কাশ্মীরিদের চোখে বাংলাদেশ
কাশ্মীরের একটি গ্রামের নাম বাংলাদেশ। শ্রীনগরের লোকেরা এ তথ্য খুব একটা জানে না। খবরের কাগজের ভেতরের পৃষ্ঠায় একটা রিপোর্টে হঠাৎ এসেছিল তথ্যটা। প্রাণের টানে ছুটে গেলাম সেখানে। শ্রীনগর থেকে অন্তত ৮০ কিলোমিটার উত্তরে বান্ডিপুরা জেলার আলুসা তহশিলে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ’। জেলা শহরেও গ্রামটি পরিচিত নয়। সোপুর-বাভিপুরা রোডের মধ্যখান থেকে মাটির রাস্তায় হেঁটে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। সাধারণত বাইরে থেকে কেউ সেখানে যায় না। আমার মতো এক বিদেশি ওখানে যাচ্ছে শুনে রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছিল পথিকেরা।
সেখানকার লোকেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে পানিবাদাম সংগ্রহ করে। বিখ্যাত উলার হ্রদের তীরে অনেকটা ভাসমান ছোট্ট সেই গ্রাম। বিপরীত দিকে সুউচ্চ পর্বত। গ্রামটি ১৯৭১ সালে স্থাপিত। ওই গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ ভাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী জুরিমঞ্জ গ্রামের ৫/৬টি ঘর ১৯৭১ সালে হঠাৎ করে পুড়ে গিয়েছিল। তখন তারা পাশের ফাঁকা স্থানে নতুন ঘর বানায়। একই বছর যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান আজাদ হয়ে বাংলাদেশ নাম নেয়, তাই তারাও তাদের গ্রামের নাম রাখেন বাংলাদেশ। সেই পাঁচ ছয়টি ঘর থেকে বেড়ে এখন ওই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ। ঘরের সংখ্যা ৫০টি। বান্ডিপুরা ডিসি অফিসের তালিকায় এটিকে একটি আলাদা গ্রামের মর্যাদা দেওয়া হয় ২০১০ সালে।
ছছাট্ট মৎসজীবী কমিউনিটির জনগণের কাছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘটনাটি এভাবে জমাটবদ্ধ হয়ে আছে তা সত্যিই অপূর্ব। এই গ্রামটি যেদিন আবিষ্কার করলাম সেদিন থেকে মনে হচ্ছিল কাশ্মীরের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যরকম এক হৃদয়ের সম্পর্ক আছে। মজার ব্যাপার হলো, এখন ওই গ্রামের সব মানুষ বাংলাদেশ নামে আরেকটি দেশের খবর জানে না। শিশুদের কয়েকজনকে দেখা গেছে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চেনে। বিপরীত একটা খবর দেই। বাংলাদেশের বরিশালের নাজিরপুর, নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) ও বানারীপাড়া উপজেলার মধ্যবর্তী একটি দ্বীপ গ্রাম বেলুয়া মুগারঝোর। ওই গ্রামকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় বাংলার কাশ্মীর’। গ্রামটি মূলত পিরোজপুর জেলার অধীনে। এই নামকরণটি নিছক একটি জনশ্রুতি। কাশ্মীরের সঙ্গে ওই গ্রামের তেমন কোনো বৈশিষ্ট্যগত মিলও নেই। তবে, এর মধ্য দিয়ে মানুষের মনে কাশ্মীরের যে একটি অবস্থান আছে তার ইঙ্গিত মেলে।
কাশ্মীরের ইতিহাসেও বাংলাদেশের সংযোগ মিলেছে খানিকটা। মৃদু রায় তার বইয়ে একটি তথ্য তুলে ধরেছেন। ডোগরা মহারাজার আমলে কাশ্মীরের মুসলিম খানকাহ ও মসজিদগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব মুসলমানদের হাতে ন্যস্ত করা হয় ১৮৮৬ সালের দিকে। সে সময় অর্থাভাবে সেগুলোর মেরামতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
সেই বছর হজরতবাল মসজিদ ও খাজা নকশাবন্দির মাজার (টম্ব) মেরামতের জন্য ঢাকার নবাব অর্থ দিয়েছিলেন। আরেকটি তথ্য ১৯৬৪ সালের। হজরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত হজরতের (সাঃ) কথিত দাড়ি- মুঈ মুবারক চুরি হয়েছিল তখন। কাশ্মীরের ইতিহাসের এ এক বিরাট ঘটনা। সে ঘটনার জের ধরে কলকাতা, ঢাকা, খুলনায় একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল।
সার্বিকভাবে কাশ্মীরিদের কাছে বাংলাদেশ কেমন তা জানতে শুধু ওই একটি গ্রামের কথা যথেষ্ট নয়। ওখানে নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হলে আমার খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল, Do you know Bangladesh? উত্তর পেয়েছি বিভিন্ন রকমের। অশিক্ষিত গ্রামীণ মানুষের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর ছিল, ‘না’। আমার বন্ধু মেরাজের অক্ষরজ্ঞানহীন মা যখন জেনেছিলেন আমি বাংলাদেশি তখন এটা তার কাছে আলাদা কোনো অর্থ বহন করেনি। তিনি শুধু এটুকুই বুঝেছিলেন এই ছেলে তার ভাষা জানে না, বিদেশি।
এই ছেলে চেহারা-আকৃতিতে বিদেশি। বিদেশি অতিথিকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আপ্যায়ন করার জন্য তিনি ছিলেন ব্যাকুল! তিনি আমার কাছে এসে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। আমার বন্ধুর মাধ্যমে তিনি আমার পরিবারের কথা জানতে চাইলেন। আমার বাবা অনেক আগে মারা গেছেন জেনে মুখখানি গোল করে চোখদুটো বড় করলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। মায়ের কথা আমি জানালাম, তার মতো বৃদ্ধা। গ্রামে থাকেন। তখন মনে পড়ল, আমার মায়ের কথা। মনে মনে তুলনা করলাম, আমার মায়ের সঙ্গে কাশ্মীরি এই মো-জির। জিজ্ঞাসা করলেন, ভাইবোনের কথা। বললাম, চার ভাই আর চার বোন। মে’রাজ কাশ্মীরি ভাষায় বুঝিয়ে দিল, চুয়ার বোওই, চুয়ার বেহেন।
পোশাকের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। রুমের এক কোনায় ঝুলিয়ে রাখা নিজের ফেরেন (জুব্বার মতো শীতের পোশাক বিশেষ) বের করে দেখালেন এটা তার পোশাক। আমি জানালাম, আমার মা বাড়িতে শাড়ি পরেন। বাইরে গেলে বোরখা পড়েন। মে’রাজ তার মাকে উচ্চারণ করে দিল সাড়ি’। তিনি বোঝেননি। তাকে বোঝানো হলো, হিন্দুস্থানি পোশাক। তিনি মেনে নিলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। ওর বাবাকে দেখে মনে হলো তিনি ব্রিত। তিনিও একভাষী, কাশ্মীরি। শেষ বিকালের দিকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আমার দিকে প্রথমবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। একটু পরে আমার বন্ধু তাকে জানাল আমার পরিচয়।
তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি বেশ স্পষ্ট গলায় হাসি দিয়ে উচ্চারণ করলাম, আসসালামু আলাইকুম। এই বাক্যটি তার জন্য অপরিচিত ছিল না। তিনি হাসিমুখে জবাব দিলেন। কাছে এলেন আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবিনয়ে ঝাকালেন। বন্ধু জানাল, বাংলাদেশ থেকে এসেছে। হেসে মাথা ঝাকাতে ঝাঁকাতে বললেন, বাঙ্গাল! কোনো ভাল-মন্দ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম না। তারপর চলে গেলেন গোসলখানার দিকে। ফেরার সময় আমি একইভাবে দোয়া চাইলাম। শুকরিয়া জানালাম। তিনি হাসলেন। হাত মিলিয়ে বিদায় দিলেন। মনে হলো, মা-জি যতটা যত্নবান তিনি ততটা নন।
বিদেশি মানুষের সামনে তিনি যথেষ্ট অন্তর্মুখী। বন্ধুর বোনদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা সরাসরি আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে তা নিয়ে হয়তো ব্ৰিত ছিল। কারণ ভাষা যে দুর্বোধ্য। ফিরে আসার আগে অবশ্য ওদের বাসায় গিয়েছি আরও বহুবার। যতবার গিয়েছি, পেয়েছি বাংলাদেশের মেহমানের জন্য অপরিসীম তাড়া আর অস্থিরতা। শেষবার ফেরার আগে মা সুটকেস
খুলে সাদা কাপড়ের একটা প্যাকেট বের করলেন। সোনালি সুতার নকশা আঁকা সালোয়ার-কামিজের কাপড়। আমাকে দিলেন। বললেন, তোমার মায়ের জন্য বকশিস। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার মা সালোয়ার-কামিজ পরেন না। তিনি শাড়ি পরেন। তাকে জানালাম, কাশ্মীরি চাদর আমার মায়ের পছন্দের। এবং তা আমি কিনেছি। তখন তিনি খুশি হলেন। আমি বললাম, আপনার দোয়া আমার মায়ের কাছে পৌছাবে। আরও বললাম, আপনাদের জন্য আমার মাকে দোয়া করতে বলব। তিনিও দোয়া করলেন। ওই মা’কে ভোলা যাবে না কোনো দিন।
আরেক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর বাবা শিক্ষিত, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। দুই ভাই সরকারি চাকরিজীবী। ওদের পরিবারের সবাই বাংলাদেশকে জানে। শিক্ষক বাবা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশের সবকিছু জানতে চাইলেন। প্রধান ফসল কী? আমরা কী খাই। মানুষের অবস্থা কেমন? ধনী ও দরিদ্রের খবর জানলেন। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা জানতে চাইলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা জানতে চাইলেন। বিয়ে-আচার-ব্যবহার, রাজনীতি-সংস্কৃতি সবকিছু জিজ্ঞাসা করলেন। তরুণদের অনেকে বলেছে, তারা বাংলাদেশকে চেনে সাকিব আল হাসানের নামে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভাল খেলে এটা তারা জানে। তারা, সাধারণত ক্রিকেটে পাকিস্তানের সমর্থন করে। ২০১৩ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তান সেমিফাইনালে
বাদ পড়ার পর ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে তারা বাংলাদেশের বিজয়ের জন্য বুক বেঁধে প্রত্যাশা করেছে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও তারা ভারতের বিরুদ্ধে সমর্থন করেছে বাংলাদেশকে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের (ভারতমুখী রাজনৈতিক দল) এক নেতার সঙ্গে (ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এক রাতে কফি পান করছিলাম দিল্লির খান মার্কেটে। তিনি মজা করে বলছিলেন, আমরা অনেক বিষয়ে ভারতের সঙ্গে থাকতে চাইলেও তিনটি বিষয়ে আমাদের পাকিস্তানের পক্ষেই থাকতে হবে।
এক, ক্রিকেট, দুই. ঈদের চাঁদ এবং তিন, নারায়ে তাকবির শ্লোগান। আমরা ভারতকে বলে থাকি, এই তিন বিষয়ে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে। এতে আপনাদের নাখোশ হওয়ার কিছু নেই। মোটকথা হলো, কাশ্মীরের অধিকাংশ তরুণ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে সমর্থন করে পাকিস্তানের পরে আর ভারতের বিরুদ্ধে। তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেনে নিষ্ঠুর’ এবং ভারতমুখী রাজনীতিক হিসেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। আমি আশ্চর্য হয়েছি একটি বিষয়ে যে, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের গানি কাশ্মীরি স্কলার্স হোস্টেলে অবস্থানরত পিএইচডি গবেষকদের যার সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি তিনিই আমাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সায়েন্সের শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশকে কেমন দেখেন আপনি (১৬/০২/১৫; নয়া দিল্লি)? তিনি বললেন, বাংলাদেশ অসীম সম্ভাবনাময় দেশ ও দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী। দ্রুত উন্নত হওয়ার জন্য তারা অদম্য। অর্থনৈতিকভাবে তারা এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কিন্তু, সামরিকভাবে তাদের শক্তি তেমন নয়। অনেকটা ভারতের ওপর নির্ভরশীল।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতের বিগ-ব্রাদার সুলভ ভূমিকা থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারছে না। সামরিক ছাড়াও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে। এখনও দেশটির বড় একটা সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। সেদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি ছিল সরকারের। দেশটি এখনও ১৯৭১ সালের কিছু বিষয়ের সমাধান করতে পারছে না। জামায়াতে ইসলামীর লোকদের যেভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তা দেশটিকে আরও বেশি সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে। তাদের ফাঁসি
দিয়ে জেলখানায় পুরে রাখা যেত। তারা সেখানেই মরতো, এতে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু, ফাসি দিয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরেও তো জামায়াতে ইসলামী আছে। সম্ভবত তারাও একই আদর্শের অনুসারি। এই ধর্মীয় গ্রুপটির ব্যাপারে আপনার মতামত কি? একজন কাশ্মীরি হিসেবে এই দলটির বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী? বললেন
“জামায়াতে ইসলামী একটা ইসলামী রাজনৈতিক দল। তবে, রাজনীতির বাইরেও তাদের রয়েছে অনেক ব্যবস্থা। তারা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। ১৯৭০’র দশকেই তারা এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরে। সৈয়দ আলী গিলানী (জামায়াতে ইসলামী ও হুরিয়াত কনফারেন্স উভয়ের সদস্য) তখন জামায়াতের নির্বাচিত এমএলএ ছিলেন। ধর্মভিত্তিক এই দলটি সবসময়ই ‘সেকুলার আদর্শের ন্যাশনাল কনফারন্সের (আবদুল্লাহ) জন্য ছিল চ্যালেঞ্জ। ১৯৪০-এর দশক থেকে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদী সকল আন্দোলনে শেখ আবদুল্লাহর এই ন্যাশনাল কংগ্রেস অনবদ্য অবদান রেখেছে।
কিন্তু, তারা জামায়াতে ইসলামীর আদর্শের মোকাবিলা রাজনৈতিকভাবে করতে পারেনি। শেখ আবদুল্লাহ এখনও কাশ্মীরের মানুষের কাছে স্মরণীয়। তার নেতৃত্বেই কাশ্মীরে জামিদারদের হাত থেকে জমি অধিগ্রহণ করে সবাইকে বন্টন করা হয়েছে। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের মানুষের আর্থসামাজিক এই পরিবর্তনের ফল তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে ভোগ করবে। কিন্তু তিনিই জামায়াত মোকাবিলায় ভুল করেছেন। ১৯৭০-এর দশকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় তার আমলে। তাদের পরিচালিত স্কুলগুলো পোড়ানো হয়। অনেক মানুষকে মারা হয়। পুলিশ দিয়ে চালানো হয় তাদের ওপর অনেক নির্যাতন। পরে তারা আবার অন্যভাবে সামনে আসে। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ তেমন ভুল করছে।”
জানতে চাইলাম, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির জন্য ধর্মীয় দল একটা চ্যালেঞ্জ। এটা সত্য। কিন্তু, এটা মোকাবিলার উপায় কি? তিনি বললেন
‘সেকুলারিজম একটা আদর্শ। যারা সেকুলার তাদের কাছে এটা শ্রেষ্ঠ। ভারতে অনেকের কাছে হিন্দুত্ব শ্রেষ্ঠ। তেমনি জামায়াতের লোকদের কাছে ইসলাম শ্রেষ্ঠ। সেকুলার শক্তি কেন মনে করে যে, শুধু সেকুলারিজমই একমাত্র আদর্শ? জনগণের ভোটে যারা ক্ষমতায় যাবে তারা তাদের আদর্শে চালাবে। তারপর জনগণের যদি পছন্দ না হয় তাহলে তারা পাঁচ বছর পর দেখে নেবে। কিন্তু, সেকুলার দলগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সেই আস্থা রাখতে পারছে না। মিশরেও তাই হয়েছে। সব জায়গায়ই হচ্ছে।’
একজন ব্যক্তির বক্তব্য এখানে তুলে ধরেছি। সিংহভাগ কাশ্মীরি শিক্ষিত মানুষের মন্তব্য এমনই। মোটকথা, বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়ে অধিকাংশ কাশ্মীরির মতামত মূলত পাকিস্তানের রাজনৈতিক মতামতের কাছাকাছি। শুধু শিক্ষিত কেন, সাধারণ মানুষও এর বিপরীত নয়। রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জুমাতুল বিদা (২৬ জুলাই ২০১৪)। হজরতবাল মসজিদে সেদিন উপচে পড়া ভিড়। হাজার হাজার মানুষ সেদিন এসেছে সেখানে নামাজ ও দোয়া করতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম নানা বয়সের মানুষ শুয়ে-বসে আছে গাছের ছায়ায়। আমি আর আমার নেপালি বন্ধু বিষ্ণু বসলাম এক জায়গায়। বিষ্ণু হাফপ্যান্ট পরা হলেও তেমন কেউ খেয়াল করছে না। তবে, আমার চেহারা কাশ্মীরিদের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে
সবাই খেয়াল করে। প্রৌঢ় এক লোক সামনে বসা ছিলেন। তিনি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কাহা সে? তখন ভাষা বুঝতে আমার অসুবিধা হতো। বিষ্ণু জবাব দিল, ‘ম্যায় নেপাল সে হুঁ, অর ইয়ে বাংলাদেশ সে’। আমার দিকে তাকিয়ে বারবার বলতে লাগলেন, বাংলাদেশ সে আগে গেয়া?’ একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, Do you know Bangladesh? হেসে বললেন, ‘ও ভি মাশরেকে পাকিস্তান থা। হিন্দুস্থান জবরদস্তি কারকে বাটোয়ারা কার দিয়া। পাকিস্তান সে আলাক বানা দিয়া। বাংলাদেশ তো হামারা দেশ লাগতা থা’। বৃদ্ধের নাম গোলাম মোহাম্মদ। তিনি অনন্তনাগ জেলার বাসিন্দা। এসব কথার খুব একটা জবাব দিতে পারতাম না প্রথম দিকে।
কারণ, মুখে উর্দু ফুটতো না। পরে যখন দুই এক লাইন উর্দু উচ্চরণ করা শিখলাম তখন খুব শক্ত উত্তর দেওয়া শুরু করেছিলাম। একবার এক দোকানি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাহা সে?’ আমি বললাম, বাংলাদেশ সে’। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমলোক পাকিস্তান সে আলাক বানায়া?’ আমি সেদিন তাকে বলেছিলাম, ‘পাকিস্তান ডি হামারা ভাই লাগতা থা। মাগার, হামলোগকো গুলি কারকে খুন লে লিয়াথা। হাম লোগোকো মার দিয়া। ইয়ে অ্যায়সা মুসলমান ব্রাদার লাগতা থা’। তিনি আর কখনও এ বিষয়ে প্রশ্ন করেননি। প্রায় দুই বছর ওই দোকানির সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। তার দোকান থেকেই চালডাল কিনতাম সবসময়। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কাশ্মীরের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের কথা উঠলেও আসতো বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
তাদের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটা বড় উদাহরণ। তাদের বক্তব্য হলো, পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সংগ্রাম করেছে। একইভাবে, ভারতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে কাশ্মীর। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে ১৯৭১ সালে, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী একই হিংস্রতা চালাচ্ছে ৬/৭ দশক ধরে। এই প্রসঙ্গে একবার খাবার টেবিলে আলোচনা উঠেছিল কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি বললেন, বাংলাদেশিরা স্বাধীনতা পাওয়ার ৪২ বছরেও সেই হিংস্রতার বেদনা ভুলতে (Reconcile) পারেনি। আমরা স্বাধীনতা না পেয়েও কিভাবে ভুলব? প্রসঙ্গত, এখানে একটা উদ্ধৃতি দেওয়া জরুরি।
বিখ্যাত সুফি খানকাহ চারার-এশরীফে ১৯৯৫ সালে কয়েক ডজন মিলিট্যান্ট সশস্ত্র অবস্থায় আশ্রয় নেয়। সেখানে দীর্ঘ দুই মাস উত্তেজনার শেষে প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য ওই এলাকায় অবতীর্ণ হয়। রাতভর যুদ্ধ হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামসুদ্ধ। খানকাহ ধ্বংস হয়। পুরো গ্রামটিও তছনছ হয়ে যায়। পরে দেখা গেল মাত্র দুইজন যুবকের লাশ। বাকিরা নিশ্চিন্তে পালিয়ে গেছে। সে সময় এক স্থানীয় নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করলে সেনা সদস্যদের মন্তব্য ছিল, ‘ঢাকার মুসলমানদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যরা কী করেছে, দেখনি? একাধিক সূত্রেই এমনটি জানা গেছে, ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের
নিপীড়নের দোহাই দিয়ে ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরে তাদের সব নিপীড়নকে বৈধ করত। এভাবেই কাশ্মীরের রাজনীতিতে ঘুরে ফিরে আসে বাংলাদেশ। অনেকে বাংলাদেশ আর কাশ্মীরের তুলনা করে বলে, তোমরা লড়েছে পাকিস্তানি ফৌজের বিরুদ্ধে ভারতের সাহায্যে। আমরা লড়ছি ভারতীয় ফৌজের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাহায্যে। শত্রু-মিত্র বদলে গেছে। স্বাধীনতার মর্ম আমাদের একই। হার্ভার্ড পিএইচডি অধ্যাপক সিদ্দিক ওয়াহিদ, স্বাধীনতার প্রক্রিয়া নিয়েও বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বলেছেন, স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ ছিল না। পাকিস্তানের শোষণ তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। ২৫ মার্চের সেনা অপারেশন তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার পরপরই আবার তারা সংঘাত শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে। সুতরাং, কাশ্মীরের স্বাধীনতা যদি অর্জিত হয়, তারপরই পূর্ণ শান্তি বিরাজ করবে এমনটি নয়। শান্তির জন্য কাশ্মীরিদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর (জামিয়া মিলিয়া, দিল্লি, মার্চ, ২০১৫)।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য কাশ্মীর মূলত একটা দ্বিধা। স্পষ্টতই, বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল, তখন কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের জাতীয় অবস্থানই ছিল বাংলাদেশের জাতীয় অবস্থান। কিন্তু, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এক নতুন জাতিসত্তা। কাশ্মীর প্রশ্নে আমাদের অবস্থানও তাই নতুনত্বের দাবি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের পবিত্র স্বাধীনতা কাশ্মীরিদের জন্য ছিল একটা শ। কারণ, যে পাকিস্তান কাশ্মীরের স্বাধীনতার ত্রাতা’, সে ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালে। জিএন গওহর লিখেছেন,
In 1971, Pakistan shattered the hopes here. Frustation prevailed throughout and the whole nation got a severe shock. People could not react in any manner for a pretty long time. The shimla pact revived the hopes to some extent.৭)
বাংলাদেশ ও কাশ্মীরের সংযোগটাকে গোটা উপমহাদেশের ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার জন্য ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘাভানের কয়েকটি বাক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন
১৯৭১ সালের যুদ্ধটি ছিল ১৯৪৭-এর বিভাগের পর উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একদিকে এটা বাংলাদেশ নামে একটা জনবহুল জাতির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে এটা ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষমতার ভারসাম্যটাকে ভারতের পক্ষে হেলিয়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে উপমহাদেশের সমস্ত সংঘাতই ওই যুদ্ধের ধারাবাহিকতা। কাশ্মীরের মধ্যে লাইন অব কন্ট্রোল, ভারত ও পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার শক্তি হয়ে ওঠা, কারগিলের সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে যুদ্ধ, কাশ্মীরে শুরু হওয়া সশস্ত্র বিদ্রোহ আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক যন্ত্রণা- সবকিছুই ঘুরেফিরে আলোচনাকে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের এই নয়টি গুরুত্বপূর্ণ মাসের কথায়।)
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ধারণা নেওয়া যেতে পারে যে, কেন কাশ্মীরিদের কাছে পাকিস্তান ভাগ করার দায়ে তির্যক মন্তব্য শুনেছি। বস্তুত, ভারতীয় ফৌজের প্রতি তাদের ঘৃণা হচ্ছে পর্বতসম। সেই ভারতের সৈন্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নিঃস্বার্থ সহায়তা করেছে এটা তারা বিশ্বাস করে না। তবে, পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম বর্বরতার বিপরীতে বাংলাদেশিদের প্রতি সহানুভূতি তাদের আছে। শিক্ষিত ও পেশাজীবীদের কেউ কেউ বাংলাদেশকে জানে ড. ইউনূসের নামে। একজন কাশ্মীরিকে পেয়েছিলাম যিনি বাংলাদেশকে চেনেন রানা প্লাজার ভয়াবহতা থেকে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টের কাপড় কাশ্মীরের মানুষের কাছে খুবই পছন্দনীয়। বাংলাদেশিদের কাছ থেকে কটনের পোশক উপহার পেলে তারা খুশি হয় সবচেয়ে বেশি। ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘরের মধ্যে লুঙ্গি পরার অভ্যাস আছে। লুঙ্গি পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া পোশাক হলেও বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে এর কদর রয়েছে ব্যাপক। কাশ্মীরের কোনো ব্যক্তিকেই আমি লুঙ্গি পরতে দেখেনি। আমার পরনের দুটো লুঙ্গি পুরনো হওয়ার পর ওখানকার বাজারগুলোতে খুঁজে কোথাও লুঙ্গি মেলেনি। পরে, বাংলাদেশের এক বন্ধুকে পাঠাতে বলেছিলাম।
বছর খানিক পরে আমার একাধিক কাশ্মীরি বন্ধুকে দেখেছি লুঙ্গির প্রশংসা করতে। আমি পরে তাদের লুঙ্গি উপহারও দিয়েছিলাম। ওরা হোস্টেলে অনেকেই ট্রাউজার পরে ঘুমায়। আর, পোশাক বদলায় বাথরুমে। বাংলাদেশের অসংখ্য এলাকা আছে যেখানে এখনও বাথরুম বলতে আলাদা কোনো ঘর নেই, টয়লেট আছে। টিউবয়েলের সামনে দাঁড়িয়ে বা পুকুরে ঝাপিয়ে গোসল করে গ্রামবাংলার অগণিত মানুষ। তাদের জন্য লুঙ্গি এক দারুণ পোশাক। অপর এক বৃদ্ধ গোলাম নবীর মাইক্রোবাসে আমরা ১০ বিদেশি শিক্ষার্থী চলছিলাম। জিজ্ঞাসা করলেন, কাহাসে? আমরা বললাম, বাংলাদেশ সে।
তিনি জানলেন আমরা মুসলমান। তারপরই তার জিজ্ঞাসা বাংলাদেশি মেয়েদের ইশারা করে, টিকা (কপালের টিপ) লাগানো হয়েছে কেন? এ হিন্দুয়ানি। মুসলমান হয়ে কেন টিকা লাগাতে হবে? বাংলাদেশের মেয়েরা এই প্রশ্নের মুখে পড়ে প্রায় নিয়মিতই। প্রায়ই তারা প্রশ্ন করে, তোমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা টিকা পরে। অথচ এটা শক্তভাবে নিষিদ্ধ ইসলামে। এটা হিন্দু সংস্কৃতি। একবার আমি জবাবে বললাম, হ্যাঁ। এটা নিষিদ্ধ তা আমি জানি। আমাদের দেশে অনেকে এটা পরে। অনেকে পরে না। যার পছন্দ হয় পরে, যার পছন্দ হয় না পরে না। আলেমরা এ ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কেউ অনুসরণ করে, কেউ করে না। আমাদের কাশ্মীরি বন্ধুরা অভিযোগ করে, বাংলাদেশি মেয়েরা বলছে, তারা সবাই এটা পরে। এটা তাদের কালচার।
আমি বললাম, হ্যাঁ। যারা টিকা (টিপ) পরে তাদের এটা কালচার। যা পরে না। তাদের এটা কালচার নয়। আসলে এখানে আমরা পাঁচজন শিক্ষার্থী যে বাংলাদেশের সবকিছুর প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি তা মনে করো না। বাংলাদেশে ধার্মিক মানুষ আছে। আবার অধার্মিক মানুষও আছে। কেউ ধর্ম পালন করে না, তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের মানুষ অধার্মিক। আরও বললাম, আমি মুসলিম। কিন্তু আমি দাড়ি সেভ করি। তার মানে এই নয়, সব বাংলাদেশিই দাড়ি রাখে না। সত্যিকারের বাংলাদেশকে দেখতে হলে তুমি বাংলাদেশে যাও। কাশ্মীরের খবরের কাগজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের।
বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে যাদের সন্তান কিংবা ভাইবোন বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে পড়ে। তেমন এক শিক্ষার্থী যায়ের মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম অনেকটা আগ্রহ নিয়ে। ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ছে। দুই মাসের ছুটিতে সে তার দেশে ফিরেছে। দেখলাম সে বেশ ভাল বাংলা শিখেছে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে দেখেছে বাংলাদেশকে? জানাল, ভাল ও মন্দলাগার কথাগুলো। ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামই ওর কাছে সবচেয়ে দুঃসহ বলে জানাল। ও জানাল, ঢাকায় ওর ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩০ জন কাশ্মীরি। তবে, কলেজ কর্তৃপক্ষ বিদেশিদের ছাত্রাবাসেও ইংরেজি পত্রিকা রাখে না বলে ওর খবরের কাগজ পড়া হয়
বাংলাদেশে লেখাপড়ার জন্য ভিসা পেতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। জানিয়েছে, না। দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে এক বছরের ভিসা পেতে ওর লেগেছে মাত্র এক দিন। পরে, আগারগাঁও সিআইডি অফিস থেকে ভিসার মেয়াদ বাড়িয়েও নিতে পেরেছে। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে অধ্যয়নরত আরেক শিক্ষার্থী জানিয়েছিল, সে বাংলাদেশে মেডিকেল সায়েন্স পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল।
কিন্তু, উত্তপ্ত আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে দেশে ফিরেছে। মোদ্দাকথা, কাশ্মীরিদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে বেড়িয়েছে; অধিকাংশই দূর থেকে খবরের কাগজের মাধ্যমে জেনেছে আর গ্রামের কেউ কেউ একেবারেই দেখেনি। এই তিন ধরনের মানুষের কাছে বাংলাদেশ তিন রকমের। বিপরীতক্রমে, বাংলাদেশ থেকেও আমার মতো কেউ কেউ কাকতালীয়ভাবে কাশ্মীরে গিয়ে অবস্থান করছে, দেখছে-জানছে, আর অনেকেই কাশ্মীরকে জানতে চাইছে নানা মাধ্যমে। এই দুই জানার মধ্যে বিদ্যমান দিন-রাতের বিশাল ফারাক।
নোট/সূত্র
১. Rasool, MT (August 11, 2015); Kashmir’s Bangladesh
faces discrimination; Rising Kashmir; Srinagar; 10
২. পানিবাদামকে ইংরেজিতে বলে ওয়াটার নাট। ওয়াটার চেস্টনাট। স্থানীয় কাশ্মীরিরা একে বলে সিংগাড়া। তিনকোণা একটা ফল। কাশ্মীরের লেকের পানিতে ভাসমান গাছে এগুলো হয়। স্বাদ খানিকটা কাঁঠালের বীজের মতো। উপরে শক্ত একটা কালো। খোসা থাকে। সেটি ধারোলা ছুরি দিয়ে উঠিয়ে বিক্রি করা হয় বাজারে। সেগুলো বেসনে মিশিয়ে তেলে ভেজেও বিক্রি হয়।
৩. Rai, Mridu (2004); Hindu Rulers Muslim Subjects; New Delhi: Permanent Black; 200
৪. Amitav Ghosh (1988); The Shadow Lines; UK: John Murray-2011; হজরতবালের মুঈ মুবারক সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন সপ্তম অধ্যায়।
৫. বিস্তারিত জানতে পড়ুন লেখকের অপ্রকাশিত গবেষণা রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব শেখ মো. আবদুল্লাহ ও শেখ মুজিবুর রহমান (২০১৬)’; এমএ থিসিস; কাশ্মীর ইউনিভার্সিটি।
৬. Gouhar, G. N (2001); Military Operation in Kashmir: Insurgency at Charar-e-Sharif, New Delhi: Manas Publication; 184-85
৭. প্রাগুক্ত, ১৩১। বিস্তারিত ৬ষ্ঠ ও ৭ম অধ্যায়
৮. Raghavan, Srinath (2013); 1971: The Global History of the Creation of Bangladesh; England: Harvard University Press; P4.