কাশ্মীরিদের ধর্মবোধ ও সংস্কৃতি
সবাই জানে, ধর্ম অদৃষ্টে বিশ্বাস করতে বলে। অনেকেই বলেন, মানুষের বিশ্বাস আর ভক্তিতে ভর করে ভগবান টিকে থাকে; বেঁচে থাকে। ইসলামী দার্শনিকদের মতে, আল্লায় বিশ্বাস করতে হয় মানুষের একালের সুখ আর ওকালের মুক্তির জন্য। ভয়, ভক্তি ও বিশ্বাস মানুষকে দেয় প্রশান্তি। কিন্তু, কালক্রমে ভক্তির লক্ষ্য/গন্তব্য আল্লাহ আর ভগবান থেকে নেমে আসে জীবিত কিংবা মৃত মানুষে; পাথর কিংবা কবরে।
পীর-বুজুর্গ, ওলি-আওলিয়া, গাউস-কুতুব আর সাধু-ঋষিরা হয়ে পড়েন ভক্তের ভক্তিগুরু। এভাবেই মাজার আর কাবার মর্তবা এক হয়ে পড়ে। ধনীর ধন তাকে কাবা শরীফে নিয়ে যায়। গরিবের দারিদ্র্য তাকে নিয়ে যায় মাজারে। কাশ্মীর এরই এক জীবন্ত চিত্র আজও। ওয়াল্টার লরেঞ্জ লিখেছিলেন, প্রত্যেক কাশ্মীরি বিশ্বাস করে যে, মানুষ ডাকলে বুজুর্গরা সাহায্য করবেন। তারা মনে করে, মৃত বুজুর্গ হচ্ছেন অধিকতর কার্যকর একজন জীবিত পীরের চেয়ে।’ কাশ্মীরিদের বিদেশিরা পীর-পরাস্ত বা পীরের উপাসনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেও লিখেছেন লরেঞ্জ। লরেঞ্জের এই অভিজ্ঞতা শতাব্দীকাল আগের। এখন অবশ্য প্রত্যেক কাশ্মীরি এমনটি বিশ্বাস করে না।
তবে, অধিকাংশই করে। কাশ্মীরকে পীর-ওয়ার (পীরদের পবিত্র ভূমি) বলে উল্লেখ করলে তারা খুশি হয়। এখনও কাশ্মীরি গাড়িচালকেরা কোনো মাজার অতিক্রমকালে বন্ধ করেন তাদের গানের রেকর্ড। এখনও আবাল-বৃদ্ধবণিতা অশ্রুসিক্ত বদনে নতমস্তকে মাজারের সিঁড়িতে চুমু খান। কল্যাণ কামনা করেন নিজের এবং সকলের। অধিকাংশ মানুষ পর্বতের গুহায় গড়ে ওঠা মাজারের মধ্যে যান। বুজুর্গের কবরের মাটিতে চুমু খান। সেখানকার পাথুরে দেয়ালের গায়ে সিঞ্চিত পানি ভক্তিভরে গায় মাখেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ঈদুল আজহার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম হজরতবাল মসজিদে। সচরাচর, মসজিদের ভেতরে ঢোকার সময় মেলে না। ভিড়ের কারণে জায়গাও পাওয়া যায় না। ঈদের দিন মূল ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদের পশ্চিম দিকের মাঠে। ফলে মূল মসজিদের মিম্বর ফাঁকা থাকে। তবে, মসজিদের মধ্যেও কাতারবন্দি হয়ে ঈদের নামাজ পড়ে মানুষ। আমিও সেই কাতারে যোগ দিলাম। গিয়েছিলাম প্রায় দুই ঘণ্টা আগে। নামাজের পাশাপাশি উদ্দেশ্য ছিল ভেতরের দৃশ্য দেখা। আগে অবশ্য মসজিদের পূর্বদিকে নারী ও পুরুষদের দেখেছি
ফটকে চুমু খেতে, মাথা ঠেকাতে। মানুষের হাত-মুখের ছোঁয়ায় সাদা পাথরের দেয়াল কালো হয়ে গেছে সেখানে। মিম্বরের দৃশ্যও একই রকম। সেখানে চারটি পিলার আছে। সাদা পাথরের মোজাইক করা। সেখানে মানুষ একে একে আসে। পিলার জড়িয়ে ধরে। দুই হাতে শীতল পিলারের পরশ নেয়। তারপর মুখে হাত বোলায়। চকাস চকাস করে পিলারের গায়ে চুমু খায়। মিম্বরের দুই পাশে দুটি দরজা আছে। লোহার দরজা। তালাবদ্ধ। সেখানে রক্ষিত আছে কথিত ‘হজরতবাল’ বা মুঈ-মুকাদ্দাস’। প্রতিটি দরজার সামনে পর্দা ঝোলানো। মানুষ সেখানে যায়। কেউ পর্দা সরিয়ে দরজায় চুমু খায়। কেউ পর্দা জড়িয়ে ধরে কাঁদে যতক্ষণ পারে। কেউ কেউ পাশে বসে দোয়া করেন হাত তুলে, কেউ ঢুলে ঢুলে।
কেউ হন নামাজরত। কিছুক্ষণ পর পর মসজিদের সেবকরা আসেন। সুগন্ধী মেশানো পানি ছিটিয়ে দেন প্রত্যেকের গায়ে। মানুষ সেই সুগন্ধী জল মুখে-মাথায়-গায়ে মাখে। মাইকে আওয়াজ করে, সুর করে দরুদ-দোয়া কালাম পড়া চলে। অশুদ্ধ আরবি উচ্চরণে কিন্তু হৃদয়কাড়া সুরে মানুষ পড়তে থাকে, আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়াসাল্লিম আলা, সাইয়্যিদিনা…’ অথবা ‘ইয়া.. আ..র হামা..রা… হীমী…ন’। ডাল লেকের পশ্চিম তীরে অবস্থিত কাশ্মীরি মুসলমানদের বৃহত্তম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এই হজরতবাল। কথিত আছে, ১৭ শতকে নবীজীর (সাঃ) এক বংশধরের মাধ্যমে তার একগাছি চুল-মুবারক ভরতবর্ষে আসে। খাওয়াজা নূরুদ্দীন নামে এক কাশ্মীরি ব্যবসায়ী তা নিয়ে যান কাশ্মীরে। তার উত্তরসূরিরা প্রতিষ্ঠা করেন ওই মসজিদ। ১৯৬৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর মুঈ-মুকাদ্দাস চুরি হয়ে যাওয়ার খবরে গোটা ভারতবর্ষে শুরু হয় দাঙ্গা।
কাশ্মীরের হিন্দু-মুসলিম-শিখ সব ধর্মের পক্ষ থেকে ওই পবিত্র রিলিক চুরির প্রতিবাদে প্রদেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়। এ ঘটনায় বাংলাদেশের খুলনা ও ঢাকায়ও দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ‘পবিত্র’ চুল চুরির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিও দেন। ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি এটি আবার পুনরুদ্ধার করে স্থাপন করা হয় বলে জানা যায়। তবে, সব কাশ্মীরি এমনটা বিশ্বাস করে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ওই মসজিদে নিয়মিত নামাজ, উর্দু ও কাশ্মীরি বয়ান হয়।
মসজিদের নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে ব্যাপক পুলিশি প্রহরা। সেখানে মহিলাদের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের ব্যবস্থা। ঢাকার মসজিদের সঙ্গে কাশ্মীরের মসজিদের পরিবেশের রয়েছে বেশ ফারাক। জুতা নিয়ে মসজিদের ভেতরে ঢোকা নিষিদ্ধ। কেউ ঢুকলে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চড়-থাপ্পড়ও জুটতে পারে ভাগ্যে। মসজিদের বারান্দায় জুতাসেন্ডেল রাখার জায়গা আছে। সেখানে জুতা চুরির ঘটনা শোনা যায় না। সবাই নামাজে দাঁড়ায় একেবারে গাদাগাদি করে। একজনের পায়ের সঙ্গে আরেজনের পা লাগিয়ে। মসজিদ-মাজারে মানুষের এই পাগলপারা ভক্তির কারণ হয়তো সহজেই বোধগম্য। কিন্তু কবরের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নিয়ে রহস্যের উন্মোচন আমি এখনও করতে
পারিনি। প্রথমবার কাশ্মীরে পৌছে যখন দেখেছি গোরস্থান, রীতিমতো অবাক হয়েছি। প্রতিটি ছোটবড় কবর কংক্রিটের স্লাব বাঁধানো। লাশের মাথার দিকে উঁচু প্ল্যাকার্ডের মতো। তাতে নাম লেখা মরহুমের। বাংলাদেশে কোথাও কোথাও একটি-দুটি কবর দেখা যায় বাঁধানো। আর পাবলিক গোরস্থানের চারপাশে বিরাট এলাকাজুড়ে দেয়াল ঘেরা থাকে। ভেতরে সারি সারি কবরের সঙ্গে কাঠের খুটিতে টিনের টুকরায় হয়তো লেখা থাকে মৃত মানুষের নাম। কিন্তু, প্রতিটি কবরের ওপরে কংক্রিটের চৌকোনা চাব দেখে প্রথম খ্রিস্টানদের কবরের কথা মনে হয়েছিল, শুনেছি খ্রিস্টানদের দাফন করা হয় খাড়াভাবে। যখন জানলাম, এগুলো মুসলমানদের কবর ভাবলাম, হয়তো যুদ্ধে অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছে। তাদের স্মৃতিফলক! কিন্তু তাও না।
যুদ্ধে নিহত মানুষের গণকবরের অস্তিত্ব আছে বটে। তবে, কবরের এই সজ্জার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। পরে জানলাম, ১৪ শতকে শাহ-ই হামদান (র.) প্রথম কাশ্মীরে কবর বাঁধানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন। আরেক দৃশ্য দেখে একদিন বিস্মিত হলাম। দেখলাম, একটি কবরের উপর অনেক চাল (প্রায় কেজি খানিক) পড়ে আছে। আরেকদিন দেখলাম একাধিক কবরের ওপর! কোথাও স্তুপাকারে, কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দু-চারটি পাখি এসে সেগুলো খুঁটে খাচ্ছে। ভাবলাম, হয়তো প্রকৃতিপ্রেমী কোনো মানুষ পাখিদের জন্য দিয়েছেন ওগুলো। ঈদুল আজহার দিন দেখলাম, একটি কবরের ওপর হলুদ আর লাল ফুলের সজ্জা। তার দুই কোণে দুইটি ছোট্ট পেয়ালা।
একটিতে একমুঠি চাল, অন্যটিতে খানিক তরল-কালচে কিছু একটা। পাশে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করছেন একজন মানুষ। তখনও হিসাব মেলাতে পারছিলাম না। এই রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি। একাধিক বন্ধু বলেছে, গোরস্থানের পাখিদের খাওয়ার জন্যই এগুলো দেওয়া হয়, যদিও উদ্দেশ্য থাকে স্বজনের কল্যাণ কামনা বা সওয়াব। জাইনুদ্দীন শাহ নামে এক বুজুর্গের মাজার আছে অনন্তনাগে (স্থানীয়রা বলে ইসলামাবাদ)। অত্যন্ত জনপ্রিয় ওই মাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলাম। সেখানে সুর করে কাওয়ালী গান হয়। মূল মাজারটি একটি গুহা।
প্রায় বিশ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পেরিয়ে সেই গুহায় ওই বুজুর্গ ধ্যান করেছিলেন বলে জানা যায়। সুড়ঙ্গের বাইরে এখন মসজিদ আছে, আছে অন্য ভক্তদের বিশ্রামাগার। প্রতিদিন শত শত লোক ওই গুহায় ঢোকেন। সারিবদ্ধ হয়ে আমরা প্রবেশ করছিলাম। সুড়ঙ্গের মাঝ বরাবর পাহাড়ের পিঠ গম্বুজের মতো আকার নিয়েছে। ভেতরে নারী পুরুষরা দোয়া করছে। কাঁদছে। আমরা সারিবদ্ধ। অপেক্ষা করছি ভেতরে যাওয়ার। ওই গম্বুজাকৃতির পাহাড়ের গা বেয়ে পানি পড়ছে। আমার এক সহপাঠিনীকে দেখলাম সেই ফোঁটা ফোঁটা পানি ধরে গায়ে মাখছে। আমি একটু আরাম করতে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সহপাঠিনী আমাকে যথেষ্ট তিরস্কার করে বলেছিল, এখানে ওয়ালী সাহেব বিশ্রাম নিতেন। এখানে
তোমার হেলান দেওয়া ঠিক নয়। ভক্তির গভীরতা আমাকে আশ্চর্যান্বিত করেছে। একই রকম ভক্তিগদগদ উপাসনা দেখেছি বাড়গাম জেলার চারার-ই-শরীফে। চারার-ই-শরীফ হলো নূর উদ্দীন ওয়ালী (রহ.)-এর মাজার। দেখেছি গুলমার্গ এলাকার এক মাজারে। দেখেছি বারামুলার বাংলাদেশ গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাবা
শুকুরুদ্দীন-এর মাজারেও। কাশ্মীরি সংস্কৃতির আরও কিছু রহস্যময় বিষয় রয়েছে যার মর্ম উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছি। অধ্যাপক শফি শাউকের লিখেছেন, ‘গৃহস্থালির হাতে তৈরি করা নানা সামগ্রী, ফেরেন আর কাংড়ির মতো পোশাক, ভাত, শুকনা সবজি ও ডাল, খড়ের মাচা-মাটির ঘর এবং নিজস্ব উপায়ে তৈরি পানীয়- নুনচায় সঙ্গে করে মানুষ বসবাস করছে সহস্রাব্দ ধরে। কখনও সূর্যের বদান্যতা আবার কখনও নিষ্ঠুর মেঘের কাছে অনুগত হয়েছে জীবন। অস্পষ্ট চাদ, চতুর্দিক ঘেরা পর্বতরাজি, গভীর জঙ্গল আর খামখেয়ালিপূর্ণ আকাশের নিচে এই জীবনধারা অনেকটা একঘেয়ে। এমন
জীবনধারাই জন্ম দিয়েছে অগণিত লোককথা, কাল্পনিক মিথ (পুরাকথা), প্রবাদ ও গীত আর মাইক্রো-ন্যারেটিভ’। এখনও কাশ্মীরের ঘরে ঘরে ওয়ানথুন, রফ, হিকিত, পিঠির আর ভায়ুন ছাড়া অনুষ্ঠানাদি চলে না। এসবের মধ্যে লুকিয়ে আছে গোটা সমাজের গাঠনিক ভিত্তি। মনজুর ফাজিলির মতে, এগুলো হলো সুখ আর দুঃখ উভয়ের বাহক। গান কিংবা সঙ্গীতের কথা আলাদা একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে কাশ্মীরিদের ধর্মবোধ আর ধর্মের মর্মবোধ নিয়েই কথা বলতে চাই। উপরের বর্ণনায় তাদের ধর্মচর্চার বাহ্যিক রূপটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
ওই সমাজের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল মিলে মিশে আমার অভিজ্ঞতা হলো, তাদের পরিচিতির মধ্যে (আইডেনটিটি) মুসলমান বোধ সুগভীর। কিন্তু, ধর্মের চর্চায়নামাজে কালামে অনেকে সে অর্থে ততটা সক্রিয় নয়। সেখানে অবস্থানকারী যে কেউ উপলব্ধি করবেন, হয়তো অনেক কাশ্মীরিই নামাজে অনিয়মিত। কিন্তু, দৈনন্দিন যোগাযোগে, মানুষের সঙ্গে লেনদেন বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা সৎ। ওয়াল্টার লরেঞ্জ (১৮৯৫) অবশ্য লিখেছেন, কাশ্মীরিরা সরকারি কর্মকর্তার সামনে সত্য বলেন না। কিন্তু, বাকি ক্ষেত্রে তাদের সততা প্রশংসনীয়। মানুষের মধ্যে হৃদ্যতার গভীরতা বোঝাতে আরেকটি স্মৃতিচারণ জরুরি।
এক অনুষ্ঠানে গিয়েছি একদিন। অচেনা বলেই, দূরে এক কোনায় বসেছিলাম চুপচাপ। লক্ষ করলাম, কাশ্মীরি মানুষের সাক্ষাতের উচ্ছ্বাস! অনুষ্ঠানস্থলে একেকজন মানুষ আসেন আর একে একে সবার সঙ্গে করেন মোলাকাত, কোলাকুলি। যখন কোলাকুলি হয় তখন ছোটর গালে চুমু খায় বড়রা। এ এক দারুণ সখ্য, মিল, মোহব্বত। মনে হলো, আমরা বাঙালিরা কোলাকুলি ভুলে গেছি। দীর্ঘ সময়ের সাক্ষাৎ-বিচ্ছিন্ন আলাপচারিতার পর শুরু হলো আলোচনা।
কিন্তু, আলোচনার গাম্ভীর্য কখনোই আসেনি সেখানে। বরং, খানিক পর পর যখনই নতুন কেউ এসেছেন, পর্বের পর পর্ব কোলাকুলির দৃশ্যই ছিল মূল হৃদ্যতার বিষয়। এই উচ্ছ্বসিত হৃদ্যতার দৃশ্য কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়েও হরহামেশা দেখা যায়। এমনকি সদর রাস্তার মধ্যখানে গাড়ি থামিয়ে, গাড়ির দরজা খোলা রেখে শাট-কোট পরা দ্রলোকদের দেখেছি কোলাকুলি করতে। এ কারণে পেছনের গাড়িগুলো ব্রেক কশে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু, কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। সবাই এ অবস্থায় অভ্যস্ত যেন। এক বন্ধুকে একবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম, পাবলিক প্লেসে এতটা হৃদ্যতা আন-প্রফেশনাল’। তারপর থেকে সে নিজে প্রায়ই আমার সঙ্গে দেখা হলে সদর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বলত, “আমরা এমনই।
সুফিভাবধারার প্রতি কাশ্মীরিদের সখ্যের সূত্র বুঝতে আবারও ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া জরুরি। ইতিহাস বলছে, কাশ্মীরে ইসলামের আবির্ভাবই হয়েছে সুফিদের মাধ্যমে। অসংখ্য সুফি ও বুজুর্গ এসেছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে কাশ্মীরে। আবার অনেকের জন্ম হয়েছে কাশ্মীরে। তারা আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রচার করেছেন। রাজারা
ক্ষমতায় এসেছেন এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ করেছেন। বণিকরা এসেছেন রাজাদের সহায়তায়, করেছেন বাণিজ্য। একই সঙ্গে সুফিরা চালিয়েছেন শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও মানুষের হৃদয় পরিশুদ্ধির কাজ। এর মাধ্যমে কোটি হৃদয় তারা শুধু পরিশুদ্ধই করেননি, দখলও করেছিলেন। কাশ্মীরে প্রথম এসেছিলেন হজরত বুলবুল শাহ কালান্দার (১৩৩৮)। তিনি ইরানের খোরাসান থেকে এসেছিলেন।” অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, তিনি তুর্কিস্তান থেকে এসেছিলেন। শাসক রিনচান ইসলাম গ্রহণ করেন বুলবুল শাহের হাতেই। সৈয়দ আলী হামদানি, তৈমুর লঙের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। পরে তিনি মধ্য এশিয়া থেকে কাশ্মীরে আসেন ১৩৯৪ সালে। সিকান্দার শাহের শাসনামলে। অন্য একটি সূত্র বলছে, হামদানী একাধিক বার কাশ্মীরে এসেছিলেন।
প্রথমে আসেন ১৩৭২ সালে। পরে ১৩৭৯ সালে। শেষবার এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন ১৩৮৩ সালে। হামদানী কাশ্মীরে নতুন সভ্যতা, নতুন জ্ঞান এবং নতুন শিল্পকর্ম শুরু করেন। তিনি আওরাদ-ই-ফাতিহা ও উচ্চ কণ্ঠে জিকির চালু করেন। যেমনটা ব্রাহ্মণরা তাদের ভজন সঙ্গীতের সময় করে। তার হাতে ৭০০০ কাশ্মীরি হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি ৭০০ বয়ন শিল্পীকে ইরান থেকে নিয়ে আসেন। কাশ্মীরের শাল বা চাদর শিল্পের বিকাশ সেখান থেকেই শুরু বলে মনে করা হয়। তিনি পারস্য ও মধ্য এশিয়ার জ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য ফার্সি ভাষা শিখতে উৎসাহ দিতেন। তিনি সুলতানের মনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তার পরামর্শে ওয়াইনসহ অন্যান্য অ্যালকোহল সেবন নিষিদ্ধ করা হয়। জুয়া, গান ও পতিতাবৃত্তির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সুহাভট্ট ছিলেন তখন সুলতানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাশ্মীরি প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ওই সময়ে হামদানীর হাতে এবং সাইফুদ্দীন নাম গ্রহণ করেন। শেখ নূর-উদ্দীন নূরানী (১৩৭৭ – ১৪৩৮) কাশ্মীরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি হামদানির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সাম্য ও মানবতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি কাশ্মীরের নিজস্ব ঋষি ধারার প্রবর্তক। তিনিও ছিলেন মহান সাধক যিনি কাশ্মীরি সমাজকে হিন্দুত্ব থেকে ইসলামী সমাজে রূপান্তরে বিপুল ভূমিকা রেখেছেন।
শান্তিপ্রিয় ধর্মপীর হওয়ায় কাশ্মীরি ব্রাহ্মণরাও তাকে নান্দ ঋষি (শান্তিকামী) বলে ডাকত। শামসুদ্দীন ইরাকি কাশ্মীরে এসেছিলেন ১৫ শতকের শেষ দশকে। তিনি ধর্মান্তরের দীক্ষা না দিয়েই সোমচন্দ্রের শুরুতে পরিণত হন। পরে তিনি আবার কাশ্মীরে আসেন ১৫০১ সালে। তিনি বাবা আলী নজর এবং তার মুরিদদের সমর্থন পান। নকশাবন্দিয়া সুফি ধারাও শামসুদ্দীন ইরাকিকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু, বায়হাকী সাঈদেরা তাকে সমর্থন করেনি। ফলে, সেখানে দুই সুফি তরিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করেছে। শামসুদ্দীন ইরাকি ইসলামী চর্চার বিষয়ে শক্ত ছিলেন। সারকথা, ইসলাম একটি আদর্শ হিসেবে কাশ্মীরে এসেছিল পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে
এবং তা বহু সুফি ও দরবেশের হাত ধরে। সুফিবাদের চারটি তরিকার (কাদেরিয়া, চিশতিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, নকশাবন্দিয়া) সবগুলোই মধ্য এশিয়ায় প্রভাবশালী ছিল। তারা সবাই কাশ্মীরে এসে তাদের প্রভাব রেখেছেন। পরে কাশ্মীর তার নিজস্ব ধারার সুফিবাদের জন্ম দিয়েছে, যার নাম ঋষি ধারা। তবে, মৌলিকভাবে ইসলামের দুটি ধারা যা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তা হলো শিয়া ও সুন্নী। এই দুটি পক্ষেরই উপস্থিতি আছে কাশ্মীরে। ইতিহাস বলে, অনেক শাসক ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী আবার অনেকে ছিলেন সুন্নী। এই শিয়া-সুন্নী বিভেদও কাশ্মীরে আসে মধ্য এশিয়া ও ইরান থেকে। সবকিছু সত্ত্বেও কাশ্মীরের সংস্কৃতিতে সুফিবাদের শেকড় সুগভীর।
নোট/সূত্র
১. Niazmand, M. S; The Role of Khanqas; Journal of Kashmir Studies; Vol:III; 2009; Pp: 57-64.
২. Khayal, G. N; Role of Islam in Transforming Kashmiri Society; Kournal of Kashmir Studies; Vol:III; 2009, Pp: 73-79.
৩. Fazili, Manzoor; Kashmir Miths; Journal of Kashmir Studies; 2007; Pp:9-15.
৪. Shauq, Shafi; Kashmiri Folklore: A language with thousand dialects; Journal of Kashmir Studies, 2007, Pp: 3-7.
৫. Hassnain, Fida M; The Impact of Muslim Rule on the Kashmiri Society; Journal of Kashmir Studies (Vol: III), 2009, pp: 6-36.