কাশি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আমি যখন ছোটো ছিলুম তখন আমার খুব কাশি হত। হলেই হল। শুকনো কাশি, সে বড়ো ভয়ংকর। তার কোনো কমা, ফুলস্টপ থাকে না। খ্যাঁকোর খ্যাঁকোর চলছে তো চলছেই। যে কাশে তার তো কষ্ট হয়-ই, যাঁরা শোনেন, তাঁদের কষ্ট আরো বেশি। কাশি তো আর গান নয়, যে সবাই শুনে মোহিত হয়ে যাবেন। কোনো কারণে থামলে বলবেন,—থামলে কেন, থামলে কেন, চলুক চলুক, বেশ হচ্ছে।
কাশির ধর্মই হল সূর্য ডোবার পরই বাড়বে। অন্ধকারে যেমন প্যাঁচা বেরোয়, বাদুড় বেরোয়, সাপ, কীটপতঙ্গ বেরিয়ে আসে গর্ত ছেড়ে পিল পিল করে, কাশিও তেমনি মনের আনন্দে গলার গর্ত ছেড়ে বেরোতে থাকে। যত রাত বাড়ে তত কাশি বাড়ে।
আমার বাবা বলতেন,—ভাগ্য ভালো হলে এই রকমই হয়, বিনা আয়াসে কাশীবাস।
মাঝে মাঝে গবেষণা করতেন,—আচ্ছা কীভাবে তুমি এটা করো? কায়দাটা কী? পড়ার ভয়ে নকল কাশি বলেও তো মনে হয় না। শতকরা একশো ভাগ খাঁটি কাশি। মুখ আড়াই ইঞ্চি ফাঁক, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, একেবারে খোলতাই কাশি। আচ্ছা, তোমার একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে না! সিনেমার হাফটাইম আছে, ফুটবল খেলার হাফটাইম আছে, বড়ো বড়ো যুদ্ধেও কয়েক ঘন্টার যুদ্ধবিরতি হয়। তোমার কি একটুও ইন্টারভ্যাল নিতে ইচ্ছে করে না!
এর আমি কী উত্তর দেব? কাশি একেবারে একটা স্বাধীন জিনিস। গলার গর্তে বসবাস করে। যেই রাত নামে খোল-কত্তাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
বাবাকে উত্তর দিলেন জ্যাঠামশাই,—তোমার মতো বুদ্ধিমান, বিবেচক এক মানুষ, এমন একটা ছেলেমানুষি প্রশ্ন করতে পারলে?
—হ্যাঁ পারলুম। কাশিটা হল শুকনো কাশি। আসছে পেট থেকে। গঙ্গার উৎস যেমন গোমুখী, শুকনো কাশির উৎস হল পেট। পেট থেকে কাশি বেরিয়ে আসছে কীভাবে? গরমে। উপমা ছাড়া তুমি বুঝবে না। আমাদের চৌকিতে ছারপোকা হলে কী করি? গরম জল ঢালি।
জ্যাঠামশাই বললেন,—প্রশ্ন আছে। পেট কি চৌকি? কাশি কি ছারপোকা? অসম উপমা হল। তুমি উপমা পালটাও। প্রাণীর সঙ্গে অপ্রাণী, অপ্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর উপমা চলে না।
—কেন চলে না? আমরা বলি না, খেয়ে-দেয়ে সে তাকিয়ার মতো পড়ে আছে। আমরা বলি না, শোকে পাথর হয়ে গেছে। আমরা পড়িনি, পলাশির যুদ্ধে মিরজাফর দাঁড়িয়ে রইলেন কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ, রোগা, শীর্ণ মানুষকে আমরা বলি বৃষকাষ্ঠ। তোমার স্বভাবটাই হল, কারণে- অকারণে প্রতিবাদ।
জ্যাঠামশাই হারবার মানুষ নন। তিনি বললেন,—ও সব উপমাগুলো দীর্ঘদিন চলে আসছে। তুমি হঠাৎ একটা নতুন উপমা যথেষ্ট প্রচার ছাড়াই চালাতে চাইছ। সুধীজন নেবে কেন। তুমি যদি গায়ের জোরে বলতে চাও, শসার ইংরেজি শসকুইটো।
—সে আবার কী? আমি তা বলব কেন?
—কেন বলবে না। মশা যদি মস্কুইটো হয়, শসা কেন শসকুইটো হবে না। তুমি বলতেই পারো। তোমার পক্ষে সবই সম্ভব।
—আজ্ঞে না। সম্ভব নয়। ল্যাঙ্গোয়েজ পালটানো যায় না। উপমা আমি মাথা খাটিয়ে নতুন নতুন বের করতে পারি। সে স্বাধীনতা আমার আছে। তোমারও আছে।
—বেশ তাহলে আমার প্রতিবাদ তুলে নিলুম। বলো তুমি।
—আর বলো। এমন ঘুরপাক খাইয়ে দিলে সব গুলিয়ে গেল। তার ওপর কানের কাছে এই ননস্টপ কাশি।
জ্যাঠামশাই বললেন,—আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানের কথা বলছিলে।
আমি কোনোরকমে কাশির দমক চেপে বললুম,—আজ্ঞে না, কাশির উৎস-সন্ধানে।
বলার ফাঁকে ফাঁকে ভুক ভুক হচ্ছিল। শেষ হওয়ামাত্রই মাঝরাতের কুকুরের মতো ভৌ- ঔ-ঔ করে পেল্লায় এক ডাক ছাড়লুম।
বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,—ফ্যান্টাস্টিক। মানুষ যে এইভাবে ডাকতে পারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তুমি একটা দেখালে বটে।
জ্যাঠামশাই সংশোধন করে দিলেন,—ওটা ডাক নয়। কাশি। বাঁধ ভেঙে যেমন জল বেরিয়ে আসে সেইরকম। চাপা ছিল, তেড়ে বেরিয়ে এল।
—পেট গরম হয়েছে। কেন হয়েছে? না কুপথ্য করেছে। তেলেভাজা, চানাচুর, আচার, ঝাল আলুরদম, পেঁয়াজি, পাঁপড়। এর পেছনে কাঁচাপয়সার খেলা আছে। দুপুরবেলা আইসক্রিম আছে।
জ্যাঠামশাই বললেন,—আইসক্রিম ঠান্ডা।
বাবা বললেন,—সংশোধনের প্রয়োজন আছে। ধারণার সংশোধন। আইসক্রিম ঠান্ডা নয় গরম। যত আইসক্রিম খাবে ততই পেট গরম হবে। এখন একটু অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। এর হাতে কাঁচাপয়সা দিচ্ছে কে? পয়সার উৎসটা কোথায়?
—তুমি তো কাশির উৎস-সন্ধান করছিলে হঠাৎ পয়সায় চলে গেলে? পয়সার উৎস তো টাঁকশাল।
—আবার আমাকে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। এর কাশি। শুকনো কাশি। মানে পেট গরম। পেটে গরমাগরম জিনিস ঢুকছে। জিনিস এমনি আসে না। পয়সা লাগে। সেই পয়সা এ পাচ্ছে কোথা থেকে? কেউ দিচ্ছে আদর করে। সেই কেউটা কে?
জ্যাঠামশাই বললেন,—সেই কেউ তো তোমার সামনে বসে আছে। আমিই তো সেই কেউ।
—তুমি? তুমি এইভাবে ওর ফিউচারটা নষ্ট করছ। তুমি পয়সা দিচ্ছ, আর ও সেই পয়সায় যা-তা কিনে কিনে খাচ্ছে। আর কেশে কেশে আমাদের শুধু নয়, গোটা পাড়ার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কোনো অচেনা মানুষ আমাদের বাড়ি জানতে চাইলে, পাড়ার লোক কীভাবে চেনায় জানো, সোজা চলে যান, কাশির শব্দ শুনতে পাবেন। ওইটাই প্রকাশবাবুদের কাশীধাম। এর চেয়ে লজ্জার, এর চেয়ে অপমানের কী আছে!
জ্যাঠামশাই বললেন,—এইটাই তো খাওয়ার বয়স। এই বয়সে খাবে, না তো কোন বয়সে খাবে?
—কাঁচাপয়সা হাতে না-দিয়ে, ঠান্ডা ঠান্ডা জিনিস কিনে দাও।
—কোন কোন জিনিস ঠান্ডা?
—যেমন ধরো, বাতাসা, কুমড়োর বরফি, পাকা পেঁপে, ডুমুর, মুড়কি, খই, চিঁড়ে, কদমা।
—খাস্তা কচুরি, ঝুরি ভাজা, ডাল বড়া।
—বিষ, বিষ। ঘিয়ে ভাজা কোনো কিছু চলবেই না। হালকা, সহজে হজম হয় এমন জিনিস খেতে হবে।
—আচ্ছা, ওর টনসিলটা একবার দেখালে হয় না। কাশি টনসিল থেকেই হয়।
—পেট থেকেও হয়।
—বুক থেকেও হয়।
—এটা পেটের।
—এটা গলার।
—আমি বলছি, এটা পেটের।
—আই সে ইট ইজ থ্রোট।
—আই সে দিস ইজ বেলি।
—থ্রোট।
—বেলি।
থ্রোট, বেলি, বেলি, থ্রোট, শুনে অন্দরমহল থেকে সবাই ছুটে এলেন। সবার আগে এলেন দাদু। তিনি প্রশ্ন করলেন,—কীসের এই শব্দকল্পদ্রুম!
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম,—কাশির।
—ইংরেজি কাশি?
—বাংলা কাশিটাই হঠাৎ কীভাবে ইংরেজি হয়ে গেল।
—সায়েবদের কীর্তি। ছিল কাশি হল বারাণসী, শেষে বেনারস। তা তোমাদের এই ভয়ংকর ফাটাফাটির কারণটা জানতে পারি? আমার পুজো মাথায় উঠে গেল।
দাদু পুজোর কাপড় পরে আছেন। হাতে জপের মালা দুলছে।
বাবা বললেন,—এ কাশি পেটের।
জ্যাঠামশাই টেবিল চাপড়ে বললেন,—আলবাত নয়। এ কাশি গলার।
দাদু বললেন,—কার কাশি!
বাবা আমাকে দেখিয়ে বললেন,—এই যে এর খ্যাঁকখেঁকে কাশি। আপনিই বলেছিলেন, শুকনো কাশি, পেটের কাশি। পেট গরম হলেই হয়।
জ্যাঠামশাই বললেন,—ও আপনি বলেছিলেন, তাহলে আমি তর্ক করতুম না। বেশ এটা পেটের কাশি। নেকস্ট পয়েন্ট, সারবে কীসে?
দাদু বললেন,—ভেরি সিম্পল। নেচারোপ্যাথি। গঙ্গার মাটি গুঁড়ো করে, মিহি করে, তিলের তেল মিশিয়ে, জল দিয়ে কাদাকাদা করে, তলপেটে লেপে দাও। আর তিন দিন শুধু লাউপথ্য।
জ্যাঠামশাই বললেন,—লাউপথ্য কাকে বলে?
দাদু বললেন,—ভেরি সিম্পল। লাউ যার পথ্য। তুমি তো আবার সায়েবমানুষ, নিরামিষের খবরই রাখো না। সাদা সাদা, লম্বা লম্বা একধরনের ফল আছে, তার নাম লাউ। সংস্কৃত হল অলাবু। চিংড়ির সঙ্গে ভোগীর প্রিয় প্লেন অ্যান্ড সিম্পল হল যোগীর আহার। শুদ্ধ-সত্ত্ব। সেই লাউ সেদ্ধ করা থাকবে। খিদে পেলেই খাও।
জ্যাঠামশাই বললেন,—মরে যাবে। কাশির সঙ্গে কেশো দুজনেই চলে যাবে। তা ছাড়া পেটে ওই মাটির প্রলেপ, নিমোনিয়া হয়ে যাবে।
বাবা বললেন,—তোমার অ্যানাটমির জ্ঞান সাংঘাতিক। কোথায় পেট আর কোথায় লাংস। এগুলো তো একটু শিখতে পারো। ভাস্ট ইগনোরেন্স। অজ্ঞানের আটলান্টিক।
দাদু বললেন,—সংযম, সংযম। ব্রাইডল ইওর টাং। যে জানে না, তাকে তিরস্কার কোরো না। তাকে বোঝাও। তবে হ্যাঁ, একটা সম্ভাবনা আছে, আমাশা হয়ে যেতে পারে। সে তবু মন্দের ভালো। বিনিদ্র রজনী কাটাতে হবে না। আর আমাশার সহজ ওষুধ, থানকুনি পাতা। বাটো আর খেয়ে নাও একদলা।
আমি বললুম,—দাদু, আপনি বলেছিলেন, আমাশার ওষুধ গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি।
—হ্যাঁ, সেটাও হতে পারে।
—তাহলে আজই আমার পেটে মাটি লেপে দিন।
—এই রাতে তো তা সম্ভব নয়। কাল নিজে পুলটিস তৈরি করে তোমাকে অয়েল ক্লথে ফেলে হবে।
জ্যাঠামশাই বললেন,—হোয়াই নট হোমিয়োপ্যাথি?
বাবা বললেন,—হোয়াই নট নেচারোপ্যাথি!
জ্যাঠামশাই বললেন,—কারণটা রোগীর পক্ষে অতিশয় অপমানজনক। ওর বয়সের একটা ছেলে অয়েল ক্লথের ওপর উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে, আর তলপেটে একগাদা মাটি। সেই সময় ওর বন্ধুরা যদি কেউ ডাকতে আসে।
বাবা বললেন,—তখন বলা হবে, দেখা হবে না। ও এখন নেচার-ক্লিনিকে মাড বাথ নিচ্ছে। হয়ে গেল, মিটে গেল ঝামেলা।
জ্যাঠামশাই বললেন,—এটা একটা টর্চার।
দাদু বললেন,—আর এক হয় কবিরাজি।
বাবা বললেন,—কবিরাজিতে আমার অ্যাবসলিউটলি কোনো ফেথ নেই। খল, নুড়ি, ডালপালা।
দাদু বললেন,—তোমার তো কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নেই। তা তুমি তাহলে তোমার মতোই চলো।
—আজ্ঞে না, আমি ডিকটেটার নই। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ছেলে হল, একটা স্টেট, একটা রাজ্যের মতোই। এই বাড়ির সবাই যা ব্যবস্থা নেবেন তাই হবে। আর আমি তো আপনার কর্দমচিকিৎসা সমর্থন করেছি। এরপর তো আর কোনো কথা নেই।
অন্দরমহল থেকে ডাক পড়ল,—আর ভালো লাগছে না কাশিপর্ব, এইবার আহারপর্বে আসতে হবে। বাবা, আপনার পুজো শেষ করে নিন তাড়াতাড়ি।
2
খাবার ঘরে পরপর আসন পড়েছে। রান্নাঘরে বামুনদি প্রাণখুলেলুচি ভাজছেন। গন্ধে জিভে জল এসে যাচ্ছে। নতুন ফুলকপি উঠেছে। বড়ো বড়ো বেগুনভাজা। মা আর জ্যাঠাইমা খুব ব্যস্ত। আমি ছোটো বলে আমার ছোটো থালা। দু-খানা ধবধবে সাদা ফুলকো লুচি পড়েছে পাতে। বেগুনভাজা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। হঠাৎ বাবা বললেন,—না, না অসম্ভব। লুচি খাবে কী? যার এই ভয়ংকর কাশি! পেটে বেশি লোড চাপানো ঠিক হবে না। লাইট, ভেরি লাইট।
জ্যাঠামশাই ফুলকো লুচিতে একটা আঙুল ঢোকালেন। ফুস করে একটু ধোঁয়া বেরিয়ে গেল। দাদু চোখ বুজিয়ে ঈশ্বরকে নিবেদন করছেন। দাদু চোখ খুলে বললেন,—কী বললে?
—ওর লাইট কিছু খাওয়াই উচিত। লুচি, কপি, ভেটকি মাছ রাত্তিরে চলবে না।
—কী চলবে তাহলে?
—খই, দুধ।
—ও খই-দুধ খাবে। আমরা খাব রাজভোগ? এ যে দেখি কাজির বিচার!
—ওর কাশি ভদ্রতার সমস্ত লিমিট ছাড়িয়ে গেছে। এরপর আমাদের ওপর পাড়া ছাড়ার নোটিশ আসবে।
—শোনো, বাইবেলে আছে, হেট দি সিন, নট দি সিনার। কাশিকে মারো, ছেলেটাকে মেরো না। ও যা খাচ্ছে তাই খাবে। তোমাদের ঘরে শুলে যদি অসুবিধে হয়, ও আমার কাছেই শোবে। আমি সারারাত জেগে থাকি, ও-ও সারারাত জাগবে আমার সঙ্গে। সংস্কৃতে উইক। সারারাত ওকে আমি সংস্কৃত পড়াব। দ্যাখো অসুখটার নাম কাশি। মহাতীর্থের নাম কাশী। কাশির কল্যাণে যদি মহাপণ্ডিত হতে পারে, সেটা হবে শাপে বর।
সংস্কৃতের নাম শুনে লুচি আমার মাথায় উঠে গেল। বললুম,—থাক গে, আমি খাব না।
জ্যাঠামশাই আমার হাত চেপে ধরে বললেন,—নির্ভয়ে খাও। আমি আছি। তুমি আমার কাছে শোবে। তেমন হলে সারারাত তোমাকে আমি গল্প শোনাব। এভারেস্ট অভিযানের গল্প, অ্যান্টার্টিক অভিযানের গল্প। সাহারার গল্প।
সমস্ত দায়িত্ব তোমাদের।—বাবা আহার শুরু করে দিলেন।
জ্যাঠামশাই আমাকে বললেন,—নির্ভয়ে চালিয়ে যাও। লুচি তোমার ফেভারিট সাবজেক্ট। ফুল মার্কস পাওয়া চাই।
শেষ পাতে এল ক্ষীর। বাবা বললেন,—চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। হোল ফ্যামিলি আজ জাগবে।
দাদু বললেন,—কেন অশান্তি করছ। তুমি তো সারারাত জেগে জেগে অঙ্ক করো। কত ঘুমোও, সে তো জানাই আছে। শেষ পাতে ক্ষীর শাস্ত্রের বিধান। অশাস্ত্রীয় কাজ কেমন করে হয়।
—আর একটু পারে শাস্ত্র-অশাস্ত্র সব বেরোবে গলা ফেঁড়ে।
খাওয়া শেষ হল। জ্যাঠামশাই কানে কানে বললেন,—তুমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে থাকো। দুম করে এখনি শুতে যেয়ো না।
লুচি দেখলে আমার জ্ঞান থাকে না। খেয়েছিও তেমনি। পরিণামের কথা না-ভেবেই। পেট ফুলে জয়ঢাক। এতক্ষণ কাশি বন্ধ ছিল। লক্ষ করেছি অন্যমনস্ক থাকলে কাশতে ভুলে যাই। পড়তে বসলেই কাশি আসে। স্কুলে গেলেই কাশি পায়। আবার অঙ্কের স্যার ক্লাসে এলেই মারের ভয়ে কাশি চুপ করে যায়। আমার কাশিটা মহাপাজি আছে।
সব কাজ শেষ করে জ্যাঠাইমা ঘরে এলেন। জ্যাঠাইমা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আঁচল থেকে একটা কাগজের মোড়ক খুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন,—এতক্ষণ বসে বসে তোমার জন্যে এই দাওয়াইটা করে এনেছি। আমার মায়ের কাছে শেখা। তালমিছরি, যষ্টীমধু, মরিচ, পিপুল আর লবঙ্গ সব একসঙ্গে হামানদিস্তেতে ফেলে গুঁড়ো করা। খেতেও ভালো। যেই কাশি পাবে মুখে এক চিমটি ফেলে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে কাজ।
জ্যাঠামশাইকে বললেন,—দুজনে মুখোমুখি বসে থ্রোট, বেলি, বেলি, থ্রোট না-করে, ছেলেটাকে একজন ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না।
জ্যাঠামশাই বললেন,—একার মতে হবে না। মিটিং কল করে, সকলের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে। কোন ডাক্তার? অনেক ডাক্তার আছেন।
—তাহলে কাল সকালে, চায়ের সময় মিটিং ডাকো।
—তাহলে আজ রাতেই নোটিশ দিতে হবে।
—দিতে হবে তো দিয়ে এসো। আর ফেলে রাখা যায় না। ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে।
বাবা বলছিলেন,—ছোটোরা যত কাশে ততই ভালো। পেট বড়ো হয়। বেশি খেতে পারে। এই বয়সে যত খাবে ততই স্বাস্থ্য বাড়বে।
—আর পেট বেড়ে দরকার নেই। তুমি কাজের কাজ করো।
জ্যাঠামশাই ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। জ্যাঠাইমা বললেন,—তোমার মাকে দিয়ে হবে না। নিরীহ, ভালো মানুষ। ব্যাটাছেলেরা কিছু না-করলে, এইবার আমাকেই চেঁচামেচি করে একটা কিছু করতে হবে। ডক্টর ভট্টাচার্য আমাকে খুব চেনেন। চেম্বারে নয়, সোজা বাড়িতে নিয়ে যাব। তোমাকে একটা কায়দা শিখিয়ে দি, যখনই কাশি পাবে, একটা ভালো কিছু ভাববে। মনে করবে, তুমি একা একটা সমুদ্রে ভাসছ। ছোট্ট একটা নৌকা। ঘন কালো রাত। আকাশে ছড়িয়ে আছে খইয়ের মতো তারা। শুধু জল আর জল। ফসফরাস জ্বলছে ঢেউয়ের মাথায়। বহুদূরে একটা জাহাজ যাচ্ছে। কেবিনে কেবিনে পুট পুট আলো জ্বলছে। তোমার কাছে রেডিয়ো সংকেত পাঠাবার একটা যন্ত্র। তুমি চেষ্টা করছ জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার। মাঝে মাঝে পারছ, মাঝে মাঝে কেটে যাচ্ছে। নৌকোটা তোমার দুলছে। ঢেউ ছিটকে আসছে। জাহাজটার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না-পারলে মহাবিপদ। চোখের সামনে দেখার চেষ্টা করবে, সমুদ্র, আকাশ, তারা, জাহাজ, ঢেউ। গায়ে তোমার ঠান্ডা বাতাস লাগবে। এইটা যদি করতে পারো, তোমার কাশি থেমে যাবে।
আরো একটা কায়দা আছে, মনে করো তুমি একটা মই বেয়ে ধাপে ধাপে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছ। নারকেল গাছের মাথা। মাথা ছাড়িয়ে আরো উঁচু। আরো আরো উঁচু। পৃথিবীর বাড়িঘর সব অদৃশ্য। মেঘের মধ্যে ঢুকে গেছ। মেঘ ছাড়িয়ে আকাশের আরো উঁচুতে। তারাগুলি ক্রমশই বড়ো হচ্ছে। চাঁদ ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে আরো ওপরে। তুমি উঠছ, তুমি উঠছ। কী মজা! জানো তো এই ভাবে ধ্যান করতে হয়। এতে মন ভালো হয়। মন একাগ্র হয়। লেখাপড়া ভীষণ ভালো হয়। তুমি রাতে শুয়ে শুয়ে অভ্যাস করবে।
জ্যাঠামশাই ঘরে এলেন। এসে বললেন,—ঘরে ঘরে গিয়ে নোটিশ জারি করে এলুম। সকাল সাড়ে সাতটায় মিটিং। তোমরা সব যোগ দেবে, উইদাউট ফেল।
আমার পেল্লায় একটা হাই উঠল। জ্যাঠামশাই আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,—ঘুম আসছে বাপী?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—এই ছেলেটা ভীষণ ভালো। কাশি একটু কম?
—এখন আর হচ্ছে না।
—তাহলে শোয়ার চেষ্টা করে দেখবে?
—তাই দেখি।
—গুড নাইট।
—গুড নাইট। জ্যাঠাইমা গুড নাইট।
—গুড নাইট সোনা।
দাদুর ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে দেখলুম, দাবাবোড়ের ছক সাজিয়ে বসেছেন। বৃদ্ধমানুষ রাতে ঘুম আসে না, একা একা জাগেন। ভোরের দিকে শুয়ে পড়েন। ঘন্টাখানেকের ঘুম। বাবা টেবিলে। টেবল ল্যাম্প জ্বলছে। গণিতের মোটা বই খোলা। অঙ্ক তাঁর খেলা।
মায়ের পাশে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লুম। টেবিলের আলোটা এমনভাবে ঢাকা দেওয়া যাতে আমাদের চোখে না-লাগে। বাবার সামনে মা আমাকে আদর করার সাহস পায় না। বাবা বলে দিয়েছেন, ছেলেদের বেশি আদর দেবে না। বেশি আদরে সব আলালের ঘরের দুলাল তৈরি হয়। আদর মনে রাখবে।
বাবা অঙ্কে ডুবে আছেন। এই সুযোগে মা আমাকে একটু আদর করে নিলেন। মা আমাকে পাশ-বালিশের মতো জড়িয়ে ধরে শুতে ভীষণ ভালোবাসেন। আর ওই সময়টায় মনে হয়, আমি যেন স্বর্গে আছি। আমার মা তো ভীষণ ভালো। জ্যাঠাইমা বলেন, ভগবান তোকে কোন মাটি দিয়ে তৈরি করেছিল রে উমা।
মায়ের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকার সময় মনে হয়, আমার কোনো ভয় নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, কাশি নেই। মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। মায়ের একটা নরম হাত আমার পিঠের ওপর দিয়ে ওপাশে চলে গেছে। ভারী একটা পা আমার কোমরে। আলতো একটা হাত আমার চুলে। মায়ের শরীর সবসময় বরফের মতো শীতল। গা দিয়ে হালকা একাট গোলাপের গন্ধ বেরোয়। জ্যাঠাইমা বলেন, সারাক্ষণ যাঁরা ভগবানে মন ফেলে রাখেন, তাঁদের চেহারায় একটা আলো ফোটে, শরীর পদ্মফুলের মতো নরম, ঠান্ডা হয়। সুবাস আসে।
মায়ের কোলের ভেতর আরামসে ঢুকে গিয়ে জ্যাঠাইমার শেখানো সেই ধ্যানটা অভ্যাস করতে লাগলুম। আমার মা যেন একটা সাদা, নরম পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। আমি সেই মেঘে শুয়ে আছি। মেঘটা ধীরে ধীরে আমাকে নিয়ে আকাশের দিকে উঠছে। ওপরে, আরো ওপরে। শেষে চলে এলুম চাঁদের কাছে।
হঠাৎ বাবা অঙ্কের খাতা থেকে মুখ তুলে বললেন,—কী হল আর কাশছে না কেন?
আমি তখন চাঁদের পাহাড়ে। পাহাড়টা রুপোর। হিরের ফুল ফুটে আছে। দুধের ঝরনা।
মা বলছেন,—পেট খালি থাকলেই কাশি বাড়ে।
বাবা বলছেন,—অ্যাবসলিউটলি ভুল ধারণা, পেট ভরা থাকলে কাশি আরো বাড়ে।
মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি আমার দু-আঙুল দিয়ে মায়ের পাতলা পাতলা ঠোঁট দুটো চেপে ধরলুম। মায়ের নাকে ছোট্ট একটা নোলক আছে। আমার দাদু পরিয়ে দিয়েছেন। পাতলা নাকে নোলক নাকি ভীষণ মানায়। দুর্গা ঠাকুরের নাকে নোলক আছে। সেই নোলকটা আমার আঙুল ছুঁয়ে আছে।
আমি কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম।