কাশ্মীরের স্বাধীনতা ও বামপন্থা
কাশ্মীরের বামপন্থা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা সামান্যই চোখে পড়েছে। শেখ আবদুল্লাহর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে কিছু কথা লিখেছেন। এখানেও সবিস্তার আলোচনার খুব একটা সুযোগ নেই। মূলত কাশ্মীর ইস্যুতে যত কথাই হয়, ঘুরে ফিরে ইসলামপন্থার কথা আসে। তবু কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্কটি তুলে ধরা কোশেশ জরুরি। বামপন্থার মূলকথা হলো, শ্রমিক-মজুর ও দরিদ্র লোকেরা ক্ষমতার কেন্দ্ৰাসীন ‘উচ্চ শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। একটি শ্রেণিহীন-সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চলবে।
সে অর্থে ডোগরা মহারাজার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রথম বিদ্রোহ পূর্ণরূপে একটি বাম বিদ্রোহ। যদিও সেখানে তখন বামপন্থার তত্ত্ব নিয়ে পর্যালোচনা হয়নি। স্রেফ একটি বিদ্রোহ হয়েছে মহারাজার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের। ১৮৬৫ সালে শাল শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনার জন্য ওই বিদ্রোহ করেছিল। ডোগরা আমলে জমিদারি ব্যবস্থার অধীনে অস্বাভাবিক ট্যাক্স আরোপের কারণে মানুষের জীবন ছিল মানবেতর। বিভিন্ন একাউন্টে তার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। শাল বুননের কাজে নিয়োজিত শিল্পীদের মহারাজার আমলে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো দৈনিক চার আনা। মাসিক আয় হতো ৭-৮ রুপি। সেখান থেকে জনপ্রতি মাসিক পাঁচ রূপি ট্যাক্স আদায় করতেন মহারাজা। ১৮৬০-এর দশকে কাশ্মীর ভ্যালিতে ১১ হাজার তাঁত মেশিনে ২৭ হাজার শিল্পী কাজ করতেন।
সেই হিসেবে তাদের কাছ থেকে বার্ষিক ১৫ লাখ ৯০ হাজার রুপি আয় হতো যার ১২ লাখ জমা হতে মহারাজার খাতে। বাকিটা থাকত কাশ্মীরের গভর্নরের পকেটে। গভর্নরও হতেন মহারাজার অধীনস্থ, বিশ্বস্ত কেউ (ওজির পানু ও কৃপা রাম প্রমুখ গভর্নর ছিলেন ১৮৬০-এর দিকে)। এই শোষণের বিরুদ্ধে ১৮৬৫ সালের ২৯ এপ্রিল শাল শ্রমিকরা বিদ্রোহ করেন। তারা শ্রীনগরের পুরান শহরের জলডেগার এলাকায় জড়ো হন। মহারাজার পুলিশ তাদের একটি জলাশয়ের পাশে আবদ্ধ করে দেয়। সেখানে ঠাণ্ডা পানিতে পড়ে ২৮ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। রসুল শেখ, ইবলি বাবা, আবু কুদুস, সোনা শাহ প্রমুখ নেতাসহ প্রায় ৩০০ শ্রমিক গ্রেপ্তার হয়। রসুল শেখ ও ইবলি বাবা কাস্টডিয়াল নির্যাতনে প্রাণ দেন। কাশ্মীরি লেখক জাভেদ ইকবাল লিখেছেন, হে মার্কেটে ১৮৮৬ সালে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মরণে সারা পৃথিবীতে মে দিবস পালিত হয়। কাশ্মীরের শ্রমিকরা তারও প্রায় দুই দশক আগে অধিকারের জন্য
জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বিস্মৃতপ্রায়। কাশ্মীরের মহারাজার বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া প্রথম ওই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। ওই আন্দোলন সে অর্থে কোনো দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ, আন্দোলনটি একেবারেই শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব তাতে ছিল না। এখনও সামান্য সংখ্যক শিক্ষিত লোক এই আন্দোলনটির খবর রাখে। পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে মহারাজার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তুমুল গণআন্দোলন দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ, তাতে শিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল ছিল। দ্বিতীয়ত, তা শুরু হয়েছিল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে ঘিরে। অর্থাৎ, কাশ্মীরের সংগ্রামে ধর্ম শুরু থেকেই ফ্যাক্টর ছিল। কাশ্মীরের ইতিহাসে বামপন্থার সবচেয়ে বড় অবদান হলো ‘নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টো’।
১৯৪৪ সালে এই মেনিফেস্টো দেওয়া হয়। পাঞ্জাবের ড. বাবা পিয়ারে লাল বেদী ও তার স্ত্রী ফরিদা বেদী (বলিউড অভিনেতা কবির বেদীর বাবামা) এই মেনিফেস্টোর রচয়িতা। তারা মার্কসবাদের দর্শনে আকৃষ্ট ছিলেন। এতে একটি কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স, প্রতি ৪০ হাজার লোকের বিপরীতে একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় পরিষদ, স্বাধীন বিচার বিভাগ, সকল নাগরিকের সমানাধিকার, প্রত্যেক নাগরিকের বিবেকের স্বাধীনতা, উপাসনার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, শিক্ষা, সম্পদের মালিকানার, কাজ, বিশ্রাম ও সংগঠনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয় সেখানে। রাজ্যের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার ঘোষণাও ব্যক্ত হয়।(২) দৃশ্যত নয়া কাশ্মীরকে বিপ্লবী মনের একটি ফসল মনে হয়। ওই কমিউনিস্ট চিন্তকরা কাশ্মীরের দারিদ্র্য ও অশিক্ষার অবস্থা দেখে এবং বিপ্লবের মাতৃভূমি রাশিয়া থেকে কাশ্মীরের অবস্থানগত নিকটবর্তিতার কারণে একে টার্গেট করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।
তারা কাশ্মীরকে কমিউনিস্ট বিপ্লবের একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছিলেন। শোষণ বঞ্ছনার শিকার হওয়া শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবের মন্ত্রে ধাবিত করার মতো সম্ভাবনা সেখানে ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু বামপন্থী নেতারা সে অর্থে শ্রমজীবী মানুষের কাছে বিপ্লবের শ্লোগান নিয়ে যাননি। তারা বরং নেতৃত্বস্থানীয় শেখ আবদুল্লাহকে টার্গেট করেন। কে এম আশরাফ, দানিয়াক লতিফ ও আসান দানেশ প্রমুখ ওই মেনিফেস্টো শেখ আবদুল্লাহর কাছে দেন। সেটাই শেখ আবদুল্লাহ তার দলীয় মেনিফেস্টো হিসেবে গ্রহণ করেন। এর পেছনে তার দলের বিশেষ কোনো আদর্শিক গ্রাউন্ড ওয়ার্ক ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১৯৪৪ সালের ৩১শে জুলাই, মহারাজা হরি সিংয়ের কাছে ওই মেনিফেস্টো তুলে দেন শেখ আবদুল্লাহ। মহারাজা তা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কাশ্মীর তখন ব্রিটিশ ভারতের অংশ। সুতরাং, মহারাজা তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি বা করেননি। আশিক হোসেন ভাট লিখেছেন, ‘নয়া কাশ্মীর’ ছিল মুসলিম লিগের দ্বি-জাতিতত্ত্বের
ভিত্তিতে আলাদা পাকিস্তান ধারণার একটা সূক্ষ্ম প্রত্যাখ্যান। এই কারণটি মহারাজা ও তার সঙ্গীদের নয়া কাশীর মেনে নিতে আগ্রহী হওয়ার পেছনে কাজ করে থাকবে। এছাড়া, শেখ আবদুল্লাহ এবং তার দলের তখনকার কর্মকাণ্ড মহারাজাকে খুশি করে থাকবে। মহারাজার বিরুদ্ধে ১৯৩১ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছিল শেখ আবদুল্লাহর দল। কিন্তু, মেনিফেস্টো ঘোষণার এর এক মাস আগেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে অসম্মানিত করেছিলেন শ্রীনগরে শেখ আবদুল্লাহ। শেখ আবদুল্লাহর কর্মী মকবুল শেরওয়ানী নর্থ কাশ্মীরের বারামুলা শহরে জিন্নাহকে নিন্দিত করেছিলেন। ভারতীয় সাংবাদিক অজিত ভট্টাচার্য তার বইয়ে লিখেছেন, শেখ তার মুসলিম কংগ্রেসের নাম বদলে ন্যাশনাল কংগ্রেস করার উদ্দেশ্য ছিল অমুসলিমদের জন্য দলের দরজা খোলা রাখা।
অমুসলিমরা অনেকে তার দলে যুক্ত হয়েছিলেন বটে। কিন্তু তাতে মুসলমানদের কাছে আবদুল্লাহর জনপ্রিয়তা ঝুঁকিতে পড়ে। সে অবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের খুশি করার জন্য নয়া কাশ্মীরকে একটা বড় অস্ত্র হিসেবে নিয়েছিলেন শেখ। এ জন্য একে অনেকে জনগণকে দেওয়া রাজনৈতিক ঘুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নয়া কাশ্মীর অনুসারেই শেখ আবদুল্লাহ রাজ্যের প্রধান হওয়ার পর জমিদারি বিলুপ্ত করে কৃষকদের জমি বণ্টন করে দেন। কিন্তু, সেই ঘটনা আবার জমিদার শ্রেণির হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলে। আর ততক্ষণে কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কাশ্মীর তখন জাতিসংঘে বিচারাধীন ভারত বা পাকিস্তানের সম্পত্তি! অর্থাৎ, একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, শেখ আবদুল্লাহ মৌলিকভাবে কমিউনিস্ট ছিলেন
তিনি জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে কমিউনিস্টদের দেওয়া মেনিফেস্টো গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রেক্ষিতে নয়া কাশ্মীর দেওয়া হয়েছিল। বস্তুত, নয়া কাশ্মীর একটা ডকুমেন্ট হিসেবে ছিল পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিহীন সমাজের রূপরেখা। কিন্তু, তার প্রয়োগ ঘটেছে এমন নেতার হাত ধরে, যিনি ক্ষমতার জন্য ডানে-বামে সবদিকেই ছোটাছুটি করেছেন। তার পর থেকে সময় যতটা গড়িয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় দিকে সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে কাশ্মীরের। বামপন্থা ক্রমে বিচ্ছিন্ন, গুটি কয়েক মানুষের রাজনৈতিক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
ভারতের মূল ভূ-খণ্ডে বামপন্থী দলগুলো সাধারণত কাশ্মীর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সমালোচনা মুখর। তবে, তারা কোনো ক্রমেই ভারতের জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কাশ্মীরিদের আজাদির দাবি করে না। এমনটা তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ তাই প্রমাণ করে। জম্মু-কাশ্মীরে মোহাম্মদ ইউসুফ তারিগামি নামে একজন নেতা আছেন। তিনি সেখানকার সংসদ সদস্য। তিনি সিপিআইর (মার্কসবাদী) জম্মু-কাশ্মীর কমিটির সেক্রেটারি। তিনিও সবসময় সমস্যা সমাধানের জন্য বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার দাবি করে থাকেন।
নোট/সূত্র
১. Javed Iqbal; Zaldagar 1865; Greater Kashmir, P9; May 2, 2015,
২. Sheikh Abdullah (1993), Flames of the Chinar, Pp: 108 12
৩. Ashik Hossain Bhat; New Kashmir Manifesto; Kashmir Life; 2013,
৪. Ajit Bhattacharjea (2008); Sheikh Mohammad Abdullah: Tragic Hero of Kashmir, New Delhi: Roli Books; 71-74.
৫. জাকারিয়া পলাশ, এমএ থিসিস, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় (ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)