলো একটি স্থানিক লোকাল গ্রোন প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র হলো মৌলিকভাবে বহিরাগত। স্পষ্টতই, ইউরোপীয়। সমাজ একই সঙ্গে হারমনি আর কনফ্লিক্টের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। রাষ্ট্র চলে ক্ষমতার ভিত্তিতে। রাষ্ট্র দাবি করে তার শক্তি প্রয়োগের বৈধতা আছে। আমার দেশে এমনই একটা রাষ্ট্রযন্ত্র আজ সমাজের ওপর আধিপত্য করে। আর কাশ্মীরে দেখেছি সমাজ বুড়ো আঙ্গুল দেখায় রাষ্ট্রকে। যদিও রাষ্ট্র সেখানে প্রশাসনযন্ত্র চালায় কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ ব্যাপকভাবে পরিচালিত এবং প্রভাবিত হয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা। কাশ্মীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাষ্ট্রগুলো আজও এই সীমাবদ্ধতাগুলো উপলব্ধি করেছে বলে মনে হয়
যত দ্রুত তারা বুঝতে পারে ততই ভাল। তৃতীয়ত, আমি এখান থেকে শিখেছি বিশ্বাসের গভীরতা। বুঝেছি, বিশ্বাস কতটা গভীরভাবে মানুষের কার্যক্রমকে বাতলে দিতে পারে। এখানকার অধিকাংশ মানুষ ভাবে এবং চলে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে। তারা অন্যকে ভালবাসে কেবল বিশ্বাসের কারণে, আস্থাও রাখে।
আবার কেবল বিশ্বাসের কারণেই ঘৃণা করে। সমাজের এই বৈশিষ্ট্যটি অনেক কল্যাণকর বিবেচিত হতে পারে। এটা সমাজে শান্তি আনতে পারে। কেবলমাত্র যদি বিভিন্ন বিশ্বাসের মধ্যকার সম্পর্কগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি ও নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু, কাশ্মীরিদের বিশ্বাসগুলো বহুধাবিভক্ত। স্পষ্টতই, সেখানে আছে স্টিরিওটাইপস আর প্রিজুডিস। একের বিরুদ্ধে অন্যের। সেটাই সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা আর অস্থিরতা। সেই অস্থিরতা অবসানের আশাবাদ জানিয়ে কাশ্মীরি ভাষায়ই শেষ করি, ‘খোদায়েস পৈঠ হাওয়ালাহ’- খোদা ভরসা।