আট
প্রতিবেশী বলল, তুমি জাহান্নমে যাও!
দোষ তো করিনি, এ কথা কেন?
প্রতিবেশীর চোখ গরম, তোমার নেই কেন?
আবার একদিন। প্রতিবেশী বলল, সেলাম সেলাম, অনেক সেলাম।
সেলাম কেন ভাই?
প্রতিবেশীর চোখ নরম, তোমার যে অনেক আছে-তাই।
এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিবেশীতত্ত্বের এ-দিকটা দেখে ধীরাপদ ফাঁপরে পড়ে গেল। তার জীবনে যেন হঠাৎই জোরালো রকমের সৌভাগ্যের আলো জ্বলে উঠেছে একটা। সেই আলোয় সুলতান কুঠির বাসিন্দাদের চোখে ধাঁধা লেগেছে প্রথম। তারপর নড়েচড়ে সজাগ হয়ে একে একে কাছে এগিয়ে এসেছে তারা। আলো আর তাপের মহিমা।
সুলতান কুঠিতে মাসে ছ’শ টাকা অনেক টাকা।
এই নতুন প্রীতি-বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে মনে মনে ধীরাপদ সোনাবউদিকেই দায়ী করেছে। সৌভাগ্যের কথা ঢাক পিটিয়ে বলে না বেড়ালেও তার কাছ থেকেই খবরটা ছড়িয়েছে।
সোনাবউদি পরদিনই এসেছিল— পরদিন দুপুরে।
অনেকদিন বাদে এই ছুটির দুপুরে ধীরাপদ ঘরেই ছিল। মেডিক্যাল হোম রবিবারেও খোলা, কিন্তু ফ্যাক্টরী বন্ধ। সোমবারে তাকে ফ্যাক্টরীতে হাজিরা দিতে হবে। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে এলোমেলো পাঁচকথা ভাবছিল। একটা বড় কাজ সারা হওয়ায় শ্রান্তি আর তৃপ্তি।
আধ-ভেজানো দরজা ঠেলে সোনাবউদি উপস্থিত। একমুখ পানে টসটসে ঠোঁট, হাতেও পানের খিলি গোটাকতক। সোনাবউদি পান বেশি খায় না, খায় যখন অমনি একগাদা খায়। দিব্যি প্রসন্ন মূর্তি, যেন রোজই গল্পগুজব করতে এ-ঘরে এসে থাকে।
আসব, না ঘুমুচ্ছেন?
আসবেও জানে, ঘুমুচ্ছে না তাও জানে। ধীরাপদ আগেই উঠে বসেছিল। জবাব দেওয়ার দরকার হয়নি, অভ্যর্থনার হাসিটুকু জবাবের থেকে বেশি।
সোনাবউদি ঘুরে দাঁড়িয়ে কদমতলার ফাঁকা উঠোনটা একবার দেখে নিয়ে ঘরের দরজা দুটো টান করে খুলে দিয়েছে। ওপাশের বন্ধ জানলা দুটোর দিকে চোখ পড়তে ভুরু কুঁচকে তাও ঠেলে খুলে দিয়ে এসেছে। তারপর হেসে ফেলে কৃতকর্মের কৈফিয়ৎ দিয়েছে, এরপর যার যা খুশি ভাবুক-
সকাল থেকেই সোনাবউদিকে অনেকবার আশা করেছিল ধীরাপদ। সুসময়েই এসেছে। বলল, আপনার এখনো ভাবাভাবির ভয় আছে নাকি?
থাকবে না কেন? ছদ্মকোপে চোখ রাঙিয়েছে সোনাবউদি, এরই মধ্যে এমন কি বুড়ী হয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করে আসুন ওই বিটলে গণৎকারকে –
কৌতূকটুকু জিইয়ে রাখার জন্যে ধীরাপদ নিরীহ মুখে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছে।—সেকথা নয়, আমি ভেবেছিলাম সেই এক ব্রত সাঙ্গ করেই একসঙ্গে সকলকে ঘায়েল করে ফেলেছেন!
অসহায় ভূ-ভঙ্গি সোনাবউদির। দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়েছে। দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলেছে।—যতই করি শিব-সাধনা, কলঙ্কিনী নাম যাবে না। হাসি চাপার চেষ্টা, খবর বলুন শুনি—
কাল এই সোনাবউদি ও-ভাবে মেয়ে ঠেঙিয়েছে ভারাও শক্ত। খবর শুনতেই আসবে এবং এসেছে তা যেন জানাই ছিল ধীরাপদর।
খবর তো আপনার…
আমার? আমার আবার খবর কি?
আনন্দ করে পান খাচ্ছেন
ও, আয়েস করে বার দুই তিন পান চিবিয়ে মেনেই নিয়েছেন, কাল অমন একখানা ভালো গরদ পেলাম, আনন্দ হল—। তাই খেলাম। আপনিও খান দুটো…
দুটো পান ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, বাকি দুটো নিজের মুখে পুরেছে। পান
হস্তগত করে ধীরাপদ বলেছে, আমি কেন, আমার তো আনন্দের কিছু হয়নি।
সোনাবউদির কৌতুকভরা দুই চোখ মুখের ওপর পড়েছিল। খানিক বাড়তি পানে নিচের ঠোঁট সিক্ত।—আপনারও হয়েছে, আয়নায় দেখে আসুন!
খবর শুনেছে তারপর। কোথায় চাকরি, কি চাকরি, কেমন চাকরি।— অত বুঝি না, কত মাইনে হল?
টাকা-পয়সার ব্যাপারে সোনাবউদির এ ধরনের সাদাসাপটা কৌতূহল বা হিসেব- নিকেশ ধীরাপদ বহুদিন দেখে আসছে। এখন আর খারাপ তো লাগেই না, বরং ভালো লাগে। খারাপ লাগাতে গিয়ে অনেকবার ঘা খেয়েছে। রণুর অসুখে সেই গোট হার বিক্রি করা বা অনটনের সময়েও মাসের বরাদ্দ থেকে ওর দেওয়া বাড়তি টাকা সরিয়ে রেখে কুকার কেনার জন্য একসঙ্গে দেড়-বছরের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ধীরাপদ জীবনে ভুলবে না। আসক্তি আর নিস্পৃহতার এমন গায়ে গায়ে মিতালি আর দেখেনি।
ছ’শ টাকা! মাসে? সোনাবউদির পান চিবুনো থেমে গিয়েছিল, বিস্ফারিত চোখে সংশয় আর বিস্ময়। — চাল দিচ্ছেন না তো?
ধীরাপদ হেসে ফেলেছিল। সোনাবউদিও। আনন্দ ধরে না।
সোনাবউদির মুখ থেকে গণুদা শুনেছে।
গণুদা বিকেলে এসেছিল। ভদ্রলোক কথাও বেশি বলতে পারে না, উচ্ছ্বাসও তেমন প্রকাশ করতে পারে না। তবু সুখবর শুনে যতটা সম্ভব অন্তরঙ্গ আনন্দ জ্ঞাপন করেছে। আপনজনের ভালো শুনলে কত ভালো লাগে তাও বলেছে। বিনিময়ে ধীরাপদ আপনজনের মতই তারও চাকরির খোঁজখবর করেছে, সাব-এডিটার হওয়ার কতটা কি হল না হল জিজ্ঞাসা করেছে।
একেবারে মরমের কথা গণুদার। আশার উৎসে নাড়া পড়েছে।—হবে হয়ত, হওয়া উচিত, চেষ্টাচরিত্র চলছে। কিন্তু না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। ধরপাকড়ের জোর তো নেই, বরং উল্টে মন্দ করার লোক আছে। লোকের ভালো ক’জন দেখতে পারে। সাব-এডিটারদের অনুবাদের বহর তো দেখছে বছরের পর বছর ধরে, গণুদা চেষ্টা করলেও অত ভুল করতে পারবে না। মালিকদের বিচার-বিবেচনা থাকলে অনেক আগেই হয়ে যেত। রমণী পণ্ডিত অবশ্য বলেছেন, সময়টা ভালো এখন, একটু-আধটু ভালো নয়—যাতে হাত দেবে তাই সোনা হওয়ার কথা। অসহিষ্ণু খেদে উদ্দীপনা ম্লান হতেও দেখেছে ধীরাপদ। ঘরে এমন দজ্জাল মেয়েমানুষ থাকলে বরাত ভালো হলেও কত আর হবে—তিন পা এগোলে দু পা পেছনে টানবে। নিরুপায় ক্ষোভে গণুদার ফর্সা মুখ লাল। নিজের চোখেই তো দেখলে কাল, নির্বোধের মত গোঁ ধরে লাভের মুখে ছাই ঢেলে ছাড়ল—করকরে আড়াইশ’ টাকা লোকসান, তার ওপর শুধুমুদু মেয়েটাকে ঠেঙিয়ে আধমরা করল, রাগের মাথায় তোমাকেও কি না কি বলে ফেললাম…
রাগের মাথায় ওকে কি বলা হয়েছে না হয়েছে মনেও নেই। কিন্তু চিত্তদাহের কারণ শুনে অবাক।—আড়াইশ’ টাকা লোকসান কেন?
সেটা আর বলেনি বুঝি? বলবে কেন, আর কেউ আড়াই টাকা লোকসান করলে ঢাক পিটিয়ে বলত। ঢোক গিলে গণুদা গৃহিণীর হঠকারিতা ফাঁস করে দিয়েছে। তার অফিসের এক ভদ্রলোক নিয়মিত রেস্ খেলে, অনেক সময় অনেক খবর দেয়, গণুদা কানও দেয় না কোনদিন, ঘোড়দৌড়ের মাঠও আজ পর্যন্ত ভালো করে দেখেছে কিনা সন্দেহ। সেদিন সেই ভদ্রলোক অব্যর্থ খবর পেয়ে গেছল একটা, দুয়ে দুয়ে চার কষার মত নির্ভুল খবর-একেবারে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের শুধু দিয়েছিল খবরটা। গণুদা তাও কান দিত না হয়ত, কিন্তু রমণী পণ্ডিত বলেছিলেন, ধনস্থানে রাহু তুঙ্গী এখন, চন্দ্র-সূর্য গিলে বসাও অসম্ভব নয়। তাই অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সোনাবউদির কাছ থেকে গণদা মাত্র পঞ্চাশটি টাকা চেয়েছিল। টাকা দেওয়া দূরে থাক, বুকে পা দিয়ে তার ঘরণী কালীর নাচ নেচেছে। ওদিকে সেই ঘোড়া ঠিক প্রথম এসেছে। শুধু প্রথম? টাকার আগুিল মুখে নিয়ে প্রথম—এক টাকায় পাঁচ টাকা— পঞ্চাশ টাকায় আড়াইশ’ হত। ফোঁস করে বড় নিঃশ্বাস ফেলেছে গণুদা। সন্তর্পণে ধীরাপদও। যাবার আগে গণদা ওর আশাতীত খুশির খবরে আবারও আনন্দ-জ্ঞাপন করে গেছে।
গণুদার কাছ থেকে খুশির খবরটা রমণী পণ্ডিত শুনেছেন।
কালো মুখে উদ্দীপনার জলুষ বার করে সকালেই হস্তদন্ত হয়ে একেবারে ঘরে এসে হাজির। শকুনি ভট্টচার্য আর একদশী শিকদারের টিপ্পনীর পরোয়া করেন নি, ধীরাপদর ছ’শ টাকার জোরে তাঁরও জোর বেড়ে গেছে। –কি, সকলের আগে কোথায় আমি খবরটা পাব, না আমাকেই ফাঁকি! বলেছিলাম কিনা, আপনার অনেক হবে, আমার কথা মিলিয়ে নেবেন একদিন—বলেছিলাম কিনা বলুন?
না বললেও অস্বীকার করা শক্ত, তবে রমণী পণ্ডিত বলেছিলেন ঠিকই। সোনাবউদির ব্রতভঙ্গের নেমন্তন্নে বাদ পড়ার দুঃখের রাতে কদমতলার বেঞ্চিতে বসে আর পাঁচকথার সঙ্গে এই কথাও বলেছিলেন। বাজার করে দিয়েও ধীরাপদ নেমন্তন্ন এড়িয়েছিল সেই আনন্দে বলেছিলেন। উদ্ভাসিত মুখে আজ জোর করেই ডান হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়েছেন, অর্থাৎ দেখবেনই তিনি হাত। দেখেছেন আর পঞ্চমুখে ভেঙে পড়েছেন।—ভাগ্যের সিঁড়িতে সবে পা পড়ল, এখনো অনেক, অনেক বাকী। একাদশে বৃহস্পতি মশাই, একাদশে বৃহস্পতি! শুধু তাই? শুক্র কড়া, রবি চড়া— শৌর্যে বীর্যে হাত ভরা। উচ্ছ্বাসের তোড়ে ধীরাপদ সরে বসতে চেষ্টা করেছে।
হাত তো সবে আজ দেখলেন তিনি, এই দিন যে আসবে তাঁর জানাই ছিল। হাত না দেখেই তো বলেছিলেন সে-কথা। চলন দেখলেই তিনি বলে দিতে পারেন কার পিছনে লক্ষ্মী ঘুরছে, কপাল দেখেই বলে দিতে পারেন কার কপালে ভাগ্য নাচছে। শেষে ওর ভাগ্য থেকে নিজের দুর্ভাগ্য প্রসঙ্গে এসে স্তিমিত হয়েছেন আর সানুনয়ে একটা আবেদন ব্যক্ত করেছেন। গত এক মাসে নতুন-পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক দে-বাবু ধীরাপদর খোঁজে দু-তিন দিন নিজে এই সুলতান কুঠিতে এসেছিলেন, পণ্ডিতের সঙ্গে তখন তাঁর আলাপ হয়েছে। আর একটা ওষুধ কিনতে গিয়ে পাকেচক্রে একটু- আধটু আলাপপরিচয় হয়েছে কবিরাজী দোকানের অম্বিকা কবিরাজের সঙ্গেও। এখন এই দুজনের কাছে তাঁর হয়ে একটু সুপারিশ করতে হবে, ধীরাপদ যে কাজ করত সে কাজ উনি স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। বিজ্ঞাপন লেখা ছাড়াও দে-বাবুর জন্য ভালো ভালো বইও লিখে দিতে পারবেন তিনি, তাঁর জ্যোতিষীর বইয়ের কদর কম হবে না। ঘরের অচল অবস্থা প্রায়, এটুকু সাহায্য ধীরাপদকে করতেই হবে, এই সুযোগটুকু পেলে হয়ত একদিন ঘরভাড়া নিয়ে জ্যোতিষীর দপ্তরও খুলে বসতে পারবেন তিনি। মেডিকেল হোমের রমেন হালদারের স্বপ্ন ওষুধের দোকান করবে, পণ্ডিতের স্বপ্ন জ্যোতিষীর দোকান। ধীরাপদ রমণী পণ্ডিতকেও সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে হাঁপ ফেলে বেঁচেছে।
সকালে কদমতলার হুঁকোর আসরে তাঁর কাছ থেকে শকুনি ভট্টচার্য আর একাদশী শিকদারও এই ভাগ্যোদয়ের সমাচার শুনবেন জানা কথাই।
সেদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙতে ধীরাপদর মনে হয়েছিল কল-পাড়ে শকুনি ভট্টচাযের ঊষা-কাশির ঠনঠনে শব্দটা যেন আগের থেকে স্তিমিত আর অনেক বেশি কষ্টক্লিষ্ট। অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে শেষে ধীরাপদ বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
কদমতলার বেঞ্চির সামনে হুঁকো হাতে একাদশী শিকদার দাঁড়িয়ে। বসতে পারছিলেন না বলে দাঁড়িয়ে। জানালা বন্ধ দেখে কাগজওয়ালা বন্ধ দরজার গায়ে কাগজ ফেলে গেছে। কাউকে কিছু না বলে শিকদার মশাই দোরগোড়া থেকে কাগজ নিয়ে যেতে পারছে না, আবার চোখের সামনে কাগজ পড়ে আছে দেখে শান্তি-মত বসতেও পারছে না। ধীরাপদ বাইরে আসতে সতৃষ্ণ চোখজোড়া কাগজের ওপর থেকে ওর দিকে ঘুরেছে। উদগ্রীব প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষার যাতনা।
–বেঁচে থাকো বাবা, দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি হোক। বাঁ হাতে হুঁঝে, শিরা-বার-করা শীর্ণ ডান হাত বাড়িয়ে ধীরাপদর হাত থেকে কাগজ নিয়েছেন। ব্যগ্র চোখ দুটো কাগজের ওপর থেকে ছিঁড়ে এনে ওর দিকে তুলেছেন—রমণীর মুখে শুনেছি বাবা, বড় আনন্দ হয়েছে শুনে–কার ভিতরে কি আছে এ কি আর বাইরে থেকে বোঝা যায়, কত সময় কত অবহেলাই না করেছি—
আশীর্বচনে নয়, আনন্দ হয়েছে শুনেও নয়, শেষের কথাটায় ধীরাপদ অস্বস্তি বোধ করেছে। বেঞ্চিতে বসেও একাদশী শিকদার কাগজ পড়া একটু স্থগিত রেখেছেন। বলীরেখায় হিজিবিজি মুখখানা ওর দিকে তুলে ধরেছেন, তা তুমি বাবা নিজের গুণেই কারো ত্রুটি ধরো না জানি, এখন তো মস্ত লোক, মস্ত আশা-ভরসা। মুখে হঠাৎই যেন আশা উঁকিঝুঁকি দিয়ে উঠেছিল একটু, আগ্রহে গলার স্বর নেমেছিল।—তুমি তো বাবা নিজেই আর একখানা কাগজ রাখতে পারো এখন, বাংলা কাগজ — পারো না?
কাগজ!
একখানা কাগজ পড়ে ঠিক সুখ হয় না, আরো তো বড় কাগজ আছে- তাছাড়া এক কাগজে সব খবর থাকেও না বোধ হয়। থাকে?
বড় খবর সবই মোটামুটি থাকে। ধীরাপদ না ভেবেই বলেছিল।
তবু সব তো থাকে না, কোন খবরটা কার কাছে বড় তার কি ঠিক আছে!
সত্যি কথা। জবাব নেই।
ইত্যবসরে গঙ্গাজলের বাটি হাতে শকুনি ভট্টচার্য উপস্থিত। ধীরাপদকে দেখে অবাক হলেও আগে কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। উপবীত স্পর্শ করে একখানি শীর্ণ হাত তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে অস্ফুটস্বরে আশীর্বাদ করেছেন। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত মিশিয়ে আশীর্বাদটুকু দীর্ঘতর করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হাঁপের ঠেলায় আর ফ্যাশফেশে কাশির ধমকে পেরে ওঠেননি, কাশতে কাশতে বেঞ্চিতে বসে পড়েছেন।
শিকদার মশাই কাগজে ডুবেছেন। সোনাবউদির মত ধীরাপদও দুজনের পায়ের ধুলো নিয়ে ফেলবে কিনা ভাবছিল। অতটা পেরে ওঠেনি। ভট্টচার্য মশাইয়ের কাশির যাতনা দেখে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল। ভদ্রলোক এরই মধ্যে এত কাহিল হয়েছেন লক্ষ্য করেনি।—আপনার কাশিটা কি আগের থেকে বেড়েছে নাকি?
আর বাবা কাশি। কাশির ধমকে আটকে গিয়ে হাত তুলে আকাশ দেখিয়েছেন। অর্থাৎ এবারে গেলেই হয়। চোখে জল এসে গিয়েছিল, সেটা দম-বন্ধ কাশির যাতনায়ও হতে পারে, আবার মাটির টান ঢিলে হয়ে আসছে বলেও হতে পারে। সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে খেদ প্রকাশ করেছেন, সব শীতেই মনে হয় হয়ে গেল, এবারে আরো বেশি-একটু-আধটু খাঁটি চ্যবনপ্রাস পেলে হয়ত কমত, অগ্নিমূল্যের বাজারে খেয়ে- পরে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্ত, ওষুধ জুটবে কোথা থেকে!
পাছে এর পর রমণী পণ্ডিত এসে হাজির হন সেই ভয়ে ধীরাপদ তাড়াতাড়ি সরে এসেছে। এই দুই বৃদ্ধের জন্য মমতা বোধ করেছিল কিনা জানে না। মানুষের এই অসহায় দিকটাও পীড়ার কারণ হতে পারে।
রমণী পণ্ডিতকে এড়ানো সম্ভব হয়নি। তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর দলিলে সই করার মধ্যে তফাৎ নেই খুব। তাগিদে অতিষ্ঠ হয়ে পরের শনিবারেই ফ্যাক্টরী ফেরত সোজা তাঁকে নিয়ে হাজির হয়েছে দে-বাবুর কাছে আর অম্বিকা কবিরাজের কাছে।
প্রথম দর্শনে জ্বলে উঠতে গিয়েও জ্বলে উঠতে পারেননি নতুন-পুরনো বই-এর দোকানের দে-বাবু। গোল গোল চোখ দুটো ধীরাপদর পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিচরণ করেছে একদফা। — দিন বদলেছে মনে হচ্ছে যেন মশায়ের।
দিন কতটা বদলেছে তা রমণী পণ্ডিতই বলে দিয়েছেন। সেই বলার ঝোঁকে মাসে ছ’শ টাকা আটশ হাজারে দাঁড়িয়েছে। দিন আরো কত বদলাবে তারও একটা নিশ্চিত ছবি এঁকে দিয়েছেন তিনি দে-বাবুর চোখের সামনে দু-চার হাজার টাকা হামেশাই ডান-পকেট বাঁ-পকেট হবে। এই দিন বদলের শুভযোগগুলি যে অনেক আগেই তিনি ছকে দিয়েছিলেন সেকথাও জানাতে ভোলেননি।
রমণী পণ্ডিতের উদ্দেশ্য সফল। তাঁর অভ্রান্ত গণনার ফল চোখের সামনে দেখেও দে-বাবু অবিশ্বাস করেন কি করে। ধীরাপদ না হয়ে আর কেউ হলেও কথা ছিল। টাকার জোরে আর কাজের তাগিদে যতই চোখ রাঙান, তলায় তলায় শ্রদ্ধাও করতেন একটু। ভালো কাজ করতে, বিনিময়ে ঠকালেও বুঝেশুনেই ঠকত—এক-এক সময় মনে হত সে-ই যেন উল্টে অনুকম্পা দেখিয়ে গেল তাঁকে। অমন মাথাওয়ালা নির্বিকার কাজের লোক দে-বাবু বেশি দেখেননি। প্রস্তাব মাত্র কাজ হল। রমণী পণ্ডিতকে কাজ দেবেন তিনি, আর ভূত-ভবিষ্যৎ চোখের সামনে নাচে এমন একখানা সহজ-সরল জ্যোতিষীর বই লিখতে পারলে ছাপতেও আপত্তি নেই তাঁর। কিন্তু পুরনো বন্ধুকে একেবারে ভোলা চলবে না ধীরাপদর, দরকার হলে একটু-আধটু সাহায্য করতে হবে।
দে-বাবু এখন আর মনিব নন, বন্ধু। হাসি চেপে ধীরাপদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
অম্বিকা কবিরাজের দোকানেও সেই একই প্রহসন, একই উপসংহার। ধীরাপদ দেখিয়ে-শুনিয়ে দিলে রমণী পণ্ডিতকে কাজ দিতে আপত্তি নেই তাঁরও। সেখান থেকে বেরুবার আগে কি ভেবে ধীরাপদ চ্যবনপ্রাস কিনেছে এক কৌটো। নিজের দরকার শুনে অম্বিকা কবিরাজ ভিতর থেকে খাঁটি জিনিস বার করে দিয়েছেন নাকি, আর লাভ ছেড়ে দাম নিয়েছেন।
ফিরতি-পথে বাসের ভিড়ে রমণী পণ্ডিত উচ্ছ্বাস প্রকাশের সুযোগ পাননি। বাস থেকে নেমে তাঁর খুশির অবতরণিকার মুখেই ধীরাপদ চ্যবনপ্রাসের কৌটোটা এগিয়ে দিয়েছে।—ভটচায মশাইকে দিয়ে দেবেন, ভদ্রলোক বড় কষ্ট পাচ্ছেন। কিনেছি বলবেন না।
রাতের অন্ধকারেও পণ্ডিতের বিস্ময় উপলব্ধি করা গেছে। উচ্ছ্বাস এবার অন্য খাতে গড়াতে দেখে ধীরাপদ বাধা দিয়েছে, বিজ্ঞাপন লিখতে হলে একটা ডিকশনারি জোগাড় করে ভালো ভালো বিশেষণ মুখস্থ করুন–
রমণী পণ্ডিত হেসেছেন, জ্যোতিষীর ডিকশনারি হাতড়ে অলঙ্কার খুঁজতে হয় না মশাই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তা বলে আপনার সম্বন্ধে যা বলেছি একটুও বাড়ানো নয়, নিশ্চিত ফলবে দেখবেন।
আর গণুদার সম্বন্ধে যা বলেছেন?
বেখাপ্পা প্রশ্ন শুনে রমণী পণ্ডিত থতমত খেয়ে গেছেন। কোন্ জবাবে তুষ্ট হবে গলার স্বরে স্পষ্ট নয় তেমন। বললেন, তাঁরও ভালই, তবে এক-একজনের ভালো এক-একরকম। আপনার ভালোর সঙ্গে তাঁর ভালোর তুলনা হবে কেমন করে? তাঁর স্ট্যাণ্ডার্ড অনুযায়ী তাঁরও ভালো, বেশ ভালো—
ওই ভালোটা আর একটু কম ফাঁপালে ভালো হয়, ভদ্রলোক বিগড়ে যেতে পারেন। ভদ্রলোক বিগড়োন আর না বিগড়োন, পণ্ডিত একটু বিগড়েছেন। পায়ে-চলা পথ ধরে মজাপুকুরের কাছাকাছি পর্যন্ত গুম হয়ে থেকে বলেছেন, শুধু ভালোর খবরটাই বুঝি আপনাকে সাতখানা করে শুনিয়েছেন উনি, খারাপও তো কম বলিনি, সে-কথা বলেছেন?
ধীরাপদর প্রথমে মনে হয়েছে খারাপের ইঙ্গিতটা সোনাবউদিকে নিয়ে।… কিন্তু সম্ভব নয়। ওরই কাছে সে-রকম ইঙ্গিত করবেন রমণী পণ্ডিত অতটা নির্বোধ নন। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে ধীরাপদ খুব শাস্তমুখে আবার বলেছে, অন্যের খারাপ-ভালোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিকটাও একটু দেখা দরকার বোধ হয় আপনার মেয়ে এখনো ছেলেমানুষ একেবারে, একটু নজর রাখবেন।
রমণী পণ্ডিত দাঁড়িয়ে গেছেন। সুলতান কুঠির অন্ধকার আঙিনায় কালো মুখের থমকানি ভালো করে দেখা না গেলেও অনুমান করা গেছে। আর একটি কথাও বলেননি, একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেননি। ফলে ধীরাপদর ধারণা, ভদ্রলোক সব জেনেই চোখ বুজে ছিলেন আর চোখ বুজে আছেন। মেয়ের চালচলন যে আরো কারো চোখে পড়েছে, চুপ করে থেকে সেই ধাক্কাই সামলেছেন শুধু।
নিজের ঘরে ঢুকে ধীরাপদর মনে হয়েছে, না বললেই হত। রেস্তরাঁয় যাদের সঙ্গে দেখেছিল মেয়েকে তাদের একজন তো আত্মীয়ই বটে। ছেলেমানুষদের নির্দোষ আনন্দ নিজের চোখের দোষে হলদে দেখেছে কিনা কে জানে! মন বলছে তা নয়, তবু সঙ্কোচ।
অফিসের জন্যে তৈরী হয়ে বেশ সকাল-সকালই বেরুতে হয় রোজ। হোটেলের ‘কিউতে’ আটকালে খাওয়ার আশায় জলাঞ্জলি। কিন্তু পরদিন বেরুবার মুখে বাধা, রমণী পণ্ডিতের দশ বছরের ছেলেটা হস্তদন্ত হয়ে এসে শেখানো বুলির মত বলে গেল, বাবা আপনাকে দয়া করে এক্ষুণি একবারটি আমাদের ঘরে আসতে বলেছেন—
পায়ে পায়ে কোণা-ঘরের প্রথম ঘরটিতে ঢুকেই ধীরাপদ হতভম্ব। দরজার কাছে পাথরের মূর্তির মত রমণী পণ্ডিত দাঁড়িয়ে, অদূরের জানলায় মুখ গুঁজে কুমু কান্নায় ভেঙে পড়েছে, পাশের ঘরের দরজার নিচ দিয়ে রমণী পণ্ডিতের রমণীটির পা দেখা যাচ্ছে।
ধীরাপদ নির্বাক।
এই, এদিকে আয়!
বাপের কঠোর আদেশে মুখে আঁচল গুঁজে মেয়েটাকে জানলা থেকে সরে আসতে হয়েছে। শাসন আর নির্যাতন যতটা হবার হয়ে গেছে এক নজরেই স্পষ্ট।
ধীরাপদর হুঁশ ছিল না যেন। তারই দুই পায়ের ওপর মুখ গুঁজে মেয়েটা ফুলে ফুলে কাঁদছে। রমণী পণ্ডিতের দুই চোখে শাসনের তৃপ্তি এবং প্রতীক্ষা। যেন ধীরাপদর কাছেই মেয়ের সমস্ত অপরাধ, সে ক্ষমা না করা পর্যন্ত ক্ষমা নেই।
হাত বাড়িয়ে ধীরাপদ কুমুকে ভুলতে চেষ্টা করেছে, মেয়েটা ওর পা-দুটো আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে।
ওঠো-।
কণ্ঠস্বরে কাজ হয়েছে। কুমু উঠেছে।
যাও, ভিতরে যাও।
এই আদেশ পালন না করে পারেনি। চলে গেছে।
রাগে-বিতৃষ্ণায় আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ধীরাপদ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। হনহনিয়ে সুলতান কুঠিও পেরিয়ে এসেছে। হোটেলের পথে না গিয়ে ফ্যাক্টরীর বাস ধরেছে। সারা পথ অনুশোচনা আর অস্বস্তি। মেয়েটার ওই অত কান্নার ফাঁকে-ফাঁকে ও যা চোখে পড়েছিল সেটা কী? কুমু কাঁদছিল, কিন্তু আর কিছু যেন ব্যঙ্গ করছিল ওকে।
নীতির মুঠোয় যৌবন ধরে কোনদিন?
সুলতান কুঠির বাইরে ছ’শ টাকা মাইনেটা বড় ব্যাপার নয়, মর্যাদার দিকটাই বড়। সব শুনে চারুদি সাদাসিধে মন্তব্য করেছেন, মাইনে আরো কিছু বেশি হবে ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু মাইনের জন্যে ভাবনা নেই, মাইনে অনেক বাড়বে। দায়িত্বটাই আসল, সেটা যেন ও ভালোমত দেখে-শুনে বুঝে নিয়ে চলতে পারে।
ধীরাপদ অবাক হয়েছিল, চারুদির স্বার্থের উৎসটা আজও ঠিকমত ধরা গেল না। মর্যাদার আসন লাভ করা আর সেই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে কিছু তফাত আছে। সেই তফাতটুকু ঘোচানো তেমন সহজ হচ্ছিল না ধীরাপদর। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অফিস করবে না আর পাঁচজনের মত কোট-প্যান্ট চড়াবে, সেই এক সমস্যা ছিল। এ নিয়ে কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে যাওয়া বিড়ম্বনা। শেষে ধুতি-পাঞ্জাবিই বহাল রেখেছে। মুখে কেউ কিছু না বললেও গোড়ায় গোড়ায় সেটা লক্ষণীয় হয়েছে। অবশ্য এই ধুতি-পাঞ্জাবি আগের ধুতি-পাঞ্জাবি নয়। সোনাবউদি মুখ টিপে ঠাট্টাও করেছিল, ঘষলে মাজলে চেহারাখানা খুব মন্দ নয় তো দেখি…!
ছোট সাহেবের ঘরের পাশেই আলাদা ছোট ঘর তার। ঘরের ভিতরে হালফ্যাশানের অফিসি-সরঞ্জাম, বাইরে নেম-প্লেট, দোরগোড়ার টুলে সাদা কোর্তার ওপর কোম্পানীর লাল-ছাপ মারা বেয়ারা।
প্রথম দিন স্বয়ং বড় সাহেব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। বলা বাহুল্য ধীরাপদ শুধু শুনেছে, বোঝেনি। ছোট সাহেবের নির্দেশমতই কাজ করতে হবে তাকে। সাধারণ প্রচার-চাকচিক্য বাড়ানো, বিজ্ঞাপন দেখা, খবরের কাগজ, সরকারী দপ্তর আর ড্রাগ- হাউসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, কর্মচারীদের ছুটিছাটা নিয়মশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেওয়া, সময়মত মেডিক্যাল হোমের বিধি-ব্যবস্থা তদারক করা—এক কথায় ছোট সাহেবের পরেই কোম্পানীর যাবতীয় তত্ত্বাবধানের ভার তার।
ভারটা ধীরাপদর বুকের ওপর অনেকদিন পর্যন্ত গুরুভারের মত চেপে বসেছিল। অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের কর্ণধার সিতাংশু মিত্র, প্রোডাকশানের অমিতাভ ঘোষ। কেউ কারো কম নয়। তবু মাইনে বা প্রাধান্য বিচার করতে গেলে ফ্যাক্টরীর প্রধান ব্যক্তি অমিতাভ ঘোষ। তার মাইনে চোদ্দশ’ টাকা, দাপট ফ্যাক্টরী-জোড়া। সেই দাপটের কাছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশান আর প্রোডাকশানের সীমারেখা অবলুপ্ত। ফলে চীফ কেমিস্টের মেজাজের আওতায় কোনো কর্মচারীই নিরাপদ বোধ করে না খুব। ধীরাপদ এই একজনের অধীনে কাজ পেলে সব থেকে খুশি হত, নিশ্চিন্ত হত।
কিন্তু কাজের দিক থেকে তার সঙ্গে সামান্যতম যোগের সম্ভাবনাও দেখল না। অর্গ্যানিজেশান চীফের সচেতন গাম্ভীর্যে সিতাংশু মিত্র তাকে সঙ্গে করে সমস্ত বিভাগগুলো ঘুরে দেখিয়েছে, অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তারপর একে একে ফাইল চিনিয়েছে। প্রচারের ফাইল, বিজ্ঞাপনের ফাইল, খবরের কাগজের মন্তব্য সংগ্রহের ফাইল, সরকারী দপ্তর আর ড্রাগ হাউসের ফাইল, কর্মচারীদের ফাইল, মেডিক্যাল হোমের ফাইল। এত দ্রুততালে যে ধীরাপদর চোখের সামনে সবই ঘষামোছা। কিন্তু ছোট সাহেবের ধারণা, সুপারভাইজারকে সব শেখানো হয়ে গেছে। সরাসরি কাজ চালান করেছে তারপর। এটা করুন, ওটা দেখুন, সেখানে যান, এই ঝামেলা মেটান; ওই রিপোর্ট দিন—
ধীরাপদর হিমসিম অবস্থা। এক ঘণ্টার কাজ তিন ঘণ্টায় হয়ে ওঠে না, এক ব্যাপার তিনবার করে জিজ্ঞাসা করে আসতে হয়। ছোট সাহেব অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে না বটে, কিন্তু গোপনও থাকে না খুব। নিজে ব্যস্ত থাকলে লাবণ্য সরকারকে দেখিয়ে দেয়, ওর কাছে যান, বুঝিয়ে দেবেন—
সে ঘরে না থাকলে লাবণ্য নিজেই ডাকে, কি আটকালো আবার, আসুন বলে দিচ্ছি—
বলে দেয়, বুঝিয়েও দেয়। আর ধীরাপদর মনে হয়, তলায় তলায় হাসেও। সে নিজে কোনো কাজের ফাইফরমাশ করে না, ঘরে ডেকেও পাঠায় না। তেমন দরকার পড়লে নিজেই উঠে আসে, আলোচনার ছলে বক্তব্য জানিয়ে যায়। তবু ধীরাপদর মনে মনে ধারণা, এখানকার যত সব নীরস ঝামেলার কাজগুলো ছোট সাহেবের নির্দেশে ওর ঘাড়ে এসে চাপলেও তার পিছনে এই রমণীটির হাত আছে।
ধারণাটা একেবারে অহেতুক নয়। মেডিক্যাল হোমের রমেন হালদারের মুখে লাবণ্য সরকারের কর্তৃত্বের কথা শোনা ছিল। এখানে এই কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতায় মহিলাটির পরোক্ষ কর্তৃত্ব-প্রসঙ্গে কর্মচারীদের এক ধরনের বিদ্রূপাত্মক হাব-ভাব লক্ষ্য করেছে। পুরুষ রূপরসিক বলেই হয়ত জীবিকার স্থূল-বাস্তবে নারীর প্রভাব তেমন প্রীতির চোখে দেখে না।
—ছোট সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আগে আপনি সার মিস সরকারকে একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়, তিনি রাজী হলে আটকাবে না!
বিনা নোটিসে দিনকতক কামাই করার ঝামেলায় পড়ে আবেদন জানাতে এসে একজন কর্মচারী নবাগত মুরুব্বীটিকে সাহায্যের রাস্তাও দেখিয়ে দিয়েছিল। ধীরাপদ বলেছিল, ছোট সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করবে। জবাবে ওই উক্তি।
নতুন বয়লার চালানো নিয়ে অমিতাভ ঘোষের সেই টিপ্পনীও ধীরাপদ ভোলেনি। তুমি বললে এখানে সব হবে, এভরিথিং ইজ পসিবল।
কিন্তু বাহ্যত তার প্রতি লাবণ্য সরকারের ব্যবহারে কর্তৃত্বের সামান্য আভাসও দেখা যায়নি এ পর্যন্ত। বরং নিস্পৃহ গোছের প্রীতিভাবই লক্ষ্য করেছে একটু। ধীরাপদর বিশ্বাস, সেটা শুধু এই অপ্রত্যাশিত উঁচু আসনে তাকে এনে বসানো হয়েছে বলেই নয়, আরো একটা সূক্ষ্ম কারণ আছে। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে চারুদি বার তিনেক টেলিফোনে ডেকেছেন। ধীরাপদর টেবিলে টেলিফোন আসেনি তখনো। শীগগিরই আসবে শুনছে। এ ঘরে দুজনের টেবিলে দুটো টেলিফোন। ডাকটা প্রত্যেকবার লাবণ্যর টেবিল থেকেই এসেছে। বাইরের কল এলে ফ্যাক্টরীর অপারেটারই হয়ত ছোট সাহেবকে বিরক্ত না করে এই টেবিলে কানেকশান দিয়ে দেয়। চারুদির টেলিফোনের ফলেই ধীরাপদর সুপারিশের জোরটা লাবণ্য সরকার আঁচ করতে পেরেছিল বোধ হয়। অস্তত সেই রকমই মনে হয় ধীরাপদর
তাছাড়া মেজাজপত্র ভালো থাকলে যখন-তখন নিজের টেবিল থেকে টেলিফোন করে অমিতাভ ঘোষও। কখনো বলে, ফ্রী থাকলে চলে আসুন, কখনো বা টেলিফোনেই গল্প জুড়ে দেয়। ধীরাপদর ঘরেও এসে বসে মাঝে মধ্যে। ধীরাপদর টেবিলে তার প্রিয় সিগারেট মজুত থাকে এক টিন, সেই লোভেও আসে। লাবণ্যের চোখে পদমর্যাদার সঙ্গে এই মর্যাদাটুকুও যোগ হয়েছে। মুখ ফুটে একদিন জিজ্ঞাসাও করে ফেলেছিল, মিস্টার ঘোষের সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় কত কালের? দু মাসেরও নয় শুনে মনে মনে অবাক হয়েছে।
তাকে নিয়েও যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চলে টেলিফোনে, টের পায় কিনা কে জানে! এরই মধ্যে একদিন টেলিফোন ধরে নাজেহাল অবস্থা ধীরাপদর। ওদিক থেকে চীফ কেমিস্টের হালকা প্রশ্ন, আপনার সামনে যে মহিলাটি বসে, তার মুখখানা ভার-ভার কিনা দেখুন তো—
লাবণ্য সরকার মাথা নিচু করে লিখছিল কিছু, ধীরাপদ একটা চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জবাব দিল, ঠিক বুঝছি না—কেন?
গলাটা ভার-ভার লাগল, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন। লঘু তাগিদ।
…দেখা শক্ত। না তাকিয়েও ধীরাপদ টের পেল, কলম রেখে লাবণ্য সরকার মুখ তুলেছে।
এদিকে লোকটা বিব্রত বোধ করছে অনুমান করেই যেন অমিতাভ ঘোষের ভারী আনন্দ।—শক্ত আবার কি। কি রঙের শাড়ি পরেছে, সাদা না রঙিন?
টেলিফোন রাখতে পারলে বাঁচে ধীরাপদ।-গিয়ে বলছি। কি কথা আছে বলুন। কিচ্ছু কথা নেই, বেজায় ফুর্তি, আপনি মশাই কোনো কাজের নন, দিন ওকেই দিন দেখি—
ধীরাপদ প্রমাদ গুনেছে। আপনা থেকেই সম্মুখবর্তিনীর সঙ্গে চোখোচোখি হয়ে গেছে একবার। লাবণ্য সরকার তার দিকেই চেয়ে ছিল।
—এখন নয়, পরে করবেন। ওদিকের হাসির ওপরেই ঝপ করে টেলিফোন নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি উঠে এসেছে, ভরসা করে সামনের দিকে তাকাতেও পারেনি আর। লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে হাসবে না রাগ করবে ভেবে পায়নি।
চারুদির সুপারিশ আর অমিতাভ ঘোষের হৃদ্যতার জোর যত বড়ই হোক, কাজ পাবার পর ধীরাপদ কাজের জোরের ওপরেই নির্ভর করতে চেয়েছিল। কিন্তু অনভ্যন্ত মনটাকে দিবারাত্র ফাইলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেও সেই জোরটা তেমন পেয়ে উঠছিল না। যার ইঙ্গিতেই কাজ আসুক, ধীরাপদ মন দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছে, মন দিয়ে করতে চেষ্টা করেছে। এখানে আসার পর একবার মেডিক্যাল হোমে হাজিরা দেবারও ফুরসৎ মেলেনি।
কিন্তু এত করেও ধীরাপদর নিজেরই এক-এক সময় মনে হত, সোনার দাঁড়ে কাক বসানো হয়েছে। মাসে ছ-শ টাকা মাইনে নেবার মত এখানে কি তার করার আছে বা কি সে করতে পারে, নিজে থেকে ঠাওর পেয়ে উঠত না।
এই অস্বস্তিটা দিনে দিনে বাড়ছিল।
কোম্পানির কাজে না হোক, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিমাংশু মিত্রের ব্যক্তিগত কাজে কিছুটা যোগ্যতা দেখাবার সুযোগ ঘটল একদিন।
বড় সাহেবের তলবে সেদিন সকালে তাঁর বাড়ি আসতে হয়েছিল। সামনে কোম্পানীর ছোট স্টেশন-ওয়াগন দাঁড়িয়ে। ফলে যাকে আশা করেছিল ভিতরে ঢুকে তাকেও দেখল। অন্দরমহলের দিকের সেই বসার ঘরের গদি আঁটা বিশ্রামশয্যায় হিমাংশু মিত্র অর্ধশয়ান। বাহুতে ফেটি বেঁধে কানে স্টেথোসকোপ লাগিয়ে লাবণ্য সরকার গম্ভীর মুখে তাঁর ব্লাডপ্রেসার দেখছে।
হিমাংশুবাবু ইশারায় বসতে বললেন। লাবণ্যর দু চোখ যন্ত্রের দাগগুলোর ওপর। পাশেই একটা চেয়ারে ঝুঁকে বসে আছে, পাম্প করে পারা তুলছে ছেড়ে দিচ্ছে।
ধীরাপদ অঙ্গস্তিবোধ করতে লাগল কেমন। এই বাড়ির এই ঘরে এক প্রবল পুরুষের এত কাছে ওইভাবে ঝুঁকে বসাটুকুর মধ্যে, এমন কি রক্ত চাপ পরীক্ষার ওই নির্বিষ্টতার মধ্যেও কিছু যেন আছে, যা দেখলে দু চোখে তাপ লাগে। হৃৎপিণ্ড অশান্ত হয়। স্নায়ুতে স্নায়ুতে কানাকানি হতে থাকে।
পরীক্ষা করলে এই মুহূর্তে ধীরাপদরও রক্তচাপ খুব কম হত না হয়ত।
প্রেসার দেখা শেষ করে লাবণ্য ওর দিকে একবার তাকালো শুধু। চেনে কি চেনে না! হিমাংশুবাবু উঠে বসে জামার গোটানো হাতাটা টেনে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কত?
লাবণ্য ধীরেসুস্থে যন্ত্র গোটাচ্ছে, সামান্য হেসে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ ঠিক আছে। ব্লাডপ্রেসার নিয়ে মেডিক্যাল হোমের পেশেন্টদের সঙ্গে তার অনেক হালকা মন্তব্য শুনেছে ধীরাপদ। যেখানে যেমন দরকার।
হিমাংশুবাবু ধীরাপদর দিকে চেয়ে হাসলেন।—ও আবার আমাকে প্রেসার সব সময় বলে না, বললেও কমিয়ে বলে হয়ত, যদি নার্ভাস হয়ে পড়ি!
ভিতর থেকে সহজ হওয়ার তাগিদ, ধীরাপদ জিজ্ঞাসা করল, আপনার শরীর অসুস্থ নাকি?
ঝুঁকে সামনের সেন্টার টেবিল থেকে পাইপটা হাতে নিলেন হিমাংশুবাবু। বললেন, অসুস্থ হতে কতক্ষণ, পাছে অসুস্থ হয়ে পড়ি সেই ভয়ে সপ্তাহে তিন দিন করে প্রেসার চেক করা ওরা দরকার মনে করে। মৃদু হেসে লাবণ্যর ডাক্তারি গাম্ভীর্যটুকু লক্ষ্য করলেন। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন। —যে জন্যে তোমাকে ডেকেছিলাম, তোমার লেখা-টেখায় বেশ হাত আছে শুনলাম?
ধীরাপদ অবাক। বাড়িতে ডেকে পাঠানোর ফলে অনেক এলোমেলো সম্ভাবনার কথা ভেবেছে, এ প্রশ্ন কল্পনা করেনি।
যাই শুনে থাকুন, চারুদির কাছ থেকে শুনেছেন। হিমাংশুবাবুর পরের কথা থেকে তাঁর বক্তব্য বোঝা গেল। ইংরেজি বাংলা দুটো খবরের কাগজ শিল্প-বাণিজ্যের ওপর বিশেষ সংখ্যা বার করছে, এ দেশের ভেষজ-শিল্প প্রসঙ্গে লেখার জন্য তাঁর কাছে আমন্ত্রণ এসেছে। সামনের টেবিলের টাইপকরা কাগজ ক’টা এগিয়ে দিলেন তার দিকে —রচনার জন্য এই তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, আরো কিছু তথ্য লাবণ্য এবং সিতাংশু তাকে দেবে। সব নিয়ে বেশ ভেবেচিন্তে লিখতে হবে কিছু, বাংলাটা লেখা হয়ে গেলে ইংরেজি কাগজের জন্য কাউকে দিয়ে সেটা অনুবাদ করিয়ে নিলেই হবে।
আলোচনা শেষ। লাবণ্যকে নির্দেশ দিলেন, তাকে নার্সিং হোমে ছেড়ে ড্রাইভার যেন ধীরাপদকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
দোতলায় সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কেয়ার টেক বাবু বিনয়-নম্র বদনে নিজের চকচকে টাক মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। চকিত তৎপরতায় এগিয়ে এসে লাবণ্যর উদ্দেশে নিবেদন করল, অফিসঘরে ছোট সাহেব দেখা করে যেতে বলেছেন।
লাবণ্যর মুখ দেখে মনে হল, ছোট সাহেব বাড়ি আছে তাই জানত না। কিছু একটা জিজ্ঞাসা করার মুখেও থেমে গেল।
আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।— ওদিকের হলঘরে ঢুকে গেল। নিচে সিঁড়ির ওধারে সবিনয়ে মানকে দাঁড়িয়ে। আসার সময় আধখানা ঝুঁকে ভক্তি জ্ঞাপন করেছিল, এখনও তাই করল। এই কদিনের আনাগোনায় তাকে বড় সাহেবের সুনজরের লোক ঠাউরেছে, তাই ভক্তিশ্রদ্ধাও বেড়ে গেছে। ফিসফিস করে আরজি পেশ করল, কারখানায় চাপরাসীর কাজের কথাটা একটু বলে-কয়ে দেবেন বাবু। সেই যে পেথম দিন আপনার সঙ্গে কথা হল-
মনে আছে। কিন্তু বলে-কয়ে দেওয়াটা সম্ভব কিনা সেটা মানকেকে বলা না বলা সমান।
বাঁধানো উঠোনে কোম্পানীর স্টেশান ওয়াগনের পাশে হিমাংশুবাবুর লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে। বেরুবেন হয়ত। ধীরাপদ বাইরেই চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল। সপ্তাহে তিন দিন লাবণ্যের এখানে ব্লাডপ্রেসার চেক করতে আসার খবরটা জানত না।… চারুদি জানে?
মনের ওপর এই অশোভন আঁচড়টাই ফেলতে চায়নি। আপনি পড়ল। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালো, চারুদির চর নয় ও, হবেও না কোনকালে। ধীরাপদ সুস্থ বোধ করল অনেকটা, নিজের বশে এলো। দশ মিনিট অপেক্ষা করেছে, দু ঘণ্টা অপেক্ষা করতেও আপত্তি নেই।
লাবণ্য সরকার নয়, হিমাংশু মিত্র বেরিয়ে এলেন।
ড্রাইভার অভ্যস্ত তৎপরতায় লাল গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। তোমরা যাওনি এখনো? লাবণ্য কোথায়?
সিতাংশুবাবু ডেকেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কথা কইছেন…..
ঈষৎ বিস্ময়ে হিমাংশুবাবু বাড়িটার দিকে ঘুরে তাকালেন একবার, ছেলে বাড়িতেই আছে তিনিও জানতেন না বোধ হয়। ভদ্রলোকের প্রসন্ন গাম্ভীর্যে এই প্রথম বিরক্তির ছায়া লক্ষ্য করল ধীরাপদ। নিজের গাড়ির দিকে এগোলেন তিনি, উঠতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন।—তুমি থাকো কোন দিকে?
বলল।
এসো—
গাড়িতে উঠে বসলেন। বিব্রত মুখে ধীরাপদও। ড্রাইভার সশব্দে দরজা বন্ধ করল। গাড়িটা দু-পাঁচ হাত ব্যাক করে স্টেশান ওয়াগনের পাশ কাটাতে হবে।
নিচের দরজার ওপর পাশাপাশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল সিতাংশু আর লাবণ্য সরকার। হকচকিয়ে গেছে দুজনেই। হিমাংশুবাবু নির্লিপ্তমুখে তাদের দিকে একবার ফিরে তাকালেন শুধু।
গাড়ি বেরিয়ে গেল।
বড় রাস্তায় পড়তে তিনি জানালেন, ওকে চৌরঙ্গীর কাছাকাছি ছেড়ে দেবেন, সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে সে যেন বাড়ি চলে যায়। এভাবে যখন যা ট্যাক্সিভাড়া লাগে মাসকাবারে বিল করে দেয় যেন, সকলেই তাই করে।
ধীরাপদর কেমন মনে হল, ওই দুটিকে একটু জব্দ করার জন্যেই বড় সাহেব এই ব্যাপারটা করলেন। পাইপ টানছেন, বিরক্তির ছায়াটা গেছে। আগের মতই সুশ্রী গাম্ভীর্য।
একসময় বললেন, তোমার এই আর্টিকেল লেখা নিয়ে অমিতের সঙ্গেও পরামর্শ করতে পারো, দু-একটা ইন্টারেস্টিং অ্যানেকডোট হয়ত সেও বলতে পারবে।
এখানকার কাজের হদিস না পেয়ে এ পর্যন্ত ধীরাপদ অনেক দিনই অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সব সময়েই আর পাঁচটা বাজে কথা কাজের কথা ডুবে গেছে। বেশি বলতে গেলে সে বিরক্তিতে ধমকে উঠেছে, এখানে কাজ কেউ চায় না মশাই, ডোন্ট বদার— যা করতে বলে করে যান।
কিন্তু বড় সাহেবকে সেটা বলা যায় না। তিনি আবার বললেন, সে তোমাকে পছন্দ করে শুনলাম, তার সঙ্গে খাতির রেখো, হি রিকোয়ারস কম্প্যানী।
খানিকক্ষণের নীরবতায় ধীরাপদর উৎকণ্ঠা গেল, জটিলতার সূচনা নয় কিছু। চুপচাপ পাইপ টানতে লাগলেন, কিন্তু পাইপ টানার ফাঁকে ফাঁকে এক-একবার দেখছেন ওকে, কিছু ভাবছেনও হয়ত। চোখাচোখি হতে ঘুরেই বসলেন একটু, পাইপ হাতে নিলেন।—অনেক কাল আগে কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে, জিজ্ঞাসা করব ভেবেছিলাম…দেখেছি?
হঠাৎ ফাঁপরে পড়ে গেল ধীরাপদ। এ-রকম একটা প্রশ্নের জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না। জবাব দিয়ে উঠতে পারল না, বিব্রত মুখে মাথা নাড়ল শুধু। অর্থাৎ দেখেছেন।
কোথায়? ঈষৎ উৎসুক।
চারুদির শ্বশুরবাড়িতে।
জবাবটা নিজের কানেই বড় বেশি স্পষ্ট ঠেকল ধীরাপদর। মোটা ফ্রেমে আঁটা গোটা মুখে বিস্ময় আর বিড়ম্বনার ব্যঞ্জনা। হাসিমুখে ভুরু কুঁচকে সরাসরি চেয়েই রইলেন ওর দিকে। স্মরণের প্রয়াস। স্মরণ হল বোধ হয়। চারুদির শ্বশুরবাড়িতে প্রতিদ্বন্দ্বী তরুণ প্রেমিকের আনাগোনা নিয়ে দুজনের মধ্যে তখন হাসাহাসিও হত কিনা কে জানে। হিমাংশুবাবু সামনের দিকে ঘুরে বসে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন, শেষে পাইপ দাঁতে চেপে বললেন, তাহলে ধরে নেওয়া যাক, আগে আর দেখিনি।
যতই বিব্রত ভাব দেখাক, মনে মনে খুশি ধীরাপদও। ব্যাপারটা মন্দ দাঁড়াল না। ধরে যা-ই নিন, আর যত বড় সাহেবই হোন উনি, আঠারো বছর আগের অধ্যায়টি আর একেবারে বিস্মৃত হতে পারবেন বলে মনে হয় না।
নেমে যাওয়ার সময়ও তাঁর মুখের হাসির আভাসটুকু একেবারে মিলোয়নি।….. অফিসে সেদিন লাবণ্য সরকারকে বেশ একটু গম্ভীরই দেখাচ্ছিল। সকালে বড় সাহেবের বাড়িতে ওভাবে বিব্রত হওয়ার অপরাধটা যেন ধীরাপদরই। সমস্ত দিন চুপচাপ থেকে বিকেলের দিকে নিজেই ঘরে এলো। হাতে দু-তিন শিট টাইপ-করা কাগজ।
ধীরাপদ সকালের পাওয়া রচনা-সংক্রান্ত তথ্যগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল আর ভাবছিল কি-ভাবে কি লেখা যায়। লাবণ্য সরকার সামনের চেয়ারে না বসে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। হাতের কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো আপনার কাজে লাগবে কিনা দেখুন।
আপনি দিচ্ছেন যখন কাজে লাগবে জেনেই দিচ্ছেন। সহজ বিনয়ে ত্রুটি নেই ধীরাপদর, বসুন—
লাবণ্য বসল না, দুই-এক পলক চেয়ে থেকে বলল, সকালে এগুলোই ঠিকঠাক করে আনতে গিয়ে দেরি হয়েছিল, আপনি চলে গেলেন কেন?
ডাকলে না গিয়ে করি কি, কিন্তু এরই জন্যে দেরি নাকি? কণ্ঠস্বরে সহজ বিস্ময়, এই ব্যাপারে আটকে ছিলেন কি করে জানব, জানলে এড়ানো যেত—
ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায়, আর্টিকল লিখব আমি, এই ব্যাপারের জন্যে হলে তোমার বদলে আমাকেই ডাকা উচিত ছিল ছোট সাহেবটির, অথচ আমিই রইলুম বাইরে দাঁড়িয়ে!
একটুও উপলব্ধি না করার কথা নয় লাবণ্য সরকারের। আগে সামান্য কর্মচারী ভাবত যখন তখন যে-চোখে তাকাতো দৃষ্টিটা প্রায় তেমনি। নির্লিপ্ত চোখে ধৃষ্টতার বহর দেখছে যেন। নিস্পৃহ শুভার্থিনীর মত ঠাণ্ডা পরামর্শ দিল, ভালো করে লিখুন, ভালো হলে আপনারও ভালো।
বিদ্রূপ গায়ে না মেখে ধীরাপদ ফিরে আগ্রহ প্রকাশ করল, ভালোর আশা দেখি নে, বসুন না….
নিস্পৃহতায় ফাটল দেখা গেল একটু, টিপ্পনী কাটল, বসলে ভালো হবে আশা করেন?
ধীরাপদ হেসে ফেলল, খুব করি।
আসবেন তাহলে এক সময়, দেখব। কাজ আছে।
শিথিল চরণে দরজার দিকে এগোলো। এই মূর্তিতে সহকর্মিণীর থেকেও আর কিছুর জোরটুকুই যেন অনেক বেশি। নারীর প্রাধান্য বেশি। সেটুকুই দেখিয়ে গেল। যেতে যেতেও অনুসন্ধানরত চোখ দুটোকে সেই প্রাধান্য বুঝিয়ে দিচ্ছে যেন। চেয়ে থাকো, আমার জোরটা কোথায় চেয়ে চেয়ে দেখো।
ধীরাপদ চেয়ে ছিল, দেখছিল।
ছেলে সকালে লাবণ্য সরকারকে আটকে রেখেছে শোনার সঙ্গে সঙ্গে হিমাংশু মিত্রের মুখের চকিত বিরক্তি ধীরাপদর দৃষ্টি এড়ায়নি। গাড়ি ছাড়ার মুখে দোরগোড়ায় এসে লাবণ্যও সেটুকু অনুভব করেছে হয়ত। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে ধীরাপদ কল্পনা করেনি। ভাবছে। মহিলা হঠাৎ ওর ওপর এত বিরূপ কেন। ও কি করল?
যতটা সম্ভব ভালো করেই ভেষজ-রচনা সরবরাহ করল ধীরাপদ। শুধু বাংলা নয়, ইংরেজীটাও সে-ই করে দিল। হিমাংশুবাবু এতটা আশা করেননি। ফলে এরপর এ ধরনের ব্যাপার মাঝসাঝেই ঘাড়ে এসে চাপতে লাগল। এক-আধটা ভাষণ লিখে দেওয়া, ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট সভাসমিতিতে বিবৃতি পাঠানো। সেই প্রথম দিন ছাড়া সামনাসামনি আর প্রশংসা করেননি হিমাংশুবাবু। ধরেই নিয়েছেন ভালো হবে।
চারুদি সেদিন প্রশংসার ছলে একটু ব্যঙ্গই করলেন যেন। এ-কথা সে-কথার পর বললেন, তোমাদের বড় সাহেব তো খুব খুশি দেখি তোমার ওপর—
খানিক আগেও আজকাল আর বেশি আসে-টাসে না বলে বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে। অনুযোগের মুখে থেমে গিয়ে টিপ্পনী কেটেছেন চারুদি, অত সময়ই বা পাবে কি করে, কোম্পানীর কাজ, বড় সাহেবের কাজ—-ছোট সাহেব আর মেমডাক্তারের কাজও কিছু কিছু জুটছে নাকি?
ধীরাপদ পাল্টা ঠাট্টা করেছিল, এখনো জোটেনি, তবে সে জোটাতে চেষ্টা করছে বটে। বড় সাহেবের খুশি-প্রসঙ্গে হাসিমুখেই ফিরে অনুযোগ করল, ঝামেলাটি তো বাধিয়েছ—আমি লিখতে পারি এ কথা তাঁকে কে বলেছে?
আমিই বলেছি, চারুদির নিরীহ স্বীকার-উক্তি, তোমার সুবিধে-টুবিধে যদি হয়। তা ঝামেলা কিসের, বেশ তো সুনজরে এসে গেছ।
ধীরাপদ বলে ফেলল, সুনজরে আসাটা তুমি তেমন সুনজরে দেখছ বলে তো মনে হয় না।
কলে পড়ে হেসে ফেললেন চারুদি, তা কি করব, এক ধার থেকে তুমি যদি এখন বক্তৃতা আর ভাষণ লেখো বসে বসে। এই সঙ্গে সেক্রেটারীর মাইনেটাও তাহলে তোমাকে দিতে বলো!
একটু থেমে ধীরাপদ বলল, এ-সব লেখা-টেখা আর আমার দ্বারা হবে না, তাই বরং জানিয়ে দেব।
এ কথা বলবে নাকি তাঁকে? চারুদির গলায় শঙ্কার রেশ।
ধীরাপদ ঘাড় নাড়ল, বলবে। জানালো, লিখতে তো আর সত্যিই পারে না, রীতিমত পরিশ্রম হয়, আর কাজেরও ক্ষতি।
চারুদি বিব্রত বোধ করছেন বোঝা গেল। বিদ্রূপ প্রত্যাহারের চেষ্টা।— গোঁয়ারতুমি করে কাজ নেই, পরিশ্রম গোড়ায় গোড়ায় করতেই হয়। কিছু বলতে হলে অমিতের সঙ্গে কথা কয়ে নিও, সে-ই বলছিল…
অর্থাৎ আগের ওই অভিযোগ চারুদির নয়, অমিতাভর। ধীরাপদ ধাক্কা খেল একটু, কিছুদিন যাবৎ অমিতাভ ঘোষ ওর ঘরে আর আড্ডা দিতে আসছে না বা টেলিফোনে ডাকছে না মনে পড়ল। অথচ ধীরাপদ যাহোক করে তাকে ধরে-বেঁধে কাজের আলোচনায় বসবে স্থির করেছিল। এই কোম্পানীতে কাজ কিছু করার ইচ্ছে থাকলে সাহায্য একমাত্র সে-ই করতে পারে।
চারুদির বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে ছোট যোগাযোগ একটা। ফলটা সুবাঞ্ছিত মনে হল ধীরাপদর।
বাইরের ঘরের বইএর আলমারির পাশে ছোট টেবিলটার কাছে পার্বতী দাঁড়িয়ে। তার কানে টেলিফোন। কথা বলছে না, চুপচাপ কথা শুনছে।
এক নজরে মুখের ঋজু, গাম্ভীর্যটুকু লক্ষ্য করেই ধীরাপদ অনুমান করেছে, কার কথা। পায়ের শব্দে পার্বতী ফিরে তাকালো। রিসিভারে একটা হাত চাপা দিয়ে মৃদু অথচ স্পষ্ট অনুরোধ করল, একটু দাঁড়াবেন। রিসিভার মুখের কাছে এনে শুধু বলল, ছেড়ে দিচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখল রিসিভারটা।
ধীরাপদর মনে হল অপর প্রান্তে যে আছে, এভাবে বিচ্ছিন্ন হবার জনো তার প্রস্তুত থাকার কথা নয়। একেবারে গদ্যাকারের সমাপ্তি। সামনাসামনি তার সঙ্গে এই প্রথম কথা বলল পার্বতী। টেলিফোন রেখে নীরবে একবার চোখ তুলে তাকালো শুধু, তারপর ভিতরে ঢুকে গেল।
দু-দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এলো। হাতে ক্যামেরা।
অমিতাভ ঘোষের সেই ক্যামেরা।
এটা দিয়ে দেবেন—
কাকে দিতে হবে বলল না, জানাই আছে যেন। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ধাঁরাপদ জিজ্ঞাসা করল, অমিতবাবু বাড়িতেই আছেন এখন?
ঘাড় নাড়ল। তারপর মৃদু গলায় জানালো, কাল অফিসে দিলেও হবে।
কাল নয়, অফিসেও নয়, চারুদির বাড়ি থেকে ধীরাপদ সরাসরি হিমাংশু মিত্রের বাড়িতে উপস্থিত। আসার উপলক্ষ্য যোগানোর জন্যে পার্বতীর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু নিজের উদ্দেশ্য ভুলে থেকে ওই মেয়েটার কথাই ভেবেছে। ওকে দেখলেই আকাশের একরাশ মেঘের কথা মনে হয় ধীরাপদর। যে-মেঘ ত্রাসের কারণ সেই মেঘ নয়, যে মেঘ আশ্বাস যোগায় সেই মেঘ। আর ভেবেছে, ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়ে বার বার এভাবে ফেলেই বা আসে কেন অমিতাভ ঘোষ?
মানকে জানালো, ভাগ্নেবাবু খানিক আগে গাড়ি নিয়ে বেরুলেন, বোধ হয় খেতেটেতে গেছেন, এক্ষুনি ফিরবেন মনে হয়, ঘর খোলা।
অর্থাৎ শীগগির ফেরার সম্ভাবনা না থাকলে ঘর তালা বন্ধ থাকত। ধীরাপদ বলল, তাঁর ঘরেই তাহলে বসি একটু—
অমিতাভ ঘোষ নিচে থাকে জানত না। সিঁড়ির ডান দিকের বড় হল পেরিয়ে তার ঘর। দরজা দুটো ভেজানো ছিল, মানকে খুলে দিল।
অগোছালো ঘর। কোণের টেবিলে একপাঁজা বিলিতি ডিটেকটিভ বই। টেবিলের পিছনের তাকে কতকগুলো বিজ্ঞানের বই আর একটা ফোটো অ্যালবাম। ধীরাপদ চেয়ার টেনে বসল।
সামনের অবিন্যস্ত শয্যার ওপরেও আর একখানা অ্যালবাম। ঘরটা ওকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখে মানকে নিজের দোষ-ক্ষালনের চেষ্টা করল তাড়াতাড়ি। বলল, ভাগ্নেবাবুর ঘর বারো মাসই এমনি থাকে – মেজাজ ভালো না থাকলে যে পরিষ্কার করতে আসবে তাকে ঝেটিয়ে তাড়াবেন।
হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে অ্যালবামটা তুলে নিল ধীরাপদ। কিন্তু খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করতে হল আবার। না, মানকে লক্ষ্য করেনি, ভাগ্নেবাবুর মেজাজের কথা সবে শেষ করেছে।
চাঞ্চল্য গোপন করে ধারাপদ বলল, তোমার কাজ থাকে তো যাও না, আমি বসছি।
তার দিকে চেয়ে মানকে বুঝে নিল গল্প জমবে না। বলল, হ্যাঁ যাই, সন্ধ্যেনিদ্রার পর কেয়ার-টেক বাবু হাতের কাছে খাবারটি না দেখলে আবার তো আমাকেই ধরে চটকাবেন। দরকার হলে বেল টিপবেন—
মানকে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালবাম খুলে বসল। পর পর লাবণ্য সরকারের ছবি কতগুলো। লাবণ্যের এ মূর্তি ধীরাপদ দেখেনি। হাসি-খুশি-আনন্দ-ভরা ছবি। এই লাবণ্য পদস্থ কর্মচারী নয়, বচন-কুশলিনী ডাক্তারও নয়। এই লাবণ্য একটি মেয়ে শুধু, ভর-ভরতি মেয়ে।
আবারও থামতে হল এক জায়গায়। চকিতে দরজার দিকে তাকালো একবার।
…লাবণ্যর ছবি শেষ হয়েছে। এবারে পার্বতীর ছবি। গোটা অ্যালবামের চার ভাগের তিন ভাগই তাই।
কানের কাছটা গরম ঠেকছে ধীরাপদর। আর দেখা উচিত নয় ভাবছে, অথচ পাতা না উল্টেও পারছে না। দেখার অননুভূত আকর্ষণ একটা, অজ্ঞাত তাগিদ। নানা ছাঁদে বন্দিনী ধীর গম্ভীর একখানি পার্বত্য যৌবন! কোনো কোনো ছবিতে রোদ-দাগানো মেঘের মত গাম্ভীর্যের ফাটলে ঈষৎ হাসির আভাস, প্রশ্রয়ের আভাস। কোনোটিতে নির্বিকার যৌবনের প্রসারিত দাক্ষিণ্য শুধু। বেশির ভাগ ছবির পরিচ্ছদ-স্বল্পতা চোখে বেঁধার মত, আবার গোপন তৃপ্তিতে চেয়ে চেয়ে দেখার মতও। শেষের ক’টা সমুদ্র-বেলায় আঁট কস্টিউম পরা—কোনোটায় স্নান সেরে উঠে আসছে, কোনোটায় স্নানে নামছে।
অ্যালবাম যথাস্থানে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধীরাপদ। অস্বাচ্ছন্দ্য একটা, অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। বুকের কাছটা ধকধক করছে, কান দুটো গরম ঠেকছে আরো, ঠোঁট শুকনো, খরখরে জিব।
অদূরে প্যাঁ-ক করে একটা শব্দ হতে ধীরাপদ নিজেই চমকে উঠলো। বেল সে-ই টিপেছে। দরজার বোতাম টিপে মানকেকে ডেকেছে। মানকে আসার আগে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা দুটো ভেজিয়ে দিল।
আর বসব না, যাই এখন। এলে বোলো ক্যামেরাটা রেখে গেলাম।
মানকেকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ধীরাপদ চোরের মত বাড়ি থেকে বেরিয়ে
একেবারে বড় রাস্তায় এসে থামল।