কাল হল পনিটেল

কাল হল পনিটেল

বিকেল গড়িয়ে তখন সবে সন্ধ্যা নামব নামব করছে। ইলিয়ট রোডের পুরোনো বাড়ি, দোকান, নোনাপুকুর ট্রামডিপোর গা বেয়ে আলতো করে চুইয়ে পড়ছে দিনের শেষ আলো। এই চত্বরটা শহরের একেবারে প্রাচীনতম এলাকাগুলোর মধ্যে একটা। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো বাড়িগুলোর মধ্যে হয়তো সেই চাকচিক্য নেই, অতীতের গন্ধ আছে।ইতিহাসের হাতছানি রয়েছে। আশপাশে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন নির্মাণও হচ্ছে অবশ্য কয়েকটা। বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো কচিকাঁচার দল, ফুটপাতের চাউমিন—বিরিয়ানি—ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে মাংসের দোকানে ঝুলিয়ে রাখা কাটা মাংসের মিলেমিশে যাওয়া গন্ধ, ট্রামের ঘটাং ঘটাং আর অটোরিকশা, মোটরবাইকের হর্নের চিল চিৎকার শেষ বিকেলের ব্যস্ততা জানান দেয়। রোজকার মতোই। চেনা ব্যস্ততার আবহ খান খান করে ভেঙে হঠাৎ ঢুকতে শুরু করল একটার পর একটা পুলিশের গাড়ি। “আরে ক্যায়া হুয়া হ্যায়, ভাইয়া,’ আশপাশের মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ল গুঞ্জন। ইলিয়ট রোডের একটা পুরোনো বহুতল বাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল পার্ক স্ট্রিট থানার বড়বাবুর লাল টাটাসুমা, বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনারের কালো স্করপিও গাড়ি। দ্রুত পায়ে ভিতরে ঢুকলেন অফিসাররা। কিছুক্ষণ বাদে এলেন লালবাজারের গোয়েন্দা প্রধান। তার আগেই হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা ঢুকে পড়েছেন বাড়িতে এক এক করে।

তিনতলার ফ্ল্যাটটার দরজা ঠেলে ঢুকতেই ড্রয়িং রুম। তার সামনে চিৎ হয়ে পড়েছিল কালো প্যান্ট ও ছাই রংয়ের গেঞ্জি পরা দেহটা। মুখের উপর একটা তোয়ালে ফেলা। নাকের নীচে সামান্য রক্তের দাগ। রক্তের সামান্য ছিটে লেগে তোয়ালেতেও। ৭০ ছুঁইছুঁই সুদেবকুমার মুখোপাধ্যায়কে চিনতে অসুবিধা হয় না কারও। ইলিয়ট রোডের চারতলা বাড়িটার তিনতলার ফ্ল্যাটের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চিনতেন মোটামুটি এলাকার সবাই। টলিপাড়ায় সিনেমা বা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট—রাইটার হিসাবে সুনাম ছিল। তাছাড়া পড়শিদের বিপদে—আপদে সাহায্য করতেন। কখনও কারও ব্যাঙ্ক, কারও পোস্টঅফিস বা কপোরেশনে চিঠি লেখালেখির দরকার হলেই শরণাপন্ন হতেন সুদেববাবুর। বৃদ্ধের স্ত্রী বিপাশা মুখোপাধ্যায় বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন একসময়। গত হয়েছেন মাস সাত—আটেক আগে। পুত্র—পুত্রবধূ দিল্লির বাসিন্দা।

‘স্যর, সুদেববাবু তো আমাদের ‘প্রণাম’—এর মেম্বার। এই তো কদিন আগে এক সকালে ফোন করেছিলাম ওঁকে, হোমিসাইড বিভাগের পোড়খাওয়া গোয়েন্দাকে বলছিলেন পার্ক স্ট্রিট থানার এক তরুণ অফিসার।

‘মানে, ওঁকে আগে চিনতে,’ প্রশ্ন করেন গোয়েন্দা অফিসারটি। পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসার বললেন, হ্যাঁ স্যর। কদিন আগেও যখন ফোন করেছিলাম, বললেন, ভালো আছেন। কোনও সমস্যা নেই। কী একটা লেখা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। তাহলে উনি যে খুন হতে পারেন, এমন কোনও আশঙ্কা ওঁর মধ্যে ছিল না। থাকলে নিশ্চয়ই পুলিশকে জানাতেন,’ নিজের মনেই খানিক বিড়বিড় করলেন প্রবীণ গোয়েন্দা অফিসার।

গোয়েন্দাদের অভিজ্ঞ চোখ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল মৃতদেহ। খুন, নাকি অন্য কিছু? পুলিশের প্রাথমিক পাঠ বলে, এরকম যে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তে সবার আগে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা দরকার মৃতদেহ এবং অকুস্থল। তা—ই করছিলেন পার্ক স্ট্রিট থানা ও হোমিসাইডের অফিসাররা। দুই চোখের মাঝখানে কপালের ঠিক নীচে, সুদেববাবুর মুখের ঠিক সেই জায়গাটায় যেন ঘুষি মারার মতো একটা দাগ। ডান চোখের পাতার উপর কালশিটের ছাপ স্পষ্ট। সে দাগ কি কোনওভাবে পড়ে গিয়েও হয়ে থাকতে পারে? হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ। তোয়ালেতে মুখ মোছার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর পড়ে গিয়ে মৃত্যু। এমনটাও তো হতে পারে। নাকি কেউ বলপ্রয়োগ করে কাবু করেছিল বৃদ্ধকে? ঠান্ডা মাথায় খুন? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণ দেখতে থাকেন তদন্তকারীরা। ঘরের ভিতরে কারও সঙ্গে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন মিলল না আপাতদৃষ্টিতে। মেঝের উপর কার্পেট টানটান। বিছানা, বালিশ, আসবাবও বড় একটা ওলটপালট হয়নি। যদি খুনও হয়ে থাকেন সুদেববাবু, তাহলে মোটিভ কী? লুঠের কোনও চিহ্ন আপাতভাবে নেই। অবশ্য বৃদ্ধ একা থাকতেন। তাই বাড়ি থেকে কিছু খোয়া গিয়ে থাকলেও এখনই বোঝা মুশকিল। আর যদি ধরেও নেওয়া যায় ইলিয়ট রোডের মতো জনবহুল এলাকায় দিনদুপুরে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে, তাহলে কেউ টের পর্যন্ত পেলেন না—সেটাই বা কী করে হয়? তাহলে কি পরিচিত কেউ? চিন্তার ভাঁজ পার্ক স্ট্রিট থানা ও লালবাজারের হোমিসাইড বিভাগের ঝানু গোয়েন্দাদের কপালে। একে পার্ক স্ট্রিটের মতো শহরের অভিজাত এলাকা! আবার টলিউড কানেকশন। হাইপ্রোফাইল কেস!

পুলিশের প্রাথমিক কাজটা সারতে রাত হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাস্থল ছাড়ার আগে গোয়েন্দা প্রধান নির্দেশ দিলেন হোমিসাইডের ওসিকে, ‘পোস্ট মর্টেমের প্রাইমারি ওপিনিয়নটা কাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানার চেষ্টা করো। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে কিপ মি আপডেটেড। আর গাড়িতে ওঠার আগে পার্ক স্ট্রিট থানার ওসিকে বললেন, ‘সুদেববাবুর ছেলে দিল্লিতে থাকেন না ? ওঁকে ইমিডিয়েটলি খবর দাও। দেখো, উনি যদি কোনও আলোকপাত করতে পারেন। সুদেববাবু নিজের সুরক্ষার জন্য আমাদের প্রণামের সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু কী এমন বিপদ হল, যা উনি আঁচই করতে পারলেন না?’

১১ জুন, ২০১৪। বুধবার শেষ বিকেলে ইলিয়ট রোডের একটা পুরোনো বাড়ির তিনতলার ঘরে ডােরবেল বাজাল মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার সংস্থার এক কুরিয়র বয়। ফ্ল্যাটের বাসিন্দার নামে মোবাইল বিল এসেছে। সেটি পৌঁছে দিতে হবে। বেল বাজল বেশ কয়েকবার। ছেলেটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করল ভিতর থেকে কোনও সাড়া আসে কি না। সাড়া মিলল না। এ বার পড়শি এক মহিলার ঘরের কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল ছেলেটি।

মহিলা জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘ওই ঘরের ভদ্রলোক দরজা খুলছেন না। একটু দেখবেন, প্লিজ,’ জবাব দিল ছেলেটি।

মোবাইল সংস্থার যুবকের সঙ্গে তড়িঘড়ি পাশের ঘরে গেলেন মহিলা। দরজায় অল্প চাপ দিতেই খুলে সেটা খুলে গেল। মেঝেতে নিঃসাড়ে পড়েছিল সুদেবকুমার মুখোপাধ্যায়ের মৃতদেহ। পড়শি মহিলাই প্রথম খবর দিয়েছিলেন পুলিশে।

উদ্ধার করা মৃতদেহ
উদ্ধার করা মৃতদেহ

সেই পড়শি, কুরিয়র বয়, আশপাশের অন্য বাসিন্দা, নীচতলার দোকানদার— সবার বয়ান নিল পুলিশ। কারা নিয়মিত আসা—যাওয়া করত সুদেববাবুর ঘরে, কারও সঙ্গে বৃদ্ধের শত্রুতা ছিল কি না—সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তদন্তকারীরা। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু মিলল না। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে পরদিন বিকেলে চলে এলেন আর্যপ্রতিম মুখোপাধ্যায়— সুদেববাবুর ছেলে। সন্ধ্যায় ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের প্রাইমারি ওপিনিয়ন পৌঁছে গেল পুলিশের হাতে। আর সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। খুনই হয়েছেন সুদেববাবু। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন, গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বৃদ্ধকে। শরীরে মিলল অন্তত ১৩টি ছোটখাটো আঘাতের চিহ্ন। ঘাড়ের দু’টি হাড় ভাঙা। সম্ভবত সুদেববাবুর ঘাড় ধরে পিছন দিকে মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল খুনি। গলা, ডান হাতে নখের আঁচড়ের দাগ জানান দিচ্ছে আত্মরক্ষাজনিত আঘাতের আভাস। মৃত্যুর আনুমানিক সময় ১০ জুন, রাত ১২টার আশপাশে। কিন্তু খুনি কে? সে কি সুদেববাবুর পরিচিত কেউ? ইলিয়ট রোডের এই বাড়িটিতে বাইরের অপরিচিত কেউ ঢুকতে গেলে তো কারও না—কারও চোখে পড়ার কথা। কেউ কিছুই দেখলেন না? অত রাতে একাকী বৃদ্ধ খুনিকে দরজা খুলেই বা দিলেন কেন? পরিচিত কেউ ছাড়া তো দরজা খোলা খুব স্বাভাবিক নয়। সুদেববাবুর কি কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল কারও সঙ্গে? না নিছক ডাকাতি করতে এসে খুন? নাকি প্রি—প্ল্যানড মার্ডার? খুন করে ঘরটা আগের মতো গুছিয়ে রেখে গেল কি আততায়ীই? পুলিশের চোখকে ধোঁকা দিতে? কেউ কি বৃদ্ধকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন? নাকি স্ক্রিপ্ট লেখা নিয়ে প্রফেশনাল রাইভ্যালরি? সম্ভাব্য খুনি, খুনের মোটিভ সবকিছুই হোমিসাইড বিভাগের অফিসারদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। খুব একটা আশার আলো দেখাতে পারলেন না বৃদ্ধের ছেলেও।

—বাবার সঙ্গে তো আপনার নিয়মিত কথা হত। শেষ যখন কথা হয়েছিল, অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল কি?

—না, বাবা তেমন কিছু আমাকে অন্তত বলেননি।

—কোনও শত্রু বা বিপদের কথা…

—না, না। সেরকম কিছু হলে তো বাবা নিশ্চয়ই বলতেন। উনি একা থাকতেন বলে ‘প্রণাম’—এর সদস্যপদও নিয়েছিলেন। আমরাই বলেছিলাম, নিয়ে রাখতে। বিপদে—আপদে পুলিশকে পাশে পাবেন।

—আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়? মানে বাড়ি ছাড়তে কেউ চাপ দিচ্ছিল আপনার বাবাকে? বা প্রফেশনাল রাইভ্যালরি?

—বাবার কোনও শত্রু আছে বলে তো অন্তত আমার জানা নেই। ওঁর সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক ছিল। কেউ ওঁর ক্ষতি করতে পারেন, ভাবতেই পারছি না।

অগত্যা কিছুটা অন্ধকারে হাতড়াতে থাকেন তদন্তকারী অফিসাররা। ধোঁয়াশা অনেক। খটকার জায়গাও বিস্তর। কী কী জানা দরকার, কী করা দরকার, তদন্তকারী অফিসার তালিকা তৈরি করতে থাকেন।

তদন্তের অগ্রগতি প্রতিদিন গোয়েন্দা প্রধানের কাছে ব্রিফ করছিলেন হোমিসাইড বিভাগের ওসি। সাউথ ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে পার্ক স্ট্রিট থানার কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে একযোগে তদন্ত চালাচ্ছিল হোমিসাইড বিভাগ। তদন্তের এক একটা পার্ট দেখছিলেন এক একজন। একটা দল খুঁটিয়ে দেখছিল প্রত্যেকের বয়ান। একই ব্যক্তিকে বারবার প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছিল। এক প্রশ্ন বারবার করা ক্লান্তিকর, শোনাটাও, তবু করে যেতে হয়, কার কথায় কখন কী সূত্র বেরিয়ে পড়ে, তার অপেক্ষায়। অন্য একটা দল খোঁজ করছিল, যদি আশপাশের কোনও রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে কোনও সূত্র মেলে। তবে খুনি কে, শেষ তাঁর ঘরে কে এসেছিল, তা না—জানলে ক্যামেরার ফুটেজই বা খুনিকে আলাদা করে চিহ্নিত করবে কীভাবে? পুরোনো বাড়িটায় সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের যে ক্যামেরা আছে, তাতেও এই বাড়িটা সরাসরি ধরা পড়ছে না। তবে তারও আগে দরকার সম্ভাব্য আগন্তুকের একটা তালিকা তৈরি করা। পুলিশের তিন নম্বর দলটা ঝাড়াইবাছাই করছিল সুদেববাবুর মোবাইলের কল ডিটেলস রেকর্ড, পুলিশি ভাষায় সিডিআর। শেষবার কার সঙ্গে কখন কথা হয়েছিল তাঁর, কোনও একটা সূত্র যদি বের হয় সেখান থেকে। প্রত্যেকটা ডিটেলস নজরে রাখছিলেন সাউথ ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান। একটা জিনিস গোড়া থেকেই আঁচ করছিলেন তদন্তকারীরা, তা হল, আততায়ী সম্ভবত বৃদ্ধের পরিচিত। আগেও এসেছে এই বাড়িতে। তা না হলে এত রাতে কেন সুদেববাবু অচেনা লোককে এভাবে দরজা খুলে দেবেন? খুনিই বা কী করে এতটা নিশ্চিন্তে পালাতে পারল, যে কেউ টের পেল না? নিশ্চয়ই দরজা খোলার সময় আগন্তুকের নাম ও গলার স্বর শুনে নিশ্চিত হয়েছিলেন সুদেববাবু।

গত কয়েক দিনে কারা এসেছিল ওই বাড়িতে, তার সম্ভাব্য একটা তালিকা তৈরি হল। সবাইকেই মোটামুটি চেনেন সুদেববাবুর পড়শিরা। কাজের লোক, দুধওয়ালা, খবরের কাগজওয়ালা—বয়ান নেওয়া হল প্রত্যকেরই। বৃদ্ধের বাড়ির উপরতলার এক বাসিন্দা জানালেন, দিন কয়েক আগে একটা ছেলেকে আসতে দেখেছেন তাঁর ফ্ল্যাটে। পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসার প্রশ্ন করলেন, ‘কে? চেনেন তাঁকে? কবে এসেছিল ছেলেটি?’

পড়শিটি বললেন, “আমি চিনি না। ছেলেটা এসেছিল, যতদূর মনে পড়ছে, সুদেববাবু মারা যাওয়ার দু’—তিনদিন আগে। আগেও দু—একবার দেখেছি। ছেলেটার মাথায় চুল একটু লম্বা, পনিটেল করে বাঁধা, আর কানে দুল। চেহারা বেঁটেখাটো বলা চলে, তবে বেশ গাঁট্টাগোট্টা।’

‘তারপর আর দেখেননি,’ প্রশ্ন করেন অফিসারটি। পড়শিটি জবাব দেন, ‘না, আর তো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে ছেলেটার নাম জানি না।’

অন্ধকারের মাঝে একটা সরু আলোর রেখা দেখা দিয়েও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। ‘ছেলেটাকে বের করতে পারলে হতে পারে একটা সূত্র বেরবে। আশপাশ। এলাকায় তোমাদের সোর্সদের কাজে লাগাও, কেউ যদি এমন চেহারার কারও খোঁজ দিতে পারে, নির্দেশ দিলেন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। কিন্তু এ তো। খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো!

পুলিশের আর একটা টিম সুদেববাবুর মোবাইলের কল ডিটেলস খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। পার্ক স্ট্রিট থানা, হোমিসাইড শাখার পাশাপাশি সেই কাজে নেমেছিল লালবাজারের টেকনিক্যাল উইং। ছাইয়ের স্তুপ সরিয়ে রত্ন খোঁজার মতোই একটা মোবাইল নম্বর বের করে আনলেন গোয়েন্দারা। আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হতে পারে। তবে কোনও মোবাইল নম্বরে আসা কয়েকশো কলের মধ্যে থেকে একটা বা দু’টো সন্দেহজনক নম্বর খুঁজে বের করার গোটা প্রক্রিয়াটা বাস্তবে এতটাও জলবৎ তরলং নয়। কঠিন অধ্যবসায় লাগে তদন্তকারী অফিসারের। লাগে অক্লান্ত মনঃসংযোগ। টেকনিক্যাল উইংয়ের অফিসাররা অনেক খুঁজে বের করে আনলেন তেমনই একটানম্বর। সুদেববাবুর মৃত্যুর দিন থেকে তার দু’সপ্তাহ আগের সময়সীমার মধ্যে ওই নম্বরটি থেকে একবারই কল এসেছিল তাঁর মোবাইলে। সেটা ১০ জুন রাত ৯টা নাগাদ। ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা পর খুন হন বৃদ্ধ। কার মোবাইল নম্বর সেটা? আততায়ীরই কি? সন্দেহ আরও দৃঢ় হল সেই নম্বরটি সুইচড অফ থাকায়। লালবাজার থেকে গোয়েন্দা প্রধানের নির্দেশ এল, ‘ইমিডিয়েট খুঁজে বের করার চেষ্টা করো, কার নামে রয়েছে ওই নম্বরটা। খুনি নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ধরতে হবে। কার নামে সিমকার্ড তোলা হয়েছে, জানা গেল দ্রুত। সিমকার্ড নেওয়া হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার এক ব্যক্তির নামে। খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। তবে তাঁকে নিছক ভালো মানুষ বলেই মনে হল তদন্তকারীদের। তিনি তো বলছেন, ওই সিমকার্ড কোনওদিন ব্যবহার করেননি। তাঁর কোনও পরিচিতকেও দেননি সিমকার্ড। সুদেববাবুকেও তিনি চেনেন না। ফোন করার অবকাশ নেই। বক্তব্য যাচাই করে নেওয়ার জন্য পুলিশের হাজারো তরিকা আছে। সবই উল্টেপাল্টে দেখা হল। নাহ, এই ভদ্রলোকটি তো মিথ্যা কথা বলছেন না।

তাহলে?

পার্ক স্ট্রিট থানার তরুণ অফিসারটি বলছিলেন, ‘ভেরি ক্লেভার। তাহলে কি নিজের মোবাইল ব্যবহার করেনি খুনি? ওই মোবাইল নম্বরটা থেকে আর কিছু জানা যাচ্ছে?’

টেকনিক্যাল উইংয়ের আধিকারিক বললেন, ‘স্যর, আমরা সবরকম চেষ্টা করছি।’

মোবাইল নম্বর সুইচড অফ থাকলেও প্রযুক্তির সাহায্যে এখন বোঝা সম্ভব, কোন মোবাইলে ব্যবহার করা হয়েছিল ওই সিমকার্ড। গোয়েন্দারা দ্রুত বের করে আনলেন যে মোবাইলে ব্যবহার করা হয়েছিল ওই সিমকার্ড, তার ‘ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি বা আইএমইআই নম্বর। এই নম্বরটা এক—একটা মোবাইলের ক্ষেত্রে আলাদা। প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, সেটা দেখে মানুষকে আলাদা করে চেনা যায়, তেমনই প্রতিটি মোবাইলকে আলাদা করে দেয় আইএমইআই নম্বর। দেখা গেল, সেই মোবাইলে শুধু একটা নয়, ১৭টি সিমকার্ড ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সবকটাই প্রি—অ্যাক্টিভেটেড সিম। কিন্তু সেই সিমকার্ড নম্বরের ভিড়ে কীভাবে মোবাইলের আসল মালিককে খুঁজে পাওয়া যাবে? সব নম্বরগুলোই বিভিন্ন লোকের নামে নেওয়া। হঠাৎ একটু অন্য বুদ্ধি খেলে যায় কলকাতা পুলিশের টেকনিক্যাল উইংয়ের সেই অফিসারটির মাথায়।

‘স্যর, একটা কাজ করলে হয় না? এই নম্বরগুলোর কোনওটায় হোয়াটস অ্যাপ আছে কি না, একবার দেখা যায়,’সাউথ ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনারকে বলেন অফিসারটি।

‘তাতে লাভ কী, প্রশ্ন করেন ডেপুটি কমিশনার।

অফিসারটি বলেন, ‘স্যর, যদি কোনওটায় হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্ট থাকে। আর তার প্রোফাইলে ছবি পাওয়া যায়, তাহলে একটা ক্লু মিলতে পারে।

লোকটার চেহারা হয়তো পাওয়া যেতেও পারে।’

সবক’টা নম্বরই মোবাইলে সেভ করলেন তদন্তকারীরা। দেখা গেল, ১৭টির মধ্যে চারটি নম্বর হোয়াটস অ্যাপে কখনও না—কখনও ব্যবহার করা হয়েছে। আর তার একটার প্রোফাইলে ছবিও মিলল। সেই ছবি দেখে চমকে উঠলেন পুলিশ অফিসাররা। বছর পঁচিশ—ছাব্বিশের একটা ছেলে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় পনিটেল। ‘আরে, এইরকমই একজনের কথা বলছিলেন না সুদেববাবুর পড়শিটি, প্রশ্ন করলেন ডেপুটি কমিশনার।

পার্ক স্ট্রিট থানার এক অফিসার বললেন, ‘স্যর, ঠিক তাই।’ ওই ছবি দেখানো হল সুদেববাবুর উপরতলার পড়শিকে। তিনিও বললেন, ‘হ্যাঁ, এ—ই। এই ছেলেটাকেই দেখেছি ওঁর ফ্ল্যাটে। পুলিশের স্থানীয় সোর্সদের চিনতে অসুবিধা হল না ওই যুবককে। এর নাম আবদুল মোমিন। ইলিয়ট রোডেই বাড়ি। বাড়ি গিয়ে অবশ্য মিলল না তাঁকে। বাড়ির লোকেরা জানালেন, মোমিন পাড়ি দিয়েছেন মুম্বইয়ের মীরা রোডে। সেখানে তিনি অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তখন।

৫ জুলাই মুম্বই পাড়ি দেয় পুলিশের একটা টিম। মীরা রোডের ছোট্ট ঘরের ভিতর তখন উচ্চগ্রামে চলছে টেলিভিশন। মোমিন কিং খানের ফ্যান। শাহরুখের সিনেমার বাছা বাছা ডায়লগের সঙ্গে লিপ মেলাচ্ছেন বছর পঁচিশের গাঁট্টাগোট্টা চেহারার যুবক, ‘ডন কা ইন্তেজার তো গ্যায়ারা মুল্কোঁ কী পুলিশ কর রহি হ্যায়, লেকিন সমঝ লো…’

হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা যুবকের মনঃসংযোগে চিড় ধরায়। একটু খেকিয়ে উঠে দরজা খোলেন মোমিন, ‘কৌন?’

ছোট্ট জবাব আসে, ‘পুলিশ। আপনি আবদুল মোমিন?’ বাড়িতে পুলিশ দেখে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি।

—কী বস? ডনকেও তো হার মানাচ্ছ! কলকাতা থেকে সোজা উড়ে এলে মুম্বইয়ে। ভাবলে কেউ কিছু জানবে না।

—আপনারা? কী ব্যাপার?

—কিছুই বুঝতে পারছ না চাঁদু? এতদূর থেকে কি তোমার ফিল্মি ডায়লগ শুনতে এসেছি? খুনটা কেন করলি? সোজাসুজি বল তো?

—খুন? কাকে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

—পারবি, পারবি। এই ছবিটা দেখ, চিনতে পারছিস তো? নাকি এখনও বলবি কিছুই জানিস না! সুদেববাবুর একটা ছবি মোমিনের হাতে দিলেন তদন্তকারী অফিসারটি। এ বার কিছুটা গুটিয়ে গেল সে, ছিনে জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমনটা হয়, অনেকটা সেরকমই।

সদাব্যস্ত ইলিয়ট রোডে ঘটে খুনের ঘটনা
সদাব্যস্ত ইলিয়ট রোডে ঘটে খুনের ঘটনা

‘স্যর, আমি কিছু জানি না। আমার সঙ্গে শুধু আঙ্কলের পরিচয় ছিল। ভারি ভালো মানুষ ছিলেন। অনেককে সাহায্য করেছেন। আমিও নিয়েছি সাহায্য ওঁর কাছ থেকে। এর বেশি সত্যিই কিছু জানি না,’ গোড়ায় বারবার এটাই বলে যাচ্ছিল মোমিন।

তদন্তকারী অফিসারটি একটু কড়া ভাষায় প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে ১০ জুন। সুদেববাবুকে ফোন করেছিলি কেন?’ জবাব আসে, ‘ওঁর কাছে উপকৃত হয়েছি। আঙ্কলকে ধন্যবাদ জানাতে।’

‘তা বলে এত রাতে ! এমন কী উপকার করেছিলেন সুদেববাবু?’ ফের প্রশ্ন করেন তদন্তকারী অফিসারটি। ‘আমাকে কয়েকদিন আগে হাজার খানেক টাকা ধার দিয়েছিলেন আঙ্কল। অ্যাক্টিং স্কুলের ফিজ দিতে হত। ওঁকে ফোন করে বলি, টাকা খুব শিগগিরই ফেরত দিয়ে দেব। এত ভালো মানুষ, বললেন, টাকা ফেরত দিতে হবে না। আমি অ্যাক্টিং শিখছি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন।

—ওহ, তাই! তারপরই ভদ্রলোক মারা গেলেন। একবারও দেখতে গেলি ?

—না, মানে, ওই…

শাক দিয়ে আর কতক্ষণ মাছ ঢাকা যায়? পুলিশি জেরার মুখে প্রতিরোধের বাঁধ ভাঙল তাড়াতাড়িই। সুদেববাবুর পড়শি যেমনটা জানিয়েছিলেন,তাঁর মৃত্যুর দু’দিন আগে, ৮ জুন মোমিনই গিয়েছিল ইলিয়ট রোডের ফ্ল্যাটে। মানতে বাধ্য হল সে। ১০ তারিখ গভীর রাতেও সে—ই গিয়েছিল সুদেববাবুর ফ্ল্যাটে।

‘স্যর, আমি একা ছিলাম না। ফজলও ছিল আমার সঙ্গে,’ জেরায় কবুল করল মোমিন।

গোয়েন্দা প্রধান হোমিসাইডের ওসির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফজল, মানে ফজল আহমেদ। একে তো তোমরা ইন্টারোগেট করেছিলে। আবার তুলে আনো ওকে।’

ওসি হোমিসাইড বলেন, ‘স্যর, ওই ফজলই তখন বলেছিল, ও কিছু জানে না।’

ফজলের হদিশ পেতে দেরি হল না। ইলিয়ট রোডের বাড়ি থেকে ধরা পড়ল দ্রুত। কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে সম্ভবত সর্বপ্রথম একটি রহস্যের কিনারা হল হোয়াটস অ্যাপের সূত্রে। হতে পারে প্রযুক্তির সৌজন্যে, তবু সেই প্রযুক্তিও তো মানুষেরই মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত।

কিন্তু খুনের মোটিভ কী?

জেরায় দু’জনেই স্বীকার করে, সুদেববাবুর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশ কিছুদিনের। আর পাঁচজনের মতো তাদেরও মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বৃদ্ধ। সেই সুবাদে বাড়িতে যাতায়াত ছিল দু’জনের। মিশুকে, দিলখোলা সুদেববাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটেই কলসেন্টার খোলার প্রস্তাব দিয়েছিল মোমিন। তাঁকে বুঝিয়েছিল, এতে তাঁরও লাভ হবে। সুদেববাবু রাজি হননি। বরং বেশি চাপাচাপি করলে পুলিশের কাছে যাওয়ারও হুশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। তখন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আর ফজল হাওড়ায় তার মায়ের নামে একটি সম্পত্তি নিজের নামে করে নিতে চেয়েছিল। সুদেববাবুকে বলেছিল কিছু জাল কাগজপত্র তৈরি করে দিতে হবে। তাতেও নারাজ ছিলেন বৃদ্ধ। তাই রাগ মেটাতেই ১০ জুন রাতে শেষবারের মতো দু’জন গিয়েছিল সুদেববাবুর ফ্ল্যাটে। পরিচিত মোমিন ও ফজলকে দেখে দরজা খুলে দেন তিনি। তখনও দু’জনে একই কথা পাড়ে বৃদ্ধের কাছে। সুদেববাবু জানিয়ে দেন, তিনি মোমিন—ফজলের কথামতো চলবেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন দু’জনকে। তা না—হলে পুলিশ ডাকার কথা বলেন। তখনই রাগের মাথায় বৃদ্ধের মুখে একটা ঘুষি মারে মোমিন। তারপর তাঁর গলা চেপে ধরে দু’জন। হাতের সামনে পড়ে থাকা তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরা হয় তাঁর মুখ। সুদেববাবুর নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে দু’জনই পালিয়ে যায়, সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে। নিশ্চিত হয় তারা, অত রাতে কেউ তাদের দেখতে পায়নি। তাই সুদেববাবুর খুনের পরও নিশ্চিন্তে ছিল মোমিন—ফজল। স্বাভাবিক জীবনে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। তবে কথায় আছে না, ধর্মের কল, বাতাসে নড়ে। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার সময়েই খুন হলেন সুদেববাবু। আর খুনিদের একজন পালিয়ে গিয়ে মুম্বইয়ে সিনেমায় অভিনয়ের ট্রেনিং নিচ্ছে। কী অদ্ভুত সমাপতন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *