নয়
চোখের সামনে সেদিন নিয়তির ছোটখাটো খেলা দেখে উঠল একটা।
ধীরাপদ নিচে নেমেছিল অমিতাভ ঘোষের খোঁজে, তাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল। তার পাশে পাশে ভ্যাট ঝোলানো ঠেলাটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল লোকটা। পাশে পাশে ঠিক নয়, একটু আগে আগে। লোকটাকে চেনে ধীরাপদ। তানিস সর্দার—হৈ-চৈ করে কথা বলে, হড়বড় করে কাজ করে।
ভ্যাট-ভরতি লিভার-একস্ট্রাক্ট। আলকাতরার মত ঘন গাঢ় ফুটন্ত লিভার একস্ট্রাক্ট। ফারনেস থেকে নামিয়ে মেন বিলডিং-এর একতলায় সিনথেটিক স্টোরেজে রাখতে চলেছে। ওয়ার্কশপ থেকে এই পথটুকু কিছুটা এবড়ো-খেবড়ো। অত বড় এক ফুটন্ত ভ্যাট আর একটু সাবধানে ঠেলে নিয়ে যাওয়া উচিত লোকটার। ধীরাপদ অস্বস্তি বোধ করছিল। দু’দিকের কড়ায় ঝোলানো ভ্যাটটা ওর চলার ঠমকে বড় বেশি নড়ছিল, দুলছিল। ধীরাপদ অঘটন ঘটবে জানত না, অথচ অঘটনের একটা ছায়া আশ্চর্যভাবে মনে আসছিল।
অঘটন ঘটল। লোকটার নিজের দোষেই ঘটল।
মেন বিল্ডিং-এর প্রবেশপথের এমাথা-ওমাথা জুড়ে আধ হাতের মত উঁচু একটাই মাত্র বাঁধানো ধাপ। তারপর লম্বা করিডোর। তরতর করে সেই ধাপের মুখে এসে এক মুহূর্তও না থেমে লোকটা দুহাতে ধরা রড দুটোতে সজোরে নিচের দিকে চাপ দিল একটা। উদ্দেশ্য সামনের চাকা দুটো সিঁড়ির ওপর তুলে দিয়ে ঠেললেই পিছনের চাকাটা আপনি উঠে যাবে। উচিত হোক অনুচিত হোক, পরিশ্রম বাঁচানোর জন্যে হয়ত এভাবেই কাজ করে অভ্যস্ত ওরা।
চিৎকার চেঁচামেচি গেল গেল রব।
ফ্যাক্টরী ভেঙে লোক দৌড়ে এলো।
ধীরাপদ চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে। কোথা দিয়ে কি ভাবে কি ঘটে গেল ঠিক বোঝেনি। লোকটাকে দু হাত তুলে আর্তনাদ করে উঠতে দেখেছে, তার পরেই গড়াগড়ি খেতে দেখেছে—মাটিতে ভ্যাটের ফুটন্ত পদার্থের কুটিল স্রোত।
লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় ধীরাপদ ভালো করে দেখল। নিচের অঙ্গ ঝলসে গেছে, ওপরের অঙ্গও দগদগে। মুমূর্ষু, অজ্ঞান।
গতির যুগ। শান-বাঁধানো জায়গাটা মুছে ফেলা হয়েছে। এধারের মাটিতে অনেকটা জায়গা জুড়ে মস্ত একটা কালচে ছাপ পড়ে আছে। তানিস সর্দার বাঁচবে কিনা যে ভাবছে ভাবুক, তার দেহের দাগ দেখে যে শিউরে উঠছে উঠুক। এ-রকম ছোটখাটো অঘটন নতুন কিছু নয়। কিন্তু ওই কালো দাগটা কোম্পানীর সুনিশ্চিত লোকসানের দাগ। সেই দাগটা একেবারে ছোট নয়। ছোট হলেও এই অকারণ ক্ষতি নীরব সহিষ্ণুতায় বরদাস্ত করার মত ছোট নয়।
ওপরে এসে লাবণ্য সরকারের উদ্দেশে গম্ভীর মুখে সিতাংশু বলল, কম করে বারো-চৌদ্দ হাজার টাকা লোকসান!
পাশাপাশি নিজেদের ঘরের দিকে যাচ্ছিল তারা। ধীরাপদ পিছনে।
নিজের ঘরে বসে ধীরাপদ চুপচাপ একটা অস্বস্তি ভোগ করল খানিকক্ষণ। কোম্পানীর ক্ষতি বটে। ক্ষতিটা কর্মচারীর অসাবধানের ফলেই। কিন্তু এই ক্ষতি ছেড়ে একটা লোকের ওই ক্ষতটাই বিভীষিকার মত বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। হাসপাতালে কি ব্যবস্থা হল না হল একবার দেখে আসা উচিত কি না ভাবছে। কেউ তো কিছু বলল না।
চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব হল না শেষ পর্যন্ত। খানিক বাদে কোম্পানীর গাড়ি নিয়ে ফ্যাক্টরী থেকে বেরিয়ে এলো সে। হাসপাতালে এসে মনে হল, না এলেই ভালো হত। ফ্রী বেড খালি নেই, সাধারণ পেইং বেডও না। এমারজেন্সি কেস বলে রোগী ফেরত দেওয়া হয়নি বটে, বাইরের বারান্দায় বাড়তি বেড ফেলে জায়গা দেওয়া হয়েছে তানিস সর্দারকে। সেখানে এরকম এক্সট্রা বেড-এর সংখ্যা এই একটিই নয়, অনেক দেখলে অনভ্যস্ত চোখে ধাক্কা লাগে। রোগী যেখানেই থাক, হয়ত চিকিৎসায় ত্রুটি হয় না, হবার কথা নয় অন্তত, তবু বেডগুলোর দিকে চেয়ে অনুগ্রহের রোগশয্যা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না।
ফ্যাক্টরীর দুজন কর্মচারী ছিল, সেলাম জানিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। তারাও দরকারমত চিকিৎসা হবে বলে ভাবতে পারছে না। অদূরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ওদেরই শ্রেণীর একজন স্ত্রীলোক বসেছিল, সামনে পাঁচ-সাত বছরের দুটো নোংরা ছেলে। কর্মচারী দু’জন কিছু ইশারা করেছে কিনা বোঝা গেল না, স্ত্রীলোকটি দিশেহারার মত উঠে এসে ধীরাপদর দু-পা জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠল।
বচা দে বাবু, বচা দে!
সে হাসপাতালের নিয়ম-কানুন বোঝে না, সম্ভব-অসম্ভব বোঝে না, ভব্যতা- অভব্যতা বোঝে না। নিজের লোকসান বোঝে—তাই বুঝেছে
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিক-বধূর কান্না দেখল ধারাপদ।
খোঁজ নিয়ে জানল, ক্যাবিন খালি আছে এবং দিনে তিন-চার টাকার বিনিময়ে তা পাওয়া যেতে পারে। আর ওষুধপত্রের খরচও লাগবে। সব ব্যবস্থা করে বেরিয়ে এলো যখন, শ্রমিক-রমণীর কান্নাটা কানে বাজছে তখনো। ভাবছে, এত কান্নার সবটাই কি শুধু নিরাশ্রয় হবার ভয়ে…!
ফ্যাক্টরীতে হিমাংশু মিত্র সপ্তাহে সাধারণত দু-তিন দিনের বেশি আসেন না। এসেও দু-এক ঘণ্টার বেশি থাকেন না। অঘটনের পরদিন এই প্রথম তাঁর ঘরে ডাক পড়ল ধীরাপদর।
সাজানো-গোছানো মস্ত বড় ঝকঝকে তকতকে ঘর। বড় সাহেবের সামনে সিতাংশু আর লাবণ্য বসে। পাশের হেলান দেওয়া চেয়ারে অমিতাভ ঘোষ—নির্বিকার মুখে সিগারেট টানছে। মামার সামনেও এমন সহজ মুখে সিগারেট টানে ধীরাপদ জানত না।
আলোচনা গতকালের অঘটন প্রসঙ্গে। কোম্পানীর লোকসান প্রসঙ্গেও। ধীরাপদ প্রতি নির্দেশ, তার চাক্ষুষ দেখার একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে, তানিস সর্দারের গাফিলতির কথা লিখতে হবে, কোম্পানীর লোকসানের অঙ্কটাও বসাতে হবে। এদিকটা এক্ষুনি ঠিক করে না রাখলে পরে গোলযোগের সম্ভাবনা।
অতঃপর চিকিৎসার প্রশ্ন। ব্যবস্থার কথা শুনে বড় সাহেব কিছু মন্তব্য করার আগেই সিতাংশু বিরক্তমুখে বলে উঠল, আপনি কাউকে না জিজ্ঞেস করে সাত- তাড়াতাড়ি এ ব্যবস্থা করতে গেলেন কেন? নিজের কেয়ারলেসনেস-এ অ্যাকসিডেন্ট, এই লোকসানের ওপর আবার আমরা তার ক্যাবিন ভাড়া আর চিকিৎসার খরচা যোগাতে যাব? ফ্রী বেড পেয়েছিল যখন, আপনার ইন্টারফিয়ার করার দরকার কি ছিল?
ধীরাপদ জবাব দিল না।
হিমাংশু মিত্র আঙুল দিয়ে টেবিলে দাগ কাটছেন, লাবণ্য সরকার গম্ভীর, অমিতাভ ঘোষ চেয়ারে মাথা এলিয়ে সিগারেট টানছে।
একটু বাদে হিমাংশুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ক্যাবিন ভাড়া কত?
কত শুনে একটু আশ্বস্ত হতে যাচ্ছিলেন বোধ হয়, সিতাংশু তেমনি অসহিষ্ণু কণ্ঠেই বলে উঠল আবার, টাকার জন্যে তো কথা নয়! আমরা এভাবে আদর-যত্ন করে চিকিৎসা করালে সকলে ধরেই নেবে যে ওর কিছু গাফিলতি নেই, ক্ষতিপূরণ নিয়ে একটা ঝকাঝকি লাগবে হয়ত, এঁর তো কাউকে না জিজ্ঞাসা করে এ-সব করার দরকার ছিল না কিছু।
দরকার ছিল। বিনীত ভাবেই ধীরাপদ জবাব দিল এবার। যে-ভাবে ছিল লোকটা সে-ভাবে থাকলে বাঁচবে বলে মনে হয়নি। হয়ত এখনো বাঁচবে না, যা করেছি নিজের দায়িত্বে করেছি, কোম্পানীর অসুবিধে হলে কোম্পানী দিতে যাবে কেন? একটু থেমে আবার বলল, লোকটার গাফিলতির কথাও সবাই জানে, তবু দরকার হলে কোম্পানী নিজে থেকেই যদি ক্ষতিপূরণ কিছু দেয়, তাহলেও ক্ষতি যা হয়ে গেছে এর ওপরে সেটুকু আর তেমন কিছু বড় ক্ষতির ব্যাপার হবে বলে আমার মনে হয় না, বরং ফলটা ভালো হবে বলেই বিশ্বাস।
হিমাংশু মিত্রের মুখে হালকা বিস্ময়, লাবণ্য সরকার ঘাড় ফিরিয়েছে, অমিতাভ ঘোষ নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে আর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে—কৌতুক-দৃষ্টিটা ধীরাপদর মুখের ওপর।
যত নরম করেই বলুক, চুপচাপ বরদাস্ত করার কথা নয় ছোট সাহেবের। করলও না। রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে, আপনার বিশ্বাসের কথা কেউ শুনতে চায়নি। যা হয়েছে লোকটার নিজের দোষে হয়েছে, আমরা তার জন্যে এত সব করতে যাব কেন?
তার দিকে চেয়েই ধীরাপদ তেমনি শান্ত অথচ স্পষ্ট জবাব দিয়ে ফেলল আবারও একটা। বলল, নিজের দোষে কেউ মরে গেলেও তাকে কেউ ফেলে দেয় না, তারও সৎকার হয়ে থাকে।
সিতাংশু নির্বাক হঠাৎ। নির্বাক কয়েক মুহূর্ত সামনের দুজনও। চীফ কেমিস্ট ফড়ফড়িয়ে সিগারেট টানছে।
হিমাংশু মিত্রই মধ্যস্থতায় এগোলেন। ছেলেকে বললেন, অকারণ বাদানুবাদ করে লাভ নেই, চিকিৎসার সব ব্যয়ভার কোম্পানীর নেওয়া উচিত, কোম্পানীই নেবে। আর ধীরাপদকে বললেন, লোকটা সেরে উঠবে কি উঠবে না তাই যখন ঠিক নেই, পরের কথা পরে—সময় নষ্ট না করে আপাতত অফিসিয়াল স্টেটমেন্টটাই রেডি রাখা দরকার।
ধীরাপদ চুপচাপ উঠে এলো।
সেদিনও বিকেলে হাসপাতালে এসেছিল। শক-পিরিয়ড না কাটা পর্যন্ত তানিস সর্দারের ভালোমন্দ কিছু বলা যায় না। তবে চিকিৎসা যে হচ্ছে সেটা বোঝা যায় এখন। ওর বউকেও দেখল। আজ আর কাঁদছে না। ধীরাপদকে দেখে কালো মুখে আশা আর কৃতজ্ঞতা উপচে উঠছিল।
বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ক্যাবিনে ঢুকল অমিতাভ ঘোষ। ধীরাপদ তাকে এখানে আশা করেনি, দেখে মনে মনে খুশি। অমিতাভ দাঁড়িয়ে রোগী দেখল দু-চার মিনিট।
বাইরে এসেই হাসিখুশি মুখে বলল, ফ্যাক্টরী থেকে তাড়াতাড়ি পালাতে দেখেই বুঝেছি আপনি এখানে, লোকটা আছে কেমন—বাঁচবে?
জবাব শুনল কি শুনল না। আনন্দে গোটা মুখ ডগমগ। এখানে রোগী দেখতে এসেছে কি ধীরাপদর খোঁজে এসেছে বোঝা শক্ত। নিজের পুরনো ছোট গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। উৎফুল্ল মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে স্টার্ট দিল। হাসপাতাল-কম্পাউণ্ডের বাইরে এসেই বলল, আপনি মশাই এমন সাঙ্ঘাতিক লোক জানতুম না!
কেন, কি হল?
যা হল বাবুরা বুঝেছেন, ছোট সাহেবের মাথা ঘুরে গেছে, তার মুখের ওপর এ-রকম কথা কেউ কখনো বলে না।
ধীরাপদ হেসে ফেলল, চীফ কেমিস্টও না?
আমার কথা ছেড়ে দিন, ঠোটের ফাঁকে সিগারেট চেপে হাসছে অমিতাভ। এখানে এই লোকটার জন্যে আপনি যা করলেন চীফ কেমিস্ট হিসেবে সেটা আমারই করার কথা, কিন্তু আমি বললে পাগলের দরদ বলে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করত। এখন জোড়া পাগলের পাল্লায় পড়ল কিনা ভাবছে।
তার আনন্দ দেখে ধীরাপদর ভয় হল, হাতের স্টিয়ারিং ঠিক থাকলে হয়। হেসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি চলেছেন কোথায়?
আপনার চারুদির ওখানে, যাবেন?
চকিতে ধীরাপদ গাড়ির ভিতরটা একবার দেখে নিল। না, ক্যামেরা নেই। বলল, আমি আজ আর না, বাড়ি যাব এখন, আমাকে এদিকেই নামিয়ে দিন কোথাও।
চলুন, পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছি—
মেজাজ যথার্থই প্রসন্ন আজ। ক’দিন ধরে এমন একটা সুযোগই খুঁজছিল ধীরাপদ। সুলতান কুঠি পাঁচ-সাত মাইল পথ এখান থেকে, এই অন্তরঙ্গতার ফাঁকে কাজের কথা তোলাটা অসম্ভব হবে না হয়ত। ঘোরানো পথে গিয়ে ফল হবে না, সমস্যাটা সোজাসুজি ব্যক্ত করে ফেলল। বলল, এদিকে আমার যে চাকরি থাকে না—
অমিতাভ শুধু ফিরে তাকালো একবার, বক্তব্য বুঝতে চেষ্টা করল।
বসে বসে শুধু ফাইলই ঘাঁটছি, আর যে-যা বলছে করছি, নিজে থেকে কিছু বুঝছিও না করছিও না—একটু-আধটু কাজ না দেখাতে পারলে চাকরি থাকবে কেন?
সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ ঘোষের টিপ্পনী, কাজও তো বেশ দেখাচ্ছেন, ওষুধের ব্যবসা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে দিচ্ছেন, ভাষণ লিখে দিচ্ছেন, বাণী লিখে দিচ্ছেন—
বক্রোক্তি গায়ে না মেখে ধীরাপদ জবাব দিল, সে কাজের জন্যে ছ’শ টাকা মাইনে দিয়ে সুপারভাইজার রাখা দরকার নেই—সেটা তাঁরা শীগগিরই বুঝবেন।
অমিতাভর মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। সাদাসাপটা যা বলে বসল, শুনতে ভালো লাগার কথা নয়, ভালো লাগলও না। বলল, আপনার গুণ দেখে আপনাকে এখানে আনা হয়নি, কাজও কেউ আশা করে না। চারু মাসী চেয়েছেন বলেই আপনাকে এখানে এনে বসানো হয়েছে।
ধীরাপদ জানে। শুধু চারুদির এ-রকম চাওয়ার হেতুটাই দুর্বোধ্য। খানিক চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, চারুদির সঙ্গে ব্যবসার কি সম্পর্ক?
সম্পর্কটা সে জানে না শুনে অমিতাভ যেমন অবাক, সম্পর্কটা জানার পর ধীরাপদও অবাক তেমনি। সমস্ত ব্যবসায়ের চার আনার মালিক চারুদি। বলতে গেলে চারুদির টাকাতেই ব্যবসা শুরু, মামার জিম্মায় অমিতাভর মায়েরও কিছু টাকা ছিল। মামার নিজস্ব কত ছিল জানে না, তবে মামা মোটা টাকা ঋণ সংগ্রহ করেছিলেন আর সেই ঋণের দায়িত্বও নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। কারবারের ন’আনা অংশ মামা আর মামাতো ভাইয়ের, এক আনা বাইরের লোকের। নিজের দু’আনার কথা আর উল্লেখ করল না। চারুদির ডাক্তার স্বামী বেঁচে থাকতেই এই ব্যবসার জল্পনা-কল্পনা চলছিল। মামার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল খুব। তিনি মারা যেতে তাঁর জমানো টাকা, বিষয়ের অংশ, আর লাইফ ইনসিওরেন্সের টাকা—সবই চারুদি মামার হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই ব্যবসার জন্য।
অমিতাভ ঘোষ আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ধীরাপদ একেবারে চুপ। কিন্তু ভিতরটা চুপ করে নেই। চারুদির বাড়ি-গাড়ি বিষয়-আশয়ের ওপর থেকে একজনের অনুগ্রহের ছায়াটা মন থেকে সরে গেল বলে খুশি হবার কথাই, কিন্তু ধীরাপদ সেদিকটা ভাবছেই না। এক-রকম জোর করেই চারুদি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন তাকে। ধরে বেঁধে উপকার করা নিয়ে ধারাপদ ঠাট্টা করতে জবাব দিয়েছিলেন, উপকারটা তার একার নাও হতে পারে। পাকাপাকি ভাবে কাজে লাগার পরেও দায়িত্বের কথা বলেছেন চারুদি, বলেছেন সেটা যেন সে ঠিকমত দেখেশুনে বুঝে নিয়ে চলতে পারে।
কিন্তু ধীরাপদ কি করতে পারে? ওর কাছ থেকে কি প্রত্যাশা চারুদির?
বিশ্বাস করে একদিন যাঁর হাতে যথাসর্বস্ব তুলে দিয়েছিলেন, আজ আর তাঁকে অতটা বিশ্বাস করেন না হয়ত। সেদিন বিশ্বাস করেছিলেন, কারণ আর একটা জোর ছিল সেদিন। অনেক বড় জোর। নারীর যে জোরের কাছে অতি বড় প্রবল পুরুষেরও সমর্পণ। সেই জোরটা আজ তেমন নেই ভাবছেন চারুদি? সেই জন্যেই কথায় কথায় বয়সের কথা তোলেন? সেই জন্যেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় চোখে-মুখে জল দিতে হয়? আর সেই জন্যেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওকে যুক্ত করার আগ্রহ?
সবই হতে পারে। কিন্তু ধীরাপদর তা মনে হয় না। এখনও চারুদির বাড়ির দরজায় হিমাংশু মিত্রের লাল গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আর চারুদির স্নেহভাজন বলেই ওর প্রতি অমন রাশভারী বড় সাহেবের প্রচ্ছন্ন প্রীতিভাব।
থেকে থেকে ধীরাপদর কেবলই মনে হল, চারুদির মনের তলায় আরো কিছু আছে। অনেকক্ষণ বাদে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আমি এখানে এসে চারুদির কোন্ কাজে লাগতে পারি?
সামনের দিকে চোখ রেখে অমিতাভ ভুরু কুঁচকে জবাব দিল, কাজে লাগার দরকার নেই, চারুমাসির লোক এখানে একজন থাকা দরকার, আপনি আছেন।
তাঁর লোক একজন থাকা দরকার কেন?
তাঁকেই জিজ্ঞাসা করবেন।
আপনি জানেন না?
না। হালকা শিস দিতে দিতে স্পীড কমালো, সামনে লরী!
ধীরাপদ হাসছে অল্প অল্প। কিন্তু মনে মনে সঙ্কল্প আঁটছে কিছু। হিতে বিপরীত হবে কিনা কে জানে। হবে না বোধ হয়, মেজাজপত্র অন্য রকম দেখছে আজ।
এখানে আসার আগে আমি কি করতাম আপনার জানা নেই, না?
লরীর পাশ কাটিয়ে ঘাড় ফেরালো, ঠোঁটের ফাঁকে হালকা শিসটা ধরা তখনো।
ছেলে পড়াতাম আর কবিরাজী ওষুধ আর পুরনো বই-এর দোকানের বিজ্ঞাপন লিখতাম — মাসে পঞ্চাশ টাকা রোজগার করতে কালঘাম ছুটে যেত। হাসতে লাগল।
সামনের ফাঁকা রাস্তাটা দেখে নিয়ে অমিতাভ আবারও ফিরে তাকালো। শিস থেমে গেছে।
ধীরাপদ বলল, আবারও তাহলে সেই অবস্থার মধ্যেই ফিরে যেতে বলছেন আমাকে?
সশঙ্ক প্রতীক্ষা। কিন্তু কাজ হয়েছে মনে হচ্ছে। স্টীয়ারিং হাতে ফিরে ফিরে বারকতক দেখল।—ব্যাপারখানা কি খুলে বলুন না, কে যেতে বলেছে আপনাকে?
আপনি যা বললেন সেই রকমই দাঁড়ায়। কারো তাঁবেদারের লোক হয়ে বসতে রাজী নই। আপনার ভরসায় কাজের ওপর দাঁড়াব আশা করছিলাম।
রাগতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হেসেই ফেলল অমিতাভ ঘোষ- আচ্ছা, আশা বার করছি আপনার। স্পীডের কাঁটা তিরিশ থেকে এক লাফে পঞ্চান্নর দাগে। উৎফুল্ল বিস্ময়ে বলে উঠল, অদ্ভুত লোক মশাই আপনি
হাসছে ধীরাপদও। স্বস্তি।
চারুদির সঙ্গে যেদিন এসেছিল সেদিনও নাকি সুলতান কুঠির এই পরিবেশটা ভালো লেগেছিল অমিতাভ ঘোষের। পৌঁছে দিতে এসে আজ ধীরাপদর সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। অর্থাৎ এক্ষুনি যাবার বাসনা নেই। অগত্যা আমন্ত্রণ না জানিয়ে ধীরাপদ করে কি?
আসুন, বাইরেটা ভালো লাগলেও ভিতরটা লাগবে না।
সুলতান কুঠিতে গাড়ি আসা আর সেই গাড়িতে ধীরাপদর আসা এখন আর উকিঝুঁকি দিয়ে দেখার মত নয় খুব। কিন্তু তার ঘরের সামনের বারান্দায় যে মানুষটি দাঁড়িয়ে, তার বিস্ফারিত চোখে রাজ্যের বিস্ময়। গণুদা। গণুদার এমন চিত্রার্পিত মূর্তি ধীরাপদ আগে কখনো দেখেনি।
উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে আসতে গণুদার দিশা ফিরল যেন। শশব্যস্তে দু হাত জুড়ে আধখানা ঝুঁকে বিনয়ে ভেঙে পড়ে অভিবাদন জ্ঞাপন করে উঠল একটা। জবাবে একখানা হাত কপালে তুলে অমিতাভ জিজ্ঞাসু নেত্রে ধীরাপদর দিকে তাকালো।
গণেশবাবু, গণুদা—এই পাশের ঘরে থাকেন। ঘরের দরজা খোলার ফাঁকে ধীরাপদ পরিচয়ের বাকি আধখানা এড়িয়ে গেল, কাকে নিয়ে এসেছে সেটা আর গণুদাকে বলল না। তার শ্রদ্ধার বহর দেখে ঘাবড়ে গেছে।
কিন্তু যে কারণেই হোক ওটুকু পরিচয় গণুদার পছন্দ নয়। বিনয়ের আঁচে মাখন- গলানো মুখখানি করে বলল, ধীরু আমার ছোট ভাইয়ের মত….
অমিতাভর চোখে নীরব কৌতুক। ধীরাপদর কানেও বেখাপ্পা লাগল, ফিরে দেখে গণুদার দুই চোখ চাপা আনন্দে চকচকিয়ে উঠেছে। ধীরাপদ অবাক, মতলবখানা কি গণুদার।
ঘরে ঢুকে ছড়ানো বিছানায় অমিতাভ আয়েস করে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। আধ-ময়লা বালিশ, আধ-ময়লা চাদর, ঘরেও এ পর্যন্ত ঝাঁট পড়েনি। কিন্তু যে এসেছে এ-সব দিকে তার চোখ নেই। ঘুরেফিরে দুপুরের সেই মজার ব্যাপারটাই রোমন্থনের বস্তু হল আবার। বড় সাহেবের ঘর থেকে ধীরাপদ বেরিয়ে আসার পর ছোট সাহেব নাকি গুম একেবারে। কিন্তু আসলে দেখার মত হয়েছিল লাবণ্য সরকারের মুখখানা। লাভলি …! মামার কাজেও সায় দিতে পারে না, সত্তুর কথায়ও না, সী ইজ মোস্ট চার্মিং হোয়েন সী ইজ অন টা বোটস! মামা ছিল বলে কোনরকমে লোভ সামলে বসেছিল অমিতাভ ঘোষ, নইলে কিছু একটা করেই বসত হয়ত।
কে বলবে অত বড় কোম্পানীর দোর্দণ্ড প্রতাপ চীফ কেমিস্ট এই মানুষ। হাসছে ধীরাপদত্ত, আর ভাবছে দিনটা শুভ বটে। এমন অপ্রত্যাশিত অতিথিকে এক পেয়ালা চা দিয়েও অভ্যর্থনার ব্যবস্থা নেই ঘরে। সঙ্গে গাড়ি আছে যখন, নিজের অসহায় অবস্থার কথা বলে তাকে নিয়ে আবার ভালো কোনো চায়ের দোকানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে কিনা ভাবছিল। এরই মধ্যে আর এক কাণ্ড।
গণুদা ঘরে ঢুকল, তার হাতে ট্রে একটা। ট্রেতে দু পেয়ালা চা। পিছনে মেয়ে উমা। তার দুই হাতে দুটো খাবারের ডিশ।
অমিতাভ সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল, আসুন – আমি তো তাই ভাবছিলাম, ধীরুবাবু এখনো চায়ের কথা বলছেন না কেন? ধীরাপদর দিকে তাকালো, চারুমাসির মুখে শুনে শুনে আপনার ধীরু নাম বেশ মিষ্টি লাগে, ধীরাপদ নামটা বিচ্ছিরি।
ট্রে রেখে গণুদা মেয়ের হাত থেকে খাবারের ডিশ দুটো নিয়ে সামনে ধরল। নাম নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই, প্রথম কথাটার সুতো ধরে সবিনয়ে বলল, আপনি এসেছেন কত ভাগ্য, ওকে বলতে হবে কেন—ঘরের তৈরী সামান্য জিনিস, সাহস করে আনতেই পারছিলাম না।
ধীরাপদ হাঁ করে গণুদাকে দেখছে। আতিথ্যের দায় উদ্ধার হল সে-কথাটা মনেও আসছে না। অমিতাভ ঘোষ ওদিকে ডিশের সাদা দ্রব্যটি গোটাগুটি মুখে পুরে দিয়ে চিবুতে চিবুতে গণদার বিনয়-বচন শুনল। তারপর গম্ভীর মুখে বলল, ঘরে থাকলে নারকেল সন্দেশ সাহস করে আরো দু-চারটে নিয়ে আসুন তো।
গণুদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটল আবার। অমিতাভ এদিকে ফিরে চোখ রাঙালো, আপনি বেশ আছেন দেখি মশাই, অ্যাঁ? এই জন্যেই এখানে ডেরা বাঁধা হয়েছে?
গণুদার কথা ভুলে কোম্পানীর দু আনার অংশীদার, চৌদ্দশ’ টাকা মাইনের বিলেত- ফেরত চীফ কেমিস্টকে দেখছিল ধীরাপদ। বিধাতা খেয়ালী বটে।
সন্ধ্যার পর কুঠির আঙিনা থেকে গাড়ির শব্দটা মেলাবার আগেই গণুদা হাজির। নাইট-ডিউটি আছে বোধ হয়, পরনে পাটভাঙা জামাকাপড়। অতিথি-বিদায়ের অপেক্ষায় ছিল হয়ত। আগ্রহে আর চাপা আনন্দে এই মুখের চেহারাই অন্যরকম। গলার স্বরে অন্তরঙ্গ বিস্ময়— এর সঙ্গে তোমার এত খাতির জানতুম না তো! এঁদেরই কারখানায় চাকরি বুঝি তোমার? আশ্চর্য… আশ্চর্য…
ধীরাপদ চেয়ে আছে। স্বার্থের উদ্দীপনা অনেকটা গিল্টিকরা গহনার মত, নজর করে দেখলে চোখে পড়ে। স্বার্থটা কি সেটাই এখন পর্যন্ত ঠাওর করে উঠতে পারেনি। –আপনি এঁকে চেনেন কি করে?
আমি? শুধু আমি কেন, আমাদের কাগজের অফিসে কে আর না চেনে ওঁকে? ফর্সা মুখ হাসিতে ভিজিয়ে বিছানার একধারে বসে পড়ল গণুদা।
অতঃপর কাগজের অফিসে কতখানি পরিচিত এবং সম্মানিত ব্যক্তি অমিতাভ ঘোষ সেই বৃত্তান্ত। খাতিরটা বছরান্তে মোটা টাকার বিজ্ঞাপন আসে বলে নয়, তাদের বর্তমান ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের অন্তরঙ্গ বন্ধু এই মিস্টার ঘোষ। একসঙ্গে বিলেত গেছে, একসঙ্গে ফিরেছে। আগে মাসের মধ্যে দু-তিনদিন অমিতাভ ঘোষ কাগজের অফিসে আসত, এলে দেড় ঘণ্টার আগে উঠত না। এখন অবশ্য কমই আসে, যাবার সময় ম্যানেজিং ডাইরেক্টার নিজে সঙ্গে করে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। তাদের ওষুধের কোম্পানীর বিজ্ঞাপনে এতটুকু ভুলচুক হলে মালিকের তলবের ভয়ে বিজ্ঞাপন ম্যানেজারের পর্যন্ত মুখ শুকোয়। আরো আছে, শহরের সব থেকে নামজাদা বিলিতি ক্লাবের মেম্বার দুজনেই, কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের-
ছেদ পড়ল। গণদার দৃষ্টি অনুসরণ করে ধীর পদ দেখল দরজার কাছে সোনাবউদি দাঁড়িয়ে। হারিকেনের আলোয় ঠিক ঠাওর হল না, তবু মনে হল মুখখানা হাসি-হাসি।
কাগজের অফিসের ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের সঙ্গে অমিতাভ ঘোষের হৃদ্যতার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই গণদার এত উদ্দীপনার কারণ বোঝা গেছে। শেষ অবদানের প্রতীক্ষায় ধারাপদ সশঙ্কে মুখ বুঝে বসেছিল।
প্রস্তুতির মধ্যপথে ছন্দপতন।
সোনাবউদি ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াতে গোটা মুখের প্রত্যাশার আলোটা টুপ করে নিবিয়ে দিয়ে গণুদা বলল, অফিসের সময় হয়ে গেল, কাল কথা হবে’খন। কাল কেন, আজই হোক না— সোনাবউদির গলায় কৃত্রিম আগ্রহ, একদিন না হয় দু ঘণ্টা দেরিতেই গেলে, না হয় না-ই গেলে অফিসে একদিন—এ-সব কথা কি ফেলে রাখার কথা নাকি?
গণুদা সরোষে তাকালো তার দিকে, কিছু একটা কটূক্তি করে ওঠার মুখে থেমে গিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এখানে বকা-ঝকা করলে যার কাছে সুপারিশের প্রত্যাশা সে-ই বিগড়াতে পারে ভেবে সামলে নিল বোধ হয়। উল্টে হাসতেই চেষ্টা করল গণুদা, বলল, অফিসটা তো আর শ্বশুরবাড়ি নয়, অফিস কি জায়গা তোমার এই দেওরটিকেই জিজ্ঞাসা করে দেখো—
সামনা-সামনি তোষামোদের ব্যাপারে তেমন সুপটু নয় গণুদা, ফলে আরো বিসদৃশ শোনালো। ভদ্রলোক চলে যেতে সোনাবউদির নির্বাক দৃষ্টিবাণ সরাসরি ধীরাপদর মুখে এসে বিদ্ধ হল। দ্রষ্টব্য কিছু দেখছে যেন।
বসুন না। ধীরাপদ খুব স্বস্তি বোধ করছে না।
বসতে হবে? বিনীত প্রশ্ন। ধীরাপদর মুখে বিব্রত হাসি। সোনাবউদির মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। মুখখানা অপরাধী-অপরাধী। বলল, বিছানার চাদরটা তো ময়লা দেখি, বালিশের ওয়াড়গুলোও তাই—আমার কাছে সব ধোয়া আছে একপ্রস্থ, এনে পেতে দেব?
ধীরাপদ থতমত খেয়ে গেল কেমন।
ঘরের দিকে চেয়ে সোনাবউদি আরো সঙ্কুচিতা।—ঘরটায়ও ঝাঁট পড়েনি পর্যন্ত, আপনি দয়া করে একটু উঠলে ঝেড়ে মুছে দিতাম।
ধীরাপদ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
কুঁজোটায় জল ভরা আছে তো? হারিকেনে তেল? ধীরাপদই আগে হেসে ফেলল, কি ব্যাপার?
সোনাবউদির আয়ত চোখ দুটো ওর মুখের ওপর এসে থামল এবার। ঠোঁটের ফাঁকে বিদ্রূপের আভাস। দেখল একটু।—কি ব্যাপার আপনি জানেন না?
জানুক আর না-জানুক ধীরাপদ মাথা নাড়ল, জানে না।
শুনুন তাহলে, সোনাবউদি বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল একটা, পুরুষের দশ দশা, কখনো হাতী কখনো মশা— মশার দশা গিয়ে এখন আপনার হাতীর দশা চলছে। এক পশলা ব্যঙ্গ ছড়িয়ে গজেন্দ্রগমনে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ধীরাপদর দু চোখ দরজা পর্যন্ত অনুসরণ করেছে। তার পরেও বসেই আছে তেমনি।
ধীরাপদ গণুদার কথা ভাবছে, গণুদার প্রত্যাশার কথা বা আবেদনের কথা নয়।
গণুদা ঈর্ষার পাত্র সেই কথা।
গণুদার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াটাই শেষে তাগিদের মত হয়ে দাঁড়াল। পাশাপাশি ঘরে বাস করে ধীরাপদ তাকে এড়াবে কেমন করে? যার একটু ইঙ্গিতে গণুদার জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে, একটা মাসের মধ্যে তাকে একবার অনুরোধও করা হল না দেখে গণুদা মর্মাহত। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকবার বলেছে, সুপারিশের জোর না থাকলে আজকাল কারো কিছু হয় না ভাই, এটা সুপারিশের যুগ।
ধীরাপদ জানে। জেনেও কিছু করে উঠতে পারে না। কেন পারে না গণুদা বুঝবে না। এই একটা মাসের মধ্যে সোনাবউদির সঙ্গে কমই দেখা হয়েছে। ধীরাপদর অনুমান, তার ওপরেও একটু-আধটু গঞ্জনা চলেছে। গণদা ভাবে, স্ত্রীটি একবার মুখ ফুটে বললে অনুরোধ করা দূরে থাক, ধীরাপদ অমিতাভ ঘোষের কাঁধে চেপে বসত।
গণুদার চাকরির উন্নতি ধীরাপদর কাম্য। গণুদার জন্যে নয়, উন্নতি হলে সোনাবউদি আর একটু ভালো থাকবে, ছেলেমেয়েগুলো ভালো থাকবে। শুধু তাদের কথা ভেবেই অমিতাভকে অনুরোধ করার ইচ্ছে আছে। ফাঁক পেলে করবেও। কিন্তু ফ্যাক্টরীর পরিবেশে অমিতাভ ঘোষ ভিন্ন মানুষ। শুধু একটা ভ্রুকুটিতে অনুরোধটা উড়িয়ে দেওয়াও বিচিত্র নয়। অনেক ভেবেচিত্তে ধীরাপদ গণুদাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সুবিধেমত আর একদিন তাকে সুলতান কুঠিতে ধরে নিয়ে আসবে। খামখেয়ালী লোক, একবার পারব না বলে বসলে আর তাকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না।
কিন্তু সেই আশায়ও সম্প্রতি ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে বসেছে গণুদার।
ইতিমধ্যে ফ্যাক্টরীতে ধীরাপদর প্রতিপত্তি বেড়েছে কিছু। বাড়ছেও। তারও মূলে চীফ কেমিস্ট। তানিস সর্দার আরোগ্য-পথে। এখনো বেশ কিছুকাল হাসপাতালে থাকতে হবে বটে, কিন্তু প্রাণের আশঙ্কা নেই। তার চিকিৎসার অপ্রত্যাশিত সুব্যবস্থার ফলে কর্মচারীরা দল বেঁধে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিল চীফ কেমিস্টকে। তানিস সর্দার সর্দার- গোছেরই একজন, সে হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে তাকে বসা কাজে লাগানো হবে, এমন কথাও শোনা গেছে।
অমিতাভ ঘোষ সরাসরি ধীরাপদকে দেখিয়ে দিয়েছে। যা কিছু হয়েছে তার জন্যেই হয়েছে, আর যেটুকু হবার আশা তার জন্যেই হবে। অতএব সব কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ তারই প্রাপ্য। কর্তাদের সঙ্গে কিভাবে ঝকাঝাকি করে সুব্যবস্থাটুকু আদায় করেছে ধীরাপদ, মনের আনন্দে অমিতাভ ঘোষ তাও নিঃসঙ্কোচে বলে দিয়েছে।
ফলে কর্মচারীরা নতুন চোখে দেখেছে ধীরাপদকে। নিস্পৃহতার দরুন ছোট সাহেবের প্রতি, অন্যথায় লাবণ্যের প্রতিও অনেকদিনের ক্ষোভ তাদের। অভিযোগ নিয়ে অথবা সুব্যবস্থার আরজি নিয়ে এ পর্যন্ত বহুবার তারা দল বেঁধে চড়াও হয়েছে। সব অভিযোগ আর সব আরজিই যে যুক্তিসঙ্গত তা নয়। টানা-হেঁচড়ায় কখনো কিছুটা আদায় হয়েছে কখনো বা হয়নি। কিন্তু হোক না হোক, তাদের অস্তিত্বের লাগামটি যে শেষ পর্যন্ত মালিকের হাতেই, সেটা তাদের উপলব্ধি করতে হয়। এরই মধ্যে মালিকের সঙ্গে যুঝে তাদের জন্যে সুবিধে আদায় করেছে একজন, সেটা যেমন বিস্ময়ের তেমনি আনন্দের। তানিস সর্দারের এই প্রাপ্তিটুকু অসময়ে নিজেদেরও একটা প্রাপ্য নজির হিসেবে দেখেছে তারা।
তাদের সোজাসুজি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসাহ দেখে ধীরাপদ অপ্রস্তুতের একশেষ। জনতার কৃতজ্ঞতায় ভেজাল নেই।
এরপর ছোট সাহেবের বিরূপভার আঁচ গায়ে লাগবে এটা ধীরাপদ ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু বিরূপতার আভাস মাত্র না পেয়ে মনে মনে অবাক হয়েছে। অবশ্য পরে এর একটা কারণ অনুমান করেছে। ছেলেটার বয়স তো মাত্র আটাশ-ঊনত্রিশ, তার ওপর অলস গোছের, একটু বিলাসীও। ভিতরে ভিতরে সবল নয় খুব। যা কিছু জোর আর প্রতিপত্তি সব বাপের জোরে, তাঁর প্রবল সত্তার নিরাপদ ছায়ায় বসে। সেই বাপই যখন প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তার তিক্ততা বাড়িয়ে কাজ কি? অন্যের দায়িত্বের ওপর নির্ভর করে নিজের আধিপত্যের ঠাটটুকু বজায় থাকলেই সে খুশি। বাপের সেদিনের ফয়সালার দরুন লোকটাকে উল্টে আরো একটু বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে হয়ত। ফলে ধীরাপদর খানিকটা দায়িত্ব বেড়েছে আর ছোট সাহেবের কিছুটা অবকাশ বেড়েছে।
কিন্তু বাপের প্রভাব যত বড়ই হোক, ছেলের যা কিছু উদ্দীপনার উৎস লাবণ্য সরকার। সেই লাবণ্য সরকারও বদলেছে। ছোট সাহেবের মনে বিরূপতার ইন্ধন যোগানো দূরে থাক, ধীরাপদর সঙ্গে তারও ব্যবহার ক্রমশ সহজ হয়ে উঠেছে। এক-আধ সময় খোঁচা দিয়ে কথা বলতে ছাড়ে না অবশ্য, কিন্তু যাই বলুক হৃদ্যতার ছলে বলে, হাসিমুখে বলে।
বড় সাহেবের ঘরে তানিস সর্দারের কেস নিয়ে কথা-কাটাকাটির দিন-দুই পরে লাবণ্য তার ঘরে এসে বসেছিল। কাজের কথা নিয়েই এসেছিল বটে, কিন্তু ধীরাপদর ধারণা এমনিই এসেছিল। সর্দারের প্রসঙ্গ নিজেই উত্থাপন করেছে। মন্তব্য, লোকটার বরাত ভালো, ওদের জন্যে কে আর এতটা করে!
প্রকারান্তরে সমর্থনের সুরই।
ধীরাপদ বলেছিল, হাসপাতালে ওর বউটার সেই কান্না দেখলে আপনিও না করে পারতেন না-
সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ওপর ছদ্ম-বিস্ময় মেশানো কৌতুক-বাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে একটা।—তাই নাকি? আপনি আসলে সেদিন ওর বউটার সেই কান্না দেখেই অমন ক্ষেপে গিয়েছিলেন তাহলে!
ধীরাপদ হালকা প্রতিবাদ করতে ছাড়েনি। আমি ক্ষেপতে যাব কেন, আপনারই বরং মেজাজ বিগড়েছিল।
আমারও? আমার বিগড়োতে যাবে কেন? আমার কী?
ভিতরে ভিতরে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল ধীরাপদ। — আমিও তাই ভাবি, আপনার সঙ্গে অন্তত আমার কোনো বিরোধ থাকার তো কথা নয়।
লাবণ্য সরাসরি চেয়েছিল মুখের দিকে, অবলার প্রতিমূর্তিটি।— অথচ বিরোধ দেখছেন!
ধীরাপদ হেসে ফেলেছিল, আমি দেখি না-দেখি আপনি যে আমাকে ভালো চোখে দেখেন না সেটা তো ঠিক।
সঙ্গে সঙ্গে নারী-মুখের এক বিচিত্র মাধুর্য-তরঙ্গ দেখেছিল ধীরাপদ। লোভ সামলে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি। চাপা হাসিতে দুই ঠোঁট টসটসিয়ে উঠতে দেখেছিল। মুখে কৃত্রিম সঙ্কট-রেখা। চোখের পাতায় কৌতুক কাঁপছিল।— আপনাকেও ভালো চোখে দেখতে হবে?
অসহায় দীর্ঘনিঃশ্বাস। অর্থাৎ কত আর পারি। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েছে তারপর।– আচ্ছা, দেখব চেষ্টা করে।
ইচ্ছে করলে বা প্রয়োজন হলে লাবণ্য সরকার কতটা পারে সে সম্বন্ধে ধীরাপদ র মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। সিতাংশু মিত্রের মোটরে তাকে এক রকম দেখেছে, হিমাংশু মিত্রের মোটরে আর এক রকম। মেডিক্যাল হোমের নিস্পৃহ কর্ত্রীর গাম্ভীর্যে তাকে এক রকম দেখেছে, চিকিৎসার পসারে আর এক রকম। ওষুধের লাইসেন্স বার করে আনার সুপারিশ নিয়ে তাকে এক রকম দেখেছে, অমিতাভ ঘোষের ছবির অ্যালবামে আর এক রকম।
আর, এই আরো এক রকম দেখল।
ধীরাপদর ইচ্ছে হচ্ছিল, তাকে ডেকে চেয়ারে এনে বসায় আবার। বসিয়ে বলে, চেষ্টাটা আজ থেকেই শুরু হোক।
লাবণ্য সরকারের সঙ্গে আপসের সূত্রপাত সেই। তারপর এ পর্যন্ত ওতে বড় রকমের কোনো ঘা পড়েনি বটে, কিন্তু মাঝে-মধ্যে চিড় খেত। তার কারণ, তার লঘু ঠাট্টা বা টিপ্পনীর জবাবে ধীরাপদও একেবারে চুপ করে থাকত না। আর বলত যখন কিছু, একেবারে ইঙ্গিতশূন্যও হত না সেটা। কিন্তু তা বলে লাবণ্য সরকারের হাসিমুখের ব্যতিক্রম দেখেনি খুব। কখনো সহাস্যে হজম করেছে, কখনো বা ছদ্মরাগে চোখ রাঙিয়েছে, আপনি লোক সহজ নন অনেক দিনই জানি, লাগতে আসাই ভুল।
কিন্তু সেদিন এর স্পষ্ট ব্যতিক্রম দেখে ধীরাপদ অবাক।
উপলক্ষ অমিতাভ ঘোষ।
তারই উদ্যমে এদিককার কাজের ধারারও একটা স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। সেদিন মোটরে ধীরাপদর অনুযোগ আবেদন আর নিজের প্রতিশ্রুতি ভোলেনি সে। ধীরাপদ কাজ দেখতে চেয়েছিল, তাকে দিয়ে কাজ দেখিয়েই ছাড়ছিল। দুপুরের মধ্যে নিজের কাজ সেরে রাত নটা-দশটা পর্যন্তও ধীরাপদর ঘরে কাটাতে দেখা গেছে তাকে এরপর ক্রমশ চিরাচরিত বিজ্ঞাপন- নক্সার তফাত লক্ষ্য করেছে সকলে, প্রচার-বিবৃতির উন্নতি দেখেছে, আর সব থেকে বেশি দেখেছে কার্টনিং আর লেবেলিং-এর বিশেষ আকর্ষণ-বিন্যাস। নিজের হাতে কাঁচি ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক-একটা লেবেল মক্স করেছে অমিতাভ ঘোষ, কাগজের রঙ নিয়ে আর শেড নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে, এমন কি কোন প্যাকিংএ কোন কাগজ দেবে তাই নিয়েও অনেক ভেবেছে। এমন সমাহিত তন্ময়তা ধীরাপদ আর বড় দেখেনি। উন্নতির জন্য কি ভাবে ভাবতে হবে আর কোন পথে মাথা খাটাতে হবে সেই হদিস অদ্ভুত ধীরাপদ পেয়েছে।
এই নতুন উদ্দীপনার ফলাফল বোঝা গেছে মাস দেড়েকের মধ্যেই। মনে মনে একটু ভয় ছিল ধীরাপদর, পরিবর্তনের ফলে খরচ কিছু বাড়ছিল, সেটা উশুল হবে কিনা। সেল-গ্রাফের দিকে চেয়ে নিশ্চিন্ত, সেটা মাথা উঁচিয়েছে। পরিচিত ডাক্তারদের মন্তব্য অনুকূল, লেবেলিং কার্টনিং সুন্দর হচ্ছে, ফোল্ডার ভালো হচ্ছে। অন্যদিকে ‘জি-আর’ কমেছে, অর্থাৎ প্যাকিং-সৌষ্ঠবের দরুন গুডস রিটারনড বা মাল ফেরত কম আসছে।
ফ্যাক্টরীতে সেদিন হিমাংশু মিত্র নিজেই ধীরাপদর ঘরে এলেন। সঙ্গে লাবণ্য।
বড় সাহেব ফ্যাক্টরীতে এলে সাধারণত সে-ই সঙ্গে থাকে। ধারাপদর পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করলেন তিনি, তার সুবিধে-অসুবিধের খোঁজ নিলেন, নতুন প্ল্যান ভাবতে বললেন, টাকার জন্যে ভাবনা নেই সে-কথাও জানিয়ে দিলেন। এমন কি, কিছু একটা অন্তরঙ্গ রসিকতার মুখে লাবণ্যকে দেখেই যে থেমে গেলেন তাও বোঝা গেল।
দরজা পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এলেন আবার। ভালো কথা, ওই সর্দার লোকটি কেমন
আছে?
ভালো।
গুড! চলে গেলেন।
একটু বাদেই লাবণ্য সরকার ফিরে এসে তার সামনের চেয়ারটায় বসল। বলল, আপনার মুখখানা একবার দেখতে এলাম।
ধীরাপদ জবাব দিল, এমন অবিচার কেন, সেটা কি দেখার মত?
আজ বেশ দেখার মত, হিংসেয় আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
ধীরাপদ হেসে ফেলল। – সাহেব তো নতুন প্ল্যান ভাবতে বলে গেলেন, এবার কোনো ওষুধ বার করা যায় কিনা ভাবা যাক আসুন তাহলে।
গত দেড় মাসে এখানকার কাজে সুফল যা-কিছু হয়েছে অমিতাভ ঘোষের জন্যেই হয়েছে, সেটা হিমাংশু মিত্র যেমন জানেন লাবণ্যও তেমনি জানে। তাকে যে এর মধ্যে টেনে আনতে পেরেছে সেটাই ধীরাপদর সব থেকে বড় কেরামতি। লাবণ্য ও সেটা মনে মনে অস্বীকার করে না। তবু একটা টিপ্পনীর লোভ সংবরণ করে উঠতে পারল না। বলল, বসে বসে বড় সাহেবের প্রশংসা তো খুব শুনলেন, আপনার গুরুর নাম তো কই করলেন না একবারও?
যত হালকা করেই বলুক, কথাটা খচ ক’রে লাগার মতই স্থূল। এই খোঁচাটা দেবার জন্যেই আবার ফিরে আসা কিনা বুঝতে চেষ্টা করল ধীরাপদ। হাসিমুখে সেও পাল্টা খোঁচা দিয়ে বসল একটা, কাজ ফুরোলে গুরুর নাম কে আর করে? আপনি
করেন?
হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল লাবণ্য সরকার। থমকালো। সাদা আলোর ওপর ঘন ছায়া পড়লে যেমন ঘোলাটে দেখায় তেমনি দেখতে হল মুখখানা। মেডিক্যাল হোমের সামান্য কর্মচারী ভ্রমে তার ধৃষ্টতা দেখে যে-চোখে তাকাতো সেই চোখে তাকালো। তারপর একটি কথাও না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেল।
ধীরাপদ যতই অপ্রস্তুত হোক, মনে মনে অবাক হয়েছে অনেক বেশি। এতটাই লাগবে ভাবেনি। লাগলেও সেটা প্রকাশ করার মেয়ে নয় লাবণ্য সরকার। কিন্তু কতটা বিধেছে স্বচক্ষেই দেখল।
এর পর তিন-চারদিন একেবারে অন্যরকম। লাবণ্য সরকার তাকে যেন চেনে না ভালো করে। এভাবেই কাটত হয়ত আরো কিছুদিন, কাটল না যে-জন্যে সে-ও এক মন্দ ব্যাপার নয়।
গণুদার ধৈর্য গেছে তার আঁচ পাচ্ছিল, তা বলে বেপরোয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত সে ফ্যাক্টরীতে হানা দেবে ভাবেনি। তাকে সঙ্গে করে ঘরে এনে হাজির অমিতাভ ঘোষ নিজেই। তার বাক্যছটা থেকে বোঝা গেল, বাইরে গেটকিপারের জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল গণুদাকে। তারা ধীরুবাবুও চেনে না, ধীরাপদও চেনে না। চক্রবর্তী সাহেব বা সুপারভাইজার সাহেবকে চেনে। নিরুপায় গণুদা শেষে অমিতাভ ঘোষের নাম করতে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এখানে।
গণুদা বিব্রত মুখে হাসতে চেষ্টা করছিল, ফর্সা মুখ লাল। ধীরাপদ বড় চাকরি করে এটুকুই জানা ছিল, এমন পরিবেশে আর এমন ঘরে বসে চাকরি করে ভাবতে পারেনি।
কিছু বলতে হলে এটাই অনুকূল মুহূর্ত। ধীরাপদ সিগারেটের টিন এগিয়ে দিল তাড়াতাড়ি, বসুন, গণুদা কিন্তু আসলে আপনার কাছেই এসেছেন—
আমার কাছে! সিগারেট ধরিয়ে ফিরে তাকালো, আমার কাছে কী?
গণুদার দিকে চেয়ে হাসি পাচ্ছিল, লজ্জায় একেবারে অধোবদন। কি সেটা ধীরাপদই ব্যক্ত করল। আর করল যখন জোর দিয়েই করল। গদার মত এমন গে লোকের প্রতি এই দীর্ঘকালের অবিচার শুধু মাত্র তাঁর সুপারিশের জোর নেই বলে। উপসংহার, অমিত ঘোষের সঙ্গে আলাপের পর এখন আর জোর নেই বলা চলে না।
অমিতাভ সিগারেট টানল আর গম্ভীরমুখে শুনল। গাম্ভীর্যটুকু একজনের সঙ্কোচ এবং আর একজনের শঙ্কার কারণ। ধীরাপদর বক্তব্য শেষ হতেই সে বলে উঠল, আমার দ্বারা কি-স্-সু হবে না। গণুদার দিকে ফিরল, চারটে ছটা নারকেলের সন্দেশে এত হয় না, এক কুড়ি চাই। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল, আসুন –
ধীরাপদ ইশারা না করলে গণুদা বোকার মত বসেই থাকত হয়ত। উঠে শশব্যস্তে অনুসরণ করল। তার মতি-গতি গণুদার বোঝার কথা নয়, ধীরাপদ বুঝেছে। পাশের ঘরের টেলিফোনে সুপারিশ-পর্বটি এক্ষুনি সমাধা করে ফেলতে চলল।
শেষ পর্যন্ত এত সহজে দায় উদ্ধার হবে ধীরাপদ ভাবেনি। অমিতাভ ঘোষকে ওভাবে উঠতে দেখেই ধরে নিয়েছে, তার সুপারিশও ব্যর্থ হবে না।
কিন্তু এক মিনিটও হয়নি বোধ হয়, ধীরাপদ হকচকিয়ে গেল একেবারে। গদা ফিরে এসেছে। সমস্ত মুখ শুকনো আমসি।
কি হল?
জবাবে গণুদা পাংশুমুখে শুধু মাথা নাড়ল একটু, অর্থাং হল না কিছুই। তারপর চেয়ারে বসে বিড়বিড় করে বলল, কি আর হবে, কপালই মন্দ
মন্দ কপালের বিবরণ শুনে ধীরাপদও নির্বাক। বেশ হাসিখুশি মুখেই ভদ্রলোক গণুদাকে সঙ্গে করে পাশের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। ঘরের মধ্যে ফিটফাট সাহেবী পোশাক পরা একজন লোক একটি মেয়ের সঙ্গে খুব গল্প করছিল। মেয়েটি চেয়ারে বসে ছিল, আর লোকটি তার টেবিলের ওপর বসে তার দিকে ঝুঁকে কথা কইছিল আর হাসছিল। মেয়েটিও হাসছিল। তারা ওভাবে ঢুকে পড়তে লোকটি বিরক্ত মুখে ফিরে তাকিয়েছিল, তারপর একটু অবাক হয়েছিল হয়ত। গণুদার মুরুব্বীটি রাগে লাল হয়ে তক্ষুণি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাকে বলেছে পরে আর একদিন দেখা যাবে। তারপর গনগনে মুখে বারান্দা পেরিয়ে নিচে নেমে চলে গেছে।
ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, ঘরে মেম টাইপিস্ট ছিল কিনা। কি ভেবে সেটা আর জিজ্ঞাসা করল না। আশ্বাস দিয়ে মন্দ-কপাল গণুদাকে বিদায় করল আগে।
তারপর হাতের কাজ একদিকে সরিয়ে রেখে কলম বন্ধ করল। কাজ আর আজ হবে না।
চীফ কেমিস্টের হঠাৎ এমন মেজাজ বিগড়েছে নীতির কারণে নয়। ওদের অন্তরঙ্গতা বরদাস্ত হয়নি ভাই। কিছু যেন ভাবার আছে ধীরাপদর। ভাবনাটা অমিত ঘোষকে নিয়ে। অমিত ঘোষকে নিয়ে আর লাবণ্য সরকারকে নিয়ে। অমিত ঘোষকে নিয়ে আর ফোটো অ্যালবামের পার্বতীকে নিয়ে।
ভাবনা জমে উঠতে না উঠতে সুবাঞ্ছিত বিঘ্ন আবার। অবশ্য ঘড়ির দিকে চোখ পড়লে ধীরাপদ দেখত, কোথা দিয়ে ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেছে এরই মধ্যে। দুখানা চিঠি হাতে লাবণ্য সরকার ঘরে ঢুকল। তিন-চার দিন আগে সেই উঠে গিয়েছিল আর এই এলো। সেদিনের সেই বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র নেই। লঘু রমণীয় ছন্দে আবির্ভাব।
চিঠি দুটো তার সামনের টেবিলের ওপর ফেলে দিল। আপনার জন্যে আমাদের চাকরি শেষ পর্যন্ত থাকলে হয়, আপনি আসার আগে এখানে যেন কাজই হত না কিছু
ধীরাপদ চিঠি দুটোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল একবার। মামুলী প্রশংসার চিঠি দু-পাঁচ লাইন করে। নানা জায়গা থেকে এ-রকম ভালো-মন্দ চিঠি দিনে এক-আধ ডজন এসে থাকে। তা ছাড়া এই চিঠির প্রশংসাও আলাদা করে ধীরাপদরই প্রাপ্য নয়।… চিঠি দুটো উপলক্ষ মাত্র, চিঠি হাতের কাছে না থাকলেও এই আগমন ঘটতই। ধীরাপদ হেসে তাকালো, বসুন-
বসব না, বেরুব এক্ষুনি—খুশি তো?
ধীরাপদ মাথা নাড়ল, তারপর মন্তব্য যোগ করল—এই চিঠির জন্যে নয়, আপনাকে খুশি দেখে।
উৎফুল্ল বিস্ময়, আমাকে আবার অখুশি দেখলেন কবে?
ধীরাপদর মনে হল কিছু একটা আনন্দের উৎসে নাড়া পড়েছে। সেই প্রসন্নতার উকিঝুঁকি। বিগত ক’টা দিনের বিরূপতা সত্ত্বেও এখন এ-ঘরে একবার আসবার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। এসেছে দেখতে। দর্পণে দেখতে।
ওকে দেখার ভিতর দিয়ে আর কাউকে দেখার তুষ্টি।
জবাব শুনবে বলেই যেন টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু কিছু বলার আগে সিতাংশু মিত্রকে দরজার ওধারে দেখা গেল। লাবণ্য সরকার সোজা হয়ে দাঁড়াল। -রেডি? চলুন। হাসতে হাসতে বলে গেল, খুশি-তত্ত্ব নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
চেয়ার ছেড়ে পায়ে পায়ে ধীরাপদ জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। নিচেটা দেখা যায়। গাড়িবারান্দা থেকে সিতাংশু মিত্রের সাদা গাড়ি বেরুলো। সিতাংশু চালকের আসনে। পাশে লাবণ্য। হাসছে। ঘাড় ফিরিয়ে যেদিকে তাকিয়ে আছে সেই দিকে চীফ কেমিস্টের অবস্থান। দোতলার জানলা থেকে ও-দিকটা চোখে পড়ে না।